এসএসসি(ভোকেশনাল) - ফ্রুট এন্ড ভেজিটেবল কাল্টিভেশন-২ - প্রথম পত্র (নবম শ্রেণি) | NCTB BOOK

আমের চাষ

আম বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ও উপাদেয় ফল । আমকে ফলের রাজা বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে । বাংলাদেশে প্রায় সব জেলাতেই আমের চাষ হয় । কিন্তু উৎকৃষ্ট মানের আম উৎপাদান প্রধানত উত্তর পশ্চিমের জেলাগুলোতে হয়ে থাকে । যেমন- বৃহত্তর রাজশাহী, দিনাজপুর ও কুষ্টিয়া । বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৫ হাজার হেক্টর জমিতে আমের চাষ হয় এবং মোট উৎপাদন ১ লাখ ৯০ হাজার টন ।

জমি ও মাটি নির্বাচন

যে কোন ধরনের মাটিতেই আমের চাষ করা যায় । গভীর, সুনিষ্কাশিত, উর্বর দোয়াশ মাটি আম চাষের জন্য উত্তম । উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি আম চাষের জন্য নির্বাচন করতে হয় । তবে সুনিষ্কাশিত ২.৫-৩.০ মিটার নিচু পানিতল বিশিষ্ট, সামান্য অম্লীয়, উর্বর দোঁআশ মাটি আম চাষের জন্য সর্বোত্তম । অত্যধিক বেলে ও কাদামাটি এবং ক্ষারীয় মাটি আম চাষের জন্য অনুপযুক্ত । আম গাছ যথেষ্ট মাত্রায় জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। সব সময় সাতসেঁতে থাকে এরূপ মাটিতে আম ভালো হয় না। জলাবদ মাটিতে গাছের বৃদ্ধি, ফুল ও ফল ধারণ ব্যহত হয় । ৫.৫-৭.৫ অম্লমান (অর্থাৎ পিএইচ) সম্পন্ন মাটিতে আম ভালো হয় । এঁটেল মাটিতে পানি নিষ্কাশনের ভালো ব্যবস্থা থাকলেও আম চাষ করা যায় । প্রচুর সূর্যের আলো পড়ে, খোলামেলা এমন উঁচু জমি আম চাষের জন্য নির্বাচন করতে হবে। শীতকালে প্রয়োজনে সেচ প্রদান করা যায় এমন ব্যবস্থা রাখতে হবে। আবার বর্ষাকালে জমিতে যাতে পানি না দাঁড়াতে পারে সে জন্য পানি নিকাশের নালা থাকতে হবে ।

জমি ও গর্ত তৈরি

বাগান আকারে আমের চাষ করতে হলে এপ্রিল-মে মাসে কয়েক পশলা বৃষ্টি হলে প্রথমেই নির্বাচিত জমি লাঙ্গল দ্বারা ৩ থেকে ৪ বার গভীরভাবে চাষ দিয়ে কর্ষণ করে নিতে হবে । আচড়ার সাহায্যে আগাছা পরিস্কার করে মই দ্বারা ঢেলা ভেঙে জমি সমতল করে নিতে হবে এবং জমিতে যেন পানি না দাঁড়ায় তার জন্য যথাযথ সেচনালা তৈরি করতে হবে । বাগান আকারে গাছ লাগাতে হলে ষড়ভুজ বা বর্গাকার অনুসারে নকশা তৈরি করলে ভালো হয় । কলমের চারা হলে দুরত্ব কম দিতে হবে এবং বীজের চারা হলে দূরত্ব বেশি দিতে হবে । আর্দ্র এলাকার উর্বর পলিমাটিতে বড় জাতের গাছ ১২ মি. ×১২ মি. দূরত্বে লাগাতে হবে। শুষ্ক এলাকার উর্বর পলি মাটিতে ৯মি.×৯মি. অথবা ১০.৫ মি.×১০.৫ মি. দূরত্ব রাখা ভালো। তবে বেঁটে জাতের ক্ষেত্রে অনেক সময় দূরত্ব আরো কমানো যেতে পারে ।

সার প্রয়োগ

চারা রোপণের পূর্বে তৈরি গর্ত ভরাট করার সময় মাটির সাথে প্রতি গর্তে নিম্নোক্ত পরিমাণ সার মিশিয়ে দিতে হবে । গর্তের মাটির সাথে সার মিশানোর সময় রাসায়নিক সার গর্তের উপরের মাটির সাথে মিশিয়ে গর্ভের নিচে এবং জৈব সার গর্ভের নিচের মাটির সাথে মিশিয়ে গর্তের উপরের অংশে দিয়ে গর্ত ভরাট করতে হবে ।

সারের পরিমাণ

সারের নাম

প্রতি গর্তে সারের পরিমাণ

জৈব সার

১৮-২২ কেজি

ইউরিয়া

১০০-২০০ গ্রাম

টিএসপি

৪৫০-৫৫০ গ্রাম

এমপি

২০০-৩০০ গ্রাম

জিপসাম

২০০-৩০০ গ্রাম

জিংক সালফেট

৪০-৬০ গ্রাম

সম্ভব হলে গর্ত প্রতি ২ কেজি পচা নিমের খৈল দিতে হবে । সার মিশানোর অন্তত ১০ দিন পর চারা রোপন করা ভালো । গর্তের মাটি শুকনা থাকলে চারা রোপনের পূর্বে অর্থাৎ সার মিশানোর পরই পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিতে হবে ।

চারা রোপণ ও পরবর্তী পরিচর্যা

বর্ষার সময় অর্থাৎ মে - জুন মাসে চারা রোপন করা উত্তম । তবে অতিরিক্ত বৃষ্টি বা বর্ষার সময় চারা রোপণ না করাই ভালো । মেঘাচ্ছন্ন দিনে বিকালে চারা রোপণ করা সবচেয়ে ভালো । চারা রোপণের জন্য তৈরি গর্তের ঠিক মাঝখানে চারটি খাড়াভাবে বসায়ে গোড়ার চারপাশের মাটি সামান্য চেপে দিতে হবে । চারা রোপণের পর পরই হালকা সেচ দিতে হবে ।

চারায় অতিরিক্ত পাতা থাকলে কিছু পাতা কেটে দেয়া ভালো । এতে গাছ সবল হয় এবং আকৃতিও সুন্দর হতে পারে । রোপণের পর বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বুঝে ২-৩ সপ্তাহ প্রতি দিন বা একদিন পর পর ১ বার করে বিকেলে পানি সেচ দিলে ভালো হয় । চারা সবল বা দুর্বল যাই হউক রোপণের পর বাঁশের খুঁটি দিয়ে বেঁধে দিতে হবে । আম বাগান আগাছা মুক্ত রাখতে হবে। এ জন্য মাঝে মাঝে জমি চাষ করা ভালো। চারা রোপণের পর পরবর্তীতে বৃষ্টি না হলে প্রথম ৮ মাস বা দেড় বছর পর্যন্ত শুকনো মৌসুমে ৭ দিন পর পর সেচ দিতে হবে । এরপর ৫ বছর পর্যন্ত ১৪/১৫ দিন পর পর সেচ দিতে হবে । কলমের চারা রোপণের বছরই মুকুল দিতে পারে । তবে প্রথম বছর মুকুল জন্মালে তা ভেঙে দিতে হবে । কেননা মুকুল গুলো ভেঙে না দিলে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং গাছের কাঠামো শক্ত হতে পারে । গাছের বৃদ্ধির জন্য ৩-৪ বছর পর্যন্ত মুকুল ভেঙে দেয়া উচিত । গাছ যাতে ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারে সে জন্য সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন ।

সারণি -১ বিভিন্ন বয়সে আমের গাছ প্রতি সার প্রয়োগের পরিমাণ সারের নাম

গাছ রোপণের বছর ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া সমান দুই ভাগ করে একভাগে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে অর্থাৎ বর্ষার শুরুতে একভাগ অশ্বিণে অর্থাৎ বর্ষার শেষে গাছের চারদিকে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে । গাছ গুলো বৃদ্ধির সাথে সাথে জৈব রাসায়নিক সারের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে যা সারণি-১ এ দেখানো হলো । উলেখিত সার দুই কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে । প্রথম কিস্তিতে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে এবং দ্বিতীয় কিস্তিতে আশ্বিন মাসের দিকে প্রয়োগ করতে হবে । মাটিতে যথেষ্ট রস না থাকলে সার দেওয়ার পর সেচ দিতে হবে । ছোট গাছের গোড়া থেকে ৪০-৫০ সে.মি., মাঝারি বয়সী গাছে গোড়া থেকে ২-৩ মি. দূরে এবং বড় গাছের বেলায় দুই গাছের মধ্যবর্তী স্থানে সার প্রয়োগ করতে হবে । গাছ বড় হয়ে গেলে মধ্যবর্তী স্থানে সার প্রয়োগ করে টিলার (Power tiller) দিয়ে চাষ দিয়ে মাটির সাথে সার মিশিয়ে দিতে হবে । জিপসাম ও জিংকসালফেট প্রতি বছর না দিয়ে এক বছর পর পর প্রয়োগ করা ভাল ।

মাধ্যমিক পরিচর্যা

আম বাগানে সাধারণত প্রতি বছর দুবার চাষ দেয়া দরকার। প্রথম বার জ্যৈষ্ঠ আষাঢ় মাসে এবং দ্বিতীয় বার আশ্বিন কার্তিক মাসে । গাছের গোড়ার দিকে ১ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত কাণ্ডের মধ্যে ডালপালা রাখা উচিত নয় । প্রধান কাণ্ডের ১ মিটার উপরে চারপাশে গজানো ৪/৫ টি মজবুত ডাল রেখে বাকীগুলো কেটে দিতে হবে। ফল পাড়ার সময় যে সকল মুকুল দণ্ডে আম থাকে সেগুলো ভেঙ্গে দিতে হবে । আম পাড়ার পর মরা, রোগাক্রান্ত ও অপ্রয়োজনীয় ডালা ছেটে দিতে হয় । ইহা গাছের বৃদ্ধির সহায়ক হয় । গাছের ভিতর যেগুলো ফল দেয় না অথচ ছায়াময় ও ঝাপালো হয় সেগুলো কেটে দিলে ভালো হয় । কেননা এগুলো পোকা মাকড়ের আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে।

সেচ

গাছে মুকুল হওয়ার আগে সেচ দিলে বা বৃষ্টিপাতে গাছের মারাত্মক ক্ষতি হয় । কেননা সেক্ষেত্রে মুকুল না হয়ে নতুন পাতা গজাতে পারে । নতুন পাতা গজালে সে মৌসুমে আর মুকুল হবে না । আমের গুটি মটরদানার মত হলে ১০-১৫ দিন পর পর ৩-৪ বার সেচ দিলে গুটি ঝরা বন্ধ হয় এবং আমের আকার বড় হয় । আম গাছে সেচ দেয়ার ইহাই উত্তম সময় । ঐ সময় বৃষ্টি হলে সেচ দেয়ার প্রয়াজন নেই ।

পোকা ও রোগ বালাই দমন

আম বা আম গাছ নানা ধরনের পোকা মাকড় ও রোগবালাই দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে । এক এক অঞ্চলে এক এক রকমের ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ লক্ষ করা যায় । আমের বিভিন্ন কিটপতঙ্গের মধ্যে ১। পাতা ও ফল শোষক (Mango-hopper) (২) কাণ্ডের মাজরা পোকা (৩) ডগার মাজরা পোকা (৪) ফলের মাছি পোকা (৫) ফলের ভোমর পোকা এবং (৬) পাতার বিছা পোকা (Mango defoliator) বিশেষ ভাবে উল্লেখ যোগ্য ।

পাতা ও ফল শোষক (Mango hopper): 

এই পোকা গ্রীষ্ম মৌসুমে এবং ফুলের ঋতুতে অধিক সংখ্যক দেখা যায় । এদের বাচ্চা ও পূর্ণবয়স্ক পোকা ফুলের মঞ্জুরীর রস চুষে পান করে । তাতে ফুল ও ছোট ফল ঝরে পড়ে । মুকুলেও রস চোষার সাথে সাথে এ পোকা মলদ্বার দিয়ে প্রচুর পরিমাণ আঁঠালো মধুরস ত্যাগ করে যা মুকুল ও ফল গাছের গাছের পাতায় আটকে যায় । এই আঁঠালো পদার্থে ফুলের পরাগ রেণু আটকে গিয়ে ফুলের পরাগায়ণ

ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত করে। পাতা ও ফুল আটকানো মধু রসে Shooty mould fungus (শুটি মোল্ড) জন্মায় এবং ফুল ও পাতা কাল বর্ণ ধারণ করে । ফলে সালাকে সংশেষণ প্রক্রিয়া ব্যহত হয় । এতে আমের ফুল ঝরে পড়ে আমের উৎপাদন ১০০ ভাগ পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে। জানুয়ারির শুরুতে এবং গাছের পুষ্পিত অবস্থায় অর্থাৎ আম গাছে মুকুল আসার ১০ দিনের মধ্যে একবার এবং এর একমাস পর আর একবার প্রতিলিটার পানির সাথে এক মি:লি: সাইপারমেথ্রিন (রিপকর্ড / ফিনম / বাসাথ্রিন) ১০ ইসি অথবা ডেসিস ২.৫ ইসি অথবা ০.৫ মি.লি. সুমিসাইডিন ২০ ইসি মিশিয়ে আম গাছের কাণ্ড, ডাল, পাতা, ও মুকুল ভালো ভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করলে আমের পাতা ও ফল শোষক পোকা অর্থাৎ আমের হপার দমন করা যায়।

কাণ্ডের মাজরা পোকা

এ পোকার কীড়া কাণ্ড ছিদ্র করে ভিতরে ঢুকে নরম অংশ খেতে থাকে। এতে আক্রান্ত কাণ্ডের উপরের অংশ মারা যেতে পারে । আক্রান্ত শাখা সহজেই ভেঙে যায় । বাঁকানো তার দিয়ে গর্ত থেকে পোকা বের করে মারতে হবে অথবা গর্তে বাইড্রিন/ লোসিড কিংবা আলকাতরা ঢুকিয়ে কাদা দিয়ে গর্তের মুখ বন্ধ করে দিতে হবে ।

ফলের ভোমরা পোকা: উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় এ পোকার আক্রমণ বেশি হয় । কোন কোন সময় প্রায় সমগ্র ফলই আক্রান্ত; হয় ও খাওয়ার অযোগ্য হয়ে পড়ে। স্ত্রী পোকা ফলের গায়ে ছিদ্র করে তাতে ডিম পাড়ে। ছিদ্রের ক্ষতর শুকিয়ে যাওয়ার পর ছিদ্র চেনা যায় না। এ পোকা দমনের জন্য বাগান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। প্রতি লিটার পানিতে ২ মি.লি. ডায়াজিনন ৫০ ইসি অথবা ৬০ ইসি বা লিবাসিড ৫০ ইসি মার্চের মাঝামাঝি সময় কাণ্ড ও ডালের বাকলে স্প্রে করতে হয় ।

আমের রোগ: 

নিম্নে আমের প্রধান প্রধান রোগের নাম উল্লেখ করা হলো। আমের রোগের মধ্যে ১। ফোস্কা পড়া রোগ ২) পাউডারী মিলডিউ ৩) সুটি মোল্ড ৪) বাকটিপ প্রধান।

ফোস্কা পড়া বা অ্যানথ্রাকনোজ

রোগের আক্রমণে পাতা, কাণ্ড, ফুল ও ফল প্রভৃতির উপর বাদামি বা ধূসর বাদামি ফোস্কা পড়ে । এতে ফুল ও গুটি ঝরে যায় এবং ফলের উপর কালো দাগ পড়ায় তার বাজার মূল্য কমে যায় । ফেব্রুয়ারি- এপ্রিল মাসে ২-৩ বার বোর্দো মিশ্রণ (৬:৬:১০০) দ্বারা গাছকে ভালোভাবে ভিজিয়ে দিয়ে এ রোগ দমন করা যায় ।

পাউডারি মিলডিউ

এর আক্রমণে পুষ্প মঞ্জুরী ও শাখা প্রশাখার উপর সাদা গুড়ার মত ছত্রাকের স্পোর বা বীজকণা দেখা যায় । এর ফলে ফুল ও গুটি শুকিয়ে ঝরে পড়ে। ফুল ফোটার পূর্বে, ফুল ফোটার পর ও ফল ধরার পর প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মি.লি. টিল্ট বা ২ গ্রাম থিওভিট মিশিয়ে গাছে প্রয়োগ করে এ রোগ দমন করা যায়। এ ছাড়া আমের অন্যান্য রোগ গুলো হলো: ডগামরা, রেডরাস্ট, কালদাগ, পিংক রোগ, ফল পঁচা রোগ ইত্যাদি ।

ফল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ

সাধারণত ফেব্রুয়ারি মার্চ মাসে আম গাছে ফুল আসে। ফুল হওয়ার পর থেকে আম পরিপক্ক হতে ৪-৫ মাস সময় লাগে । পাকার লক্ষণ দেখে গাছ হতে আম পাড়তে হয় । যেমন- বোটার নিচের অংশ হলুদাভ রং ধারন, আমের চামড়ার রং হালকা সবুজ হওয়া, আমের বোটা ভাঙলে কষ বিন্দু বিন্দু আকারে জমা হওয়া । আম গাছের সবগুলো ফল এক সাথে পরিপক্ব হয় না। বাগানের আম এবং বাড়ি হতে দুরবর্তী স্থানে অবস্থিত গাছের আম একসাথে পাড়তে হয়। গাছ ঝাঁকি দিয়ে আম পাড়া উচিত নয়। কেননা তাতে আম আঘাত প্রাপ্ত হয়ে তাড়াতাড়ি পঁচে যায় । তাই যতদূর সম্ভব হাত দিয়ে আম পাড়া উত্তম । উঁচু ডালের আম পাড়তে হলে হালকা, শক্ত ও সাজা ২-৬ মিটার বাঁশের সরু দণ্ড নিতে হয়। বাঁশের সরু দণ্ডের মাথায় একটি চাকের সাথে দড়ির তৈরি  জালি বাঁধতে হবে । বাঁশের সরু দণ্ডের মাথায় একটি চাকের সাথে দড়ির তৈরি জালি বাঁধতে হবে। এরপর জালির চাকের মধ্যে বাধায়ে আমের বোটায় টান দিলে জালে আম আটকাবে। আম পাড়ার পর ছোট, মাঝারি ও বড় আলাদা করে বাছাই করতে হবে। বাঁশের ঝুড়িতে আম পাতা বিছায়ে সারি করে আম সাজিয়ে দূরে অক্ষত ভাবে নেয়া যায় । তবে আমের প্রতি স্তরে পাতা দিতে হবে ।

ফল সংরক্ষণ

সাধারণত বেশিরভাগ আম পাকার পর ৭ দিন রাখা যায়। পরিপক্ক আম পেড়ে শক্ত ও সবুজ অবস্থায় বাঁশের ঝুড়ি বা বাস্কেটে ভালভাবে প্যাকিং করে ৭০- ৯° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এবং ৮৫-৯০ শতাংশ আপেক্ষিক আর্দ্রতায় ৪-৭ সপ্তাহ ভালোভাবে রাখা যায় । পরিপক্ক আম তরল মামের আবরন দিয়ে ঠান্ডা ঘরে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশিদিন রাখা যেতে পারে । কাঁচা আম হতে আবার আমসি, আমসত্ত্ব, আঁচার, কাসুন্দি, ইত্যাদি খাদ্য তৈরি করে সংরক্ষণ করা যায় । পাকা আম থেকে জ্যাম, ফুট জুস, ফুট সিরাপ, জেলি, আমসত্ত্ব, প্রভৃতি প্রস্তুত করা যায়। শাঁসযুক্ত পাকা আম বাতেল বা টিনে সিরাপের মধ্যে সংরক্ষিত করা যায়। ৫০°-৫২° সে. তাপমাত্রায় গরম পানিতে ১০ মিনিট ভিজিয়ে রেখে পরে তুলে রাখলে বেশি দিন আম সংরক্ষন করা যায় ।

কাঁঠালের চাষ

কাঁঠাল পৃথিবীর বৃহত্তম ফল এবং এটি আমাদের জাতীয় ফল । সাধারন মানুষের অত্যন্ত প্রিয় ফল । কাঁঠালকে গরিবের খাদ্য বলা হয় । কেননা এত বেশি পুষ্টি উপাদান আর কোন ফলে পাওয়া যায় না। কাঁঠাল পাকা ও কাঁচাউভয় অবস্থায় খাওয়া যায় । আঁঠাল এমন একটি ফল যার প্রত্যেকটি অংশ ব্যবহৃত হয়। কাঁচা কাঁঠাল সবজি হিসেবে ব্যবহার হয় । কাঁঠাল গাছ বহুবর্ষজীবী চিরহরিৎ বৃক্ষ। এ গাছ ১০-১৫ মি. উঁচু হয়ে থাকে। স্ত্রী ফুল ও পুরুষ ফুল একই গাছে পৃথক পৃথক ভাবে ধরে। কাঁঠালের ফল বহু ফলের সমষ্টি এবং সরোসিস নামে পরিচিত। একটি কাঁঠালের মধ্যে অনেক কোয়া থাকে । প্রত্যেকটি কোয়াই একটি ফল। কাঁঠাল গাছের পাতা, কাণ্ড, ফল, বীজ সব কিছুই মূল্যবান এবং বহুলভাবে ব্যবহৃত হয় ।

মাটি ও জমি নির্বাচন

প্রায় সব ধরনের মাটিতেই কাঁঠালের চাষ করা যায় । পানি দাঁড়ায় না এমন উঁচু ও মাঝারি উঁচু সুনিষ্কাশিত উর্বর জমি কাঁঠালের জন্য উপযোগী। দোঁয়াশ, বেলে দোঁয়াশ, এটেল ও কাকুরে মাটিতেও এর চাষ করা যায়। এটেল দোয়াশ মাটি কাঁঠাল চাষের জন্য সবচেয়ে উত্তম । তবে গভীর সুনিষ্কাশিত পলি দোয়াশ মাটিতে কাঁঠালের ফলন গুলো হয় । কাঁঠাল গাছ বেশি ক্ষার বা অম্ল পছন্দ করে না । তবে সামান্য অম্ল লাল মাটিতে কাঁঠাল ভালবদ্ধতার ব্যাপারে অত্যন্ত সংবেদনশীল। গাছের গোড়ায় কয়েকদিন দাড়ানো পানি থাকলে গাছ মারা যায় । এইজন্য যে সব স্থান ব্যাকালে বন্যার পানিতে পাবিত হওয়ার সম্ভাবনা বিদ্যমান সেখানে কাঁঠাল গাছ লাগানো উচিত নয় । মাটি বেশি গভীর হলে কাঁঠাল গাছের জন্য ভাল। কেননা এর শিকড় মাটির খুব গভীরে যায়। গাছের শিকড় মাটির নিচে পানির তলের সংস্পর্শে এলে গাছ মারা যেতে পারে। এমন কি বাঁচলেও সহজে ফল ধরতে চায় না । ভূ-গর্ভস্থ মাটির নিচে পানির তল ২ মি: মিটারের বেশি নিচে হলে ভাল । সারা দিন আলো পায় এমন উঁচু জমি কাঁঠালের পছন্দনীয় তবে আংশিক ছায়া তলেও চাষ করা যায় ।

গাছ জমি ও গর্ত তৈরি

আগাছা পরিষ্কার করে গভীর ভাবে কর্ষন করে কয়েকটি চাষ দিয়ে ভালোভাবে জমি তৈরি করতে হবে। চারা লাগানোর পূর্বে জমিতে নালা কেটে পানি নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। চারা লাগানোর জন্য বর্গাকার ও ষড়ভূজ রোপণ পদ্ধতি অনুসরণ করে রোপণের ১০ দিন পূর্বে ১২ মি. দূরে দূরে ১ মিটার দৈর্ঘ্য ১ মিটার গভীর ও ১ মিটার প্রস্থ গর্ত তৈরি করতে হবে। গর্তের উপরের দুই-তৃতীয়াংশে মাটি আলাদা রাখতে হবে। উপরের এই দুই-তৃতীয়াংশে মাটির সাথে জৈব সার মিশিয়ে গর্ভের নিচের দিক এবং গর্ভের নিচের অংশের মাটির সাথে রাসায়নিক সার নিম্নোক্ত হকে দেখানো পরিমাণ মিশিয়ে গর্তের উপরের দিক ভরাট করে ১০-১৫ দিন রাখতে হবে । মাটি শুকনা থাকলে প্রয়োজনে পানি দিয়ে পর্বের মাটি ভিজিয়ে দিতে হবে। তবে গর্ভের নিচের অংশের মাটির সাথে রাসায়নিক সার মিশিয়ে মাটির মধ্যে হালকা কোপ দিয়ে ৫০০ গ্রাম টিএসপি ও ২৫০ গ্রাম এম পি সার মিশিয়ে দিতে হবে। এর ১০-১৫ দিন পর চারা রোপণ করতে হবে।

সারের নাম

প্রতি গর্তে সারের পরিমাণ

গোবর/কম্পোস্ট

২৫-৩৫ কেজি

টিএসপি

১৯০-২১০ গ্রাম

এমপি

১৯০-২১০ গ্রাম

সার প্রয়োগ

বড় কাঁঠাল গাছে সার দেওয়ার প্রচলন কম । তবে সঠিক পরিমাণে সার দিলে ফলন ভালো হয় । বিভিন্ন বয়সের গাছে সার প্রয়োগের পরিমাণ নিচের সারণিতে দেখানো হলো। সারণি ও বিভিন্ন বয়সে গাছে বিভিন্ন সার প্ররোপের পরিমাণ

সার৫ বছর পর্যন্ত৬-১০ বছর পর্যন্ত১০ বছরের উর্ধ্বে
গোবর (কেজি)১০-১৫১৫-২০২০-৩০
ইউরিয়া (গ্রাম)২৫০৫০০১০০০
টিএসপি (গ্রাম)২৫০৫০০১০০০
এমপি২৫০৫০০১০০০

সম্পূর্ণ গোবর সার ও টি এসপি সার এবং অর্ধেক ইউরিয়া ও এমপি সার বর্ষার শুরুতে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে গোড়া থেকে অন্তত ৫০ সে:মি: দূরত্বে গাছের চারিদকে ছিটিয়ে মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে । বাকি অর্ধেক ইউরিয়া ও এমপি সার বর্ষার শেষে ভাদ্র আশ্বিন একইভাবে প্রয়োগ করতে হবে। সার ডিবলিং পদ্ধতিতে ও প্রয়োগ করা যেতে পারে। গাছের বয়স যতই বাড়বে গাছের গোড়া হতে সার দেয়ার দূরত্ব ততই বাড়াতে হবে । ২০-২৫ বছরের পূর্ণ বয়স্ক কাঁঠালের বাগানে দুটো সারির মাঝখান দিয়ে সার ছিটিয়ে চাষ দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়াই উত্তম। তবে মাটিতে তেমন রস না থাকলে সার প্রয়োগের পর সেচ দিতে হবে । যেন কোন অবস্থাতেই জলাবদ্ধতা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে ।

রোপন পরবর্তী পরিচর্যা

কাঁঠালের বাগান আগাছামুক্ত রাখতে হবে। গাছের গোড়া বছরে দুবার পরিষ্কার করা ভালো । চারা লাগানোর পর ৩-৪ বছর পর্যন্ত গোড়া পরিষ্কার করে গোড়ায় হালকা মাটি দিয়ে চেপে দিতে হবে। সেপ্টেম্বর মাসে একবার এবং এপ্রিল মাসে একবার এ ব্যবস্থা অনুশীলন করা ভালো । চারার গোড়া হতে ২-৩ মি: বাড়ার পর মাথা কেটে দেয়া যায়। এরপর মাথার চারদিকে ডাল বের হলে তা রেখে দিতে হবে। শুকনো রোগাক্রান্ত এবং নিচের দিকে ঝুলে থাকা ডাল ছেটে দিতে হবে । ফল পাড়ার কিছুদিন পর কাণ্ড সমান করে বোঁটা কেটে ফেলতে হবে । গাছের ভেতরের দিকের ছোট ছোট শাখা প্রশাখা ছেটে দিলে আলো বাতাস সহজে ঢুকতে পারবে এবং গাছ তাড়াতাড়ি বৃদ্ধি পাবে। তবে ডাল ছাটার পর রোগ ও পোকা মাকড়ের আক্রমণ ঠেকাতে বোর্দোমিক্সার বা ডায়থেন এম-৪৫ ঔষধ প্রয়োগ করা উচিত । সাধারণত ৭-৮ বৎসরের গাছে ফল ধরে, গাছ বয়স্ক হলে গুড়িতে ও পরে গোড়ার দিকে ফল ধরে। ডিসেম্বর হতে ফেব্রুয়ারি মাসে ফুল ধরে এবং মে হতে জুলাই মাসে ফল থাকে । গাছে প্রথম দিকের ফল বড় হয় এবং পরের দিকের ফল ছোট হয়। এক বছর বেশি ফল দিলে পরের বছর ফল কম দেয় । তবে বেশি ফলন পাওয়ার জন্য ফুল আসার সময় ২-৩ বার সেচ দেওয়া যায়। বর্ষার পর গাছের গোড়ার চারপাশের মাটি সরায়ে ৫-৭ দিন খোলা রেখে সার ও সেচ দিলে উপকার হয় । ফল না ধরলে অনেক সময় গাছের নিচে ধোয়া দেয়া হয় । গাছে কখনও ফল ফাটতে দেখা দিলে কিছু মুল ছাটাই করে দেয়া যেতে পারে। এছাড়া দা দ্বারা কাণ্ডের উপর স্থানে স্থানে কোপ দিয়ে কষ বের করে দিলে উপকার পাওয়া যায়।

পোকা ও রোগ বালাই দমন

কাঁঠালের মুচি ও ফলের মাজরা পোকা প্রধান ক্ষতিকর পোকা হিসেবে গণ্য করা হয়। এ পোকার আক্রমণে মুচি(ফুল) । ঝরে যায় । সুতরাং মুচি আসার সময় প্রতি লিটার পানিতে ১.০ মি:লি: সাইপার মেথ্রিন/রিপকর্ড/ সিমবুস ১০ ইসি বা ১ মি: লি: ডেসিস ২.৫ ইসি বা ০.৫ মি:লি: ফেনভ্যালিরেট (সুমিসাইডিন) ২০ ইসি বা ২.০ মি: লি: ফেনট্রোথিয়ন (সুমিথিয়ন) ৫০ ইসি বা ডায়াজিনন ৫০ ইসি স্প্রে করে ফুল বা মুচি ভিজিয়ে দিতে হবে । ১৫ দিন পর পর এক বা দুবার স্প্রে করলেই এ পোকা দমন করা যাবে ।

রোগ দমন

ফলা পঁচা রোগ কাঁঠালের একটি মারাত্মক রোগ। এ রোগের জীবাণু পুরষ ফুল এবং কচি ফলে আক্রমণ করে । এর ফলে ফল ঝরে পড়ে । ঝরে পড়া ফল ও ফুল সমূহ বাগান থেকে সংগ্রহ করে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে । বাগান আগাছা মুক্ত রাখতে হবে। এবং রোর্দা মিকচার দিয়ে স্প্রে করে সব ফুল ভিজিয়ে দিতে হবে ।

ফল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ

গাছে খুব বেশি ফল ধরলে কিছু ফল সবজি খাবার জন্য কেটে নেয়া ভালো এতে বাকি ফলের আকৃতি বৃদ্ধি পায় । গ্রীষ্মের শেষে জুন মাসে ফল পাকে । ফল পুষ্ট হলে গায়ের কাপগুলো গোলাকার হয় এবং খোসার রং সবুজ পীত হয় ।

পুষ্ট ফল বোঁটা সমেত পেড়ে ঘরের গরম জায়গায় রেখে দিলে ৪-৭ দিনের মধ্যে পেকে যায় । ফল দ্রুত পাকার জন্য পাড়া ফলের বোটাতে লবণ বা চুন দেয়া হয়। কাঁচা অবস্থায় লাঠি দিয়ে আঘাত করলে ঠন ঠন শব্দ হয় । আর পাকা অবস্থায় ডেব ডেব শব্দ হয় । দূরবর্তী স্থানে পাঠাতে হলে পুষ্ট ফল পেড়ে তখনই গাড়িতে সাজাতে হবে । তবে বড় কাঁঠাল নিচের দিকে এবং ছোট কাঁঠাল উপরের দিকে দিয়ে সাজাতে হয়। এ সময় গাড়িতে খড় বিছিয়ে দিতে হয় অন্যথায় ঝুঁকিতে কাঁঠালের কাঁটায় দাগ পড়ে এবং তাতে কাঁঠালের মান কমে যায় । সাধারণত কাঁঠাল হিমাগারে রাখা হয় না। তবে ১১° - ১২° সেলসিয়াস তাপমাত্রা ও শতকরা ৮৫-৯০ ভাগ আপেক্ষিক আদ্রতায় ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত রাখা যেতে পারে। পাকা ফলের কোয়া থেকে রস, সিরাপ, জেলি, ক্যান্ডি তৈরি করে রাখা যায় ।

 কুল চাষ

স্বাদ ও পুষ্টি মানের বিচারে কুল একটি উৎকৃষ্ট ফল। এদেশের সব শ্রেণির লোকের নিকট এটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ফল । পৃথিবীতে উৎপাদিত কুল দুই প্রকার, যথা- ১। চীনা কুল এবং ২। ভারতীয় কুল । চিনা কুল গাছ ক্ষুদ্রাকার, সরল এবং পত্র পতনশীল, বসন্তকালে ফুল ধরে এবং শরৎকালে পাকে। ভারতীয় কুল মাঝারি আকারের ও ছড়ান প্রকৃতির, শরৎকালে ফুল ধরে এবং শীতকালে ও বসন্তের প্রারম্ভে ফল পাকে। এটা কিছু পরিমান পত্র পতনশীল । দীর্ঘাকৃতি ও সুমিষ্ট নারিকেলী কুলকে জিজিফাস যুযুবা এবং অম্লমধুর ও নাম গোত্রহীন কুলকে জিজিফাস ভালগারিস নামে অভিহিত করা হয়। কুলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি আছে ।

জমি ও মাটি নির্বাচন

কুল গাছ অত্যন্ত কষ্টসহিঞ্চ। তাই যে কোন প্রকার মাটিতে ইহা জন্মানো যায়। যদিও এর উপযোগী অম্ল ক্ষারত্বের সীমারেখা দীর্ঘ, তবু নিরপক্ষ কিংবা ক্ষার মাটিতে এটি অপেক্ষাকৃত ভালো জন্মে । ভারী ও সামান্য ক্ষারযুক্ত বেলে দোঁআশ মাটি কুলের জন্য সর্বোত্তম। কুল গাছ লবণাক্ততা ও জলাবদ্ধতা উভয়ই সহ্য করতে পারে। তথাপিও পানি নিকাশের ভালো ব্যবস্থা থাকলে ভালো হয় । কুল গাছ প্রচণ্ড খরা ও বর্ষা সহ্য করতে পারে । কুল চাষের জন্য তেমন বৃষ্টিপাতের দরকার হয় না। তাই উঁচু জমি ও কম বৃষ্টিপাত এলাকায় সহজেই কুল চাষ করা যেতে পারে। প্রচুর আলো বাতাস পায় এমন স্থান কুল চাষের জন্য নির্বাচন করা উচিত।

জমি ও গর্ত তৈরি

জমিতে ৪-৫ বার লাঙল দিয়ে চাষ ও ম‍ই দিয়ে আগাছামুক্ত ও সমতল করে নির্দিষ্ট জায়গাতে গর্ত তৈরি করতে হবে । চারা রোপণের ২-৩ সপ্তাহ আগে চারা রোপনের নির্ধারিত স্থানে ৬-৭ মিটার দূরে দূরে ১×১×১ মিটার আকারে গর্ত খনন করতে হবে। প্রতিটি গর্তের উপরের অংশের মাটির সাথে রাসায়নিক এবং নিচের অংশের মাটির সাথে জৈব সার মিশিয়ে গর্ত ভরাট করে ২-৩ সপ্তাহ রাখতে হবে ।

ছক: গর্ত প্রতি সারের পরিমাণ সারের নাম

সারের নাম

গর্ত প্রতি সারের পরিমাণ

পঁচা গোবর

২০-২৫ কেজি

টিএসপি

২০০-২৫০ গ্রাম

এমপি

২৪৫-২৫৫ গ্রাম

ইউরিয়া

২০০-২৫০ গ্রাম

তবে চারা রোপণের এক মাস পূর্বে গর্ত খনন করা উচিত। মাটি খুব উর্বর হলে রাসায়নিক সার না দিলেও চলে।

সার প্রয়োগ

নিয়মিত ভালো ফলন পেতে হলে সঠিক পরিমাণে সার প্রয়োগ করতে হবে ।

এ সমস্ত সার একবারে না দিয়ে ২-৩ বারে দিতে হবে । প্রথম বার সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে এবং দ্বিতীয় বার এপ্রিল-মে মাসে গাছের গোড়ার চারদিকে কুপিয়ে মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে । ফল ধরার পর, ফল পাড়ার পর ও বর্ষার পর এই তিন বারেও উল্লিখিত সার দেওয়া যেতে পারে । গাছের বয়স বাড়ার সাথে সাথে গাছের গোড়ায় সার দেয়ার দূরত্ব ও বাড়াতে হয় । সার দেয়ার পর শুষ্ক মৌসুমে পানি সেচ দিতে হবে ।

রোপণ পরবর্তী পরিচর্যা

কুলের বাগানে প্রয়োজনমত আগাছা পরিষ্কার, পানি সেচ ও নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে । নিয়মিত ভালো ফলন পেতে হলে সঠিক পরিমাণে সার প্রয়োগ করতে হবে । নভেম্বর- ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত নিয়মিত সেচ দিলে ফল বড় হয় এবং ফলন বেশি হয় । কুল গাছে ডাল ছাটাই করা খুব প্রয়োজন । ডাল ছাঁটাই এর পর খুব তাড়াতাড়ি নতুন শাখা প্রশাখা গজায় । বছরে দুইবার ডাল ছাঁটাই করা ভালো । ফল পাড়ার পর পরই বেশি করে একবার এবং ফুল আসার আগে হালকা করে আর একবার হেঁটে দিলে ফলন বেশি হয় । কুল গাছ অত্যন্ত কস্ট সহ্য করতে পারে । সে জন্য এতে ভারী ছাঁটাই দরকার হয় । কুল গাছ নতুন ডালে ফুল আসার প্রবণতা বেশি তাই ছাঁটাই করার পর নতুন করে শাখা-প্রশাখা গজায় বিধায় পরবর্তী বছর ফলন বেশি হয় । লক্ষ রাখতে হবে কুল বাগানের আশে পাশে যেনগাছ না থাকে । কেননা জলী গাছ রোগ জীবাণ ও ফলের মাছি পোকার আবাসস্থল হিসেবে কাজ করে ।

ছাঁটাইকরণ

গাছের প্রাথমিক অবস্থায় একটি শক্ত ও মজমুত কাঠামো তৈরি করে নিতে হবে। এ জন্য প্রধান কাণ্ডকে কমপক্ষে ৭৫ সে.মি. লম্বা করে তালোর পর মাথা কেটে দিতে হবে । এরপর চারদিক দিয়ে বহু নতুন শাখা বের হয়ে গাছ ঝোপালো হবে । প্রধান কাণ্ড হতে বের হওয়া ৬-৮ টি ভালো শাখা রেখে বাকিগুলো কেটে দিতে হবে । শাখা কেটে পাতলাকরণের সময় এক শাখা হতে অন্য শাখা ১৫-২০ সে:মি: দূরে রাখতে হবে । তাছাড়া মরা, শুকনা, রোগাক্রান্ত ও সরু হয়ে নুয়ে পড়া শাখাগুলো কেটে দিতে হবে । ফল পাড়ার পর খরার সময় যখন পাতা ঝরে যায় তখন ছাঁটাই করা উচিত । এপ্রিল হতে মে মাসে সাধারণত পাতা ঝরে গাছ শুকনা কাঠির মত হয় ।

পোকা মড়ক ও রোগ বালাই দমন

ফলের মাছি পোকা ফলে ডিম পাড়ে এবং ফলের ভেতর শুক্রকীটের উপস্থিতি ফলকে খাওয়ার অযোগ্য করে তোলে । কোন কোন ক্ষেত্রে গাছের সব ফলই আক্রান্ত হয়। প্রতি ১০ লিটার পানিতে ১০-১৫ মি:লি: ডায়াজিনন মিশিয়ে ফল পাকার আগে মাঝে মাঝে সিঞ্চন করলে উপকারে আসে। ফল ছিদ্রকারী পোকা কুলের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর।

বয়স্ক পোকা ফলের বোটার কাছ ডিম পাড়ে এবং শুককীট ফলের ভেতর সুড়ঙ্গ তৈরি করে শাস খেতে খেতে অগ্রসর হয় । এতে ফল খাওয়ার উপযোগী থাকে না । গাছে ফল ধরার পর থেকে কিছু দিন পর পর ১০ লিটার পানিতে ১০-১৫ মি. লি. ডায়াজিনন প্রয়োগ করে এ পোকা দমন করা যায়। কুলের উইভিল ও বিছা পোকা অনেক সময় বিরাট ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। উভয় পোকাই প্রধানত পাতা খায় । যে কোন কীটনাশক প্রয়োগ করে দমনকরা যায় ।

ফলের পচন – এ রোগের আক্রমণে ফলের অপ্রান্তে প্রথমে বাদামি রঙের দাগ পড়ে। পরে এ দাগগুলো সমগ্র - ফলকে ঘিরে পচিয়ে ফেলে। এ রোগ প্রতিকারের জন্য ৫ চামচ ডাইথেন এম-৪৫ ২.৫ গ্যালন পানিতে মিশিয়ে। ১০ দিন । অন্তর গাছে ছিটানো যেতে পারে।

রোগ বালাই- পাউডারী মিলডিউ ও এ রোগের আক্রমণে গাছের পাতা ও ফলের উপর সাদা পাউডারের মতো একটি বস্তু জমা হয় এবং আক্রান্ত ফল ঝরে পড়ে। ফল ধরার মৌসুমে এ রোগ দেখা যায় । বোর্দোমিশ্ৰণ অথবা সালফার গুড়া প্রয়োগ করে এ রোগ দমন করা যায় ।

ফল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ

বীজের গাছে ফুল আসতে ৩-৪ বছর সময় লাগে। কিন্তু কলমের গাছ রোপণের ২-৩ বছরের মধ্যেই ফল পাওয়া যায়। সেপ্টেম্বর- অক্টোবর মাসে ফুল আসে এবং ফল পাকতে ৪-৫ মাস সময় লাগে । জাত ভেদে জানুয়ারি-মার্চ মাসে ফল পাকে । খুব পাকা ফল বা অপব্ধ ফল কখনও সংগ্রহ করা উচিত নয় । ফলে হালকা সবুজ বা হলুদ রং ধরতে থাকলেই ফল সংগ্রহ করতে হয়। শখায় ঝাকানি দিয়ে মাটিতে ফেলে ফল সংগ্রহ করলে অনেক ফল ফেটে গিয়ে দ্রুত নষ্ট হয় । ঝাকানি দেয়া অপরিহার্য হলে নিচে জাল পেতে ফল সংগ্রহ করা যেতে পারে ।

তাজা ফল ছায়াযুক্ত ও ঠান্ডা ঘরে সাধারণত এক সপ্তাহ পর্যন্ত ভালো ভাবে রাখা যায় । এক ডিগ্রি সেলসিয়াস । তাপমাত্রায় এক থেকে দেড় মাস সংরক্ষন করা যায়। কুলের টক, আচার, জেলি তৈরি করা হয় । পাকা ফল রোেদ শুকিয়ে রস কমিয়ে ও কুল সরাসরি রাখা যায় । পরে খাওয়ার জন্য কয়েকদিন কড়া রোদ ছড়িয়ে রাখলে বরই শুকিয়ে যায় । শুকনা বরই দিয়ে ভালো আচার তৈরি করা যায় ।

Content added By

অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন

১। বাংলাদেশে কত হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়ে থাকে ? 

২। সাধারণত কত অম্লমান সম্পন্ন মাটিতে আম ভালো হয় ? 

৩। কাঁঠাল কোন অবস্থায় খাওয়া যায় ? 

৪। কাঁঠাল কোন ধরনের ফল ? 

৫। কুল সাধারণত কোন ধরনের মাটিতে চাষ করা হয় ?

সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন

১। কাঁঠালের চারা রোপণ পরবর্তী পরিচর্যা সম্পর্কে লেখ । 

২। আম চাষের জন্য কি ধরনের জমি ও মাটির প্রয়োজন ? 

৩। আমের চারার জন্য গর্ত তৈরি ও গর্তে ব্যবহৃত সারের নাম ও পরিমাণ লেখ । 

৪ । নিকৃষ্ট কুল গাছকে মিষ্টি গাছে রূপান্তর সম্বন্ধে ব্যাখ্যা কর। 

৫। কাঁঠাল গাছে সার প্রয়োগ সম্পর্কে বর্ণনা কর । 

৬। কাঁঠাল চাষের জন্য প্রয়োজনীয় জমিও মাটির ধরন সম্পর্কে লেখ ।

রচনামূলক প্রশ্ন

১। আম/কাঁঠাল/কুল গাছের জমি তৈরি, গর্ত তৈরি, সার প্রয়োগ ও অন্তর্বর্তী পরিচর্যা সম্পর্কে লেখ । 

২। কুল চাষের গুরুত্ব ও ব্যবহার সম্বন্ধে লেখ । 

৩। কুল গাছ ছাঁটাই সম্বন্ধে বর্ণনা কর । 

৪। কাঁঠালের গুরুত্ব ও ব্যবহার সম্বন্ধে লেখ। 

৫ । আম বাগানে সার প্রয়োগের মাত্রা ও গুরুত্ব সম্পর্কে বর্ণনা কর । 

৬ । আম/কাঁঠালের ফল ও গাছের পোকা ও রোগ বালাই দমনের কৌশল বর্ণনা কর ।

Content added By