এসএসসি(ভোকেশনাল) - ফ্রুট এন্ড ভেজিটেবল কাল্টিভেশন-২ - দ্বিতীয় পত্র (দশম শ্রেণি) | NCTB BOOK

লিচু চাষাবাদ কৌশল লিচু মধ্যম আকৃতির দ্বিবীজ পত্রী, চিরহরিৎ ও বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ । আমাদের অনেক পরিচিত ও প্রিয় ফলের মধ্যে লিচুর এক বিশেষ স্থান রয়েছে। রূপে, গুনে ও স্বাদে লিচু একটি আকর্ষণীয় ও উপাদেয় ফল । আমাদের দেশে লিচু একটি অন্যতম জনপ্রিয় ফল। এতে প্রচুর পরিমাণে খনিজ পদার্থ, শর্করা জাতীয় খাদ্য ও ভিটামিন সি থাকায় লিচু একটি পুষ্টিকর ফল ও ঘটে। এতে ভিটামিন এ, বি১ ও বি২ উল্লেখ্যযোগ্য পরিমাণে বিদ্যমান। লিচু গ্রীষ্ম প্রধান ও অগ্রীষ্ম প্রধান অঞ্চলের ফল । বাৎসরিক বৃষ্টিপাত ১৫০ মিমি ও বাতাসের আপেক্ষিক আদ্রতা ৭০-৮০ % লিচু চাষের জন্য উপযোগী।

জাত - বাংলাদেশে চাষ কৃত লিচুর উৎকৃষ্ট জাতগুলো হলো- বোম্বাই, বেদানা, মুজাফফরপুর, এলাচিরোজ, দুধিয়া, চায়না - ৩ ইত্যাদি । বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউট বারি লিচু-১, বারি লিচু-২, এবং বারি লিচু-৩ নামে ৩টি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে ।

বংশবিস্তার-বীজ থেকে ও অঙ্গজ পদ্ধতিতে লিচুর চারা তৈরী করা যায় । বীজ থেকে উৎপাদিত চারার ফল পেতে ৭-১২ বছর সময় লাগে। চারা উৎপাদনের জন্য গুটি কলম সর্বাধিক উপযোগী। গুটি কলম হতে উৎপাদিত চারা হতে ৩-৪ বছরের মধ্যেই ফল ধরে।

মাটি ও জমি নির্বাচন

লিচু গাছ বিভিন্ন ধরনের মাটিতে জন্মাতে পারে যদি তা পানি নিষ্কাশনের সুবিধাযুক্ত থাকে । প্রচুর জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ সুনিষ্কাশিত গভীর বেলে দোঁআশ মাটি লিচু চাষের উপযুক্ত। বেলে মাটি লিচু চাষের জন্য অনুপযুক্ত । কেউ কেউ বলেন লিচু ক্ষার মাটিতে ভালো হয় । তাই অনেকে লিচুর বাগানে চুন ব্যবহার করে থাকেন। মাটি খুব বেশি অল্প বা খুব বেশি ক্ষার হলে গাছের জন্য ক্ষতিকর । ৬.৫-৬.৮ পিইচ সম্পন্ন মাটিতে লিচু ভালো হয় । সামান্য অম্লীয় মাটিতে মাইকোরাইজা উৎপন্ন হয় যা লিচু গাছের জন্য উপকারী। নতুন চারা গাছের গোড়ায় পুরাতন লিচু গাছের নিচের কিছু মাটি প্রয়োগ করলে মাইকোরাইজা সৃষ্টি হয় ।

গাছ রোপণের জন্য জমি ও গর্ত তৈরি

বাড়ীর আশেপাশে বা বসতভিটায় দু'একটি গাছ রোপণ করতে চাইলে জমি তৈরির প্রয়োজন নেই । গাছ রোপণের গর্তগুলো (Planting pit) করলেই চলবে। কিন্তু লিচুর বাগান করতে চাইলে জমিতে ঝোপ জঙ্গল ও আগাছা থাকলে তা পরিষ্কার পরিছন্ন করে জমি সমান করে নিতে হবে এবং ভালো ভাবে চাষ দিয়ে জমি তৈরী করতে হবে । লিচু গাছ ১০×১০ মিটার দূরে দূরে রোপণ করতে হয় । লিচু গাছ ষড়ভুজ প্রণালীতে রোপণ করা উত্তম । ১০ মিটার দূরে দূরে লাইন টেনে লাইনে ১০ মিটার দূরে দূরে গাছ রোপণ করতে হবে । প্রথমেই মাপ জোক করে কাঠি পুঁতে গাছ রোপণের স্থান নির্দিষ্ট করতে হবে। এরপর কাঠিটিকে কেন্দ্র করে ১ মি: ১মি:× ১মিঃ সাইজের গর্ত খুঁড়তে হবে । গর্ভের মাটিতে ভালোভাবে রোদ পাওয়ার জন্য গর্ত খুড়ে ২-৪ সপ্তাহ খোলা রাখতে হবে । গর্ত তৈরির সময় গর্তের উপরের ও নিচের মাটি আলাদা আলাদা করে রাখতে হবে। এ মাটির সাথে জৈব সার ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে । গাছ রোপণের কমপক্ষে ১০-১৫ দিন আগে এই সার মিশানো মাটি দিয়ে গর্ত ভরাট করে রাখতে হবে। গর্তের মাটি শুকানো থাকলে পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিতে হবে । গাছ থেকে গাছের দূরত্ব উভয় দিকে ১০ মিটার রাখতে হবে । জৈষ্ঠ (মে-জুন) মাসে লিচু চারা রোপণের উত্তম সময় । সেচ সুবিধা থাকলে বছরের অন্যান্য সময়েও (অতি খরা সময়বাদে) ছোট ছোট বাগানে চারা রোপণ করা যেতে পারে ।

সার প্রয়োগের কলা কৌশল

প্রথমে উপরের (Top soil) মাটির সাথে গর্ভ প্রতি ১০ কেজি গোবর সার মিশিয়ে গর্ত ভরাট করে ফেলতে হবে। এরপর ১৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ২৫০ গ্রাম টি এস পি ও ২০০ গ্রাম এমপি সার গর্ডের উপরের ২৫ সে:মি: মাটির মধ্যে হালকা কোপ দিয়ে মিশিয়ে দিতে হবে। এখন রোপণের জায়গাটি কাঠি পুঁতে নির্দিষ্ট করে রাখতে হবে । এর ১০-১৫ দিন পর লিচুর কলম উক্ত গর্ভে রোপণ করা যাবে। রোপণের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন গাছের গোড়ার মাটির বলটি না ভেঙ্গে যায়। এরপর গাছটি মাটিতে বসিয়ে চারদিকের মাটি পা দিয়ে শক্ত করে বসিয়ে দিতে হবে এবং রোপণের পর পরই সেচ দিতে হবে।

গাছ রোপণ পরবর্তী পরিচর্যা

লিচু বাগান আগাছামুক্ত রাখতে হবে। লিচুর শিকড় বেশি গভীরে যার না। তাই শুষ্ক মৌসুমে সপ্তাহে ২-৪ বার হালকা ভাবে চাষ দিয়ে মাটি আলগা করে রাখলে রস সংরক্ষণে সহায়তা হবে। গাছ ছোট অবস্থায় বাগানে সবুজ সারের চাষ করা যেতে পারে। গাছ বৃদ্ধির জন্য শুষ্ক মৌসুমে সেচ দিতে হবে । এটি ফল ঝরে পড়ে রোধে সাহায্য করে। গরমের দিনে হঠাৎ বৃষ্টিপাত হলে ফল ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই সেচ দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলে ফল ফেটে যাওয়া অনেকাংশে রোধ হয়। লিচু বাগানের মাটি চাষ করে কলাই ভাল্ব এর চাষ করা যেতে পারে । এতে বাড়তি আয় হবে এবং মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পাবে। লিচু বাগানে সবজি চাষ করা যায়। এতে বাগান পরিষ্কার থাকে।

সারে উপরি প্রয়োগ ও সেচ ব্যবস্থাপনা

লিচু পাছে বছরে দুবার সার দিতে হবে। প্রথম কিস্তিতে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে এবং দ্বিতীয় কিন্তুি ভাদ্র-আশ্বিন মাসে। গাছের সন্তোষজনক বৃদ্ধির জন্য সার দরকার। প্রথম চার বছর যে হারে সার দিতে হবে তা সারনিতে দেয়া হলো। সার দেয়ার পরপরই প্রয়োজনে সেচ দিতে হবে। 

সারণি – ১ প্রথম চার বছর লিচু গাছে সার প্রয়োগের পরিমাণ

গাছের বয়সগোবর সার কেজি প্রতি গাছ প্রতি বছরইউরিয়া গ্রাম/প্রতি গাছ/প্রতিবছরইউরিয়া গ্রাম/প্রতি গাছ প্রতিবছরএমপি গ্রাম/প্রতি গাছ প্রতি বছর
১৭০৫০১২৫
২২০৫০১৭০
৩২০১১০২৫০
৫৫০১৬০৪২০

সম্পূর্ণ গোবর সার ও টি এসপি এবং অর্ধেক ইউরিয়া ও এমপি প্রথম কিস্তিতে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে একসাথে গাছের গোড়ার মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। গাছের গোড়া হতে ৫০ সে:মি: দুরত্বে বা গাছের ডাল যতদুর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে ততদূর পরিমাণ দূর দিয়ে সার ছিটিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। সার দেয়ার পরপরই সেচ দিতে হবে । বাকী ইউরিয়া ও এম পি সার দ্বিতীয় কিস্তিতে ভাদ্র-আশ্বিন মাসে একই ভাবে গাছের গোড়ায় প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগের পরপরই সেচ দিতে হবে। শুষ্ক মৌসুমে ১৫-২০ দিন পরপর সেচ দেয়া ভালো! সার প্রয়োগে মাটির উর্বরতা, গাছের দূরত্ব ও বৃদ্ধি ইত্যাদির উপর নির্ভরশীল। তবে প্রতি বছর সারের মাত্রা বাড়িয়ে ৫ বছর বা তদুদ্ধ বয়সের গাছ প্রতি সার প্রয়োগ সারণি - ২ তে দেয়া হলো ।

সারণি-২ পাঁচ বছর বা তদুর্ধ লিচু গাছে সার প্রয়োগের পরিমাণ

প্রতি ক্ষেত্রেই সার প্রয়োগের পরপরই লিচু বাগানে সেচ দিতে হবে। ফলন্ত গাছে ফুল আসার পর থেকে শুরু করে ১৫-২০ দিন পরপর সেচ দিলে ফল বড় হয় এবং ফলন বাড়ে। পানির অভাব হলে ফল ঝরে পড়ে ।

ট্রেনিং ও প্রুনিং

ফলন্ত লিচু গাছে ট্রেনিং বা প্রবর্নিং দরকার নাই। নার্সারিতে থাকতে এবং রোপণের পর কয়েক বছর গাছের কিছু ট্রেনিং এবং প্রুনিং এর দরকার আছে । যাতে গাছের একটি মাত্র প্রধান কাণ্ড কমপক্ষে এক থেকে দু মিটার উঁচু হতে পারে । এ জন্য পাশের অন্যান্য ডালপালা ঘেঁটে দিতে হবে । প্রতি বছর বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার আগে মরা ও রোগাক্রান্ত ডালপালা ছাঁটাই করতে হবে। লিচু ফল এক বছর বয়সের প্রান্ত শাখায় হয়ে থাকে । ফল আহরণের সময় শাখার কিছু অংশ ফলসহ ভেঙে নেওয়া হয় । শাখার কিছু অংশ ভাঙার ফলে নতুন শাখা প্রশাখা বের হয় । সেগুলো পরবর্তী বছর ফল দেয়। এর বেশি ছাঁটাইয়ের প্রয়োজন হয় না ।

পোকা মাকড় ও রোগ বালাই

লিচুর তেমন কোন মারাত্মক রোগ নেই। তবে Litchi Fruit লিচু গাছের অতিক্ষুদ্র মাকড়, ও Litchi Fruit Borer লিচু ফলের বীজ খেকো মাজরা পোকা লিচু ফলের মারাত্মক ক্ষতি করে ।

বাদুর পাকা লিচুর প্রধান শত্রু । এটি পাকা ফলে আক্রমণ করে । ফল পাকার সময় মাছ ধরার জাল দিয়ে গাছ ঢেকে রাখলে বাদুরের উৎপাত কমে যায় । লিচু মাইট পাতার রস চুষে পাতাকে শুকিয়ে ফেলে । এর আক্রমণে পাতার নিচের পিঠে বাদামি বর্ন ধারন করে এবং পাতা কুঁকড়িয়ে যায় । কচি শাখা প্রশাখা ফুলের কুঁড়ি ইত্যাদিও আক্রান্ত হয় । প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২০-৩০ ঘন মি: লি: ক্যালথেন বা ২০ গ্রাম থায়াভিট মিশিয়ে প্রয়োগ করলে ইহা দমন হয় । পোকার শুককীট ফলের বোটার দিকে গর্ত করে ঢুকে শাঁস ও বীজ আক্রমণ করে । ফল পাকার সময় হলে এ পোকার আক্রমণ বেশি হয়। কচি অবস্থায় ফলের উপর জায়াজিনন ৫০ ইসি ৬ মিলি ১লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করে এ পোকা নিয়ন্ত্রন করা যায় । লিচু উচ্চ আর্দ্র ও কুয়াশাযুক্ত আবহাওয়ায় পুষ্প মঞ্জুরী মিলডিউ ও অ্যানথ্রাকনোজ রোগে আক্রান্ত হতে পারে । অনেক সময় ফল পচতে ও শুকিয়ে যেতে দেখা যায় । এর প্রতিকারে বোর্দোমিশ্রণ ও ডাইথেন এম-৪৫ ছত্রাকনাশক ছিটানো যেতে পারে।

ফল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ কৌশল

কলমের গাছে ৪-৫ বছরের মধ্যেই ফল ধরতে শুরু করে ও ভাল ফলন পেতে ৭-৮ বছর সময় লাগে । বীজের গাছে ফল আসতে ৮-১০ বছর সময় লাগে । একটা গাছে প্রায় ৫০-৬০ বছর পর্যন্ত ভালো ফলন পাওয়া যায় । ফেব্রুয়ারি - মার্চ মাসে লিচু গাছে ফুল আসে ও মে-জুন মাসে লিচুর পাকা ফল সংগ্রহ করা যায় । ফল পুষ্ট হলে কাটা গুলো অনেকটা মোটা হবে ফলের রং উজ্জ্বল হবে এবং বোটার নিচে লালচে রং ধারণ করবে পরিপক্ক লালচে ভাবাপন্ন লিচু সগ্রহ করা হয়। এতে ফল বেশি দিন সংরক্ষণ করে রাখা যায়। বৃষ্টির পর পরই কখনো ফল সংগ্রহ করা উচিত নয়। সাধারণত প্রতিটি গাছ থেকে ৩০০০ হতে ৫০০০ লিচু পাওয়া যায়। গাছ প্রতি ফলন ৮০-১৫০ কেজি।

সংরক্ষণ

সাধারণত লিচু সংগ্রহের পর ২-৩ দিনের বেশি ঘরে রাখা যায় না। লিচুর উপর লবণের পানি ছিটিয়ে বাঁশের ঝুড়িতে করে দূরবর্তী স্থানে লিচু প্রেরণ করলে সহজে নষ্ট হয় না। ২.২° -৩.৩° সে: তাপমাত্রায় ৮০ ৮৪% আর্দ্রতায় লিচুকে একমাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল নারিকেল। নারিকেল এমন এক ধরনের গাছ যার ফল, ছোবড়া, খোল, পাতা, কাণ্ড, মূল প্রভৃতি সমস্ত কিছুই মানুষের কাজে লাগে। বাংলাদেশের সব জেলাতেই নারিকেল জন্মায়। তবে উপকূলীয় জেলাসমূহে এর উৎপাদন বেশি। নারিকেলের জন্য উষ্ণ আর্দ্র জলবায়ুর প্রয়োজন । যে সব স্থানের বার্ষিক গড় তাপমাত্রা ২৭° সে. এবং তাপমাত্রা দৈনিক উঠানামা ৬-৭° সেঃ বেশি নয় এবং বার্ষিক বৃষ্টিপাত ১২৫ সে:মি: এর বেশি সেখানে এটি সবচেয়ে ভালো জন্মে । নারিকেলের জাত প্রধানত তিনটি (১) টিপিকা জাত যা লম্বা শ্রেণিভুক্ত (২) জাভাটিকা জাত মাঝারি লম্বা শ্রেণি এবং (৩) নানা জাত যা বামন শ্রেণির

মাটি ও জমি নির্বাচন

নারিকেল গাছ প্রায় সব রকম মাটিতেই জন্মে। তবে সুনিষ্কাশিত অগভীর পানিতল বিশিষ্ট দোআশ বা বেলে দোঁআশ হতে এঁটেল মাটিতে খুব ভালো জন্মে । স্বাভাবিক জোয়ার ভাটার প্রভাবাধীন স্থান সমূহ নারিকেল চাষের জন্য উপযোগী । ৫.০ - ৮.০ অম্লক্ষারত্বে নারিকেল জন্মানো যায়। অত্যাধিক অম্ল বা অত্যধিক ক্ষার মাটি নারিকেল চাষের জন্য ভালো নয়। মাটির পটাসিয়াম ও সোডিয়াম লবন নারিকেলের জন্য ভালো। যে স্থানে মাটি সব সময় স্যাঁতসেঁতে থাকে অথচ শিকড় এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় না। তথায় নারিকেল সবচেয়ে ভালো জন্মে। নারিকেল জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। অথচ পর্যাপ্ত রসের প্রয়োজন, তাই সমুদ্রের কাছাকাছি পরিবেশে নারিকেল ভালো ভাবে জন্মে।

জমি তৈরি ও গর্ত তৈরি

জমি বেশ কয়েকবার চাষ দিতে হয় । তারপর মাটি ঝুর ঝুরে করে তৈরি করে আগাছা পরিষ্কার করে নিতে হয় । নারিকেল গাছ লাগানোর জন্য উঁচু জমি প্রয়োজন । জমিতে ১.৫ থেকে ২মি: উঁচু চওড়া বাধ তৈরি করে সেখানে নারিকেল গাছ লাগানো যায় । চারায় ছায়া প্রদানের সুবিধার্থে আগে হতে গর্তের স্থানের চারদিকে ৫০ সে.মি. দূর দিয়ে ধইঞ্চা বা শন পাটের বীজ বপন করা যেতে পারে । সারি থেকে সারির দুরত্ব এবং সারি থেকে গাছের দুরত্ব মাপজোক করে রোপণের স্থানে কাঠি পুঁতে নির্দিষ্ট করতে হবে । চারা রোপণের ২-৩ সপ্তাহ পূর্বে ৯০ সে.মি. প্রস্থ ও ৯০ সে.মি. গভীর করে গর্ত খুঁড়তে হবে। কোন কোন সময় চারা লাগানোর স্থানে ১০×১০×1.0 মিটার আকারের গর্ত করে ১৫ দিন থেকে ১ মাস রোদ খোলা রাখা হয়। গর্তের আকার বড় হলে বেশি উপকার পাওয়া যায়। এ গর্ত খোড়ার সময় উপর স্তরের মাটি আলাদা রাখতে হবে। এই উপরের মাটির সাথে ভালো ভাবে সার মিশিয়ে গাছ রোপণের ১০-১৫ দিন আগেই গর্তগুলো ভরাট করে দিতে হবে।

সার প্রয়োগের কলা কৌশল

গর্তের উপরের মাটির সাথে পর্বপ্রতি ২০ কেজি গোবর মিশিয়ে গর্তগুলো ৩০ সেঃমিঃ ফাঁকা রেখে ভরটি করতে হবে । তারপর প্রতি গর্তের উপরে ২৫ সেঃমিঃ মাটির সাথে নিম্নের সারনিতে উলেখিত সারগুলোর অর্ধেক মিশাতে হবে ।

সারণি ও প্রতি গর্তে গাছে সারের পরিমাণ

গোবর২০ কেজি
ইউরিয়া১৩২৫ গ্রাম
টিএসপি১০৪০ গ্রাম
এমপি১৬৬০ গ্রাম
জিপসাম২৭৭৫ গ্রাম
জিংক সালফেট২৭৫ গ্রাম

বাকি সার ভাদ্র আশ্বিন মাসে গাছের চারদিকে ৩-৫ মিটার পর্যন্ত ছিটিয়ে টিলার বা লাঙ্গল দিয়ে চাষ দিয়ে মাটির সাথে মিশে দিতে হবে ।

চারা রোপণের দূরত্ব

বাগান করলে গাছ থেকে গাছ ও সারি থেকে সারি ৬.৫-৮.৫ মিটার দূরে চারা লাগানো যায়। তবে গাছ থেকে গাছ । এবং সারি থেকে সারি ৫-৬ মিটার দুরত্বেও লাগানো যেতে পারে । বর্গাকার, ষড়ভূজী বা ত্রিকোনাকার পদ্ধতিতে নারিকেল চারা রোপণ করা যার। বড়ভূজ পদ্ধতিতে বর্গাকার বা ত্রিকোনাকার পদ্ধতি অপেক্ষা বেশি গাছ লাগানো যায় ।

চারা নির্বাচন: যে সব চারা দ্রুততর গলায় এবং ঘন ঘন পাতা উৎপাদন করে সেগুলো উৎকৃষ্ট । ঐগুলোর পাতা চওড়া, গাঢ় সবুজ। পাতার বোটা খাটো, চারার গোড়া পুরু, শিকড়ের সংখ্যা অধিক। তেজী চারা লাগালে দ্রুত ফল পাওয়া যায় এবং ফলনও বেশি হয়।

চারা রোপণের সময় মে হতে জুলাই বা আগষ্ট মাস পর্যন্ত চারা রোপণ করা যেতে পারে। বীজ তলা হতে চারা ভালোর দিনই মূল বাগানের জমিতে চারা লাগানো উচিত। তাতে চারা খুব তাড়াতাড়ি লেগে যেতে পারে।

চারা রোপণ পদ্ধতি: সার মিশানো মাটি দিয়ে গর্ত গুলো ভরাট করার ১০-১৫ দিন পর নারিকেলের সুস্থ ও সবল চারা জমির সমতল হতে ৩০ সে:মি: গভীরে গর্তের মাঝখানে বসাতে হবে। চারা গর্তের মাটিতে রোপণের সময় চারা নারিকেলটি শুধু মাটি চাপা দিতে হবে এবং চারদিকের মাটি শক্ত করে বসিয়ে দিতে হবে। অতিরিক্ত বৃষ্টির সময় যখন মাটি কর্দমাক্ত থাকে তখন সার মিশানো বা চারা রোপণ না করে যখন জমিতে “জো” আসে তখন করা সবচেয়ে ভালো। রোপণের পরপরই চারার দু পাশে দুটি কাঠি পুঁতে বাংলা চারটি এর মত করে চারটি মাঝখানে রেখে দুটি কাঠি বেঁধে দিতে হবে ।

রোপণ পরবর্তী পরিচর্যা

রোপণের পর ৪-৫ বছর পর্যন্ত নারিকেল গাছের প্রয়োজনীয় পরিচর্যা যথা সময়ে করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । এতে গাছ দ্রুত ফলবান হবে এবং পরবর্তী সময়ও গাছের উপর এর শুভ প্রতিক্রিয়া থাকবে ।

সেচ ও পানি নিকাশ এবং অন্যান্য পরিচর্যা: প্রথম অবস্থায় গর্তের চারাটি মাটি এসে চারার গোড়া যেন ঢেকে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এরূপ হলে অতিরিক্ত মাটি চারার গোড়া হতে সরিয়ে ফেলতে হবে । চারা যতই বড় হতে থাকবে গর্তের মাটিও আস্তে আস্তে ভরাট হতে থাকবে । শুকনো মৌসুমে নিয়মিত সেচ দিতে হবে এবং বর্ষা মৌসুমে নারিকেল বাগানে যেন জলাবদ্ধতা না হয় এ জন্য পানি নিষ্কাশনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে । কোন গাছের ছায়া যাতে ক্ষতি না করে সেদিকে খেয়াল করতে হবে। নারিকেল গাছ উন্মুক্ত আলো বাতাস চায় ।

সারের উপরি প্রয়োগ: গাছের সুষ্ঠু বৃদ্ধি ও ফল উৎপাদনের জন্য সব খাদ্যোপাদানই আবশ্যক । চারা রোপণের পর গাছের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য জৈব সার প্রয়োগ করা যেতে পারে । প্রাথমিক অবস্থায় চারার বৃদ্ধি কম হলে ফল ধরতে দেরী হয় । সাধারণত ৪ থেকে ৭ বছরের মধ্যে নারিকেল গাছে ফল ধরতে শুরু করে। তবে ১২ বছর বয়স হতে ভালভারে ফল ধরা শুরু করে। এক পরীক্ষায় প্রমান পাওয়া গেছে যে নারিকেল গাছে ফসফরোগর চাহিদা কম, পটাসিয়ামের চাহিদা বেশি এবং নাইট্রোজেনের চাহিদা মোটামুটি মাঝারি ধরনের । গাছের সুষ্ঠু বৃদ্ধির জন্য বয়স বাড়ার সাথে সাথে গাছ প্রতি সারের পরিমাণ বাড়াতে হবে।১ বছর

চারার বয়স

সারের পরিমাণ

সারের নাম ও আনুপাতিক হার

১ বছর৭৫০ গ্রামইউরিয়া: টিএসপি এমপি (২:১:৩)
২ বছর১০০০ গ্রাম 
৩ বছর১২৫০ গ্রাম 
৪ বছর১৫০০ গ্রাম 

সাথে প্রতি বছর ১০ কেজি গোবর সার প্রয়োগ করতে হবে । 

সূত্র: বিএআরসি/ডিএই ছক-২ 

ফলন্ত নারিকেল গাছে সার প্রয়োগের পরিমাণ

সারের নাম 

গাছ প্রতি সারের পরিমাণ

ইউরিয়া ১.৫০
টিএসপি ১.০০ কেজি
এমপি ১.৭০ কেজি
জিপসাম ৫০০ গ্রাম
জিংক সালফেট ২০০ গ্রাম

সারের অধিক মে-জুন মাসে এবং বাকি অর্ধেক সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে গাছের গোড়ার মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে । পাছের গোড়ার চারদিকে ৪০-৬০ সে.মি. দূর দিয়ে ৫০ সে:মি: চওড়া ও ১২-১৫ সে:মি: গভীর করে গর্ত করতে হবে। গাছ বাড়ার সাথে সাথে এই দূরত্ব বাড়িয়ে দিতে হবে। মে-জুন মাসে যে অর্ধেক সার দেওয়া হবে তা গর্ভে ছড়িয়ে দিয়ে মাটি চাপা দিতে হবে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে বাকি অর্ধেক সার গাছের চারদিকে ৩-৫ মিটার দুর দিয়ে ছিটিয়ে চাষ করে মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে। মাটিতে রস কম থাকলে সার প্রয়োগের পর পরই সেচ দিতে হবে। গাছ বাড়ার সাথে সাথে সার প্রয়োগ করা না হলে ফলন কমে যায়। নিয়মিত সার ও সেচ দিলে ফলন স্বাভাবিকের চেয়ে ৩ গুণ পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব। নারিকেল গাছে সার প্রয়োগের ১৫-২০ মাস পর ফলনের ওপর সারের প্রভাব পাওয়া যায়।

পোকা মাকড় ও রোগ বালাই দমন কৌশলঃ

পোকা দমন ও দুটি পোকা নারিকেল গাছের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এদের একটি Rhinoceros beetle বা গোবরে পোকা এবং অপরটি রেড পাম উইভিল। গোবরে পোকা কচি অর্থভাগ ছিদ্র করে ঢুকে পড়ে এবং গাছের কচি অংশের রস চুষে খায়। ফলে সেখানে পচন ধরে এবং বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়। পচা অংশের আকর্ষণে রেড পাম উইভিল এর আগমন হয়। এর শুককীট পাছের অগ্রভাগ কেটে ফেলে এবং গাছের মৃত্যু ঘটায়। এ দুটি পাকার আক্রমণ থেকে গাছকে রক্ষার জন্য নিম্নে বর্ণিত ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে ।

১। নারিকেল গাছ মারা গেছে বা মরার উপক্রম হয়েছে সেগুলো কেটে সরিয়ে ফেলতে হবে এবং আক্রান্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে । 

২। নারিকেল বাগানের মধ্যে বা আশে পাশে গোবর ও আবর্জনা রাখা যাবে না। 

৩। বছরে অন্তত দু'বার বর্ষা শুরুর আগে এবং শেষে গাছের অগ্রভাগের আবর্জনা, শুষ্ক পাতা ও ছড়ার অংশ পরিষ্কার করে দিতে হবে । ছিদ্র দেখলে লাহোর শিক ঢুকিয়ে পোকা পেঁথে মেরে ফেলতে হবে। তাছাড়া ছিদ্র পথে যত টুকু সম্ভব প্লাষ্টিকের সিরিঞ্জের সাহায্যে “নগস" বা ডেনকাভ্যাপন ১০০ ইসি ঢুকিয়ে ছিদ্র কাদা দিয়ে বন্ধ করে দিতে হবে। কীটনাশক হতে উৎপন্ন বিষ বাস্প নারিকেল গাছের অভ্যন্তরে উইভিলের কীড়া ধ্বংস করবে।

রোগ দমন: নারিকেল গাছের শীর্ষ পচা (Bud rot) রোগ খুবই মারাত্মক। এ রোগে আক্রান্ত গাছের শীর্ষদেশের কোমল অংশ পচে বিকট গন্ধ ছড়ায়। আক্রমণের প্রথম অবস্থায় বোর্দো মিকচার ছিটিয়ে এ রোগ দমন করা যায় । অথবা আক্রান্ত গাছের মাথা কেটে পুড়ে ফেলা উচিত এবং নিকটবর্তী গাছগুলোতে বোর্দো মিকচার ছিটানো উচিত ।

ফল আহরণ ও সংরক্ষণ কৌশল

ফুল আসা থেকে শুরু করে ঝুনা হতে প্রায় ১ বছর সময় লাগে। অনুকূল অবস্থায় চারা লাগানোর ৫-৬ বছরের মধ্যে নারিকেল গাছে ফুল ধরতে শুরু করে। বছরের বিভিন্ন সময়ে নারিকেল পাড়া যায় । কতবার নারিকেল পাড়া যাবে তা সংখ্যা বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন হয়ে থাকে । পরিপক্ক নারিকেল গাছে উঠে কঁধি কেটে রশিতে বেঁধে নিচে ফেলে সংগ্রহ করা হয় । দূরে পাঠাতে হলে বা বাজারজাত করতে হলে খোসাসহ খাঁচায় বা গাড়িতে করে পরিবহন করা যেতে পারে। ডাব হিসেবে ব্যবহার করতে হলে ৬-৭ মাস বয়সের ফল পাড়া ভালো । ঝুনা নারিকেল ঘরের শুকনো মেঝেতে ৩-৪ মাস রাখা যায়। বছরে গাছ প্রতি ১০০-১৫০ টি নারিকেল পাওয়া যায়।

Content added || updated By

অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন 

১। লিচু বাগানের জন্য মাটির উপযুক্ত পিএইচ মান কত ? 

২। লিচুর মাইট পাকা দমনে কি কীটনাশক ব্যবহার করা হয় ? 

৩। লিচু সংরক্ষণের জন্য তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা কত হওয়া উচিত ? 

৪। নারিকেল গাছের জন্য গর্তে গোবর এবং জিপসাম সার কত গ্রাম দিতে হয় ? 

৫। নারিকেলের শীর্ষ পচা রোগ দমনে কি ছত্রাকনাশক ব্যবহার করবেন ? 

৬। বাগানে লিচু গাছ কত দুরে দুরে লাগাতে হয় ? 

সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন 

১। নারিকেল চারা রোপণ পদ্ধতি ও দূরত্ব সম্পর্কে লেখ। 

২। লিচু গাছ রোপণের সময় ও দূরত্ব লেখ । 

৩। চিত্রসহ নারিকেলের চারা রোপণ পদ্ধতি লেখ । 

৪। লিচু সংগ্রহ ও সংরক্ষণ কৌশল লেখ। 

৫। নারিকেল সংগ্রহ কৌশল লেখ । 

৬। নারিকেল চাষের জন্য জমি নির্ধারন ও জমি তৈরি সম্পর্কে লেখ । 

রচনামূলক প্রশ্ন 

১। নারিকেলের চারা রোপণের জন্য গর্ত তৈরি, সার প্রয়োগ ও অন্তবর্তীকালীন পরিচর্যা সম্পর্কে লেখ । 

২। লিচুর চাষাবাদ কৌশল বর্ণনা কর । 

৩। নারিকেল ও লিচুর প্রধান প্রধান পোকাও রোগবালাই দমন কৌশল বর্ণনা কর । 

৪। নারিকেল ও লিচুর রোপণ পরবর্তী পরিচর্যা বর্ণনা কর । 

৫। বয়স্ক লিচু গাছে নারিকেল গাছে প্রয়োগের জন্য সারের নাম ও পরিমাণ ছক আকারে লেখ।

Content added By