SATT ACADEMY

New to Satt Academy? Create an account


or

Log in with Google Account

নবম শ্রেণি (মাধ্যমিক ২০২৪) - বিজ্ঞান (অনুসন্ধানী পাঠ) - Science (Investigative Study) - NCTB BOOK

পর্যায় সারণিতে অবস্থিত 11৪টি মৌলের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম সম্পর্কে ধারণা থাকলে রসায়ন সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় বুঝতে সুবিধা হয়। কিছু কিছু মৌলিক পদার্থ একই রকম ধর্ম প্রদর্শন করে। তাই, একই রকম ধর্ম প্রদর্শন করে পদার্থসমূহকে একই গ্রুপে রেখে সকল মৌলিক পদার্থের জন্য একটি ছক তৈরি করার চেষ্টা বিজ্ঞানীরা বহুকাল ধরেই করে আসছিলেন। বিজ্ঞানীদের এই প্রচেষ্টা সফল হয়েছিল বিভিন্ন সময়ে এই ছকের বিভিন্ন পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মধ্য দিয়ে, যা আজকে আধুনিক পর্যায় সারণি (Periodic Table) হিসেবে পরিচিত। সুতরাং, এই পর্যায় সারণি বিজ্ঞানীদের এক অসামান্য অবদান। এই অধ্যায়ে পর্যায় সারণির ধারণা ও পর্যায় সারণিতে অবস্থিত মৌলসমূহ সম্পর্কে বিভিন্ন দিক তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।

৬.১ পর্যায় সারণির ধারণা ও পটভূমি

পদার্থ ও তাদের ধর্ম সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন ধারণার সম্মিলিত প্রকাশ হচ্ছে পর্যায় সারণি। এই পর্যায় সারণি একজন বিজ্ঞানীর কোনো একক প্রচেষ্টা বা গবেষণার ফলে তৈরি হয়নি, এটি অনেক বিজ্ঞানীর অনেক দিনের অক্লান্ত পরিশ্রম ও গবেষণার ফলে আধুনিক পর্যায় সারণিতে রূপ নিয়েছে। নিচে এই আধুনিক পর্যায় সারণি তৈরি হওয়ার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:

1989 সালে বিজ্ঞানী ল্যাভয়সিয়ে (Lavoisier) কিছু মৌলিক পদার্থসমূহকে ধাতু ও অধাতু এই দুই ভাগে ভাগ করেছেন। এই মৌলিক পদার্থগুলো হচ্ছে- অক্সিজেন (০), নাইট্রোজেন (N), হাইড্রোজেন (H), ফসফরাস (P), মার্কারি (Hg), জিঙ্ক (Zn), সালফার (S), ইত্যাদি। সুতরাং, বিজ্ঞানী ল্যাভয়সিয়ের সময় পরবর্তী কালে বিজ্ঞানী ডোবেরাইনার (Dobereineir) একই রকম ধর্ম প্রদর্শন করে এরকম মৌলিক পদার্থসমূহকে তাদের পারমাণবিক ভর অনুযায়ী তিনটি করে মৌল দিয়ে সাজানোর চেষ্টা করেন। এক্ষেত্রে তিনি লক্ষ করেন যে, দ্বিতীয় মৌলের পারমাণবিক ভর প্রথম ও তৃতীয় মৌলের পারমাণবিক ভরের যোগফলের অর্ধেক বা তার কাছাকাছি হয় এবং একে 'ডোবেরাইনারের সূত্র' বলা হয়। এভাবে, ক্লোরিন (CI), ব্রোমিন (Br), এবং আয়োডিন (1) কে প্রথম ত্রয়ী মৌল হিসেবে তিনি চিহ্নিত করেন।

এরপর, 1829 সাল পর্যন্ত যে সকল মৌল আবিষ্কৃত হয়েছে, সেসব মৌলের জন্য ইংরেজ বিজ্ঞানী জন নিউল্যান্ড (John Newland) একটি সূত্র প্রদান করেন যা 'নিউল্যান্ড অষ্টক সূত্র' নামে পরিচিত। এই সূত্র অনুযায়ী তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষ করেন যে, যখন মৌলসমূহকে পারমাণবিক ভর কম থেকে বেশি অনুযায়ী সাজানো হয়, তখন এখানে একটি মৌলের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম তার অষ্টম মৌলের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্মের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

এরপর 1869 সালে রাশিয়ান বিজ্ঞানী মেন্ডেলিফ (Mendeleev) সকল মৌলসমূহের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম পর্যালোচনা করে একটি পর্যায় সূত্র প্রদান করেন যা মৌলসমূহের ধর্মগুলোর সঙ্গে তাদের পারমাণবিক ভর সম্পর্কিত। সূত্রটি এরকম: "মৌলসমূহের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম তাদের পারমাণবিক ভর বৃদ্ধির সঙ্গে পর্যায়ক্রমে আবর্তিত হয়"। এ সূত্র অনুযায়ী তখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত 63টি মৌলকে তিনি সাজিয়ে ছিলেন। মৌলসমূহকে 12টি আনুভূমিক সারি (horizontal) এবং ৪টি খাড়া কলাম (vertical) -এর একটি ছকে তাদের পারমাণবিক ভর বৃদ্ধি অনুসারে সাজান এবং দেখেন যে, একই কলামের সকল মৌলের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম একই রকম। আবার, একই সারির প্রথম থেকে শেষ মৌল পর্যন্ত মৌলসমূহের ধর্মের ক্রমান্বয়ে পরিবর্তন হয়। এই ছকটির নাম দেওয়া হয় পর্যায় সারণি (Periodic table)।

মেন্ডেলিফের এই পর্যায় সারণির গুরুত্বপূর্ণ সাফল্যের মধ্যে রয়েছে কিছু মৌলিক পদার্থের অস্তিত্ব সম্পর্কে সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করা। উল্লেখ্য, তখন মাত্র 63টি মৌলিক পদার্থ আবিষ্কৃত হয়েছিল। ফলে পর্যায় সারণির কিছু ঘর ফাঁকা রয়ে যায় এবং পরবর্তী কালে এই ফাঁকা ঘরগুলোর জন্য মেন্ডেলিফ যে সব মৌল ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন সেগুলো প্রমাণিত হয় বা মিলে যায়।

মেন্ডেলিফের পর্যায় সারণির সাফল্য যেমন- রয়েছে, তেমনি কিছু সীমাবদ্ধতাও ছিল। যেমন- পারমাণবিক ভর অনুযায়ী মেন্ডেলিফ তার পর্যায় সারণিতে যেভাবে মৌলসমূহকে বসিয়েছিলেন, সেই নিয়ম অনুযায়ী কম পারমাণবিক ভরের মৌল অধিক পারমাণবিক ভরের মৌলের আগে বসার কথা। কিন্তু এ নিয়মের ব্যতিক্রম দেখা যায়, যেমন- মেন্ডেলিফের পর্যায় সারণিতে আর্গন (Ar) -এর পারমাণবিক ভর 40 হওয়া সত্ত্বেও কম পারমাণবিক ভরের (39) পটাশিয়াম (K) -এর আগে বসিয়েছিলেন। এটা করা হয়েছিল শুধু একই গ্রুপের মৌলসমূহের ধর্মের মিল করানোর জন্য। এছাড়া হাইড্রোজেনকে পর্যায় সারণিতে সঠিক অবস্থান দিতে পারেননি।

এরপর 1913 সালে বিজ্ঞানী মোসলে (Moseley) মৌলসমূহকে পারমাণবিক ভরের পরিবর্তে পারমাণবিক সংখ্যা অনুযায়ী পর্যায় সারণিতে সাজানোর জন্য প্রস্তাব করেন। এ অনুযায়ী যখন পর্যায় সারণিকে সাজানো হলো তখন দেখা যায় যে, আর্গন (পারমাণবিক সংখ্যা 1৪) পটাশিয়ামের (পারমাণবিক সংখ্যা 19) আগে বসেছে। ফলে পারমাণবিক সংখ্যা অনুযায়ী পর্যায় সারণিতে মৌলসমূহকে স্থান দেওয়া হলে মেন্ডেলিফের ত্রুটিগুলো সংশোধিত হয়। আমরা জানি যে, আন্তর্জাতিক রসায়ন ও ফলিত রসায়ন সংস্থা IUPAC (International Union of Pure and Applied Chemistry এখন পর্যন্ত মোট 11৪টি মৌলের সন্ধান পেয়েছে। এই 11৪টি মৌলের মধ্যে বেশির ভাগ মৌলই প্রকৃতিতে পাওয়া যায়, আর কিছু মৌল গবেষণাগারে তৈরি হয়েছে।

কাজেই তোমরা দেখতে পাচ্ছ বিজ্ঞানী ল্যাভয়সিয়ে মাত্র 33টি মৌল নিয়ে ছক তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন। মেন্ডেলিফ কাজ করেছিলেন 63টি আবিষ্কৃত এবং 4টি অনাবিষ্কৃত মৌল নিয়ে। বর্তমানে সেটি 11৪টি মৌল নিয়ে তৈরি করা হয়েছে আধুনিক পর্যায় সারণি ,।

৬.২ পর্যায় সারণির বৈশিষ্ট্য

৬.২ চিত্রে পর্যায় সারণির বৈশিষ্ট্যগুলো দেখানো হয়েছে।

৬.৩ পর্যায় সারণিতে মৌনের অবস্থান নির্ণয়

যেহেতু পর্যায় সারণিতে মৌলগুলো তার পারমাণবিক সংখ্যা দিয়ে ধারাবাহিকভাবে সাজানো আছে তাই শুধু এই সংখ্যাটি জানা থাকলেই আমরা পর্যায় সারণিতে মৌলটির অবস্থান বের করে ফেলতে পারব। তারপরেও পর্যায় সারণি সম্পর্কে আরেকটু গভীরভাবে জানার জন্য এবং মৌলের ইলেকট্রন বিন্যাসের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য আমরা কোনো একটি মৌল পর্যায় সারণির কোন গ্রুপ এবং কোন পিরিয়ডে রয়েছে তা বের করার জন্য মৌলটির ইলেকট্রন বিন্যাসের সাহায্য নিতে পারি। নিচে একটি মৌলের পর্যায় সারণিতে অবস্থান নির্ণয় সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো :

ক) মৌনের পর্যায় নম্বর নির্ণয় করার নিয়ম বা পদ্ধতি

কোনো মৌলের ইলেকট্রন বিন্যাস যদি লক্ষ করি, তাহলে মৌলটির ইলেকট্রন বিন্যাসের সবচেয়ে বাইরের বা সর্বোচ্চ প্রধান শক্তিস্তরের নম্বরই হচ্ছে ঐ মৌলটির পর্যায় নম্বর। যেমন- লিথিয়াম (Li) -এর ইলেকট্রন বিন্যাস হলো: Li(3) 1s² 2s²। এখানে Li -এর ইলেকট্রন বিন্যাসে সবচেয়ে বাইরের প্রধান শক্তিস্তর হচ্ছে 2। সুতরাং, লিথিয়াম 2 নম্বর পর্যায়ে অবস্থান করছে।

চিত্র ৬.২: পর্যায় সারণির বৈশিষ্ট্য
 

আবার পটাশিয়াম (K) -এর ইলেকট্রন বিন্যাস এরকম: K(19) 1s 2s 2p 3s 3p 4s এক্ষেত্রে, K -এর ইলেকট্রন বিন্যাসে সবচেয়ে বাইরের প্রধান শক্তিস্তর 4; সুতরাং, K পর্যায় সারণির 4 নম্বর পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত।

খ) মৌলের গ্রুপ নম্বর নির্ণয় করার নিয়ম

পর্যায় সারণিতে মৌলের গ্রুপ নম্বর বের করার জন্য কয়েকটি নিয়ম রয়েছে। সেগুলো হলো:

নিয়ম 1: কোনো মৌলের ইলেকট্রন বিন্যাসের বাইরের বা সর্বোচ্চ প্রধান শক্তিস্তরে যদি শুধু ও অরবিটাল থাকে, তাহলে ঐ অরবিটালে বিদ্যমান মোট ইলেকট্রন সংখ্যাই হচ্ছে মৌলটির গ্রুপ নম্বর।

উদাহরণ: হাইড্রোজেন (H) -এর ইলেকট্রন বিন্যাস হলো: H(1) 1s। এখানে অরবিটালে 1টি ইলেকট্রন রয়েছে। সুতরাং, নিয়ম অনুযায়ী গ্রুপ বা শ্রেণি নম্বর হচ্ছে 1।

নিয়ম 2: কোনো মৌলের ইলেকট্রন বিন্যাসের বাইরের প্রধান শক্তিস্তরে ও p অরবিটাল থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে, এই ৪ ও p অরবিটালে থাকা মোট ইলেকট্রনের সঙ্গে 10 যোগ করলে যে সংখ্যা পাওয়া যাবে সেই সংখ্যাটিই হবে ঐ মৌলের জন্য গ্রুপ নম্বর।

উদাহরণ: বোরন (B) -এর ইলেকট্রন বিন্যাস হলো: B(5) 1s² 2s² 2p। এক্ষেত্রে, বোরনের বাইরের প্রধান শক্তিস্তরে ও p অরবিটালদ্বয়ে যথাক্রমে 2 ও 1টি ইলেকট্রন আছে। সুতরাং, বোরনের গ্রুপ নম্বর হবে (2110) 13 1

নিয়ম ও: কোনো মৌলের ইলেকট্রন বিন্যাসের বাইরের প্রধান শক্তিস্তরে অরবিটালে কয়টি ইলেকট্রন থাকে সেটি লক্ষ করতে হবে। আর তার আগের প্রধান শক্তিস্তরে যদি d অরবিটাল থাকে এবং এই d অরবিটালের ইলেকট্রন সংখ্যাও গণনায় নিতে হবে। এখন উক্ত ও অরবিটালের ইলেকট্রন সংখ্যা যোগ করলে যে সংখ্যা পাওয়া যাবে, সেটিই হচ্ছে ঐ মৌলের গ্রুপ নম্বর।

উদাহরণ: আয়রন (Fe) ইলেকট্রন বিন্যাস হলো ।  Fe(26) 1s2 2s2 2p6 3s2 3p6 3d6 4s2 এক্ষেত্রে, আয়রন (Fe) -এর বাইরের প্রধান শক্তিস্তরে অরবিটাল আছে এবং তার আগের প্রধান শক্তিস্তরে d অরবিটাল আছে। এখানে এ অরবিটালে চটি এবং অরবিটালে 2টি ইলেকট্রন রয়েছে। সুতরাং, আয়রন (Fe) -এর গ্রুপ নম্বর হবে 6281

নিচের ছকে কিছু মৌলের ইলেকট্রন বিন্যাস দেখানো হলো যেখান থেকে মৌলের পর্যায় নম্বর ও গ্রুপ নম্বর সহজেই বের করা যাবে।

উপরোল্লিখিত ছকে বাইরের স্তরের ইলেকট্রন বিন্যাসকে লাল রং দিয়ে দেখানো হয়েছে।

সুতরাং, উপরের আলোচনা থেকে বুঝা যায় যে, কোনো মৌলের ইলেকট্রন বিন্যাসের মাধ্যমে সেটি কত নম্বর পিরিয়ডে এবং কত নম্বর গ্রুপে অবস্থান করছে তা বের করা সম্ভব। অর্থাৎ, ইলেকট্রন বিন্যাসই পর্যায় সারণির মূল ভিত্তি, এই কথাটি বলা যায়।

৬.৪ পর্যায় সারণির কিছু ব্যতিক্রম

পর্যায় সারণির কিছু মৌলের তাদের ধর্ম অনুযায়ী ব্যতিক্রমী অবস্থান লক্ষ করা যায়। নিচে এরকম কিছু ব্যতিক্রম উল্লেখ করা হলো:

১) হাইড্রোজেন (H) -এর অবস্থান

হাইড্রোজেন মৌল হচ্ছে অধাতু। হাইড্রোজেনের কিছু ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য তীব্র ধনাত্মক ক্ষারীয় ধাতুর সঙ্গে আবার হ্যালোজেন মৌলসমূহের সঙ্গেও মিলে যায়। কিন্তু পর্যায় সারণিতে হাইড্রোজেনকে ক্ষারীয় ধাতু 

যেমন- Na, K, Rb, Cs, Fr -এর সঙ্গে গ্রুপ-1 এ রাখা হয়েছে। এখানে ক্ষারীয় ধাতুর সঙ্গে হাইড্রোজেন মৌলের মিল হলো ক্ষার ধাতুর মতো হাইড্রোজেনের বাইরের প্রধান শক্তিস্তরে 1টি ইলেকট্রন আছে (যেমন- H (1) 1s¹; Na(11) 1s² 2s² 2p 3s¹। অন্যদিকে, হ্যালোজেন মৌলসমূহের (যেমন- F, Cl, Br, I) বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এদের একটি পরমাণু অন্য মৌল থেকে 1টি ইলেকট্রন গ্রহণ করতে পারে; তেমনিভাবে হাইড্রোজেনও 1টি ইলেকট্রন গ্রহণ করতে পারে যা হ্যালোজেন মৌলসমূহের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিলে যায়। উল্লেখ্য, হাইড্রোজেনের বেশিরভাগ ধর্মসমূহ ক্ষার ধাতুসমূহের ধর্মের সঙ্গে মিলে যায়। ফলে, হাইড্রোজেনকে ক্ষার ধাতুর সঙ্গে গ্রুপ-1 এ রাখা হয়েছে।

২) ন্যান্থানাইড (Lanthanides) এবং অ্যাকটিনাইড (Actinides) মৌনসমূহের অবস্থান

পর্যায় সারণিতে ল্যান্থানাইড (Lanthanides) এবং অ্যাকটিনাইড সারির মৌলগুলোর অবস্থান যথাক্রমে 6 নম্বর পর্যায় ও ও নম্বর গ্রুপ এবং 7 নম্বর পর্যায় ও ও নম্বর গ্রুপে। আসলে, উক্ত অবস্থানগুলোতে এই মৌলগুলোকে বসালে পর্যায় সারণির প্রস্থ অহেতুক অনেক দীর্ঘ হয়। তাই এই মৌলসমূহকে পর্যায় সারণির নিচে আলাদাভাবে রাখা হয়েছে।

৬.৫ মৌলের পর্যায়ভিত্তিক ধর্মসমূহ (Periodic properties of elements)

পর্যায় সারণিতে দেখা যায় যে, মৌলগুলোর বৈশিষ্ট্য তাদের পারমাণবিক সংখ্যার সঙ্গে পর্যায়ক্রমে আবর্তিত হয়। অর্থাৎ, এ বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়মিত বিরতিতে পুনরায় দেখা যায় বা একটি নির্দিষ্ট প্রবণতা অনুসরণ করে। এই বিষয়গুলো মৌলসমূহের পর্যায়ক্রমিকতা (periodicity) হিসেবে পরিচিত। পর্যায় সারণিতে মৌলসমূহের বিভিন্ন ধর্ম রয়েছে। এগুলো হচ্ছে ধাতব ধর্ম, অধাতব ধর্ম, পরমাণু আকার, তড়িৎ ঋণাত্মকতা, আয়নিকরণ শক্তি, ইলেকট্রন আসক্তি ইত্যাদি। এই ধর্মসমূহ হলো মৌলগুলোর পর্যায়ভিত্তিক ধর্ম এবং এ ধর্মগুলো ৬.৩ চিত্রে দেখানো হয়েছে।

ক) ধাতব ধর্ম (Metallic properties)

ধাতব মৌলসমূহের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরা চকচকে হয়, আঘাত করলে ধাতব শব্দ করে এবং তাপ ও বিদ্যুৎ পরিবাহী। কোনো মৌলের পরমাণুর ইলেকট্রন ত্যাগ করার প্রবণতা দিয়ে ওই মৌলটির ধাতব ধর্ম বোঝা যায়। যেসব মৌল এক বা একাধিক ইলেকট্রন ত্যাগ করতে পারে এবং ইলেকট্রন ত্যাগ করে ধনাত্মক আয়নে পরিণত হয়, তাদেরকে ধাতু বলা হয়। যেমন- সোডিয়াম (Na) একটি ইলেকট্রন ত্যাগ করে সোডিয়াম আয়নে (Na+) পরিণত হয়, তাই সোডিয়াম একটি ধাতু।

Na Na+ + e-

অন্যভাবে বলা যায় কোনো মৌলের পরমাণু যত সহজে ইলেকট্রন ত্যাগ করতে পারবে তার ধাতব ধর্ম তত বেশি। পর্যায় সারণি অনুসারে, পর্যায় সারণির যে কোনো পর্যায়ের বাম থেকে ডান দিকে গেলে মৌলগুলোর ধাতব ধর্ম হ্রাস পায়।

খ) অধাতব ধর্ম (Non-metallic properties)

কোনো মৌলের পরমাণুর ইলেকট্রন গ্রহণ করার প্রবণতা দিয়ে ওই মৌলটি অধাতব কি না তা বোঝা যায়। অর্থাৎ কোনো মৌলের পরমাণু যত সহজে ইলেকট্রন গ্রহণ করতে পারবে, তার অধাতব ধর্ম তত বেশি হবে। যেসব মৌল এক বা একাধিক ইলেকট্রন গ্রহণ করতে পারে এবং ইলেকট্রন গ্রহণের ফলে ঋণাত্মক আয়নে পরিণত হয়, তাদেরকে অধাতু বলে। যেমন- ক্লোরিন (CI) একটি ইলেকট্রন গ্রহণ করে ঋণাত্মক আয়ন (Cl-) -এ পরিণত হয়। তাই, ক্লোরিন (CI) একটি অধাতু।

পর্যায় সারণির যে কোনো পর্যায়ে যখন বাম থেকে ডান দিকে যাওয়া হয় তখন মৌলগুলোর অধাতব ধর্ম বৃদ্ধি পায়।

পর্যায় সারণি লক্ষ করলে দেখা যায় যে, কিছু মৌল আছে যারা কোনো কোনো সময় ধাতুর মতো আচরণ করে, আবার কোনো কোনো সময় অধাতুর মতো আচরণ করে, এদেরকে অপধাতু বলা হয়। এই অপধাতুসমূহ অবস্থা অনুযায়ী ইলেকট্রন ত্যাগ ও গ্রহণ দুটোই করতে পারে। আর্সেনিক (As) হচ্ছে এরকম একটি অপধাতু।

গ) পরমাণুর আকার/পারমাণবিক ব্যাসার্ধ (Size of atoms/Atomic radius)

পর্যায় সারণির যে কোনো একটি পর্যায়ের বাম দিক থেকে ডান দিকে গেলে পরমাণুর আকার কমতে থাকে, অর্থাৎ পরমাণুর ব্যাসার্ধ কমে যায়। আবার, যে কোনো একটি গ্রুপের উপর থেকে নিচের দিকে গেলে পরমাণুর আকার বাড়তে থাকে অর্থাৎ পরমাণুর ব্যাসার্ধ বেড়ে যায়। একটি পরমাণুর আকার মূলত নির্ধারিত হয় তার প্রধান শক্তিস্তর দিয়ে। পর্যায় সারণি লক্ষ করলে দেখা যায়, একই পর্যায়ের বাম দিক থেকে ডান দিকে গেলে পারমাণবিক সংখ্যা বা ইলেকট্রনের সংখ্যা বাড়তে থাকে কিন্তু প্রধান শক্তি স্তরের সংখ্যা বাড়ে না। পারমাণবিক সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাইরে অবস্থিত ইলেকট্রন সংখ্যার সঙ্গে নিউক্লিয়াসে বিদ্যমান প্রোটনের সংখ্যা বেড়ে যায়। সে কারণে নিউক্লিয়াসে অবস্থিত প্রোটন এবং নিউক্লিয়াসের বাইরে অবস্থিত ইলেকট্রনসমূহের মধ্যে আকর্ষণ বেশি হয়। তখন ইলেকট্রনগুলোর শক্তিস্তর নিউক্লিয়াসের কাছে চলে আসে, ফলস্বরূপ, পরমাণুর আকার ছোটো হয়ে যায় বা তার ব্যাসার্ধ ছোটো হয়ে যায় (চিত্র ৬.৪)।

আবার, পর্যায় সারণির একই গ্রুপের যতই উপর থেকে নিচের দিকে যাওয়া হয়, পরমাণুতে ততই বাইরের দিকে একটি করে নতুন শক্তিস্তর যুক্ত হয়। নতুন শক্তিস্তর যুক্ত হলে পরমাণুর আকারও বৃদ্ধি পায় বা ব্যাসার্ধ বেড়ে যায়।

এখানে উল্লেখ্য, একই গ্রুপের উপর থেকে নিচের দিকে গেলে নিউক্লিয়াসে থাকা প্রোটন সংখ্যার সঙ্গে নিউক্লিয়াসের বাইরে অবস্থিত ইলেকট্রন সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে প্রোটন ও ইলেকট্রনের মধ্যে আকর্ষণ বেড়ে পরমাণুর আকার যতটুকু হ্রাস পায়, পরমাণুতে একটি নতুন শক্তিস্তর যোগ হলে পরমাণুর আকার তার চেয়ে বেশি বৃদ্ধি পায়। ফলে একই গ্রুপের উপরের দিকের মৌলের চেয়ে নিচের মৌলের আকার বড়ো হয়।

ঘ) আয়নিকরণ শক্তি (lonization energy)

গ্যাসীয় অবস্থায় কোনো মৌলের পরমাণু থেকে একটি ইলেকট্রন অপসারণ করে সেটিকে ধনাত্মক আয়নে পরিণত করতে যে পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন হয়, তাকে ঐ মৌলের আয়নিকরণ শক্তি বলে। পারমাণবিক ব্যাসার্ধ কমলে মৌলের নিউক্লিয়াসে থাকা প্রোটনগুলো আরও বেশি বলপ্রয়োগ করে ইলেকট্রনগুলোকে আকর্ষণ করতে পারে, তাই ইলেকট্রনগুলোকে অপসারণ করতে আরও বেশি শক্তি প্রয়োগ করতে হয়। সেজন্য পারমাণবিক ব্যাসার্ধ কমলে আয়নিকরণ শক্তির মান বাড়ে এবং পারমাণবিক ব্যাসার্ধ বাড়লে আয়নিকরণ শক্তির মান কমে।

তোমরা দেখেছ পর্যায় সারণির কোনো গ্রুপের উপর থেকে নিচের দিকে গেলে পরমাণুর আকার বৃদ্ধি পায়, কাজেই তার আয়নিকরণ শক্তি হ্রাস পায়। আবার অন্যদিকে একটি পর্যায়ের বাম থেকে ডানদিকে গেলে যেহেতু পরমাণুর আকার হ্রাস পায় তাই তার আয়নিকরণ শক্তি বৃদ্ধি পায়।

উদাহরণ : পর্যায়-ও এ লক্ষ করলে দেখা যায়, সোডিয়াম (Na), ম্যাগনেসিয়াম (Mg), অ্যালুমিনিয়াম (Al), সিলিকন (Si) -এর মধ্যে সিলিকনের পারমাণবিক ব্যাসার্ধ সবচেয়ে কম হওয়ায় সিলিকনের আয়নিকরণ শক্তি বেশি হবে। আবার, গ্রুপ-1 এ লিথিয়াম (Li), সোডিয়াম (Na), পটাশিয়াম (K), রুবিডিয়াম (Rb) সিজিয়াম (Cs), ফ্রানসিয়াম (Fr) -এর মধ্যে লিথিয়ামের পারমাণবিক ব্যসার্ধ সবচেয়ে কম, সুতরাং লিথিয়ামের আয়নিকরণ শক্তির মান এই মৌলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি।

ঙ) ইলেকট্রন আসক্তি (Electron affinity)

গ্যাসীয় অবস্থায় কোনো মৌলের পরমাণুতে একটি বাড়তি ইলেকট্রন সংযুক্ত করে ঋণাত্মক আয়নে পরিণত করা হলে যে পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়, সেটিই হচ্ছে ওই মৌলের ইলেকট্রন আসক্তি। আয়নীকরণ শক্তির মতোই মৌলের পারমাণবিক ব্যাসার্ধ কমলে ইলেকট্রন আসক্তি বাড়ে এবং পারমাণবিক ব্যাসার্ধ বাড়লে ইলেকট্রন আসক্তির মান কমে।

চ) তড়িৎ ঋণাত্মকতা (Electronegativity)

একটি অণুতে যখন দুটি পরমাণু বন্ধনে আবদ্ধ থাকে, তখন ওই বন্ধনের জন্য দু'টি ইলেকট্রনের প্রয়োজন হয়। দুটি পরমাণুই ইলেকট্রন দুটিকে নিজের দিকে আকৃষ্ট রাখতে চায়। যে পরমাণু যত বেশি আকৃষ্ট করতে পারবে, ইলেকট্রন দুটি সেই পরমাণুর তত কাছে থাকবে। এই আকৃষ্ট করা বা আকর্ষণকে তড়িৎ ঋণাত্মকতা বলে। একই মৌলের দুইটি পরমাণু হলে দুটি পরমাণুই ইলেকট্রন দুটিকে সমান পরিমাণ আকর্ষণ করবে, তাই ইলেকট্রন পরমাণু দুইটির ঠিক মাঝখানে থাকবে। একটি মৌলের তড়িৎ ঋণাত্মকতা অন্যটি থেকে বেশি হলে ইলেকট্রন দুটি সেই পরমাণুর কাছাকাছি থাকবে। পর্যায় সারণিতে একই পর্যায়ের বামদিকের মৌলের পারমাণবিক ব্যাসার্ধ ডানদিকের মৌলের পারমাণবিক ব্যাসার্ধ থেকে বেশি হওয়ায় তাদের মৌলের তড়িৎ ঋণাত্মকতা অপেক্ষাকৃত কম হয়। সবচেয়ে কম (0.7) তড়িৎ ঋণাত্মকতা সর্ববামে এবং সর্বনিচের 85Fr মৌলটির। অন্যদিকে সবচেয়ে বেশি (4.0) তড়িৎ ঋণাত্মকতা নিষ্ক্রিয় গ্যাস ব্যতীত সর্বডানে এবং সবচেয়ে উপরের ফ্লোরিন (9F) মৌলের।

উদাহরণ: ও নম্বর পর্যায়ে অবস্থিত সোডিয়াম (Na) -এর তড়িৎ ঋণাত্মকতার মান ক্লোরিন (Cl) -এর থেকে কম। অর্থাৎ ক্লোরিনের তড়িৎ ঋণাত্মকতা বেশি। এখানে আমরা ইলেকট্রন দুটিকে সোডিয়াম থেকে সবচেয়ে দূরে ক্লোরিনের সবচেয়ে কাছে দেখে থাকি। প্রকৃতপক্ষে সেটি দুটি পরমাণুরই আয়নিত অবস্থা।

৬.৬ পর্যায় সারণির গুরুত্ব

পর্যায় সারণির নানাবিধ সুবিধা রয়েছে। সবকটি মৌল এক সারণিতে থাকার কারণে একটি সামগ্রিক ছবি পাওয়া যায়। যে কোনো মৌলের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে খুব দ্রুত ধারণা নেওয়া যায়। এমনকি এখনও আবিষ্কৃত হয়নি এমন কোনো মৌলের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেও অনুমান করা যায়। নিচে পর্যায় সারণির গুরুত্বপূর্ণ কিছু সুবিধা আলোচনা করা হলো।

ক) রসায়ন অধ্যয়ন সহজতর হওয়া

তোমরা জানো যে, এখন পর্যন্ত 11৪টি মৌল আবিষ্কৃত হয়েছে। এ মৌলগুলোর গলনাঙ্ক, স্ফুটনাঙ্ক, অ্যাসিড ও ক্ষারের সঙ্গে বিক্রিয়া ইত্যাদিসহ এরও অনেক ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম রয়েছে। এ ধর্মসমূহকে একসঙ্গে জানা বা মনে রাখা সম্ভব নয়। কিন্তু, তুমি যদি পর্যায় সারণির কোনো একটি গ্রুপের সাধারণ ধর্ম জানো, তাহলে ওই গ্রুপের সকল মৌল সম্বন্ধে একটি সাধারণ ধারণা লাভ করা যায়। সুতরাং, পর্যায় সারণিতে যে 1৪টি গ্রুপ ও টি পর্যায়ে রয়েছে, সেখানে অবস্থিত সকল মৌল সম্বন্ধে সহজে ধারণা পেতে পর্যায় সারণির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এছাড়া, পর্যায় সারণি সম্পর্কে  ভালো ধারণা থাকলে সেখানে অবস্থিত বিভিন্ন মৌল নিয়ে গঠিত তাদের যৌগের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেও ধারণা লাভ করা সহজতর হয়। 

খ) নতুন মৌনের ধারণা ও আবিষ্কার

পর্যায় সারণিতে যেটি পর্যায় ও 1৪টি গ্রুপ রয়েছে একটি সময় পর্যন্ত সেখানে কিছু ঘর ফাঁকা ছিল। পরবর্তী কালে সে ফাঁকা ঘরের মৌলগুলো আবিষ্কৃত হয়। কিন্তু তার আগেই এই ফাঁকা ঘরের আবিষ্কৃত মৌলগুলোর ধর্ম কেমন হবে তা পর্যায় সারণি থেকে অনুমান করা সম্ভব হয়েছিল। বিজ্ঞানী মেন্ডেলিফ তাঁর সময়ে আবিষ্কৃত 63টি মৌল পর্যায় সারণিতে স্থান দিতে গিয়ে কিছু মৌলের অস্তিত্ব সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যা পরবর্তী কালে আবিষ্কৃত হয়েছিল।

গ) গবেষণায় ভূমিকা

আমরা জানি যে, নতুন কোনো পদার্থ গবেষণার মাধ্যমেই আবিষ্কৃত হয়। এই নতুন পদার্থের ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য কেমন হবে তা আগে থেকেই কিছু ধারণা থাকলে গবেষণায় সুবিধা হয়। কারণ, সেইসব ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য সংবলিত পদার্থ তৈরি করতে কি ধরনের মৌল প্রয়োজন হবে তা পর্যায় সারণি থেকে ধারণা পাওয়া যেতে পারে।

পর্যায় সারণির উপরোল্লিখিত সুবিধাসমূহ ছাড়া আরও অনেক ব্যবহার রয়েছে যা তোমরা উচ্চতর শ্রেণিতে জানতে পারবে।

 

Content added By

Promotion