SATT ACADEMY

New to Satt Academy? Create an account


or

Log in with Google Account

নবম শ্রেণি (মাধ্যমিক ২০২৪) - ইসলাম শিক্ষা - Islamic Study - আখলাক | NCTB BOOK

আখলাকে হামিদাহ (প্রশংসনীয় চরিত্র)

হামিদাহ' শব্দের অর্থ প্রশংসনীয়। আখলাকে হামিদাহ হলো মানুষের প্রশংসনীয় চরিত্র, সুন্দর চরিত্র, উত্তম গুণাবলি, সচ্চরিত্র ইত্যাদি। ইসলামি পরিভাষায়, যেসব স্বভাব বা চরিত্র আল্লাহ তা'আলা এবং রাসুলুল্লাহ (সা.)- এর নিকট পছন্দনীয় ও সমাদৃত তাকে 'আখলাকে হামিদাহ' বলা হয়।

এককথায়, মানব চরিত্রের উত্তম, সুন্দর, নির্মল ও মার্জিত গুণাবলিকে আখলাকে হামিদাহ বলা হয়। যেমন, ধৈর্য্য, সততা, সত্যবাদিতা, ওয়াদা পালন, মানব সেবা, দেশপ্রেম, দয়া, ক্ষমা ইত্যাদি।

আমরা তাওয়াক্কুল, শ্রমের মর্যাদা, সৌহার্দ্য ও সাম্য, শিশুদের প্রতি সদাচার, মাতা-পিতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য, প্রবীণ ও বয়োজ্যেষ্ঠদের মর্যাদা ও অধিকার, হালাল উপার্জন ও সমাজসেবা প্রভৃতি প্রশংসনীয় গুণাবলি সম্পর্কে জানব।

 

তাওয়াক্কুল

তাওয়াক্কুল' আরবি শব্দ। এর অর্থ ভরসা করা, নির্ভর করা, আস্থা রাখা ইত্যাদি। পরিভাষায়, যেকোনো প্রয়োজন কিংবা সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ তা'আলার ওপর পূর্ণরূপে নির্ভর করাকেই তাওয়াক্কুল বলে। অন্যকথায় তাওয়াক্কুল হলো, কল্যাণকর বিষয় অর্জনের জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করে ফলাফলের জন্য আল্লাহর ওপর ভরসা করা এবং তাকদিরের ওপর বিশ্বাস রাখা।

তাওয়াক্কুলের গুরুত্ব ও ফযিলত

ইসলামে তাওয়াক্কুলের গুরুত্ব অপরিসীম। মহান আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুলের পরিমাণ যার যত বেশি, তার সফলতাও তত বেশি। কারণ সফলতা একমাত্র আল্লাহরই হাতে। তাওয়াক্কুলের গুণ অর্জনের জন্য পবিত্র কুরআনে অনেক নির্দেশনা রয়েছে। আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করা মু'মিনের একটি অপরিহার্য গুণ। আল্লাহর ওপর পূর্ণ তাওয়াক্কুলের মাধ্যমে ইমান বৃদ্ধি পায়। বিশ্বাস মজবুত হয়। এটি ইমানের শর্ত। আল্লাহ তা'আলা বলেন,

اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ وَعَلَى اللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُوْنَ 

অর্থ: আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই। সুতরাং মু'মিনগণ আল্লাহর ওপর নির্ভর করুক। (সূরা আত তাবাগুন, আয়াত: ১৩)

অন্য আয়াতে এসেছে      

وَعَلَى اللَّهِ فَتَوَكَّلُوا إِنْ كُنْتُمْ مُّؤْمِنِينَ .

অর্থ: আর আল্লাহর ওপর তোমরা নির্ভর করো, যদি তোমরা মু'মিন হও। (সূরা আল মায়িদা, আয়াত: ২৩)

তাওয়াক্কুলের ফল অতি উত্তম। আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করলে মন শান্ত থাকে। মনে প্রশান্তি আসে। কেননা আল্লাহ তো রাজাধিরাজ। তিনি চিরঞ্জীব ও মহাপরাক্রমশালী। তিনি যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারেন। মহান আল্লাহ বলেন,

وَتَوَكَّلْ عَلَى الْعَزِيزِ الرَّحِيمِ 

অর্থ: আর তুমি নির্ভর করো মহাপরাক্রমশালী, পরম দয়ালুর ওপর। (সূরা আশ্ শু'আরা, আয়াত: ২১৭)

তাওয়াক্কুল একটি ইবাদাত। প্রতিটি কাজে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করা মু'মিনের জন্য আবশ্যক। মু'মিন ব্যক্তি কাজের জন্য দৃঢ় সংকল্প করবে। কাজ সম্পাদনের জন্য সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করবে। সে সফল না হলে মুষড়ে পড়বে না। কেননা, তাওয়াক্কুলকারী কখনো হতাশ হয় না। বিপদ-সংকটে ঘাবড়ে যায় না। ঘোর অন্ধকারে আশার আলো দেখে। আল্লাহকে উপকার ও ক্ষতির একমাত্র মালিক বলে বিশ্বাস করে। সর্বাবস্থায় আল্লাহ তা'আলার ওপর দৃঢ় আস্থা রাখে। এটি তাওয়াক্কুলের সর্বোচ্চ পর্যায়। আল্লাহ তা'আলা বলেন,

فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِينَ 

অর্থ: অতঃপর আপনি কোনো সংকল্প করলে তখন আল্লাহর ওপর নির্ভর করবেন, নিশ্চয় আল্লাহ তাওয়াক্কুলকারীদের ভালোবাসেন। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫৯)কুরআন ও হাদিসে তাওয়াক্কুলের অনেক ফযিলত ও উপকারিতা বর্ণনা করা হয়েছে। কেউ যদি আল্লাহর ওপর শতভাগ তাওয়াক্কুল করে, তাহলে আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট হয়ে যান। সে দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা লাভ করে। আর আল্লাহ তা'আলা তার রিযিকের জিম্মাদার হয়ে যান। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'তোমরা যদি প্রকৃতভাবেই আল্লাহ তা'আলার ওপর নির্ভরশীল হতে, তাহলে পাখিদের যেভাবে রিযিক দেওয়া হয়, সেভাবে তোমাদেরও রিযিক দেওয়া হতো। এরা সকালবেলা খালি পেটে বের হয় এবং সন্ধ্যাবেলায় ভরা পেটে ফিরে আসে।' (তিরমিযি)

তাওয়াক্কুলের পদ্ধতি

তাওয়াক্কুল মানে চেষ্টা সাধনা না করে শুধু আল্লাহর ওপর ভরসা করে হাত গুটিয়ে বসে থাকা নয়। আল্লাহ তা'আলা দুনিয়াকে জীবনোপকরণের কেন্দ্রবিন্দু বানিয়েছেন। তাই জীবন উপকরণ গ্রহণ করতে হবে। শরিয়ত সমর্থিত উপকরণ গ্রহণ করা তাওয়াক্কুল পরিপন্থী নয়; বরং চেষ্টা করার দায়িত্ব আমাদের আর পূর্ণতা দান করবেন আল্লাহ। এ সম্পর্কে হাদিসে একটি ঘটনা বর্ণিত আছে। একবার এক বেদুইন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে এলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, 'তোমার বাহন তথা উট কোথায় রেখে এসেছ?' বেদুইন সাহাবি বললেন, 'ইয়া রাসুলুল্লাহ! মসজিদের বাইরে বাঁধনমুক্ত অবস্থায় রেখে এসেছি এবং আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করেছি। আল্লাহই দেখবেন আমার উট।' তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, 'আগে তোমার উটকে বাঁধো, তারপর আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করো।' (তিরমিযি) এ থেকে বোঝা যায়, পূর্ণ চেষ্টা-সাধনার পর আল্লাহ তা'আলার ওপর ভরসা করতে হবে।

পরিশেষে বলা যায়, তাওয়াক্কুল হলো তাওহিদের গুরত্বপূর্ণ একটি অংশ। মহান আল্লাহ হলেন সর্বশক্তিমান এবং যাবতীয় উপকার ও ক্ষতির একমাত্র মালিক। তাই আমরা সর্বাবস্থায় আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করব।

হালাল উপার্জন

মু'মিন জীবনে হালাল উপার্জন একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। হালাল উপার্জনের ফলে মানুষের চিন্তা-চেতনা ও কর্মতৎপরতায় আসে পবিত্রতা। স্বভাব-চরিত্র সুন্দর হয়। সুকুমার বৃত্তির বিকাশ ঘটে। ধর্মানুরাগী হতে সহায়তা করে।

'হালাল' আরবি শব্দ। এর অর্থ বৈধ ও পবিত্র। সাধারণত শরিয়ত অনুমোদিত বিষয়কে হালাল বলা হয়। আর উপার্জন হলো, রোজগার ও আয়। সুতরাং হালাল উপার্জন বলতে বিধিসম্মত রোজগার, বৈধ আয়, বৈধ উপার্জন ইত্যাদিকে বুঝায়।

পরিভাষায়, ইসলামি শরিয়ত কর্তৃক অনুমোদিত পন্থায় আয়-রোজগার করাকে হালাল উপার্জন বলে। অন্য কথায় আল্লাহ তা'আলা প্রদত্ত ও রাসুলুল্লাহ (সা.) নির্দেশিত পন্থায় কুরআন ও সুন্নাহর মূলনীতি অনুযায়ী উপার্জন করাকে হালাল উপার্জন বলে।

হালাল উপার্জনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের শান্তি ও নিরাপত্তা নির্ভর করে হালাল উপার্জনের ওপর। তাই মানবজীবনে হালাল উপার্জনের গুরুত্ব অপরিসীম।

আল্লাহ তা'আলা মানুষকে হালাল জীবিকা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। হালাল জীবিকা গ্রহণের মাধ্যমে আল্লাহ তা'আলা নির্দেশ পালন করা যায়। হালাল উপার্জন ইমানের পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ফরয ইবাদাত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'হালাল জীবিকা উপার্জন করা ফরয ইবাদাতের পর আরেকটি ফরয কাজ।' (বায়হাকি) ইবাদাত কবুলের পূর্বশর্ত হলো হালাল জীবিকা গ্রহণ করা। তাই ইবাদাতে একাগ্রতা ও একনিষ্ঠতার জন্য হালাল জীবিকা ভক্ষণ করা জরুরি। আল্লাহ তা'আলা বলেন,

يَأَيُّهَا النَّاسُ كُلُوا مِمَّا فِي الْأَرْضِ حَلْلًا طَيِّبًا * وَلَا تَتَّبِعُوْا خُطُوتِ الشَّيْطَنِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِينٌ .

অর্থ: হে মানবজাতি! পৃথিবীতে যা কিছু বৈধ ও পবিত্র খাদ্যবস্তু রয়েছে তা হতে তোমরা খাও। আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না, নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৬৮)

হালাল উপার্জন মানুষকে কর্মপ্রেরণা দেয়। নিষিদ্ধ ও পাপ কাজ থেকে বিরত রাখে। অনৈতিক চিন্তা ও কর্ম থেকে বিরত রাখে। পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র জীবন যাপনে উৎসাহিত করে। ফলে সমাজেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।

হালাল উপার্জন করা নবি ও রাসুলগণের সুন্নাত। নবি ও রাসুলগণ হালাল পথে উপার্জন করেছেন। তাঁদের উম্মতকে হালাল পথে উপার্জন করতে নির্দেশ দিয়েছেন। কেননা, কায়িক শ্রমের মাধ্যমে যে খাবার অর্জিত হয় তা শ্রেষ্ঠতম খাবার। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,

مَا أَكَلَ أَحَدٌ طَعَامًا قَطَّ خَيْرًا مِنْ أَنْ يَأْكُلَ مِنْ عَمَلِ يَدِهِ

অর্থ: নিজ হাতে উপার্জিত খাদ্যের চেয়ে উত্তম খাদ্য কখনো কেউ খায় না। (বুখারি)

হালাল উপার্জনকারী আল্লাহ তা'আলার ভালোবাসার পাত্র। আল্লাহর বন্ধু। আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে পুরস্কৃত করবেন। হালাল উপার্জনের মাধ্যমে মহান আল্লাহ এবং রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আনুগত্য করা হয়। তাই হালাল পথে উপার্জনকারীকে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'পরিবারের জন্য হালাল উপার্জনকারী যেন আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারী।' (ইবনে মাজাহ)

মানুষ হালাল উপার্জনের প্রয়োজনে চাকরির পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। ফলে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। জাতীয় উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি সুনিশ্চিত হয়। শুধু তাই নয়, হালাল উপার্জনকারী ব্যক্তি কর্মঠ হিসেবে গড়ে ওঠে। তাই মহানবি (সা.) বলেছেন, 'দক্ষ কারিগরকে আল্লাহ ভালোবাসেন।'

হালালভাবে অর্জিত অর্থের প্রতি মানুষের মায়া থাকে। তাই অনর্থক ও গুনাহের কাজে টাকা ব্যয় করে না। এতে সমাজ থেকে আর্থিক অনাচার ও অপচয় দূর হয়; দুর্নীতি বিলুপ্ত হয়। অবৈধ ও জোরপূর্বক অর্থ আদায়ের চিন্তা দূর হয়। অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ ভক্ষণের কথা মাথায়ও আসে না। ফলে সমাজের সর্বত্র অনিয়ম ও দুর্নীতি কমে আসে। মানুষ নির্দ্বিধায়-নির্বিবাদে তার উপার্জন ভোগ করে। প্রশান্তিতে তার হৃদয় মন উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে।

অবৈধভাবে উপার্জনের সম্পদ দ্বারা যে শরীর বা প্রজন্ম গড়ে উঠবে, তা জাহান্নামের ইন্ধন হবে। তা দিয়ে মানুষের দুনিয়ার জীবন ধ্বংস হবে। তাদের পরিবার-পরিজনের জীবন নষ্ট হবে। আখিরাতের শাস্তি তো আছেই। কাজেই হালাল উপার্জনে সবার আত্মনিয়োগ করা প্রয়োজন।

হালাল উপার্জনের উপায়

নিষিদ্ধ ও হারাম পন্থা পরিহার করে কাজের মাধ্যমে হালাল উপার্জন করা যায়। যেমন: দৈহিক পরিশ্রম তথা কৃষিকাজ, ব্যবসা ও চাকুরি করে। তবে দৈহিক পরিশ্রমের ক্ষেত্রে কাজে ফাঁকি দিলে, কাজ যথাযথভাবে না করলে, নির্দেশিত পন্থার বিপরীত করলে তা হালাল হবে না। কৃষিকাজের ক্ষেত্রে অপরের জমি দখল বা অন্যের ক্ষতি করা যাবে না। ব্যবসার ক্ষেত্রে হারাম জিনিসের ব্যবসা করা যাবে না। আবার ব্যবসায় মিথ্যার আশ্রয় নিলে, মাপে কম-বেশি করলে, প্রতারণা ও ধোঁকার আশ্রয় নিলে, সিন্ডিকেট ও মজুদদারী করলে ব্যবসা হালাল হবে না। চাকরির ক্ষেত্রে অর্পিত দায়িত্ব ঠিকমতো পালন না করলে উপার্জন হালাল হবে না।

এছাড়াও নার্সারি ও বৃক্ষ রোপণ, মৎস্য চাষ, গবাদি পশু পালন, হাঁস-মুরগির খামার করা; ছোট-বড় কুটির শিল্প স্থাপন ইত্যাদির মাধ্যমে হালাল উপার্জন করা যায়।

মোটকথা, মুসলমান হিসেবে জীবন-যাপনের জন্য হালাল উপার্জনের বিকল্প নেই। প্রত্যেকটি মানুষ হালাল উপার্জনের চেষ্টা করলে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন সমাজ গড়ে উঠবে। এতে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে আর্থিক অনাচার ও লাগামহীন অপচয় রোধ হবে। আর মানুষের দেহ, মন ও আত্মার উন্নতি হবে। তারা ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি লাভ করবে।

 

জোড়ায় কাজ 

'দৈনন্দিন জীবনে তাওয়াক্কুল ও হালাল উপার্জন এর চর্চা বা প্রয়োগক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করো' 

(শিক্ষকের নির্দেশনা মোতাবেক তোমরা জোড়ায় পোস্টার/কাগজে উপস্থাপন করো)।

 

শ্রমের মর্যাদা

প্যানেল আলোচনা 

শিক্ষকের নির্দেশনা মোতাবেক সুনির্দিষ্ট বিষয়বস্তুর আলোকে তোমরা প্যানেল আলোচনা করে উপস্থাপন করো।

কর্ম সম্পাদনে দৈহিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তি ব্যয় করাকেই শ্রম বলে। আবার মানবতার কল্যাণ, নৈতিক উন্নয়ন, সৃষ্টির সেবা ও উৎপাদনে নিয়োজিত সকল প্রকার কায়িক ও মানসিক শক্তি ব্যয়কে শ্রম বলে।

পৃথিবীতে আজও মানুষ শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করছে, জীবন দিচ্ছে। অথচ প্রায় সাড়ে চৌদ্দশ বছর পূর্বেই ইসলাম শ্রমের মর্যাদা নিশ্চিত করেছে। নবি-রাসুলগণ জীবিকা উপার্জনের জন্য শ্রম ব্যয় করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তার সাহাবিগণও জীবিকা উপার্জনের জন্য বিভিন্ন পেশা গ্রহণ করেছেন। বিনাশ্রমে উপার্জন করাকে তারা ঘৃণা করতেন। প্রকৃতপক্ষে শ্রমের মাধ্যমেই মানুষের জীবনে সুখ আসে।

শ্রমের মর্যাদা

ইসলামে শ্রমের মর্যাদা অতুলনীয়। কেননা, শ্রমই হলো সকল উন্নয়ন ও উৎপাদনের চাবিকাঠি। যে জাতি যত বেশি পরিশ্রমী সে জাতি তত বেশি উন্নত। শ্রম আল্লাহ প্রদত্ত মানব জাতির জন্য এক অমূল্য শক্তি ও সম্পদ। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলা বলেন,

لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ فِي كَبَدٍ 

অর্থ: নিশ্চয় আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি কষ্ট-ক্লেশের মধ্যে। (সুরা আল বালাদ, আয়াত: ৪)

ইসলামে মালিক-শ্রমিকের মাঝে কোনো বৈষম্য নেই। মালিক পুঁজি দিচ্ছে আর শ্রমিক শ্রম দিচ্ছে। শ্রমিক মালিকের পরিবারভুক্ত। ইসলাম শ্রমিককে 'ভাই' হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'তোমাদের দাসরা তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ তাদের তোমাদের অধীন করেছেন। কাজেই কারো ভাই যদি তার অধীনে থাকে, তবে সে যা খায়, তা থেকে যেন তাকে খেতে দেয় এবং সে যা পরিধান করে, তা থেকে যেন পরিধান করায়।' (বুখারি) রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেও শ্রমিকের সঙ্গে বসে খেতেন।

শ্রম ব্যয় বা কাজ করা হলো নবিগণের সুন্নাত। প্রত্যেক নবিই জীবনে কোনো না কোনো কাজ করেছেন। তাঁরা কাজ করে উম্মতকে শ্রমের মর্যাদা শিক্ষা দিয়েছেন। যেমন: আদম (আ.) কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। পাশাপাশি হাওয়া (আ.) কাপড় বুনন, সেলাই ও কৃষি যন্ত্রপাতি নির্মাণ করে আদম (আ.)- কে সহযোগিতা করতেন। নূহ (আ.) কাঠের কাজ জানতেন, দাউদ (আ.) বর্ম প্রস্তুত করতেন, ইদরিস (আ.) দর্জির কাজ করতেন, শুয়াইব (আ.) ও সালেহ (আ.) ব্যবসা করতেন এবং মুসা (আ.) মেষ চরাতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'আল্লাহ দুনিয়াতে

এমন কোনো নবি পাঠাননি যিনি ছাগল ও ভেড়া চরাননি।' তখন সাহাবিগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে রাসুল (সা.) আপনিও? রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'হ্যাঁ! আমিও মজুরির বিনিময়ে মক্কাবাসীদের ছাগল ও ভেড়া চরাতাম।' (বুখারি) আমাদের নবি (সা.) নিজেও পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।

সাহাবায়ে কেরামও নবি (সা.)-এর পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। যেমন: হযরত আবু বকর (রা.), হযরত ওমর (রা.) ও হযরত উসমান (রা.) ব্যবসা করেছেন। হযরত আলি (রা.) বিনিময়ের মাধ্যমে কূপ থেকে পানি উঠানোর কাজ করতেন। খাব্বাব (রা.) কর্মকার ছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) মেষ-বকরি চরাতেন। আনসারগণ সাধারণত কৃষিকাজ করতেন। আর মুহাজিররাগণ ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। মহানবি (সা.) সব কাজেই সমানভাবে উৎসাহিত করতেন।

আল্লাহ তা'আলা নিখুঁত ও নির্ভুলভাবে সম্পন্ন শ্রমকে ভালোবাসেন। কেননা সর্বোত্তম শ্রমিক সেই যে শক্তিশালী ও দায়িত্বশীল হয়। এ ধরনের শ্রমিকের জন্য জাহান্নাম হারাম। হাদিসে এসেছে, সা'দ (রা.) কামারের কাজ করতেন। হাতুড়ি দিয়ে কাজ করতে করতে তাঁর হাত দুটি বিবর্ণ ও শক্ত হয়ে গিয়েছিল। একদিন নবি (সা.)-এর সঙ্গে তিনি করমর্দন করলেন। তখন নবি (সা.) সাদ (রা.)-কে হাতের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বলেন, হাতুড়ি দিয়ে কাজ করতে গিয়ে এ অবস্থা হয়েছে। নবি (সা.) তাঁর হাত চুম্বন করে বললেন, 'এ হাতকে কখনো জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না।' (বুখারি)

ইসলামে শ্রমের গুরুত্ব অনেক বেশি। বিশেষভাবে কায়িক শ্রম একটি উত্তম কাজ। কায়িক শ্রম মানুষের মনে অনন্য আনন্দ সৃষ্টি করে। এর দ্বারা তার আত্মবিশ্বাস বাড়ে। অন্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমে। নিজ হাতে অর্জিত জীবিকা সর্বোত্তম জীবিকা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'এর চেয়ে উত্তম খাদ্য আর নেই, যা মানুষ স্বহস্তে উপার্জনের মাধ্যমে ভক্ষণ করে।' (বুখারি)

আল্লাহ তা'আলা আদম সন্তান হিসেবে মানুষকে সম্মানিত করেছেন। তাই ইসলামে কোনো শ্রেণিবৈষম্য নেই। কোনো ধরনের শ্রমই ইসলামের দৃষ্টিতে মূল্যহীন নয়। প্রতিটি শ্রমই মর্যাদার। আর কোনো পেশাই ঘৃণিত নয়; বরং পরিশ্রম করা সর্বোত্তম কাজ। রাসুলুল্লাহ্ (সা.) খেটে খাওয়া মানুষের মর্যাদা বর্ণনা করে বলেন,

الْكَاسِبُ حَبِيْبُ اللَّهِ

অর্থ: শ্রমিক হলো আল্লাহর বন্ধু। (কানজুল উম্মাল)

ইসলামে ভিক্ষাবৃত্তি সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজ। যে কাজ না করে ভিক্ষা করবে, সে কিয়ামতের দিন মাংসহীন চেহারায় উঠবে। আর শ্রম দিলে সাহায্যের জন্য মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে হয় না। তাই শ্রম বিনিময় করা হাত পাতা অপেক্ষা উত্তম কাজ। মহানবি (সা.) বলেন, 'অন্যের নিকট হাত পাতার চেয়ে দড়ি নিয়ে জঙ্গলে যাওয়া এবং সেখান থেকে কাঁধে জ্বালানি কাঠ বহন করে আনা এবং তা দিয়ে জীবিকা উপার্জন করা উত্তম।' (বুখারি)

শ্রম আমাদের জীবনে এক অপরিহার্য বিষয়। শ্রমকে আল্লাহ তা'আলা নিয়ামতের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কেননা, আমরা শ্রমের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করি। জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করি। তাই তো আল্লাহ তা'আলা ইবাদাত শেষে শ্রম ব্যয়ের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, 'অতঃপর সালাত সমাপ্ত হলে তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করো ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ করবে, যাতে তোমরা সফল হও।' (সূরা জুমুআ, আয়াত: ১০) তবে কাজকর্ম করতে গিয়ে আল্লাহকে ভুলে যাওয়া যাবে না।

ইসলাম অলসতার সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। অলস মস্তিষ্কে শয়তান ধোঁকা দেয় বেশি। শ্রম মানুষকে অনর্থক ও অনৈতিক কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখে।

আল্লাহর কাছে বান্দার শ্রমের মর্যাদা অনেক বেশি। কারণ, দুনিয়া হচ্ছে আখিরাতের শস্যক্ষেত্র। আর শ্রমের মাধ্যমেই আখিরাতের সফলতা লাভ করা যায়। তাই আমরা যেকোনো ধরনের শ্রম ও পেশাকে সম্মান করব। নিজেরাও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পরিশ্রমী হব। 

সমাজসেবা

মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। তাই সামাজিক জীবনে পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানবসেবা ও সমাজসেবা ইসলামের অন্যতম লক্ষ্য। ইসলাম ও সমাজসেবা একটির সঙ্গে অন্যটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর ইসলাম মানুষকে অন্যের কল্যাণে পারস্পরিক সাহায্য- সহযোগিতা করতে অনুপ্রাণিত করে। মহান আল্লাহ বলেন,

تَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ "

অর্থ: সৎকর্ম ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পরকে সহযোগিতা করো এবং পাপ ও সীমালঙ্ঘনে একে অন্যের সহযোগিতা করো না। (সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ২)

সামাজিকভাবে জীবনযাপনের কোনো বিকল্প নেই। একে অন্যের পাশে দাঁড়িয়েই মানুষ সারা জীবন বসবাস করে। সুতরাং সমাজের বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর কল্যাণে স্বেচ্ছায় গৃহীত কাজকে সমাজসেবা বলে। ব্যাপক অর্থে মানবকল্যাণ ও উন্নয়নের জন্য গৃহীত সকল কর্মসূচিই সমাজসেবা নামে পরিচিত। সাধারণত সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কল্যাণে গৃহীত সেবামূলক কার্যক্রমকে সমাজসেবা বলা হলেও সমাজের মানুষকে সহযোগিতা করা, সমাজ ও দেশের উন্নতিকল্পে কাজ করাকেই আমরা সমাজসেবা বলি। জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুসারে, 'ব্যক্তি ও তার পরিবেশের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানে সহায়তাদানের লক্ষ্যে গৃহীত ও সংগঠিত কাজের সমষ্টিই সমাজসেবা।'

ইসলামে সমাজসেবার পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক। যেমন: রোগীর চিকিৎসা ও সেবা করা, দুর্যোগপীড়িত মানুষের সেবা-যত্ন ও সাহায্য-সহযোগিতা করা, কর্মহীন মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, অনাহারী মানুষের আহার যোগানো, পিপাসার্ত মানুষের পিপাসা নিবারণ করা, বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দেওয়া, অসহায়-নিঃস্ব ও দরিদ্রদের আর্থিক সাহায্য-সহযোগিতা করা, আশ্রয়হীন, কর্মক্ষম ও প্রতিবন্ধী মানুষের পুনর্বাসন করা, দারিদ্র্য বিমোচন, রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি ও সেতু নির্মাণ, পরিবেশ উন্নয়ন ও বৃক্ষরোপণ করা, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিশৃঙ্খলা ও সন্ত্রাস দূরীকরণ, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শান্তি স্থাপন এবং জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধান ইত্যাদি সমাজসেবার অন্তর্ভুক্ত। এমনকি পথের কাঁটা বা কষ্টদায়ক বস্তু অপসারণ করা এবং অন্যের প্রতি মুচকি হাসিও সমাজসেবা।

গুরুত্ব ও তাৎপর্য

আমরা অনেক সেবামূলক কাজ করি। আর উত্তম সমাজসেবামূলক কাজ হলো- নিঃস্ব, দরিদ্র, ক্ষুধার্ত, ইয়াতিম, মিসকিন ও মুসাফিরদের খাদ্য দান করা। এসবের মাধ্যমে জান্নাত লাভ করা যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'যে ব্যক্তি মুসলিম ইয়াতিমকে স্বাবলম্বী হওয়া পর্যন্ত পানাহার করাবে, ঐ ব্যক্তির জন্য জান্নাত অবধারিত হয়ে যাবে।' (আহমাদ) অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে

أَنَّ رَجُلًا سَأَلَ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَيُّ الْإِسْلَامِ خَيْرٌ ؟ قَالَ تُطْعِمُ الطَّعَامَ

অর্থ: জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করল, ইসলামের কোন কাজটি উত্তম? তিনি বললেন, 'তুমি (অভাবীকে) খাবার খাওয়াবে।' (বুখারি)

সমাজে ধনী-গরিব, উঁচু-নিচু নানা শ্রেণি ও পেশার মানুষ বাস করে। তাদের সকলের আর্থ-সামাজিক অবস্থা সমান নয়। তাদের সুযোগ-সুবিধাও সমান নয়। কেউ বিপুল সম্পদের অধিকারী আবার কেউ নিঃস্ব। সম্পদশালী ব্যক্তিগণ অভাবী জনগোষ্ঠীর উন্নয়নেও সম্পদ ব্যয় করবেন। সমাজের অবহেলিত মানুষের কল্যাণে প্রতিষ্ঠান গড়বেন। এটাই ইসলামের নির্দেশ। কেননা, ধনীদের সম্পদে নিঃস্বদের অধিকার রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,

وَفِي أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ لِلسَّابِلِ وَالْمَحْرُومِ .

অর্থ: এবং তাদের (ধনীদের) ধন-সম্পদে রয়েছে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতের হক। (সূরা আয-যারিয়াত, আয়াত: ১৯)

সম্পদশালী ব্যক্তিরা কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান গড়লে সমাজের অভাবী লোকেদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। তারা বাঁচার অবলম্বন খুঁজে পাবে। দেশের উন্নয়নের বাধাসমূহ দূর হবে।

শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। শিক্ষা ছাড়া দ্বীন বোঝা যায় না। দুনিয়া বোঝা যায় না। সমাজ ও জাতির উন্নয়ন সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে বিত্তশালীদের এগিয়ে আসতে হবে। তাঁরা সমাজকে অশিক্ষা ও নিরক্ষরতার হাত থেকে মুক্ত করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়বেন। যদি সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়, তাহলে সমাজ থেকে নিরক্ষরতা দূর হবে। কেননা মহান আল্লাহ আমাদের জ্ঞানার্জনের নির্দেশনা দিয়েছেন। তাই প্রত্যেক ব্যক্তির ওপর জ্ঞান অর্জন করা ফরয। হাদিসে বলা হয়েছে-

طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ

অর্থ: জ্ঞান অন্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরয। (ইবনে মাজাহ)

সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা বজার রাখা মু'মিনের দায়িত্ব। সংশোধনমূলক প্রতিটি কার্যক্রমই সমাজসেবার অন্তর্ভুক্ত। সমাজে কোনো বিশৃঙ্খলা বা গোলযোগ সৃষ্টি হলে তা দূর করতে হবে। কারণ, বিশৃঙ্খলা সমাজের পরিবেশকে নষ্ট করে। আল্লাহ তা'আলা বলেন,

وَالْفِتْنَةُ أَشَدُّ مِنَ الْقَتْلِ

অর্থ: ফিতনা (বিশৃঙ্খলা) হত্যা অপেক্ষা গুরুতর। (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৯১)

সামাজিক নিরাপত্তা রক্ষা করা এবং পরস্পরের দ্বন্দ্ব ও কলহ মেটানোও সমাজসেবার অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তা'আলা বলেন, 'মু'মিনদের দুই দল দ্বন্দ্বে লিপ্ত হলে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও।' (সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ৯)

ছোটবেলা থেকেই জনসাধারণের উপকারে আসে এমন কাজের অভ্যাস করা দরকার। যেমন: ভাঙা রাস্তা মেরামত করা, নতুন রাস্তা নির্মাণে সাহায্য করা, পুল-সাঁকো নির্মাণ করা, রুগ্ণ ব্যক্তির সেবা করা, আহত ব্যক্তিকে চিকিৎসাকেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়া, বৃক্ষরোপণ করা, পরিবেশ সংরক্ষণ করা ইত্যাদি।

সমাজসেবা একটি ইবাদাত। এর মাধ্যমে সমাজ থেকে হিংসা-বিদ্বেষ দূর হয়। সমাজসেবা দ্বারা আল্লাহ তা'আলার সাহায্য লাভ করা যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'আল্লাহ বান্দাকে ততক্ষণ সাহায্য করেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইকে সাহায্য করতে থাকে।' (মুসলিম)

অতএব বলতে চাই, আমরা সব সময় সমাজের সেবা করব। সমাজকে ভালো করে গড়ে তুলব। সর্বস্তরের মানুষের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করব। মানবসেবার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের চেষ্টা করব।

সৌহার্দ্য ও সাম্য

ইসলাম সাম্য, মৈত্রী, সৌহার্দ্য ও শান্তির ধর্ম। মহানবি (সা.) সবার প্রতি সহনশীলতা ও সহানুভূতি প্রদর্শনের অগ্রদূত ছিলেন। পারস্পরিক কল্যাণ কামনা, বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো, নিজের প্রয়োজন সত্ত্বেও অন্যকে প্রাধান্য দেওয়া ইত্যাদি হচ্ছে ইসলামের চিরায়ত সৌন্দর্য। সৌহার্দ্য ও সাম্যের সর্বোত্তম উদাহরণ হলো মদিনার আনসারগণ। তাঁরা নিজেরা দরিদ্র হওয়া সত্ত্বেও মুহাজিরগণের জন্য ধন-সম্পদ ও আপন স্বার্থ ত্যাগ করেছিলেন। তাদের এই ত্যাগ সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলা বলেন, 'আর তারা (আনসার সাহাবিগণ) তাদেরকে (মুহাজিরগণকে) নিজেদের ওপর অগ্রাধিকার দেয় নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও।' (সূরা হাশর, আয়াত: ০৯)

সৌহার্দ্য অর্থ, বন্ধুত্ব, মিত্রতা, সৌজন্য, প্রীতি, মৈত্রী, সম্ভাব, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ইত্যাদি। আর সাম্যের অর্থ হলো সমতা ও সাদৃশ্য। সাম্য অনেক ধরনের হতে পারে। যেমন আর্থিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও আইনি সাম্য। ইসলামের দৃষ্টিতে সমস্ত মানুষ সমান।

গুরুত্ব

ইসলামে সৌহার্দ্য ও সাম্যের গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলামে অন্যায়-অবিচার, দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার, হানাহানি-মারামারি, ধর্মের নামে যুলুম, নির্যাতন, সন্ত্রাস, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, ফিতনা-ফ্যাসাদ গ্রহণযোগ্য নয়। ইসলাম জাতি, ধর্ম, বর্ণ বা ভাষার ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে পার্থক্য করে না।

ইসলামের দৃষ্টিতে সব মানুষ সমান। কেননা, সবাই এক আদমের সন্তান। আর আদম (আ.) মাটি থেকে সৃষ্টি। প্রিয় নবি (সা.) বর্ণবৈষম্য ও আভিজাত্যের গর্বকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন। তিনি একতা, সাম্য-মৈত্রী, সৌহার্দ্য ও শান্তির ভিত্তি স্থাপন করেছেন। এই শান্তিকে সর্বস্তরে সুদৃঢ় করতে মহানবি (সা.) 'মুসলমান' শব্দের ব্যাখ্যা করে বলেছেন, 'যার হাত ও মুখ থেকে অন্যেরা নিরাপদ নয়, সে প্রকৃত মুসলমান নয়।' (বুখারি ও মুসলিম)

সুন্দর সামাজিক পরিবেশের জন্য সৌহার্দ্য ও সাম্যের খুবই প্রয়োজন। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মাঝে হিংসা-বিদ্বেষ ছড়ানো, অত্যাচার-নির্যাতন ও নিপীড়ন করা ইসলামে নিষিদ্ধ। আল্লাহ তা'আলা বলেন,

وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَانُ قَوْمٍ عَلَى أَلَّا تَعْدِلُوا * إِعْدِلُوا هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوى :

অর্থ: কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদের যেন কখনো সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে। তোমরা সুবিচার করবে, এটা তাকওয়ার নিকটতর। (সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৮)

মহানবি (সা.) ধনী-গরিব, বর্ণ-গোত্র বা বংশ গৌরবের মূলে কুঠারাঘাত করেছেন। প্রতিষ্ঠা করে গেছেন সাম্য, মৈত্রী ও বিশ্বভ্রাতৃত্ব। সবার সমান অধিকার নিশ্চিত করেছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা'আলা বলেন, 'হে মু'মিনগণ! কোনো পুরুষ যেন অপর কোনো পুরুষকে উপহাস না করে; কেননা, যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে।' (সূরা হুজুরাত, আয়াত: ১১)

জাতি, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার প্রতি সবার সদ্ব্যবহার করতে হবে। কেননা, সবাই একই পরিবারভুক্ত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'বিশ্বজগৎ আল্লাহর পরিবার। আল্লাহর কাছে ওই ব্যক্তি উত্তম যে তার পরিবারের প্রতি সর্বাপেক্ষা উত্তম।' (তাবরানি)

শুরু থেকেই ইসলাম মানবাধিকার, সাম্য, সৌহার্দ্য ও ইনসাফভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের কথা বলছে। বাস্তবজীবনে তা প্রয়োগ করতে কার্যকর পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে। ইবাদাতের সমতার জন্য সারিবদ্ধভাবে সালাত আদায় করতে বলেছে। রাষ্ট্রপ্রধান ও ভিখারি সালাতে একই কাতারে পাশাপাশি দাঁড়াতেও কোনো বাধা নেই। ধনী-গরিবের বৈষম্য রোধ করতে যাকাত ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছে। রোযা, ঈদ, কুরবানি, হজ সব ইবাদাতের মধ্যে সাম্যের বীজ বপন করে রেখেছে।

ইসলাম ন্যায়নিষ্ঠার ধর্ম। সমাজে সাম্য, মৈত্রী ও সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠা করা মু'মিনের দায়িত্ব। কেননা, কল্যাণকর কাজ আল্লাহর নিকট পছন্দনীয়। রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হলো, আল্লাহ্র নিকট সবচেয়ে পছন্দনীয় মানুষ কে? তিনি উত্তর দিলেন, 'ঐ ব্যক্তি যে মানুষের জন্য সবচেয়ে কল্যাণকারী।' (তাবরানি)

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চরিত্রে সব সময় সৌহার্দ্য, সাম্য ও মৈত্রীর চমৎকার দৃশ্য ফুটে উঠেছে। সাহল বিন সাদ (রা.) বলেন, 'একজন নারী নবিজির জন্য সুন্দর কারুকার্য করা একটি চাদর এনে বললেন, আমি এটি নিজ হাতে তৈরি করেছি। আপনি তা পরিধান করলে আমি খুশি হব। রাসুলুল্লাহ (সা.) কাপড়টি গ্রহণ করলেন। তাঁর কাপড়ের প্রয়োজনও ছিল। যখন তিনি তা লুঙ্গি হিসেবে পরিধান করে ঘরের বাইরে এলেন, এক ব্যক্তি বলল, খুব চমৎকার কাপড় তো! আমাকে তা দান করবেন কি? তখন নবিজি ঘরে গিয়ে তা খুলে ভাঁজ করে লোকটির জন্য পাঠিয়ে দিলেন। এ দৃশ্য দেখে অন্যান্য সাহাবি ওই ব্যক্তিকে তিরস্কার করে বলতে লাগলেন, আরে ভাই! তুমি কি জানো না, কাপড়টি নবিজির প্রয়োজন রয়েছে। আর তিনি কোনো কিছু চাইলে 'না' বলেন না। লোকটি জবাবে বলল, আমি সবই জানি, এরপরও চেয়েছি, যাতে তাঁর শরীর মুবারকের স্পর্শে ধন্য কাপড় দিয়ে আমি নিজের কাফন বানাতে পারি। বর্ণনাকারী সাহাবি বলেন, ওই ব্যক্তির মৃত্যুর পর সেই কাপড়েই তাকে দাফন করা হয়েছিল।' (বুখারি)

এছাড়া সাম্যের প্রতীক মহানবি (সা.) এক ইহুদি মহিলার দাওয়াতে উপস্থিত হয়েছিলেন। এক ইহুদির লাশ দেখে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। সবার জন্য মহানবির সাক্ষাৎকারের দরজা সব সময় খোলা ছিল। আর বিদায় হজের ভাষণে তিনি বলেছেন, 'মানব সন্তান আদম (আ.) থেকে এবং আদম (আ.) মাটি থেকে সৃষ্ট। একের ওপর অন্যের প্রাধান্য নেই।'

এক মুসলমান অপর মুসলমানের কল্যাণে কাজ করবে। পারস্পরিক সৌহাদ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখবে। একে অপরের বিপদে এগিয়ে আসবে। ক্ষুধার্ত হলে খাবার দেবে। দাওয়াত করলে সাড়া দেবে। অসুস্থ হলে শুশ্রুষা করবে। তাকে মুখ ও হাতের অনিষ্ট থেকে নিরাপদে রাখবে। সে মৃত্যুবরণ করলে তার জানাযা ও দাফনে শরিক হবে।

এসব বিষয়ের প্রতি ইসলামে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। কারণ, অন্যকে সহযোগিতার মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য পাওয়া যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'আল্লাহ ততক্ষণ বান্দার সাহায্য করতে থাকেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইকে সাহায্য-সহযোগিতা করতে থাকে।' (মুসলিম)

মুসলমানদের মধ্যকার শত্রুতা, হিংসা-বিদ্বেষ ও দ্বন্দ্ব দূর করার যেমন তাগিদ দিয়েছে ইসলাম, তেমনি অন্যান্য ধর্ম ও জাতির লোকদের সঙ্গেও সৌহার্দ্য ও সম্ভাব বজায় রাখার নির্দেশও দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'আল্লাহর শপথ, সে প্রকৃত মু'মিন নয়, যার অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়।' (বুখারি ও মুসলিম)

ইসলামের এই অনুপম আদর্শ বাস্তবায়ন করতে পারলে সমাজে শান্তি ফিরে আসবে। আর অশান্তি ও দুঃখ-বেদনা - থেকে মানবতা মুক্তি পাবে।

 

প্রতিফলন ডায়েরি লিখন 

'সমাজেসেবামূলক কর্মকাণ্ডে আমি নিজেকে যেভাবে সম্পৃক্ত করতে পারি' 

(উল্লিখিত শিরোনামের আলোকে তুমি নিজেকে যেভাবে সমাজসেবায় যুক্ত করবে তা শিক্ষকের নির্দেশনা মোতাবেক প্রকাশ করো।)

 

শিশুদের প্রতি সদাচার

সদাচার সুখ-শান্তি-সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যায়। অন্যদিকে, কদাচার দুঃখ-দুর্দশার পথে নিয়ে যায়। শিশুদের সঙ্গে কোমল ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। শিশু-কিশোরদের মন খুবই সহজ-সরল, কোমল ও পবিত্র। যদি শিশুদের সঙ্গে কোমল আচরণ করা হয়, তাহলে তারা নিরাপদে বেড়ে উঠবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বিশ্বকে একটি 'শিশুবান্ধব' সমাজ উপহার দিয়ে গেছেন।

শিশু হলো ব্যক্তির ভূমিষ্ঠকালীন প্রাথমিক রূপ। জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে ১৮ বছরের কম বয়সী যেকোনো মানব সন্তানকেই শিশু বলা হয়েছে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটেও ০-১৮ বছর বয়সসীমার মধ্যে অবস্থানকারীদের শিশু হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে ইসলামের দৃষ্টিতে যৌবনপ্রাপ্ত হয়নি এমন মানব সন্তানই হলো শিশু।

সদাচার অর্থ শুদ্ধ আচরণ, উত্তম আচরণ, ভালো ব্যবহার ইত্যাদি। শিশুদের প্রতি সদাচার হলো শিশুদের সঙ্গে সুন্দর আচরণ করা।

সদাচার মানুষের একটি মহৎ গুণ। এটি শিশুদের অন্তর জয়ে সাহায্য করে। তাই মু'মিনের উচিত শিশুদের ভালোবাসা, আদর করা, সালাম দেওয়া, কোমল ব্যবহার করা, তাদের সঙ্গে নরম গলায় কথা বলা, তাদের চুমু খাওয়া। কেননা, এগুলো মহানবি (সা.)-এর শিক্ষা। নবি করিম (সা.) নিজেও শিশুদের সঙ্গে কোমল আচরণ করতেন। শিশুদের প্রতি তাঁর এই অকৃত্রিম ভালোবাসার কথা ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। শিশুদের প্রতি সদাচার করলে তাদের মধ্যে আত্মসম্মানবোধ সৃষ্টি হয়। শিশুদের সঙ্গে সুন্দর আচরণ ইমানের অংশ। এ সম্পর্কে মহানবি (সা.) বলেছেন,

لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَمْ يَرْحَمْ صَغِيْرَنَا وَلَمْ وَيُوَقِّرُ كَبِيرَنَا

অর্থ: যে ব্যক্তি আমাদের ছোটদের স্নেহ করে না এবং বড়দের সম্মান করে না সে আমাদের দলভুক্ত নয়। (তিরমিযি)

সদাচরণ ইসলামের সৌন্দর্য। সন্তানদের সঙ্গে উত্তম আচরণ করা, তাদের সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন শিষ্টাচার শিক্ষা  দেওয়া, সুন্দর নামে ডাকা, নামাযে অভ্যস্ত করা, উন্নত বাচনভঙ্গি, শুদ্ধ উচ্চারণ ইত্যাদি শিক্ষা দেওয়া অভিভাবকের দায়িত্ব। এগুলো শিশুদের প্রতি সদাচারের অংশ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'তোমরা শিশুদের স্নেহ করো, তাদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করো এবং সদাচরণ ও শিষ্টাচার শিক্ষা দাও।' (তিরমিযি) তিনি অপর হাদিসে বলেন, 'সন্তানকে সদাচার শিক্ষা দেওয়া দান-খয়রাতের চেয়েও উত্তম।' (মুসলিম)

ইসলামের নৈতিক শিক্ষা হলো শিশুদের সঙ্গে সদাচরণ করা। শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা করা, কৌতুক করা, গল্প করা, সময় দেওয়া, তাদের খোঁজ খবর নেওয়া, নতুন জামা-কাপড় কিনে দেওয়া, উপহার দেওয়া, ধর্মীয় কর্তব্যপালনে আগ্রহী করে তোলা, ভালো কাজের প্রশংসা করা, তাদের মনের অভিব্যক্তি বুঝতে পারা, মৌলিক চাহিদা পূরণ করা এবং তাদের জন্য দোয়া করাও সদাচার।

রাসুলুল্লাহ (সা.) মুসলিম-অমুসলিম সব শিশুকেই ভালোবাসতেন ও স্নেহ করতেন। তিনি তাদের সঙ্গে খেলাধুলা করতেন। মহানবি (সা.) মাঝে মাঝে উপুড় হয়ে দুই নাতি হাসান ও হোসাইন (রা.)-কে পিঠে সওয়ার হতে দিতেন। অনেক সময় মহানবি (সা.) যখন নামাযে সিজদায় যেতেন, শিশু নাতিদ্বয় তাঁর পিঠে চড়ে বসতেন। নাতিরা তাঁর পিঠ থেকে না নেমে আসা পর্যন্ত তিনি সিজদারত অবস্থায় থাকতেন। কখনোই বিরক্তিবোধ করতেন না। নিষেধও করতেন না। মসজিদে কোনো শিশু এলে তাকে তিনি সামনে ডেকে নিতেন। সফর থেকে ফেরার পর ছোট ছেলেমেয়েদের উটের সামনে-পেছনে বসাতেন এবং তাদের সঙ্গে আনন্দ করতেন। তিনি ছোটদের আদর করে কাছে বসাতেন। তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। তাদের নতুন জামা-কাপড় কিনে দিতেন। শিশুদের কষ্টের কথা ভেবে তিনি ফরয নামাযের জামায়াত সংক্ষিপ্ত করার কথা বলেছেন। তিনি শত ব্যস্ততার মাঝেও শিশুদের খোঁজখবর নিতেন। এভাবেই রাসুলুল্লাহ (সা.) শিশুদের প্রতি সদাচার করতেন।

মহানবি (সা.)-এর জীবনে শিশু-কিশোরদের প্রতি সদাচারের অনেক ঘটনা বিদ্যমান। একবার মসজিদে খুতবা দেওয়ার সময় হাসান-হোসাইন লাল জামা পরিধান করে নানার দিকে এগিয়ে এলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাদের দেখে আর থাকতে পারলেন না। তিনি খুতবা স্থগিত রেখে তাদের কোলে তুলে সামনে এনে বসিয়ে দিলেন। অতঃপর আবার খুতবা শুরু করলেন। (ইবনে মাজাহ) শিশুদের কোনো ধরনের আচরণেই তিনি কখনো বিরক্ত হতেন না। একবার তিনি এক শিশুকে কোলে নিয়ে মিষ্টি খাওয়াচ্ছিলেন। এমন সময় শিশুটি তাঁর কোলে প্রস্রাব করে দিল। কিন্তু তিনি তাতে বিন্দুমাত্র বিরক্ত হলেন না; বরং নিজেই পানি দিয়ে ওই স্থানটি ধুয়ে নিলেন।

এতিম শিশুদের প্রতি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দরদ ছিল আরো বেশি। একবার ঈদের দিন সকালবেলা নবিজি (সা.) দেখলেন, এক শিশু রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে কাঁদছে। পরনে তার ছিন্ন বস্ত্র। সারা শরীরে কাদা। শিশুটিকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন যে সে এতিম। এ কথা শুনে নবিজির খুব খারাপ লাগল। শিশুটির প্রতি তাঁর মায়া হলো। শিশুটিকে বাড়িতে নিয়ে এলেন। স্ত্রী আয়েশা (রা.)-কে বললেন, শিশুটিকে ভালোভাবে গোসল করিয়ে দাও। আয়েশা (রা.) তাকে গোসল করিয়ে দিলেন। এরপর প্রিয় নবি নিজ হাতে তাকে নতুন পোশাক পরিয়ে দিলেন। অতঃপর ঈদের নামায পড়তে নিয়ে গেলেন। আদর করে শিশুটিকে বললেন, 'আজ থেকে আমি তোমার পিতা আর আয়েশা তোমার মা।'

শিশুদের কোমল ও পবিত্র মনে কোনো খারাপ ধারণা প্রবেশ করলে তাদের ভবিষ্যৎ জীবনে সেটা থেকে যায়। তাই শিশুদের সত্য কথা বলা ও সত্য পথে চলার জন্য অভ্যস্ত করানো উচিত। তাদের সঙ্গে সদা সত্য বলা উচিত। কর্কশ ভাষা ব্যবহার করা উচিত নয়। তাদের দেওয়া ওয়াদা পূরণ করা, তাদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন না করা, রাগ না করা, উপহাস না করা, গালি না দেওয়া, অবহেলা না করা, অভিশাপ না দেওয়া, তাদের আচরণে বিরক্ত না হওয়া ইত্যাদিও সদাচার। যেমন: আনাস (রা.) দীর্ঘ ১০ বছর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সেবায় কাটিয়েছেন। নিজের শৈশবের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেছেন, 'রাসুলুল্লাহ (সা.) আমার কোনো কাজে কখনো আপত্তি করে বলেননি যে, এমনটি কেন করেছ বা এমনটি কেন করোনি।' (মুসলিম)

আজকের শিশুই আগামী দিনের দেশ, জাতি ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কর্ণধার। তাই শিশুদের সঙ্গে যদি সদাচার করা হয়, তাদের সদাচার শিক্ষা দেওয়া হয়, ইসলামের নীতি-নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধের আদর্শ শিক্ষা দেওয়া হয়, তাহলে মাতা-পিতা, সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্র তাদের সেবা লাভে উপকৃত হবে। সুন্দর হবে ভবিষ্যৎ পৃথিবী।

মাতা-পিতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য

মাতা-পিতা হচ্ছেন আল্লাহ তা'আলার দেওয়া সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত। তাঁদের মাধ্যমেই সন্তান পৃথিবীর মুখ দেখতে পায়। মা কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে সন্তান জন্ম দেন এবং লালন-পালন করেন। মাতা-পিতার একান্ত আদর-যত্নে ছোট শিশুটি ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। রোগ-শোকে ও বিপদ-আপদে তাঁরা সন্তানকে আগলে রাখেন। তাঁদের পায়ের নিচে সন্তানের জান্নাত। মাতা-পিতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং মাতা-পিতার অসন্তুষ্টিতে আল্লাহর অসন্তুষ্টি। মাতা-পিতার ঋণ শোধ করা সন্তানের পক্ষে সম্ভব নয়। মাতা-পিতার প্রতি সন্তানের রয়েছে সুনির্দিষ্ট কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য। সেগুলো আদায়ের মাধ্যমে সন্তান জান্নাত লাভ করতে পারবে। সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলো হলো

মাতা-পিতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা, তাঁদের খেদমত করা, তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা, মাতা-পিতার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, তাঁদেরকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা, বিভিন্ন উপলক্ষে তাঁদের উপহার দেওয়া ইত্যাদি। মাতা-পিতা অসহায় শিশুকে যেমন পরম স্নেহে, আদর-যত্নে ও ভালোবাসায় লালন করেন, সর্বাবস্থায় তাঁদের সাথে তেমনি সর্বোত্তম আচরণ করা উচিত। কেননা, মাতা-পিতা খুশি থাকলে আল্লাহ্ও খুশি থাকেন। মাতা-পিতা বিধর্মী হলেও তাঁদের সঙ্গে সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। আল্লাহ তা'আলা বলেন,

وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا 

অর্থ: আর তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন তিনি ব্যতীত অন্য কারো ইবাদাত না করতে এবং মাতা- পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে। (সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত: ২৩)

প্রত্যেক সন্তানের উচিত মাতা-পিতাকে কষ্ট না দেওয়া, তাঁদের ধমক না দেওয়া, গালমন্দ না করা, কর্কশ ভাষা ব্যবহার না করা, অসম্মান না করা, বিশেষ করে বৃদ্ধাবস্থায় তাঁদের শিশুসুলভ আচরণ সহ্য করতে হবে। তাঁদের কথাবার্তা বা আচরণে বিরক্তি প্রকাশ না করে তাদের প্রতি উদার মনোভাব পোষণ করা সন্তানের কর্তব্য। আল্লাহ তা'আলা বলেন, 'তাদের একজন অথবা উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাঁদেরকে 'উফ' বলো না এবং তাঁদেরকে ধমক দিও না; তাদের সঙ্গে সম্মানসূচক কথা বলো।' (সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত: ২৩)

মাতা-পিতার আনুগত্য করা সন্তানের কর্তব্য। যেকোনো বিষয়ে তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত। তাঁরা ইসলামবিরোধী কোনো কাজের নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত তাদের সকল আদেশ পালন করা উচিত। তাদের সঙ্গে সুন্দর ও মার্জিত ভাষায় কথা বলা এবং তাঁদের প্রতি দয়ার দৃষ্টিতে তাকানো উচিত। তবে মাতা-পিতার সঙ্গে নাফরমানি করা হারাম। তাঁদের সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টির মধ্যে রয়েছে জান্নাত ও জাহান্নাম। এ প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন,

هُمَا جَنَّتُكَ وَنَارُكَ

অর্থ: তাঁরা তোমার জান্নাত এবং তোমার জাহান্নাম। (ইবনে মাজাহ)

সন্তানের আরো কর্তব্য হলো বৃদ্ধ মাতা-পিতাকে সঙ্গ দেওয়া, মাতা-পিতা অক্ষম হলে তাঁদের সার্বিক দায় দায়িত্ব নেওয়া, তাঁদের ভরণপোষণের যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করা, আর্থিক সহযোগিতা করা, তাঁদের অসুবিধা দূর করা, তাঁরা অসুস্থ হলে সাধ্যমত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, তাঁদের পরিচর্যা এবং সেবা করা উচিত। অসুস্থতা বা বার্ধক্যের কারণে মাতা-পিতা অক্ষম হয়ে পড়লে তাঁদের সহযোগিতা করা সন্তানের কর্তব্য।

মাতা-পিতার মৃত্যুর পর কর্তব্য

মাতা-পিতার মৃত্যুর পর সন্তানের দায়িত্ব হলো-তাঁদের কাফন-দাফন করা, তাঁদের রেখে যাওয়া ঋণ পরিশোধ করা, সম্পত্তি বণ্টনের পূর্বে তাঁদের কৃত ওয়াদা ও অসিয়ত পূর্ণ করা, তাঁদের জন্য সামর্থ্য অনুযায়ী সাদকাহ করা, ওয়ারিশদের মাঝে তাঁদের রেখে যাওয়া সম্পত্তি সুষ্ঠুভাবে বণ্টন করা ইত্যাদি। অসিয়ত পূর্ণ করার ক্ষেত্রে পরিত্যক্ত সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত ব্যয় করা যাবে। এমনকি মাতা-পিতার আত্মীয় ও বন্ধুদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা উচিত।

মাতা-পিতার মৃত্যুর পর তাঁদের জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করা, ক্ষমা প্রার্থনা করা সন্তানের দায়িত্ব। দোয়ার ভাষাটি আল্লাহ তা'আলা নিজেই শিখিয়ে দিয়ে বলেন,

وَقُلْ رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيْنِي صَغِيرًا 

অর্থ: এবং বলো, হে আমার প্রতিপালক! তাঁদের প্রতি দয়া করো, যেভাবে শৈশবে তাঁরা আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন। (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ২৪)

আল্লাহ তা'আলা অন্যত্র বলেন,

رَبَّنَا اغْفِرْ لِي وَلِوَالِدَيَّ وَلِلْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ يَقُوْمُ الْحِسَابُ .

অর্থ: হে আমাদের প্রতিপালক! যেদিন হিসাব অনুষ্ঠিত হবে সেদিন আমাকে, আমার মাতা-পিতাকে এবং মু'মিনদেরকে ক্ষমা করো। (সূরা ইবরাহিম, আয়াত: ৪১)

মোটকথা, মাতা-পিতার খেদমত করা ইবাদাত। তাঁদের দেওয়া কষ্ট সহ্য করাও ইবাদাত। যারা মাতা-পিতার হক আদায় করে না তাদের ধ্বংস অনিবার্য। মহানবি (সা.) একদা তিনবার বললেন, ঐ লোক ধ্বংস হয়ে যাক। তাঁকে প্রশ্ন করা হলো, কে সে? তিনি বললেন, 'যে ব্যক্তি তার মাতা-পিতা অথবা তাঁদের একজনকে বৃদ্ধাবস্থায় পেল অথচ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারল না।' (মুসলিম)

মাতা-পিতাকে অভিশাপ দেওয়া কবিরা গুনাহ। তাই আমরা মাতা-পিতাকে সন্তুষ্ট রাখব। তাঁদের প্রতি সমস্ত কর্তব্য পালন করব। তাঁরা আমাদের মঙ্গল চান। তাঁদের আদেশ-নিষেধ আমরা সবসময় মেনে চলব।

প্রবীণ ও বয়োজ্যেষ্ঠদের মর্যাদা ও অধিকার

বার্ধক্য বা প্রবীণ একটি জৈবিক অবস্থা। যা মানব জীবনচক্রের শেষ ধাপ। সকলকেই এ নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে। আজ আমাদের মাঝে যাঁরা বার্ধক্যে উপনীত হয়েছে। তাঁরা আমাদের অগ্রজ এবং সমাজের সার্থক রূপকার। আমরা তাদের জীবনব্যাপী আত্মত্যাগের চরম সুবিধাভোগী। তাই ইসলাম প্রবীণদের দিয়েছে যথাযোগ্য মর্যাদা ও অধিকার।

সাধারণ অর্থে প্রবীণত্ব বলতে শারীরিক ও মানসিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিকে বুঝায়। জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা এবং প্রবীণ বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণা অনুযায়ী ৬০ বছর বা তদুর্ধ্ব ব্যক্তিকে প্রবীণের হিসেবে গণ্য করা হয়। বাংলাদেশে প্রবীণের সংখ্যা বৃদ্ধির হার উদ্বেগজনক। বর্তমান বাংলাদেশে প্রবীণ ব্যক্তির সংখ্যা ১.৬০ কোটি। যা মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশ। জনসংখ্যাবিদদের ধারণা ২০২৫ সালে দেশে প্রবীণের সংখ্যা হবে ২.৮০ কোটি এবং ২০৫০ সালে হবে ৪.৫০ কোটি। ২০৫০ সালে প্রবীণের সংখ্যা হবে মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ।

প্রবীণদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন সব সমাজেরই অনুসরণীয় রীতি। সমাজে প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনের ঐতিহ্য আজও মোটামুটি লক্ষ করা যায়। তারপরও কিছু কিছু বৃদ্ধকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো হয়। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। প্রবীণরা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের বোঝা নয়; বরং দুনিয়া ও পরকালের সফলতার অনন্য অনুপ্রেরণার মাধ্যম। ইসলাম প্রবীণদের অসম্ভব শ্রদ্ধা ও সম্মান দিয়েছে। প্রবীণদের সম্মান ও মর্যাদা সুরক্ষা এবং অধিকার সুনিশ্চিতে বিশ্বনবি (সা.) ও তাগিদ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, 'যে ব্যক্তি আমাদের ছোটদের স্নেহ করে না এবং আমাদের বড়দের সম্মান করে না সে আমাদের দলভুক্ত নয়।' (তিরমিযি)

প্রবীণদের শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাত। তাই মর্যাদাবান ব্যক্তিকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়া উচিত। কেননা, প্রবীণদের শ্রদ্ধা ও সম্মান করলে সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় থাকে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'প্রবীণদের সঙ্গেই তোমাদের কল্যাণ ও বরকত আছে।' (ইবনে হিব্বান)

জ্ঞানীকে তার জ্ঞানের জন্য আর বৃদ্ধকে তার বয়সের জন্য শ্রদ্ধা ও সম্মান করতে হবে। এটাই ইসলামের শিক্ষা। যারা ইসলামের এ বিধান মানবে না, তারা অবশ্যই আল্লাহর সামনে অপরাধী হিসেবে উপস্থিত হবে। বস্তুত প্রবীণদের শ্রদ্ধা ও সম্মানের মাঝেই আল্লাহর প্রতি সম্মান প্রদর্শন নিহিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন,

إِنَّ مِنْ إِجْلَالِ اللَّهِ إِكْرَامَ ذِي الشَّيْبَةِ الْمُسْلِمِ 

অর্থ: নিশ্চয়ই সাদা চুলবিশিষ্ট বৃদ্ধ মুসলিমকে সম্মান করা মহান আল্লাহর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের অন্তর্ভুক্ত। (আবু দাউদ)

ইসলাম প্রবীণদের মূল্যায়ন ও সম্মান করেছে। তাদেরকে সালামে অগ্রাধিকার এবং সালাত আদায়ে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। যেমন: দাঁড়িয়ে সালাত আদায়ে অক্ষম হলে বসে আদায় করবে। তাতেও যদি অক্ষম হয়, তাহলে শুয়ে শুয়ে আদায় করবে। এমনকি প্রবীণদের সম্মানে নবি করিম (সা.) ইমামকে সালাত সংক্ষিপ্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন, ইমামতিতে প্রবীণদের অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলেছেন, সাওম পালনের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা দিয়েছেন। অতিবৃদ্ধ বা প্রবীণ ব্যক্তি যদি সাওম পালনে অক্ষম হন, তাহলে প্রতিটি সাওমের বিনিময়ে একজন করে মিসকিনকে খাবার খাওয়াবে। বিনিময়ে প্রবীণদের সাওম রাখায় ছাড় দেওয়া হয়েছে। হজ পালনে শারীরিকভাবে অক্ষমদের জন্য বদলি হজের বিধান দিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নৈকট্য পাওয়ার ক্ষেত্রেও প্রবীণদের অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তিনি বলতেন, 'তোমাদের মধ্যকার প্রবীণ ও জ্ঞানী লোকেরা যেন আমার কাছাকাছি দাঁড়ায়। তারপর পর্যায়ক্রমে দাঁড়াবে যারা তাদের কাছাকাছি। তারপর দাঁড়াবে যারা তাদের কাছাকাছি তারা।' (মুসলিম) এছাড়াও ইসলামে প্রবীণদের ইবাদাতের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। যেহেতু প্রবীণরা শারীরিক কারণে ইবাদাত করতে কষ্ট হয়, তাই আল্লাহ তা'আলা তাঁদের ইবাদাত কবুল করেন।

ইসলামের শিক্ষা হলো: সন্তানের অসহায়ত্বের সময় মাতা-পিতা যেভাবে প্রতিপালন করেন, মাতা-পিতার বৃদ্ধাবস্থায়ও তাঁদের সেভাবে যত্ন নেওয়া সন্তানের কর্তব্য। এখানেই শেষ নয়, মাতা-পিতা অমুসলিম হলেও তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। এ দায়িত্ব পালনে অবহেলা করা অমানবিক ও ইসলাম বিবর্জিত কাজ। এমন কাজ যারা করে তাদের কোনো ক্ষমা নেই। অন্যদিকে বৃদ্ধ মাতা-পিতাকে প্রাপ্য মর্যাদা না দেওয়ায় পারিবারিক অশান্তি হচ্ছে। পরিবার প্রথা হুমকির মুখে পড়ছে। আর বিভিন্ন ধরনের সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে।

পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবনে প্রবীণদের অবদান অপরিসীম। এক সময়ে তাঁরা বার্ধক্যে উপনীত হন। তখন প্রবীণদের সার্বিক কল্যাণ ও সুরক্ষা করা সমাজের আবশ্যিক কর্তব্য। প্রবীণরা ভালোবাসা, সেবা-যত্ন ও শ্রদ্ধা পাওয়ার যোগ্য অধিকারী। এছাড়াও কথা বলা ও আসন পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া, অভাবী হলে আর্থিক সহায়তা ও পুনর্বাসন করে প্রয়োজনীয় দেখাশোনা, খাবার-দাবার, চিকিৎসা, বস্ত্র-বাসস্থানের ব্যবস্থা করা, রাস্তা পারাপারে সাহায্য করা ইত্যাদি হলো প্রবীণদের অধিকার।

মোটকথা, প্রবীণদের যথাযথ সম্মান প্রদর্শন এবং প্রয়োজন পূরণ করা সবার কর্তব্য। বিশেষ করে নিকটাত্মীয়দের এটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। তাই প্রবীণ ব্যক্তির প্রতি কোনোরূপ অবজ্ঞা নয়, কোনো বৈষম্য নয়। প্রবীণের প্রতি পরম শ্রদ্ধা, মমতা ও ভালোবাসা হোক সকলের অঙ্গীকার। প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং তাঁদের অধিকার আদায়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব।

দলগত কাজ 

তুমি তোমার মা-বাবা, পরিবার বা প্রতিবেশি বয়োজেষ্ঠ্যদের সম্মান, শ্রদ্ধা কীভাবে প্রদর্শন করো বা করবে তা শিক্ষকের নির্দেশনা মোতাবেক সহপাঠীর সাথে আলোচনার করে উপস্থাপন করো।

Content added By

আরও দেখুন...