নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বিজ্ঞান - জীবন বাঁচাতে বিজ্ঞান | NCTB BOOK

১৯৫০ সালে পৃথিবীর মানুষের গড় আয়ু ছিল ৫০ বছরের কাছাকাছি, ষাট বছরে সেই আয়ু ২০ বছর থেকে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। পৃথিবীর মানুষের জীবনধারণের মান উন্নত হওয়া, রোগ প্রতিষেধক ব্যবহার, স্বাস্থ্য সচেতন হওয়া এবং চিকিৎসার মান উন্নয়নের জন্য সারা পৃথিবীতে মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়ে গেছে। তোমরা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছ, মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ার পিছনে চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির একটা সম্পর্ক আছে। আর চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির পিছনে রয়েছে আধুনিক যন্ত্রপাতি, সেগুলো দিয়ে অনকে সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে। একটা সময় ছিল যখন চিকিৎসকরা রোগীর বাহ্যিক বিভিন্ন লক্ষণ দেখে রোগ নির্ণয় করতেন। শরীরের তখন অনেক কিছু অনুমান করতে হতো, সঠিকভাবে রোগ নিরূপণ করা যেত না। আধুনিক যন্ত্রপাতির কারণে শুধু যে অনেক নিখুঁতভাবে রোগ নিরূপণ করা যাচ্ছে তা নয়, অনেক কার্যকরভাবে চিকিৎসা করা সম্ভব হয়েছে।

১৪.১.১ এক্স-রে (X-Ray )

১৮৮৫ সালে উইলহেলোম রন্টজেন উচ্চশক্তিসম্পন্ন এক ধরনের রশ্মি আবিষ্কার করেন, যেটি শরীরের মাংসপেশি ভেদ করে গিয়ে ফটোগ্রাফিক প্লেটে ছবি তুলতে পারত। এই রশ্মির প্রকৃতি তখন জানা ছিল না বলে তার নাম দেওয়া হয়েছিল এক্স-রে। এখন আমরা জানি, এক্স-রে হচ্ছে আলোর মতোই বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ, তবে তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য আমাদের পরিচিত দৃশ্যমান আলো থেকে কয়েক হাজার গুণ ছোট। তাই তার শক্তিও সাধারণ আলো থেকে কয়েক হাজারগুণ বেশি। যেহেতু তরঙ্গদৈর্ঘ্য অনেক ছোট তাই আমরা খালি চোখে এক্স-রে দেখতে পাই না। ১৪.০১ চিত্রে কীভাবে এক্স-রে তৈরি হয়, সেটি দেখানো হয়েছে। একটি কাচের গোলকের দুই পাশে দুটি ইলেকট্রোড থাকে একটি ক্যাথোড অন্যটি অ্যানোড। ক্যাথোড টাংস্টেনের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহ করে উত্তপ্ত করা হয়। তাপের কারণে ফিলামেন্ট থেকে ইলেকট্রন মুক্ত হয় এবং অ্যানোডের ধনাত্মক ভোল্টেজের কারণে সেটি তার দিকে ছুটে যায়। ক্যাথোড এবং অ্যানোডের ভেতর ভোল্টেজ যত বেশি হবে, ইলেকট্রন তত বেশি গতিশক্তিতে অ্যানোডের দিকে ছুটে যাবে। এক্স-রে টিউবে এই ভোল্টেজ ১০০ হাজার ভোল্টেজ কাছাকাছি হতে পারে। ক্যাথোড থেকে প্রচন্ড শক্তিতে ছুটে আসা ইলেকট্রন অ্যানোডকে আঘাত করে। এই শক্তিশালী ইলেকট্রনের আঘাতে অ্যানোডের পরমাণুর ভেতর দিকের কক্ষপথের ইলেকট্রন কক্ষপথচ্যূত হয়। তখন বাইরের দিকে কক্ষপথের কোনো একটি ইলেকট্রন সেই জায়গাটা পূরণ করে। তখন যে শক্তিটুকু উদ্বৃত্ত হয়ে যায়, সেটি শক্তিশালী এক্সরে হিসেবে বের হয়ে আসে। ঠিক কতো তরঙ্গদৈর্ঘ্যের এক্স-রে বের হবে সেটি নির্ভর করে অ্যানোড হিসেবে কোন ধাতু ব্যবহার করা হবে তার উপর। সাধারণত ভাষাকে অ্যানোড হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এক্স-রে অনেকভাবে ব্যবহার করা যায়, নিচে তার কয়েকটি ব্যবহারের তালিকা দেওয়া হলো।

১. স্থানচ্যূত হাড়, হাড়ে ফাটল, ভেঙে যাওয়া হাড় ইত্যাদি খুব সহজে শনাক্ত করা যায় (চিত্র ১৪.০২)।

২. দাঁতের ক্যাভিটি এবং অন্যান্য ক্ষয় বের করার জন্য এক্স-রে ব্যবহার করা হয়।

৩. পেটের এক্স-রে করে অন্ত্রের প্রতিবন্ধকতা (Intestinal obstruction) পরিমাপ করা যায় ।

৪. এক্স-রে দিয়ে পিত্তথলি ও কিডনি পাথরের অস্তিত্ব বের করা যায় ।

৫. বুকের এক্স-রে করে ফুসফুসের রোগ যেমন যক্ষা, নিউমোনিয়া ফুসফুসের ক্যান্সার নির্ণয় করা

৬. এটি ক্যান্সার কোষকে মেরে ফেলতে পারে, তাই রেডিওথেরাপিতে এক্স-রে চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হয়।

এক্স-রের অপ্রয়োজনীয় বিকিরণ যেন শরীরে কোনো ক্ষতি করতে না পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। এজন্য কোনো রোগীর এক্স-রে নেওয়ার সময় এক্স-রে করা অংশটুকু ছাড়া বাকি শরীর সিসা দিয়ে তৈরি অ্যাপ্রন দিয়ে ঢেকে নিতে হয়। অত্যন্ত   প্রয়োজন না হলে গর্ভবতী মেয়েদের পেট বা তলপেটের অংশটুকু এক্স-রে করা হয় না ।

১৪.১.২ আলট্রাসনোগ্রাফি (Ultrasonography)
আলট্রাসনোগ্রাফি দিয়ে শরীরের ভেতরের অঙ্গপ্রতঙ্গ, মাংসপেশি ইত্যাদির ছবি তোলা হয়, এটি করার জন্য খুব উচ্চ কম্পাংকের শব্দ ব্যবহার করে তার প্রতিধ্বনীকে ব্যবহার করা হয়। শব্দের কম্পাঙ্ক ১-১০ মেগাহার্টজ হয়ে থাকে বলে একে আলট্রাসনোগ্রাফি বলা হয়ে থাকে। ১৪.০৩ চিত্রে সাধারণ 2D এবং সাম্প্রতিক আবিষ্কৃত 3D আলট্রাসনোগ্রাফি ছবি দেখানো হলো। আলট্রাসনোগ্রাফি যন্ত্রে ট্রান্সডিউসার নামে একটি স্ফটিককে বৈদ্যুতিক শক্তি দিয়ে উদ্দীপ্ত করে উচ্চ কম্পাঙ্কের আলট্রাসনিক তরঙ্গ উৎপন্ন করা হয়। আলট্রাসনিক যন্ত্রে এই তরঙ্গকে একটা সর্ বিমে পরিণত করা হয়। শরীরের ভেতরের যে অঙ্গটির প্রতিবিম্ব দেখার প্রয়োজন হয় ট্রান্সডিউসারটি শরীরে উপরে সেখানে স্পর্শ করে বীমটিকে শরীরের ভেতরে প্রবেশ করানো হয়, রোগী সে যেন কোনো ব্যথা বা অস্বস্তি অনুভব  না করে। যে অঙ্গের দিকে বিমটি নির্দেশ করা হয়, সেই অঙ্গের প্রকৃতি অনুযায়ী প্রতিফলিত, শোষিত বা সংবাহিত হয়। যখন বিষটি মাংসপেশি বা রত্নের বিভিন্ন ঘনত্বের বিভেদতলে আপতিত হয়, তখন তরঙ্গের একটি অংশ প্রতিধ্বনিত হয়ে পুনরায় ট্রান্সডিউসারে ফিরে আসে। এই প্রতিধ্বনিগুলোকে বৈদ্যুতিক সংকেতে রূপান্তর করে সমন্বিত করে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবিম্ব তৈরি করে।

আলট্রাসনোগ্রাফি নিচের কাজগুলো করার জন্য ব্যবহার করা হয়:

১. আলট্রাসনোগ্রাফির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার স্ত্রীরোগ এবং প্রসুতিবিজ্ঞানে। এর সাহায্যে ভ্রূণের আকার গঠন, স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক অবস্থান জানা যায়, প্রসূতি বিজ্ঞানে এটি একটি দ্রুত, নিরাপদ এবং নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি।

২. আলট্রাসনোগ্রাফি দিয়ে জরায়ুর টিউমার এবং অনান্য পেলভিক উপস্থিতিও শনাক্ত করা যায়।

৩. পিত্তপাথর, হৃদ্যন্ত্রের জুটি এবং টিউমার বের করার জন্যও আলট্রাসনোগ্রাম ব্যবহার করা হয়। হৃৎপিণ্ড পরীক্ষা করার জন্য যখন আলট্রাসাউন্ড ব্যবহার করা হয়, তখন এই পরীক্ষাকে ইকোকার্ডিয়গ্রাফি বলে।

৪. এক্স-রের তুলনায় আলট্রাসনোগ্রাফি অনেক বেশি নিরাপদ, তবুও এটাকে ঢালাও ভাবে ব্যবহার না করে সীমিত সময়ের জন্য ব্যবহার করা হয় ট্রান্সডিউসারটি যেন কোনো নির্দিষ্ট স্থানে বেশি সময়ের জন্য একটানা বিম না পাঠায় সেজন্য আলট্রাসাউন্ড করার সময় ট্রান্সডিউসারটিকে ক্রমাগত নড়াচড়া করাতে হয়।

১৪.১.৩ সিটি স্ক্যান (CT Scan )

সিটি স্ক্যান শব্দটি ইংরেজি Computed Tomography Scan - এর সংক্ষিপ্ত রূপ। টমোগ্রাফি বলতে বোঝানো হয় ত্রিমাত্রিক বস্তুর একটি ফালির বা দ্বিমাত্রিক অংশের প্রতিবিম্ব তৈরি করা। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এই যন্ত্রে এক্স-রে ব্যবহার করা হয়। সাধারণ এক্স-রে করার সময় শরীরের ভেতরের একবার ত্রিমাত্রিক অঙ্গের দ্বিমাত্রিক একটা প্রতিচ্ছবি নেওয়া হয়। সিটি স্ক্যান যন্ত্রে একটি এক্সরে টিউব রোগীর শরীরকে বৃত্তাকারে ঘুরে এক্স-রে নির্গত করতে থাকে এবং অন্য পাশে ডিটেকটর প্রতিবিম্ব গ্রহণ করতে থাকে। প্রতিবিম্বটি স্পষ্ট করার জন্য অনেক সময় রোগীর শরীরে বিশেষ Contrast দ্রব্য ইনজেকশন করা হয়।
বৃত্তাকারে চারপাশের এক্সরে প্রতিবিম্ব পাওয়ার পর কম্পিউটার দিয়ে সেগুলো বিশ্লেষণ করে সমন্বয় করা হয় এবং একটি পরিপূর্ণ ফালির (slice) অভ্যন্তরীণ গঠন পাওয়া যায়। একটি ফালির ছবি নেওয়ার পর সিটি স্ক্যান করার যন্ত্র রোগীকে একটুখানি সামনে সরিয়ে পুনরায় বৃত্তাকারে চারদিক থেকে এক্স-রে প্রতিচ্ছবি গ্রহণে করে যেগুলো বিশ্লেষণ করে দ্বিতীয় আরেকটি ফালির অভ্যন্তরীণ গঠনটির একটি পূর্ণাঙ্গ ছবি তৈরি করে (চিত্র ১৪.০৪)। এভাবে রোগীকে একটুখানি একটু খানি করে সামনে এগিয়ে নিয়ে তার শরীরের কোনো একটি অঙ্গের অনেকগুলো ফালির প্রতিচ্ছবি নেওয়া হয়। একটা গুটির অনেকগুলো স্লাইস পরপর সাজিয়ে নিয়ে আমরা যেরকম পুরো গুটিটি পেয়ে যাই, ঠিক সেরকম শরীরের কোনো অঙ্গের অনেকগুলো স্লাইসের ছবি একত্র করে আমরা রোগীর শরীরের ভেতরের একটা ত্রিমাত্রিক প্রতিচ্ছবি তৈরি করে নিতে পারি। সিটিস্ক্যানের কাজের পদ্ধতিটি দেখে তোমরা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছ এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল, জটিল এবং একটি বিশাল যন্ত্র। চিত্র ১৪.০৪: হৃৎপিণ্ডের সিটি স্ক্যান এ যন্ত্রটি শরীরের ভেতরে না গিয়ে বাইরে থেকেই শরীরের ভেতরের অঙ্গপ্রতঙ্গের নিখুঁত ত্রিমাত্রিক ছবি তৈরি করতে পারে। এটি আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের খুব প্রয়োজনীয় একটি যন্ত্র (চিত্র ১৪.০৫) হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সিটিস্ক্যান করে নিচের কাজগুলো করা সম্ভব :

১. সিটিস্ক্যানের সাহায্যে শরীরের নরম টিস্যু, রক্তবাহী শিরা বা ধমনী, ফুসফুস, ব্রেন ইত্যাদির পূর্ণাঙ্গ ছবি পাওয়া যায়।

২. যকৃত, ফুসফুস এবং অগ্নাশয়ের ক্যান্সার সনাক্ত করার কাজে সিটিস্ক্যান ব্যবহার করা হয়।

৩. সিটিস্ক্যানের প্রতিবিম্ব টিউমারকে শনান্ত করতে পারে। টিউমারের আকার ও অবস্থান সম্পর্কে বলতে পারে এবং টিউমারের আশপাশের টিস্যুকে কী পরিমাণ আক্রান্ত করেছে, সেটিও জানিয়ে দিতে পারে। চিত্র ১৪.০৫: সিটি স্ক্যান

৪. মাথার সিটিস্ক্যানের সাহায্যে মস্তিস্কের  কোনো ধরনের রক্তপাত হয়েছে কীনা, ধমনী ফুলে গেছে কী না কিংবা কোনো টিউমার আছে কি না, সেটি বলে দেওয়া যায়।

৫. শরীরে রক্ত সঞ্চালনে সমস্যা আছে কিনা সেটিও সিটি স্ক্যান করে জানা যায়।

সর্তকতা: সিটিস্ক্যান করার জন্য যেহেতু এক্স-রে ব্যবহার করা হয়, তাই গর্ভবর্তী নারীদের সিটিস্ক্যান করা হয় না। ছবির কন্ট্রাস্ট বাড়ানোর জন্যে যে “রং” ব্যবহার করা হয় সেটি কারো কারো শরীরে এলার্জির জন্ম দিতে পারে বলে সেটি ব্যবহার করার আগে সতর্ক থাকতে হয়।

১৪.১.৪ এমআরআই (MRI Magnetic Resonance Imaging)

মানুষের শরীরের প্রায় সত্তরভাগ পানি, যার অর্থ মানুষের শরীরের প্রায় সব অপ্রত্যঙ্গে পানি থাকে। পানির প্রতিটি অনুতে থাকে হাইড্রোজেন এবং হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস হচ্ছে প্রোটন। শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র প্রয়োগ করলে প্রোটনগুলো চৌম্বকক্ষেত্রের দিকে সারিবদ্ধ হয়ে যায়, তখন নির্দিষ্ট একটি কম্পনের বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ পাঠানো হলে এই প্রোটনগুলো সেই তরঙ্গ থেকে শক্তি গ্রহণ করে তাদের দিক পরিবর্তন করে এবং এই প্রক্রিয়াটিকে বলে নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স। পদার্থবিজ্ঞানের এই চমকপ্রদ ঘটনাটির উপর ভিত্তি করে ম্যাগনেটিক রেজোরেন্স ইমেজিং বা এমআরআই তৈরি করা হয়েছে (চিত্র ১৪.০৬)। এমআরআই যন্ত্রটি দেখতে সিটিস্ক্যান যন্ত্রের মতো কিন্তু এর কার্যপ্রণালি সম্পূর্ণ ভিন্ন। সিটিস্ক্যান যন্ত্রে এক্স-রে পাঠিয়ে প্ৰতিচ্ছবি নেওয়া হয়, এমআরআই যন্ত্রে একজন রোগীকে অনেক শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্রে রেখে তার শরীরে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ দেওয়া হয়। শরীরের পানির অণুর ভেতরকার হাইড্রোজেনের প্রোটন থেকে ফিরে আসা সংকেতকে কম্পিউটার দিয়ে বিশ্লেষণ করে শরীরের ভেতরকার অঙ্গপ্রত্যঙ্গের প্রতিবিম্ব তৈরি করা হয়। সিটিস্ক্যান দিয়ে যা কিছু করা সম্ভব, এমআরআই দিয়েও (চিত্র ১৫.০৬: এম আর আই করার যন্ত্র) সেগুলো করা সম্ভব। তবে এমআরআই দিয়ে শরীরের ভেতরকার কোমল টিস্যুর ভেতরকার পার্থক্যগুলো ভালো করে বোঝা সম্ভব। সিটিস্ক্যান করতে পাঁচ থেকে দশ মিনিটের বেশি সময়ের দরকার হয় না, সেই তুলনায় এমআরআই করতে একটু বেশি সময় নেয়। সিটিস্ক্যানে এক্স-রে ব্যবহার করা হয় বলে যত কমই হোক তেজস্ক্রিয়তার একটু ঝুঁকি থাকে এমআরআইয়ে সেই ঝুঁকি নেই। শরীরের ভেতরে কোনো ধাতব কিছু থাকলে (যেমন: পেস মেকার) এমআরআই করা যায় না, কারণ আর এফ (RF) তরঙ্গ ধাতুকে উত্তপ্ত করে বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।

১৪.১.৫ ইসিজি (ECG)

ইসিজি হলো ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম (Electro Cardiogram) শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ। ইসিজি করে মানুষের হৃৎপিণ্ডের বৈদ্যুতিক এবং পেশিজনিত কাজকর্মগুলো পর্যবেক্ষণ করা যায়। আমরা জানি, বাইরের কোনো উদ্দীপনা ছাড়াই হৃৎপিণ্ড ক্ষুদ্র বৈদ্যুতিক সংকেত তৈরি করে এবং এই সংকেত পেশির ভেতর ছড়িয়ে পড়ে, যার কারণে হৃৎস্পন্দন হয়। ইসিজি যন্ত্র (চিত্র ১৪.০৭ ) ব্যবহার করে আমরা হৃৎপিণ্ডের এই বৈদ্যুতিক সংকেতগুলো শনাক্ত করতে পারি । এর সাহায্যে হৃৎপিন্ডের স্পন্দন হার এবং ছন্দময়তা পরিমাপ করা যায়। ইসিজি সংকেত হৃৎপিণ্ডের মধ্যে  রক্ত প্রবাহের একটি পরোক্ষ প্রমাণ দেয়।
ইসিজি করতে হলে বৈদ্যুতিক সংকেতগুলো গ্রহণ করার জন্য শরীরে ইলেকট্রোড লাগাতে হয়। দুই হাতে দুটি, দুই পায়ে দুটি এবং ছয়টি হৃৎপিন্ডের অবস্থান-সংলগ্ন বুকের উপর লাগানো হয়। প্রত্যেকটি ইলেকট্রোড থেকে বৈদ্যুতিক সংকেতকে সংগ্রহ করা হয়। এই সংকেতগুলোকে যখন ছাপানো (চিত্র ১৪.০৮) হয়, তখন সেটিকে বলে ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম।
একজন সুস্থ মানুষের প্রত্যেকটি ইলেকট্রোড থেকে পাওয়া বৈদ্যুতিক সংকেতের একটা স্বাভাবিক নকশা থাকে। যদি কোনো মানুষের হৃৎপিণ্ডে অস্বাভাবিক অবস্থা তৈরি হয়, তখন তার ইলেকট্রোড থেকে পাওয়া সংকেতগুলো স্বাভাবিক নকশা থেকে ভিন্ন হবে। সাধারণ কোনো রোগের কারণ হিসেবে বুকের ধড়ফড়ানি, অনিয়মিত কিংবা দ্রুত হৃৎস্পন্দন বা বুকে ব্যথা হলে ইসিজি করা হয়। এছাড়া নিয়মিত চেক আপ করার জন্য কিংবা বড় অপারেশনের আগে ইসিজির সাহায্য নেওয়া হয়।

হৃৎপিণ্ডের যেসব অস্বাভাবিক অবস্থা ইসিজি করা যায়, সেগুলো হচ্ছে:

১. হৃৎপিণ্ডের অস্বাভাবিক স্পন্দন, অর্থাৎ স্পন্দনের হার বেশি বা কম হলে

২. হার্ট এটাক হয়ে থাকলে

৩. হৃৎপিণ্ডের আকার বড় হয়ে থাকলে

ইসিজি মেশিনটি অত্যন্ত সহজ সরল মেশিন। এটি ব্যবহার করে শরীরের ভেতরকার হৃৎপিন্ডের অবস্থার অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। একজন রোগীর চিকিৎসার জন্য এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়।


১৪.১.৬ এন্ডোসকপি (Endoscopy)

চিকিৎসার কারণে শরীরের ভেতরের কোনো অঙ্গ বা গহ্বরকে বাইরে থেকে সরাসরি দেখার প্রক্রিয়াটির নাম এন্ডোসকপি। এন্ডোসকপি যা দিয়ে শরীরের ফাঁপা অঙ্গগুলোর ভেতরে পরীক্ষা করা যায় (চিত্র ১৪.০৯)। এন্ডোসকোপ যন্ত্রে দুটি স্বচ্ছ নল থাকে। একটি নল দিয়ে বাইরে থেকে রোগীর শরীরের নির্দিষ্ট অঙ্গের ভেতরে তীব্র আলো ফেলা হয়। এটি করা হয় অপটিক্যাল ফাইবার দিয়ে, আলো এই ফাইবারে পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলনের মাধ্যমে প্রবেশ করে বলে নলটি সোজা থাকতে হয় না, আঁকাবাঁকা হতে পারে। (চিত্র ১৪,০৯: এন্ডোসকপির মাধ্যমে পাকস্থলীর ভেতরে দেখার প্রক্রিয়া) রোগীর শরীরের ক্ষতিগ্রস্ত বা রোগাক্রান্ত জায়গাটি আলোকিত করার পর সেই এলাকার ছবিটি দ্বিতীর স্বচ্ছ নলের ভেতর দিয়ে দেখা যায়। কোনো বস্তু দেখতে হলে সেটি সরল রেখায় থাকতে হয়। কিন্তু শরীরের ভেতরের কোনো অঙ্গের ভেতরে সরল রেখায় থাকানো সম্ভব নয়। তাই ছবিটি দেখার জন্য অপটিক্যাল ফাইবার ব্যবহার করা হয় যেখানে আলো পূর্ণ অভ্যন্তরীন প্রতিফলন হয়ে আঁকাবাঁকা পথে যেতে পারে। শরীরের অভ্যন্তরের একটি নির্দিষ্ট জায়গা সুক্ষ্মভাবে দেখার জন্য অত্যন্ত সরু ৫ থেকে ১০ হাজার অপটিক্যাল ফাইবারের একটি বান্ডিল ব্যবহার করা হয়। প্রত্যেকটি ফাইবার একটি বিন্দুর প্রতিচ্ছবি নিয়ে আসে বলে সব মিলিয়ে অত্যন্ত নিখুঁত একটি ছবি দেখা সম্ভব হয়। অপটিক্যাল ফাইবার অত্যন্ত সরু হয় বলে ৫ থেকে ১০ হাজার ফাইবারের বান্ডিলটির প্রস্থচ্ছেদও কয়েক মিলিমিটার থেকে বেশি হয় না। বর্তমানে অত্যন্ত ক্ষুদ্র সিসিডি ক্যামেরার প্রযুক্তির কারণে এন্ডোসকপি যন্ত্রের নলের মাথায় একটি ক্ষুদ্র ক্যামেরা বসিয়ে সেটি সরাসরি শরীরের ভেতরে ঢুকিয়ে ভিডিও সিগন্যাল দেখা সম্ভবপর হচ্ছে। এন্ডোসকপি ব্যবহার করে ডাক্তারেরা যেকোনো ধরনের অস্বস্তিবোধ, ক্ষত, প্রদাহ এবং অস্বাভাবিক কোষ বৃদ্ধি পরীক্ষা করে থাকেন। যে অঙ্গগুলো পরীক্ষা করার জন্য এন্ডোসকপি ব্যবহার করা হয় সেগুলো হচ্ছে-

১. ফুসফুস এবং বুকের কেন্দ্রীয় বিভাজন অংশ

২. পাকস্থলী, ক্ষুদ্রান্ত্র, বৃহদন্ত্র বা কোলন

৩.স্ত্রী প্রজনন অঙ্গ

৪. উদর এবং পেলভিস

৫. মূত্রনালির অভ্যন্তর ভাগ

৬. নাসা গহ্বর , নাকের চারপাশের সাইনাস এবং কান

এন্ডোসকপি করার সময় যেহেতু একটি নল সরাসরি ক্ষতস্থানে প্রবেশ করানো হয়, সেটি দিয়ে সেই ক্ষতস্থানের নমুনা নিয়ে আসা সম্ভব এবং প্রয়োজনে এটা ব্যবহার করে কিছু কিছু সার্জারিও করা সম্ভব।
 

১৪.১.৭ এনজিওগ্রাফি (Angiography )

এক্স-রের মাধ্যমে শরীরের রপ্তনালিগুলো দেখার জন্য এনজিওগ্রাফি ব্যবহার করা হয়। সাধারণ এক্স-রে করে রক্তনালি ভালোভাবে দেখা যায় না বলে এনজিওগ্রাম করার সময় রক্তনালিতে বিশেষ Contrast Material বা বৈসাদৃশ্য রঙিন তরল (ডাই) ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। রক্তনালির যে অংশটুকু পরীক্ষা করতে হবে ঠিক সেখানে রঙিন তরল দেওয়ার জন্যে একটি সরু এবং নমনীয় নল কোনো একটি ধমনি দিয়ে শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এই সরু এবং নমনীয় নলটিকে বলে ক্যাথিটার। ক্যাথিটার দিয়ে রক্তনালির নির্দিষ্ট জায়গায় ডাই দেওয়ার পর সেই এলাকায় এক্স- রে নেওয়া হয়। ডাই থাকার কারণে এক্স- রে তে রক্তনালিগুলোকে স্পষ্ট দেখা যায় (চিত্র ১৪.১০)। ডাই পরে কিডনির সাহায্যে ছেকে আলাদা করা হয় এবং প্রস্রাবের সাথে শরীর থেকে বের হয়ে যাन। এনজিওপ্লাস্টি ব্লক :

সাধারণত যেসব সমস্যা এনজিওগ্রাম​​​​​​​ পরীক্ষা করার জন্য দেওয়া হয় সেগুলো হচ্ছে:

১. হৃৎপিণ্ডের বাইরের ধমনিতে ব্লকেজ হলে। রক্তনালি ব্লক হলে রত্নের স্বাভাবিক প্রবাহ হতে পারে না, হৃৎপিন্ডে যথেষ্ট রক্ত সরবরাহ করা না হলে সেটি ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না এবং হার্ট এটাকের আশঙ্কা বেড়ে যায়।

২. ধমনি প্রসারিত হলে

৩. কিডনির ধমনির অবস্থাগুলো বোঝার জন্য

৪. শিরার কোনো সমস্যা হলে।

সিটিস্ক্যান কিংবা এমআরআই করার সময় সকল পরীক্ষাগুলো শরীরের বাইরে থেকে করা হয়। এনজিওগ্রাম করার সময় একটি ক্যাথিটার শরীরের ভেতরের রক্তনালিতে ঢোকানো হয় বলে কোনো রকম সার্জারি না করেই তাৎক্ষণিকভাবে রক্তনালি ব্লকের চিকিৎসা করা সম্ভব। যে প্রক্রিয়ায় এনজিওগ্রাম করার সময় ধমনির ব্লক মুক্ত করা হয়, তাকে এনজিওপ্লাস্টি বলা হয়। এনজিওপ্লাস্টি করার সময় ক্যাথিটার দিয়ে ছোট একটি বেলুন পাঠিয়ে সেটি ফুলিয়ে রক্তনালিকে প্রসারিত করে দেওয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে সেখানে একটি রিং (ring) প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয় যেন সংকুচিত ধর্মনিটি প্রসারিত থাকে এবং প্রয়োজনীয় রক্তের   প্রবাহ হতে পারে।

 

Content added || updated By