নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বিজ্ঞান - দুর্যোগের সাথে বসবাস | NCTB BOOK

সাইক্লোন শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ "Kyklos" থেকে, যার অর্থ হলো Coil of Snakes বা সাপের কুণ্ডলী। সাইক্লোনের স্যাটেলাইট ছবি থেকে দেখা যায়, প্রচণ্ড গতিবেগসম্পন্ন বাতাস কুণ্ডলীয় আকারে ঘুরপাক খাচ্ছে (চিত্র ১.০৫)। অর্থাৎ নিম্নচাপের কারণে যখন বাতাস প্রচণ্ড গতিবেগে ঘুরতে থাকে, তখন সেটাকে সাইক্লোন বা ঘুর্ণিঝড় বলে। দক্ষিণ এশিয়াতে আমরা যেটাকে সাইক্লোন বলি, আমেরিকাতে সেটাকে হ্যারিকেন (Hurricane) এবং দূরপ্রাচ্যের দেশগুলোতে টাইফুন (Typhoon) বলে।

বাংলাদেশের উত্তরে হিমালয় পর্বত, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর এবং মাঝখানে ফানেল আকৃতির উপকূলীয় এলাকা বিদ্যমান। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ সাইক্লোনের জন্য খুব ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। ১৯৬০ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫০ বার বাংলাদেশে সাইক্লোন আঘাত এনেছে। এর মধ্যে ১৯৬০, ১৯৬১, ১৯৬৩, ১৯৬৫, ১৯৭০, ১৯৮৫, ১৯৯১, ২০০৭ ও ২০০৯ সালের সাইক্লোন ছিল প্রলয়ংকরী। তবে ১৯৭০ সালের সাইক্লোনটি সর্বকালের সবচেয়ে প্রলয়ংকরী সাইক্লোন হিসেবে পৃথিবীর ইতিহাসে চিহ্নিত হয়েছে। এ ঝড়ে প্রায় ৫ লক্ষ প্রাণহানি ঘটেছিল। ১৯৯১ সালে ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ১ লক্ষ ৪০ হাজার প্রাণহানি ঘটেছে। ২০০৭ 19 ২০০৯ সালের সাইক্লোন সিডর (চিত্র ১.০৬) ও আইলাতে যথাক্রমে ১০ হাজার ও ৭ হাজার লোকের প্রাপহানি ঘটেছে। এছাড়া এই সাইক্লোনে লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছিল। এ দুটি সাইক্লোনে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে প্রায় ১.৭ বিলিয়ন ও ৬০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

সাইক্লোন সৃষ্টির কারণ ও করণীয়

যেহেতু সাইক্লোন সৃষ্টি হয় গভীর সমুদ্রে, তাই এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা সহজসাধ্য নয়। ভৰে যে দুটি কারণ মূলত সাইক্লোন সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তা হলো নিম্নচাপ এবং উচ্চ তাপমাত্রা। সাধারণত সাইক্লোন তৈরি হতে সাগরের তাপমাত্রা ২৭° সেলসিয়াসের বেশি হতে হয়। দুর্ভাগ্যবশত বঙ্গোপসাগরে প্রায় সারা বছরই এই তাপমাত্রা বিদ্যমান থাকে। সমুদ্রের উত্তপ্ত পানি বাষ্পীভবনের ফলে উপরে উঠে যখন জল কণায় পরিণত হয় তখন বাষ্পীভবনের সুপ্ত তাপটি বাতাসে ছেড়ে দেয়। সে কারণে বাতাস উত্তপ্ত হয় এবং বাষ্পীভবন আরো বেড়ে যায়, ফলে বায়ুমণ্ডল অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে নিম্নচাপের সৃষ্টি করে। নিম্নচাপ সৃষ্টি হলে আশপাশের বাতাস সেখানে ছুটে আসে, যা বাড়তি তাপমাত্রার কারণে ঘুরতে ঘুরতে উপরে উঠতে থাকে এবং সাইক্লোন সৃষ্টি করে। এই প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট হওয়া ঘূর্ণিঝাড়ের বাতাসের বেগ অনেক বেশি হয়। তবে বাতাসের বেগ ঘণ্টায় ৬৩ কিলোমিটার বা তার চাইতে বেশি হলে সেটাকে সাইক্লোন হিসেবে গণ্য করা হয়। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে সবচেয়ে শক্তিশালী সাইক্লোন হয়েছিল ১৯৯১ সালে। তখন বাতাসের বেগ ছিল ঘণ্টায় ২২৫ কিলোমিটার।


এখন প্রশ্ন হলো, সাইক্লোনের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার কি কোনো উপায় আছে? আর সাইক্লোন হলে আমাদের করণীয়ই বা কী? সাইক্লোন অত্যন্ত শক্তিশালী। একটি দুর্বল সাইক্লোনও শক্তিতে মেগাটন শক্তির কয়েক হাজার পারমাণবিক বোমার সমান। তাছাড়া যেহেতু সাইক্লোন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, তাই এটি প্রতিরোধ করা প্রায় অসাধ্য। সম্প্রতি আমেরিকাতে ঝড়ের সময় সিলভার আয়োডাইড (AgI) নামক রাসায়নিক দ্রব্য ৰাতাসে ছড়িয়ে পানিকে শীতল করে ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ কমানোর চেষ্টা করা হলেও নানা ধরনের সীমাবদ্ধতার কারণে এটি ঠিকভাবে কাজ করেনি। এছাড়া সাগরে তেল বা অন্যান্য সাইক্লোন সৃষ্টির কারণ ও করণীয় যেহেতু সাইক্লোন সৃষ্টি হয় গভীর সমুদ্রে, তাই এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা সহজসাধ্য নয়। ভৰে যে দুটি কারণ মূলত সাইক্লোন সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তা হলো নিম্নচাপ এবং উচ্চ তাপমাত্রা। সাধারণত সাইক্লোন তৈরি হতে সাগরের তাপমাত্রা ২৭° সেলসিয়াসের বেশি হতে হয়। দুর্ভাগ্যবশত বঙ্গোপসাগরে প্রায় সারা বছরই এই তাপমাত্রা বিদ্যমান থাকে। সমুদ্রের উত্তপ্ত পানি বাষ্পীভবনের ফলে উপরে উঠে যখন জল কণায় পরিণত হয় তখন বাষ্পীভবনের সুপ্ত তাপটি বাতাসে ছেড়ে দেয়। সে কারণে বাতাস উত্তপ্ত হয় এবং বাষ্পীভবন আরো বেড়ে যায়, ফলে বায়ুমণ্ডল অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে নিম্নচাপের সৃষ্টি করে। নিম্নচাপ সৃষ্টি হলে আশপাশের বাতাস সেখানে ছুটে আসে, যা বাড়তি তাপমাত্রার কারণে ঘুরতে ঘুরতে উপরে উঠতে থাকে এবং সাইক্লোন সৃষ্টি করে। এই প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট হওয়া ঘূর্ণিঝাড়ের বাতাসের বেগ অনেক বেশি হয়। তবে বাতাসের বেগ ঘণ্টায় ৬৩ কিলোমিটার বা তার চাইতে বেশি হলে সেটাকে সাইক্লোন হিসেবে গণ্য করা হয়। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে সবচেয়ে শক্তিশালী সাইক্লোন হয়েছিল ১৯৯১ সালে। তখন বাতাসের বেগ ছিল ঘণ্টায় ২২৫ কিলোমিটার।

এখন প্রশ্ন হলো, সাইক্লোনের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার কি কোনো উপায় আছে? আর সাইক্লোন হলে আমাদের করণীয়ই বা কী? সাইক্লোন অত্যন্ত শক্তিশালী। একটি দুর্বল সাইক্লোনও শক্তিতে মেগাটন শক্তির কয়েক হাজার পারমাণবিক বোমার সমান। তাছাড়া যেহেতু সাইক্লোন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, তাই এটি প্রতিরোধ করা প্রায় অসাধ্য। সম্প্রতি আমেরিকাতে ঝড়ের সময় সিলভার আয়োডাইড (AgI) নামক রাসায়নিক দ্রব্য ৰাতাসে ছড়িয়ে পানিকে শীতল করে ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ কমানোর চেষ্টা করা হলেও নানা ধরনের সীমাবদ্ধতার কারণে এটি ঠিকভাবে কাজ করেনি। এছাড়া সাগরে তেল বা অন্যান্য 

রাসায়নিক দ্রব্য ছিটিয়ে বাষ্পীভবন কমিয়ে ঘূর্ণিঝড়ের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার চিন্তাভাবনা করা হয়। তবে প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করা কখনোই বাস্তবভিত্তিক নয়। তাহলে কী করা যেতে পারে?
আমাদের ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস প্রক্রিয়া জোরদার করে মানুষের প্রাণ বাঁচানোর এবং সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড়ের আরেকটি মারাত্মক দিক হলো জলোচ্ছ্বাস। তাই ঘূর্ণিঝড় প্রবন এলাকায় উঁচু করে মজবুত আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করতে হবে। ঘূর্ণিঝড়ের সময় নিচু এলাকায় বসবাস করা মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়স্থলে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। জলোচ্ছ্বাস ঠেকানোর জন্য উপকূলীয় এলাকায় বাঁধ তৈরি করা যেতে পারে। সাথে সাথে সেখানে প্রচুর গাছপালা লাগিয়েও ক্ষতির পরিমাণ কমানো সম্ভব। ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলার জন্য যথাযথ পূর্বপ্রস্তুতি নিতে হবে। বাংলাদেশ ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশে রেড ক্রিসেন্টের যৌথ উদ্যোগে ইতোমধ্যেই সাইক্লোন প্রস্তুতি কার্যক্রম চালু আছে। এর আওতায় প্রায় ৩২০০০ স্বেচ্ছাসেবী উপকূলীয় এলাকায় জনসচেতনতা বৃদ্ধিসহ অন্যান্য কাজ করে যাচ্ছে। ২০১৭ সালে সাইক্লোন 'মোরা' বাংলাদেশকে আঘাত করেছিল, সময়মতো যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ায় তখন মাত্র ৭ জনের প্রাণহানি ঘটেছিল।
আমাদের অতিপরিচিত একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলো কালবৈশাখী। সাধারণত এপ্রিল থেকে মে মাসের ভেতর আমাদের দেশে কালবৈশাখী ঝড় হয়। সাধারণত ঈশান কোণে (North) মেঘ জমা হয়ে কিছুক্ষণের মাঝে আকাশ মেঘে ঢেকে গিয়ে কালবৈশাখী ঝড় শুরু হয়। এই ঝড়ে বাতাসের বেগ ঘণ্টায় ৫৫ থেকে ৮০ কিলোমিটারের মতো হতে পারে। ঝড়ের বেগ ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটারের বেশি হলে এটাকে টর্নেডো বলা হয়। বাংলাদেশ ছাড়াও আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও রাশিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশেই টর্নেডো আঘাত হানে। টর্নেডোর সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হচ্ছে এটি হঠাৎ করে অল্প সময়ের মধ্যে প্রচণ্ড ধ্বংসযজ্ঞ করে ফেলতে পারে।

টর্নেডো শব্দটি এসেছে স্প্যানিশ শব্দ “Tonada' থেকে, যার অর্থ হলো Thunder storm বা বজ্রঝড়। সাইক্লোনের মতো টর্নেডোর বেলাতেও প্রচণ্ড বেগে বাতাস ঘূর্ণির আকারে প্রবাহিত হয় এবং এর যাত্রাপথে যা পড়ে তার সবই ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয়। টর্নেডোর বিস্তার মাত্র কয়েক মিটার এবং দৈর্ঘ্য ৫-৩০ কিলোমিটার হতে পারে। সাইক্লোনের সাথে টর্নেডোর মূল পার্থক্য হচ্ছে যে, সাইক্লোন সৃষ্টি হয় সাগরে এবং এটি উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে আর টর্নেডো যে কোনো স্থানেই সৃষ্টি হতে পারে কিংবা আঘাত হানতে পারে। সাইক্লোনের মতো টর্নেডোর জন্যও লঘু বা নিম্নচাপ সৃষ্টি হতে হয়। এর ফলে উষ্ণ বাতাস উপরে উঠে যায় এবং ঐ শূন্য জায়গা পূরণের জন্যই শীতল বাতাস ছুটে এসে টর্নেডোর সৃষ্টি হয়।বাংলাদেশে একটি প্রলয়ংকরী টর্নেডো আঘাত হানে ১৯৮৯ সালে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়াতে। ঐ আঘাতের ফলে টর্নেডোর গতিপথের মধ্যে প্রায় সবকিছু ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ১৯৭৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত শতাধিক টর্নেডো বাংলাদেশে আঘাত হেনেছে। স্মরণকালের ভয়াবহ টর্নেডোর মধ্যে একটি হলো ১৯৬৯ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকা জেলার ডেমরা থানায়। ঐ টর্নেডোতে বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ৬৪৪ কিলোমিটার। যেহেতু টর্নেডোর বেলায় পূর্বাভাস কিংবা সতর্কবাণী প্রচার করা সম্ভব হয় না, তাই এক্ষেত্রে আগাম প্রস্তুতি নেওয়া যায় না। তাই দুর্গত এলাকায় জরুরি ভিত্তিতে দ্রুত ত্রাণ সরবরাহ এবং পুনর্বাসন কাজ করাই হচ্ছে একমাত্র সমাধান। এরকম সময় সরকারি এবং বেসরকারি সব সংগঠনের মধ্যে সমন্বয় করে কাজ করা খুবই জরুরি।

 

Content added By