নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বিজ্ঞান - এসো বলকে জানি | NCTB BOOK

তুমি যদি হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দেওয়ালে একটা ঘুষি দাও, তাহলে নিশ্চিতভাবেই তুমি তোমার হাতে ব্যথা পাবে। ঘুষির মাধ্যমে “তুমি” দেওয়ালকে বল দিয়েছ, যদি দেওয়ালের ব্যথা অনুভব করার ক্ষমতা থাকত তাহলে সেটি ব্যথা অনুভব করত কিন্তু তুমি কেন ব্যথা পেয়েছ? কারণটি তুমি নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছ। তুমি যখন তোমার মুষ্টিবদ্ধ হাত দিয়ে দেওয়ালে বল প্রয়োগ করেছ, তখন দেওয়ালটিও তোমার মুষ্টিবদ্ধ হাতে পাল্টা একটা বল প্রয়োগ করেছে। এটি সব সময়েই সত্যি, কোথাও বল প্রয়োগ করলে সেটিও পাল্টা বল প্রয়োগ করে। 


একক কাজ: একটি রাবার ব্যান্ড হাত দিয়ে ধরে দেখ সেটি কত লম্বা। এবারে একটা ছোট বই সূতা দিয়ে রাবার ব্যান্ডের সাথে বেঁধে ঝুলিয়ে দাও, দেখবে রাবার ব্যান্ডটি খানিকটা লম্বা হয়ে বইটিকে ঝুলিয়ে রেখেছে।


আমরা জানি, বইটির ওজন আছে, ওজন হচ্ছে বল, কাজেই এই বল বইটিকে নিচের দিকে টানছে। বল প্রয়োগ করলে বস্তু গতিশীল হয় কিন্তু এই বইটি গতিশীল নয় বইটি স্থির, কারণ উপর থেকে রাবার ব্যান্ডটি প্রসারিত হয়ে বইটিকে উপরের দিকে টেনে এজনের বলটুকু নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে। অর্থাৎ আমরা বলতে পারি, বইটা রাবার ব্যান্ডকে নিচের দিকে টানছে (তাই রাবার ব্যান্ডটা একটু খানি লম্বা হয়ে গেছে) আবার রাবার ব্যান্ডটা বইটাকে উপরের দিকে টানছে। (ভাই বইটা নিচে পড়ে না গিয়ে স্থির হয়ে আছে)। উপরের উদাহরণগুলো থেকে আমরা দেখতে পাই, আমরা যখনই কোথাও কোনো বল প্রয়োগ করি, তখনই বিপরীত দিকে একটা বল তৈরি হয়। একটি বলকে ক্রিয়া (বল) বলা হলে অন্যটিকে আমরা প্ৰতিক্ৰিয়া (বল) বলতে পারি। আইজ্যাক নিউটন তিনি তাঁর গতিবিষয়ক তৃতীয় সূত্রে বলেছেন: প্রত্যেক ক্রিয়া বলেরই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া বল আছে।


ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বল সবসময়ই একটি অন্যটির ওপর কাজ করে—কখনোই একই বস্তুর ওপর কাজ করে না। অর্থাৎ A বস্তু যদি B বস্তুর উপর বল প্রয়োগ করে তাহলে B বস্তু A বস্তুর উপর বিপরীত দিকে সমান বল প্রয়োগ করবে। প্রতিক্রিয়া বলটি ততক্ষণই থাকবে, যতক্ষণ পর্যন্ত ক্রিয়া বলটি থাকবে। ক্রিয়া থেমে গেলে প্রতিক্রিয়াও থেমে যাবে। এ ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া বলদ্বয় বস্তুগুলোর স্থিরাবস্থায় বা গতিশীল অবস্থায় বা সাম্যাবস্থায় থাকা বা একে অপরের সংস্পর্শে থাকা বা না থাকার ওপর নির্ভরশীল নয়—সর্বত্রই বর্তমান থাকে।


ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কয়েকটি উদাহরণ

নিউটনের তৃতীয় সূত্র বোঝার সবচেয়ে সোজা উপায় হচ্ছে আমরা কীভাবে হাঁটি সেটা বোঝা। আমরা সবাই হাঁটতে পারি, এর পেছনে কি পদার্থবিজ্ঞান আছে, সেটা না জেনেই সবাই হাঁটে। কিন্তু ভোমরা যেহেতু পদার্থবিজ্ঞান শিখতে শুরু করেছ, তোমাদের খুব সহজ একটা প্রশ্ন করা যায়। তুমি যেহেতু স্থির অবস্থা থেকে হাঁটতে পার, কাজেই আসলে তোমার একটি ত্বরণ হচ্ছে, যার অর্থ তোমার উপর বল প্রয়োগ করা হচ্ছে। কিন্তু আমরা সবাই জানি, কেউ আমাদের উপর বল প্রয়োগ করে না। আমরা নিজেরাই হাঁটি। কেমন করে সেটা সম্ভব?
নিউটনের তৃতীর সূত্র না জানা থাকলে আমরা কখনোই হাঁটার বিষয়টা ব্যাখ্যা করতে পারতাম না। আমরা যখন হাঁটি, তখন আমরা পা দিয়ে মাটিতে ধাক্কা দিই (অর্থাৎ বল প্রয়োগ করি), তখন মাটিটা নিউটনের তৃতীর সূত্র অনুযায়ী আমাদের শরীরে সমান এবং বিপরীত বল প্রয়োগ করে (চিত্র ১০.০৩)। এই সমান এবং বিপরীত বলটা দিয়েই আমাদের ক্ষরণ হয়, আমরা হাঁটি। একইভাবে মাঝি যখন লগি দিয়ে নদীর তলার মাটিকে ধাক্কা দেয়, তখন নৌকা সামনের দিকে এগিয়ে যায় (চিত্র ১০.০৪)।
চিত্র ১০.০৩: একজন মানুষ হাঁটার সময় পা দিয়ে যখন মাটিকে ধাক্কা দেয়, তখন মাটিও মানুষটিকে পাল্টা ধাক্কা দেয়।
চিত্র ১০.০৪: মাঝি লগি দিয়ে নৌকা ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে।
বিষয়টা যাদের বুঝতে একটু সমস্যা হচ্ছে, তাদেরকে মনে করিয়ে দেওয়া যায়, শক্ত মাটিতে হাঁটা সোজা কিন্তু ঝুরঝুরে বালুর উপর হাঁটা সোজা না, তার কারণ বালুর ওপর বল প্রয়োগ করা যায় না, বালু সরে যায়— তাই নিউটনের তৃতীয় সূত্রের পাল্টা বলটাও ঠিকভাবে পাওয়া যায় না। ব্যাপারটা আরো অনেক স্পষ্ট করে দেওয়া যায় যদি কাউকে অসম্ভৰ মসৃণ একটা মেঝেতে সাবান পানি কিংবা তেল দিয়ে পিচ্ছিল করে হাঁটতে দেওয়া হয়! সেখানে ঘর্ষণ খুব কম, তাই আমরা পিছনে বল প্রয়োগ করতেই পাৱৰ না এবং সে জন্য তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে আমাদের ওপর কোনো বলও পাব না! আর তাই হাঁটতেও পারব না (বিশ্বাস না হলে চেষ্টা করে দেখতে পার)। বল প্রয়োগ করলে বিপরীত এবং সমান বল পাওয়া যায়, যদি প্রয়োগ করতেই না পারি তাহলে তার প্রতিক্রিয়া বল পাব কেমন করে? আর হাঁটব কেমন করে?


তুমি ওজন মাপার যন্ত্রের উপর দাঁড়াও। সেখানে তোমার ওজন দেখতে পাবে, এটি হচ্ছে ওজন মাপার যজ্ঞের উপর তোমার প্রযুক্ত বল। এখন তুমি যদি উপরে উঠতে চাও তাহলে নিশ্চিতভাবে নিচ থেকে তোমার উপর উপরের দিকে বল প্রয়োগ করতে হবে। সেই বলটি কোথা থেকে আসবে?


একক কাজ: তুমি একটি লাফ দিয়ে দেখ। দেখবে মুহূর্তের জন্য ওজন মাপার যন্ত্রের কাঁটাটি সরে গিয়ে অনেক বেশি ওজন দেখাচ্ছে। তুমি এই বাড়তি বলটুকু মুহূর্তের জন্য নিচের দিকে প্রয়োগ করেছে এবং তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে ওজন মাপার যন্ত্রটি তোমার উপর উপরের দিকে বল প্রয়োগ করছে। সেই প্রতিক্রিয়া বলের কারণে তুমি উপরে উঠতে পেরেছ।


একক কাজ: একটি বেলুন নিয়ে একে ভালোভাবে ফোলাও। হাত দিয়ে শক্ত করে মুখ বন্ধ করে রাখ। এর পর হঠাৎ হাত ছেড়ে বেলুনটিকে মুক্ত করে দাও। (চিত্র: ১০.০৫)। কী দেখলে? তুমি দেখবে বেলুনটি উড়ে বেড়াচ্ছে! বেলুনটিকে যখন ফোলানো হয়েছে তখন বেগুনের রাবারটি প্রসারিত হয়ে ভিতরকার বাতাসের উপর একটা চাপ সৃষ্টি করেছে। যখন তুমি বেলুনের মুখটি ছেড়ে দিয়েছ, তখন বেলুনটি ভেতরকার বাতাসের উপর বল প্রয়োগ করে বেলুনের মুখ দিয়ে সঙ্গোরে বের করতে শুরু করেছে। বেলুনটি যখন বাতাসের উপর বল প্রয়োগ করতে শুরু করেছে, তখন বেলুনের বাতাসও বেলুনটির উপর বল প্রয়োগ করতে শুরু করেছে। এই বলের কারণে বেলুনটি বিপরীত দিকে ছুটতে শুরু করেছে।
চিত্র ১০.০৫: বেলুন থেকে পিছন দিকে বাতাস বের হওয়ার সমর বেলুনটি সামনে এগিয়ে যায়।

 

Content added || updated By