সপ্তম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - ইসলাম শিক্ষা - কুরআন ও হাদিস শিক্ষা | NCTB BOOK

‘কুরআন’ (القرآن) শব্দটি আরবি। এর অর্থ হলো বহুল পঠিত। আল-কুরআন পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি পঠিত কিতাব। প্রত্যেক দিন কোটি-কোটি মুসলমান এ গ্রন্থ তিলাওয়াত করে থাকে। আমরা পাঁচ ওয়াক্ত সালাতে এ গ্রন্থ থেকে বিভিন্ন সূরা ও আয়াত পাঠ করে থাকি। এ জন্য এ কিতাবের নাম রাখা হয়েছে ‘আল-কুরআন’। ইসলামি পরিভাষায়, আল্লাহ তা'আলা মানবজাতির হিদায়াতের জন্য হযরত জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে মহানবি হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর উপর যে কিতাব নাযিল করেছেন তাকেই আল-কুরআন বলা হয়।

আল কুরআন আল্লাহ তা'আলার পবিত্র বাণী। এটি মানবজাতির জন্য সুস্পষ্ট দলীল, বিশ্বাসীদের জন্য হেদায়ত ও রহমত। আল্লাহ তা‘আলা মহানবি হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর উপর সুদীর্ঘ ২৩ বছরে এটি নাজিল করেন। আসমানি কিতাব সমূহের মধ্যে এটি সর্বশেষ নাজিল করা হয়েছে। এরপর আর কোনো কিতাব আসেনি। আর ভবিষ্যতেও আসবে না। কিয়ামত পর্যন্ত এ কিতাবের বিধি-বিধান ও শিক্ষা বলবৎ থাকবে। এটি সর্বকালের সকল মানুষের জন্য হিদায়াতের উৎসস্বরূপ। আল-কুরআনের নির্দেশনা মেনে চললে মানুষ দুনিয়াতে শান্তি ও সম্মান পাবে। আর আখিরাতে চিরশান্তির জান্নাত লাভ করবে। আল্লাহ তা'আলা বলেন,

অর্থ: ‘এই কিতাব আমি নাযিল করেছি, যা কল্যাণময়। অতএব, তোমরা এর অনুসরণ কর এবং সাবধান হও, হয়তো তোমাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করা হবে।' (সূরা আল-আন'আম, আয়াত: ১৫৫)

আল কুরআন অবতরণ

আল কুরআন আল্লাহ তা'আলার কালাম। আল্লাহ তা'আলা ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে রমযান মাসের ২৭ তারিখ লাইলাতুল ক্বদর বা মহিমান্বিত রাতে কুরআন মাজিদ নাযিল করা শুরু করেন। আমরা এ রাতকে শবে কদরও বলে থাকি। এটি লাওহে মাহফুজ বা সংরক্ষিত ফলকে লিপিবদ্ধ আছে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলা বলেন,

অর্থ: ‘বস্তুত এটি সম্মানিত কুরআন। সংরক্ষিত ফলকে লিপিবদ্ধ।'(সূরা আল বুরূজ, আয়াত: ২১-২২)

আল কুরআন আল্লাহর বাণী যা তিনি আরবি ভাষায় নাযিল করেছেন। কারণ, আমাদের প্রিয়নবি হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর ভাষা ছিলো আরবি। তিনি আরব দেশের মক্কা নগরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মের সময় গোটা আরব ছিল অজ্ঞতা ও বর্বরতায় আচ্ছন্ন। তারা মূর্তির পূজা করত। নবি করিম (সা.) আরবদের এরূপ অজ্ঞতা ও বর্বরতা পছন্দ করতেন না। তিনি সব সময় সত্য ও সুন্দরের অনুসন্ধান করতেন। এ জন্য তিনি হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন থাকতেন। হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন অবস্থাতেই তাঁর নিকট সর্বপ্রথম কুরআনের বাণী নাজিল হয়। তিনি সত্যের সন্ধান পান। তখন তাঁর বয়স ছিল চল্লিশ বছর। আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে শেষ নবি ও রাসুল হিসেবে মনোনীত করেন এ সময় মহান আল্লাহর নির্দেশে হযরত জিবরাইল (আ.) সূরা আলাকের প্রথম ৫ আয়াত নিয়ে তাঁর নিকট আগমন করেন। এটাই ছিল সর্বপ্রথম ওহি। তাঁর জীবদ্দশায় আল্লাহ তা'আলা প্রয়োজন অনুসারে আল কুরআনের । বিভিন্ন অংশ অল্প অল্প করে নাযিল করেন। কখনো ৫ আয়াত, কখনো ১০ আয়াত, কখনো আয়াতের অংশবিশেষ, আবার কখনো একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা একসাথে নাযিল হতো। এভাবে দীর্ঘ ২৩ বছরে আল কুরআন সম্পূর্ণ অবতীর্ণ হয়।

আল-কুরআন সংরক্ষণের দায়িত্ব

আল কুরআন মহান আল্লাহর বাণী। আল্লাহ তা‘আলা নিজে আল কুরআন সংরক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। আল্লাহ তা'আলা বলেন,

অর্থ: ‘নিশ্চয়ই আমিই কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং অবশ্যই আমিই এর সংরক্ষক।' (সূরা আল হিজর, আয়াত : ৯)

আল্লাহ তা'আলা স্বয়ং আল কুরআনের সংরক্ষক। তিনি তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এ কিতাব সংরক্ষণ করেন। এ জন্য আজ পর্যন্ত এ কিতাবের একটি হরফ (অক্ষর), হরকত বা নুকতারও পরিবর্তন হয়নি। এটি যেভাবে নাজিল হয়েছিল আজও ঠিক সেভাবেই বিদ্যমান। আর কিয়ামত পর্যন্ত অবিকৃত থাকবে। পবিত্র কুরআন সেই প্রথম থেকে এখন পর্যন্ত অগণিত হাফেযের মাধ্যমেও সংরক্ষিত আছে। কেউ ভুল করলে সাথে সাথে অন্যরা-এমনকি সালাত অবস্থায়ও সংশোধন করে দেন।

আল কুরআন সংরক্ষণ

কুরআন মাজিদের কোনো অংশ নাযিল হলে সর্বপ্রথম মহানবি (সা.) তা নিজে মুখস্থ করে নিতেন। এরপর তা সাহাবিগণকে মুখস্থ করতে বলতেন। মহানবি (সা.)-এর উৎসাহ ও নির্দেশে সাহাবিগণ আল-কুরআন মুখস্থ করতেন, দিনরাত তিলাওয়াত করতেন, নামাযে পাঠ করতেন এবং পরিবার-পরিজন, স্ত্রী-সন্তান ও বন্ধু- বান্ধবদের মুখস্থ করাতেন। এভাবে আল-কুরআন সর্বপ্রথম মুখস্থ করার মাধমে সংরক্ষণ করা হয়। উল্লেখ্য, তৎকালীন আরবদের স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ। তারা কোনো জিনিস শিখলে তা আর কখনো ভুলত না। সম্ভবত আল কুরআন মুখস্থ করার জন্যই আল্লাহ তা'আলা তাঁদের এরূপ অসাধারণ স্মরণশক্তি দান করেছিলেন। তাদের এ অসাধারণ স্মরণশক্তির কারণে কুরআন মাজিদ সহজেই তাদের স্মৃতিপটে সংরক্ষিত হয়।

আল কুরআন লেখনীর মাধ্যমেও সংরক্ষণ করা হয়। কুরআনের কোনো অংশ নাযিল হলে তা মুখস্থ করার পাশাপাশি লিখে রাখার জন্যও নবি করিম (সা.) নির্দেশ দিতেন। যে সকল সাহাবি লিখতে জানতেন তাঁরা এ দায়িত্ব পালন করতেন। তাঁদের বলা হয় কাতিবে ওহি বা ওহি লেখক। তাঁদের সংখ্যা ছিল ৪২ জন। প্রধান ওহি লেখক সাহাবি ছিলেন হযরত যায়দ ইবন সাবিত (রা.)। ওহি লেখক সাহাবিগণের মধ্যে কেউ না কেউ সদা সর্বদা নবি (সা.)-এর সাথে থাকতেন। কুরআনের কোন অংশ নাযিল হলে তাঁরা সাথে সাথেই তা লিখে রাখতেন। সেসময় কুরআন মাজিদ খেজুর গাছের ডাল, পশুর হাড়, চামড়া, ছোট ছোট পাথর ইত্যাদিতে লিখে রাখা হতো।

আল কুরআন সংকলন

মহানবি (সা.) এর সময়ে আল কুরআন মুখস্থ ও লেখনীর মাধ্যমে পুরোপুরি সংরক্ষণ করা হয়। কিন্তু সে সময় তা একত্রে গ্রন্থাবদ্ধ হয়নি। বরং তাঁর তত্ত্বাবধানে লিপিবদ্ধ টুকরোগুলো নানাজনের নিকট সংরক্ষিত ছিল। হযরত আবু বকর (রা.)-ই সর্বপ্রথম কুরআন সংকলনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ছিলেন ইসলামের প্রথম খলিফা। তাঁর সময় ইয়ামামার যুদ্ধে কুরআনের বহুসংখ্যক হাফিজ শাহাদাৎবরণ করেন। এ অবস্থা দেখে হযরত উমর (রা.) ভাবলেন কুরআনের হাফিজগণ এভাবে ইন্তেকাল করলে কুরআনের অনেক অংশ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তাই তিনি হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) কে কুরআন সংকলনের পরামর্শ দেন। হযরত উমর (রা.) এর পরামর্শক্রমে হযরত আবু বকর (রা.) কুরআন সংকলনের উদ্যোগ নেন। তিনি প্রধান ওহী লেখক সাহাবি হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত (রা.) কে সাহাবিদের নিকট সংরক্ষিত কুরআনের লিখিত অংশগুলো একত্র করেন। পাশাপাশি তিনি কুরআনের হাফিজগণের সাহায্যও গ্রহণ করেন। কুরআনের প্রতিটি অংশ তিনি লেখনী ও মুখস্থ উভয় পদ্ধতির সাথে মিলিয়ে দেখেন। এভাবে তিনি সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে আল কুরআনের প্রামাণ্য পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেন। আল কুরআনের এ কপিটি খলিফা হযরত আবু বকর (রা.) এর নিকট সংরক্ষিত ছিল। তাঁর ইন্তেকালের পর তা দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রা.) এর তত্ত্বাবধানে সংরক্ষিত থাকে। হযরত উমর (রা.)-এর শাহাদাতের পর এ কপিটি তাঁর মেয়ে উম্মুল মুমিনীন হযরত হাফসা (রা.)-এর নিকট সংরক্ষিত থাকে।

ইসলামের তৃতীয় খলিফা ছিলেন হযরত উসমান (রা.)। তাঁর সময়ে ইসলামি সাম্রাজ্য ছিল বিশাল-বিস্তৃত। পৃথিবীর নানা প্রান্তে ও দেশে ইসলাম ছড়িয়ে পড়েছিল। ফলে মুসলমানদের সংখ্যাও ছিল অগণিত। এ সময় বিভিন্ন অঞ্চলে কুরআনের পাঠরীতি নিয়ে মারাত্মক বিপর্যয় দেখা দেয়। এ নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে নানা অনৈক্যের সৃষ্টি হয়। এমতাবস্থায় হযরত উসমান (রা.) বিশিষ্ট সাহাবীগণের সাথে পরামর্শ করে আল কুরআনের একক ও প্রামাণ্য পাঠরীতি প্রচারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এজন্য তিনি হযরত যায়েদ (রা.)-এর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেন। এ কমিটি হযরত হাফসা (রা.)-এর নিকট সংরক্ষিত মূল পাণ্ডুলিপি থেকে আরও সাতটি অনুলিপি প্রস্তুত করেন। এরপর বিভিন্ন প্রদেশে আল কুরআনের একটি করে কপি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ফলে পবিত্র কুরআনের পাঠরীতি নিয়ে মুসলমানদের অনৈক্য দূর হয়। আল কুরআন সংরক্ষণের এরূপ অসামান্য অবদানের জন্য হযরত উসমান (রা.) কে ‘জামিউল কুরআন' বলা হয়। জামিউল কুরআন অর্থ কুরআন সংকলক বা কুরআন একত্রকারী।

Content added By