সপ্তম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - শিল্প ও সংস্কৃতি - NCTB BOOK

বহুদিন পরে মনে পড়ে আজি পল্লী মায়ের কোল, 

ঝাউশাখে যেথা বনলতা বাঁধি হরষে খেয়েছি দোল 

কুলের কাটার আঘাত লইয়া কাঁচা পাকা কুল খেয়ে, 

অমৃতের স্বাদ যেন লভিয়াছে গাঁয়ের দুলালি মেয়ে 

পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসে খুশীতে বিষম খেয়ে, 

আরো উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি খেয়ে। 

                                                    সুফিয়া কামাল।

বারো মাসে তের পার্বণের দেশ আমাদের বাংলাদেশ। এইসব পার্বণ আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির শেকড়। পৃথিবীর সমস্ত দেশের সংস্কৃতির মতো এদেশেও শিল্প একটা বড় জায়গা নিয়ে আছে আমাদের রোজকার জীবনে। রান্নাঘরের পাটাপুতার (শিলনোরা) নকশা থেকে গায়ে দেয়ার কাঁথায়ও কতরকমের নকশা। খেয়াল করে কখনও দেখা হয় না আমাদের খুব একটা। তারপরও কিছু কিছু নকশা এমন সুন্দর হয় যে খেয়াল না করে উপায় থাকে না।

নকশি পিঠা তেমন সুন্দর একটা শিল্প। যুগে যুগে উৎসব অনুষ্ঠানের একটা প্রধান আকর্ষণ পিঠা আর সে পিঠা দেখতে গিয়ে যদি খাওয়ার কথা মুহূর্তের জন্য কেউ ভুলে যায় তবে সে নিশ্চিত একটা দারুণ বিষয়। নকশি পিঠার কথাই বলছি। কিছু ঘরোয়া টুকিটাকি যেমন চুলের কাঁটা বা খেজুর কাঁটা, সুঁচ, কাঠি, কাঁটাচামচ বা আনকোরা নতুন চিরুনি, এককথায় যাকিছু দিয়ে নকশা ফোটানো তার সবই ব্যবহার হয় নকশা করার জন্য। যেন আমাদের চেনা পরিবেশ থেকে পরিচিত সব ফল, ফুল, মাছ, গাছ, লতাপাতা সেসব নকশায় উঠে আসে রূপকথার রূপ নিয়ে নকশি পিঠার নকশায়। এসব নকশা শিশুকাল থেকেই মনে আগ্রহ জন্ম দেয়, সুন্দরকে দেখার আর সেটা চর্চায় আনার প্রথম পাঠ আমাদের নিতান্ত সহজ সাধারণ পিঠা-পার্বণের হাত ধরে।

পিঠার নকশাতো হলো এবার বলি রিক্সার কথা এ যেন এক বর্নিল নকশার জগত। আমাদের দেশে রিক্সার গায়ে পেইন্টিং, হুডে নকশা – সব মিলিয়ে প্রতিটি রিক্সা যেন এক একটা চলমান শিল্প। রিক্সা শিল্পীদের দীর্ঘ দিনের চর্চার মাধ্যমে বাংলাদেশের রিক্সা শিল্প আজ একটি জনপ্রিয় শিল্পধারা হিসেবে দেশের বাইরেও সমাদৃত হচ্ছে।

পোশাকে, চাদরে, বিভিন্ন আসবাবপত্রের গায়ে, চায়ের কাপে, খাবারের থালায়, জানালার গ্রিলে, ঘরের মেঝেতে প্রসাধনীর প্যাকেট, ঘড়ি থেকে মোবাইল ফোন সবত্রই আমরা নকশা দেখতে পাই।

ওপরের ছবিগুলো যদি লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাব নানা রকমের রেখা ও আকার-আকৃতিকে একই রকম করে পুনরাবৃত্তিকভাবে (repetitive) সাজিয়ে তৈরি করা হয়েছে নকশাগুলো। বিভিন্ন রেখা পাশাপাশি রেখে, প্রাকৃতিক ও জ্যামিতিক আকার-আকৃতি দিয়েও সৃষ্টি করা যায় নানা রকমের নকশা। ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে আমরা জেনেছিলাম ছবি আঁকার উপাদান রেখা, আকার-আকৃতি, গড়ন সম্পর্কে। সোজা, বাঁকা, মোটা, চিকন, খাড়া, শোয়ানো, কোনাকুনি নানা রকমের রেখা দিয়ে সৃষ্টি করা যায় অসাধারণ সব শিল্পকর্ম। এই অভিজ্ঞতায় আমরা নিজেদের আশপাশে থেকে বিভিন্ন রকমের রেখার মাধ্যমে তৈরি নকশা খুঁজে বের করব এবং তা আমাদের বন্ধু খাতায় লিখে/এঁকে রাখব; যা আমরা নকশা তৈরিতে ব্যবহার করব। প্রাকৃতিক ও জ্যামিতিক আকার ও আকৃতি দিয়ে নকশা ও বিভিন্ন শিল্প তৈরির বিষয়ে আমরা পরবর্তী সময়ে আরও জানব।

এই পাঠে প্রথমে আমরা জানব কীভাবে সহজে নকশা তৈরি করা যায়।

নকশা : পরিকল্পনা অনুসারে রেখা বা আকার-আকৃতিকে একই রকম করে পুনরাবৃত্তিক (repetitive) ভাবে সাজানোর মধ্যদিয়ে আমরা সহজে নকশা তৈরি করতে পারি। নকশা তৈরি আরো কিছু নিয়ম-রীতি আছে যা আমরা পরবর্তীতে জানব।

এবার আমরা বিভিন্ন রকমের রেখা দিয়ে নকশা তৈরি করব, এই ক্ষেত্রে আমরা আমাদের সংগৃহীত নকশার নমুনা থেকেও সাহায্য নিতে পারি।

* প্রথমে আমরা নুন্যতম দৈর্ঘ্যে ছয় ইঞ্চি, প্রস্থে চার ইঞ্চি একটা আয়তক্ষেত্র আঁকব । 

* আয়তক্ষেত্রটাকে ১ ইঞ্চি করে করে ভাগ করে নিব। যার ফলে আয়তক্ষেত্রটির দৈর্ঘ্যে আমরা ৬টি ১ ইঞ্চি মাপের আর প্রস্থে ৪টি ১ইঞ্চি মাপের ছক পাব। মনে রাখার সুবিধার্তে আমরা প্রত্যেকটা সারিকে ১, ২, ৩, এই ভাবে নম্বর দিয়ে রাখতে পারি। 

* ১ নম্বর সারির প্রথম ঘরে আমরা ২টি সোজা রেখা পাশাপাশি আঁকব। 

* ২ নম্বর সারির প্রথম ঘরে আমরা ২টি সোজা রেখা খাড়াভাবে আঁকব। 

* এইভাবে ৬ নম্বর সারি পর্যন্ত ২৪ ঘর পুরণ করে আমরা একটা সহজ নকশার প্যাটার্ন তৈরি করতে পারি।

একইভাবে সোজা রেখাকে কোনাকুনিভাবে সাজিয়ে সারির সংখ্যা বাড়িয়ে-কমিয়েও আমরা নকশার প্যাটার্ন তৈরি করতে পারি।

সোজা রেখার জায়গায় আমরা বক্র রেখা পাশাপাশি এবং খাড়াভাবে এঁকেও নকশার প্যাটার্ন তৈরি করতে পারি। তাছাড়া একাধিক প্যাটার্নকে একত্রিত করেও আমরা ভিন্ন ভিন্ন রকমের নকশা তৈরি করতে পারি।

এবার আমরা জানব এমন একজন বিখ্যাত শিল্পীর কথা যিনি ছবি আঁকার অন্যান্য মাধ্যম যেমন— জলরং, তেলরঙের সাথে সাথে শুধু কালি দিয়ে রেখার আঁচড়ে সৃষ্টি করেছেন কালজয়ী সব শিল্পকর্ম। তিনি হলেন আমাদের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। আমরা এবার জেনে নেই, তাকে কেন শিল্পাচার্য বলা হয়।

জয়নুল আবেদিন বাংলাদেশের আধুনিক শিল্প আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। যেটি শুরু হয়েছিল গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অফ আর্টস অ্যান্ড ক্রাফ্টস (বর্তমানে চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) স্থাপনের মাধ্যমে। এই যাত্রায় তার সঙ্গী ছিলেন আনোয়ারুল হক, সফিউদ্দিন আহমেদ, শফিকুল আমীন, কামরুল হাসান প্রমুখ শিল্পী। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। তাঁর শৈল্পিক দূরদর্শীতায় ও নেতৃত্বে আমাদের দেশের শিল্পশিক্ষা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। এই জন্য তাঁকে ‘শিল্পাচার্য' উপাধি দেওয়া হয়।

আমাদের লোকশিল্পের প্রতি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ছিল অসীম ভালোবাসা। লোকশিল্প ধারাগুলোকে সকলের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য তিনি বেশকিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় সোনারগাঁয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় লোকশিল্প জাদুঘর।

যা করব—

     ■ আশপাশে দেখা/জানা লোকশিল্পের তালিকা বন্ধুখাতায় লিখে রাখব। 

     ■ আশপাশে পুনারাবৃত্তিকভাবে অবস্থান করে নকশা তৈরি করছে/হচ্ছে তার layout/খসড়া বন্ধুখাতায় এঁকে রাখব। 

     ■ রেখাভিত্তিক এবং আকৃতিভিত্তিক নকশা খুঁজে পেলে তা আলাদা করে রাখব। 

     ■ কাগজ/মাটি দিয়ে repetitive pattern তৈরি করতে পারি। 

     ■ কাগজ কেটে ঝালর তৈরি করতে পারি। 

     ■ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের শিল্পকর্ম সম্পর্কে আরো জানার চেষ্টা করব।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Content added By