একাদশ- দ্বাদশ শ্রেণি - ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি - ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি ২য় পত্র | NCTB BOOK

বাংলার ইতিহাস: স্বাধীন সুলতানি আমল (১৩৩৮-১৫৩৮ খ্রি.)
 


ইখতিয়ারউদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির মাধ্যমে ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা হলে বাংলার ইতিহাসে এক নবযুগের সূচনা হয়। কেননা এরপর থেকে রাজা গণেশের স্বল্পকালীন শাসনামল ব্যতীত ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা মুসলিম শাসনাধীনে ছিল। বখতিয়ারের বাংলা বিজয়ের পর থেকে ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যেসব খলজি মালিক, তুর্কি শাসক ও বলবনী শাসকগণ বাংলা শাসন করেছেন তাদের অনেকেই পুরোপুরি স্বাধীন ছিলেন না, বরং তাঁরা দিল্লির সুলতানদের দ্বারা নিয়োগপ্রাপ্ত হতেন। কিন্তু দিল্লি থেকে বাংলা দূরবর্তী স্থানে হওয়ায় তাঁদের অনেকেই সুযোগ পেলেই স্বাধীনতার জন্য দিল্লির সুলতানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। এজন্য বাংলাকে বুলঘাকপুর বা বিদ্রোহের নগরীও বলা হত । ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে সোনারগাঁও-এ স্বাধীন সুলতানি যুগের সূচনা করেন। তখন থেকে ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় দু'শ বছর ধরে বাংলাদেশ অবিচ্ছিন্নভাবে স্বাধীনতা ভোগ করেছিল। বাংলার এই স্বাধীন সুলতানি যুগে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ, ইলিয়াস শাহী বংশ, রাজা গণেশের বংশ, হাবশি সুলতান এবং পরবর্তীতে হোসেন শাহী বংশের শাসকগণ বাংলা শাসন করেছেন। এ সময় বাংলার সুলতানগণ নিজেদের যোগ্যতা, শক্তি ও ঐশ্বর্য দিয়ে ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ নৃপতিদের পাশে স্থান করে নিয়েছিলেন। তাঁরা বাংলায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা, শিক্ষাসংস্কৃতির উৎকর্ষ সাধন, জনকল্যাণকামী কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছেন। তাই দু'শ বছরের এ স্বাধীন যুগটিকে বাংলার গৌরবময় যুগ বলা হয় ।

এই ইউনিটের পাঠসমূহ
পাঠ- ১ ঃ সুলতান ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ: সুলতানি শাসন প্রতিষ্ঠা, চরিত্র ও কৃতিত্ব মূল্যায়ন
পাঠ- ২ ঃ ইলিয়াস শাহী বংশ: শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ
পাঠ-৩ ঃ সিকান্দর শাহ ও গিয়াস উদ্দিন আযম শাহ
পাঠ- ৪ : রাজা গণেশ ও পরবর্তী শাসন
পাঠ- ৫ : পরবর্তী ইলিয়াস শাহী বংশ
পাঠ-৬ ঃ বাংলায় হাবশি শাসন
পাঠ- ৭ : হোসেন শাহী বংশ: আলাউদ্দিন হোসেন শাহ
পাঠ- ৮ : পরবর্তী হোসেন শাহী শাসন ও হোসেন শাহী বংশের অবদান পাঠ- 
৯ : সুলতানি বাংলার আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা

 

 


পাঠ-৫.১
সুলতান ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ: সুলতানি শাসন প্রতিষ্ঠা, চরিত্র ও কৃতিত্ব মূল্যায়ন
উদ্দেশ্য
এই পাঠ শেষে আপনি-
বাংলায় কীভাবে স্বাধীন সুলতানি যুগের সূচনা হয় তা বর্ণনা করতে পারবেন । ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের গৌরবোজ্জ্বল রাজত্বকাল, বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর অবদান সম্পর্কে জানতে পারবেন ও
মরক্কোর বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতার বাংলায় ভ্রমণের বিবরণ দিতে পারবেন ।

মূখ্য শব্দ
ফখরুদ্দিন, সোনার গাঁ ও ইবনে বতুতা
ভূমিকা
১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেও ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার শাসকগণ দিল্লির সুলতানদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতেন। দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের শাসনামলে বাংলাকে সোনারগাঁও, লখনৌতি ও সাতগাঁও এই তিনটি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়। ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে সোনারগাঁওয়ের শাসনকর্তা বাহরাম খানের (তাতার খান) মৃত্যু হলে ‘ফখরা’ বা ফখরুদ্দিন নামে তাঁর একজন সিলাহ্দার (বর্মরক্ষক) স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তিনি ‘মুবারক শাহ’ উপাধি গ্রহণ করেন। এ সময় দিল্লির সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বিদ্ৰোহ দমনে ব্যস্ত থাকায় বাংলায় ফখরুদ্দিনের বিরুদ্ধে তিনি কোন অভিযান প্রেরণ করতে পারেননি। ফলে বাংলা দিল্লির প্রশাসন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। কেন্দ্রের দূর্বলতার সুযোগে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ফখরুদ্দিন বাংলায় তাঁর কর্তৃত্ব সুদৃঢ় করলে ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে বাংলায় দু'শো বছরের স্বাধীন ইতিহাসের সূচনা হয় ।
প্রাথমিক বিদ্রোহ দমন ও সোনারগাঁ পুনরুদ্ধার ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের স্বাধীনতা ঘোষণায় লখনৌতির গভর্নর কদর খান ও সাতগাঁও-এর গভর্নর মালিক ইজুদ্দিন ইয়াহিয়া যৌথভাবে ফখরুদ্দিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান প্রেরণ করেন। শত্রুপক্ষের সম্মিলিত আক্রমণে তিনি বিপর্যস্ত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে বর্তমান টাঙ্গাইলের মধুপুরের জঙ্গলে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। আক্রমণকারীদের অনেকেই নিজ নিজ অঞ্চলে ফিরে গেলেও কদর খান সোনারগাঁও-এ থেকে যান। ফখরুদ্দিন বর্ষার আগমনের প্রতিক্ষায় ছিলেন। কারণ সোনারগাঁও ছিল নিম্ন অঞ্চল। অঞ্চলটি বর্ষায় প্লাবিত হলে কদরখানের সেনাবাহিনীকে সহজেই কাবু করা যাবে। বর্ষা মৌসুম এলে ফখরুদ্দিন সোনারগাঁও-এ অবস্থানরত কদর খানকে পাল্টা আক্রমণ করলে কদরখান অবরুদ্ধ হন। ফখরুদ্দিন কদর খানের সৈন্যদের গোপনে ঘুষ প্রদান করে তাদেরকে নিজের দলভুক্ত করেন। অবশেষে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধে কদর খান পরাজিত ও নিহত হলে ফখরুদ্দিন সোনারগাঁও পুনরুদ্ধার করতে সমর্থ হন। এই সোনারগাঁও-ই হল স্বাধীন বাংলার প্রথম রাজধানী।
তাঁর কৃতিত্ব
ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ ছিলেন বাংলার প্রথম স্বাধীন সুলতান। একজন যোগ্য শাসক ও কূটকৌশলী রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তিনি নিজ নামে মুদ্রা জারি করেন। তিনি তাঁর রাজ্যসীমা দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অনেকটা সম্প্রসারণ করেন। তিনি চট্টগ্রাম বিজয় করেন এবং এ পর্যন্ত সমগ্র ভূ-ভাগে তাঁর সুদৃঢ় নিয়ন্ত্রণে ছিল। লখনৌতি দখলের জন্য বার বার চেষ্টা করেও তিনি সফলতা পাননি । তিনি চাঁদপুর থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত একটি রাজপথ নির্মাণ করেছিলেন বলে জানা যায় ।
প্রজাহিতৈষী শাসক
তিনি একজন বিচক্ষণ ও প্রজাহিতৈষী শাসক ছিলেন। তিনি তাঁর রাজ্যে অনেক মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকাহ ইত্যাদি নির্মাণ করেন। তিনি আউলিয়া, পীর-দরবেশ ও ফকিরদের উদার পৃষ্ঠপোষকতা করেন। ফলে চট্টগ্রাম থেকে পুরো পূর্ববঙ্গে ইসলাম ধর্মের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার ঘটে।
 


পর্যটক ইবনে বতুতার বিবরণী
ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের রাজত্বকালে সুদূর আফ্রিকার মরক্কো থেকে ইবনে বতুতা নামে একজন মুসলিম পর্যটক ১৩৪৫- ৪৬ খ্রি. বাংলায় অসেন। তাঁর ‘রেহেলা-ই-ইবনে বতুতা' নামক ভ্রমণ বিবরণীতে সমসাময়িক বাংলায় আর্থ-সামাজিক অবস্থার অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। তিনি তৎকালীন বাংলার কৃষি, বাণিজ্য, সামাজিক অবস্থা, সম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, নারীর মর্যাদা ইত্যাদির প্রসংশা করেছেন। ইবনে বতুতা সিলেটের প্রখ্যাত সাধক হযরত শাহজালালের সাথে সাক্ষাৎ করেন। পরবর্তীকালে তিনি চীনের রাজদরবার গমনের উদ্দেশ্যে বাংলা ত্যাগ করেন ৷

সারসংক্ষেপ :
ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ বাংলার প্রথম স্বাধীন সুলতান ছিলেন। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্ব ও কর্মে বাংলার অভ্যন্তরীণ অবস্থার ব্যাপক উন্নতি ঘটলে বাংলার সুনাম এর বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর সময়ে বাংলার সীমানা চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত হলে বাংলার গৌরব উজ্জ্বলতর হয়। তাই ফখরুদ্দিনের রাজত্বকালকে বাংলার গৌরবময় যুগ বলা হয় ।
 

 

 

 

 


ইলিয়াস শাহী বংশ: শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ
পাঠ-৫.২
উদ্দেশ্য
এই পাঠ শেষে আপনি-
বাংলার সুলতানি আমলের প্রথম স্বাধীন রাজবংশ ইলিয়াস শাহী বংশের প্রতিষ্ঠাতা সম্পর্কে জানতে পারবেন। ইলিয়াস শাহের রাজ্য বিস্তারের একটি ধারণা লাভ করতে পারবেন;
বাংলার স্বাধীন সালতানাতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের কৃতিত্ব বর্ণনা করতে পারবেন ।
মূখ্য শব্দ
শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ, শাহ-ই-বাঙ্গালাহ ও একডালা দুর্গ
শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের প্রাথমিক জীবন
শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের পরিচয় ও প্রথম জীবন সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। ঐতিহাসিক ইবন হজর ও আল সাখাভির মতে, সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হবার পূর্বে তাঁর নাম ছিল হাজী ইলিয়াস। তিনি পূর্ব ইরানের সিজিস্তানের অধিবাসী ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। ইলিয়াস শাহ কখন, কিভাবে ভারতবর্ষে আসেন তাঁর সমকালীন কোন বিবরণ পাওয়া যায় না। তবে গোলাম হোসেন সলিম এর রিয়াজউস-সালাতীন গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে, হাজী ইলিয়াস ও তাঁর এক দুধভাই আলী মুবারক এক সময় দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহ তুগলকের ভৃত্য ছিলেন। কিন্তু এসময় কোন অপকর্ম করে হাজী ইলিয়াস জীবন বাঁচাতে পালিয়ে যান। এর ফলে ফিরোজ শাহ হাজী ইলিয়াসকে ধরে আনার জন্য আলী মুবারককে আদেশ করেন। আলী মুবারক হাজী ইলিয়াসকে খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হলে ফিরোজ শাহ আলী মুবারককে বিতাড়িত করেন। অতঃপর আলী মুবারক বাংলায় চলে আসেন এবং লখনৌতির শাসনকর্তা কদর খানের অধীনে চাকরি লাভ করেন। অল্পকালের মধ্যেই আলী মোবারক কদর খানের আস্থাভাজন হন এবং কালক্রমে প্রধান সেনাপতির পদ লাভ করেন। ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের সাথে এক যুদ্ধে কদর খান নিহত হলে তাঁর সেনাধ্যক্ষ আলী মুবারক ‘সুলতান আলাউদ্দিন আলী শাহ' উপাধি গ্রহণ করে লখনৌতির সিংহাসনে বসেন ।
শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের ক্ষমতালাভ
ভাই আলী মোবারক লখনৌতির শাসক হলে হাজী ইলিয়াস কিছুকাল পরে দিল্লি হতে বাংলায় আসেন কিন্তু আলী মুবারক
তাঁকে বন্দি করেন। পরে তাঁর মাতার অনুরোধে আলী মুবারক তাঁকে ছেড়ে দেন এবং উচ্চ রাজপদে নিয়োগ করেন । কিন্তু হাজী ইলিয়াস এক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আলাউদ্দিন আলী শাহকে হত্যা করে নিজে ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দে সুলতান শামসুদ্দিন ‘ইলিয়াস শাহ’ উপাধি গ্রহণ করে লখনৌতির সিংহাসনে বসেন।
শাসন সুদৃঢ়করণ
একজন সুযোগ্য রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে ইলিয়াস শাহ শাসন ক্ষমতায় বসেই সেনাবাহিনীকে সুসংহত করেন। তিনি রাজ্যের কেন্দ্রিয় প্রশাসনকে সুষ্ঠুভাবে বিন্যস্ত করে সার্বভৌম রাজবংশ প্রতিষ্ঠার জন্য রাজ্য বিস্তারে মনোযোগ দেন এবং একে একে সাতগাঁও, ত্রিহুত, নেপাল ও পূর্ব বাংলা সহ অনেক স্থানে অভিযান চালনা করে ইলিয়াস শাহী শাসনকে সুদৃঢ় করেন ।
রাজ্য বিস্তার: সাতগাঁও বিজয়
ইলিয়াস শাহ ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দে উত্তর ও উত্তর পশ্চিম বাংলার অধিপতি হয়ে ফিরোজাবাদে নিজের অবস্থানকে সুসংহত করে রাজ্য বিস্তারে মনোনিবেশ করেন। তিনি প্রথমে সাতগাঁও-এর দিকে রাজ্য সম্প্রসারণের চেষ্টা করেন। এজন্য তিনি ১৩৪৬ সালের মধ্যে সাতগাঁও সহ সমগ্র দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলায় নিজ আধিপত্য বিস্তার করেন।
ত্রিহুত বিজয় ও নেপাল অভিযান
ইলিয়াস শাহ তাঁর রাজ্যের পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত ত্রিহুত অধিকার করেন। তিনি ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে নেপালে অভিযান করে দুর্গম পর্বতময় নেপাল থেকে প্রচুর ধনসম্পদ হস্তগত করে বাংলায় ফিরে আসেন ।
সোনারগাঁ অধিকার
 

 

 

 

 


পরিচয় দিয়েছেন। ইলিয়াস শাহ একজন ধার্মিক ও নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন। ফকির ও দরবেশগণকে তিনি খুব শ্রদ্ধা করতেন। পীর আঁখি সিরাজউদ্দিন ও তাঁর শিষ্য শায়খ আলাউল হক এবং শায়খ রাজা বিয়াবানী এদেশে আগমন করে তাঁর দরবার অলংকৃত করেন। তিনি তাঁদের সম্মানে রাজ্যময় খানকাহ, মসজিদ ও মাদ্রাসা স্থাপন করেন ৷
কৃতিত্ব মূল্যায়ন
ইলিয়াস শাহের রাজত্বকাল বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল অধ্যায়। একজন সামান্য শাসক থেকে একত্রিত বৃহৎ বাংলা প্রতিষ্ঠিত করে এখানে সুষ্ঠু প্রশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে জনকল্যাণমূলক শাসন প্রতিষ্ঠিত করায় ইলিয়াস শাহ বাংলার ইতিহাসে উচ্চ স্থান অধিকার করে আছেন। দুইবাংলার সমগ্র সীমানাকে একত্রিত করে বাঙ্গালাহ নামটি তাঁর সময়েই প্রচলিত হয় এবং সামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহকে শাহ-ই-বাঙ্গালাহ বলা হয়। তাঁর রাজত্বকালে বাঙালিরা সর্বপ্রথম একটি জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এ সময় বাংলার লোকেরা বাঙালি হিসেবে পরিচিত হয়। এ কারণে ঐতিহাসিকগণ তাঁকে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদের জনক' বলে উল্লেখ করেছেন। বাংলার ইতিহাসের এ মহানায়ক সুদীর্ঘ ১৬ বছর রাজত্ব
করার পর ১৩৫৮ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন ।  

শিক্ষার্থীর কাজ
একটি চার্টের মাধ্যমে ইলিয়াস শাহ কর্তৃক জয়কৃত অঞ্চলের পরিচয় তুলে ধরুন।
সারসংক্ষেপ :
ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ বাংলার স্বাধীন সুলতানি যুগের সূচনা করলেও সুলতানি যুগের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ। অতি সাধারণ অবস্থা থেকে লখনৌতির শাসক হয়ে লখনৌতি, সাতগাঁও, সোনারগাঁ ও বিহার অধিকার করে সমগ্র বাংলাকে একটি কেন্দ্রিয় শাসনের অধীনে এনে ইলিয়াস শাহ বাংলার ইতিহাসে অমর স্থান অধিকার করে আছেন।
 

 

 

 


তিনি একজন শিল্পানুরাগী ও শিল্পস্রষ্টা সুলতান ছিলেন। তাঁর রাজত্বকালে স্থাপত্য শিল্পের যথেষ্ট উন্নতি হয়। সিকান্দর শাহের উদার নীতির ফলে স্থাপত্য শিল্পে দেশী ও বিদেশী উপাদানের সংমিশ্রণ ঘটে। এ কারণে বাংলাদেশের স্থাপত্য রীতিতে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হয়। তাঁর রাজত্বকালের স্থাপত্য নিদর্শনের মধ্যে পাণ্ডুয়ার আদিনা মসজিদ দিনাজপুরের মোল্লা আতার মসজিদ এর নাম উল্লেখযোগ্য। প্রায় দশ বছর (১৩৭৪-৮৪ খ্রি.) ধরে নির্মিত আদিনা মসজিদ দৈর্ঘ্যে ৫০৭.৫ ফুট এবং প্রস্থে ২৮৫.৫ ফুট ছিল। পাথর ও পোড়া মাটির নক্শা এ বৃহৎ মসজিদটির শোভাবৃদ্ধি করে। সর্বোপরি এর বিশালতা এবং উচ্চমানের কারুকার্যের জন্য এ মসজিদটি মুসলিম স্থাপত্যের ইতিহাসে অতুলনীয়। এছাড়া পীর আঁখি সিরাজ উদ্দিনের মসজিদ ও সমাধি এবং গৌড়ের কোতোওয়ালী দরওয়াজা তাঁর সময় নির্মিত হয়।
পীর দরবেশদের প্রতি অনুরাগ
পিতার মতই সিকান্দর শাহ একজন নিষ্ঠাবান মুসলিম ছিলেন। তিনি সুফি-দরবেশদেরকে অত্যন্ত ভক্তি ও শ্রদ্ধা করতেন। তিনি তাদের সম্মানে মসজিদ ও খানকাহ নির্মাণ করেন। জানা যায় যে, তিনি দিনাজপুর জেলার দেবকোর্টে অবস্থিত মোল্লা আতার দরগাহে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। শেখ আলাউল হক তাঁর সমসাময়িক ছিলেন এবং পাণ্ডুয়াতে বসবাস করতেন। তাঁর সমসাময়িক আর একজন বিখ্যাত সুফি শেখ শরফুদ্দিন ইয়াহিয়া মানেরি বিহারের মনের-এ বসবাস করতেন।
কৃতিত্ব মূল্যায়ন
ইলিয়াস শাহী বংশের দ্বিতীয় শাসক সিকান্দর শাহ একজন সুযোগ্য শাসক ছিলেন। তিনি সুশাসক ও প্রজাবৎসল ছিলেন। তাঁর শাসনামলে দেশে শান্তি ও সমৃদ্ধি বিরাজমান ছিল। তাঁর রাজত্বকালে কোন রাজ্যবিস্তার না হলেও তিনি তাঁর পিতার নিকট থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত রাজ্যের সীমানা অক্ষুণ্ণ রাখতে সক্ষম হন। তাঁর সময় শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের ব্যাপক উৎকর্য সাধিত হয়েছিল। তিনি বিদ্বানুরাগী ছিলেন এবং বিদ্বানের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। ভূমি জরিপ, রাজস্ব নির্ধারণ এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সুলতান সিকান্দর শাহ বাংলার ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন।
করুণ পরিসমাপ্তি
সিকান্দর শাহের শেষ জীবন সুখের হয়নি। গোলাম হোসেন সলিম উল্লেখ করেন যে, সিকান্দর শাহের পুত্র গিয়াসউদ্দিন আজম বিমাতার চক্রান্তে বিদ্রোহী হন এবং পিতা ও পুত্রের মধ্যে এক যুদ্ধ হয়। ১৩৯৩ খ্রিস্টাব্দে পিতা ও পুত্রের মধ্যকার সংঘটিত এ যুদ্ধে সিকান্দর শাহ পরাজিত ও নিহত হন। পাণ্ডুয়ার আদিনা মসজিদের সন্নিকটে তাঁকে সমাহিত করা হয় । গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ (১৩৯৩-১৪১০ খ্রি.)
সিংহাসনোরোহণ
সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ বিমাতার চক্রান্তে একান্ত বাধ্য হয়ে পিতা সিকান্দর শাহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তিনি রাজধানী পাণ্ডুয়া থেকে পালিয়ে সোনারগাঁও চলে যান এবং একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন । এরপর তিনি পিতা সিকান্দর শাহের সুসজ্জিত বাহিনীর মোকাবেলা করার জন্য অগ্রসর হন। সিকান্দর শাহ আজম শাহকে প্রতিরোধের চেষ্টা করলে গোয়ালপাড়া নামক স্থানে পিতা পুত্রের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সংঘটিত যুদ্ধে সিকান্দর শাহ মৃত্যুবরণ করেন। পিতা সিকান্দর শাহকে পরাজিত ও নিহত করে গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ ১৩৯৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন ।
বিদ্ৰোহ দমন
সিংহাসনে আরোহণ করে আজম শাহ প্রথমেই ষড়যন্ত্রকারী ১৭ জন বৈমাত্রেয় ভাইয়ের চক্ষু উৎপাটন করার নির্দেশ দেন। ইংরেজ ঐতিহাসিক বুকাননের মতে, আজম শাহ তাঁর ভাইদের হত্যা করেছিলেন। মধ্যযুগীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এমন ঘটনা মোটেও বিরল ছিল না। এরপর তিনি অত্যন্ত কঠোর হাতে সকল ধরণের প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, বিদ্রোহ ও বিরুদ্ধাচরণ দমন করে তাঁর রাজ্যেকে সকল প্রকারের শত্রু মুক্ত করেন।
রাজ্য বিস্তার
যুদ্ধ-বিগ্রহ বা রাজ্য বিস্তারে গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের কোন আগ্রহ ছিল না। তিনি রাজ্য বিস্তারের চেয়ে রাজ্যে শান্তি
স্থাপনের পক্ষপাতি ছিলেন। জানা যায় আজম শাহ আসামের কামরূপের কিছু অংশ রাজ্যভুক্ত করেন। কামরূপ ছাড়াও কামতা ও অহোমরাজ্যে তিনি সমরাভিযান চালনা করেছিলেন বলে জানা যায়, যদিও তিনি সেখানে সফলতা পাননি । তিনি

 

 


 

 



দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর সগৌরবে রাজত্ব শেষে ১৪০৯ খ্রিস্টাব্দে আজম শাহ রাজা গণেশের চক্রান্তে নিহত হন। আজম শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সাইফউদ্দিন হামযা শাহ সিংহাসনে বসেন। তিনি মাত্র দু'বছর রাজত্ব করেন। রাজা গণেশের চক্রান্তে সুলতানের ক্রীতদাস শিহাবউদ্দিন তাঁকে হত্যা করে নিজেই সিংহাসনে আরোহণ করেন। বায়েজিদ শাহ উপাধিধারী এই শাসক সম্ভবত: গণেশের চক্রান্তে নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর পর বায়েজিদের পুত্র আলাউদ্দিন ফিরোজশাহ সুলতান হন। পরবর্তীতে রাজা গণেশ তাকে অপসারণ করে নিজেই সিংহাসনে বসেন ৷

শিক্ষার্থীর কাজ
সিকান্দর শাহ্ ও গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের মধ্যকার সম্পর্ক চিহ্নিত করুন।
সারসংক্ষেপ :
ইলিয়াস শাহী শাসকদের মধ্যে সিকন্দার শাহ সুদীর্ঘ সময় ধরে বাংলার সুলতান ছিলেন। তাঁর রাজত্বকালে বাংলায় সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি বিরাজমান ছিল। তিনি সুকৌশলে ফিরোজ শাহের আক্রমণ প্রতিহত করেন। তিনি সাহিত্য, শিল্পকলা, স্থাপত্য প্রভৃতি সুকুমার শিল্পের উদার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ এক সংঘর্ষে পিতা সিকান্দর শাহকে হত্যা করে বাংলার সিংহাসন দখল করেন। তিনি ভাইদের প্রাথমিক বিদ্রোহ দমন করে রাজ্যের ভিত্তি সুদৃঢ় করেন। রাজ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে তিনি কোন খ্যাতি লাভ করতে না পারলেও দেশে শিক্ষা বিস্তার, শিল্প-সংস্কৃতির উৎকর্ষ সাধনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হন। তিনি পারস্যের বিখ্যাত কবি হাফিজের সাথে পত্রালাপ এবং চীন সম্রাট ইয়াং লুর সাথে দূত বিনিময় করেন। রাজ্যে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় তাঁর সুনাম ছিল কিংবদন্তী তুল্য। বলা হয় যে, বাংলার স্বাধীন সুলতানদের মধ্যে তাঁর মত এত আকর্ষণীয় চরিত্রের লোক সম্ভবত দ্বিতীয় কেউ নেই।
 

 

ওপেন স্কুল
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি ২য় পত্র
পাঠ-৫.৪
রাজা গণেশ ও পরবর্তী শাসন
উদ্দেশ্য
এই পাঠ শেষে আপনি-
সুলতানি বাংলায় হিন্দু শাসক রাজা গণেশের উত্থানের বিবরণ দিতে পারবেন। রাজা গণেশের রাজত্বকাল ও মুসলিম নির্যাতনের কাহিনী বর্ণনা করতে পারবেন।
রাজা গণেশের পরবর্তী বংশধরদের সম্পর্কে ধারণা লাভ করবেন ।
ABC
মূখ্য শব্দ
দনুজমর্দন দেব, নূর কতুবুল আলম, সুবর্ণধেনু ও খলিফাতুল্লাহ
রাজা গণেশ
ইলিয়াস শাহী বংশের রাজত্বকালে রাজা গণেশের আবির্ভাব বাংলার ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। রাজা গণেশ ও তাঁর বংশধরগণ ১৪১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৪৪২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মোট ২৮ বছর বাংলায় রাজত্ব করে করেছেন। সুদীর্ঘ ২০০ বছরের অধিক সময় ধরে বাংলায় মুসলিম শাসন নিরবচ্ছিন্ন ভাবে অব্যাহত থাকার পর হঠাৎ করে হিন্দু রাজত্বের পুনরুত্থান ইতিহাসের এক চমকপ্রদ ঘটনা। বাংলার ইতিহাসে রাজা গণেশ ও তাঁর বংশধরদের শাসনকাল ছিল এ দেশে মুসলিম শাসনের বিরতিকাল ।
রাজা গণেশের উত্থান
ইলিয়াস শাহী বংশের শাসকদের উদার ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাঁদের রাজত্বকালে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় ছিল। তাঁরা অনেক হিন্দুকে উচ্চ রাজপদে নিয়োগ করেন। এ সুযোগে তাঁর রাজত্বকালে হিন্দু সামন্ত রাজাগণ বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেন। এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য ছিলেন দিনাজপুরের ভাতুরিয়া পরগণার শক্তিশালী জমিদার রাজা গণেশ। কোন কোন বর্ণনায় তিনি রাজা কানস্ নামে পরিচিত ছিলেন। সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের অধীনে রাজা গণেশ রাজস্ব এবং শাসন বিভাগের কর্মকর্তা ছিলেন। আজম শাহের মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরাধিকারীদের ব্যর্থতায় রাজা গণেশ সমকালীন বাংলার সুলতানি রাজনীতির উপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেন। আজম শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র হামযা শাহ সিংহাসনে বসলে রাজনৈতিক গোলযোগ শুরু হয়। প্রভাবশালী রাজা গণেশের ষড়যন্ত্রে হামযা শাহ ক্রীতদাস শিহাব উদ্দিনের হাতে নিহত হন। হামযা শাহের পর শিহাবউদ্দিন বায়েজীদ শাহ নাম গ্রহণ করে সিংহাসনে উপবেশন করেন। কিন্তু বাংলার প্রকৃত ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন রাজা গণেশ। এরপর রাজা গণেশ সুযোগ বুঝে ১৪১৪ খ্রি. বায়েজীদকে হত্যা করে বাংলার সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হন। এভাবে বাংলার ক্ষমতায় রাজা গণেশের বংশ প্রতিষ্ঠিত হয়। বায়েজীদের পুত্র আলাউদ্দিন ফিরোজ দক্ষিণ বঙ্গে পলায়ন করেন। অতঃপর রাজা গণেশ দনুজমর্দন দেব উপাধি ধারণ করে মুদ্রা চালু করেন এবং বাংলায় স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতে থাকেন।
ইসলামের প্রতি রাজা গণেশের বৈরি আচরণ ও মুসলিম নির্যাতন রাজা গণেশের ক্ষমতালাভের ফলে বাংলায় হিন্দু প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার সূচনা এবং ইসলাম ও মুসলমানদের দুর্দিন শুরু হয়। তিনি মুসলমানদের উপর নির্যাতন শুরু করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল বাংলা থেকে ইসলাম ধর্মকে সমূলে উৎপাটন করা। এজন্য গণেশ প্রখ্যাত মুসলিম সাধক বদর-উল-ইসলামসহ বেশ কয়েকজন দরবেশকে হত্যা করেন। এতে মুসলিম জনগণ অত্যন্ত ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে। গণেশের এরূপ অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সুফি সাধক নূর-কুতুব-উল-আলম শঙ্কিত হয়ে জৈনপুরের শাসনকর্তা ইব্রাহিম শর্কীর সাহায্য প্রার্থনা করেন। তাঁর আমন্ত্রণে ইব্রাহিম শর্কী সসৈন্যে অগ্রসর হয়ে পথে ত্রিহুত দখল করেন। তিনি বাংলায় প্রবেশ করলে তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে রাজা গণেশ সিংহাসন ত্যাগ করেন। অতঃপর তাঁর পুত্র যদু ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে জালালউদ্দিন মাহমুদ শাহ নাম ধারণ করে বাংলার সিংহাসনে বসেন। এরপর ইব্রাহিম শর্কী জৌনপুরে ফিরে গেলে রাজা গণেশ পুনরায় জালালুদ্দিনের নিকট থেকে তাঁর ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করেন।

 

 



রাজা গণেশের দ্বিতীয় শাসন
প্রথমবার মাত্র কয়েকমাস ক্ষমতায় থাকার পর ইব্রাহিম শর্কী কর্তৃক ক্ষমতাচ্যুত হবার পর ১৪১৫ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি দ্বিতীয়বার সিংহাসনে আরোহণ করে রাজা গণেশ তাঁর পুত্র জালালউদ্দিনকে সুবর্ণ ধনু অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শুদ্ধি করে পুনরায় হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনেন। রাজা গণেশ সর্বমোট চার বছর রাজত্ব করে ১৪১৮ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন ।
জালালউদ্দিন মাহমুদ শাহ (১৪১৮-১৪৩২ খ্রি.) ১৪১৮ খ্রিস্টাব্দে রাজা গণেশ পরলোকগমন করলে তাঁর কনিষ্ঠপুত্র মহেন্দ্ৰ দেব উপাধি নিয়ে সিংহাসনে বসেন কিন্তু দু-এক মাসের বেশী তিনি রাজত্ব করতে পরেন নি। এসময় জালালউদ্দিন (যদু সেন) মহেন্দ্ৰ দেবকে অপসারণ করে সিংহাসন দখল করেন। তিনি ইসলাম ধর্মের একজন একনিষ্ঠ সেবক ছিলেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর থেকে তিনি নিজেকে খাঁটি মুসলমান হিসেবে পরিচয় দিতে বেশি উৎসাহী ছিলেন। তাঁর আমলে ইসলামের বিশেষ উন্নতি সাধিত হয় । ক্ষমতালাভ করে তিনি পিতা কর্তৃক নিবাসিত দরবেশ নুর-কতুব-উল আলমের দৌহিত্র শেখ জাহিদকে সোনারগাঁও থেকে রাজধানীতে ফিরিয়ে আনেন। তিনি একজন সুযোগ্য শাসক ছিলেন। তিনি তাঁর রাজ্যের রাজধানী পাণ্ডুয়া থেকে গৌড়ে স্থানান্তরিত করেন। তাঁর সময়ে গৌড় একটি সমৃদ্ধ নগরীতে পরিণত হয়। সেখানে মসজিদ, স্নানাগার, জলাশয়, সরাইখানা প্রভৃতি নির্মিত হয়। এ সময় ইব্রহিম শর্কীর রাজ্যের কিছু অংশ জালালউদ্দিনের দখলে আসে। তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব রাজনৈতিক মেধা ও সামরিক দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর সময় অনেক মসজিদ ও মাদ্রাসা স্থাপিত হয়। তিনি তাঁর মুদ্রায় নিজেকে খলিফাতুল্লাহ বা আল্লাহর খলিফা হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি চীন, পারস্য, মিশর ও দামেস্কের সঙ্গে দূত বিনিময় করেন। জালালউদ্দিন মাহমুদ শাহের পর তাঁর পুত্র শামসউদ্দিন আহমদ শাহ সুলতান হন। তিনি ন্যায়পরায়ণ ধর্মপ্রাণ ও বিচক্ষণ সুলতান ছিলেন। আহমদ শাহ তাঁর দুই ক্রীতদাস সাদী খান ও নাসির খানের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ১৪৪২ খ্রিস্টাব্দে নিহত হন । এভাবে রাজা গণেশ ও তাঁর বংশধদের প্রায় ত্রিশ বছরের শাসনের অবসান হয়। 
শিক্ষার্থীর কাজ
রাজা গণেশের শাসনামলে সুফিদের ভূমিকা চিহ্নিত করুন।
সারসংক্ষেপ :
গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের মৃত্যুর পর তাঁর উত্তাধিকারীদের দুর্বলতার সুযোগে রাজা গণেশ নামক একজন হিন্দু সামন্তরাজা ক্ষমতা দখল করেন। তিনি মুসলমানদের উপর নির্যাতন করতেন। জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শর্কীর বাংলায় অভিযানের কারণে গণেশ ক্ষমতা ছাড়াতে বাধ্য হন। তাঁর পুত্র যদু সেন জালালউদ্দিন নাম ধারণ করে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন এবং সিংহাসনে বসেন। জালালউদ্দিনের পর সুলতান হন তাঁর পুত্র শামসুউদ্দিন আহমদ শাহ। রাজা গণেশ এবং তাঁর বংশধগণ প্রায় ৩০ বছর বাংলা শাসন করেন।
 

 

 


পাঠ-৫.৫
পরবর্তী ইলিয়াস শাহী রাজবংশ (১৪৪২-১৪৮৭ খ্রিস্টাব্দ)
উদ্দেশ্য
এই পাঠ শেষে আপনি-
পরবর্তী ইলিয়াস শাহী শাসনের পুনরুত্থান সম্পর্কে জানতে পারবেন; সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদ শাহের গৌরবোজ্জল রাজত্বকালের ধারণা পাবেন ও
পরবর্তী ইলিয়াস শাহী শাসকদের কর্মকাণ্ড আলোচনা করতে পারবেন ।
মূখ্য শব্দ
ভূমিকা
বাংলার আফগানি যুগ, হাবশি, শ্রীকৃষ্ণ বিজয় ও মহাভারত
বাংলার স্বাধীন সুলতানি শাসনামলে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দে ইলিয়াস শাহী রাজবংশের শাসনের সূচনা করেন। এই বংশের শাসনের প্রথম দিকে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ, সিকান্দর শাহ ও গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ প্রমুখ সুলতানগণ যোগ্য শাসক ছিলেন। গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের মৃত্যুর পরবর্তী ইলিয়াস শাহী শাসকদের দুর্বলতার সুযোগে হিন্দু জমিদার রাজা গণেশ ইলিয়াস শাহী বংশের শাসনে একটি ছেদ টেনে দেন। কিন্তু ১৪৪২ খ্রিস্টাব্দে রাজা গণেশের বংশের পতন ঘটলে বাংলায় পুনরায় ইলিয়াস শাহী বংশের শাসনের সূত্রপাত ঘটে। এরপর এ বংশের শাসকগণ ১৪৮৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা শাসন করেন।
নাসির উদ্দিন মাহমুদ শাহ (১৪৪২-১৪৫৯খ্রি.) গিয়াস উদ্দিন আজম শাহের মৃত্যুর পর ইলিয়াস শাহী শাসকদের শাসন দুর্বলতার সুযোগে রাজা গণেশ কর্তৃক স্বল্পকালীন হিন্দু শাসনের সূচনা হয়। গণেশের মৃত্যু পরবর্তী সময়ে ১৪৪২ খ্রিস্টাব্দে দেশের অরাজক অবস্থা প্রেক্ষিতে গণেশের উত্তরাধিকারীদের হটিয়ে আমিরগণ ইলিয়াস শাহের বংশধর নাসির উদ্দিনকে ‘নাসির উদ্দিন আবুল মুজাফ্ফর মাহমুদ শাহ’ উপাধি দিয়ে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করলে আবার ইলিয়াস শাহী বংশের শাসনের সূচনা হয়। নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বে ইলিয়াস শাহী বংশের পুনরভ্যুদয় বাংলার ইতিহাসে বিশেষভাবে স্মরণীয়।
নাসির উদ্দিনের রাজ্য শাসন
নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহ পরবর্তী ইলিয়াস শাহী রাজবংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি ন্যায়পরায়ণতা ও উদারতার সাথে রাজ্য পরিচালনা করেন এবং দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। খান জাহান আলীর সমাধি গাত্রে খোদিত লিপি থেকে জানা যায় যে, তাঁর শাসনামলে যশোর ও খুলনার কিছু অংশ ইলিয়াস শাহী শাসনের অধিকৃত হয়েছিল এবং মুসলিম বাংলার সীমানা অনেকদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। এ সময় হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায় এবং শিল্প সাহিত্যের ব্যাপক অগ্রগতি ঘটলে তা সুলতানি বাংলার সমাজ ও রাজনীতিতে সুগভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল।
শিক্ষ-সাংস্কৃতিক ও জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড
নাসিরউদ্দিন মাহমুদের রাজত্বকাল ছিল শান্তিপূর্ণ। রাজ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এ মহান সুলতান শিল্প ও স্থাপত্যের উন্নতি বিকাশে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা, শিক্ষা-দীক্ষার প্রসার, সাহিত্য ও বিজ্ঞানের একজন একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এজন্য তাঁর শাসনামলকে ঐতিহাসিকগণ ‘বাংলার অগাস্টান যুগ' বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি রাষ্ট্রীয় খরচে রাজধানী গৌড়, পাণ্ডুয়া, সাতগাঁও, ঢাকা, বাগেরহাট প্রভৃতি জনপদে মসজিদ, খানকাহ, সেতু, তোরণ, সমাধি ও প্রাসাদ এর মত নানা স্থাপনা নির্মাণে সহায়তা করেছেন।
চরিত্র চিত্রণ
নাসির উদ্দিন মাহমুদ শাহ জ্ঞানী, চরিত্রবান, দরদি, প্রজাবাৎসল, উদার ও ধর্মপায়ণ শাসক ছিলেন। তিনি ধনী, আমির, উমরাহ, দরবেশ, সাধু, সুফি, বৃদ্ধ, যুবক সকলের প্রতি সদয় ছিলেন এবং উদার হস্তে সকলকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। মহানুভব ও সুশাসক মাহমুদ শাহ প্রায় ২৪ বছর রাজত্ব করে ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন ।
 

 

 


রুকন উদ্দিন বরবক শাহ (১৪৫৯-১৪৭৪ খ্রি.)
সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদের মৃত্যুর পর পুত্র রুকনউদ্দিন বরবক শাহ (১৪৫৯-১৪৭৪ খ্রি.) বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন । তিনি পিতার ন্যায় একজন যোগ্য ও বিচক্ষণ শাসক ছিলেন । তাঁর সুশাসনে বাংলাদেশের সুখ-শান্তি আরও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। তিনি নিজে পণ্ডিত ছিলেন। জ্ঞানী ও গুণীরা তাঁর নিকট খুব সমাদর পেতেন। তিনি সে যুগের বিখ্যাত কবি মালাধর বসুকে গুণরাজ খান উপাধি দিয়েছিলেন। বৃহস্পতি মিশ্র, কৃত্তিবাস, মনসুর সিরাজী প্রমুখ কবি বরবক শাহের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। তাঁর সভা কবি ছিলেন আমির জয়েনউদ্দিন হাববী। তিনি বাংলা সাহিত্যের একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তবে রুকনউদ্দিন বরবক শাহ কমপক্ষে ৮০০০ আবিসিনীয় ক্রীতদাসকে রাজ্যের বিভিন্ন পদে নিযোগ করেন যা রাজ্যের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তিনি ১৪৭৪ খ্রিস্টাব্দে আসামের কামরূপ অভিযানকালে সেখানকার হিন্দু রাজা নীলাম্বরে সাথে এক যুদ্ধে লিপ্ত হন কিন্তু তিনি সেখানে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য লাভ করতে পারেননি।
দ্বিতীয় শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহ (১৪৭৪-৮১ খ্রি.) বরবক শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দ্বিতীয় শামসউদ্দিন আবু মুজাফ্ফর ইউসুফ শাহ (১৪৭৪-৮১ খ্রি.) বঙ্গের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি বিচক্ষণ, ধৈর্যশীল, প্রজাহিতৈষী, ধর্মভীরু ও আদর্শবান সুলতান ছিলেন। তিনি বিদ্বান ও জ্ঞানীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তিনি রাজ্যব্যাপী মদ্যপান নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। তাঁর রাজত্বকালে মালাধর বসুর ‘শ্রীকৃষ্ণ বিজয়' রচনা সমাপ্ত হয় এবং বিজয় পণ্ডিত ‘মহাভারত’ এর বঙ্গানুবাদ করেন। স্থাপত্যের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তিনি গৌড়ের কদম রসুল মসজিদ, তাঁতিপাড়া মসজিদ ও পাণ্ডুয়ার চতুষ্কোন মসজিদ নির্মাণ করেন।
জালাল উদ্দিন ফতেহ শাহ (১৪৮১-১৪৮৭ খ্রি.)
ইউসুফ শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সিকান্দর শাহ বাংলার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু অযোগ্যতার জন্য মাত্র তিন মাস পরে তাঁকে সিংহাসনচ্যুত করে তাঁর ভাই জালালউদ্দিন ফতেহ শাহ (১৪৮১-১৪৮৭ খ্রি.) কে বাংলার সিংহাসনে বসানো হয়। তিনি উদার, বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ ছিলেন। তাঁর সময়ে হাবশি ক্রীতদাসদের ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তি বেড়ে যায়। এ প্রভাব খর্ব করতে গিয়ে তিনি বরবক নামক জনৈক হাবশি ক্রীতদাসের হাতে ১৪৮৭ খ্রিস্টাব্দে নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে ইলিয়াস শাহী বংশের শাসনের অবসান হয় এবং বাংলা ছয় বছরের জন্য (১৪৮৭-১৪৯৩ খ্রি.) হাবশি মালিকদের শাসনে চলে যায় ।
শিক্ষার্থীর কাজ
পরবর্তী ইলিয়াস শাহী বংশের শাসকদের শাসনকাল চিহ্নিত করুন।
সারসংক্ষেপ :
রাজা গণেশ প্রতিষ্ঠিত রাজবংশটি ইলিয়াস শাহী শাসনের ছেদ টেনে প্রায় ২৮ বছর বাংলা শাসন করেন। অতঃপর পরবর্তী ইলিয়াসশাহী সুলতানগণ (১৪৪২-১৪৮৭ খ্রি.) আবার বাংলা শাসন করেন। এ বংশের যোগ্যতম শাসক ছিলেন নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহ। এ বংশের অপর একজন সুশাসক ছিলেন রুকনউদ্দিন বরবক শাহ। তিনি জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তিদের সমাদর করতেন। এ সময় বাংলা শিক্ষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে যথেষ্ঠ উন্নতি লাভ করেছিল। | হাবশি ক্রীতদাসদের ষড়যন্ত্রে জালালউদ্দিন ফতেহ শাহের মৃত্যুর পর এ বংশের শাসনের অবসান ঘটে এবং বাংলায় ছয় বছরের জন্য (১৪৮৭-১৪৯৩ খ্রি.) হাবশি মালিকদের শাসনের সূচনা হয় ।
 

 

 


পাঠ-৫.৬
বাংলায় হাবশি শাসন (১৪৮৭-১৪৯৩ খ্রি.)
উদ্দেশ্য
এই পাঠ শেষে আপনি-
সুলতানি বাংলায় হাবশি শাসকদের উত্থান ও প্রাথমিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে পারবেন; হাবশি শাসকদের সম্প্রসারিত কর্মকাণ্ড বিষয়ে ধারণা পাবেন ও
হাবশি শাসনের পতনের কারণ সম্পর্কে অবহিত হবেন।
মূখ্য শব্দ
হাবশি, সুলতান শাহজাদা, উজির, সৈয়দ ও হোসেন
বাংলার ইতিহাসে খুবই স্বল্প সময়ের শাসন হিসেবে পরিচিতি পেলেও হাবশি শাসন একটি কৌতুহলোদ্দীপক অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। মাত্র ছয় বছরের এই সময়কালে চারজন সুলতান বাংলা শাসন করেছেন, যাদের প্রত্যেকেই পূর্বসুরীকে হত্যা করে ক্ষমতায় এসেছেন এবং ষড়যন্ত্রকারী উত্তরসূরীর হাতেই নিহত হয়েছেন। তবে তা সত্ত্বেও এ সময়ে বাংলার সীমানা সংকুচিত হয়নি এবং শাসকরা জনকল্যাণকামী ছিলেন।
হাবশিদের পরিচয়
পরবর্তী ইলিয়াস শাহী সুলতান বা মাহমুদ শাহী সুলতান রুকনুদ্দিন বরবক শাহ অনেক সংখ্যক ইথিওপিয়ান দাসকে বাংলায় নিয়ে এসেছিলেন যারা পরবর্তীকালে নিজ যোগ্যতাবলে অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন। সুলতান রুকনুদ্দিন বরবক-এর মৃত্যুর পর এ দাসদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয় এবং গিয়াসুদ্দিন বারবক শাহ তাঁর মালিককে হত্যা করে প্রথম হাবশি শাসক হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এ সুলতানগণ প্রাথমিক জীবনে দাস ছিলেন বলে তাঁদের ব্যঙ্গার্থে হাবশি বলে অভিহিত করা হয়। মূলত হাবশি আমল বলতে মাহমুদ শাহী সুলতান জালালুদ্দিন ফতেহ শাহের পরে বাংলা শাসনকৃত গিয়াসুদ্দিন বারবক শাহ বা “সুলতান শাহজাদা”, ফিরোজ শাহ, মাহমুদ শাহ এবং মুজাফ্ফর শাহের শাসনকালকে বোঝানো হয় ।
গিয়াসুদ্দিন বারবক শাহ বা “সুলতান শাহজাদা” (১৪৮৭ খ্রি.)
সুলতান গিয়াসুদ্দিন বারবক শাহ প্রাথমিক যুগে মাহমুদ শাহী বংশের শাসক সুলতান রুকনুদ্দিন বরবক শাহের দাস ছিলেন। এ সময় থেকে তিনি দরবারে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন এবং পরবর্তীতে সুলতান ফতেহ শাহকে হত্যা করে গিয়াসুদ্দিন বারবক শাহ উপাধি ধারণ করে ক্ষমতায় বসেন। তিনি হাবশি বংশোদ্ভূতদের নানা রাজপদে নিয়োগ দেন। তিনি তাঁকে ক্ষমতায় আসীন হতে সাহায্যকারী শাহজাদা মালিক আন্দিলকে বন্দি করার জন্য কৌশলে ডেকে পাঠান বারবকের এ ছল বুঝতে পেরে মালিক আদিল বারবককে হত্যার মনোবাঞ্ছা নিয়ে রাজধানীতে প্রবেশ করেন। এ সময় হাবশি অভিজাতগণ ও এই শাসকের সিংহাসনে বসাকে ভাল ভাবে নেয়নি। এমতাবস্থায় অভিজাত শ্রেণি এ ষড়যন্ত্রে অংশ নেয় এবং পাইকদের একত্রিত করে বারবককে হত্যা করে ।
সাইফুদ্দিন ফিরোজ শাহ (১৪৮৭-১৪৯০ খ্রি.)
অভিজাতদের সহায়তায় সুলতান গিয়াসুদ্দিন বারবক শাহকে হত্যা করে মালিক আন্দিল গৌড়ের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন এবং সাইফুদ্দিন ফিরোজ শাহ উপাধি গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন কুশলি ও ন্যায়পরায়ণ তিনি উদারতার মাধ্যমে বাংলার সার্বভৌম শাসক হয়েছিলেন। ফিরোজ শাহ যোগ্যতা ও দক্ষতার সাথে বাংলা শাসন করেন এবং শিল্প-সংস্কৃতির একজন উদার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিন বছর শাসন করার পর ১৪৯০ খ্রিস্টাব্দে এই শাসকের মৃত্যু হয়।
কুতুবউদ্দিন মাহমুদ শাহ (১৪৯০-১৪৯১ খ্রি.)
সাইফুদ্দিন ফিরোজ শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র কুতুবউদ্দিন মাহমুদ শাহ বাংলার শাসক হন। কুতুবউদ্দিন মাহমুদ শাহের কোন শিলালিপি পাওয়া না যাওয়ায় তাঁর সম্পর্কে সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায় না। ১৪৯১ খ্রিস্টাব্দে এ শাসকের মৃত্যু হয় বলে জানা যায় ।

 

 

 



শামসুদ্দিন মুজাফ্ফর শাহ (১৪৯১-১৪৯৩ খ্রি.)
কুতুবউদ্দিন মাহমুদ শাহের মৃত্যুর পর শামসুদ্দিন মুজাফ্ফর শাহ বাংলার শাসন ক্ষমতায় বসেন। তিনি স্বর্ণ মুদ্রা চালু করেছিলেন। প্রায় সমগ্র উত্তরবঙ্গ তাঁর অধীনে ছিল। নৃশংসতা এবং অত্যাচারের কারণে তিনি জনগণের নিকট জনপ্রিয় ছিলেন না। ফলে গৌড়ের অভিজাতরা তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং এ বিদ্রোহে যুক্ত হন উজির সৈয়দ হোসেন। উজির
সৈয়দ হোসেন-এর নেতৃত্বে মুজাফ্ফর শাহকে হত্যা করা হলে বাংলায় হাবশি শাসনের পতন ঘটে।
শিক্ষার্থীর কাজ
হাবশিদের পতনের কারণসমূহ চিহ্নিত করুন।
সারসংক্ষেপ :
সুলতানি শাসনামলে বাংলায় মাত্র ৬ বছরের জন্য হাবশি শাসনের সূত্রপাত হলেও এঁদের ইতিহাস ছিল ষড়যন্ত্র,
অরাজকতা ও অবিশ্বাসে পূর্ণ। মাত্র ৬ বছরে ৪ জন শাসকের শাসন থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে হোসেন শাহী বংশের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান হোসেন শাহের মাধ্যমে এ বংশের পতন হলে বাংলায় নতুন যুগের সূচনা হয় ।
 

 

 


পাঠ-৫.৭
হোসেন শাহী রাজবংশ: আলাউদ্দিন হোসেন শাহ
উদ্দেশ্য
এই পাঠ শেষে আপনি-
হোসেন শাহী বংশের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে জানতে পারবেন;
আলাউদ্দিন হোসেন শাহের রাজ্য শাসন সম্পর্কে ধারণা পাবেন ও সর্বোপরি আলাউদ্দিন হোসেন শাহের কৃতিত্ব আলোচনা করতে পারবেন ।
মূখ্য শব্দ
হোসেন শাহী বংশ, নৃপতি তিলক, সত্যপীর ও গুনরাজ খাঁ
হোসেন শাহী বংশ
বাংলার স্বাধীন সুলতানদের যুগে হোসেন শাহী বংশের শাসন ছিল একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। মধ্যযুগের সুলতানি শাসন আমলে ইলিয়াস শাহী শাসনের সমাপ্তির পর হোসেনশাহী রাজ বংশের উত্থান বাংলার ইতিহাসের একটি অনন্য অধ্যায়। হাবশি শাসকদের হটিয়ে সৈয়দ বংশীয় আলাউদ্দিন হোসেন শাহ কর্তৃক এ রাজ বংশের শাসনের সূচনা হয়েছিল। এ বংশের ৪ জন শাসক প্রায় ৪৫ বছর (১৪৯৩-১৫৩৮ খ্রি.) বঙ্গদেশ শাসন করেন। তাঁদের শাসনকালে বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা-সংস্কৃতি, কৃষি-শিল্প প্রভৃতি ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধিত হয়। হোসেন শাহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এ রাজবংশটি প্রায় ৪৫ বছর বাংলা শাসন করে আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে মধ্যযুগীয় বাংলাকে উন্নতির শীর্ষে নিয়ে গিয়েছিল।
হোসেন শাহী বংশের প্রতিষ্ঠা
হোসেন শাহী বংশের প্রতিষ্ঠাতা আলাউদ্দিন হোসেন শাহ ছিলেন আরবের সৈয়দ বংশের লোক । পিতা সৈয়দ আশরাফ আল হুসেনি এবং ভাই ইউসুফের সাথে তিনি হাবশি সুলতান বরবক শাহের আমলে বাংলায় আসেন এবং চাকুরি গ্রহণ করেন । হোসেন শাহ পরবর্তী হাবশি সুলতান সাইফউদ্দিন ফিরোজ শাহ (১৪৮৭-১৪৯০ খ্রিস্টাব্দ) দ্বিতীয় মাহমুদ শাহ (১৪৯০ খ্রি.) এর অধীনে উচ্চ পদে নিয়োজিত ছিলেন। সর্বশেষ হাবশি সুলতান মুজাফ্ফর শাহ তাঁকে উজির নিযুক্ত করেন। মুজাফ্ফর গ্রহণ করেন। তাঁর নামানুসারেই তাঁর বংশের নাম হয় হোসেন শাহী বংশ ।
শাহের স্বৈর শাসনে দেশে বিদ্রোহ দেখা দেয়। গৌড়ের অনেক অধিবাসীকে তিনি নির্মমভাবে হত্যা করেন। দেশের এরূপ পরিস্থিতিতে হোসেন শাহ হাবশি শাসনের অবসান ঘটিয়ে বাংলার সিংহাসনে বসেন। তিনি আলাউদ্দিন হোসেন শাহ উপাধি
রাজ্য শাসন
আলাউদ্দিন হোসেন শাহ সিংহাসনে আরোহণ করেই কঠোর হস্তে রাজ্য শাসন শুরু করেন। তিনি রাজ্যময় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। সর্ব প্রথমেই তিনি হাবশি আমির ও সৈন্যদেরকে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত করেন এবং স্থানীয় আমির ও সৈন্যদেরকে নিজ নিজ পদে পূর্ণবহাল করেন। তিনি রাজধানী গৌড় থেকে একডালাতে স্থানান্তরিত করেন। রাজ্যে লুটতরাজ বন্ধ করে শান্তি ও শৃংখলার ব্যবস্থা করেন। রাজ্যের প্রায় ১২ হাজার লুণ্ঠনকারীকে তিনি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেন। বাংলার শাসন ক্ষেত্রে তিনি সৈয়দ, আফগান ও মোঙ্গলদের প্রাধান্য দেন। রাজ্যের নিরাপত্তা ও সংহতি প্রতিষ্ঠা করে হোসেন শাহ রাজ্য বিস্তারে মনোনিবেশ করেন।
দিল্লির সুলতানের সাথে সম্পর্ক
সিংহাসনে আরোহণের পর হোসেন শাহের সাথে দিল্লির সুলতান সিকান্দর লোদীর সংঘর্ষ বাধে। জৌনপুরের বিতাড়িত সুলতান হোসেন শাহ শৰ্কীকে বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়ায় সিকান্দর লোদী হোসেন শাহের বিরুদ্ধে অভিযান করেন। কিন্তু এ অভিযান ব্যর্থ হয়। উভয়ের মধ্যে সন্ধি স্বাক্ষরিত হয় এবং সিকান্দর লোদী স্বসৈন্যে দিল্লি ফিরে যান।

 

 

 

 

 


শিল্প ও স্থাপত্যের নির্মাতা
সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শিল্প স্থাপত্যের একজন শ্রেষ্ঠ নির্মাতা ছিলেন। গৌড়ের বিখ্যাত ছোট সোনা মসজিদ, মানিকগঞ্জ জেলার নাচাইল মসজিদ, গোমতি ফটক ছাড়া অগণিত মসজিদ, মাদ্রসা, সমাধি ও দূর্গ নির্মাণ করে তিনি ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। তিনি ‘বাদশাহী সড়ক' সহ সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিদের চলাচলের জন্য অনেক রাস্তাঘাট নির্মাণ করেন। সুদীর্ঘ ২৬ বছর গৌরবময় রাজত্ব শেষে ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে হোসেন শাহ ইন্তেকাল করেন। আলাউদ্দিন
হোসেন শাহ নিঃসন্দেহে মধ্যযুগীয় বাংলার ইতিহাসে একজন শ্রেষ্ঠ নরপতি ছিলেন। *
শিক্ষার্থীর কাজ
হোসেন শাহী শাসনামলে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার বিষয়টি তুলে ধরুন।
সারসংক্ষেপ :
হাবশি শাসনের অবসান ঘটিয়ে ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের নেতৃত্বে হোসেনশাহী বংশের | প্রতিষ্ঠা হয়। হোসেন শাহ ছিলেন বাংলার স্বাধীন সুলতানদের মধ্যে সবচেয়ে যোগ্য শাসক। রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপন, রাজ্য বিস্তার ও শিল্প সাহত্যের উৎকর্ষ সাধনে তিনি অসামান্য অবদান রাখেন। একজন পরমত সহিষ্ণু, প্রজাদরদী ও উদার শাসক হিসেবে অমর হয়ে আছেন ।

 

 

 


 

 


কৃতিত্ব বাংলার ইতিহাসে নসরত শাহ তাঁর পিতার ন্যায় একজন মহান সুলতান ছিলেন। নসরত শাহ নানা মানবিক গুণে গুণান্বিত ছিলেন। তিনি ন্যায় পরায়ণ, উদার ও প্রজারঞ্জক শাসক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। ভাইদের প্রতি তাঁর সদ্ব্যবহার ও উদারতা এবং পলাতক আফগানদের আশ্রয় দান তাঁর চরিত্রের মানবিক দিককে প্রস্ফুটিত করেছে। জনগণের প্রতিও তিনি সহৃদয় ও সহনশীল ছিলেন। প্রজা সাধারণের পানিকষ্ট দূর করার জন্য তিনি রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে কূপ ও পুকুর খনন করেন। বাগেরহাটের ‘মিঠা পুকুর’ তাঁর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। নসরত শাহ সাহিত্য শিল্প ও স্থাপত্য বিদ্যার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। গৌড়ের বিখ্যাত কদমরসুল মসজিদ, বড় সোনা মসজিদ ছাড়াও তিনি বহু মসজিদ, মাদ্রাসা ও দরগাহ নির্মাণ করেন। তাঁর রাজত্বকালে কবি শ্রীকর নন্দী প্রথম হিন্দু ধর্মালম্বীদের ধর্মীয় গ্রন্থ মহাভারতের বাংলা অনুবাদ করেন। প্রজাহিতৈষী এই মহান সুলতান ১৫৩২ খ্রিস্টাব্দে জনৈক প্রাসাদরক্ষী কর্তৃক নিহত হন।
সুলতান আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ (১৫৩২-১৫৩৩ খ্রি.) নসরত শাহের পুত্র আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ ১৫৩২ খ্রিস্টাব্দে বাংলার ক্ষমতায় বসেন। তিনি প্রায় এক বছর ক্ষমতাসীন ছিলেন তাঁর স্বল্পকালীন রাজত্বে তেমন উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি। অহোম রাজ্যের সাথে বাংলায় চলমান সংঘর্ষ তাঁর সময়েও অব্যাহত থাকে। তিনি সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশে উৎসাহী ছিলেন। তাঁর অনুপ্রেরণায় কবি শ্রীধর কবিরাজ বিখ্যাত প্রেম উপাখ্যান বিদ্যাসুন্দর রচনা করেন। আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহের স্বল্পকালীন রাজত্বের পর তাঁর চাচা গিয়াসউদ্দিন মাহামুদ শাহ কর্তৃক নিহত হন।
গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ (১৫৩৩-১৫৩৮ খ্রি.) গিয়াসউদ্দিন মহমুদ শাহ ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ছিলেন হোসেন শাহী বংশের শেষ সুলতান এবং একজন অযোগ্য শাসক। এ সময় শের খান নামক একজন তরুণ আফগান দলপতির আবির্ভাব ঘটলে তিনি বিপদগ্রস্থ হয়ে পড়েন। শের খান কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে বিহারের শাসনকর্তা জালাল খান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহের শরণাপন্ন হন। এর ফলে শের খানের সাথে মাহমুদ শাহের যুদ্ধ বাঁধে। ১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দে সুরুজগড়ে সংঘটিত যুদ্ধে শেরখান মাহমুদ শাহের বাহিনীকে পরাজিত করেন। অবশেষে শের খান ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে গৌড় সংঘটিত যুদ্ধে সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদের বাহিনীকে পরাজিত করে গৌড় অধিকার করে নেন। তিনি মাহমুদ শাহকে বঙ্গ দেশ থেকে বিতাড়িত করলে হোসেন শাহী বংশের শাসনের পরসমাপ্তি ঘটে।
ফিরোজ শাহ্ মিনার
হোসেন শাহী বংশের অবদান
রাজনৈতিকভাবে বাংলা শাসনের ও রাজ্যজয়ের কৃতিত্বের সাথে হোসেন শাহী শাসকগণ এ বংশের অবদানকে নানা সামাজিক, সাংস্কৃতিক, প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের দ্বারা নিজেদের শাসনকে আরো সঞ্জীবিত করেছেন। হোসেন শাহী শাসকগণ শিল্প-সাহিত্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির উদার পৃষ্টপোষক ছিলেন। এ বংশের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান হোসেন শাহের উৎসাহ ও পৃষ্টপোষকতায় কবি মালাধরবসু কর্তৃক ভগবদ গীতা, কৃত্তিবাস কর্তৃক রামায়ণ সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলায় অনূদিত হয়। রামায়ণ অনুবাদের জন্য হোসেন শাহ তাঁকে ‘গুণরাজ খাঁ' উপাধি দেন। তাছাড়া কবি মালাধর বসু, মনসা মঙ্গল এর রচিয়তা বিজয় গুপ্ত, মনসা বিজয়ের লেখক বিপ্রদাস অনেকেই তাঁর সহযোগিতা পেয়েছিলেন। তাঁর অধীনস্থ চট্টগ্রামের শাসনকর্তা পরাগল খাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় কবীন্দ্র পরমেশ্বর নামক জনৈক পণ্ডিত বাংলা
কদম রসুল মসজিদ
 

 

 


ভাষায় ‘মহাভারত’ অনুবাদ করেন। এছাড়া সুলতান নসরত শাহ সাহিত্য শিল্প ও স্থাপত্যবিদ্যার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর রাজত্বকালে কবি শ্রীকর নন্দী হিন্দু ধর্মালম্বীদের ধর্মীয় গ্রন্থ মহাভারত বাংলায় অনুবাদ করেন। তাছাড়া সুলতান আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহের অনুপ্রেরণায় কবি শ্রীধর কবিরাজ বিখ্যাত প্রেম উপাখ্যান বিদ্যাসুন্দর রচনা করেন। সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শিল্প স্থাপত্যের একজন শ্রেষ্ঠ নির্মাতা ছিলেন। গৌড়ের বিখ্যাত ছোট সোনা মসজিদ, মানিকগঞ্জ জেলার নাচাইল মসজিদ, গোমতি ফটক ছাড়া অগণিত মসজিদ, মাদ্রসা, সমাধি ও দূর্গ নির্মাণ করে তিনি ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। তিনি ‘বাদশাহী সড়ক’ সহ সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিদের চলাচলের জন্য অনেক রাস্তাঘাট নির্মাণ করেন। সুলতান নসরত শাহ গৌড়ের বিখ্যাত কদমরসুল মসজিদ, বড় সোনা মসজিদ ছাড়াও তিনি বহু মসজিদ, মাদ্রাসা ও দরগাহ নির্মাণ করেন। বাগেরহাটের ‘মিঠা পুকুর' তাঁর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
শিক্ষার্থীর কাজ
পরবর্তী হোসেন শাহী শাসকগণ কীভাবে মুঘলদের প্রতিহত করেছিল তা চিহ্নিত করুন?
সারসংক্ষেপ :
বাংলার ইতিহাসে হোসেন শাহী বংশের শাসন একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। আলাউদ্দিন হোসেন শাহ কর্তৃক এ রাজবংশ প্রতিষ্ঠার পর রাজ্যজয়, প্রশাসন ব্যবস্থাকে সুসংহতকরণ, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক ও জনকল্যাণমূলক কাজে নিজেদের নিয়োজিত করায় এ বংশের গৌরব বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু নাসিরউদ্দিন নুসরত শাহের মৃত্যুর পর আর কোন যোগ্য শাসক না থাকায় আফগান নেতা শেরশাহ শুরের হাতে মাহমুদ শাহ পরাজিত হলে এ বংশের শাসনের সমাপ্তি ঘটে।
 

 


পাঠ-৫.৯
সুলতানি বাংলার আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা
উদ্দেশ্য
এই পাঠ শেষে আপনি-
• সুলতানি বাংলার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে পারবেন;
• সুলতানি বাংলার সামাজিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে পারবেন ও সুলতানি বাংলার সাংস্কৃতিক অবদান সম্পর্কে জানতে পারবেন।

মূখ্য শব্দ
ভূমিকা
সত্য পীর, শ্রী-চৈতন্য, আশরাফ, আতরাফ, অগাস্টান যুগ ও বাদশাহী সড়ক
বাংলার শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে সুলতানি শাসন এক যুগান্তকারী অধ্যায়। স্বাধীন সুলতানদের এই শাসনামলে (১৩৩৮-১৫৩৮ খ্রি.) নানা রাজনৈতিক অবদানের পাশাপাশি এ অঞ্চলে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন সাধিত হয়েছিল। এসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সর্বদা সমানভাবে সম্পন্ন না হলেও ইলিয়াস শাহী, পরবর্তী ইলিয়াস শাহী, হাবশি ও হোসেন শাহী শাসনামলে শাসকবর্গের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় যেসব আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন সাধিত হয়েছিল তার স্বরূপ নিম্নরূপ:
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড
প্রাক মুসলিম শাসনামলে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা তেমন সচ্ছল ছিল না। বাংলায় সেন শাসনের সমাপ্তির পর মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা হলে খলজি শাসন যুগে এর অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা সূচিত হয় যা ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে সুলতানি শাসনের সূত্রপাতের মধ্য দিয়ে বেগবান হয়েছিল। সুলতানি শাসকদের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলার কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যে ব্যাপকতা আসতে থাকে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক বর্ণনায় জানা যায় যে, শাসকদের উদার পৃষ্ঠপোষকতায় স্থানীয় জনগণ এখানকার উর্বর ভূমিতে চাষাবাদ শুরু করলে কৃষি উৎপাদনে ব্যাপকতা আসে। এ সময় বাংলায় প্রচুর পরিমাণে ধান, পাট, তুলা, ভুট্টা, তিল, তিষি, সরিষা, ডাল, বিভিন্ন প্রকার শাক-সবজি, আম, কলা, কাঁঠাল সহ নানা দেশীয় ফলমূল উৎপাদিত হত। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এসব পণ্য বাংলার বাইরেও রপ্তানি হতো। বাংলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মূল উৎস ছিল কৃষি। কৃষি ফলনের প্রাচুর্য থাকলেও এ সময়ের চাষাবাদ পদ্ধতি ছিল অনুন্নত। আধুনিক সময়ের মতো পানি সেচ ব্যবস্থা সে যুগে ছিল না। কৃষককে অধিকাংশ সময়েই সেচের জন্য বৃষ্টির উপর নির্ভর করতে হতো। তবে এ সময় পারসিক ও দক্ষিণ ভারতীয় সেচ পদ্ধতি ব্যবহার করে খরার সময় সেচ প্রদানের তথ্যও পাওয়া যায় ।
স্থানীয় কৃষি উৎপাদনে ব্যপকতা এলে কৃষি উৎপাদনকে কেন্দ্র করে এ যুগে নানা শিল্পের বিকাশ ঘটতে থাকে। সমকালীন বিভিন্ন বর্ণনায় জানা যায় যে, এ সময় কৃষি পণ্যকে কেন্দ্র করে স্থানীয় জনগণ, শাসক ও অভিজাতবর্গের চাহিদা পূরণের জন্য বস্ত্র শিল্প, লবণ শিল্প, রেশম শিল্প, জাহাজ নির্মাণ শিল্প, মুদ্রা শিল্প, চিনি শিল্প, কাগজ শিল্প, স্থাপত্য শিল্প, তেল শিল্প, অস্ত্র শিল্প, অলংকার শিল্প, কাঠ শিল্প সহ নানা ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্পের উদ্ভব ও পুনরুজ্জীবণ হয়েছিল। শিল্পের ব্যাপক উন্নয়ন ও উৎপাদনের ফলে এখানে নানা পণ্যের প্রাচুর্য দেখা দেয়। এ সব পণ্যের সুনাম ও বাংলার সম্পদের প্রচুর্যতা বিদেশে ছড়িয়ে পড়লে আরব, পারসিক, চীনা, জাভানি, ডাচ ও পর্তুগিজ সহ নানা বিদেশী বণিকগণ এদেশে আসতে থাকে। ফলে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ব্যাপক সমৃদ্ধি আসে এবং বাংলা আরো সম্পদশালী হয়। মধ্যযুগে বাংলার রকমারি ক্ষুদ্র শিল্পের কথা জানা যায়। এ প্রসঙ্গে ধাতব শিল্পের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তখন লৌহ নির্মিত দ্রব্যাদির ব্যাপক প্রচলন ছিল। কর্মকারগণ বিভিন্ন কৃষি যন্ত্রপাতি নির্মাণ করত। এছাড়া দুধারী তরবারি, ছুরি, কাঁচি, কোদাল ইত্যাদি নিত্যব্যবহার্য ধাতব দ্রব্য তৈরি হতো। কলকাতা ও কাশিম বাজারে এদেশের লোকেরা কামান তৈরি করতো। কাগজ, গালিচা, ইস্পাত প্রভৃতি শিল্পের কথাও জানা যায় ।
 

 


সামাজিক কর্মকাণ্ড
সুলতানি শাসনামলে বাংলা নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য বিখ্যাত ছিল। এ সময় বাংলায় বিভিন্ন ধর্মালম্বীদের মধ্যে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় ছিল। হিন্দুগণ নানা উচ্চ রাজপদে নিয়োগ পেতা, ইলিয়াস শাহের সেনাপতি সহদেব, পরাগল খান, জমিদার কংশ নারায়ণ-এর উচ্চ রাজপদে নিয়োগের দৃষ্টান্ত থেকে যার প্রমাণ মেলে। হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে হৃদ্যতাপূর্ণ সামাজিক সম্পর্ক থাকায় হিন্দু-মুসলিম উভয়ের নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগদান করত এবং সত্যপীর ও শ্রী চৈতন্যের প্রতি উভয় গোষ্ঠি সম্মানের দৃষ্টি বজায় রাখতেন। এ সময় হিন্দু সমাজের মাঝে নানা সামাজিক বর্ণ প্রথা (প্রধানত; ব্রাহ্মণ, ক্ষয়িত্র, বৈশ্য ও শূদ্র) চালু ছিল। মুসলিমদের মধ্যে কোন বর্ণ প্রথা ছিল না, তবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানের দিক দিয়ে মুসলিম সমাজে আশরাফ (উচ্চ শ্রেণি) ও আতরাফ (নিম্ন শ্রেণি) ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। তবে তা সত্ত্বেও সকল মুসলমানরা একসাথে সকল ধর্মীয় অনুষ্ঠান (নামাজ, রোজা, হজ্জ) পালন করতে পারত ।
মধ্যযুগে বাংলার নারীদের সামাজিক অবস্থান
এ সময় নারীরা পুরুষের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ছিল। সুলতানি শাসনামলে সমাজে ব্যপকভাবে বাল্য বিবাহ চালু ছিল। এ সময় বিধবাদের নানা সামাজিক প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে যেতে হত। হিন্দু বিধবাগণ দ্বিতীয় বিয়ে না করতে পারলেও মুসলিম সমাজে তা চালু ছিল। হিন্দু সমাজে অমানবিক সতীদাহ প্রথা চালু ছিল। সুলতানি যুগে বাংলায় হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের নারীরা পর্দা পালন করতেন বলে জানা যায়। নারীরা মুখ ও মাথা ঢেকে বাইরে বের হতেন। নানা পারিবারিক সিদ্ধান্তে মুসলিম নারীদের অংশগ্রহণ থাকলেও এক্ষেত্রে হিন্দু নারীগণ অনেক ক্ষেত্রে অধিকার পেতেন না ।
সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড
সুলতানি শাসনামলে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট উন্নতি হয়। সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ ও সিকান্দর শাহ শিক্ষা ও সংস্কৃতির একজন উদার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তবে ইলিয়াস শাহী শাসকদের মধ্যে বাংলার শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশে উদার পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় শাহ মুহাম্মদ সগীর ইউসুফ জুলেখা কাব্য রচনা করেন। অনেক ঐতিহাসিক বলেন যে, তিনি বাংলা ভাষায় রামায়ণের রচিয়তা কৃত্তিবাসেরও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। আজম শাহের শাসনামলে পাণ্ডুয়া ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল বলে জানা যায়। সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ সুফি-দরবেশ, পীর-আউলিয়াদের একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। আলাউল হক, নূর কুতুব-উল-আলম ও বিহারের সুফি মুজাফ্ফর শামস বলখীকে তিনি অনেক শ্রদ্ধা করতেন। আজম শাহ বাংলায় অগণিত মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকাহ, এতিমখানা ইত্যাদি নির্মাণ করেন। তিনি মক্কা ও মদিনায় মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণের জন্য অর্থ ব্যয় করেন এবং দুই শহরের অধিবাসীদের মধ্যে বিলি করার জন্য বহু অর্থ প্রেরণ করেন। পরবর্তী ইলিয়াস শাহী শাসকদের মধ্যে নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহ জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা, শিক্ষা-দীক্ষার প্রসার, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্নয়ন এবং সাহিত্য ও বিজ্ঞান চর্চার একজন একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এজন্য ঐতিহাসিকগণ তাঁর শাসনামলকে ‘বাংলার অগাস্টান যুগ' বলে আখ্যায়িত করেছেন। সুলতান নাসিরউদ্দিনের পুত্র রুকনউদ্দিন বরবক শাহ নিজে পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। বৃহস্পতি মিশ্র, কৃত্তিবাস, মনসুর সিরাজী প্রমুখ কবি তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। তাঁর সভা কবি ছিলেন আমির জয়েনউদ্দিন হাবী। বরবক শাহের পুত্র দ্বিতীয় শামসউদ্দিন আবু মুজাফ্ফর ইউসুফ শাহ বিদ্বান ও জ্ঞানীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তাঁর রাজত্বকালে মালাধর বসুর ‘শ্রীকৃষ্ণ বিজয়’ রচনা সমাপ্ত হয় এবং বিজয় পণ্ডিত ‘মহাভারত' এর বঙ্গানুবাদ করেন । হোসেন শাহী শাসকগণ শিল্প-সাহিত্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির উদার পৃষ্টপোষক ছিলেন। এ বংশের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান হোসেন শাহের উৎসাহ ও পৃষ্টপোষকতায় কবি মালাধরবসু কর্তৃক ভগবদ গীতা, কৃত্তিবাস কর্তৃক রামায়ণ সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলায় অনূদিত হয়। রামায়ণ অনুবাদের জন্য হোসেন শাহ মালাধরবসুকে ‘গুণরাজ খাঁ' উপাধি দেন। তাছাড়া কবি মালাধর বসু, মনসা মঙ্গল এর রচিয়তা বিজয় গুপ্ত, মনসা বিজয়ের দাখিল দরওয়াজা

 


 

 


লেখক বিপ্রদাস অনেকেই তাঁর সহযোগিতা পেয়েছিলেন। তাঁর অধীনস্থ চট্টগ্রামের শাসনকর্তা পরাগল খাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় কবীন্দ্র পরমেশ্বর বাংলা ভাষায় ‘মহাভারত' অনুবাদ করেন। এছাড়া সুলতান নসরত শাহ সাহিত্য শিল্প ও স্থাপত্য বিদ্যার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর রাজত্বকালে কবি শ্রীকর নন্দী প্রথমবারের মত হিন্দু ধর্মালম্বীদের ধর্মীয় গ্রন্থ মহাভারত বাংলায় অনুবাদ করেন । তাছাড়া সুলতান আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহের অনুপ্রেরণায় কবি শ্রীধর কবিরাজ বিখ্যাত প্রেম উপাখ্যান বিদ্যাসুন্দর রচনা করেন।
সুলতানি শাসনামলে অনেক সুরম্য স্থাপত্য ও স্থাপনা নির্মিত হয়েছিল। সিকান্দর শাহের শাসনামলে পাণ্ডুয়ার আদিনা মসজিদ, দিনাজপুরের মোল্লা আতার মসজিদ, পীর আঁখি সিরাজ উদ্দিনের মসজিদ ও সমাধি এবং গৌড়ের কোতোওয়ালী দরওয়াজা নির্মিত হয়। সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহও রাষ্ট্রীয় খরচে রাজধানী গৌড়, পাণ্ডুয়া, সাতগাঁও, ঢাকা, বাগেরহাট প্রভৃতি জনপদে মসজিদ, খানকাহ, সেতু, তোরণ, সমাধি ও প্রাসাদ এর মত নানা স্থাপনা নির্মাণে সহায়তা করেছেন। সুলতান রুকন উদ্দিন বরবক শাহ স্থাপত্যের উদার পৃষ্ঠপোষক হিসেবে গৌড়ের কদম রসুল মসজিদ, তাঁতিপাড়া মসজিদ ও পাণ্ডুয়ার চতুষ্কোণ মসজিদ নির্মাণ করেন। সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শিল্প স্থাপত্যের একজন শ্রেষ্ঠ নির্মাতা ছিলেন। গৌড়ের বিখ্যাত ছোট সোনা মসজিদ, মানিকগঞ্জ জেলার নাচাইল মসজিদ, গোমতি ফটক ছাড়া অগণিত মসজিদ, মাদ্রাসা, সমাধি ও দূর্গ নির্মাণ করে তিনি ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। তিনি ‘বাদশাহী সড়ক’ সহ সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিদের চলাচলের জন্য অনেক রাস্তাঘাট নির্মাণ করেন। সুলতান নসরত শাহ গৌড়ের বিখ্যাত কদমরসুল মসজিদ, বড় সোনা মসজিদ ছাড়াও বহু মসজিদ, মাদ্রাসা ও দরগাহ নির্মাণ করেন। বাগেরহাটের বিখ্যাত ‘মিঠা পুকুর' তাঁর জনকল্যাণমূলক কূপ খননের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
কদম রসূল মসজিদের শিলালিপি
শিক্ষার্থীর কাজ
সুলতানি শাসনামলের সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের পরিচয় দিন।
সারসংক্ষেপ :
বাংলার সুলতানি শাসনামল আর্থ-সামজিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে উন্নততর ছিল। এ সময় ইলিয়াস শাহী, গণেশীয়, পরবর্তী ইলিয়াস শাহী, হাবশি ও হোসেন শাহী শাসনামলের দীর্ঘ প্রায় দুইশত বছর ধরে শাসকবর্গের উদার পৃষ্ঠপোষকতা ও ব্যাক্তি উদ্যেগে শিক্ষা, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নানা উন্নতি সাধিত হয়েছিল। মুসলিম শাসকগণ এ সময় উদার সাম্য ভিত্তিক সমাজ গঠনে কাজ করেছিল ফলে দরবারে অমুসলিমগণ উচ্চ রাজপদে নিয়োগ পেত। সমাজে নারীদের সীমিত অধিকার এবং বাল্য বিবাহ ছিল। হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে হৃদ্যতাপূর্ণ সামাজিক সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল।

Content added By