অষ্টম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - আনন্দ পাঠ(বাংলা দ্রুত পঠন) - NCTB BOOK

ব্যাপারটা শুরু হয়েছে সেই ছেলেবেলা থেকে। রঞ্জুর বয়স তখন চার, বড়ো বোন শিউলির ঘরে তার জন্যে ছোটো খাট দেওয়া হলো, সেখানে রইল রংচঙে চাদর আর ঝালর-দেওয়া বালিশ। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে যেন একা একা না লাগে সেজন্যে মাথার কাছে রইল তার প্রিয় খেলনা ভালুক। গভীর রাতে আম্মা দেখেন রঞ্জু ঘুম থেকে উঠে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে চলে এসেছে। আম্মা জিজ্ঞেস করলেন, 'কী হলো? ঘুম থেকে উঠে এলি যে? রাষ্ট্র তার আব্বা আর আমার মাঝখানে শুভে শুতে বলল, 'ভালুকটা ঘুমাতে দেয় না। ” আম্মা চোখ কপালে তুলে বললেন, 'খেলনা ভালুক তোকে ঘুমাতে দেয় না? 'না। যখনই ঘুমাতে যাই তখনই খামটি দেয়। রঞ্জু শার্টের হাতা গুটিয়ে দেখাল, এই দেখ।' আম্মা দেখলেন আঁচড়ের দাগ। বিকেলবেলা পাশের বাসার ছোটো মেয়েটির পুতুল কেড়ে নিতে গিয়ে খামচি খেয়েছিল, নিজের চোখে দেখেছেন। মাঝরাতে সেটা নিয়ে মনুর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেন না । পরদিন তার বিছানায় খেলনা ভালুকটা সরিয়ে সেখানে ছোটো একটা কোলবালিশ দেওয়া হলো। কিন্তু আবার মধ্যরাতে দেখা গেল রুহু গুটি গুটি পায়ে হেঁটে চলে এসেছে। আম্মাকে ডেকে ঘুম থেকে উঠিয়ে নিজের জন্য জায়গা করতে করতে বলল, 'খুব দুষ্টুমি করছে।'

“কে?”
‘ময়ূরটা।’
‘কোন ময়ূর?”
‘ওই যে দেয়ালে ।'

আম্মার মনে পড়ল সেই ঘরের দেয়ালে শিউলি একটা ময়ূরের ছবির পোস্টার লাগিয়ে রেখেছে, বললেন, ‘সেটা তো ছবি।' রঞ্জু মাথা নাড়ল, ‘ছবি ছিল। রাত্রিবেলা ছবি থেকে বের হয়ে এসে পায়ে ঠোকর দেয়। এই দেখ আমার বুড়ো
আঙুলে ঠোকর দিয়েছে।
অন্ধকারে আম্মা রঞ্জুর পায়ের নখ বা ময়ূরের কাজকর্ম দেখার উৎসাহ অনুভব করলেন না। রঞ্জুকে পাশে শোয়ার জায়গা করে দিলেন 

 

ব্যাপারটা এইভাবে শুরু হয়েছে প্রয়োজনে রঞ্জু চমৎকার গল্প ফেঁদে বসে। আব্বা বললেন, ‘ছোটো মানুষ সত্যি-মিথ্যে গুলিয়ে ফেলে। বড়ো হলে ঠিক হয়ে যাবে।' আরেকটু বড়ো হলে দেখা গেল তার গল্প বলার অভ্যাস বেড়ে গেছে। আগে প্রয়োজনে বানিয়ে বানিয়ে বলত
আজকাল অপ্রয়োজনেও বানানো শুরু করেছে।
যত দিন যেতে থাকল রঞ্জুর বানিয়ে গল্প বলার অভ্যাস আরো বেড়ে যেতে থাকল। ব্যাকরণ ক্লাসে একদিন
হোমওয়ার্ক না-করে চলে এসেছে, কিন্তু রঞ্জু ঘাবড়াল না, হাসিমুখে বলল, ‘স্যার আমি হোমওয়ার্কটা করেছি
স্যার।
করেছিস তাহলে আনিসনি কেন?”
‘সেটা একটা বিশাল গল্প স্যার।'

 

রঞ্জু স্যারের দৃষ্টি উপেক্ষা করে গল্প শুরু করে দিল : “আমার বড় বোনের নাম শিউলি, গভমেন্ট স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ে। তার খুব চা খাওয়ার শখ। রাতে আমার আম্মাকে বলল, সে চা খাবে। আম্মা ধমক দিয়ে বললেন, এত রাতে চা খাবি কী! ঘুমাতে যা।”

 

শিউলি আপা খুব মন খারাপ করে ঘুমাতে গেল । কিন্তু মনের মাঝে রয়ে গেছে চা খাওয়ার শখ। গভীর রাতে দেখলাম সে বিছানা থেকে উঠে হাঁটতে শুরু করল । চোখ বন্ধ করে ঘুমের মাঝে হাঁটতে শুরু করেছে-ইংরেজিতে এটাকে বলে ‘স্লিপ ওয়াকিং'। যখন কেউ স্লিপ ওয়াকিং করে তখন তাকে ডিস্টার্ব করতে হয় না। আমি তাই তাকে ডিস্টার্ব করলাম না। দেখলাম সে রান্না ঘর থেকে এক কেতলি পানি নিয়ে এল। তারপর আমার হোমওয়ার্কের খাতাটা নিয়ে হোমওয়ার্কের পৃষ্ঠাগুলো ছিঁড়ে সেখানে আগুন জ্বালিয়ে দিল । সেই আগুনে কেতলির পানি গরম করে মাঝরাতে চা তৈরি করে খেল। এ রকম সময়ে ডিস্টার্ব করতে হয় না স্যার— তাই আমি কিছু বলতে পারলাম না।” স্যার কোনও কথা না বলে থ হয়ে রঞ্জুর দিকে তাকিয়ে রইলেন ।

বছরখানেক পরে রঞ্জুকে নিয়ে সমস্যা আরো বেড়ে গেল—কারণ তখন হঠাৎ করে সে সায়েন্স ফিকশান পড়া আরম্ভ করেছে। সায়েন্স ফিকশানের উদ্ভট কাহিনি পড়ে তার মাথাটা পুরোপুরি বিগড়ে গেল—আগে বানিয়ে বানিয়ে সে যে সব গল্প বলত সেগুলো তবুও কোনো-না-কোনোভাবে সহ্য করা যেত। কিন্তু আজকাল যেগুলো বলে সেগুলো আর সহ্য করার মতো নয়। একবার দুদিন তার ক্লাসে দেখা নেই, তৃতীয় দিনে সে মহা উত্তেজিত হয়ে দুদিন
আগের একটা খবরের কাগজ নিয়ে হাজির হয়েছে। সবাই ক্রিকেট খেলা নিয়ে গল্প করছে সে তাদের থামিয়ে দিয়ে খবরের কাগজটা তাদের সামনে খুলে ধরে বলল, দেখ— সবাই খবরের কাগজটার দিকে তাকাল—দেখার মতো এমন কিছু নেই, প্রতিদিন যা থাকে তাই আছে খবরের কাগজে। আজমল জিজ্ঞেস করল, 'কী দেখব?'
রঞ্জু একটু অধৈর্য হয়ে বলল, 'তারিখটা দেখ ! দুদিন আগের তারিখ, এর মাঝে দেখার কী আছে কেউ বুঝতে পারল না। রঞ্জু বিরক্ত হয়ে মাথা নেড়ে বলল,
‘এখনো বুঝতে পারছিস না?'
উপস্থিত সবাই মাথা নেড়ে বলল, ‘না।’
‘আমি একটু আগে হকারের কাছ থেকে কাগজটা কিনেছি, এক ঘণ্টাও হয়নি।'
আজমল ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ‘হকার পুরোনো কাগজ বিক্রি করে?
রঞ্জু অধৈর্য হয়ে বলল, “দুর! পুরোনো কাগজ কিনব কেন? আজকের কাগজটাই কিনেছি। কিনে আসছি। হঠাৎ
রাস্তার মোড়ে গাছের আড়ালে দেখি চকচকে সিলিন্ডারের মতো একটা জিনিস। কেমন একটু কৌতূহল হলো, তাই দেখতে গেলাম, কাছে যেতেই সাঁৎ করে গোল একটা দরজা খুলে গেল । বিশ্বাস করবি না, ভেতরে দুজন মানুষ বসে আছে, তাদের গায়ের রং সবুজ। আমাকে দেখে একজন বলল, ‘এই খোকা শুনে যাও—' আমি তো ভয় পেয়ে গেলাম, একে অপরিচিত মানুষ, তার ওপর গায়ের রং সবুজ। ভাবলাম উলটো দিকে একটা দৌড় দিই। কিন্তু মানুষগুলোর চোখ দুটি দেখে থেমে গেলাম, কারণ চোখ দেখে মনে হলো খুব বিপদে পড়েছে। আমি কাছে গেলাম, ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে?' একজন বলল, ‘আমরা হারিয়ে গেছি।'

 

‘হারিয়ে গেছ?’ আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘এটা হচ্ছে তেমাথা; একটু সামনে গেলে আমাদের স্কুল, তার সামনে হচ্ছে বাসস্টেশন—'
সবুজ রঙের দুই নম্বর মানুষটা বলল, ‘না, না তুমি বুঝতে পারছ না, আমরা জায়গার ক্ষেত্রে হারাইনি । আমরা সময়ের ক্ষেত্রে হারিয়ে গেছি।'
‘সময়ের ক্ষেত্রে?'
‘হ্যাঁ। এটা হচ্ছে টাইম মেশিন । এক হাজার বছর অতীতের একটা মিশন শেষ করে ভবিষ্যতে ফিরে যাচ্ছি, হঠাৎ হারিয়ে গেলাম। কোন সময়ে আছি জানি না। তাই টাইম মেশিনটাকে কেলিব্রেট করতে পারছি না। আমি বললাম, তা-ই বল! তার মানে তোমরা জানতে চাও আজকে কয় তারিখ?' 'হ্যাঁ।'

‘এই দেখ—বলে আমি তাদের সামনে খবরের কাগজটা খুলে ধরলাম, আটাশ তারিখ—শনিবার।' সবুজ চেহারার মানুষ দুজন তাই দেখে খুব খুশি হয়ে গেল, আমার হাত ধরে কয়েকবার হ্যান্ডশেক করে বলল, 'তুমি খুব উপকার করেছ আমাদের, কী চাও তুমি বলো।' ‘আমি তো আর বলতে পারি না—এইটা চাই সেইটা চাই, তাই ভদ্রতা করে বললাম কিছুই চাই না আমি ।’
লোক দুজন তখন আমাকে এত বড়ো একটা জিরকোনিয়ামের ক্রিস্টাল দিয়ে বলল, ‘এইটা নাও।' আমি বললাম, 'কী বলছ, , এত বড়ো একটা ক্রিস্টাল দিয়ে আমি কী করব—হাত থেকে পড়ে ভেঙে যাবে। যদি সত্যিই কিছু দিতে চাও তাহলে তোমাদের টাইম মেশিনে করে আমাকে ঘুরিয়ে আন ।'
লোক দুজন বলল, “ওঠো তাহলে ।’
আমি ভেতরে ঢুকলাম । একজন জিজ্ঞেস করল, ‘অতীতে যাবে, না ভবিষ্যতে?”
আমি বললাম, ‘ভবিষ্যতে যাই।'
‘কতদিন যেতে চাও?'
আমি বললাম, ‘বেশি দিন না। এক-দুই দিন ।'
একজন তখন একটা সুইচ টিপে দিল, ঘটাং ঘটাং করে একটা শব্দ হল তারপর দরজা খুলে বলল, ‘এসে গেছি!” আমি প্রথমে বিশ্বাস করিনি, বাইরে এসে একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী বার আজকে?' সে বলল, ‘সোমবার!”

 

আজমল সাদাসিদে ছেলে, সে মাথা নেড়ে বলল, ‘আসলেই আজকে সোমবার।'
রঞ্জু চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, 'তার মানে শনি রবি এই দুটি দিন আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে! কী
আশ্চর্য দেখলি?'
সবাই রঞ্জুকে এতদিনে চিনে গেছে, তারা মুখ টিপে হেসে আবার ক্রিকেটের গল্পে ফিরে গেল । রঞ্জু রেগে গিয়ে বলল, “আমার কথা তোরা বিশ্বাস করলি না? ভাবছিস আমি গুল মারছি? তাহলে এই খবরের কাগজটা আমার হাতে এল কোথা থেকে? বল তোরা—দুদিন আগের খবরের কাগজ আমার হাতে এখন কেমন করে এল?' তার প্রশ্নের কেউ সদুত্তর দিতে পারল না, রঞ্জু তখন বইপত্র রেখে খবরের কাগজ নিয়ে বের হয়ে গেল অন্য কাউকে গল্প শোনানোর জন্যে ।

 

রঞ্জুর সায়েন্স ফিকশানের প্রতি বাড়াবাড়ি প্রীতি জন্ম নেবার পর শিউলির জন্যেও গল্পগুলো হজম করা কঠিন হয়ে পড়তে শুরু করল। প্রায় প্রতিদিনই রঞ্জু এসে মহাকাশের কোনো এক আগন্তুকের কথা বলতে লাগল। কোনো দিন সেই আগন্তুক তাকে ব্ল্যাকহোলের গোপন রহস্যের কথা বলে গেছে; তার কাছে কাগজ কলম ছিল না বলে লিখে রাখতে পারেনি, লিখে রাখতে পারলেই পৃথিবীতে হইচই শুরু হয়ে যেত। কোনোদিন একটা ফ্লাইং সসার থেকে বিদঘুটে কোনো প্রাণী লেজারগান দিয়ে তাকে গুলি করতে চেষ্টা করেছে আর সে কোনোমতে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছে, আবার কোনো দিন স্কুল থেকে ফেরার পথে একটা জারুল গাছের নিচে চতুষ্কোণ একটা উজ্জ্বল আলো দেখে সেখানে উঁকি মারতেই ভিন্ন একটি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এক ঝলক দৃশ্য দেখে এসেছে।

কয়দিন পরের কথা । আম্মা নানাকে একটা চিঠি লিখছেন। চিঠি লিখতে লিখতে হঠাৎ আম্মার ফাউন্টেন পেনে কালি শেষ হয়ে গেল । আম্মা রঞ্জুকে ডেকে বললেন, ‘কালির দোয়াতটা নিয়ে আয় তো ।’ রঞ্জু দোয়াতটা নিয়ে আসছিল আর ঠিক তখন কোনো কারণ নেই, কিছু নেই হঠাৎ করে সে হোঁচট খেল, সঙ্গে সঙ্গে হাত থেকে কালির দোয়াত ছিটকে গেল উপরে তারপর আছড়ে পড়ল নিচে—আর কিছু বোঝার আগে দোয়াত ভেঙে একশো টুকরা হয়ে মেঝেতে কার্পেটে কালি ছড়িয়ে একটা বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা হলো । আম্মা তখন এমন রেগে গেলেন যে, সে আর বলার মতো নয় । খানিক ক্ষণ রঞ্জু ফ্যাসফ্যাস করে কাঁদল, তারপর সে সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠে গেল । নির্জন ছাদ, পাশে কয়েকটা নারকেল গাছ, বাতাসে তাদের পাতা ঝিরঝির করে নড়ছে। আকাশের মাঝামাঝি অর্ধেকটা চাঁদ, তাতেই চারদিকে আলো হয়ে আছে। ছাদে এসে রঞ্জুর মনটা একটু শান্ত হলো ।

 

ঠিক এরকম সময় রঞ্জুর মনে হলো পেছনে কেমন জানি এক ধরনের শোঁ শোঁ আওয়াজ হচ্ছে। একটু অবাক হয়ে পেছন ঘুরে সে যেটা দেখল তাতে তার সমস্ত শরীর শীতল হয়ে গেল, গলা ফাটিয়ে একটা চিৎকার দেবে দেবে করেও সে অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করে রাখল 
রঞ্জু দেখল তার পেছনে দুই মানুষ সমান উঁচু জায়গাতে গোলমতোন একটা মহাকাশযান ভাসছে। সেটি বিরাট বড়ো, প্রায় পুরো ছাদ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে—ঠিক নিচে একটা গোল গর্তের মতো, সেখান থেকে নীল আলো বেরিয়ে আসছে। মহাকাশযানটি প্রায় নিঃশব্দ, শুধু হালকা একটা শোঁ শোঁ আওয়াজ, খুব কান পেতে থাকলে শোনা যায়। রঞ্জু নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না। প্রথমে মনে হলো সে বোধহয় পাগল হয়ে গেছে—পুরোটা দৃষ্টিবিভ্রম, কিন্তু ভালো করে তাকাল সে, বুঝতে পারল এটা দৃষ্টিবিভ্রম নয় সত্যি সত্যি দেখছে। কী করবে বুঝতে না পেরে সে মুখ হা করে তাকিয়ে রইল 

একটু পরে নীল আলোতে হঠাৎ একটা আবছা ছায়া দেখতে পায়, ছায়াটা কিলবিল করে নড়তে থাকে। তারপর হঠাৎ সেটা স্পষ্ট হয়ে যায়, মনে হতে থাকে অনেক দিন না খেয়ে একটা মানুষ শুকিয়ে কাঠি হয়ে গেছে-শুধু মাথাটা না শুকিয়ে আরো বড়ো হয়ে গেছে, সেখানে গোল গোল চোখ, নাক নেই, সেখানে দুটি গর্ত। মুখের জায়গায় গোল একটা ফুটো দেখে মনে হয় বুঝি খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ।
প্রাণীটি কিলবিল করতে করতে একটা শব্দ করল। শব্দটি অদ্ভুত। শুনে মনে হয় একজন মানুষ হাঁচি দিতে গিয়ে থেমে গিয়ে কেশে ফেলেছে। রঞ্জু কী বলবে বুঝতে না পেরে বলল, ‘ওয়েলকাম জেন্টলম্যান।' কেন জানি তার ধারণা হলো ইংরেজিতে কথা বললে সেটা এই প্রাণী ভালো বুঝতে পারবে। প্রাণীটা তখন হঠাৎ করে পরিষ্কার বাংলায় বলল, ‘শুভসন্ধ্যা মানবশিশু।'

রঞ্জু অবাক হয়ে বলল, ‘তুমি বাঙালি?”
প্রাণীটা বলল, ‘না, আমি বাঙালি নই । তবে আমি তোমার গ্রহের যে কোনো মানুষের ভাষায় কথা বলতে পারি । এই দেখ—' বলে প্রাণীটা পরিষ্কার চাটগাঁয়ের ভাষায় বলল, ‘আঁসার বজা কুরার বজা ফত্যি আডত বেচি, বাজার গরি বাড়িত আইলে ইসাব লয় তোর চাচি।' ফ্লাইং সসার এবং তার রহস্যময় প্রাণী দেখে রঞ্জু যত অবাক হয়েছিল তার মুখে চাটগাঁয়ে কথা শুনে সে তার থেকে বেশি অবাক হয়ে গেল। সে খুক খুক করে একটু হেসে ফেলে বলল,
‘তোমার নাম কী?’
‘তোমাদের মতো আমাদের নামের প্রয়োজন হয় না । আমরা এমনিতেই পরিচয় রাখতে পারি।'
রঞ্জু বলল, 'আমার নাম রঞ্জু । তোমাকে দেখে আমার খুব মজা লাগছে।'
'কেন?' ‘আমার তো সায়েন্স ফিকশন পড়তে খুব ভালো লাগে—তাই।'
‘আমাদের কিছু পড়তে হয় না। আমরা এমনিতেই সব জানি।'
'সত্যি?'
‘সত্যি । আমরা তোমার কাছে এসেছি একটা কারণে। আমাদের এক্ষুনি ক্র্যাব নেবুলাতে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু আমাদের ফুয়েল ট্যাংকে একটা লিক হয়ে গেছে সেটা সারানোর সময় নেই। তুমি সেজন্য আমাদের সাহায্য করবে।' রঞ্জু অবাক হয়ে বলল, ‘আমি?’
‘হ্যাঁ তুমি ৷’
‘কীভাবে?’
‘তোমার বাম পকেটে একটা চিউইংগাম আছে। সেটা চিবিয়ে নরম করে দাও, আমাদের ট্যাংকের লিকটাতে
সেটা লাগিয়ে নেব । রঞ্জু অবাক হয়ে গেল, সত্যি সত্যি তার পকেটে চিউইংগামের একটা স্টিক আছে। সেটা মুখে পুরে চিবিয়ে নরম করে মুখ থেকে বের করে প্রাণীটার দিকে এগিয়ে দেয় । প্রাণীটা বলল, ‘আরও কাছে আসো । আমি এই নীল শক্তি
বলয় থেকে বের হতে পারব না।'
রঞ্জু আরেকটু এগিয়ে গেল। প্রাণীটা তখন তার তুলতুলে নরম হাত দিয়ে চিউইংগামটা নিয়ে বলল, “অনেক ধন্যবাদ।'
রঞ্জু বলল, ‘এখন তোমরা যাবে?'
‘হ্যাঁ। তুমি আমাদের সাহায্য করেছ বলে আমরা তোমাকে একটা উপহার দিতে চাই।' রঞ্জু কাঁপা গলায় বলল, 'কী উপহার? ’
‘আমরা যেখানে থাকি, সেই ক্র্যাব নেবুলার একটি ত্রিমাত্রিক প্রতিচ্ছবি আছে। তোমাদের গ্রহতেই পেয়েছি, আমরা অনেকগুলো নিয়ে যাচ্ছি আমাদের বাসস্থানে। তোমাকে দিয়ে যাচ্ছি একটা। হাত বাড়াও—— উত্তেজনায় রঞ্জুর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার অবস্থা হলো। সে হাত বাড়িয়ে দেয় এবং সেখানে গোলমতোন একটা জিনিস এসে পড়ল ৷

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নীল আলোটা ভেতরে ঢুকে যায় আর ফ্লাইং সসারের মতো জিনিসটা ঘুরপাক খেতে খেতে উপরে উঠে যেতে থাকে । রঞ্জু অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল সেটা ছোটো হয়ে আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে। গোলাকার জিনি- সটা হাতে নিয়ে সে সিঁড়ির দিকে ছুটে যায়। সিঁড়ির আলোতে জিনিসটা ভালো করে দেখল এবং সবিস্ময়ে আবিষ্কার করল সেটা একটা আমড়া। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে পড়ল আমড়ার আঁটিটা আসলে সত্যিই ক্র্যাব নেবুলার মতো দেখতে। মহাকাশের এক বিচিত্র প্রাণী তার সঙ্গে এ রকম ফাজলামি করবে কে জানত! রঞ্জু হতচকিতের মতো নিজের ঘরে এসে ঢুকল, শিউলি তাকে দেখে এগিয়ে আসে, ‘কী রে রঞ্জু তুই কোথায়
ছিলি, খুঁজে পাচ্ছিলাম না ৷'
রঞ্জু নিচু গলায় বলল, 'ছাদে।’
‘ছাদে একা একা কী করছিলি?'
রঞ্জু খানিক ক্ষণ শিউলির দিকে তাকিয়ে রইল, ‘তারপর বলল, কিছু না।'
“কিছু না?'
'না।'
শিউলি একটু অবাক হয়ে রঞ্জুর দিকে ঘুরে তাকাল, তাকে ভালো করে দেখল তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘তোর কী হয়েছে? এরকম করে তাকিয়ে আছিস কেন?”
‘কী রকম করে?’
'মনে হচ্ছে তুই ভূতটুত কিছু একটা দেখে এসেছিস!'
রঞ্জু কিছু বলল না। শিউলি আবার জিজ্ঞেস করল, ‘তোর হাতে ওটা কী?
‘আমড়া ।’
‘আমড়া!' শিউলির মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, ‘আমার জন্যে এনেছিস?”
রঞ্জু দুর্বলভাবে হেসে বলল, ‘তুমি নেবে?’
‘দে—' শিউলি রঞ্জুর হাত থেকে আমড়া নিয়ে ওড়না দিয়ে মুছে একটা কামড় দিয়ে বলল, “উহ্! কী টক ! কোথায়
পেলি এই আমড়া?’
রঞ্জু কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল, একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘কোথায় আবার পাব? সবাই যেখানে পায় সেখানেই পেয়েছি!'
লেখক-পরিচিতি
মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস নেত্রকোনা জেলায়। তিনি একজন প্রগতিশীল লেখক, পদার্থবিদ, কম্পিউটার-বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক রচনা, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি, কিশোর উপন্যাস ও কলাম লেখক হিসেবে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাগুলোর মধ্যে রয়েছে 'কপোট্রনিক সুখ-দুঃখ', 'ক্রুগো', 'ট্রাইটন একটি গ্রহের নাম’, ‘রবোনগরী' ইত্যাদি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি; ‘হাতকাটা রবিন’, ‘দীপু নাম্বার টু’, ‘আমার বন্ধু রাশেদ' ইত্যাদি কিশোর-উপন্যাস; ‘নিউরনে অনুরণন’, ‘একটুখানি বিজ্ঞান’, ‘গণিতের মজা মজার গণিত', 'বিগ ব্যাং থেকে হোমো স্যাপিয়েন্স' ইত্যাদি বিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ক গ্রন্থ। ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস' ও ‘ছোটোদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস' তাঁর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থ। মুহম্মদ জাফর ইকবালের একাধিক উপন্যাস থেকে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন ।

 

Content added By

এটি একটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি। চার বছর বয়েস থেকেই বানিয়ে বানিয়ে গল্প-বলা রঞ্জুর স্বভাবে পরিণত হয়েছে। পরিবারের সবাই ও স্কুলের বন্ধুরাও ব্যাপারটা জানে বলে তার গালগল্পকে কেউ আর বিশ্বাস করে না। শুধু তার বড়ো বোন শিউলি বিশ্বাস করার ভানটুকু করে। এদিকে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি পড়ে পড়ে রঞ্জুর গল্প বলার ধরনটাও পালটে যায়; আগের গল্পগুলো বিশ্বাসযোগ্য হলেও বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিগুলো মেনে নেবার মতো ছিল না। তবে সত্যি সত্যি রঞ্জু একদিন রাতে ছাদের ওপর একটি মহাকাশযান দেখতে পায়। ফ্লাইং সসারের মতো দেখতে যানটির ভেতর থেকে কাঠির মতো বড়ো মাথার প্রাণী বেরিয়ে এল, তার সঙ্গে অনেক কথাও হলো তার ক্র্যাব নেবুলার যাত্রীদের ফুয়েল ট্যাংকের ফুটোটা চিউইংগামের স্টিক চিবিয়ে নরম করে সারিয়ে তুলতে সাহায্য করল রঞ্জু। বিনিময়ে পেল বিস্ময়কর এক উপহার ক্র্যাব নেবুলার ত্রিমাত্রিক প্রতিচ্ছবি- আসলে একটি আমড়া । অবিশ্বাস্য ও অকল্পনীয় অথচ বাস্তব সেই আনন্দময় অভিজ্ঞতাটি রঞ্জু ভাগাভাগি করতে পারল না; এমনকি তার বড়ো বোনের সঙ্গেও নয়। কেননা, এটিও একটি বানানো গল্প বলে শিউলি হয়ত অবিশ্বাস করবে। গল্পটিতে শিশুকিশোরদের সৃষ্টিশীল ও কল্পনাপ্রবণ মানসিকতা প্রকাশিত হয়েছে।

Content added By

ক্র্যাব নেবুলা                            — একটি নীহারিকার নাম। ইংরেজি crab Nebula.

ফাইট                                       — যুদ্ধ। ইংরেজি fight.

স্লিপ ওয়াকিং                           — ঘুমিয়ে হাঁটা। ইংরেজি sleep walking.

ডিস্টার্ব                                  — বিঘ্নিত করা। ইংরেজি disturb.

সায়েন্স ফিকশান                    — বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি। ইংরেজি science fiction.

উদ্ভট                                       — আজগুবি, অদ্ভুত ।

বোলচাল                                 — বাগাড়ম্বরপূর্ণ কথাবার্তা।

সিলিন্ডার                                — ইনজিনে ব্যবহৃত নলাকৃতির পাত্রবিশেষ । ইংরেজি cylinder.

টাইম মেশিন                            — সময় পরিভ্রমণের যন্ত্র বা যান। টাইম মেশিনে করে অতীত বা ভবিষ্যতে ভ্রমণ করা যায়
                                                           বলে ধারণা । ইংরেজি time machine.

মিশন                                      — বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে প্রেরিত ব্যক্তিবর্গ। ইংরেজি mission.

কেলিব্রেট                                — · ক্রমাঙ্ক নির্ণয় বা সংশোধন করা। ইংরেজি calibrate.

ব্ল্যাকহোল                                 — কৃষ্ণগহ্বর। black hole.

হ্যান্ডশেক                                — করমর্দন। হাত মেলানো। ইংরেজি hand shake.

জিরকোনিয়াম                           —  ধাতব পদার্থবিশেষ। পারমাণবিক চুল্লি বা জেট ইনজিনে ব্যবহার্য ধাতব উপাদান। ইংরেজি                                                                               zirconium.

ক্রিস্টাল                                  — স্ফটিক। ইংরেজি crystal.
ফ্লাইং সসার                             — বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিতে ফ্লাইং সসার বা এমন এক ধরনের উড়ন্ত বস্তুর কথা বলা হয় যাতে
                                                     করে অন্য গ্রহের প্রাণীরা চলাচল করে। ইংরেজি flying saucer.

লেজারগান                              — একধরনের বন্দুক। বন্দুকের আদলে তৈরি অস্ত্রটিতে গুলির পরিবর্তে লেজার রশ্মি ব্যবহার

                                                 করা হয়। ইংরেজি laser gun.

বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড                               — মহাজগৎ 

শর্টকাট                                   — সংক্ষিপ্ত। ইংরেজি shortcut.

রোবট                                     — যন্ত্রমানব। ইংরেজি robot.

স্টেনলেস                               — দাগমুক্ত। স্টেনলেস স্টিল, লোহার সংকর ধাতু। ইংরেজি stainless.

নাকিস্বরে                                  — নাকে নাকে কথা। নাক থেকে উচ্চারিত স্বর বা ধ্বনি 

ডি সাইজ                                 — ডি-আকৃতি। ইংরেজি D size.

বলপয়েন্ট                                 — কলমবিশেষ। ইংরেজি ballpoint.

ফাউন্টেন পেন                          — কলমবিশেষ। ঝরনা-কলম। ইংরেজি fountain pen.

বিতিকিচ্ছিরি                              — বিশ্রী, যা তা ।

নিওনসাইন                                — নিয়ন (আলোর সাহায্যে) বিজ্ঞাপন। ইংরেজি neonsign.

মহাকাশযান                              — মহাশূন্য ভ্রমণ ও গ্রহাদিতে যাওয়ার উপযোগী বাহন বা যানবিশেষে।

ওয়েলকাম                                — স্বাগতম। শুভেচ্ছাজ্ঞাপন। ইংরেজি welcome.

জেন্টলম্যান                             — ভদ্রলোক। ইংরেজি gentleman.

গ্রহ                                           — যে জ্যোতিষ্ক সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে ।

ফুয়েল ট্যাংক                            — জ্বালানি রাখার বড়ো পাত্র। ইংরেজি fuel tank.

লিক                                          — জলীয় পদার্থ, গ্যাস ইত্যাদি প্রবেশ করার বা বেরিয়ে যাওয়ার উপযোগী ছিদ্র বা ফুটা  । ইংরেজি leak.

স্টিক                                         — কাঠি। ইংরেজি stick.

বলয়                                          — গোলাকৃতি, বেষ্টিত ।

ত্রিমাত্রিক                                  — দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও বেধযুক্ত বস্তু ।

প্ৰতিচ্ছবি                                   — ছায়া, প্রতিরূপ, প্রতিমূর্তি।

Content added || updated By