অষ্টম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় - NCTB BOOK

বাংলাদেশে প্রায় দুইশত বছরের ইংরেজ শাসনামলই (১৭৫৭-১৯৪৭) ঔপনিবেশিক যুগ হিসাবে পরিচিত। ইংরেজ আমলে বাংলাদেশে অনেক জমিদার বাড়ি, বণিকদের আবাসিক ভবন, অফিস আদালত ভবন, রেলস্টেশন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য স্থাপত্য তৈরি হয়েছিল। ‘প্রত্ন' শব্দের অর্থ হলো পুরনো। প্রত্নসম্পদ বলতে পুরনো স্থাপত্য ও শিল্পকর্ম, মূর্তি বা ভাস্কর্য, অলঙ্কার, প্রাচীন আমলের মুদ্রা ইত্যাদিকে বোঝায়। এসব প্রত্ননিদর্শনের মধ্য দিয়ে সেকালের মানুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা, জীবনযাত্রা, বিশ্বাস-সংস্কার, রুচি বা দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়।

এ অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা-
•ঢাকা শহরে ঔপনিবেশিক যুগে নির্মিত ধর্মীয় স্থাপত্যগুলোর বিবরণ দিতে পারব;
•ঢাকা শহরের কোন কোন অংশে ধর্মীয় ইমারত নির্মিত হয়েছে তা বর্ণনা করতে পারব;
•ঔপনিবেশিক যুগে ঢাকায় নির্মিত উল্লেখযোগ্য লৌকিক ইমারতসমূহের বর্ণনা দিতে পারব; কোন কোন ইমারত সরকারিভাবে আর •কোনগুলো বেসরকারিভাবে নির্মিত হয়েছে তা উল্লেখ করতে পারব;
•ঢাকার বাইরে কোন কোন অঞ্চলে জমিদাররা প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন তা বর্ণনা করতে পারব; ঢাকার বাইরে জমিদারদের তৈরি মন্দির •সম্পর্কে বর্ণনা করতে পারব;
•প্রত্ননিদর্শনের আলোকে ঔপনিবেশিক যুগে সোনারগাঁওয়ের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে পারব ;
•পানামনগর ও সরদার বাড়ির বর্ণনা করতে পারব;
•ঔপনিবেশিক যুগের প্রত্ননিদর্শন কোন কোন জাদুঘর ও সংগ্রহ শালায় রয়েছে তা বর্ণনা করতে পারব;
•জাদুঘরে সংগৃহীত নিদর্শনগুলো সম্পর্কে বর্ণনা করতে পারব ;
•প্রত্নস্থান ও প্রত্নসম্পদের প্রতি আগ্রহ তৈরি হবে এবং এসব সংরক্ষণে উদ্বুদ্ধ হব।

Content added By

ঔপনিবেশিক যুগের ঢাকার স্থাপত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি মসজিদ, মন্দির ও গির্জা । ঢাকার মসজিদগুলো মোগল স্থাপত্য রীতিতে তৈরি। তবে এর সঙ্গে কিছুটা ইউরোপীয় রীতিও যোগ হয়েছে। উনিশ শতকে তৈরি ঢাকার উল্লেখযোগ্য মসজিদের মধ্যে রয়েছে লালবাগ (হরনাথ ঘোষ রোড) মসজিদ, লক্ষ্মীবাজার শাহী মসজিদ, সূত্রাপুরের কলুটোলা জামে মসজিদ, বেচারাম দেউড়ি মসজিদ, কায়েতটুলি মসজিদ এবং সূত্রাপুরের সিতারা বেগম মসজিদ। এগুলোর নির্মাণকলা ও বিচিত্র কারুকাজ চিত্তাকর্ষক। নারিন্দার চিনি টিকরি মসজিদও স্থাপত্যশিল্পের চমৎকার নিদর্শন। ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত শিয়াদের ইমামবাড়া, হোসেনি দালান ইংরেজ আমলে নতুন করে নির্মিত হয় ।

ঢাকা শহরের বিখ্যাত ঢাকেশ্বরী মন্দির ও রমনা কালীমন্দির ঔপনিবেশিক যুগের আগে তৈরি। রমনার কালী মন্দিরটি অবশ্য ঔপনিবেশিক আমলে আবার নতুন করে নির্মিত হয়েছিল। আঠারো-উনিশ শতকে ঢাকা শহরে তৈরি হয় বেশ কয়েকটি গির্জা। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরনো হলো আর্মেনিয়ান গির্জা। এটি তৈরি হয় আরমানিটোলায় ১৭৮১ সালে। উনিশ শতকে ঢাকায় নির্মিত হয় সেন্ট টমাস এ্যাংলিকান গির্জা ও হলিক্রস গির্জা। এছাড়াও ঢাকার পুরনো স্থাপত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে সদরঘাট এলাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে অবস্থিত বাহাদুর শাহ পার্ক । উনিশ শতকের মাঝামাঝি ঢাকার নওয়াব আবদুল গণি এ পার্ক তৈরি করে ব্রিটেনের রানি ভিক্টোরিয়ার নামে এর নাম দেন ভিক্টোরিয়া পার্ক। তার আগে এ জায়গাটির নাম ছিল আন্টাঘর ময়দান । আন্টাঘর ময়দানের নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ১৮৫৭ সালের প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস। ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর এদেশীয় সৈন্যরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করেন। ইংরেজরা একে বলে সিপাহি বিদ্রোহ। যুদ্ধে ভারতীয় সৈন্যরা জিততে পারেন নি। বিদ্রোহী সৈন্যদের যাঁরা ঢাকায় ইংরেজদের হাতে বন্দি হন তাঁদের ইংরেজরা এই আন্টাঘর ময়দানে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে ফাঁসি দেয়। এই ঘটনার ঠিক একশো বছর পর ১৯৫৭ সালে স্বাধীনতার জন্য জীবনদানকারী সৈনিকদের স্মৃতিতে এখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়। ভারতবর্ষের শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের নামে পার্কটির নাম হয় বাহাদুর শাহ পার্ক।

ঢাকার প্রাচীন স্থাপত্যকীর্তির আরেকটি বিখ্যাত নিদর্শন বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে ঢাকার নওয়াবদের তৈরি প্রাসাদ আহসান মঞ্জিল। এছাড়া জমিদার ও বণিকদের তৈরি পুরনো ঢাকার রূপলাল হাউস এবং রোজ গার্ডেনও চমৎকার স্থাপত্যকর্ম। অফিস বাড়ি হিসাবে ঢাকায় যেসব ভবন তৈরি হয়েছিল তার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর হচ্ছে কার্জন হল। ইংরেজ আমলে তৈরি এ ভবনটি বহুকাল ধরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের অংশ। পুরনো হাইকোর্ট ভবনটিও ইংরেজ আমলে তৈরি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের চত্বরে অবস্থিত গ্রিক সমাধিসৌধটি ১৯১৫ সালে নির্মিত। বর্গাকার ও সমতল ছাদযুক্ত এ স্থাপত্যে প্রাচীন গ্রিসের ‘ডরিক রীতি' অনুসৃত হয়েছে।

কাজ : ঢাকা শহরের কয়েকটি প্রধান প্রত্ননিদর্শনের নাম উল্লেখ করো।

Content added By

সুলতানি আমলে বাংলার রাজধানী ছিল সোনারগাঁও। পরবর্তীকালে মোগল যুগে এর গুরুত্ব কমে যায়। কিন্তু তখনো মসলিন শাড়ির উৎপাদন ও ব্যবসাকেন্দ্র হিসাবে এর খ্যাতি ছিল। উনিশ শতকে ধনী ব্যবসায়ীদের অনেকে বসবাসের জন্য সোনারগাঁওয়ের পানাম এলাকাটি বেছে নেন। এরা পানামের মূল সড়কের দুইপাশে সারিবদ্ধভাবে অনেক ঘরবাড়ি নির্মাণ করেন। পানাম নগরে এখনও এ রকম ৫২টি ইমারত টিকে আছে। চওড়া পথের দুই পাশে ইমারতগুলো সুন্দরভাবে সাজানো। পথের উত্তর পাশে ৩১টি এবং দক্ষিণ পাশে রয়েছে ২১টি ইমারত। এর মধ্যে কয়েকটি বর্তমানে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত । এলাকার নিরাপত্তার জন্য পানামের অধিবাসীরা ইমারতগুলোর চারপাশ ঘিরে পরিখা খনন করেছিল। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এই ভবনগুলোতে ইউরোপীয় স্থাপত্য রীতি অনুসরণ করা হয়। তবে এদের নির্মাণকলায় মোগল স্থাপত্যেরও প্রভাব আছে। অনেক অট্টালিকা সাজানো হয়েছিল রঙিন মোজাইকে।

পানামের আশেপাশে আরও কয়েকটি চমৎকার ইমারত এখনও টিকে আছে। এগুলো তৈরি করেছিলেন স্থানীয় জমিদার ও ব্যবসায়ীরা । এগুলোর মধ্যে সরদারবাড়ি, আনন্দমোহন পোদ্দারের বাড়ি ও হাসিময় সেনের বাড়ি উল্লেখযোগ্য।

সরদারবাড়ি বা বড় সরদারবাড়িতে এখন স্থাপিত হয়েছে লোকশিল্প জাদুঘর। এ বাড়ির নির্মাণকাল ১৯০১ সাল। এটি তৈরি হয়েছে দুইটি বড় প্রাসাদকে নিয়ে। একটি করিডোর বা লম্বা বারান্দা দিয়ে প্রাসাদ দুইটি একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। দোতলা এই বাড়িতে রয়েছে ৭০টি কক্ষ। রঙিন মোজাইকের নানা কারুকাজে শোভিত হয়েছে সরদারবাড়ি।

সোনারগাঁওয়ের বাইরেও বাংলাদেশের নানা জায়গায় জমিদারদের তৈরি কিছু অনুপম সুন্দর প্রাসাদ ও স্থাপত্য নিদর্শন রয়েছে। যার মধ্যে ময়মনসিংহের শশীলজ একটি। মুক্তাগাছার জমিদাররা এটি তৈরি করেছিলেন। মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ায় বালিয়াটির জমিদারবাড়িও সেরকম আরেকটি চমৎকার স্থাপত্যকর্মের নিদর্শন। রংপুরের তাজহাট জমিদার বাড়িও বেশ বিখ্যাত। নাটোরের দিঘাপতিয়ার জমিদারের প্রাসাদও তার চমৎকার স্থাপত্যকর্মের জন্য সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এটি এখন উত্তরা গণভবন নামে পরিচিত। তাজহাট ও নাটোরের দুইটি প্রাসাদই বর্তমানে স্থাপত্যকীর্তির নিদর্শন হিসাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে।

কাজ : ঢাকার বাইরের কয়েকটি স্থাপত্যকীর্তি উল্লেখ করো।

Content added By

আধুনিক যোগাযোগ মাধ্যম পৃথিবীর একদেশ থেকে অন্যদেশের দূরত্ব কমিয়ে এনেছে। তাই বিভিন্ন দেশের সমাজ ও সংস্কৃতি আমাদের জীবনের উপর প্রভাব ফেলছে। আর এটাই হচ্ছে বিশ্বায়ন। বিশ্বায়নের ফলে সারা বিশ্ব এখন বিশ্বপল্লিতে রূপান্তরিত হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং তথ্য প্রযুক্তির প্রসারে মানুষ এখন নিজ সমাজ ও সংস্কৃতির মাঝে সীমাবদ্ধ নেই। মানুষ এখন বিশ্ব নাগরিক। কর্ম, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য পৃথিবীর একদেশ থেকে অন্যদেশে ছুটে বেড়ায় এবং তথ্য সংগ্রহ করে। তাই তাকে বিশ্ব সমাজ সম্পর্কে জানতে হয়। একই কারণে মানুষকে তার নিজ সমাজ ও সংস্কৃতির পাশাপাশি অন্য সমাজ ও সংস্কৃতির সাথেও খাপ খাইয়ে চলতে হয় । বিশ্বায়ন ও সামাজিকীকরণ তাই পাশাপাশি চলে।

শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের প্রভাব অনেক। বিশেষ করে বৈশ্বিক সামাজিকীকরণের ফলে আমরা এখন বিশ্ব সমাজের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিচ্ছি। আমরা বিশ্বের বহু দেশের সমাজ ও সংস্কৃতির সাথে পারস্পরিক ভাব-বিনিময় করছি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে একে অন্যের সহযোগিতা পাচ্ছি। আন্তর্জাতিক ভাষা হিসাবে স্বীকৃত ইংরেজি ভাষা জানা থাকলে এখন ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে বিশ্বের সকলের কাছাকাছি যাওয়া যায়। গণমাধ্যম ও তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নে স্যাটেলাইট যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষ আজ ঘরে বসেই পৃথিবীর নানা অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারছে। প্রত্যেকে নিজেকে একজন বিশ্ব নাগরিক হিসাবে গড়ে তুলে নিজের ও সমাজের উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হচ্ছে। তাই ব্যক্তির সামাজিকীকরণে বিশ্বায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছে। যা মানুষের জীবনকে পাল্টে দিচ্ছে।

কাজ : সামাজিকীকরণে বিশ্বায়নের প্রভাব বর্ণনা করো।

Content added By

ব্যক্তির সুষ্ঠু বিকাশের জন্য সামাজিকীকরণ প্রয়োজন। জন্মের পর থেকেই মানব শিশু সমাজের নিয়ম- কানুন ও রীতিনীতি শিখতে থাকে। একেই বলা যায় তার সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া। এই অধ্যায়ে আমরা সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে কয়েকটি সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা সম্পর্কে জানব।

পরিবার : সামাজিকীকরণের প্রথম ও প্রধান বাহন পরিবার। পরিবারে বসবাস করতে গিয়ে শিশু পরিবারের সদস্যদের প্রতি আবেগ, অনুভূতি, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জাগিয়ে তোলে। খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, ধর্মচর্চা, শিক্ষা গ্রহণ ইত্যাদি বিষয়গুলো সম্পর্কে পারিবারিক সংস্কৃতির প্রতিফলন সরাসরি ব্যক্তির উপর পড়ে। এজন্যেই বলা হয় সামাজিকীকরণের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী বাহন হচ্ছে পরিবার ।

স্থানীয় সমাজ : মা-বাবা বা পরিবারের পর স্থানীয় সমাজই শিশুর সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চারপাশের মানুষের আচার-আচরণ ও রীতিনীতি দেখতে দেখতে শিশু বেড়ে উঠে। এভাবে সে সহজেই সমাজের রীতিনীতি শিখে যায়। স্থানীয় মানুষের ভাষা, আচার-আচরণ ও মূল্যবোধ তার আচরণে প্রভাব ফেলে।

স্থানীয় সমাজের বিভিন্ন উপাদান : স্থানীয় সমাজের বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে রয়েছে সাহিত্য, সমিতি, সাংস্কৃতিক সংঘ, খেলাধুলার ক্লাব, সংগীত শিক্ষা কেন্দ্র, বিজ্ঞান ক্লাব প্রভৃতি। স্থানীয়ভাবে গড়ে উঠা এসব সংগঠন ব্যক্তির চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি ও আচার-আচরণের উপর গভীর প্রভাব ফেলে। ব্যক্তি এসব সংগঠনের সঙ্গে নিজেকে জড়ায়। সংগঠনভুক্ত অন্যদের সঙ্গে মিশে তার বুদ্ধিবৃত্তি, সুকুমার বৃত্তি ও সৌন্দর্যবোধ জেগে উঠে। এই বোধ তাকে সহনশীল হতে শেখায়। এভাবেই ব্যক্তি স্থানীয় সমাজের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়ায় এবং তাদের অংশ হয়ে উঠে।

সমবয়সী সঙ্গী : শিশুর সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে সমবয়সী বন্ধু বা সঙ্গীরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শৈশবে সমবয়সীদের সঙ্গে খেলাধুলার আকর্ষণ থাকে অপ্রতিরোধ্য। এভাবে খেলার সাথিরা একে অপরের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখে। কথাবার্তা, আচার-আচরণ ও চালচলনের ক্ষেত্রে তারা একে অন্যকে প্রভাবিত করে। এর মধ্য দিয়ে তাদের মধ্যে সহমর্মিতা, সহযোগিতা, সহনশীলতা ও নেতৃত্বের গুণাবলি বিকশিত হয়।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা পরস্পরের সাথে মিলিত হওয়ার পর্যাপ্ত সুযোগ পায়। এর মাধ্যমে একে অপরকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা, দেশপ্রেম ও নেতৃত্ব দেওয়ার মতো গুণাবলি অর্জন করতে পারে। এভাবেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সামাজিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ।

রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান : রাজনৈতিক দল, নেতৃত্ব এবং আন্দোলন-সংগ্রামও ব্যক্তির সামাজিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মানুষকে সচেতন ও সংগঠিত করার মাধ্যমে নাগরিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে উদ্বুদ্ধ করে।

কাজ : সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা উল্লেখ করো।  

Content added By

কাঙ্ক্ষিত ও সুস্থ জীবনের জন্য প্রত্যেক ব্যক্তিকে সমাজের কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি, আদর্শ, অভ্যাস আয়ত্ত করতে হয়। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যক্তি এগুলো আয়ত্ত করে। এগুলো আয়ত্ত করার পিছনে অনেক উপাদান কাজ করে। এই উপাদানগুলো হলো: অনুকরণ, অভিভাবন, অঙ্গীভূতকরণ ও ভাষা ।

অনুকরণ : যখন একজন অপরজনের কাজ ও আচার-আচরণ হুবহু নকল করে তখন তাকে অনুকরণ বলে। শিশুরা সবসময়ই বড়দের অনুকরণ করে। অনুকরণের মাধ্যমে শিশু ভাষা, উচ্চারণ ও বাচনভঙ্গি ইত্যাদি আয়ত্ত করে থাকে। বড়রাও অনেক সময় অন্যকে অনুকরণের মাধ্যমে নতুন বা অচেনা পরিবেশের উপযোগী করে নিজেকে খাপ খাওয়ায়।

অভিভাবন : অভিভাবন এক ধরনের যোগাযোগ মাধ্যম বা প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রস্তাব বা তথ্যাদি অপরের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। শিশুদের মধ্যে যুক্তি বা জ্ঞানের পরিপক্কতা থাকে না, তাই তারা সহজে অভিভাবিত হয়ে যায়। অভিভাবন প্রক্রিয়ার প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয় সমাজজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। যেমন- শিক্ষা, রাজনীতি, শিল্প, বাণিজ্য ইত্যাদি। অভিভাবন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চেষ্টা করা হয় নিজের ধ্যান-ধারণাকে অপরের মধ্যে প্রবিষ্ঠ করানোর এবং অন্যের আচার-আচরণ ও কাজ কর্মকে নিজের অভিপ্রায় অনুসারে পরিচালিত করার। সাম্প্রতিককালে সমাজব্যবস্থায় প্রচার কার্য ও বিজ্ঞাপনের ব্যাপক উদ্যোগ অভিভাবনের মনস্তাত্ত্বিক নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত।

অঙ্গীভূতকরণ : শিশু শৈশবে সচেতনভাবে বা সজ্ঞানে কিছুই করে না। শৈশব অবস্থায় সে সব কিছু এলোমেলোভাবে করে। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে কোন জিনিস তার প্রয়োজন তা সে বুঝতে পারে এবং এই জিনিসগুলো তার অঙ্গীভূতকরণের বিষয়ে পরিণত হয়। এইভাবে শিশু অঙ্গীভুত করে নেয় বিভিন্ন খেলনা, ছবি ও ছড়ার বই প্রভৃতি যা তার বিনোদনে কাজে লাগে। এছাড়া মা-বাবা ও অন্যদের যারা তার ভালোমন্দের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে তাদেরকেও অঙ্গীভূত করে নেয় । শিশুরা তার পছন্দমতো নিজেকে সাজাতে ভালোবাসে । যেমন নিজেকে স্পাইডারম্যান সাজিয়ে সবাইকে চমকে দিতে পছন্দ করে। এটি শিশুর এক ধরনের বিনোদন। অঙ্গীভূতকরণের এই প্রক্রিয়া ও প্রবণতার পরিধি ক্রমশ প্রসারিত হতে থাকে এবং সমাজবদ্ধ মানুষ সামাজিক প্ৰকৃতি অর্জন করে ।

ভাষা : মানুষের যোগাযোগের অন্যতম প্রধান মাধ্যম ভাষা। সমাজ ও সংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয় ভাষার মাধ্যমে সঞ্চারিত হয়। ভাষার মাধ্যমে ব্যক্তি তার মনের ভাব প্রকাশ করে। তাছাড়া একে অন্যকে জানা কিংবা নিজের দেশ ও সমাজ এবং বহির্জগত সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন, শিক্ষা গ্রহণ সবই চলে ভাষার মাধ্যমে । বস্তুত ভাষা শৈশব থেকে ব্যক্তিত্বকে প্রভাবিত করে।

কাজ : সামাজিকীকরণে ভাষার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করো।

Content added By

বাংলাদেশের পুরাকীর্তিগুলো থেকে পাওয়া অনেক প্রত্ননিদর্শন জাদুঘরে সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করা হয়। এসব প্রত্নসম্পদ দেখে দেশের পুরনো ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। ঢাকায় রয়েছে আমাদের জাতীয় জাদুঘর। এছাড়া নানা প্রত্নস্থলের জাদুঘরেও রয়েছে প্রচুর প্রত্নসম্পদ। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের গ্যালারিতে সারা দেশে প্রত্ননিদর্শনের সঙ্গে প্রদর্শন করা হয়েছে বাংলার নবাব, জমিদার ও ইংরেজ শাসনকালের বেশ কিছু প্রত্নসম্পদ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে দিনাজপুরের মহারাজার ব্যবহার করা দ্রব্য ও হাতির দাঁতের কারুকাজ করা শিল্পদ্রব্য। বলধার জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর সংগ্রহ থেকে আনা পোশাক, হাতির দাঁতের নানা কারুকাজ করা দ্রব্য ও ঢাল-তলোয়ার। এছাড়া এখানে রাখা হয়েছে নাটোরের দিঘাপতিয়ার জমিদারদের ব্যবহার করা দ্রব্য, পোশাক, ঢাল-তলোয়ার ও সিংহাসন এবং ঢাকার নওয়াবদের ব্যবহার করা কারুকার্যখচিত পোশাক ও জিনিসপত্র ।

কোনো কোনো আঞ্চলিক জাদুঘর ও সংগ্রহশালায় নানা প্রত্ননিদর্শন প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে। অধিকাংশ সংগ্রহশালাই জমিদারদের পুরনো প্রাসাদে অবস্থিত। জমিদারদের ব্যবহার করা নানা দ্ৰব্য এবং তাদের সংগ্রহ করা নানা প্রত্নসম্পদ সেখানে প্রদর্শন করা হয়।

বর্তমানে ঢাকার আহসান মঞ্জিল একটি জাদুঘর। আহসান মঞ্জিল জাদুঘরে ঢাকার নওয়াবদের পোশাক, খাট-পালঙ্ক, চেয়ার, সোফা, অলঙ্কার ও আলোকচিত্র স্থান পেয়েছে। ময়মনসিংহ শহরে জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৬৯ সালে। বৃহত্তর ময়মনসিংহের জমিদারদের ব্যবহার করা জিনিসপত্রই এখানে স্থান পেয়েছে বেশি।

মুক্তাগাছার জমিদারদের প্রত্নসম্পদ ময়মনসিংহ জাদুঘরে সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করা হয়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পাথরের ফুলদানি, কম্পাস, ঘড়ি, অলঙ্কার, মৃৎপাত্র, কাপড়বোনার যন্ত্র, লোহার সিন্দুক, খেলার সরঞ্জাম, সরস্বতী ও বিষ্ণুমূর্তি, বাঘ, ড্রাগন, বন্য ষাঁড় ও হরিণের মাথা, সোফাসেট ও ইটালিতে তৈরি মূর্তি ইত্যাদি।

বর্তমানে রংপুরের তাজহাট জমিদারদের প্রাসাদও একটি জাদুঘর। এখানে উত্তরবঙ্গের প্রত্ননিদর্শনের সঙ্গে তাজহাট জমিদারদের ব্যবহার করা দ্রব্যসামগ্রী, সংস্কৃত ও আরবি ভাষায় লেখা পাণ্ডুলিপি স্থান পেয়েছে।

কুষ্টিয়ার শিলাইদহে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়িতে স্থান পেয়েছে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিজড়ানো নানা নিদর্শন এবং আলোকচিত্র।

কাজ : বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত প্রত্ননিদর্শনগুলোর তালিকা তৈরি করো।

Content added By