একাদশ- দ্বাদশ শ্রেণি - বাংলা - সাহিত্যপাঠ | NCTB BOOK

একটি আংটির মতো তোমাকে পরেছি স্বদেশ

আমার কনিষ্ঠ আঙুলে, কখনও উদ্ধত তলোয়ারের মতো

 দীপ্তিমান ঘাসের বিস্তারে, দেখেছি তোমার ডোর কাটা

 জ্বলজ্বলে রূপ জ্যোৎস্নায় । তারপর তোমার উন্মুক্ত প্রান্তরে

 কাতারে কাতারে কত অচেনা শিবির, কুচকাওয়াজের ধ্বনি,

 যার আড়ালে তুমি অবিচল, অটুট, চিরকাল । 

যদিও বধ্যভূমি হলো সারাদেশ— রক্তপাতে আর্তনাদে 

হঠাৎ হত্যায় ভরে গেল বাংলার বিস্তীর্ণ প্রান্তর, 

অথচ সেই প্রান্তরেই একদা ধাবমান জেব্রার মতো

 জীবনানন্দের নরম শরীর ছুঁয়ে ঊর্ধ্বশ্বাস বাতাস বয়েছে । 

এখন সেই বাতাসে শুধু ঝলসে যাওয়া স্বজনের

 রক্তমাংসের ঘ্রাণ এবং ঘরে ফিরবার ব্যাকুল প্ররোচনা । 

শৃঙ্খলিত বিদেশির পতাকার নিচে এতকাল ছিল যারা

 জড়োসড়ো, মগজের কুণ্ডলীকৃত মেঘে পিস্তলের প্রোজ্জ্বল আদল

শীতরাতে এনেছিল ধমনীতে অন্য এক আকাঙ্ক্ষার তাপ

 আবাল্য তোমার যে নিসর্গ ছিল নিদারুণ নির্বিকার, 

সুরক্ষিত দুর্গের মতন আমাদের প্রতিরোধে সে হলো সহায়,

 ব্ল্যাক-আউট অমান্য করে তুমি দিগন্তে জ্বেলে দিলে

 বিদ্রোহী পূর্ণিমা । আমি সেই পূর্ণিমার আলোয় দেখেছি;

আমরা সবাই ফিরছি আবার নিজস্ব উঠোন পার হয়ে

নিজেদের ঘরে ।

Content added By

শহীদ কাদরী ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ই আগস্ট ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পিতার নাম খালেদ-ইবনে-আহমদ কাদরী । শহীদ কাদরী গত শতকের ষাটের দশকের অন্যতম প্রধান কবি। তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাস-জীবন যাপন করছেন । সেখানে তিনি একটি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন ।

সুগভীর মননের অধিকারী শহীদ কাদরীর মূল প্রবণতা বৈশ্বিক বোধকে বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনার আশ্রয়ে কবিতায় প্রকাশযোগ্য করে তোলা। বিশেষ করে ষাটের দশকের প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে র্বৈাপার্জিত বোধকে প্রকাশ করার উপায় হিসেবে তিনি রূপক-প্রতীকের আড়ালকে সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছিলেন । প্রকরণগত স্বাতন্ত্র্য শহীদ কাদরীর কবিতার বিশিষ্ট লক্ষণ। কবিতায় বিশেষ কৃতিত্বের জন্য তিনি ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন । তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে : 'উত্তরাধিকার' (১৯৬৭), 'তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা' (১৯৭৪), 'কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই' (১৯৭৮) প্রভৃতি ।

Content added By
তিনি বিহারের জোড়াসাঁকোতে ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে ৭ মে জন্মগ্রহণ করেন
শান্তিনিকেতন, বিশ্বভারতী ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন তাঁর অবদান
রবীন্দ্রনাথ বাংলা ২২শে শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দে মৃত্যুবরণ করেন
মানসী, সভ্যতার সংকট, বিষবৃক্ষ রবীন্দ্রনাথের উল্লেখ্যোগ্য রচনা
২২ শ্রাবণ, ১৩৪১
২২ শ্রা্বণ, ১৩৪৮
২২ শ্রাবণ, ১৩৬১
২২ শ্রাবণ, ১৩৩৯

ব্ল্যাক-আউট - নিষ্প্রদীপ। আলো বাইরে আনতে না দেওয়া। সাধারণত যুদ্ধ কিংবা জরুরি অবস্থায় কোনো নির্দিষ্ট এলাকা অন্ধকারে ঢেকে দেওয়ার কৌশল ।

উদ্ধত তলোয়ারের মতো দীপ্তিমান ঘাসের বিস্তার- স্বদেশের প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ যে ঘাস, কবি তার ভিতরেও প্রতিবাদের আলো, প্রতিরোধের সাহসকে অনুভব করেছেন ।

কাতারে কাতারে কত অচেনা শিবির, কুচকাওয়াজের ধ্বনি - শত্রুর আক্রমণ ও তাদের অস্ত্রের মহড়া। শত্রু কবলিত দেশের পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে ।

জীবনানন্দের নরম

শরীর ছুঁয়ে ঊর্ধ্বশ্বাস

বাতাস বয়েছে - জীবনানন্দ দাশের কবিতায় এদেশের মানুষ ও প্রকৃতির কোমলতার প্রসঙ্গ এসেছে বারবার। সেই কাব্যপ্রেরণা শহীদ কাদরীর চেতনায়ও গভীরভাবে ব্যাপ্ত। তাই তিনি জীবনানন্দের চোখ দিয়ে দেখা সৌন্দর্য-সমৃদ্ধ আবহমান রূপসী বাংলার স্মৃতিচারণ করেছেন এই কবিতায় ।

মগজের কুণ্ডলীকৃত

মেঘে পিস্তলের প্রোজ্জ্বল আদল  - কবি মানব-মস্তিষ্কের গঠনকে কুণ্ডলী পাকানো মেঘের সঙ্গে তুলনা করেছেন। একই সঙ্গে এই মেঘ বিপদ ও শঙ্কার চিহ্ন বহন করে । এই বিপদ থেকে মুক্ত হতে প্রয়োজন প্রতিরোধ – সশস্ত্র লড়াই। এই লড়াই চালিয়ে যেতে যত না শারীরিক শক্তির প্রয়োজন, তার চেয়ে অনেক বেশি দরকার মানসিক শক্তির। তাই কবির কল্পনায় মস্তিষ্ক নিজেই হয়ে ওঠে। অস্ত্র, পরিগ্রহ করে পিস্তলের আকার। এই বোধ ও চৈতন্যের অস্ত্রকে সঙ্গী করেই এদেশের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে ।

পূর্ণিমা - যে তিথিতে চাঁদের ষোলকলা পূর্ণ হয় । পূর্ণিমার চাঁদের আলো বোঝাতে ।

উঠোন -  আঙিনা। কবিতায় 'নিজস্ব উঠোন' বলতে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে নিজের করে পাওয়া স্বদেশকে বোঝানো হয়েছে ।

Content added By

কবিতাটি শহীদ কাদরীর ‘নির্বাচিত কবিতা' গ্রন্থ থেকে সংকলন করা হয়েছে । একাত্তরের যুদ্ধ-বাস্তবতাকে কবি তাঁর নিজস্ব উপলব্ধির ব্যতিক্রমী দ্যোতনায় উপস্থাপন করেছেন এই কবিতায়। আক্রান্ত স্বদেশ নিজেই এই কবিতায় এক সাহসী যোদ্ধা । সে প্রাকৃতিক কৌশলে তার সহযোদ্ধাদের যুদ্ধে জয়ী হতে সাহায্য করে; শত্রুর বিরুদ্ধে গড়ে তোলে অলঙ্ঘ্যনীয় প্রতিরোধ। কবি এই সহযোদ্ধাদেরই একজন। তাই তিনি স্বদেশকে একটি আংটির মতো করে আপন কনিষ্ঠ আঙুলে ধারণ করেন; স্বদেশের সঙ্গে গড়ে তোলেন নিবিড় এক সম্পর্ক । কবিতায় উল্লেখিত “কনি” আঙুল বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ । প্রাচীন গ্রিসে হাতের পাঁচ আঙুল দিয়ে পাঁচ দেবতাকে বোঝানো হতো; যেমন : তর্জনী দিয়ে বোঝানো হতো দেবরাজ জিউসকে, বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে বোঝানো হতো সমুদ্র দেবতা পসিডনকে । ঠিক একইভাবে গ্রিক যুদ্ধ দেবতা এরিসকে প্রতীকায়িত করে এই “কনি” আঙুল; যা কেবল লড়াই নয়, একই সঙ্গে নিরাপত্তা প্রদানেরও প্রতীক। আর এই ব্যঞ্জনাকেই কবি আলোচ্য কবিতায় ব্যবহার করেছেন । স্বদেশকে কবি এখানে আংটির সঙ্গে তুলনা করেছেন আর 'কনি আঙুল' দ্বারা প্রতীকায়িত এরিসের মতোই অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে দেশ-মাতৃকার নিরাপত্তা প্রদানের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন । একই সঙ্গে, এই 'আংটি' শব্দবন্ধ দ্বারা উপমিত স্বদেশ হচ্ছে কবির অভিজ্ঞান তথা পরিচয়-চিহ্ন। কেননা, স্বদেশকে দিয়েই তো বিশ্বে আমাদের পরিচয় চিহ্নিত হয়। মাতৃভূমিকে নিয়ে কবির এই বহুমাত্রিক অনুভব ক্রমান্বয়ে সম্প্রসারিত হয়েছে। যাকে তিনি তুলনা করেছেন আংটির সঙ্গে, পরে তাকেই আবার তুলনা করছেন জেব্রার সঙ্গে। প্রাণিজগতে জেব্রা শারীরিক গঠনে ও স্বভাবে অত্যন্ত স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত; সৌন্দর্য, সততা আর স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে পরিচিত। এদের দেহের সাদা-কালো ডোরাকাটা বৈপরীত্যের সম্মিলনকে নির্দেশ করে; ঠিক যেমন এদেশেও নানা ধর্ম-বর্ণের মানুষ অনায়াসে পরস্পরের সঙ্গে মিলে যেতে পারে। একই সঙ্গে জেব্রা অত্যন্ত সামাজিক এবং একের বিপদে অন্যের এগিয়ে আসার প্রবণতার কারণে এরা বিশেষভাবে খ্যাত । বাংলা ভূখণ্ডেও এই সামাজিক সম্প্রীতি দূরাতীত কাল থেকেই সুলভ। তাই কবি অত্যন্ত সচেতনভাবে স্বদেশের সঙ্গে মিলিয়ে নেন জেব্রার ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্বময়তাকে ।

এদেশে সামরিক আগ্রাসন, পাকিস্তানি শোষকদের নির্মম অত্যাচার, লাখো মানুষের হত্যা, নির্যাতন – এত সবকিছুর পরেও কবির মহিমান্বিত স্বদেশ অটল অচঞ্চল হয়ে জেগে থাকে। লাখো মৃত্যুর বেদনা এদেশের মানুষকে দমিয়ে ফেলতে পারেনি। পরাধীনতার শিকলে যারা বাঁধা পড়েছিল দীর্ঘদিন, তারাই মুক্তির বোধে উজ্জীবিত হয়েছে; মগজের অস্ত্রের প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে হাতে তুলে নিয়েছে যুদ্ধজয়ের আয়ুধ। মুক্তিসংগ্রামের এই পথে কবির কল্পনায় বাংলার নিসর্গও আবির্ভূত হয়েছে একজন সপ্রাণ মুক্তিযোদ্ধার বেশে ।

মুক্তিযুদ্ধের এই অমর অভিব্যক্তি কেবল কবিতাটির বক্তব্যে নয়, এর আঙ্গিক সৌকর্যেও গভীরভাবে পরিলক্ষিত হয় । তাই 'কনি আঙুল', 'জেব্রা', 'জীবনানন্দের কোমল শরীর', 'বিদ্রোহী পূর্ণিমা' প্রভৃতি শব্দবন্ধের আশ্রয়ে কবি প্রতীকের মালা গাঁথেন । আবার এরই সঙ্গে তিনি নান্দনিক চিত্রকল্পের ঋজু সমাহারকে সমন্বিত করেন। তাই `বাতাসে শুধু ঝলসে যাওয়া স্বজনের রক্তমাংসের ঘ্রাণ', 'মগজের কুণ্ডলীকৃত মেঘে পিস্তলের প্রোজ্জ্বল আদল', “আমরা সবাই ফিরছি আবার নিজস্ব উঠান পার হ'য়ে নিজেদের ঘরে'- এসব পঙ্ক্তি পাঠক হৃদয়ে ইন্দ্ৰিয়াতীত বোধকে উদ্দীপিত করে । এর মধ্য দিয়ে কবিতাটি হয়ে ওঠে বিশেষভাবে নান্দনিকতাঋদ্ধ । কবিতাটি অসমপর্ব বিশিষ্ট এবং অক্ষরবৃত্তের চালে গদ্যছন্দে রচিত।

Content added By