একাদশ- দ্বাদশ শ্রেণি - বাংলা - সাহিত্যপাঠ | NCTB BOOK

কবিতাটি শহীদ কাদরীর ‘নির্বাচিত কবিতা' গ্রন্থ থেকে সংকলন করা হয়েছে । একাত্তরের যুদ্ধ-বাস্তবতাকে কবি তাঁর নিজস্ব উপলব্ধির ব্যতিক্রমী দ্যোতনায় উপস্থাপন করেছেন এই কবিতায়। আক্রান্ত স্বদেশ নিজেই এই কবিতায় এক সাহসী যোদ্ধা । সে প্রাকৃতিক কৌশলে তার সহযোদ্ধাদের যুদ্ধে জয়ী হতে সাহায্য করে; শত্রুর বিরুদ্ধে গড়ে তোলে অলঙ্ঘ্যনীয় প্রতিরোধ। কবি এই সহযোদ্ধাদেরই একজন। তাই তিনি স্বদেশকে একটি আংটির মতো করে আপন কনিষ্ঠ আঙুলে ধারণ করেন; স্বদেশের সঙ্গে গড়ে তোলেন নিবিড় এক সম্পর্ক । কবিতায় উল্লেখিত “কনি” আঙুল বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ । প্রাচীন গ্রিসে হাতের পাঁচ আঙুল দিয়ে পাঁচ দেবতাকে বোঝানো হতো; যেমন : তর্জনী দিয়ে বোঝানো হতো দেবরাজ জিউসকে, বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে বোঝানো হতো সমুদ্র দেবতা পসিডনকে । ঠিক একইভাবে গ্রিক যুদ্ধ দেবতা এরিসকে প্রতীকায়িত করে এই “কনি” আঙুল; যা কেবল লড়াই নয়, একই সঙ্গে নিরাপত্তা প্রদানেরও প্রতীক। আর এই ব্যঞ্জনাকেই কবি আলোচ্য কবিতায় ব্যবহার করেছেন । স্বদেশকে কবি এখানে আংটির সঙ্গে তুলনা করেছেন আর 'কনি আঙুল' দ্বারা প্রতীকায়িত এরিসের মতোই অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে দেশ-মাতৃকার নিরাপত্তা প্রদানের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন । একই সঙ্গে, এই 'আংটি' শব্দবন্ধ দ্বারা উপমিত স্বদেশ হচ্ছে কবির অভিজ্ঞান তথা পরিচয়-চিহ্ন। কেননা, স্বদেশকে দিয়েই তো বিশ্বে আমাদের পরিচয় চিহ্নিত হয়। মাতৃভূমিকে নিয়ে কবির এই বহুমাত্রিক অনুভব ক্রমান্বয়ে সম্প্রসারিত হয়েছে। যাকে তিনি তুলনা করেছেন আংটির সঙ্গে, পরে তাকেই আবার তুলনা করছেন জেব্রার সঙ্গে। প্রাণিজগতে জেব্রা শারীরিক গঠনে ও স্বভাবে অত্যন্ত স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত; সৌন্দর্য, সততা আর স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে পরিচিত। এদের দেহের সাদা-কালো ডোরাকাটা বৈপরীত্যের সম্মিলনকে নির্দেশ করে; ঠিক যেমন এদেশেও নানা ধর্ম-বর্ণের মানুষ অনায়াসে পরস্পরের সঙ্গে মিলে যেতে পারে। একই সঙ্গে জেব্রা অত্যন্ত সামাজিক এবং একের বিপদে অন্যের এগিয়ে আসার প্রবণতার কারণে এরা বিশেষভাবে খ্যাত । বাংলা ভূখণ্ডেও এই সামাজিক সম্প্রীতি দূরাতীত কাল থেকেই সুলভ। তাই কবি অত্যন্ত সচেতনভাবে স্বদেশের সঙ্গে মিলিয়ে নেন জেব্রার ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্বময়তাকে ।

এদেশে সামরিক আগ্রাসন, পাকিস্তানি শোষকদের নির্মম অত্যাচার, লাখো মানুষের হত্যা, নির্যাতন – এত সবকিছুর পরেও কবির মহিমান্বিত স্বদেশ অটল অচঞ্চল হয়ে জেগে থাকে। লাখো মৃত্যুর বেদনা এদেশের মানুষকে দমিয়ে ফেলতে পারেনি। পরাধীনতার শিকলে যারা বাঁধা পড়েছিল দীর্ঘদিন, তারাই মুক্তির বোধে উজ্জীবিত হয়েছে; মগজের অস্ত্রের প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে হাতে তুলে নিয়েছে যুদ্ধজয়ের আয়ুধ। মুক্তিসংগ্রামের এই পথে কবির কল্পনায় বাংলার নিসর্গও আবির্ভূত হয়েছে একজন সপ্রাণ মুক্তিযোদ্ধার বেশে ।

মুক্তিযুদ্ধের এই অমর অভিব্যক্তি কেবল কবিতাটির বক্তব্যে নয়, এর আঙ্গিক সৌকর্যেও গভীরভাবে পরিলক্ষিত হয় । তাই 'কনি আঙুল', 'জেব্রা', 'জীবনানন্দের কোমল শরীর', 'বিদ্রোহী পূর্ণিমা' প্রভৃতি শব্দবন্ধের আশ্রয়ে কবি প্রতীকের মালা গাঁথেন । আবার এরই সঙ্গে তিনি নান্দনিক চিত্রকল্পের ঋজু সমাহারকে সমন্বিত করেন। তাই `বাতাসে শুধু ঝলসে যাওয়া স্বজনের রক্তমাংসের ঘ্রাণ', 'মগজের কুণ্ডলীকৃত মেঘে পিস্তলের প্রোজ্জ্বল আদল', “আমরা সবাই ফিরছি আবার নিজস্ব উঠান পার হ'য়ে নিজেদের ঘরে'- এসব পঙ্ক্তি পাঠক হৃদয়ে ইন্দ্ৰিয়াতীত বোধকে উদ্দীপিত করে । এর মধ্য দিয়ে কবিতাটি হয়ে ওঠে বিশেষভাবে নান্দনিকতাঋদ্ধ । কবিতাটি অসমপর্ব বিশিষ্ট এবং অক্ষরবৃত্তের চালে গদ্যছন্দে রচিত।

Content added By

Promotion