কাঁকরোলের চাষ
কাঁকরোলের জাতঃ বাংলাদেশে সুনির্দিষ্টভাবে কাঁকরোলের কোন জাত নেই। তবে ফলের আকার, বর্ণ এবং কাটার বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভর করে স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন জাতের নামকরণ করা হয়েছে। যেমন- মনিপুরি, আসামি, সবুজ টেম্পু, হলুদ টেম্পু, বর্ণ টেম্পু, মুকন্দপুরি ইত্যাদি।
জমি তৈরি ও সার প্রয়োগ
কাঁকরোল চাষের জন্য ৪/৫টি চাষ ও মই দিয়ে জমি হতে আগাছা বেছে ফেলতে হবে। জমি সমতল করে নেওয়া উচিত। তবে পানি জমার সম্ভাবনা থাকলে জমিকে কয়েকটি খণ্ডে বিভক্ত করে নিতে হয়।
সার প্রয়োগ
কাঁকরোল চাষের জন্য হেক্টর প্রতি সারের পরিমাণ ও প্রয়োগের নিয়ম নিচে দেওয়া হলো।
গোবর ও টি.এস.পি সারের ৫০% শেষ চাষের সময় সমস্ত জমিতে মিশিয়ে দিতে হয়। বাকী ৫০% মাদায় বা নালায় প্রয়োগ করতে হয়। গাছ ২৫-৩০ সে.মি. লম্বা হলে ইউরিয়া ও পটাশ সারের ৫০% মাদার চারিদিকে বা পাশ দিয়ে নালা কেটে সেই নালায় প্রয়োগ করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হয়। বাকী ৫০% সার ফুল আসার সময় একইভাবে প্রয়োগ করতে হয়।
চারা রোপণ ও অন্তবর্তীকালীন পরিচর্যা
বীজ/চারা রোপণ ও মাদা পদ্ধতিতে চাষ করলে ২ × ২.৫ মিটার দূরত্বে প্রতি হেক্টরে ২০০০টি মাদা তৈরি করা যাবে। মাদাপ্রতি ২টি করে মোট ৪০০০ কন্দমূল লাগে। তবে কাণ্ডের কাটিং করা হলে প্রতি মাদায় অন্তত ৩টি করে মোট ৬০০০টি কাটিং লাগানো উচিত। প্রতি হেক্টরে অন্তত ১২৫-১৫০টি পুরুষ মোথা বা কাটিং লাগাতে হবে। কেননা এর পুরুষ ও স্ত্রী ফুল আলাদা আলাদা গাছে জন্মে। পুরুষ মোথা বা কাটিং না লাগালে কাঁকরোলের স্ত্রী ফুলগুলো পরাগায়নের অভাবের ফলে পরিণত হতে পারে না। জমিতে সারি করে বা মাদা তৈরি করে কন্দমূল বা কাটিং রোপণ করতে হয়। মাদা পদ্ধতিতে কাঁকরোল রোপণে ৪০০ সে.মি. চওড়া বেড তৈরি করতে হয়। প্রতি : বেডে ২ সারি মাদা করে এক মাদা হতে অন্য মাদার দূরত্ব ২৫০ সে.মি রাখতে হয়। নালার মাটি বেডে উঠিয়ে দিলে বীজতলা কিছুটা উঁচু হয় তাতে সেঁচ বা বৃষ্টির পানি সহজে বের হতে পারে। এছাড়া সারি করে ১.৭৫-১২৫ মিটার দূরত্বে কন্দমূল বা কাটিং রোপণ করা যায়। কাঁকরোলের একই গাছে পুরুষ ও স্ত্রী ফুল জন্মায় না। তাই পরাগায়নের সুবিধার্থে ক্ষেতে সমানভাবে আনুমানিক ১০ ভাগ পুরুষ গাছ থাকা উচিত। পুরুষ গাছ বাগানের ধার দিয়ে লাগানো যেতে পারে। এতে পরাগায়নের সুবিধা হয়। পুরুষ গাছে দেরিতে ফুল আসে বিধায় এগুলো স্ত্রী গাছ রোপণের ১০-১৫ দিন আগে রোপণ করতে হয়।
কন্দ বা কাটিং রোপণের এক মাসের মধ্যে গাছ গজিয়ে উঠে। মাটি শুষ্ক হলে সেচের সাহায্যে কন্দ বা কাটিং -এর চারিদিকে ভেজা রাখতে হবে
মাচা বা বাউনি কাঁকরোলের জন্য অপরিহায। কাঁকরোলের গাছ ১৬-১৫ সে.মি. লম্বা হলেই গাছের গোড়া একদিকে হেলিয়ে বাঁশের কাঠি পুঁতে দিতে হবে। গাছ ৫০ সে.মি. লম্বা হলে তখন ১-১.৫ মিটার উঁচু করে মাচা দিয়ে তাতে গাছ তুলে দিতে হবে। কাঁকরোলে কৃত্রিম পরাগায়ন ফলন বৃদ্ধির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। কাঁকরোলে ভোরবেলা কৃত্রিম পরাগায়নের উপযুক্ত সময়।
পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন
পোকার নাম | ক্ষতির ধরন | দম ব্যবস্থা |
জাব পোকা | পাতার সবুজ অংশ ও কাণ্ডের রস চুষে খায় | ম্যালথিয়ন ৫৭ ইসি ১১২৫ মি.লি/হেক্টর বা ডাইক্লোরোফস ১০০ ইসি ৫৬ ইসি ১০০ লিটার পানির | সাথে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে |
ইপিল্যাকনা বিটল | পাতার সবুজ অংশ খেয়ে ফেলে। পাতার শিরাগুলো দেখতে জালির মত দেখায়। | পরে পাতা শুকীয়ে যায়। | ম্যালথিয়ন ৫৭ ইসি ১১২৫ মি.লি/হেক্টর বা ডাইক্লোরোফস ১০০ ইতি ৫৬০ ইসি ১০০ লিটার পানির সাথে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। |
বিছা পোকা | পাতার সবুজ অংশ খেয়ে ফেলে। | ম্যালথিয়ন ৫৭ ইসি ১১২৫ মি.লি/হেক্টর ডাইক্লোরোফস | ১০০ ইসি ৫৬০ ইসি ১০০ লিটার পানির সাথে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। |
মাজরা পোকা | কীড়া ছিদ্র করে ফলের ভিতরাংশ খেয়ে ফেলে। আক্রান্ত ফল নষ্ট হয়ে যায়। | ৫০০ মিলি/হেক্টর সাইপারমেথ্রিন বা ডায়জিন ১৭০০ মিলি/হেক্টর বা ডিপেটেরেক্স ৫৬০ মিলি/হেক্টর ১০০০ লিটার পানির সাথে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। |
ফলের মাছি পোকা | কচি ফলের খোসায় পাড়া ডিম হতে কীড়া বের হয়ে ফলের ভিতর প্রবেশ করে শাঁস খেয়ে ফেলে। আক্রান্ত ফল নষ্ট হয়ে যায়। | ফলের মাছি ধরার ফাঁদ ব্যবহার করা যায়। এতে ভিটেরেক্স ৮৫ ডবিউপি ৫ গ্রাম ঔষধ ১০০ গ্রাম পিষানো কুমড়ার সাথে মিশিয়ে বিষ টোপ তৈরি করে ফাঁদে রাখতে হয়। ফলের মাছি পোকা আক্রমণ এভাবে দমন করা যেতে পারে। প্রতি ৪০০ বর্গমিটার জমির জন্য ১টি পাকা কাঁঠালের মোথা (বোথা) দড়ি দিয়ে বেঁধে মাচার নিচে ঝুলিয়ে দিতে হবে। এর ফলে কাঁঠালের গন্ধে মাছি কাঁকরোলের উপর না বসে কাঁঠালের মোথায় বসে ডিম | পাড়বে। এতে কাঁকরোল পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবে। |
রোগবালাই
রোগঃ চারা ঢলে পড়া রোগ ও এ রোগ সাধারণত কচি গাছের গোড়ার আক্রমণ করে এবং আক্রান্ত অংশ পচে চারা ঢলে পড়ে যায়।
প্রতিকার
১) পানি পরে সুব্যবস্থা করতে হবে।
২) আসন গাছ উপড়ে ফেলতে হবে।
৩) রোগমুক্ত মোথা লাগানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
পাউডারী মিলভিউ- পাতার উপরে সাদা পাউডার এ ন্যায় পদার্থ দেখা যায় এবং পাতা মরে যায়। সাদা পাউডার দ্বারা। অনেক সময় পাতা আবৃত হয়ে যায়। এ রোগ দমনের জন্য ২ গ্রাম থিয়োটি প্রতি ১ লিটার পানির সাথে মিশিয়ে ১৫ দিন পর পর পাতা ভিজিয়ে দেখ করতে হবে।
মোজাইক ভাইরাস- এ রোগের আক্রমণে গাছের সবুজ পাতার হলুদ মোজাইক রং ধারণ করে। পাছের বাড়ক কমে যায়, ফল কমে যায় এবং ফলের আকার ছোট হয়।
প্রতিকার
১। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন জাত ব্যবহার করতে হবে।
২। রোগমুক্ত গাছ লাগানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ৩। আক্রান্ত গাছ তুলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
রেটন ফসল/মুড়ি ফসল- শীতের শুরুতেই কাকরোল গাছ মরে যায় এবং পরবর্তী বর্ষা না আসা পর্যন্ত মাটির নিচে এর মোখা নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকে। তাই শীতকালে এ অবস্থার কাঁকরোলের জমিতে স্বল্পমেয়াদি অন্য ফসল করা যায়। পরবর্তী বর্ষার আগেই ঐ মোখাগুলোকে সনি করার জন্য মাটি আগলা করে সার ও সেচ প্রয়োগ করতে হয়। তাহলেই রেটুন ফসল হিসেবে ফল পাওয়া যাবে। সাধারণত রেটুন ফসলের ফুল ও ফল তাড়াতাড়ি হয় । সেচ ও নিকাশ-বন্যামুক্ত উঁচু ও পানি নিকাশের সুবিধাযুক্ত দোঁআশ, বেলে দোআশ মাটি কাঁকরোলের জন্য । মাটিতে রস বেশি থাকলে এর বৃদ্ধি ভালো হয়। তবে দাঁড়ানো পানি কাঁকরোলের জন্য ক্ষতিকর।
ফসল সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ- কাঁকরোল যখন সবুজ থেকে হলদে ভাবাপন্ন হয় তখনই উঠানোর উপযুক্ত হয়। সাধারণত পরাগায়নের ১০-১৪ দিন পরই কাঁকরোল তোলার উপযুক্ত হয়। মাঘের মাঝামাঝি হতে ফাল্গুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত কাঁকরোল গাছের মোথা ১টন/হেঃ হারে তুলে বাজারে বিক্রি করা যায়। তবে মোথা বিক্রির সময় স্ত্রী ও পুরুষ মোথা বা কাটিং উভয়ই আনুপাতিক হারে এক সাথে বিক্রি করা উচিত। চারা গজানোর ২ মাসেই ফল ধরে। ফল উঠিয়ে ২-৩ দিন পর্যন্ত রেখে বিক্রি করা যায় ।
ফলন- প্রতি হেক্টরে ২০-২৫ টন কাঁকরোল পাওয়া যায় ।
ধুন্দলের চাষ
ধুন্দলের জাতঃ
ভারতীয় কৃষি গবেষণা কেন্দ্র হতে ধুন্দলের পুষা চিকনি জাত অনুমোদন করেছে। তবে ধুন্দলের অনুমোদিত ও উন্নত কয়েকটি জাত আছে যা আমাদের দেশে চাষ হচ্ছে। যেমন- মজনুশাহ, ফুজিয়ান, লালনশাহ, গ্রীপিচ, কর্ণফুলী, মিয়ান ইত্যাদি।
জমি তৈরি ও সার প্রয়োগ
এঁটেল বা দোআশ মাটি এবং সুনিষ্কশিত জমিতে ধুন্দল ভালো জন্মে। জলাবদ্ধতা মোটেই সহ্য করতে পারে না। জমি ভালোভাবে চাষ ও মই দিয়ে মাদা তৈরি করতে হয়। জমিতে বেড করে বা ২.০-২.৫ মিটার দূরত্বে মাদায় বীজ রোপণ করতে হয়।
সার প্রয়োগ
ধুন্দল চাষের জন্য নিম্নোক্ত পরিমাণ সার দিতে হয়। গোবর ও টিএসপি সারের ৫০% জমি তৈরির সময় শেষ চাষের আগে প্রয়োগ করতে হয়। বাকী ৫০% মাদায় দিতে হয়। ইউরিয়া ও এমওপি সার চারা গজানোর ২০-২৫ দিন পর, ৫০-৬০ দিন পর এবং ৭৫-৮০ দিন পর ৩ কিস্তিতে উপরি প্রয়োগ হিসেবে দিতে হয়। প্রতিবারই সার উপরি প্রয়োগের সময় গাছের গোড়া হতে কিছু দূর দিয়ে মাটির সাথে মিশায়ে দিতে হয়।
চারা রোপণ ও অন্তবর্তীকালীন পরিচর্যা
ধুন্দলের গাছ দীর্ঘ প্রসারি বিধায় কিছুটা পাতলা করে রোপণ করতে হয়। তবে মাদা হতে মাদার দূরত্ব ২.০-২.৫ মিটার এবং সারিতে মাদা হতে মাদার দূরত্ব ১ মিটার করে বীজ রোপণ করা যায়। ধুন্দল বেড়ায়, গাছে বা বাউনিতে উঠিয়ে দেওয়া যায়। জমিতে সারের উপরি প্রয়োগের সময় আগাছা পরিষ্কার করে মাটি মালচিং করে দিতে হয়। এতে যথেষ্ট রসের প্রয়োজন তাই এভাবে জমিতে রস সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হয়।
সেচ ও নিষ্কাশন
ধুন্দল গাছের গোড়ায় পানি জমলে গাছ মারা যায়। আবার ধুন্দল গাছের বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত রসের প্রয়োজন হয় । জমি চাষের পর বেড আকারে তৈরি করে তাতে মাদা করলে জমিতে পানি দাঁড়ানোর সুযোগ থাকে না
ফসল সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ
বীজ রোপণের দুই মাসের মধ্যে ফল ধরে। ধুন্দল কচি অবস্থায় সংগ্রহ করতে হয় । অন্যথায় আঁশ শক্ত হলে খাবার অনুপযোগী হয়ে যায়। ধুন্দল ধরা শুরু হলে ঠিকমত পরিচর্যা করলে ২-৩ মাসব্যাপি ফল অব্যাহতভাবে সংগ্রহ করা যায়। ফল সংগ্রহ করে ২-৩ দিন পর্যন্ত আর্দ্র, ছায়া ও ঠান্ডা পরিবেশে সংরক্ষণ করা যায়। ধুন্দল বাজারে নেওয়ার সময় চাপ বা আঘাত পেলে সেখানে বিবর্ণ হয়ে যায়। তাই ঝুড়িতে খড় বিছিয়ে বা ছালায় খাড়াভাবে সাজিয়ে সাবধানে বাজারে পাঠাতে হয়।
এক কথায় উত্তর
১. কাঁকরোলের ১টি জাতের নাম লেখ।
২. মাদা পদ্ধতিতে ২ ২.৫ মিটার দূরত্বে কাঁকরোল চাষে ১ হেক্টরে কয়টি মাদা লাগে ?
৩. ধুন্দল চাষে কত মিটার দূরত্বে মাদায় বীজ বপন করা হয় ?
৪. ধুন্দল বীজ রোপণের কত মাসের মধ্যে ফল ধরে ?
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১. কাঁকরোল চাষে সারের পরিমাণ উল্লেখ কর।
২. কাঁকরোল সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ সম্পর্কে লেখ ।
৩. ধুন্দলের চারা রোপণ ও অন্তবর্তী পরিচর্যা সম্পর্কে লেখ ।
রচনামূলক প্রশ্ন
১. কাঁকরোলের জাতসহ বীজ রোপণ ও পোকামাকড় দমন সম্পর্কে বর্ণনা কর ।
২. ধুন্দলের চাষাবাদ পদ্ধতি বর্ণনা কর।
আরও দেখুন...