মিয়োসিস (Meiosis)

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - জীববিজ্ঞান (নতুন সংস্করণ) - কোষ বিভাজন | NCTB BOOK

মিয়োসিস বিভাজনের এক চক্রে নিউক্লিয়াস দুবার বিভাজিত হয়। প্রথমবারে নিউক্লিয়াসের ক্রোমোজোম সংখ্যায় অর্ধেক হয়ে যায়। এই বিভাজনে মাতৃকোষের যে দুটি নিউক্লিয়াস পাওয়া যায়, দ্বিতীয়বারে তার প্রতিটিই আবার দুটি কোষে বিভাজিত হয়। এবার অবশ্য ক্রোমোজোমের সংখ্যা এবং পরিমাণ সমান থাকে। তাই সব মিলিয়ে চূড়ান্ত ফল হলো, মিয়োসিস বিভাজনে একটি মাতৃকোষ থেকে চারটি অপত্য কোষ পাওয়া যায়, যেগুলোর প্রতিটিই মাতৃকোষের অর্ধেকসংখ্যক ক্রোমোজোম ধারণ করে (কাজেই DNA-এর পরিমাণও হয় প্রায় অর্ধেক)। তাই মিয়োসিসের আরেক নাম হ্রাসমূলক বিভাজন।

চিল ১.০৪: মিয়োসিস বিভাজন সম্বন্দ্বে ধারণা

প্রশ্ন হচ্ছে মিয়োসিস কেন হয়? মাইটোসিস কোষ বিভাজনে অপত্য কোষগুলোর ক্রোমোজোম সংখ্যা মাতৃকোষের সমান থাকে। বৃদ্ধি এবং অযৌন জননের জন্য মাইটোসিস কোষ বিভাজন অপরিহার্য। যৌন জননে পুং ও স্ত্রী জনন কোষের মিলনের প্রয়োজন হয়। যদি জনন কোষগুলোর ক্রোমোজোম সংখ্যা দেহকোষের সমান থেকে যায় তা হলে জাইপোট কোষে ক্রোমোজোম সংখ্যা জীবটির দেহকোষের বিপুণ হয়ে যাবে। মনে কর, একটা জীবের দেহকোষে এবং জনন কোষে ক্রোমোজোম সংখ্যা চার (4)। পুং ও স্ত্রী জনন কোষের মিলনের ফলে সৃষ্ট জাইগোটে ক্রোমোজোম সংখ্যা দাঁড়াবে আট (৪) এবং নতুন জীবটির প্রতিটি কোষে ক্রোমোজোম সংখ্যা হবে আট, যা মাতৃজীবের কোষের ক্রোমোজোম সংখ্যার দ্বিগুণ। যদি প্রতিটি জীবের জীবনচক্র এভাবে চলতে থাকে তাহলে প্রতি চক্রে যৌন জননের ফলে ক্রোমোজোম সংখ্যা বারবার দ্বিগুণ হতে থাকবে। আমরা জানি, ক্রোমোজোম জীবের বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী জিন বহন করে। কাজেই ক্রোমোজোম সংখ্যা দ্বিপুণ হতে থাকলে বংশধরদের মধ্যে আমূল পরিবর্তন ঘটে যাবে। যেহেতু পুং ও স্ত্রী জনন কোষে ক্রোমোজোমের সংখ্যা অর্ধেক, তাই জীবের যৌনজননে পুং ও স্ত্রী জনন কোষের মিলন হয়ে জাইগোটে পূর্ণসংখ্যক ক্রোমোজোম পাওয়া যায়। এভাবে জীবের ক্রোমোজোম সংখ্যা বংশপরম্পরায় একই থাকে। জনন কোষ সৃষ্টির সময় এবং নিম্নশ্রেণির উদ্ভিদের জীবনচক্রের কোনো এক সময় যখন এ রকম ঘটে, তখন কোষের অর্ধেক ক্রোমোজোম সংখ্যার সে অবস্থাকে হ্যাপ্লয়েড (n) বলে। যখন দুটি হ্যাপ্লয়েড কোষের মিলন ঘটে, তখন সে অবস্থাকে ডিপ্লয়েড (2n) বলে। অর্থাৎ মিয়োসিস কোষ বিভাজন হয় বলেই প্রতিটি প্রজাতির বৈশিষ্ট্য বংশপরম্পরায় টিকে থাকতে পারে।

চিত্র 3.09: কোষ বিভাজনের মাধ্যমে জাইগোট সৃষ্টি

মিয়োসিস প্রধানত জীবের জনন কোষ বা প্যামেট সৃষ্টির সময় জনন মাতৃকোষে ঘটে। সপুষ্পক উদ্ভিদের পরাগধানী ও ডিম্বকের মধ্যে এবং উন্নত প্রাণিদেহের শুক্রাশয়ে ও ডিম্বাশয়ের মধ্যে মিয়োসিস ঘটে। ছত্রাক, শৈবাল ও মসজাতীয় হ্যাপ্লয়েড উদ্ভিদের ডিপ্লয়েড মাতৃকোষ থেকে যখন হ্যাপ্লয়েড রেণু উৎপন্ন হয়, তখন জাইগোটে এ ধরনের বিভাজন ঘটে।

মিয়োসিস বিভাজনের সময় একটি কোষ পর পর দুবার বিভাজিত হয়। প্রথম বিভাজনকে প্রথম মিয়োটিক বিভাজন বা মিয়োসিস-1 এবং দ্বিতীয় বিভাজনকে দ্বিতীয় মিয়োটিক বিভাজন বা মিয়োসিস-2 বলা হয়। প্রথম বিভাজনের সময় অপত্য কোষে ক্রোমোজোমের সংখ্যা মাতৃকোষের ক্রোমোজোম সংখ্যার অর্ধেকে পরিণত হয়। দ্বিতীয় বিভাজনটি মাইটোসিসের অনুরূপ, অর্থাৎ ক্রোমোজোম সংখ্যার কোনো পরিবর্তন হয় না।

বাস্তবে মাঝে মাঝে হঠাৎ করে ক্রোমোজোমের সংখ্যা বেড়ে গিয়ে নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটতে পারে। যেমন: ব্যাঙ্কের একটি প্রজাতি Xenopus tropicalis-এর সম্পূর্ণ ক্রোমোজোম সেট দ্বিগুণ হয়ে Xenopus laevis প্রজাতির উৎপত্তি ঘটেছে। প্ল্যান্টি রাজ্যের বিভিন্ন সদস্যের (যেমন: আলু) দেহকোষে (জননকোষে নয়) এই প্রক্রিয়া একটি স্বাভাবিক ঘটনা। অনেক সময় আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করার জন্য উদ্ভিদের এই জাত বেছে নিই, এমনকি সেরকম জাত পরিকল্পিতভাবে সৃষ্টি করি, কারণ তা আকারে তুলনামূলকভাবে বড় হয়। এসব জাত খাদ্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে অধিকতর সহায়ক।

চিত্র ১.৪৫ ব্যাঙ প্রজাতি Xenopus tropicalls (নিচে) এবং Xenopus larvis (উপরে)

ক্রোমোজোম বা জেনেটিক বন্ধুর সমতা রক্ষা করা ছাড়াও জীনগত বৈচিত্র্য বজায় রাখা মিয়োসিসের একইরকম গুরুত্বপূর্ণ একটি অবদান। যৌন জনন করে এমন সকল জীবে মিয়োসিসের মাধ্যমে জিনের পুনর্বিন্যাস হয়ে জিনগত বৈচিত্র্য সৃষ্টি হয়ে থাকে। কোনো প্রজাতির টিকে থাকা বা না থাকা মূলত নির্ভর করে তার সদস্য জীবদের মধ্যে কতটা বৈচিত্র্য আছে, তার উপর। পরিবেশ প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। সেইসব প্রজাতি টিকে থাকে, যাদের অন্তত কিছু সদস্যের মধ্যে সেই পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার মতো বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যদি কোনো প্রজাতির জীবদের মধ্যে বৈচিত্র্য কম থাকে তাহলে নতুন কোনো পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর মতো বৈশিষ্ট্য কারোর মধ্যে থাকার সম্ভাবনাও হবে কম। ফলে হয়তো পুরো প্রজাতিটাই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আর যদি কোনো প্রজাতির জীবদের মধ্যে বৈচিত্র্য বেশি থাকে, তাহলে নতুন কোনো পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর মতো বৈশিষ্ট্য কারো না কারো মধ্যে থাকার সম্ভাবনাও হবে বেশি। তখন যদি বড় কোনো বিপদও আসে, তবু তার অন্তত কিছু সদস্য বেঁচে যাবে। তাই মিয়োসিস কোনো জীবের জিনগত বৈচিত্র্য সৃষ্টি করে প্রজাতির টিকে থাকার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়।

জীবের টিকে থাকার ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা দেয় বলেই মিয়োসিস বিভাজন বিবর্তিত হয়ে জীবজগতে নিজের স্থান করে নিয়েছে।

 

 

আরও দেখুন...

Promotion

Promotion