মানুষের দৈনন্দিন কাজকর্মের মধ্য দিয়ে যে আচার-আচরণ ও স্বভাব-চরিত্রের প্রকাশ পায় তাকে আখলাক বলে। আখলাক (7) আরবি শব্দ ‘খুলুকুন” ( 2 ) এর বহুবচন। যার অর্থ চরিত্র বা স্বভাব। মানব জীবনের ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং আন্তর্জাতিক সকল দিকই আখলাকের অন্তর্ভুক্ত।
এ অধ্যায় শেষে আমরা-
■ সদাচরণের ধারণা, ধৈর্য, ভ্রাতৃত্ব, নারীর মর্যাদা, সমাজসেবা, দেশপ্রেম ও পরমতসহিষ্ণুতার গুরুত্ব ও তাৎপর্য ইসলামের দৃষ্টিতে বর্ণনা করতে পারব।
■ অসদাচরণের ধারণা, অহংকার, অশ্লীলতা, পরশ্রীকাতরতা, ঘৃণা, চৌর্যবৃত্তি, ঘুষ, সন্ত্রাস এগুলো পরিহারের গুরুত্ব ও প্রতিকারের উপায় ব্যাখ্যা করতে পারব।
■ এইচআইভি-এর ধারণা ও ইসলামের দৃষ্টিতে এইচআইভি এবং এইডস প্রতিরোধের উপায় বর্ণনা করতে পারব।
আখলাক দুই ভাগে বিভক্ত।
১. আখলাকে হামিদাহ্
মানবজীবনের উত্তম গুণাবলিকে আখলাকে হামিদাহ বা প্রশংসনীয় চরিত্র বলে । যেমন- ধৈর্য, সততা, দেশপ্রেম, সমাজসেবা প্রভৃতি। এ সকল চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তি সমাজে নন্দিত ও সম্মানিত।
২. আখলাকে যামিমাহ্ (25)
মানবজীবনের নিকৃষ্ট চরিত্রকে আখলাকে যামিমাহ বা নিন্দনীয় চরিত্র বলে। যেমন- অহংকার, ঘৃণা, মিথ্যাচার, সুদ, ঘুষ, অশ্লীলতা প্রভৃতি। এ সকল চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তি সমাজে ঘৃণিত ও নিন্দিত।
আখলাকের গুরুত্ব
ইসলামের দৃষ্টিতে আখলাকের গুরুত্ব সর্বাধিক । আখলাকই উন্নত জাতির জীবনীশক্তি। যে জাতির চরিত্র যত ভালো থাকে, সে জাতি তত শক্তিশালী । যে জাতির চরিত্র ঠিক নেই, সে জাতি পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারে না। সকল নবিই নিজ নিজ জাতিকে উত্তম চরিত্রের শিক্ষা দিয়েছেন। আর উন্নত চরিত্রকে পূর্ণতা দানের জন্য শেষ নবি হযরত মুহাম্মদ (স.)-কে আল্লাহ তায়ালা পাঠিয়েছেন। মহানবি (স.) বলেন,
অর্থ : “উত্তম চরিত্রের পরিপূর্ণতা দানের জন্যই আমি প্রেরিত হয়েছি।” (বায়হাকি)
উত্তম চরিত্র ব্যক্তিকে সুন্দর ও উন্নত করে । আর সমাজের সকল মানুষ চরিত্রবান ব্যক্তিকে ভালোবাসে ও শ্রদ্ধা করে। অপরদিকে চরিত্রহীন ব্যক্তি সকলের নিকট ঘৃণিত ও নিন্দিত। যার চরিত্র যত উন্নত ধর্মের দিক থেকেও সে তত অগ্রসর।
নবি করিম (স.) বলেন-
অর্থ : “উত্তম চরিত্রই হলো সকল নেক কাজের মূল কথা।” (মুসলিম)
চরিত্র মানুষের ভূষণ । চরিত্রবলেই মানুষ সর্বত্র সমাদৃত হয় । ভালো চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তি অধিকতর ইমানদার হয় । মহানবি (স.) বলেন –
অর্থ : “চরিত্রের বিচারে যে লোক উত্তম, মুমিনদের মধ্যে সেই পূর্ণতম ইমানের অধিকারী।” (আবু দাউদ ও দারিমি)
কিয়ামতের দিন পরিমাপদণ্ডে উত্তম চরিত্রের ওজন হবে অত্যন্ত ভারী।
নবি করিম (স.) বলেন, “মুমিনের পরিমাপদণ্ডে কিয়ামতের দিন উত্তম চরিত্র অপেক্ষা ভারী জিনিস আর কিছুই নেই ।” (তিরমিযি)
উত্তম চরিত্র মানুষের পাপকে খণ্ডন করে দেয়। নবি করিম (স.) বলেন, “উত্তম চরিত্র পাপকে এমনভাবে বিগলিত করে যেমনভাবে সূর্যতাপ বরফকে বিগলিত করে।” (তাবারানি, বায়হাকি)
উত্তম চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তি আখিরাতে তার উত্তম চরিত্রের বিনিময়ে অত্যধিক মর্যাদা লাভ করবে। মহানবি (স.) বলেন, “বান্দা তার উত্তম চরিত্রের বলে আখিরাতে বিশেষ মর্যাদা ও সম্মানিত স্থানে উন্নীত হবে, যদিও সে ইবাদতের দিক থেকে দুর্বল থাকে।” (তাবারানি)
আমরা উত্তম চরিত্র অর্জন করব। নিন্দনীয় স্বভাব পরিহার করব। আমরা দুনিয়াতে সকলের কাছে প্রিয় হব। পরকালে অশেষ মর্যাদা লাভ করব।
কাজ : শিক্ষার্থীরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে আখলাকে হামিদাহ-এর (সদাচরণের) সুফলগুলোর একটি তালিকা তৈরি করবে। |
ধৈর্য এর আরবি প্রতিশব্দ 'সবর' (সা)। যার অর্থ ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, দৃঢ়তা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, বিরত রাখা ইত্যাদি। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় জীবনের সকল ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর উপর ভরসা করে সহিষ্ণুতার সাথে আল্লাহর বিধান মোতাবেক সকল কর্তব্য পালন করাকে ধৈর্য বলে। কুরআন ও হাদিসের আলোকে ধৈর্য বিশ্লেষণ করলে এর তিনটি বিশেষ দিক স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
১. অবৈধ ও হারাম বস্তু থেকে নিজের নফস বা প্রবৃত্তিকে বিরত রাখতে ধৈর্যধারণ করতে হয়।
২. আল্লাহ তায়ালার ইবাদত ও আনুগত্যে ধৈর্যধারণ করতে হয়।
৩. যেকোনো বিপদ-আপদে ধৈর্যধারণ করতে হয়।
তাৎপর্য
ধৈর্য মানবজীবনের একটি মহৎ গুণ। এটি মানবজীবনের সফলতার চাবিকাঠি। ধৈর্যের অনুশীলন ছাড়া ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনে সাফল্য অর্জন করা যায় না। ধৈর্যধারণ করা খুবই কঠিন কাজ তথাপি সমাজের মানুষের কল্যাণের জন্য তা করা অপরিহার্য। সমাজ জীবনে শান্তি শৃঙ্খলা ও কল্যাণময় জীবনযাপনের জন্য ধৈর্যের (সবরের) গুরুত্ব অপরিসীম। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ ধৈর্যশীলদেরকে অফুরন্ত প্রতিদান দেওয়ার ওয়াদা করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন,
অর্থ : “অবশ্যই ধৈর্যশীলগণকে তাদের প্রতিদান অগণিতভাবে দেওয়া হবে।” (সূরা আয্-যুমার, আয়াত -১০) ধৈর্যের বিপরীত হচ্ছে অধৈর্য। অধৈর্য মানুষকে ব্যর্থতার দিকে ঠেলে দেয়। এ কারণে জীবনে চলার পথে মানুষকে অবশ্যই ধৈর্যশীল হতে হবে।
মানুষের জীবনে আসে সুখ-দুঃখ, বিপদ-আপদ, সফলতা-বিফলতা ও জয়-পরাজয়। এসব ক্ষেত্রে ধৈর্যধারণের প্রয়োজন হয়। বিপদে যেমন সুদিনের আশায় ধৈর্যধারণ করতে হয়, তেমনি সুদিনে আত্মহারা না হয়ে ধৈর্যধারণ করতে হয় । সুখশান্তি প্রাপ্তিতে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করতে হবে, জীবনে যাঁরা বড় হয়েছেন তাঁরা সবাই ছিলেন ধৈর্যশীল। বিখ্যাত নবি হযরত ইবরাহিম (আ.) ছিলেন ধৈর্যের মূর্ত প্রতীক। জালিম শাসক নমরুদের মূর্তি পূজার বিরোধিতা করায় তিনি অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। তিনি আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে সাহায্য চান নি। এমনিভাবে হযরত আইয়ুব (আ.)ও কঠিন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন । তাঁর দেহে পচন ধরেছিল। শরীর থেকে গোশত খসে পড়েছিল। আত্মীয়স্বজন তাঁকে ত্যাগ করেছিল। তাঁর সন্তানাদি মারা গিয়েছিল। তাঁর ঘরবাড়ি সব ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এমন কঠিন মুহূর্তেও তিনি ধৈর্যহারা হন নি। আমাদের নবি হযরত মুহাম্মদ (স.)ও ধৈর্যের চরম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। তাঁর ধৈর্য ছিল অতুলনীয়। তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল তবু ধৈর্য হারান নি। সকল বিপদেই তিনি ছিলেন অটল ও অবিচল।
শরিয়তের বিধান পালন করতেও ধৈর্যের প্রয়োজন হয়। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়, রমযান মাসের সিয়াম পালন, প্রচুর অর্থ ব্যয় করে হজ সম্পাদন, সঞ্চিত সম্পদের চল্লিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত হিসাবে প্রদান ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রচুর ধৈর্যধারণ করতে হয়।
এমনিভাবে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের বিভিন্ন স্তরে ধৈর্যধারণের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা সকল বিপদাপদে ধৈর্যধারণ করব। বিপদ মুক্তির জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করব।
আমরা ধৈর্যশীল হব।
কাজ : শিক্ষার্থীরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে ধৈর্যধারণের সুফলগুলোর একটি তালিকা তৈরি করবে এবং উপস্থাপন করবে। |
পরিচয়
উয়াত শব্দের আভিধানিক অর্থ ভ্রাতৃত্ব। পরস্পরের মধ্যে হৃদ্যতা ও আন্তরিকতার সম্পর্ককে ভ্রাতৃত্ব বলে।
মানুষের মাঝে এ হৃদ্যতা ও আন্তরিকতা বিভিন্নভাবে গড়ে ওঠে।
ভ্রাতৃত্বকে তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে—
১. ঔরসজাত ভ্রাতৃত্ব, ২. বিশ্বভ্রাতৃত্ব এবং ৩. ইসলামি ভ্রাতৃত্ব।
ঔরসজাত ভ্রাতৃত্ব একই পিতার ঔরসে বা একই মায়ের গর্ভে জন্মগ্রহণ করার কারণে যে ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি হয় তাকে ঔরসজাত ভ্রাতৃত্ব বলে।
বিশ্বভ্রাতৃত্ব
পৃথিবীর সকল মানুষের আদি পিতা হযরত আদম (আ.) ও আদি মাতা হযরত হাওয়া (আ.)। এ কারণে বিশ্বের সকল মানুষই ভাই ভাই। ধীরে ধীরে মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। আবহাওয়া এবং ভৌগোলিক পরিবেশের কারণে মানুষের আকার-আকৃতি, স্বভাব-প্রকৃতি এবং বর্ণ ও ভাষার মধ্যে ভিন্নতা দেখা দেয়। আর এভাবে মানুষ বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে । তবু তারা পরস্পর ভাই ভাই। কারণ তারা সবাই এক আদম (আ.) হতে সৃষ্টি । মহান আল্লাহ বলেন,
অর্থ : “হে মানবমণ্ডলী! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী থেকে, পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পারে।” (সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত ১৩)
রাসুল (স.) বলেছেন, “তোমরা প্রতেকেই আদম (আ.) হতে এবং আদম মাটি হতে সৃষ্টি ।” (বুখারি)
এ আয়াত ও হাদিসের পরিপ্রেক্ষিতে সকল মানুষ ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ।
ইসলামি ভ্রাতৃত্ব
আল্লাহর নিকট একমাত্র মনোনীত ধর্ম ইসলাম, ইসলামের মূলবাণী-আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নাই হযরত মুহাম্মদ (স.) আল্লাহর রাসুল। যারা এই কালিমায় বিশ্বাসী তারা যেকোনো বর্ণ, গোত্র, ভাষা ও অঞ্চলের অধিকারী হোক না কেন, তারা ইসলামি ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
অর্থ : “নিশ্চয়ই মুমিনগণ ভাই ভাই ।” (সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত ১০)
হাদিসে রাসুল (স.) বলেন,
অর্থ: “মুসলমান মুসলমানের ভাই ।” (বুখারি ও মুসলিম)
ইসলামি ভ্রাতৃত্বের তাৎপর্য
ইসলামের দৃষ্টিতে সকল মানুষ সমান। ইসলামে উঁচু-নিচু, সাদা-কালো, ধনী-দরিদ্রের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করার পর বিশ্বের সকল মুসলমান পরস্পরের ভাই। একই দীনসূত্রে আবদ্ধ। মহানবি (স.) বলেন, “অনারবগণের উপর যেমন আরবগণের শ্রেষ্ঠত্ব নেই, তেমনি আরবগণের উপরও অনারবগণের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই।” ইসলামি ভ্রাতৃত্ব এতই সুদৃঢ় যে, আল্লাহর রাসুল (স.) পৃথিবীর সকল ইমানদারগণকে একটি দেহের সাথে তুলনা করেছেন । দেহের কোনো একটি অঙ্গে অসুখ হলে যেমন পুরো দেহ অসুস্থ হয়ে পড়ে, তেমনি পৃথিবীর কোনো একপ্রান্তে একজন মুসলিম বিপদে পতিত হলে সকল মুসলমানের অন্তর ব্যথিত হয়। কোনো মুসলমান ভাইকে কষ্ট দেওয়া যাবে না। এমনকি যদি কখনো পরস্পরের মধ্যে কোনো কলহ সৃষ্টি হয় তখন অপর মুসলমান ভাইয়েরা তা মিটিয়ে দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করবে। কোনো মুসলমান নিজের জন্য যা পছন্দ করে, অপর মুসলমান ভাইয়ের জন্যেও তা পছন্দ করবে অন্যথায় সে প্রকৃত মুসলমান হতে পারবে না। প্রিয় নবি (স.) বলেন, “মুমিনগণ পরস্পর মিলে একটি ইমারতস্বরূপ, এর এক অংশ অপর অংশকে মজবুত করে রাখে।” (বুখারি ও মুসলিম)
আমরা পরস্পর ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ থাকব । সুখে-দুঃখে একে অপরের সঙ্গে শরিক থাকব।
কাজ : শিক্ষার্থীরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে ইসলামি ভ্রাতৃত্বের সুফলগুলো লিখে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষককে দেখাবে। |
পরিচয়
ইসলামে নারীকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। পৃথিবীর আদি পুরুষ হযরত আদম (আ.) এবং আদি নারী বিবি হাওয়া (আ.)। আর এ দুইজন থেকে পৃথিবীর সকল নর-নারীর সৃষ্টি। ইসলামে নর ও নারী উভয়ের সমমর্যাদা স্বীকৃত। মাতা, কন্যা, ভগ্নী, স্ত্রী প্রভৃতি হিসেবে সমাজে নারীদের যে বিশেষ অধিকার ও স্থান রয়েছে তা যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত করলে নারীর মর্যাদা সমুন্নত হবে।
ইসলামে নারীর মর্যাদা
ইসলাম একমাত্র ধর্ম যাতে নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো বৈষম্য না করে নারীকে পুরুষের সমমর্যাদা দেওয়া হয়েছে । প্রাচীন আরব সমাজে নারীর অবস্থা ছিল করুণ। সেখানে কন্যাসন্তান জন্ম নিলে পিতা-মাতা অসন্তুষ্ট হতো । কোনো কোনো সম্প্রদায় কন্যাসন্তানকে জীবিত কবর দিত।
কুরআন মজিদে এ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে- “তাদের কাউকেও যখন কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেওয়া হয় তখন তার মুখমণ্ডল কালো হয়ে যায় এবং সে অসহনীয় মনস্তাপে ক্লিষ্ট হয় । তাকে যে সংবাদ দেওয়া হয়, তার গ্লানি হেতু সে নিজ সম্প্রদায় থেকে আত্মগোপন করে। সে চিন্তা করে হীনতা সত্ত্বেও সে তাকে রেখে দেবে, না মাটিতে পুঁতে দেবে । সাবধান! তারা যা সিদ্ধান্ত করে তা কত নিকৃষ্ট ।” (সূরা আন-নাহল, আয়াত ৫৮-৫৯)
মহানবি (স.)-এর আবির্ভাবের পর নারী ফিরে পায় স্বীয় মর্যাদা । ইসলামে বলা হয়েছে-
অর্থ : “মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত।” (নাসায়ি)
নবি করিম (স.)-এর একটি হাদিসে পিতা অপেক্ষা মায়ের অধিকার বেশি বলে উল্লেখ আছে। আল্লাহর সৃষ্টি হিসেবে নারী পুরুষের সমান মর্যাদার অধিকারী। আল্লাহ তায়ালা বলেন-
অর্থ : “নিশ্চয়ই আমি নষ্ট করে দেই না তোমাদের মধ্য থেকে কোনো আমলকারীর আমলকে, সে পুরুষই হোক আর নারীই হোক, তোমরা একে অপরের অংশ ।” (সূরা আলে ইমরান, ১৯৫)
ইসলামে স্বামীর সংসারে স্ত্রীর বিশেষ মর্যাদা স্বীকৃত । আল্লাহ তায়ালা বলেন-
অর্থ : “তারা (স্ত্রীরা) তোমাদের ভূষণ আর তোমরা (স্বামীরা) তাদের ভূষণ ।” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ১৮৭)
মহান আল্লাহ আরও ঘোষণা করেন,
অর্থ : “নারীদের তেমনি ন্যায়সংগত অধিকার আছে যেমন আছে তাদের উপর পুরুষদের।” (সূরা আল- বাকারা, আয়াত ২২৮)
নারীদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকার ব্যাপারে মহানবি (স.) বিদায় হজের ভাষণে বলেন,
অর্থ : “তোমরা নারীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর । কেননা তোমরা আল্লাহর সাথে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে তাদের গ্রহণ করেছ।” (মুসলিম)
সম্পত্তি লাভের বেলায়ও ইসলাম নারীকে পিতা ও স্বামীর উভয়ের সম্পত্তির অধিকারিণী করেছে । প্রয়োজনীয় বিদ্যার্জন এবং অর্থ উপার্জনে ইসলাম নারীদের অনুমতি দান করেছে।
আমাদের দেশে অধিকাংশ পরিবারে দেখা যায় যে, পিতা-মাতার ইনতিকালের পর উত্তরাধিকারসূত্রে যা প্রাপ্য তা নারীদের বঞ্চিত করার চেষ্টা করা হয়। এ ধরনের কাজ কুরআন সুন্নাহর আলোকে হারাম। যারা এরূপ করবে পরকালে তাদের কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে।
আমরা এ পাঠে জানলাম
১। নারীর মর্যাদা।
২। নারীর অধিকার আদায়ের ব্যাপারে মহানবি (স.)-এর তাগিদ।
আমরা নারীসমাজকে যথাযথ মর্যাদা দেব। তাদের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে সচেতন থাকব।
কাজ : শিক্ষার্থীরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে ইসলাম কীভাবে নারীদের মর্যাদা দিয়েছে তার একটি তালিকা তৈরি করবে। |
পরিচয়
সমাজের বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর কল্যাণে স্বেচ্ছায় গৃহীত কাজকে সমাজসেবা বলে । ব্যাপক অর্থে মানবকল্যাণ ও উন্নয়নের জন্য গৃহীত সকল কর্মসূচিই সমাজসেবা নামে পরিচিত ।
তাৎপর্য
সমাজে নানা শ্রেণি ও পেশার লোক বাস করে। তারা সকলে সমান নয়। তাদের সুযোগ-সুবিধাও সমান নয়। কেউ বিপুল সম্পদের অধিকারী আবার কেউ কপর্দকহীন। সম্পদশালী ব্যক্তিগণ অভাবী জনগোষ্ঠীর উন্নয়নেও তাঁদের সম্পদ ব্যয় করবে। সমাজের অবহেলিত মানুষের কল্যাণে প্রতিষ্ঠান গড়বে। এটাই ইসলামের নির্দেশ। মহান আল্লাহ বলেন-
অর্থ : “এবং তাদের (ধনীদের) ধন-সম্পদে রয়েছে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতের হক।” (সূরা আয্-যারিয়াত, আয়াত ১৯)
অর্থশালী ব্যক্তি সমাজের অবহেলিত মানুষের কল্যাণে এমন প্রতিষ্ঠান গড়বে, যে প্রতিষ্ঠানে অভাবী লোকেরা কাজ করে তাদের আর্থিক সমস্যার সুরাহা করবে । বাঁচার অবলম্বন খুঁজে পাবে । গ্রামের উন্নয়নের বিরাট বাধা দূর করার জন্য গ্রামে-গঞ্জে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলাসহ কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সমাজসেবামূলক কাজ।
সমাজকে অশিক্ষা ও নিরক্ষরতার হাত থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে আল্লাহ তায়ালা কুরআন মজিদে বলেন-
অর্থ : “পাঠ করুন আপনার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা আল-আলাক, আয়াত ১) হাদিসে বলা হয়েছে-
অর্থ : “জ্ঞান অন্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরজ ।” (ইবনে মাজাহ ও বায়হাকি)
সরকারি ও বেসরকারি উভয় প্রকার উদ্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হলে সমাজ থেকে নিরক্ষরতা দূর হবে। সমাজ সংশোধনমূলক প্রতিটি কার্যক্রমই সমাজসেবার অন্তর্ভুক্ত। সমাজে কোনো বিশৃঙ্খলা বা গোলযোগ সৃষ্টি হলে তা দূর করতে হবে। কারণ বিশৃঙ্খলা সমাজের পরিবেশকে নষ্ট করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন -
অর্থ : “ফিত্না (বিশৃঙ্খলা) হত্যা অপেক্ষা গুরুতর ।” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ১৯১)
সামাজিক নিরাপত্তা রক্ষা করা, পরস্পরের কলহ ও দ্বন্দ্ব মেটানো সমাজসেবার অন্তর্ভুক্ত । আল্লাহ তায়ালা বলেন-
“মুমিনদের দুই দল দ্বন্দ্বে লিপ্ত হলে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও।” (সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত ৯)
সর্বস্তরের জনগণের উপকারে আসে এমন সব কাজের অভ্যাস ছোটবেলা থেকেই করা দরকার । যেমন- ভাঙা রাস্তা মেরামত করা, নতুন রাস্তা নির্মাণে সাহায্য করা, পুল-সাঁকো নির্মাণ করা, রুগ্ণ ব্যক্তির সেবা করা, আহত ব্যক্তিকে চিকিৎসাকেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়া, রাস্তার পাশে ছায়াদার বৃক্ষ রোপণ করা, বৃক্ষ সংরক্ষণ করা ইত্যাদি।
জনসেবা দ্বারা আল্লাহ তায়ালার সাহায্য লাভ করা যায়। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, “আল্লাহ বান্দাকে ততক্ষণ সাহায্য করেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইকে সাহায্য করতে থাকে ।” (মুসলিম)
আরবিতে একটি প্রবাদ বাক্য আছে—
অর্থ : “জাতির নেতা তিনিই যিনি তাদের সেবক।”
সমাজ সেবা মানবিক দায়িত্ব। আমরা সমাজের সেবা করব। সমাজকে ভালো করে গড়ে তুলব। সর্বস্তরের মানুষের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করব। মানব সেবার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে সমাজসেবা করব।
কাজ : শিক্ষার্থীরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে সমাজসেবামূলক কাজের একটি তালিকা তৈরি করে শ্রেণি শিক্ষককে দেখাবে। |
পরিচয়
জন্মভূমির প্রতি মানুষের অন্তরে একটি স্বাভাবিক আকর্ষণ সৃষ্টি হয় এবং ভালোবাসা জন্মায়। ক্রমান্বয়ে এ আকর্ষণ বা ভালোবাসা বিস্তৃতি লাভ করে সমগ্র দেশ, দেশের মাটি ও দেশের জনগণের প্রতি৷ মাতৃভূমি তথা দেশের প্রতি এ প্রীতি ও দরদের আকর্ষণকেই দেশপ্রেম বলে। দেশপ্রেম মানবজীবনের একটি মহৎ গুণ। দেশপ্রেমের মূলেই আছে দেশের ভূখণ্ডকে ভালোবাসা। দেশের জনগণকে ভালোবাসা, দেশের স্বাধীনতা ও স্বকীয়তা রক্ষা এবং দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রথা, রীতি-নীতি, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান করা কর্তব্য।
গুরুত্ব
দেশপ্রেমের গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলাম দেশপ্রেমের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। মহানবি (স.) তাঁর জন্মভূমি মক্কাকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসতেন, মক্কার অধিবাসীদের ভালোবাসতেন। তাদের হিদায়াতের জন্য তিনি অমানুষিক অত্যাচার সহ্য করেন। কাফিরদের অত্যাচারে সাহাবিগণকে মহানবি (স.) আবিসিনিয়ায় হিজরতের অনুমতি প্রদান করলেও তিনি মক্কায় অবস্থান করেন। পরবর্তীতে কাফিরদের কঠিন ষড়যন্ত্রের কারণে এবং আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে তিনি যখন মদিনায় হিজরত করেন, তখন মক্কার দিকে বার বার ফিরে তাকান, আর কাতর কণ্ঠে বলেন-
“হে আমার স্বদেশ! তুমি কত সুন্দর! আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমার আপন গোত্রীয় লোকেরা যদি ষড়যন্ত্র না করত, আমি কখনো তোমাকে ছেড়ে যেতাম না। ”
সাহাবিগণও স্বদেশ মক্কাকে খুব ভালোবাসতেন। মদিনায় হিজরতের পর হযরত আবু বকর (রা.) এবং হযরত বিলাল (রা.) কঠিন জ্বরে আক্রান্ত হন । তখন তাঁরা মক্কার তৃণলতা, পাহাড়-পর্বত এবং পানির কথা স্মরণ করে কবিতা আবৃত্তি করতে থাকেন। রাসুলুল্লাহ (স.) সাহাবিগণের এ অবস্থা দেখে বলেন,
“হে আল্লাহ! আমরা মক্কাকে যেরূপ ভালোবাসি, তদ্রূপ অথবা তার চেয়েও অধিকভাবে আপনি আমাদের অন্তরে মদিনার প্রতি ভালোবাসা দান করুন।” (বুখারি)
দেশপ্রেম মানুষকে দেশ রক্ষায় উদ্বুদ্ধ করে। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দেশপ্রেমিক নিজের জানমাল উৎসর্গ করতেও কুণ্ঠাবোধ করে না।
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, “দেশরক্ষায় একদিন এক রাতের প্রহরা (রিবাত) ক্রমাগত এক মাসের রোযা এবং সারারাত ইবাদতে কাটিয়ে দেওয়া অপেক্ষাও উত্তম।” (মুসলিম)
বলা হয়-
অর্থ : “দেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ।”
দেশপ্রেম মানুষকে দায়িত্ব সচেতন করে তোলে। দেশের উন্নতিসাধনে সজাগ রাখে। দেশের সম্পদ সংরক্ষণে উদ্বুদ্ধ করে। আমরা আমাদের দেশকে ভালোবাসব, দেশের উন্নতি করব। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করব।
কাজ : শিক্ষার্থীরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে দেশকে কীভাবে ভালোবাসা যায় তা আলোচনা করবে। |
পরিচয়
পরমত বলতে বুঝায় অপরের মত, পথ বা আদর্শ, সেটা ধর্মীয় হতে পারে এবং আদর্শিকও হতে পারে । আবার রাজনৈতিকও হতে পারে। অন্যের মতামতকে অবজ্ঞা না করে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া বা অন্যের মত বা আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাকে পরমতসহিষ্ণুতা বলে। অন্যের ধর্মীয় মতামত বা রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি সহনশীল মনোভাব পোষণ করাকে পরমতসহিষ্ণুতা বলে। পরমতসহিষ্ণুতা মানবচরিত্রের প্রশংসনীয় গুণ। এ গুণটির কারণেই সমাজে শান্তি, শৃঙ্খলা ও সম্প্রীতি বজায় থাকে। এ গুণটির কারণেই মানুষ তার নিজস্ব পরিবেশে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে পারে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সদ্ভাব বজায় থাকে। সৌহার্দ ও সম্প্রীতির সৃষ্টি হয়। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যেও সদ্ভাব বজায় থাকে।
গুরুত্ব
পারিবারিক শান্তি লাভ
একটি সুস্থ ও সুন্দর পারিবারিক জীবনের জন্য পরমতসহিষ্ণুতার গুরুত্ব অপরিসীম। পারিবারিক জীবনের সুখ শান্তি এর উপর নির্ভরশীল। পরিবারের অন্য সদস্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন বা সহানুভূতির মনোভাব পোষণ করার মাধ্যমে পারিবারিক শান্তি লাভ করা যায়।
সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠা
পারিবারিক সুখ-শান্তির মতো সামাজিক সুখ-শান্তি ও পরমতসহিষ্ণুতার উপর নির্ভরশীল। সমাজে বিভিন্ন মতাদর্শের লোক থাকতে পারে, তাদের সাথে সমঝোতা ও সহমর্মিতা প্রদর্শন করতে হবে। তাদের মতের প্রতি সহিষ্ণুতার মনোভাব পোষণ করলে শান্তি বজায় থাকবে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের মতামত ও আদর্শের প্রতি সহনশীলতা প্রদর্শন করতে হবে। তাহলেই সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
রাষ্ট্রীয় শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা
পরমতসহিষ্ণুতার উপর রাষ্ট্রীয় শান্তিশৃঙ্খলা নির্ভরশীল। একটি দেশে নানা ধর্ম, বর্ণ ও মতের লোক বসবাস করে। তাদের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, সমঝোতা ও সহাবস্থানের জন্য পরমতসহিষ্ণুতা অপরিহার্য।
আন্তর্জাতিক স্থীতিশীলতা
পরমতসহিষ্ণুতার কারণেই আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এর অভাবে পারস্পরিক সহাবস্থান কঠিন হয়ে যায়। আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক লাভের প্রধান পূর্বশর্ত পরমতসহিষ্ণুতার আদর্শ। ভিন্ন দেশ ও সমাজের আদর্শ, রীতিনীতি ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান থাকলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থাপন ও পারস্পরিক স্বার্থরক্ষা সম্ভব হয়৷
কাজ : শিক্ষার্থীরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে পরমতসহিষ্ণুতার সুফলগুলোর একটি তালিকা পোস্টারে লিখে শ্রেণিতে উপস্থাপন করবে। |
পরিচয়
যে খারাপ কাজ বা আচরণ মানুষকে হীন ও নিন্দনীয় করে তোলে তাকে আখলাকে যামিমাহ বা নিন্দনীয় চরিত্র বলে। যেমন- অহংকার, ঘুষ, অশ্লীলতা, পরশ্রীকাতরতা, ঘৃণা, চৌর্যবৃত্তি ইত্যাদি।
অপকারিতা
আখলাকে যামিমাহ্ এর কারণে ওইসব ব্যক্তি সমাজ জীবনে নিন্দনীয় হয়। তারা মানুষের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়। তাদের দ্বারা সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয়। অন্যায় ও অসৎ কাজের প্রসার ঘটে। তারা আল্লাহ ও রাসুলের অপ্রিয় হয়। এর ফলে তারা পরকালে জান্নাত থেকে বঞ্চিত হবে। তাই আমাদের সকলকে আখলাকে যামিমাহ্ বা নিন্দনীয় চরিত্র থেকে দূরে থাকতে হবে। এর ফলে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকবে, পরিবেশ হবে সুন্দর, মানুষের সম্মান ও ভালোবাসা লাভ করা সম্ভব হবে।
কাজ : শিক্ষার্থীরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে আখলাকে যামিমাহ্ এর অপকারিতা সম্পর্কে একটি তালিকা তৈরি করবে। |
পরিচয়
অহংকার শব্দের অর্থ অহমিকা, আমিত্ব, গর্ব, দর্প, দম্ভ, বড়াই, নিজেকে বড় ভাবা ইত্যাদি । নিজেকে অন্যের তুলনায় বড় গণ্য করা এবং অন্যকে তুচ্ছ ও নিকৃষ্ট মনে করাকে অহংকার বলা হয় । যে অহংকার করে তাকে অহংকারী বলে । অহংকারী ব্যক্তি বিভিন্ন দিক থেকে নিজেকে অন্যদের উপর প্রাধান্য দেয় এবং নিজেকে অন্যদের তুলনায় উত্তম মনে করে ।
অহংকারের ধরন তিনটি
১. অন্তরে অহংকার পোষণ করা।
২. চালচলন ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অহংকার প্রকাশ করা।
৩. কথাবার্তায় অহংকার প্রকাশ করা।
মানুষ বংশ, সম্পদ, সৌন্দর্য, শক্তি, সামর্থ্য ইত্যাদি বিষয়ে অহংকার করে থাকে। যেমন ধনী ও সম্পদশালীর মধ্যে অর্থের গৌরব, স্ত্রীলোকদের মধ্যে সৌন্দর্যের বড়াই এবং ক্ষমতাবানদের মধ্যে ক্ষমতার দম্ভ, বিদ্বান লোকদের মধ্যে বিদ্যার গর্ব ইত্যাদি।
অপকারিতা
অহংকারের কুফল অনেক এবং এর অপকারিতা বর্ণনাতীত। অহংকারের কারণেই ইবলিস অভিশপ্ত হয়ে জান্নাত থেকে বিতাড়িত হয়েছে । এ সম্পর্কে মহান আল্লাহর বাণী :
“তুমি এ স্থান হতে নেমে যাও । এ স্থানে থেকে অহংকার করবে তা হতে পারে না। সুতরাং বের হয়ে যাও । নিশ্চয়ই তুমি অধমদের অন্তর্ভুক্ত।” (সূরা আল-আরাফ, আয়াত ১৩)
অহংকারী ব্যক্তি দুনিয়া ও আখিরাতে ঘৃণিত । আল্লাহর কাছে অপছন্দণীয়।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
অর্থ : “নিশ্চয় আল্লাহ কোনো উদ্ধত অহংকারীকে পছন্দ করেন না।” (সূরা লুকমান, আয়াত ১৮)
মহানবি (স.) এ বিষয়ে বলেন,
অর্থ : “যার অন্তরে সামান্য পরিমাণ অহংকার আছে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।” (মুসলিম)
প্রতিটি মানুষের কোনো না কোনো অভাব আছে। সুতরাং অহংকার করা তার জন্য শোভা পায় না । অহংকার শুধু তাঁরই শোভা পায়, যার কোনো অভাব নেই । রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন,
“আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, অহংকার আমার ভূষণ।” (মুসলিম)
আমরা অহংকার বর্জন করব । কেননা মানুষের কোনো জিনিস নিয়েই অহংকার করার অবকাশ নেই। আমরা এ পাঠে শিখলাম, অহংকার পতনের মূল । অহংকারী অভিশপ্ত । আমরা অহংকার করব না।
কাজ : শিক্ষার্থীরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে কী কী কাজ করলে অহংকার প্রকাশ পায় তার একটি তালিকা তৈরি করে শিক্ষককে দেখাবে। |
পরিচয়
অশ্লীলতা অর্থ জঘন্যতা, কদর্যতা, নির্লজ্জতা, অভদ্রতা ও যৌন বিষয়ক কুৎসিত আচরণ। অশ্লীলতার দ্বারা নির্লজ্জ ও কুরুচিপূর্ণ কথা ও কাজকে বোঝানো হয়। এছাড়া যেসব কুকর্ম ধৃষ্টতাসহকারে প্রকাশ্যে করা হয় সেগুলোকেও অশ্লীল বলা হয়।
কুফল
অশ্লীলতা একটি বড় অপরাধ। এটা সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট করে। সমাজকে কলুষিত করে। নিষ্পাপ ও কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের চরিত্র হনন করে যুবক-যুবতীদের কুকর্মের প্রতি প্রলুব্ধ করে।
আল্লাহ তায়ালা অশ্লীলতাকে হারাম ঘোষণা করেছেন । আল্লাহ বলেন,
“বলুন, আমার প্রতিপালক নিষিদ্ধ করেছেন প্রকাশ্য ও গোপন অশ্লীলতা।” (সূরা আল-আ'রাফ, আয়াত ৩৩) আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন,
“প্রকাশ্য কিংবা গোপন অশ্লীল আচরণের নিকটেও যাবে না।” (সূরা আল-আনআম, আয়াত ১৫১)
অশ্লীল আচরণকারী সকলের নিকট ঘৃণিত।
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন-
“যার মধ্যে অশ্লীলতা আছে, তা তাকে ত্রুটিযুক্ত করে। আর যার মধ্যে লজ্জাশীলতা আছে, তা তাকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে।” (তিরমিযি)
কাজ : শিক্ষার্থীরা পরশ্রীকাতরতার কুফলের একটি তালিকা তৈরি করে শ্রেণিকক্ষের বোর্ডে ঝুলিয়ে দেবে। |
পরশ্রীকাতরতা অর্থ অন্যের উন্নতি ও সৌভাগ্য দেখে ঈর্ষা প্রকাশ করা। অর্থাৎ কারো ধন-দৌলত, সম্মান, ভালো ফল বা উচ্চ মর্যাদা দেখে ঈর্ষান্বিত হওয়া এবং তার ধ্বংস কামনা করাকে পরশ্রীকাতরতা বলা হয়।
কুফল
পরশ্রীকাতরতা একটি মারাত্মক মানসিক ব্যাধি। এ ব্যাধি বহু কারণে সৃষ্টি হয়। যেমন শত্রুতা, অহংকার, নিজের অসদুদ্দেশ্য নষ্ট হওয়ার আশংকা, নেতৃত্বের লোভ ইত্যাদি। এসব কারণে এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তির প্রতি হিংসা বিদ্বেষ করে থাকে। ইসলাম এ কাজগুলো হারাম ঘোষণা করেছে। পরশ্রীকাতরতার অপকারিতা সীমাহীন। হযরত আদম (আ.)-এর পদমর্যাদা দেখে ইবলিস তার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়। ফলে সে অভিশপ্ত হয় এবং আল্লাহ তায়ালার দয়া থেকে বঞ্চিত হয়।
মানব সৃষ্টির পর ঈর্ষার কারণেই সর্বপ্রথম পাপ সংঘটিত হয়। আদম (আ.)-এর পুত্র কাবিল পরশ্রীকাতরতার বশবর্তী হয়ে তারই আপন ভাই হাবিলকে হত্যা করে। পরশ্রীকাতরতা মানুষের পুণ্য কাজগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। এ সম্পর্কে মহানবি (স.) বলেছেন,
অর্থ : “আগুন যেমন শুকনা কাঠকে জ্বালিয়ে ছাই করে দেয় পরশ্রীকাতরতা তেমনই পুণ্যকে ধ্বংস করে দেয় ।” (মুসনাদি)
পরশ্রীকাতরতা মানুষের শান্তি বিনষ্ট করে। মনে অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে রাখে। পরশ্রীকাতর ব্যক্তি আল্লাহ এবং মানুষের কাছে ঘৃণিত। কেউ তাকে ভালোবাসে না। কেউ তাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে না। সমাজের লোকেরা তাকে এড়িয়ে চলে। পরশ্রীকাতরতা সমাজে ঝগড়া-ফাসাদ, মারামারি ও অশান্তি সৃষ্টি করে। মানুষের মনে অহংকার সৃষ্টি হয়। অহংকার মানুষের পতন ঘটায়।
আল্লাহ তায়ালা কুরআন মজিদে পরশ্রীকাতরতা থেকে বেঁচে থাকার শিক্ষা দিয়েছেন । কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,
আমাদের প্রতিজ্ঞা
আমরা পরশ্রীকাতর হব না । নিজের পতন নিজে ডেকে আনব না । হিংসা করব ন। সমাজের শান্তি বিনষ্ট করব না।
কাজ : শিক্ষার্থীরা পরশ্রীকাতরতার কুফলের একটি তালিকা তৈরি করে শ্রেণিকক্ষের বোর্ডে ঝুলিয়ে দেবে। |
পরিচয়
ঘৃণা অর্থ অবজ্ঞা, অপছন্দ, উপেক্ষা, তাচ্ছিল্য, তুচ্ছ জ্ঞান করা। কাউকে তুচ্ছ মনে করে তাকে সহ্য করতে না পারা এবং তার থেকে দূরে সরে থাকাকেই পরিভাষায় ঘৃণা বলে।
অহংকার, শত্রুতা, পদমর্যাদার লিপ্সা প্রভৃতি কারণে ঘৃণার উদ্রেক ঘটে। ঘৃণা করা অন্যায় তবে ক্ষেত্রবিশেষ ঘৃণা একটি মানবীয় গুণ । যেমন মন্দ কাজে ঘৃণা করা প্রশংসনীয়। সমাজে চুরি, ডাকাতি, হাইজ্যাক, সুদ, ঘুষ, মদ, জুয়া, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, হেরোইন সেবন ইত্যাদি ঘৃণিত কাজ । এগুলোকে ঘৃণা করা একজন মুমিনের বৈশিষ্ট্য । তবে মনে রাখতে হবে পাপ কাজকে ঘৃণা করব পাপীকে নয়।
কুফল
অনেক ক্ষেত্রে ঘৃণা একটি মহা গুরুতর ব্যাধি। এতে বন্ধুত্বের মধ্যে ফাটল ধরে। সমাজে অশান্তি সৃষ্টি হয়। ঘৃণাকারী কখনো মনে শান্তি লাভ করতে পারে না। এতে তার ইহলৌকিক ও পারলৌকিক ক্ষতি সাধিত হয়।
মহানবি (স.) বলেন,
অর্থ: “পূর্ববর্তী উম্মাতের দুটি রোগ তোমাদের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে, হিংসা এবং ঘৃণা ।” (বায়হাকি)
রাসুলুল্লাহ (স.) আরও বলেন, “তোমরা একে অপরকে হিংসা করো না, একে অপরকে ঘৃণা করো না, একে অন্যের ক্ষতি করার জন্য কৌশল করো না বরং তোমরা আল্লাহর বান্দা হিসেবে পরস্পর ভাই ভাই হয়ে যাও।” (বুখারি ও মুসলিম)
ঘৃণা বা তাচ্ছিল্য শয়তানের বৈশিষ্ট্য। শয়তান হযরত আদম (আ.)-এর প্রতি তাচ্ছিল্য করার কারণেই অভিশপ্ত হয়েছে। আমরা কাউকে ঘৃণা করব না।
আমরা ঘৃণার কুফল উপলব্ধি করব। সকলের প্রতি উদার হব। ভালো কাজে প্রশংসা করব । অর্থ, বিদ্যা বা সামাজিক মর্যাদার মাপকাঠিতে কাউকে ঘৃণা বা হেয় করব না। তবে মন্দ কাজকে ঘৃণা করব। মন্দ কাজকে ঘৃণা না করলে সমাজে তা ধীরে ধীরে বৈধ বলে পরিগণিত হয়।
কাজ : শিক্ষার্থীরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে ঘৃণার কুফলগুলোর একটি তালিকা তৈরি করবে এবং শ্রেণিকক্ষে উপস্থাপন করবে। |
পরিচয়
চৌর্য অর্থ চুরি । চৌর্যবৃত্তি অর্থ চোরের পেশা অথবা চোরের কাজ । কারো মালিকানাভুক্ত সম্পদ সংরক্ষিত স্থান থেকে গোপনে হাতিয়ে নেয়ার নাম চুরি বা চৌর্য ।
চুরির কুফল
নিরাপত্তাহীনতা :
চুরির জন্য সম্পদ ও জীবন নিরাপত্তাহীনতার শিকার হয় । কারণ কখনো কখনো চোর ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় মালিককে খুনও করে ।
সামাজিক শান্তি বিনষ্ট :
চৌর্যবৃত্তির কারণে মানুষ শান্তিতে ঘুমোতে পারে না । সম্পদ পাহারা দিতে নির্ঘুম রাত কাটাতে হয় । সর্বদা সম্পদ চুরি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় সামাজিক শান্তি ও স্বস্তি বিনষ্ট হয় ।
সামাজিক অপরাধ বৃদ্ধি :
চুরির দ্বারা সমাজে আরও নতুন নতুন অপরাধ সৃষ্টি হয় । চোর শুধু তার কাজ চুরির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে না বরং সে চুরি, ছিনতাই, অপহরণ, খুন এবং মাঝে মাঝে সম্ভ্রমহানির ঘটনাও ঘটায় ।
চৌর্যবৃত্তি একটি ঘৃণিত কাজ :
সমাজের নিন্দনীয় কাজগুলোর অন্যতম চৌর্যবৃত্তি । সমাজে চোরকে মানুষ ঘৃণার চোখে দেখে। চোরকে মানুষ
আত্মীয় হিসাবে পরিচয় দিতে লজ্জা বোধ করে । পরিবার ও সমাজের লোকেরা তাকে ঘৃণার চোখে দেখে ।
পরকালীন শাস্তি :
চুরি একটি অত্যন্ত জঘন্য ধরনের নিষিদ্ধ কাজ । এর ফলে ব্যক্তি প্রকৃত মুমিন থাকতে পারে না । আল্লাহ তার জন্য পরকালেও ভয়াবহ শাস্তির অঙ্গীকার করেছেন ।
চুরি প্রতিরোধে ইসলামের ভূমিকা :
চুরির জন্য পরকালে শাস্তির অঙ্গীকার ছাড়াও এ অনৈতিক অপরাধ প্রতিরোধের জন্য ইসলাম পার্থিব দণ্ডবিধানও দিয়েছে। প্রতিকার
১. মৌলিক প্রয়োজন মেটানো
কেউ যাতে অন্ন, বস্ত্র বা মৌলিক চাহিদার অভাবে চুরি না করে তার জন্য সেসবের ব্যবস্থা করতে হবে। তার কাজের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
২. দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা
অভাব না থাকা সত্ত্বেও স্বভাবগত কারণে কেউ যদি চুরি করে তাহলে সব দেশ এবং সব সমাজেই সেজন্য শাস্তির বিধান রয়েছে, ইসলাম ধর্মেও তার জন্য কঠিন শাস্তির বিধান রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
অর্থ : “পুরুষ চোর আর মহিলা চোর তাদের হাত কেটে দাও। তারা যা করেছে এ হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।” (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত ৩৮)
৩. নৈতিকতাবোধ জাগ্রতকরণ
সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে মানুষের অন্তরে চৌর্যবৃত্তির প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করা। চোরকে সামাজিকভাবে বয়কট করার মাধ্যমে নৈতিকতাবোধ জাগ্রত করা।
ধর্মীয় প্রতিকার
চুরি শুধু সামাজিক অপরাধই নয়, ধর্মীয় বিবেচনায় একটি হারাম কাজ। দুনিয়ায় ঘৃণা ও শাস্তি ছাড়াও আখিরাতে এর জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে।
কাজ : শিক্ষার্থীরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে চৌর্যবৃত্তির প্রতিকারের উপায়গুলোর একটি তালিকা তৈরি করবে। |
পরিচয়
ঘুষ অর্থ উৎকোচ। এর আরবি প্রতিশব্দ ‘রেশওয়াত’। অবৈধ সহায়তার জন্য প্রদত্ত গোপন পারিতোষিকই ঘুষ। কর্তব্যরত কোনো ব্যক্তির নিকট থেকে কাজ আদায় করার উদ্দেশ্যে কিছু দেওয়া ঘুষের অন্তর্ভুক্ত।
কোনো ব্যক্তির জন্য সুপারিশ করে উপঢৌকন গ্রহণ করাও ঘুষ। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, “যে ব্যক্তি কারো জন্য সুপারিশ করল, আর এ সুপারিশের প্রতিদানস্বরূপ তাকে কিছু উপহার দেওয়া হলে, সে যদি তা গ্রহণ করে, তবে সে সুদের দরজাসমূহের একটি বড় দরজায় উপস্থিত হবে।” (কিতাবুল কাবায়ির)
কুফল
ঘুষ একটি সামাজিক অপরাধ । ঘুষ লেনদেনের মাধ্যমে অন্যের অধিকার ক্ষুণ্ণ হয় । ঘুষ গ্রহীতাকে সকলে ঘৃণা করে । ঘুষ গ্রহণ এবং দেওয়া দুটিই পাপ কাজ। ঘুষ গ্রহীতা ও দাতার উপর আল্লাহ তায়ালার অভিশাপ বর্ষিত হয়। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন,
অর্থ: “ঘুষ দাতা ও ঘুষ গ্রহীতার উপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হয় ।” (ইব্ন মাজাহ্)
ঘুষ দেওয়া ও নেওয়া উভয়ই অমার্জনীয় অপরাধ । ঘুষদাতা ও গ্রহীতা উভয়ই জাহান্নামি। রাসুল (স.) বলেন,
অর্থ : “ঘুষ দাতা ও গ্রহীতা উভয়ই জাহান্নামি ।” (তাবারানি)
কোনো কর্মচারী তার বেতনের অতিরিক্ত জনগণ থেকে কোনো কিছু গ্রহণ করা অবৈধ। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, “কোনো ব্যক্তিকে যদি আমরা কোনো কাজে নিয়োগ করি এবং এ জন্য তাকে বিনিময় দান করি, আর সে বিনিময়ের অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করে, তবে তা খিয়ানত হিসাবে গণ্য হবে।” (আবু দাউদ)
ঘুষ প্রতিরোধে ইসলামি বিধান
ইসলাম ঘুষকে হারাম ঘোষণা করেছে। মুমিনদের ঘুষ আদান প্রদান না করার বিশেষ নির্দেশ দিয়েছে। মহান আল্লাহ ঘুষের সম্পদকে হারাম ও অপবিত্র ঘোষণা করেছেন। মুমিনদের দায়িত্ব হলো এ নিষিদ্ধ অপবিত্র কাজে অংশগ্রহণ না করা।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহর বাণী,
“আপনি বলুন, হারাম ও অপবিত্র জীবিকা এবং পবিত্র জীবিকা সমান নয় । যদিও হারামের আধিক্য তোমাকে বিস্মিত করে। কাজেই হে বুদ্ধিমানগণ, আল্লাহকে ভয় কর- যাতে সফলকাম হতে পার।” (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত ১০০)
কিয়ামত দিবসে ঘুষ গ্রহীতার পরিণতি হবে খুবই লজ্জাজনক । মহানবি (স.) বলেছেন- “যার হাতে আমার জীবন তাঁর কসম! ব্যক্তি যা ঘুষ হিসেবে গ্রহণ করবে কিয়ামতের দিন সে তা নিয়েই উপস্থিত হবে।”
সর্বোপরি মহানবি (স.) ঘুষদাতা ও গ্রহীতার জন্য জাহান্নামের সংবাদ দিয়েছেন।
আমরা সমাজকে ঘুষের অভিশাপ থেকে মুক্ত করব । নিজেরা কখনো ঘুষ আদান-প্রদান করব না।
সামাজিক অপরাধ হিসাবে এ অভিশপ্ত কাজ প্রতিরোধ করব।
কাজ : শিক্ষার্থীরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে ঘুষের সামাজিক কুফলগুলোর একটি তালিকা তৈরি করবে এবং শ্রেণিকক্ষে উপস্থাপন করবে। |
পরিচয়
সন্ত্রাস হলো ফিতনা-ফাসাদের আধুনিক রূপ। সন্ত্রাস শব্দের অর্থ অতিশয় ত্রাস বা ভয়ের পরিবেশ। অর্থাৎ ভয় দেখিয়ে বা জোর খাটিয়ে মানুষের কাছ থেকে কিছু আদায় করা বা আদায়ের পরিবেশ সৃষ্টির নীতিকে সন্ত্রাস বলে ।
সন্ত্রাসের কুফল
সন্ত্রাসের ফলে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। সামাজিক জীবন বিপর্যস্ত হয় । মানুষের স্বাভাবিক শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন ব্যাহত হয়। সন্ত্রাসকবলিত জনপদে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা থাকে না। যখন তখন কেউ অপমৃত্যুর শিকার হতে পারে। সন্ত্রাসের কারণে মানুষের সম্পদের নিরাপত্তা থাকে না । সম্ভ্রমের নিরাপত্তা থাকে না । পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট হয় । বিদ্বেষ বেড়ে যায়। আইন-শৃঙ্খলা ও প্রশাসন স্থবির হয়ে পড়ে। ফলে জাতীয় উন্নতি ও অগ্রগতি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।
সন্ত্রাস প্রতিরোধে ইসলামের বিধান
ইসলাম সন্ত্রাস প্রতিরোধে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ থেকে যুদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে। আর এ যুদ্ধকে মুমিনদের ইমান রক্ষার যুদ্ধ বলে ঘোষণা দিয়েছে। আল্লাহর বাণী,
অর্থ : “এবং তোমরা তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে থাকবে যতক্ষণ না ফিতনা দূরীভূত হয়।” (সূরা আল- আনফাল, আয়াত ৩৯)
সন্ত্রাস দমনে ইসলাম সাধারণত তিন প্রকার ব্যবস্থা নিয়েছে।
১. শাস্তিমূলক ব্যবস্থা
সন্ত্রাস ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কাজকে আল্লাহ তায়ালা অত্যন্ত অপছন্দ করেন । মহান আল্লাহ সন্ত্রাসকে হত্যার চেয়ে জঘন্য আখ্যা দিয়েছেন। আল্লাহর বাণী,
অর্থ: “ফিতনা (বিশৃঙ্খলা ও সন্ত্রাস) হত্যার চেয়ে জঘন্য ।” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ১৯১)
যারা আল্লাহর এ নিষেধাজ্ঞার পরও বিশৃঙ্খলা, বিপর্যয় বা সন্ত্রাস সৃষ্টির কাজ অব্যাহত রাখবে, তাদের বিরুদ্ধে পৃথিবীতে আল্লাহ তায়ালা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন, “যারা এইচআইভি এবং এইডস যেসব কারণে ছড়ায় তার মধ্যে প্রধান কারণগুলো হলো-
ক. অবৈধ মেলামেশা।
খ. মাদক ও নেশা জাতীয় দ্রব্য সিরিঞ্জের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করানো।
গ. অপরিশোধিত রক্ত শরীরে প্রবেশ করানো।
আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করে বেড়ায় এটাই তাদের শাস্তি যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলে বিদ্ধ করা হবে অথবা বিপরীত দিক থেকে তাদের হাত ও পা কেটে ফেলা হবে অথবা তাদেরকে দেশ থেকে নির্বাসিত করা হবে। দুনিয়ায় এটাই তাদের লাঞ্ছনা এবং পরকালেও তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি। (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত ৩৩)
২. কারণ উদঘাটন ও নিরসন
ইসলাম সন্ত্রাসের কারণ উদঘাটন ও তা নিরসনের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে । এ জন্য ইসলামে দারিদ্র্য, অশিক্ষা, বেকারত্ব ও নৈতিক অবক্ষয় রোধে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতি জোর দিয়েছে।
৩. নৈতিকতাবোধ জাগ্রতকরণ
জীবনের সকল পর্যায়ে ইসলামি বিধান কার্যকর করে ও নৈতিকতাবোধ জাগ্রত করে সন্ত্রাস দূর করা যায় । নৈতিকতাবোধ জাগ্রত করার জন্য সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন । সন্ত্রাসী কাজকে ঘৃণা করা এবং সন্ত্রাসীকে সামাজিকভাবে বয়কট করার মাধ্যমে নৈতিকতাবোধ জাগ্রত করা যায়।
কাজ : শিক্ষার্থীরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে সন্ত্রাসের কুফলগুলোর একটি তালিকা তৈরি করবে এবং শিক্ষককে দেখাবে। |
বর্তমান শতাব্দীর এক মহাআতঙ্কের নাম এইডস। আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের যুগেও এইডস বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি । এ রোগটি ১৯৮১ সালে সর্বপ্রথম আমেরিকায় সমকামীদের মধ্যে ধরা পড়ে । যে ভাইরাস থেকে এ রোগটি হয় তার নাম Human Immune Deficiency Virus, এর সংক্ষিপ্ত নাম HIV- এটি একটি ঘাতক ব্যাধি । HIV দ্বারা কোনো ব্যক্তি আক্রান্ত হলে তাকে “এইচআইভি বহনকারী” হিসেবে চিহ্নিত Y করা হয়। এ ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করে রক্তের রোগ প্রতিরোধকারী T4 কোষগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। এক পর্যায়ে আক্রান্ত ব্যক্তি রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। আক্রান্ত ব্যক্তি ক্রমান্বয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
বয়স, জাতি, লিঙ্গ, সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে সবাই এইচআইভি দ্বারা সমানভাবে আক্রান্ত হতে পারে। এইচআইভি মানুষের শরীরে বিভিন্ন ধরনের তরল পদার্থের মাধ্যমে ছড়িয়ে থাকে। তরল পদার্থগুলো হলো রক্ত, বীর্য, মাতৃদুগ্ধ ইত্যাদি । যদি এইচআইভি আক্রান্ত পুরুষ বা মহিলার শরীরের তরল পদার্থ কোনো সুস্থ ব্যক্তির দেহে প্রবেশ করে, তবে তিনি এইচআইভি দ্বারা আক্রান্ত হতে পারেন।
এইচআইভি এবং এইডস যেসব কারণে ছড়ায় তার মধ্যে প্রধান কারণগুলো হলো-
ক. অবৈধ মেলামেশা।
খ. মাদক ও নেশা জাতীয় দ্রব্য সিরিঞ্জের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করানো।
গ. অপরিশোধিত রক্ত শরীরে প্রবেশ করানো।
প্রতিরোধের উপায়সমূহ
১. সুস্থ বৈবাহিক জীবনযাপন করা।
২. নারী-পুরুষের অবৈধ মেলামেশা এড়িয়ে চলা।
মাদক ও নেশা জাতীয় সকল জিনিস বর্জন করা।
৪. অপরিশোধিত রক্ত শরীরে প্রবেশ না করানো।
আমরা ইসলামি বিধিবিধান মেনে চলব। সামাজিক অপরাধসমূহ এড়িয়ে চলব। আমরা নিজেকে এবং সমাজকে সকল অপরাধ ও রোগসংক্রমণ থেকে রক্ষা করব।
কাজ : শিক্ষার্থীরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে এইচআইভি এবং এইডস প্রতিরোধের উপায়গুলোর একটি তালিকা তৈরি করবে। |