বলা হয় মানুষ পরিবেশের দাস। জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি পরিবেশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মানুষকে চালিত করে । আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে তা নিয়ে আমাদের পরিবেশ। অপরদিকে ব্যবসায় পরিবেশ সামগ্রিক পরিবেশের একটি অংশ, যা শুধু ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত। বর্তমান প্রতিযোগিতাপূর্ণ মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে ব্যবসায়ের সাফল্য অর্জন সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে ব্যবসায়ের পরিবেশের উপর। যেসব পারিপার্শ্বিক উপাদান ব্যবসায়কে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করে তার সমষ্টিকে ব্যবসায়ের পরিবেশ বলে। পরিবেশের উপাদানগুলো ব্যবসায়ের কার্যাবলিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে।
এ অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা জানতে পারব—
সূত্র: ক্যামব্রিয়ান পাবলিকেশন্স
বাংলাদেশের কোনো গ্রামে স্বল্পবিত্তসম্পন্ন একজন কৃষকের ঘরে একটা শিশু জন্ম নিল। এরপর তার পরিচর্যা, বেড়ে ওঠা, লেখাপড়া, জীবন-জীবিকা ও চিন্তা-ভাবনা যে ধরনের হবে ইংল্যান্ডের কোনো গ্রামে জন্ম নেয়া শিশু এবং তার পরিচর্যা, বেড়ে ওঠা, লেখাপড়াসহ সবকিছু হবে ভিন্নতর। এর পিছনে উভয়ের পারিপার্শ্বিকতা অর্থাৎ প্রাকৃতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি পরিবেশের উপাদানসমূহ ভিন্ন বাস্তবতার জন্ম দিয়েছে। এটাকে অস্বীকার করার কোনোই সুযোগ নেই ।
তাই বলা যায়, প্রতিটি মানুষ তার চিন্তা-বিশ্বাস, আচার-আচরণ, জীবন-জীবিকাসহ যে ভিন্ন ভাবধারাতে গড়ে ওঠে এর পিছনে সবচেয়ে বড় প্রভাব তার পরিবেশ। সেজন্যই বলা হয়, মানুষ আজন্ম পরিবেশের দ্বারা প্রভাবিত হয়। যেসব পারিপার্শ্বিক উপাদান ব্যবসায়কে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করে তার সমষ্টিকে ব্যবসায়ের পরিবেশ । যেসব অবস্থা ব্যবসায়ের উন্নতির উপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে, তাকে ব্যবসায় পরিবেশ বলে। ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ বলতে সাধারণত বাইরের সেসব উপাদানগুলোকে বুঝানো হয় যেগুলো প্রতিষ্ঠানের জন্য সুযোগ বয়ে আনতে পারে কিংবা ক্ষতির সৃষ্টি করতে পারে।
বর্তমান প্রতিযোগিতাপূর্ণ মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে ব্যবসায়ের সাফল্য অর্জন সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে ব্যবসায় পরিবেশের উপর । পরিবেশের উপাদানগুলো মানুষের অর্থনৈতিক কার্যাবলি এবং ব্যবসায়-বাণিজ্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। নিম্নে ব্যবসায় পরিবেশের উপাদানগুলো তুলে ধরা হলো:
১। প্রাকৃতিক উপাদান (Natural element) : প্রকৃতিগত কারণে যে পরিবেশ সৃষ্টি হয় তাকে প্রাকৃতিক পরিবেশ বলে। কোনো দেশের ভূ-প্রকৃতি, জলবায়ু, প্রাকৃতিক সম্পদ, অবস্থান, আয়তন, জনসংখ্যা, নদ- নদী, পাহাড়-পর্বত ইত্যাদি প্রাকৃতিক পরিবেশের উপাদান ।
এ উপাদানসমূহের উপস্থিতি কিংবা অনুপস্থিতির দ্বারা ব্যবসায় কার্যকলাপ প্রভাবিত হয়। সে কারণেই এসব উপাদানের অনুকূল ক্ষেত্রে ব্যবসায়-বাণিজ্য, শিল্প-করখানা অধিক পরিমাণে গড়ে ওঠে।
২। অর্থনৈতিক উপাদান (Economic element): “অর্থনৈতিক পরিবেশ কতকগুলো উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত যা ভোক্তার ক্রয় ক্ষমতা ও ব্যয়ের ধরনকে প্রভাবিত করে।” এসব উপাদানের মধ্যে রয়েছে অর্থ ও ঋণ ব্যবস্থা, সঞ্চয় ও বিনিয়োগ, মূলধন ইত্যাদি। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপর একটি দেশের শিল্প ও বাণিজ্যের প্রতিষ্ঠা ও প্রসার ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। একটি দেশের জাতীয় আয়, ভোগের পরিমাণ, উৎপাদন ও বণ্টন, গড় মাথাপিছু আয় ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে কোনো দেশের অর্থনৈতিক পরিবেশ। কাজেই উপরিউক্ত উপাদানসমূহ অনকূল হলে ব্যবসায় বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন সহজতর হয়।
৩। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উপাদান (Social and cultural element):
মানুষ সমাজবদ্ধ জীবন যাপনে অভ্যস্ত। এ সমাজবদ্ধ মানুষের ধ্যান-ধারণা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি, মনোভাব ও বিশ্বাস, রীতি-নীতি, মূল্যবোধ, ধর্মীয় চেতনা ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে সামাজিক পরিবেশ। ব্যবসায়-বাণিজ্যের উপর এ সামাজিক উপাদানগুলোর প্রভাব অসীম। সামাজিক পরিবেশ সহজ, সুন্দর ও অনুকূল হলে ব্যবসায় বাণিজ্য তার কাম্য লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হয় ।
৪। রাজনৈতিক ও আইনগত উপাদান (Political and legal element): একটি দেশের রাজনৈতিক ও আইনগত উপাদানসমূহ ব্যবসায়ের উন্নয়ন ও বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। কোনো দেশের সরকারি নিয়ম-কানুন, আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনুকূল হলে ব্যবসায়ও দ্রুতগতিতে বিকশিত হতে পারে। ঠিক তেমনি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, ব্যবসায় বাণিজ্যের প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি, বাণিজ্য নীতি, রাজস্ব নীতি, বিনিয়োগ নীতি ইত্যাদির আনুকূল্য এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ব্যবসায়ের সম্প্রসারণ ও উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।
৫। তথ্য ও প্রযুক্তিগত উপাদান (Information and technological element): বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা তথ্য ও প্রযুক্তি নির্ভর। প্রযুক্তি যেমন মানুষের জীবনে এনেছে আধুনিকতার ছোঁয়া, বর্তমান কম্পিউটারভিত্তিক তথ্য ব্যবস্থাও তেমনি মানুষের জীবনধারাকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। প্রযুক্তি ও কারিগরি জ্ঞানের দ্বারা গবেষণা ও উদ্ভাবনের ফলে বিশ্ব পাচ্ছে নতুন নতুন আবিষ্কার, ক্রেতা ও ভোক্তারা পাচ্ছে নতুন নতুন পণ্য ও সেবাসামগ্রী। আবার তথ্য ব্যবস্থার অবাধ প্রবাহ ব্যবসায়-বাণিজ্য গতি সঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছে। তথ্যের অবাধ প্রবাহ ব্যতীত আজকের বিশ্বায়নের (Globalisation) যুগে ব্যবসায়-বাণিজ্যে অগ্রগতি ও উন্নয়নের প্রত্যাশা দুরাশামাত্র ।
৬। আন্তর্জাতিক উপাদান (International element): বর্তমান ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্র আজ আর কেবল সীমিত গণ্ডিতে আবদ্ধ নেই। ব্যবসায় আজ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী তার সকল ডালপালা প্রসারিত করতে সমর্থ হয়েছে। সুতরাং ব্যবসায়ের আন্তর্জাতিক দিককে অবহেলা করার সুযোগ নেই । একটি দেশের সাথে অপর দেশের সম্পর্ক, বিশেষ করে উন্নত দেশের সাথে উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশের সম্পর্ক ব্যবসায়কে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। এছাড়া আন্তর্জাতিক চুক্তি, বিশ্ব বাণিজ্য নীতি ও বিশ্ববাজার ব্যবস্থা, প্রতিবেশি দেশসমূহের সাথে সম্পর্ক ইত্যাদি যেকোনো দেশের ব্যবসায়- বাণিজ্যে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে।
পরিশেষে বলা যায়, ব্যবসায় পরিবেশের উপরোক্ত প্রতিটি উপাদানই ব্যবসায়কে কোনো না কোনোভাবে প্রভাবিত করছে।
ব্যবসায় একটি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। মানুষের জীবন প্রণালি ও অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপর পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান বা শক্তিসমূহ যেভাবে প্রভাব বিস্তার করে, তেমনিভাবে ব্যবসায় এবং তৎসংক্রান্ত কার্যাবলিও পরিবেশগত বিভিন্ন চলক / উপাদান / শক্তি দ্বারা প্রভাবিত হয়। পরিবেশের উপাদানসমূহের মধ্যে যেমন রয়েছে ভূ-প্রকৃতি, জলবায়ু, মৃত্তিকা, নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত ইত্যাদির মতো প্রাকৃতিক উপাদান, তেমনি রয়েছে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রযুক্তি, সরকারি বিধি-বিধান ইত্যাদির মতো অ- প্রাকৃতিক উপাদানসমূহ। কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের এ সময় পরিবেশগত উপাদান একক এবং সম্মিলিতভাবে অহরহ ঐ স্থানের ব্যবসায়িক কর্মধারা, সিদ্ধান্ত, ফলপ্রদতা ইত্যাদিকে প্রভাবিত করে ।
১। প্রতিষ্ঠানের জন্য মূলধন প্রাপ্তি (Availability of capital for the venture): ব্যবসায় একটি সৃজনশীল ও উদ্ভাবনমূলক কাজ। ব্যবসায়ীর এরূপ উদ্ভাবনী শক্তিকে বাস্তবে রূপদানের জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত মূলধনের। সংগঠন স্থাপন, কলকব্জা ও যন্ত্রপাতি ক্রয়, কাঁচামাল সংগ্রহ ইত্যাদি বাবদ প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। উদার ঋণদান নীতি, সুষ্ঠু ও কার্যকর শেয়ার বাজারের উপস্থিতি এবং সর্বোপরি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির উপর মূলধন সরবরাহ পরিস্থিতি নির্ভরশীল। দেশে অনুকূল অর্থনৈতিক পরিবেশ বিদ্যমান থাকলে ব্যবসায়ের মূলধন প্রাপ্তি সহজ হয়। অন্যদিকে প্রতিকূল অর্থনৈতিক পরিবেশ মূলধন প্রাপ্তিতে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। ফলে ব্যবসায় বাধাপ্রাপ্ত হয়।
২। অনুকূল কর কাঠামো (Favourable tax structure): দেশের বিরাজমান অনুকূল কর ও শুল্ক নীতি ব্যবসায়ের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। দেশে বিদ্যমান কর কাঠামোতে যেসব খাতে বা অঞ্চলে শিল্প-কারখানা ও ব্যবসায় স্থাপনে কর রেয়াত দেয়া হয়, সেসব খাতে বা অঞ্চলে দ্রুত শিল্প কারখানা গড়ে উঠে । প্রতিকূল কর ও শুল্ক কাঠামো নতুন শিল্প স্থাপনকে নিরুৎসাহিত করার সাথে সাথে চালু শিল্প কারখানা ও ব্যবসায় কর্মকাণ্ডের ইতি ঘটায়।
৩। লাইসেন্স প্রাপ্তির সুবিধা (Facility to getting licence): দেশে শিল্প স্থাপন ও ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন। শিল্প স্থাপনের এরূপ অনুমোদন বা লাইসেন্স প্রাপ্তির সুবিধা বা অসুবিধা ব্যবসায়ী কার্যক্রমে যথাক্রমে ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। তাই দেখা যায়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারি অনুমোদন ও লাইসেন্স প্রদানে দীর্ঘসূত্রিতার নীতি ব্যবসায়ী উদ্যোগকে নিরুৎসাহিত করে। আবার এক্ষেত্রে ত্বরিত ব্যবস্থার নীতি শিল্প কারখানা স্থাপনে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে।
৪। ভূমি প্রাপ্তির সুবিধা (Advantages of getting land): শিল্প বা ব্যবসায় স্থাপনে যথাযথ সুবিধা সংবলিত ভূমি প্রয়োজন। সুষ্ঠু যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা, বাজারের নৈকট্য, কাঁচামাল, শ্রমশক্তি, গ্যাস, বিদ্যুৎ ইত্যাদির সহজলভ্যতা সংবলিত ভূমি যথাযথ শিল্প স্থাপনের সহায়ক। অন্যদিকে শিল্প স্থাপনের উপযোগী ভূমির অপর্যাপ্ততা ব্যবসায় কর্মকাণ্ডকে বাধাগ্রস্ত করে ।
৫। সুষ্ঠু যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা (Smooth communication and transportation system): সুষ্ঠু ও পর্যাপ্ত যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক উপাদান-যা ব্যবসায় বা শিল্পের প্রতিষ্ঠা ও এর অগ্রগতিতে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। সুষ্ঠু যোগাযোগ ব্যবস্থা একদিকে যেমন কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য অপরিহার্য, অন্যদিকে উৎপন্ন পণ্য বাজারজাতকরণের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ । আবার উন্নত যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা ব্যবসায় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্যও একান্ত অপরিহার্য ।
৬। বাজারে প্রবেশের সুযোগ (Facility to access in the market): উৎপাদিত পণ্য অবাধে বিক্রয়ের সুযোগ তথা পণ্যের বাজার লাভের সুযোগ আরেকটি অর্থনৈতিক উপাদান-যা শিল্পীয় উৎপাদনকে প্রত্যক্ষভাবে উৎসাহিত করে। মূলত পণ্য উৎপাদিত হয় বাজারে বিক্রয়ের নিমিত্তে। এমতাবস্থায়, কোনো পণ্যের বাজার যদি একচেটিয়া বা নিয়ন্ত্রিত বা সংরক্ষণমূলক হয় তবে ঐ শিল্পের অগ্রগতি ব্যাহত হয়। অনেক সময় দেখা যায় পেটেন্ট, ট্রেডমার্ক, কপিরাইট অথবা অন্য কোনো সরকারি নির্দেশ পণ্যের বাজারকে সংরক্ষিত ও সংকুচিত করে রাখে । এরূপ অবস্থায় ব্যবসায় কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হয়ে থাকে।
৭। অনুকূল ঋণ ও আর্থিক সুবিধা (Favourable credit and financial facilities): ব্যবসায়ীগণ শিল্প স্থাপন এবং চলমান শিল্পে প্রয়োজনীয় চলতি মূলধন যোগান দেয়ার নিমিত্তে অথবা সম্প্রসারণের জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি মূলধন বা ঋণের প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন। এমতাবস্থায়, কোনো অঞ্চলে এরূপ মূলধন বা ঋণ প্রাপ্তির সুযোগ না থাকলে ব্যবসায়ীগণ নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন। ফলে ব্যবসায় কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয়। আবার প্রয়োজনীয় ঋণ বা মূলধনের যোগান দেয়ার জন্য যে অঞ্চলে পর্যাপ্ত ব্যাংক, সুষ্ঠু শেয়ার বাজার বা বিদেশি সাহায্য বিদ্যমান সেখানে সহজেই শিল্প ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে।
৮। সহায়ক ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি (Presence of supporting and service organisations): কোনো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বা শিল্প প্রতিষ্ঠানই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। এককে খাত বা শিল্পে উন্নয়ন অন্যান্য অনেক শিল্প বা ব্যবসায়ের সমর্থন বা সহায়তার উপর নির্ভরশীল। তাই ব্যাংক, বিমা, পরিবহন, গ্যাস, বিদ্যুৎ, ফায়ার সার্ভিস, পাইকারি ও খুচরা দোকান, মেরামতি সপ, টেলিযোগাযোগ, ডাক ইত্যাদির মতো সেবাদানকারি এবং সহায়ক প্রতিষ্ঠান ব্যবসায় প্রচেষ্টাকে বেগবান করে তুলতে পারে ।
৯। সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবস্থা (Socio-cultural conditions): কোনো সমাজে নতুন শিল্প স্থাপনের উদ্যোগ বা উদ্যম গড়ে উঠা না উঠার পেছনে ঐ অঞ্চলের সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিবেশ বা মূল্যবোধের প্রভাব অনেকখানি। আধুনিক প্রগতিশীল সামাজিক-সাংস্কৃতিক রীতিনীতি, আচার-আচরণ, মূল্যবোধ, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, পছন্দ-অপছন্দ, আবেগ-অনুভূতি ইত্যাদি নতুন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠার সহায়ক হলেও সনাতনী সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ব্যবসায় উদ্যোগ সৃষ্টিতে ব্যাঘাত ঘটায়। সনাতনী সাংস্কৃতিক মূল্যবোধে বিশ্বাসীগণ সামন্তবাদী চিন্তা- চেতনায় বিশ্বাসী। তাঁরা ব্যবসায়ে অর্থ-বিনিয়োগের চেয়ে ভূমির মালিকানায় অর্থ বিনিয়োগকে অধিক সামাজিক মর্যাদার প্রতীক মনে করেন। ফলে বিনিয়োগ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয় বিধায় ব্যবসায় কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয়।
১০। অনুকূল সরকারি নীতিমালা (Favourable government policies): রাষ্ট্রীয় সকল পর্যায়ে প্রণীত ও জারিকৃত বিভিন্ন আইন-কানুন, বিধি-বিধান, সরকারি-আদেশ-অধ্যাদেশ ইত্যাদির বেড়াজালে আবদ্ধ থেকে একজন ব্যবসায়ী বা শিল্প উদ্যোক্তাকে ব্যবসায় স্থাপন ও পরিচালনা করতে হয়। ব্যবসায়ের জন্মলগ্ন থেকে বিলুপ্তিকাল পর্যন্ত বিভিন্ন আইনকানুন ব্যবসায়িক কার্যক্রমকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত করে। সরকারি এরূপ আইনকানুনের মধ্যে কর, শুল্ক, ভ্যাট, ব্যবসায় সংগঠন, ব্যাংক, বিমা, বৈদেশিক বিনিময়, পরিবেশ, শ্রমিক, পরিবহন, আমদানি-রপ্তানি ইত্যাদি বিষয়ক বিধি-বিধান অন্যতম। ব্যবসায়ের প্রতি সরকারের মনোভাব প্রণীত ও জারিকৃত এসব আইন, বিধি-বিধান ইত্যাদিতে প্রতিফলিত হয় ।
১১। অর্থনৈতিক ব্যবস্থা (Economic system): অর্থনৈতিক পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও একটি দেশের ব্যবসায় প্রয়াসকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। ‘মুক্ত’ বা পুঁজিতান্ত্রিক' অর্থ ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে রাষ্ট্রের তেমন হস্তক্ষেপ না থাকায় ব্যক্তিগত পর্যায়ে উদ্যোগ প্রাধান্য লাভ করে। অন্যদিকে, ‘নিয়ন্ত্রিত’ বা ‘সমাজতান্ত্রিক' অর্থ ব্যবস্থায় উৎপাদনের সমগ্র প্রক্রিয়া রাষ্ট্রের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণাধীন থাকে বিধায় ব্যক্তিগত পর্যায়ে ব্যবসায় উদ্যোগ গ্রহণ বা শিল্প স্থাপন বাধাগ্রস্ত হয়।
১২। দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা (Political stablility): দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা শিল্প বা ব্যবসায় পরিবেশকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত, ঘন ঘন সরকার ও নীতির পরিবর্তন ইত্যাদি শিল্প ও বাণিজ্যিক পরিবেশকে বিঘ্নিত করে। কারণ এরুপ পরিস্থিতিতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও এদের বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও ব্যবসায়ের উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি সুষ্ঠু নীতিমালা বহাল থাকলে শিল্প-বাণিজ্যের উন্নয়ন ঘটে ।
১৩। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি (Science and technology): মানুষের জীবনে নাটকীয় পরিবর্তন সাধনে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারি উপাদান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। বর্তমান যুগের পেনিসিলিন, ওপেনহার্ট সার্জারি, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন ইত্যাদি বিস্ময়কর আবিষ্কার ও ব্যবহার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নেরই ফসল। প্রযুক্তির দ্রুত উন্নয়ন একদিকে যেমন উৎপাদনকে সহজতর করে, উৎপাদনের গুণগত মান ও পরিমাণ বৃদ্ধি করে, তেমনি তা ব্যবসায়ীদের জন্য বিপর্যয়ও সৃষ্টি করতে পারে। কারণ নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাব পুরাতন প্রযুক্তির প্রতিস্থাপনকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে ।
উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, ব্যবসায় কর্মকাণ্ড পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান এবং তা থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক শক্তি দ্বারা প্রভাবিত হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বা দেশে পরিবেশগত শক্তির এরূপ প্রভাব ভিন্নতর হয়ে থাকে। এজন্য রাষ্ট থেকে রাষ্ট্রে, অঞ্চল থেকে অঞ্চলে ব্যবসায়ের প্রকৃতি, গতিধারা, উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি ইত্যাদিতে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়।
১। অবকাঠামো সঙ্কট: বাংলাদেশের ব্যবসায় পরিবেশ উন্নয়নে অন্যতম সমস্যা হচ্ছে অবকাঠামোগত সঙ্কট বা সমস্যা, অবকাঠামো বলতে, রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, গ্যাস, কাঁচামালের প্রাপ্যতা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, ব্যবসায়ের লাইসেন্স প্রাপ্যতা ইত্যাদিকে বুঝায়। এই বিষয়গুলো আমাদের
দেশে সহজে পাওয়া যায় না।
২। প্রাতিষ্ঠানিক খাতের দুর্বলতা: ব্যবসায় পরিবেশ উন্নয়নে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাহায্য প্রয়োজন যেমন- আর্থিক প্রতিষ্ঠান (ব্যাংক, বিমা, শেয়ার বাজার) এই সকল খাতে যথেষ্ট দুর্বলতা আছে ।
৩। সমষ্টিক অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা: ব্যবসায় ক্ষেত্রে যৌথ উদ্যোগে বৈদেশিক বিনিয়োগ পাওয়া যায় না, যার ফলে সমষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা দুর্বল হয়ে পড়েছে।
৪। পণ্যবাজার ও শ্রমবাজারের অদক্ষতা: পণ্য সরবরাহে দেরি হওয়া বা ব্যয় বৃদ্ধি আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াজাত জটিলতা, অর্থায়নের সহজপ্রাপ্যতার অভাব, ও রুলস অব অরিজিন ইত্যাদির জন্য পণ্য বাজার ও শ্রমবাজারে অদক্ষতা দেখা দিচ্ছে।
৫। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা: বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ শত সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করছে। বললে অযৌক্তিক হবে না। রাজনৈতিক অস্থিরাতা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি সবই হচ্ছে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় । যা জনগণকে বারে বারে হতাশ করছে।
৬। উৎপাদনে ব্যবহৃত প্রযুক্তি ও দক্ষতার ঘাটতি: উপাদনে ব্যবহৃত প্রযুক্তি ও দক্ষতার ঘাটতির কারণে ক্রেতার চাহিদা অনুপাতে গুণগত মানের পণ্য সরবরাহে ব্যর্থতা দেখা দেয় ।