সংগীতগুণিদের জীবনী

অষ্টম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - সংগীত - তত্ত্বীয় | NCTB BOOK

লালন শাহ

ঝিনাইদহ জেলার হরিশপুর গ্রামে বাস করতেন সম্পন্ন গৃহস্থ গোলাম কাদির দেওয়ান। তার পুত্র দরিবুল্লা
দেওয়ান ও পুত্রবধূ আমিনা খাতুনের ছিল তিন পুত্র সন্তান। বড়ো ছেলের নাম আলম, মেজো ছেলের নাম কলম
ও ছোটো ছেলের নাম ছিল লালন। এই ছোটো ছেলে লালনই পরবর্তীকালে নিজ প্রতিভা ও সাধনার বলে
হয়েছিলেন লালন শাহ্।

বাংলার এই অধ্যাত্ম সাধক ও কবি লালন শাহের জন্ম ১১৭৯ সালের ১ কার্তিক মোতাবেক ১৭৭৪ সালের ১৪
অক্টোবর মতান্তরে ১৭ অক্টোবর। তার জন্মের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই পিতা দরিবুল্লা দেওয়ানের মৃত্যু ঘটে।
বড়ো ভাই আলম জীবিকার সন্ধানে চলে যান কোলকাতায়। মেজো ভাই কলম পিতার সামান্য জমিজমা নিয়ে
কৃষি কাজ করে কোনোরকমে সংসার চালাতেন। লালন তাঁকে গৃহকাজ ও কৃষি কাজে সামান্য সাহায্য করেন।
এমনি অভাবের মধ্য দিয়ে লালনের শৈশবকাল কাটে।

হরিশপুর গ্রামের পাশেই ছিল এক প্রকাণ্ড মাঠ। ছোট লালন সেই মাঠে গরু ছেড়ে দিয়ে সমবয়সী রাখাল
ছেলেদের সাথে খেলা করতেন এবং গান গাইতেন, তবে গানের প্রতিই ছিল তাঁর প্রবল আগ্রহ। তাঁর কণ্ঠটি
ছিল যেমন শ্রুতিমধুর তেমনি ছিল গায়ন ভঙ্গি। তার গান শুনে মাঠে ও জমিতে কর্মরত সবাই মুগ্ধ হয়ে যেত।
লালনও এতে উৎসাহ বোধ করতেন। এভাবেই সংগীতের প্রতি তার আকর্ষণ বাড়তে থাকে। সে সময়ে তাদের
ও আশেপাশের গ্রামগুলোতে প্রায়ই পালাগান, কীর্তন, জারি, কবিগান, যাত্রাগান, গাজীর গান ইত্যাদি নানা
রকম গানের আসর বসত। লালন যখন তখন ছুটে যেতেন সেসব আসরে গান শুনতে। এই গানের আসরে
যাওয়া নিয়ে মেজো ভাই কলমের শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে তাকে ঘরও ছাড়তে হয়েছিল। গৃহত্যাগী লালন আশ্রয়
পান সে এলাকার অবস্থাপন্ন গৃহস্থ ইনু কাজীর বাড়িতে। এভাবে লালন কৈশোরে পদার্পণ করেন; ইতোমধ্যে
তার মাতৃবিয়োগ ঘটে।

মায়ের মৃত্যুর পর লালন পুরোপুরি গৃহত্যাগী হয়ে দিন কাটাতে থাকেন গানের আসরে, পীর-ফকিরের
আস্তানায়, হাটে-ঘাটে। এমনি লক্ষ্যহীনভাবে নানাদিকে ঘুরে ফিরে অবশেষে লালন সাধক পুরুষ সিরাজ
শাহের নজরে পড়েন। সিরাজ শাহের নিবাস ছিল হরিশপুরে। তিনি ছিলেন পালকি বাহক। গ্রামের লোকেরা।
তাকে 'ছিরাবদ্দি বেহারা' বলে ডাকত। তিনি ছিলেন ভাবসাধক। সিরাজ শাহের অধ্যাত্ম গুরু ছিলেন আমানদি
শাহ। আমানন্দি শাহের গুরু ছিলেন মানিক শাহ এবং তিনি ছিলেন সিলেটের বিখ্যাত সাধক আমানতুল্লা শাহের
শিষ্য। ভাই সাধক ঘরানার অনুসারী হিসেবে সেসময় অধ্যাত্ম সাধক সিরাজ শাহের যথেষ্ট সম্মান ছিল। দয়ালু
সিরাজশাহ সংসার ত্যাগী লালনকে পুত্র স্নেহে বুকে টেনে নেন। লালনেরও তাঁর প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা জন্মে এবং
তাঁর কাছেই দীক্ষা গ্রহণ করেন। দীক্ষা গ্রহণ করার পর শুরু ও গুরুমায়ের সেবায় লালনের দিন কাটতে থাকে,
এর পাশাপাশি চলে সাধুসঙ্গ। এভাবেই তার তত্ত্ব জ্ঞানের ভাণ্ডার পূর্ণ হতে থাকে। এ অবস্থায় বিবাগী লালনকে
সংসারমুখী করার উদ্দেশ্যে সিরাজ শাহ সেই গ্রামের মেছের শাহ ফকিরের কন্যার সাথে তার বিবাহ দেন। কিন্তু
অল্পদিনের মধ্যেই লালনের পত্নীবিয়োগ ঘটে। সে আঘাত ভুলতে লালন গুরু ও গুরুমার সেবায় আরো
মনোযোগী হন এবং অধ্যাত্ম সাধনায় গভীরভাবে আত্মনিয়োগ করেন। সেবায় তুষ্ট হয়ে এ সময়েই সিরাজ শাহ্
লালনকে পূর্ণ ফকিরি ও খেরকা (ফকিরি পোশাক) প্রদান করেন।

১৭৯৮ সালে সিরাজ শাহ্ এবং এর কিছুদিন পর তার স্ত্রী মারা যান। গুরু ও গুরুমাকে হারিয়ে লালন অত্যন্ত
অসহায় হয়ে পড়েন। গুরু প্রদত্ত খেরকা এবং আঁচল-ঝোলা সম্বল করে তিনি অজানার পথে হরিশপুর ত্যাগ
করে তীর্থস্থান ভ্রমণ করতে থাকেন।

একবার তিনি রাজশাহীর খেতুরির মেলায় যোগ দিয়ে ফেরার পথে নৌকায় প্রচণ্ড গুটিবসন্তে আক্রান্ত হন। মাঝি
ও যাত্রীরা তাকে অচেতন অবস্থায় কালীগঙ্গা নদীর তীরে ফেলে রেখে চলে যায়। পার্শ্ববর্তী ছেউড়িয়া গ্রামের
মলম কারিগর (তন্তুবায়) মুমূর্ষ অবস্থায় তাঁকে নদীতীরে দেখতে পেয়ে নিজগৃহে নিয়ে যান এবং নিরলস
সেবাযত্ন করে তাকে সুস্থ করে তোলেন। এ ব্যাপারে মলমের স্ত্রীও আন্তরিক সহযোগিতা করেন। সে যাত্রায়
আরোগ্য লাভ করলেও লালনের একটি চোখ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়।

আরোগ্য লাভের পর লালনের পরিচয় পেয়ে মলম ও তাঁর স্ত্রী পরম শ্রদ্ধাভরে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। শুধু
তাই নয়, গুরুর প্রতি অসামান্য ভক্তির নিদর্শন স্বরূপ মলম গুরুর আশ্রম তৈরির জন্য নিজের বসতবাড়ি ও ষোলো
বিঘা জমি লালনের নামে উইল করে দেন। সে জমিতেই লালন শাহ্ সাধু ও ভক্তদের জন্য আশ্রম গড়ে তোলেন
যা আজও 'লালন শাহের আখড়া' নামে পরিচিত।

এই ছেউড়িয়াতেই লালনের বাকি জীবন অতিবাহিত হয়। এখানে লালন তার সেবার জন্য বিশাখা নামে এক
সাধক মহিলাকে বিবাহ করেন। আরো জানা যায় যে, তাঁদের কোনো সন্তান হয়নি বলে বিশাখা লালনের
অনুমতি নিয়ে একটি পোষ্য কন্যা গ্রহণ করেছিলেন। এতেই প্রমাণিত হয় যে, ত্যাগী ও সংসার বিবাগী সাধক
হয়েও লালন সংসার বিচ্ছিন্ন সন্ন্যাস জীবনের পক্ষপাতি ছিলেন না। স্ত্রী, পোষ্য কন্যা এবং অনুসারী শিষ্যদের
নিয়েই লালন গড়ে তুলেছিলেন তাঁর সাধনার জগত।

লালনের অধিকাংশ গান এই ছেউড়িয়াতেই রচিত হয়। তাঁর গানের মূল বিষয় ছিল মানবপ্রেম। তিনি গানগুলো
মুখে মুখে রচনা করতেন এবং শিষ্যরা তা লিখে রাখতেন। কালক্রমে নিজ বৈশিষ্ট্য গুণেই লালনের গানগুলো
'লালনগীতি' নামে পরিচিত লাভ করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। লোক জীবনের এমন কোন বিষয় নেই যা লালনের
গানে ঠাই পায়নি। মারফতি, মুর্সিদি, দেহতত্ত্ব, মনশিক্ষা, প্রার্থনা, নবীতত্ত্ব, বিচ্ছেদী, মানবতাবাদ, একেশ্বরবাদ,
অধ্যাত্মবাদ ইত্যাদি। নিগুঢ় তাত্ত্বিক মত সুন্দরভাবে স্থান লাভ করেছে তার গানে। এ প্রসঙ্গে তার কিছু বিখ্যাত
গানের প্রথম কলি উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন আমি একদিনও না দেখিলাম তারে', 'সবলোকে কয়
লালন কি জাত সংসারে', 'কোথায় হে দয়াল কাণ্ডারী', 'এলাহি আলামিন গো আল্লা', 'মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার",
'পারে লয়ে যাও আমায়, 'পারে কে যাবি নবীর নৌকাতে আয়', 'কোন সাধনে শমন জ্বালা যায়', 'আজব আয়না
মহল নদি গভীরে', 'তিন পাগলে হলো মেলা নদেয় এসে', 'কে কথা কয়রে দেখা দেয় না', 'মিলন হবে
কতদিনে আমার মনের মানুষের সনে', 'দিন থাকতে মুরশিদ রতন চিনে নে না', 'সাই আমার কখন খেলে কোন
খেলা' ইত্যাদি।

একমাত্র সংগীত রচনার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে যে কয়জন সাধক কবি বাঙালি মানসলোকে ধ্রুব তারার ন্যায়
উজ্জ্বল হয়ে আছেন, মরমি সাধক লালন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। জানা যায় যে, লালন সংগীতে বিমোহিত হয়ে
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে 'বাংলা সাহিত্যের অসাধারণ কবি' বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। কেবল তাই
নয়, রবীন্দ্রনাথ তাঁর সংগীত রচনার অনেক ক্ষেত্রে লালনের ভাবে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন বলেও গবেষকগণ মনে করেন।

ভাবে, রসে, দর্শনে, লালনের সংগীত যে অমৃত লোকের সন্ধান দিয়েছে তা চিরকালই আমাদের জীবন দর্শনের
উৎস হয়ে থাকবে। সংগীতের এই অসাধারণ পুরুষ বাংলা ১২৯৭ সালের ১ কার্তিক (১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের ১৭
অক্টোবর ১১৮ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি হিসেবে সবার কাছে আদৃত। অসংখ্য কবিতার পাশাপাশি তিনি সাহিত্যের সব শাখাতেই
আশ্চর্য সুন্দর সব লেখা উপহার দিয়েছেন। বাংলা সাহিত্য, সংগীতের এমন কোনো দিক নেই যা তাঁর
সৃষ্টি-স্পর্শে সমৃদ্ধ হয়নি। 'চোখের বালি, ঘরে বাইরে, যোগাযোগ 'চার অধ্যায়, শেষের কবিতা তার
উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। তার নাটক মুক্তধারা, শারদোৎসব', 'রক্তকরবী', 'ডাকঘর ইত্যাদি বাংলা সাহিত্যে
উল্লেখযোগ্য সংযোজন। রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ সাহিত্য বাঙালির চিন্তার জগৎকে প্রসারিত ও পরিণত করেছে।
তাঁর সাহিত্য, সাহিত্যের পথে', 'কালান্তর', 'সভ্যতার সংকট' প্রভৃতি প্রবন্ধের বই মানুষকে অনেক চিন্তার
খোরাক জুগিয়েছে। বলা যায়, বাংলা ভাষা তাঁর হাতেই আধুনিক রূপটি লাভ করেছে।

এত কিছু করার পরে রবীন্দ্রনাথ নিজে মনে করতেন তাঁর সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে গানই সবচেয়ে বেশিদিন টিকবে।
এ থেকে বোঝা যায় নিজের লেখা গানকে তিনি কত উচ্চমূল্য দিতেন। তিনি শুধু গান লেখেননি, গানে সুর
দিয়েছেন, নিজে গেয়েছেন এবং অন্যদের শিখিয়ে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে চমৎকার সব অনুষ্ঠান করেছেন।
রুচিশীল মানুষ আর ভালো সমাজ তৈরি করার জন্য তিনি অক্লান্তভাবে কাজ করেছেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি শহর
থেকে দূরে প্রকৃতির কোলে বোলপুরে নিজের মতো করে 'শান্তিনিকেতন' শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি গড়েছেন। তিনি
ছাত্রদের লেখাপড়া শেখানোর সাথে সাথে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। শান্তিনিকেতনে
প্রকৃতির সাথে সম্পর্কিত ঋতুভিত্তিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতেন সারা বছর। এভাবে রবীন্দ্রনাথ বাঙালির
নাগরিক সংস্কৃতির একটা ধারা তৈরি করে নিয়ে গেছেন। এটাই আজ অবধি বাঙালি সংস্কৃতির মূলধারা।

রবীন্দ্রনাথের জন্ম কোলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে বাংলা ১২৬৮ সালের ২৫ বৈশাখ তারিখে, তখন
১৮৬১ খ্রিস্টাব্দ। তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন সমাজ-সংস্কারক রাজা রামমোহন রায়ের
ভাবধারায় বিশ্বাসী। রামমোহনকে এদেশে আধুনিক শিক্ষা ও ভাবনার পথপ্রদর্শক হিসেবে গণ্য করা হয়।
সেদিক থেকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সময়ের তুলনায় মুক্ত উদার পরিবেশে মানুষ হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বালক
বয়সে পিতার সঙ্গে ভ্রমণের সঙ্গী হয়ে তাঁর চিন্তাধারাতে অনুপ্রাণিত হন। তাঁর অনেক গানে এই গভীর দার্শনিক
ভাব প্রকাশ পেয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ শৈশবে শিক্ষকের কাছে যেমন পড়া শিখেছেন তেমনি আবার পানও শিখেছেন সংগীত শিক্ষকের
নিকট। গান শিখেছেন প্রথমে পারিবারিক বন্ধু বিষ্ণু চক্রবর্তী ও শ্রীকন্ঠ সিংহের কাছে। তারপর লিখেছেন প্রসিদ্ধ
বাঙালি সংগীতজ্ঞ যদুভট্টের কাছে। দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরও তার সংগীত চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
রেখেছেন। পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের আমল থেকেই তাঁদের পরিবারে পাশ্চাত্য সংগীতের কিছু চর্চা
ছিল। তাছাড়া সতের বছর বয়সে প্রথমবার বিলেত গিয়ে রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্য সংগীতের সাথে ভালোভাবে
পরিচিত হন। ভারতীয় শাস্ত্রীয়সংগীতের মতো পাশ্চাত্য সংগীত থেকেও তিনি অনেক সুর নিজের গানে ব্যবহার
করেছেন। এসবের পাশাপাশি দেশীয় লোকসংগীত, কীর্তন, বাউল গান প্রভৃতির সুরও তাকে অনুপ্রাণিত
করেছে। তিনি যেমন লালন শাহের গান ভালোবাসতেন, তেমনি পছন্দ করতেন নানা ধরনের লোকসংগীত আর
উপমহাদেশের নানা অঞ্চলের পান। এসব গানের সুরে তিনি বহু গান রচনা করেছেন।

অনেক বিশেষজ্ঞ রবীন্দ্রনাথের সংগীত জীবনকে তিনটি যুগে ভাগ করেন। প্রথম যুগ হলো ১৮৮১ থেকে ১৯০০
পর্যন্ত। এটিকে ধরা হয় তাঁর প্রস্তুতি পর্ব। ১৯০১ থেকে ১৯২০ পর্যন্ত বিস্তৃত দ্বিতীয় যুগকে তাঁরা কবির
পরীক্ষা-নিরীক্ষার যুগ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তৃতীয় যুগ হলো ১৯২১ থেকে ১৯৪১-এ তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত।

এ হলো পরিণত পর্ব। এছাড়া কবি নিজে ভাবের দিক থেকে তাঁর গানকে প্রধানত চারটি ভাগে ভাগ করেছেন
- যথাক্রমে পূজা, স্বদেশ, প্রেম ও প্রকৃতি। এছাড়াও গীতবিতানে বিচিত্র ও আনুষ্ঠানিক নামে দুটি পর্যায় আছে।
ধ্রুপদ, ধামার, খেয়াল, ঠুমরি, টপ্পার মতো হিন্দুস্তানি সুরের কাঠামোয় যেমন তিনি গান বেঁধেছেন তেমনি
বাংলার লোকসংগীত, পশ্চিমের অপেরা সংগীত বা বিভিন্ন প্রাদেশিক ভারতের লোক গানের সুর ব্যবহার করে
স্বাতন্ত্র্যে তাঁর সংগীতকে রূপময় করেছেন। তারই গানের মাধ্যমে ধ্রুপদ গানের স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী ও
আভোগ-এ চার ভাগের বা তুকের কাঠামোটি বাংলাগানে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

রবীন্দ্রসংগীত নানা বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। তার মধ্যে তাল ও ছন্দ বৈচিত্র্যও উল্লেখযোগ্য বিষয়। গানের ভাব প্রকাশের
জন্য তালের ব্যবহার ছাড়াও নতুন কয়েকটি ছন্দ প্রয়োগ করেছেন। ছয়টি নতুন তালের সৃষ্টি করেছেন তিনি।
এগুলো হলো- রূপকড়া, নবতাল, ষষ্ঠী, একাদশী, ঝম্পক, নবপঞ্চ।

বিভিন্ন ভাবের, উচ্চ কাব্যগুণের দুই হাজারের বেশি গান তিনি রচনা করেছেন। এমনি করে উনিশ শতকের
বাংলা কাব্যসংগীত রবীন্দ্রনাথের সাধনায় উজ্জ্বল এবং সমৃদ্ধ হয়েছে। বাণী রচনায় ও সুর সংযোজনে
বাংলাগানকে প্রায় একক প্রচেষ্টায় তিনি চটুল রস থেকে মুক্ত করে এমন গভীরতা দেন। তিনি সংগীত, নৃত্য ও
নাটকের অসাধারণ মিলন ঘটান "বালীকি প্রতিভা', 'মায়ার খেলা', 'শাপমোচন', 'শ্যামা', 'চিত্রাঙ্গদা',
'চণ্ডালিকা' প্রভৃতি সার্থক গীতিনৃত্যনাট্য রচনা করে। ভাষা, সাহিত্য এবং শিক্ষা সংস্কৃতিতে উন্নত মানের
সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক বাঙালির জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছেন। তাঁর লেখা ও গান
অনুপ্রেরণার উৎস। মুক্তিযুদ্ধের সময় রবীন্দ্রনাথের বহুগান গাওয়া হয়েছে, এমনকি যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের
কণ্ঠেও শোনা গেছে এই গান। তাঁর গান আমাদের শক্তি দেয়, শাস্তি দেয়— সুরে ও কথায়, ভাবের গভীরতায়
এ গান সবসময় উদ্দীপক এবং প্রাণময়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ (৭ আগস্ট ১৯৪১)
কোলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।

হাছন রাজা

সুনামগঞ্জ জেলার অন্তর্গত 'লক্ষণশ্রী' গ্রামে ১২৬১ বঙ্গাব্দের ১৭ পৌষ (১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে) হাছন রাজার জন্ম
হয়। 'লক্ষণশ্রী' গ্রামটি সে অঞ্চলে 'লক্ষণছিরি' বা 'লখনস্থিরি' নামে পরিচিত। তাঁর পিতার নাম ছিল দেওয়ান
আলী রাজা চৌধুরী এবং মাতার নাম ছিল হুরমত জাহান বিবি। তার বৈমাত্রেয় ভাই দেওয়ান ওবায়দুর রাজা
তার নাম রেখেছিলেন দেওয়ান অহিদুর রাজা চৌধুরী। দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদ ও গবেষক দেওয়ান মোহাম্মদ
আজরফ সাহেবের লেখা থেকে জানা যায় যে, সিলেটের তৎকালীন অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফারসি ভাষাবিদ নাজিরউল্লা
তার নামকরণ করেন হাছন রাজা। হাছন রাজা নিজেও এ নামেই পরিচিত হতে বেশি পছন্দ করতেন।

জানা যায় যে, হাছন রাজার পূর্ব পুরুষেরা ছিলেন হিন্দু আর্য গোষ্ঠির ক্ষত্রিয় শ্রেণির উত্তর প্রদেশের অধিবাসী ।
ষোড়শ শতাব্দীতে তারা বসতি স্থাপনের জন্য বর্ধমান জেলায় এবং সেখান থেকে যশোরে আসেন। সেসব
স্থানে স্থায়ী বসতি স্থাপনে ব্যর্থ হয়ে তারা সিলেট অঞ্চলে চলে আসেন এবং ধীরে ধীরে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন।
সেই জমিদার বংশের অন্যতম বংশধর দেওয়ান বাবু রায় চৌধুরী পবিত্র ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নিয়ে 'বাবু খাঁ' নাম
গ্রহণ করেন। তারও কয়েক পুরুষ পরের বংশধর হাছন রাজার পিতা দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী 'লক্ষণশ্রী
গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। হাছন রাজা তার দ্বিতীয় পুত্র। হাছন রাজা দেখতে অত্যন্ত আকর্ষণীয় চেহারার
অধিকারী ছিলেন। লম্বা সুঠাম দেহ, বলশালী বাহু, সুতীক্ষ্ম নাসিকা, কোকড়া চুল, টানা-টানা চোখ -এ সকল
দৈহিক গঠনের জন্য তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রিয়।

শৈশবকালে হাছন রাজা অত্যন্ত চঞ্চল প্রকৃতির ছিলেন। লেখাপড়ার প্রতি তার তেমন আগ্রহ ছিল না। তবে
নৌকা বিহার, ঘোড়ায় চড়া, হাতিতে চড়া, পশুপাখি শিকার করা ইত্যাদি কাজে তাঁর খুব ঝোঁক ছিল। যৌবনে
ঘোড়সওয়ারী হিসেবে তিনি ছিলেন কিংবদন্তিসম জনপ্রিয়। ঘোড়দৌড়ে সেকালের নবাবদের ও ইংরেজ
সাহেবদের ঘোড়াকে হারিয়ে তিনি বহুবার পুরস্কার জিতে নিয়েছিলেন।

তিনি লেখপড়া জানতেন না বলে যে জনশ্রুতি রয়েছে, আসলে তা সত্য নয়। বংশের রীতি অনুযায়ী যতটুকু
বিদ্যালাভ প্রয়োজন, ততটুকু শিক্ষা তাঁর ছিল। বরং পারিবারিক নিয়ম অনুযায়ী আরবি শিক্ষার পাশাপাশি তিনি
সংস্কৃত ও বাংলা ভাষার চর্চা করেছিলেন বলেও গবেষকগণ মনে করেন। সে সময়ের জমি-জমা সংক্রান্ত অনেক
কাগজপত্রে তাঁর সুন্দর স্বাক্ষরের কথাও অনেকে তাদের লেখায় উল্লেখ করেছেন। জানা যায় যে, অনাগ্রহের
কারণে বাল্যকালে প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জিত না হওয়ায় পরিণত বয়সে তিনি শিক্ষা প্রসারে ব্রতী হয়েছিলেন।

মাত্র পনের বছর বয়সে হাছন রাজার পিতৃবিয়োগ ঘটে। এই অল্প বয়সে জমিদারি হাতে পেয়ে তার কৈশোর
ও যৌবন কাটে যথেষ্ট ভোগ বিলাসের মধ্য দিয়ে। পরবর্তীতে এই ভোগ বিলাসের প্রতি ক্রমেই তার অনাশক্তি
দেখা দেয়। জাগতিক সব কিছুকেই তাঁর তুচ্ছ বলে মনে হয়; অন্তরে জন্ম নেয় আধ্যাত্মিক চেতনা। বাসনা
জাগে সৃষ্টির রহস্য জানার। এই আধ্যাত্মিক চেতনাবোধ থেকেই প্রকাশ ঘটে মরমি গীতিকবি হাছন রাজার।
স্রষ্টা ও সৃষ্টির প্রতি সু-গভীর প্রেমই হাছন রাজার গানের মূল দর্শন। তাই স্রষ্টাকে তিনি যেমন দেখেছেন 'মাওলা'
বা 'মৌলা' রূপে, তেমনি দেখেছেন, 'সোনাবন্ধু', 'কানাই', 'হাছনজান' ও 'কালা' রূপে।

বিশেষজ্ঞগণও তাঁর রচনাকে মোট তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা- ১। প্রেম ২। বৈরাগ্য বা অনাসক্তি
ও ৩। উচ্চানুভূতি বা অতিন্দ্রিয়ানুভূতি। তবে সকল ধারাতেই প্রেমিক হাছন রাজার উপস্থিতি সুস্পষ্ট। এ পর্যন্ত
সংগৃহীত হাছন রাজার গানের সংখ্যা প্রায় দুই শতাধিক। সংখ্যার দিক থেকে ততটা উল্লেখযোগ্য না হলেও
বাণী ও সুরগত দিক থেকে তাঁর গান সহজ সরল ও প্রাঞ্জল হওয়ায় জনপ্রিয়তা পেয়েছে অস্বাভাবিক। আঞ্চলিক
ভাষা ও সুরের সাবলীল ও সার্থক প্রয়োগের কারণে তাঁর গান বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে এমন এক নতুন
মাত্রাযোগ করতে সক্ষম হয়, যা তাঁকে সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতায় কালজয়ী করে তোলে।

স্বভাবকবিদের মতো মুখে মুখে গান রচনা করতেন বলে হাছন রাজা স্বভাবকবি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি
নিজ হাতে গান লিখতেন না। অবিরাম মুখে মুখে রচনা করতেন এবং নিয়োজিত কর্মচারিরা তা লিখে রাখত।
কখনো কখনো তাঁর সহচর সহচরীগণও এ কাজে তাঁকে সাহায্য করতেন। রাতে গানের জলসায় এ সকল গান
বিভিন্ন গায়িকাদের দিয়ে গাওয়ানো হতো। আবিদ আলী নামে হাছন রাজার প্রিয় ঢোল বাদক সেসব গানের
সাথে সঙ্গতও করতেন। হাছনরাজা নিজেও মাঝে-মধ্যে তাদের সাথে ঢোল বাজাতেন। সাথে মন্দিরা বাজাতেন
সোনাজান নামে একজন গায়িকা। জানা যায় যে, তাঁর প্রিয় পরিচারিকা দিলারাই ছিল সেসব জলসার মূল
পরিচালক। প্রতিদিন জলসায় পরিবেশিত এ গানগুলোর সংকলন নিয়েই প্রকাশিত হয় তাঁর 'হাসন উদাস'
গ্রন্থটি।

হাছন রাজা বিয়ে করেছিলেন বেশ কয়েকবার। তাঁর সন্তানদের মধ্যে একলীমুর রাজা ছিলেন তাঁর কবি
প্রতিভার সুযোগ্য উত্তরসূরী। একলীমুর রাজার গানও এক সময় স্থানীয়ভাবে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তাঁর
জ্যেষ্ঠপুত্র তৈমুর রাজাও অনেক গান রচনা করেন বলে জানা যায়। ১৯১৪ সালে হাছন রাজা জীবিত
থাকাকালীন সময়েই তাঁর 'হাসন উদাস' গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল। এ গ্রন্থটিতে প্রায় দুইশত গান স্থান পায়।

এর পরে 'সৌখিন বাহার' নামে গাছপালা, পশুপাখি এবং নারী প্রকৃতি বিষয়ক তথ্যবহুল একটি বইও তাঁর
প্রকাশিত হয়েছিল বলে জানা যায়।

হাছন রাজার বিভিন্ন ধারার গানের মধ্য থেকে কিছু গানের প্রথম কলি উল্লেখ করা হল। যেমন: ঐশী প্রেমমূলক
গান-- 'বাউল কে বানাইলো রে, হাছন রাজারে বাউলা কে বানাইলো রে', 'আমি যাইমু ও যাইমু আল্লার সঙ্গে
বৈরাগ্য বিষয়ক গান— 'লোকে বলে বলেরে ঘরবাড়ি ভালা না আমার', 'মাটির পিঞ্জিরার মাঝে বন্দি হইয়ারে
কান্দে হাছন রাজার মন ময়নায় রে', 'হাছন রাজায় কয়, আমি কিছু নয়রে আমি কিছু নয়, প্রেমের গান- 'নেশা
লাগিলরে বাঁকা দুই নয়নে', 'সোনা বন্ধে আমারে দিওয়ানা বানাইলো' এবং অতিন্দ্রিয়ানুভূতির গান— 'রূপ
দেখিলাম রে নয়নে, আপনার রূপ দেখিলাম রে আমার মাঝত বাহির হইয়া দেখা দিল আমারে' ইত্যাদি।

কেবলমাত্র তিনটি ধারার গানেই হাছন রাজার যে আধ্যাত্মিক চেতনা, প্রেম তথা ইহলৌকিক ও পরলৌকিক
বিষয়গুলো সহজ বর্ণনায় সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে বাংলা সাহিত্যে তা বিরল। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথও হাছন
রাজার গানে আকৃষ্ট হয়ে তার রচনার প্রশংসা করেছিলেন। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, তাঁর রচনায়
সর্বক্ষেত্রেই প্রেমের ভাবটি পরিস্ফুট হয়েছে সর্বাধিক। তিনি নিজেও এ ব্যাপারে বলতেন, 'যার প্রেম নেই, তার
কিছুই নেই'। তিনি একটি গানে আরও স্পষ্টভাবে বলেছেন-
'আমি করিরে মানা, অপ্রেমিকে গান আমার শুনিবে না।

কিরা দিই, কসম দিই, আমার বই কেউ হাতে নিবে না
অপ্রেমিক পান শুনিলে কিছুমাত্র বুঝবে না,

কানার হাতে সোনা দিলে লাল ধলা চিনবে না।

হাছন রাজার কসম দেয়, আর দেয় মানা,

আমার গান শুনবে না যার প্রেম নাই জানা।

বাংলা ১৩২৯ সালের ২২ অগ্রহায়ণ ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে এই প্রেমবাদী অমর গীতিকবি হাছন রাজার মৃত্যু হয়।

ওস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ

যে সমস্ত সংগীত সাধক ভারতবর্ষের সংগীত জগতকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করে স্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁদের মধ্যে
ওস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ এক উজ্জ্বলতম জ্যোতিস্ক। ওস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ এমন এক অলৌকিক প্রতিভার
নাম, যার সংগীতপ্রেম, সাধনা ও সৃজনী শক্তির প্রভাব কিরানা ঘরানা তথা ভারতবর্ষের সংগীতকে করেছিল
বেগবান ও সমৃদ্ধতর। শুধু তাই নয়, সংগীতকে সর্বসাধারণের মধ্যে প্রচারের জন্য তাঁর সার্থক অবদান
অনস্বীকার্য। কিরানা ঘরানার এই অবিসংবাদী সুরসম্রাট আব্দুল করিম খাঁ ১৮৭২ সালে ১১ নভেম্বর উত্তর
প্রদেশের মোজাফ্ফর নগর জেলার কিরানায় জন্মগ্রহণ করেন। আব্দুল করিম খাঁর পিতামহ মুহম্মদ শাহর
রাজত্বকালে রাজানুগ্রহ পেয়েছিলেন। পিতা কালে খাঁ ও চাচা আব্দুল্লাহ্ খাঁ ছিলেন কিরানা ঘরানার প্রধান
গুণিব্যক্তিত্ব। তার মাতা ছিলেন লাঠিয়াল কুস্তিগির বংশের মেয়ে। আব্দুল করিম খাঁ শৈশবকাল থেকেই
সংগীতের খুব ভক্ত ছিলেন। তাই শৈশবেই তিনি বীণা, সেতার, তবলা, নাকাড়া, জলতরঙ্গ প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র
বাদনে বেশ পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন। এই প্রতিভাবান সংগীতশিল্পী শৈশবে পিতা কালে খাঁ ও চাচা আব্দুল্লাহ্
খাঁর কাছে সংগীতের তালিম শুরু করেন। পরবর্তীতে হায়দরাবাদের নিজামের সভাগায়ক ওস্তাদ নান্নে খাঁর
কাছে আব্দুল করিম খাঁ তালিম নেন। তৎকালে দুই আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব সিডিডির সাঁই বাবা ও নাগপুরের
তাজউদ্দিন বাবার সান্নিধ্যে এসে ওস্তাদ আব্দুল করিম খাঁর সংগীত জীবনের ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়।

আব্দুল করিম খাঁ শিশুকাল থেকেই অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী ছিলেন । শোনা যায়, ১৮৭৮ সালে মাত্র ছয়
বছর বয়সে সংগীত পরিবেশন করে তিনি তৎকালীন সংগীতগুণিদের তাক লাগিয়ে দেন। ১৮৮৩ সালে মাত্র
এগারো বছর বয়সে আব্দুল করিম খাঁ তার ভ্রাতা আব্দুল লতিফ খাঁর সঙ্গে যুগলবন্দী রীতিতে রাগ মুলতানী ও
পুরবীতে তান সরগম এর বহর শুনিয়ে অন্যতম শ্রেষ্ঠ গায়কের স্বীকৃতি লাভ করেন। ১৮৮৯ সালে ১৭ বছর
বয়সে মহীশূরের মহামান্য মহারাজার দশহারা উৎসবে রাগ টোড়ী পরিবেশন করেন। তাঁর এই গানে মুগ্ধ হয়ে
মহারাজা দামি শাল ও সোনার মণিবন্ধ উপহার দেন। তাঁর গানে মুগ্ধ হয়ে জুনাগড়ের নবাবও প্রচুর উপহার,
উপঢৌকন প্রদান করেন এবং এক বছরকাল তাঁর দরবারে সভাপায়ক হিসেবে নিযুক্ত থাকেন । অন্যদিকে তাঁর
বিনয়ী ব্যবহার, সুরেলা গলা, মাহফিলের শ্রোতা বুঝে মনোরঞ্জন করার ক্ষমতায় বড়োদার মহারাজা ও মহারাণী
মুগ্ধ হয়ে অতি অল্প বয়স হওয়া সত্ত্বেও প্রাসাদের মেয়েদের সংগীত শিক্ষা দেওয়ার চাকরি দেন । শোনা যায়,
বড়োদার মহারাজার দরবারে বড়োলাট লর্ড এসৃগিন আব্দুল করিম খাঁর গান শুনে মুগ্ধ হয়ে একটি সার্টিফিকেট
ও দুইটি সোনার আংটি উপহার দিয়েছিলেন। এছাড়া মহাত্মা গান্ধীও তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হয়ে উচ্ছসিত প্রশংসা
করেছিলেন। ১৯২৪ সালে দিলীপকুমার রায়ের আমন্ত্রণে তিনি প্রথম কোলকাতায় সংগীত পরিবেশন করেন।
ওস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ ১৯৩৬ সালে কোলকাতায় অলবেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্সে সংগীত পরিবেশন করে
বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন ।

কিরানা ঘরানার দুইটি ধারা। একটি আব্দুল করিম খাঁর এবং অন্যটি আব্দুল ওয়াহিদ খাঁর। এই দুই সংগীত
ধারার মধ্যে কিছু কিছু পার্থক্য থাকলেও মূল চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য ছিল রাগ বিস্তারের ক্ষেত্রে। ওস্তাদ আব্দুল করিম
খাঁ খেয়ালে নতুন ধরনের ছন্দবহুল সরগম এর প্রচলন ঘটান এবং তিনিই প্রথম বড়ো খেয়াল অংশে
অতিবিলম্বিত রাগ বিস্তারের প্রচলন ঘটান। শোনা যায়, এই অতি বিলম্বিত অংশে সুর লাগানোর কায়দা তিনি
পেয়েছিলেন হদু খাঁ এর পুত্র রহমত খাঁ এর কাছ থেকে। ১৯১৬ সালে ওস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ পুণাতে 'আর্য
সংগীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। যার একটি শাখা ১৯৭১ সালে চেন্নাইতে ( মাদ্রাজে ) স্থাপিত হয়। এই দুই
জায়গাতেই তিনি গুরুকূল সংগীত শিক্ষা পদ্ধতিতে তালিম দিতেন। সেই স্কুলে শিষ্য-শিষ্যাবর্গের থাকা খাওয়ার
ব্যবস্থা স্কুলকেই বহন করতে হতো। আর এ কারণে তিনি নিয়মিত আট আনা টিকিটে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের

আয়োজন করতেন। ঐসব অনুষ্ঠানে শিষ্য-শিষ্যাদের গান ও নাটক পরিবেশন করতে হতো। এছাড়া খাঁ সাহেব
নিজেও সেই অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করতেন। আব্দুল করিম খাঁর গায়ন বৈশিষ্ট্যের মধ্যে প্রথমেই আসে
তাঁর কন্ঠ। তাঁর কণ্ঠের আওয়াজ ছিল বাঁশির মতো। তাঁর গায়ন শৈলীর বিশেষ কতকগুলো বৈশিষ্ট্য ছিল। তিনি
"অ" বা "হ" বর্ণ প্রয়োগ করে কন্ঠের আওয়াজ লাগাতেন। তাঁর গায়কীতে 'অ-কার' অথবা 'হ-কার" বর্ণের
বিস্তারের মধ্যে বেশিরভাগ থাকত বোল বিস্তার। সুর ও শ্রুতির ওপর তিনি বেশি জোর দিতেন। আব্দুল করিম
যাঁর গান ছিল ধ্যান পর্যায়ের। তিনি যখন গাইতেন তখন সুরের গভীরে লীন হয়ে যেতেন, আর শ্রোতারাও তাঁর
সেই গানে সম্মোহিত হয়ে যেত। আব্দুল করিম খাঁ বোলের সাহায্যে একটির পর একটি স্বর পেরিয়ে রাগ বিস্তার
করতেন, আর সেই স্বর বিস্তারে থাকত শান্তরস সমৃদ্ধ এক গভীর সুরব্যঞ্জনা। ওস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ ভারি
গমক তান ও দ্রুত সপাট তান খুব পছন্দ করতেন। তবে সুর ও সরগম এর উপর প্রাধান্য দিতেন বেশি। তিনি
বোল-বাট বা লয়কারীর আবেদনকে অভূতপূর্ব সরগম' রচনার মাধ্যমে প্রকাশ করতেন। তাঁর সেই অভূতপূর্ব
সরগম রচনার ক্ষমতায় অভিভূত হয়ে যেতেন শ্রোতা দর্শক। তার গায়ন শৈলীতে কর্ণাটকি ও হিন্দুস্তানি সংগীতের
অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছিল। তাঁর পাওয়া 'যমুনা কি তাঁর মত যাইয়ো রাখে বিখ্যাত ভৈরবী ঠুমরিটি তৎকালীন
গুণিসমাজে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। এটি তাঁর নিজের রচনা। এছাড়া তাঁর গাওয়া 'পিয়া বিন নাহি
আবত চৈন' এই ঠুমরিটিও বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। ওস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ খেয়াল, ঠুমরি, টপ্পা,
দাদরা, ভজন প্রভৃতি গীতরীতিতে যেমন সমান পারদর্শী ছিলেন তেমন বীণা বাদনেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ওস্তাদ
আব্দুল করিম খাঁর শিষ্য প্রশিষ্যের তালিকা বিশাল। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে বড়োদার রাজকুমার ফতেহ সিং,
সওয়াই গান্ধর্ব, দশরথবুয়া মূলে, সুরেশবাবু মানে, পণপত্রাও বেহরে, বালকৃষ্ণবুয়া কোপিলেশ্বরী, শামসুদ্দিন
খাঁ, প্যারে খাঁ, রৌশন আরা বেগম (ভাইজী), বিশ্বনাথয়া বঝে, সরস্বতী রাণে, হীরাবাঈ বড়োদেকর,
শংকররাও সরনায়েক প্রমুখ উল্লেখযোগ্য ।

ওস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ-ই প্রথম খেয়ালে রাগ বিস্তার ও ছন্দোলয়মুক্ত 'সরগম এর প্রচলন করে খেয়াল গানের
রূপ পাল্টে দেন। শুধু তাই নয় সংগীতের প্রচার ও প্রসারের জন্য তিনি দুটি সংগীত বিদ্যালয় স্থাপন ও আট
আনা মূল্যের টিকিটের বিনিময়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদিরও আয়োজন করেন। শাস্ত্রীয়সংগীতে এই বৈপ্লবিক
পরিবর্তনের জন্য তাকে 'রোমান্টিক মুভমেন্ট'-এর জন্মদাতা বলা যায়। ওস্তাদ আব্দুল করিম খাঁর আধ্যাত্মিক
জীবন ছিল উঁচু স্তরের। যে কারণে তার কাছে মানুষ মানুষে কোনো ভেদাভেদ ছিল না। এক কথায় তিনি ছিলেন
ভক্তিবাদী এক প্রেমিক, যার সন্ধান পাওয়া যায় তাঁর রচিত অনেক ভক্তিগীতিতে।

১৯৩৭ সালে ভক্তদের অনুরোধে মাদ্রাজের এক সংগীত সম্মেলনে যোগদান করেন ওস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ।
সেখান থেকে পণ্ডিচেরীতে যাওয়ার পথে হঠাৎ বুকে ব্যথা অনুভব করলেন। তিনি বুঝলেন যে, তাঁর অন্তিম সময়
উপস্থিত হয়েছে। ভাই পরবর্তী স্টেশন 'সিঙ্গাপেরুমল কোইলে' নেমে শিষ্যদের চাদর বিছিয়ে তানপুরা বাঁধার
আদেশ দিলেন। প্লাটফর্মে বসে তিনি 'দরবারী কানাড়া রাগটি গাইতে শুরু করলেন। আর এ রাগ গাইতে
গাইতেই ভারতবর্ষের কিরানা ঘরানার সুরসম্রাট ওস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ ১৯৩৭ সালের ২৭ অক্টোবর শেষ
নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

কাজী নজরুল ইসলাম

বাংলা সাহিত্যের অনন্য সাধারণ কবি, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, শিল্পী ও সুরস্রষ্টা কাজী নজরুল ইসলাম। এই অমিত
প্রতিভাধর কবি (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ অনুযায়ী ১৩ মোহররম ১৩১৭ হিজরি ২৪মে ১৮৯৯ সালে)
জন্মগ্রহণ করেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার অন্তর্গত জামুরিয়া থানার
চুরুলিয়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তাঁর পিতার নাম কাজী ফকির আহমদ, মাতা কাজী জাহেদা খাতুন।
চার ভাই-বোনের ভিতর কবি ছিলেন দ্বিতীয়। বড়ো ভাই কাজী সাহেবজান, দ্বিতীয় কাজী নজরুল ইসলাম,
তৃতীয় কাজী আলি হোসেন এবং বোন কাজী উম্মে কুলসুম। কথিত আছে, চার ভাইয়ের অকাল মৃত্যুর পর
কবির জন্ম হওয়ায় সবাই তাঁকে 'দুখু মিঞা' বলে ডাকত। আবার অনেকে বলেন শিশুকালে পিতৃবিয়োগ হওয়ায়
নিদারুণ দারিদ্রের ভিতর তাঁর বাল্যকাল অতিবাহিত হয়। সেই কারণেই তাঁকে 'দুখু মিঞা' বলে ডাকা হতো।
মাত্র নয় বৎসর বয়সে ৭ চৈত্র ১৩১৪ বঙ্গাব্দ ১৬ সফর ১৩২৬ হিজরি ২০ মার্চ ১৯০৮ সালে নজরুলের পিতার
মৃত্যু হয়। ফলে সংসারে দারিদ্র্য চরমে ওঠে। এ সময়ে নজরুল গ্রামের মক্তবের ছাত্র ছিলেন। এই মক্তব
থেকেই তিনি প্রাথমিক পরীক্ষায় পাশ করেন। কিন্তু নিদারুণ দারিদ্র্য আর সাংসারিক অশান্তির কারণে তার
স্বাভাবিক পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। সংসার চালানোর জন্য মাত্র দশ বৎসর বয়সে বালক নজরুলকে মক্তবে
শিক্ষকতা করতে হয়। শুধু তাই নয়, মসজিদে ইমামতি, মাজার শরিফে বিদমভগিরি, গ্রামে মোল্লাগিরি করতে
হয় অর্থ উপার্জনের জন্য। অত্যন্ত সৎ ধার্মিক মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করার ফলে পিতার ধর্মপরায়ণতা,
সততার দ্বারা বাল্যকালেই নজরুল প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং পরবর্তীতেও তা অটুট ছিল। নজরুলের স্বাভাবিক
পড়াশোনা বাধাপ্রাপ্ত হলেও তাঁর জ্ঞানপিপাসা থেমে থাকেনি। স্কুলের বিধিবদ্ধ পড়াশোনার বাইরে যাকিছু
শিক্ষণীয় সবকিছুই তাঁকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করত। কবি আরবি ও ফারসি ভাষার প্রথম পাঠ গ্রহণ করেন
মক্তবের শিক্ষক কাজী ফজলে আহমদের কাছে। তার পিতৃব্য (পিতার চাচাত ভাই) বজলে করিম ফারসি ভাষায়
সুপণ্ডিত ছিলেন এবং ফারসি ভাষায় কবিতা লিখতেন। তাঁর সাহচর্যে কবি আরবি ও ফারসি মিশ্রিত বাঙলা
কাব্য রচনা শুরু করেন। উক্ত ভাষা ও সাহিত্যচর্চা, ইমামতি, খিদমত পিরি পরবর্তীকালে সম্পূর্ণ নতুন ধারার
ইসলামি সংগীত বিশেষভাবে গজল গানে যথোপযুক্ত আরবি, ফারসি, উর্দু শব্দ প্রয়োগে সহায়তা করে।

কবি মাত্র বারো বছর বয়সে অর্থ উপার্জনের জন্য 'লেটো' দলে যোগ দেন। লেটোগান, কবি ও যাত্রা সম্বলিত
এক প্রকার গীতি । দুই দলের মধ্যে কবিতা ও গানের মাধ্যমে যেকোনো একটি বিষয়কে ভিত্তি করে লড়াই, এর
প্রধান উপজীব্য। কবি প্রাথমিকভাবে খুব সাধারণ অবস্থায় লেটো দলে যোগ দিলেও খুব কম সময়ের মধ্যেই
নিজ প্রতিভাবলে দলের শ্রেষ্ঠতম ওস্তাদ পদটি অধিকার করে নিয়েছিলেন। ওস্তাদ হওয়ার সুবাদে তাঁকে প্রায়ই
দলের অনুরোধ মতো বিভিন্ন বিষয়ে লেটো গান লিখতে হয়েছে। যার ফলে তিনি পরবর্তীকালে ভক্তিগীতি ও
বিভিন্ন ফরমায়েসী সংগীত রচনায় অনায়াসে সাফল্য লাভ করেন।

সদাচঞ্চল কৰি কোনো এক জায়গায় বেশিদিন থাকতে পারতেন না। কাজেই এখানেও ব্যতিক্রম ঘটলো না।
হঠাৎ করেই লেটোদল ছেড়ে বর্ধমানের মাথরুন স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হলেন। শিক্ষক ছিলেন কবি কুমুদরঞ্জন
মল্লিক। কিছুদিনের মধ্যেই আর্থিক অনটনের কারণে আবার স্কুল ত্যাগ করেণে। এরপর কিছুদিন বাসুদেবের
সখের কবিগানের আসরে ঢোলক বাজিয়ে গান করেছিলেন। এই সময় তিনি পালাগান, স্বরচিত কবিতায়
সুরারোপ করতে ব্যস্ত ছিলেন। এই সময়টি পরবর্তীকালে স্বনামধন্য সুরকার ও সংগীতজ্ঞ হিসেবে প্রতিষ্ঠা
পাওয়ার ব্যাপারে বিশেষভাবে সহায়তা করে।

একদিন এই সখের কবিগানের আসরে নজরুলের গান শুনে এক খ্রিষ্টান গার্ড সাহেব মুগ্ধ হন এবং তাকে
বাবুর্চির কাজ দিয়ে তার প্রাসাদপুরের বাংলায় নিয়ে যান। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সেই গার্ড সাহেবের দেওয়া
চাকরি ছেড়ে আবার চলে আসেন আসানসোল। এবার তিনি চাকরি নেন এম বশের চা রুটির দোকানে। বিনা
পয়সায় খাওয়া দাওয়াসহ বেতন ছিল মাসে এক টাকা। কিন্তু থাকার কোনো জায়গা ছিল না। সারাদিন পরিশ্রম
করে পরিশ্রান্ত নজরুল পাশের একটি তিন তলা বাড়ির নিচে ঘুমিয়ে থাকতেন। ঐ বাড়িতে কাজী রফিজউল্লাহ
নামে পুলিশের এক সাব-ইন্সপেকটর থাকতেন। তিনি কবিকে পাঁচ টাকা বেতনে গৃহভৃত্যের কাজে নিযুক্ত
করেন। কাজী রফিজউল্লাহ এবং তার স্ত্রী নজরুলকে খুব স্নেহ করতেন। তাদের বাড়ি ছিল ময়মনসিংহ জেলার
কাজীর শিমলা গ্রামে। তারা কবি নজরুলকে তাদের বাড়িতে নিয়ে আসেন এবং দরিরামপুর হাই স্কুলে সপ্তম
শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। কিন্তু এখানেও কবি মাত্র কয়েক মাস থাকেন এবং বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে কাউকে কিছু
না জানিয়ে চলে যান। তারপর আবার তিনি রাণিগঞ্জ চলে যান এবং শিয়ারসোল রাজ হাইস্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে
ভর্তি হন। সেখানে তিনি দশম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। তার মেধা ও প্রতিভার পুরস্কার হিসেবে রাজ
পরিবার থেকে মাসিক সাত টাকা বৃত্তি ও বিনা খরচে ছাত্রাবাসে থাকা ও খাওয়ার সুযোগ পান। এখানে কবির
পরিচয় ঘটে প্রখ্যাত সাহিত্যিক শ্রী শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় এর সাথে এবং অচিরেই এই পরিচয় গভীর বন্ধুত্বে
পরিণত হয়।

কবি শিয়ারসোল রাজ হাইস্কুলের ছাত্র থাকাকালীন শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন হাফিজ নুরন্নবী সাহেবকে।
তিনি নজরুলের মেধা, কাব্যপ্রীতি ও ফারসি ভাষায় দখল দেখে মুগ্ধ হন এবং স্কুলে তাঁর দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে
সংস্কৃত ছাড়িয়ে ফারসি পড়ার ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীকালে নজরুলের ফারসি ভাষায় জ্ঞান, ফারসি সাহিত্য
পড়া এবং তাঁর কবিতায় ব্যবহার সবকিছুতেই সেই শিক্ষকের অবদান অনস্বীকার্য। সংগীতের প্রতি কবির
আগ্রহ ছিল প্রথম থেকেই। উক্ত স্কুলে আরও একজন শিক্ষক ছিলেন শ্রী সতীশ চন্দ্র কাঞ্জিলাল। শাস্ত্রীয়সংগীতে
তার যথেষ্ট দখল ছিল। উক্ত শিক্ষকের সাহচর্যে এসে কবির সংগীতের প্রতি আগ্রহ বেড়ে গিয়েছিল। সতীশচন্দ্র
অত্যন্ত যত্নের সাথে কবিকে শাস্ত্রীয়সংগীতের তালিম দিতে থাকেন। কিন্তু সদাচঞ্চল কৰি এখানেও বেশিদিন
থাকতে পারলেন না।

প্রি-টেস্ট পরীক্ষা দেওয়ার পর চারিদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। সৈন্য যোগাড়ের তোড়জোড়
চলছিল। অর্থের প্রয়োজনে কবি বাধ্য হয়ে ১৯১৭ সালে ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে যোগ দিয়ে প্রথমে লাহোরের
নৌশরাতে চলে যান। সেখানে তিন মাস ট্রেনিং নেওয়ার পর তিনি করাচি সেনানিবাসে চলে যান। ১৯১৭ সাল
থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত তিনি সেনা বিভাগে চাকরি করেন এবং হাবিলদার পদে উন্নীত হন। সৈনিক জীবনের
কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে থেকেও নজরুলের সাহিত্য চর্চা থেমে থাকেনি বরং প্রকৃত সাহিত্যচর্চা এখানেই
শুরু হয়। তাঁর প্রথম গল্প 'বাউন্ডুলের আত্মকাহিনি', প্রথম কবিতা 'মুক্তি' এখানেই রচিত হয়। এই সময় তাঁর
পরিচয় ঘটে এক পাঞ্জাবি মৌলভী সাহেবের সাথে। তিনি ফারসি সাহিত্যে সুপণ্ডিত ছিলেন। পূর্বে নজরুলের
ফারসি জানা থাকার কারণে মৌলভি সাহেবের কাছে বিখ্যাত পারস্য কবিদের অমূল্য কাব্যগ্রন্থ পাঠের সুযোগ
পান। পরবর্তীকালে নজরুল হাফিজের গজল ও রুবাইয়াত এর অনুবাদ করেন এবং ১৯৩০ সালে অনুবাদগুলো
পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়।

যুদ্ধের পর বাঙালি পল্টন ভেঙে দেওয়া হলো। নজরুল সোজা চলে এলেন কোলকাতায় বন্ধু শৈলজানন্দ
মুখোপাধ্যায় এর বাড়িতে। পরে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে চলে আসেন এবং সমিতির সার্বক্ষণিক
কর্মী মুজাফফর আহমদকে বন্ধু এবং একমাত্র সাথি হিসেবে পান। প্রকৃতপক্ষে এখানেই নজরুলের সাহিত্যিক
জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। তৎকালীন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নজরুলের কবিতা, গান, গল্প, প্রবন্ধ
একের পর এক প্রকাশিত হতে থাকে। এই সময় কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত দৌলতপুর গ্রামের আলি আকবর খান
নামে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে তার আলাপ হয় এবং তার অনুরোধে হঠাৎ করে কুমিল্লা এসে হাজির হন। সেটা
ছিল ১৯২১ সালের এপ্রিল ১৩২৭ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসে। সেখানে কয়েক মাস থাকার পর ১৩২৮ সালে ৩ আষাঢ়
১৯২১ সালের ১৭ জুন শুক্রবার আলি আকবর খান সাহেবের ভাগ্নী নার্গিস আসার খানমের সঙ্গে তার বিবাহ
সম্পন্ন হয়। কিন্তু এই বিবাহ আদৌ সুখের হয়নি। এমনকি বিয়ের দিনগত রাত্রেই কবি দৌলতপুর ত্যাগ করে
কুমিল্লা চলে আসেন। সেখানে বিখ্যাত সেনগুপ্ত পরিবারে তিনি অত্যন্ত আদরের সাথে কিছুদিন বাস করেন।
তারপর নজরুলের অকৃত্রিম বন্ধু মুজাফ্ফর আহমদ তাঁকে কোলকাতা ফিরিয়ে নিয়ে যান এবং তালতলা লেনের
এক বাড়িতে বসবাস শুরু করেন, সেখানেই লিখেছিলেন তাঁর চিরস্মরণীয় কবিতা 'বিদ্রোহী'। ১৩২৮ সালের
কার্তিক সংখ্যা মোসলেম ভারত পত্রিকায় কবিতাটি প্রকাশিত হয়। কিন্তু জনসমক্ষে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়
১৩২৮ সালের ২২ পৌষ ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি 'সাপ্তাহিক বিজলী'র মাধ্যমে। কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার
সঙ্গে সঙ্গে সুধীমহলের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় এবং সারা বাংলায় তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হয়। বাইশ বছর বয়সের এক
তরুণের পক্ষে এমন বলিষ্ঠ কবিতা লেখা সত্যিই অবিশ্বাস্য ব্যাপার।

নজরুল বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক, অর্ধ-সাপ্তাহিক পত্রিকা সম্পাদনার ও সাংবাদিকতার কাজ
করেন। যেমন– দৈনিক নবযুগ, সেবক এবং মোহাম্মদীতে সাংবাদিকতা ও 'ধূমকেতু', 'লাঙল' 'গণবাণী'
ইত্যাদি পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। বিশেষ করে 'ধূমকেতু' পত্রিকা সে সময়ে ইংরেজ বিরোধী
আন্দোলনে বাঙালি তথা ভারতবাসীদের ভীষণভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ১৯২২ সালের ধূমকেতু পূজা সংখ্যায়
নজরুলের কবিতা 'আনন্দময়ীর আগমনে' প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি এবং ধূমকেতু' ইংরেজ সরকারের
কোপানলে পড়ে এবং উক্ত সংখ্যাটি বাজেয়াপ্ত করা হয়। শুধু তাই নয় উক্ত অপরাধে নজরুলকে গ্রেপ্তার করে
কারাগারে পাঠানো হয়। হুগলী জেলে থাকাকালে রাজনৈতিক বন্দিদের ওপর অমানুষিক ব্যবহারের প্রতিবাদে
নজরুল ৩৯ (ঊনচল্লিশ) দিন অনশন ধর্মঘট করেন। এই অনশনের পর নজরুলের খ্যাতি আরও বেড়ে যায়।
এই সময় ১০ মাঘ ১৩২৯ বঙ্গাব্দ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার 'বসন্ত' নাটকটি কবি নজরুলের নামে উৎসর্গ
করেন।

তারপর ১৩৩১ বঙ্গাব্দের ১২ বৈশাখ অনুযায়ী ১৯২৪ সালের ২৪ এপ্রিল কুমিল্লার গিরীবালা দেবীর কন্যা প্রমীলা
সেনগুপ্তকে বিবাহ করেন। সাহিত্য ও সংগীতের মাধ্যমে পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্ত করার জন্য নজরুল সম
দেশবাসীকে ভীষণভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। আজীবন দারিদ্র্য আর প্রতিকূল পরিবেশে থেকেও তিনি শোষণ,
অত্যাচার, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। তৎকালীন কোলকাতায় হিন্দু মুসলিম লাগার সময়
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে নজরুল সক্রিয়ভাবে লেখনী ধরেন। রচনা করেছেন অসংখ্য মানবতাবাদী
অসাম্প্রদায়িক গান ।

কবি নজরুল হুগলীতে থাকাকালে তার প্রথম পুত্র আজাদ কামালের জন্য হয়। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই তার
অকাল মৃত্যু ঘটে। এরপর ১৯২৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় পুত্র বুলবুলের জন্ম হয় কৃষ্ণনগরে এবং তার
নামানুসারে তার সংগীত গ্রন্থের নামকরণ করেন 'বুলবুল'। এই সময় নজরুল গজল গান রচনায় মেতে ওঠেন
এবং বেশকিছু অসাধারণ গজল গান রচনা করেন।

নজরুলের যশখ্যাতি যেমনভাবে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল সে তুলনায় মোটেও তার অর্থ প্রাপ্তি ঘটেনি। এর
কারণ হয়ত তার শিশুর মতো সরল মন। অনেকেই তাকে ব্যবহার করে অর্থ উপার্জন করেছেন কিন্তু তিনি তার
সামান্যই ভোগ করতে পেরেছেন। এই নিদারুণ অর্থ কষ্টের ভিতর ১৯৩৭ সালের ২৪ বৈশাখ ইংরেজি ১৯৩০
সালের ৭ মে বুধবার পুত্র বুলবুল বসন্তরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। এই মৃত্যু কবির মনে গভীর ক্ষত।
সৃষ্টি করেছিল। তিনি শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েছিলেন। এই অশান্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তিনি এক
আধ্যাত্মিক গৃহযোগী বরোদাচরণ গুপ্তের সান্নিধ্যে আসেন। কিছুদিন নির্বাসিত জীবন যাপন করার পর তিনি
মানসিক শান্তি লাভ করেন। তাঁর বিশৃঙ্খল জীবনে শৃঙ্খলা ফিরে আসে। এই সময়ে নজরুল বেশকিছু অসাধারণ
শ্যামাসংগীত ও ভক্তিগীতি রচনা করেন।

তার অসাধারণ কাব্যগ্রন্থের ভিতর কয়েকটির নাম: ব্যথার দান, অগ্নিবীণা, যুগবাণী, দোলনচাপা, বিষের বাঁশি,
ভাঙার গান, রিক্তের বেদন, ঝিঙে ফুল, পূবের হাওয়া, ছায়ানট, সিন্ধু হিল্লোল, সর্বহারা, ফণি-মনসা, বাঁধনহারা,
জিঞ্জির, বুলবুল, চক্রবাক, সন্ধ্যা, প্রলয় শিখা, কুহেলিকা ইত্যাদি। ১৯২৮ সালে নজরুল গ্রামোফোন রেকর্ড
কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হন। এসময় কবি সংগীত চর্চা ও গবেষণায় মগ্ন হয়ে যান।

তিনি ছায়াছবি ও রঙ্গমঞ্চের সাথেও যুক্ত হন এবং কয়েকটি ছায়াছবিতেও অভিনয় করেন। আলেয়া, বিদ্যাপতি,
সাপুড়ে, মহুয়া প্রভৃতিতে গীত রচনা, সুর ও সংগীত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৩৭ সাল থেকে
১৯৪২ সাল পর্যন্ত কবি বেতারের সঙ্গে যুক্ত থেকে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান উপহার দেন। ১৯৪০ সালের
দিকে কোলকাতা বেতার থেকে 'হারামণি ও নবরাগমালিকা' নামে দুইটি অনুষ্ঠান তার পরিকল্পনা ও
পরিচালনায় অনুষ্ঠিত হতো এবং প্রচুর জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

১৯৪০ সালের শেষের দিকে কবি অনুভব করেছিলেন তার অসুস্থতার কথা। এর কিছুদিন পর তার স্ত্রী প্রমীলা
নজরুল পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হন। এই সময়টি নজরুলের জীবনে সবচেয়ে দুঃসময় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
নিদারুণ অর্থকষ্ট, স্ত্রীর অসুস্থতা কবিকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছিল। এই দুঃসহ মানসিক যন্ত্রণা বোধহয় আর সহ্য
করতে পারেননি কবি। ১৯৪২ সালের ১০ জুলাই এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে তিনি নির্বাক হয়ে
গেলেন। কিন্তু তাঁর চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা হয়নি। প্রায় দশ বৎসর পর ১৯৫২ সালের ২৭ জুন নজরুল
সমিতি গঠিত হয়।

কবিকে প্রথমে রাঁচি সেন্ট্রাল হাসপাতালে পাঠিয়ে কিছুদিন চিকিৎসা করা হয়। কিন্তু কোনো সুফল পাওয়া
যায়নি। শেষে ১৯৫৩ সালের ১০ মে সন্ত্রীক কবিকে লন্ডন পাঠানো হয়। তারপর ভিয়েনা। সেখানকার
ডাক্তারগণ কবির অসুস্থতা যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে আরোগ্য লাভের কোনো আশা বলে নেই অভিমত প্রকাশ
করেন। ফলে ১৫ ডিসেম্বর কবিকে পুনরায় কোলকাতায় ফিরিয়ে আনা হয়।

কবি নির্বাক হয়ে যাওয়ার পর ১৯৪৫ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে 'জগত্তারিণী" পুরস্কারে ভূষিত
করে। ১৯৬০ সালে ভারত সরকার 'পদ্মভূষণ' উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৬৯ সালে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়
সম্মানসূচক 'ডি-লিট উপাধিতে ভূষিত করে।

কবি পত্নী প্রমীলা নজরুল ১৯৬২ সালের ৩০ জুন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৯৭১ সালের স্বাধীন বাংলাদেশ
প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমানের ঐকান্তিক চেষ্টায় ভারত সরকার এই লোকপ্রিয় কবিকে
বাংলাদেশে নিয়ে আসার অনুমতি দেন। তারপর ১৯৭২ সালের ২৪ মে কবিকে ঢাকা আনা হয় এবং ২৫ মে
দেশব্যাপী বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে কবির ৭৩তম জন্মদিন পালন করা হয়। বাংলাদেশ সরকার,
দেশের সকল মানুষ তাঁকে রাজকীয় সম্মানে ভূষিত করলেন। অপরিসীম শ্রদ্ধায় সরকার ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি
মাসে কবিকে নাগরিকত্ব প্রদান করেন এবং দেশের সর্বোচ্চ পুরস্কার একুশে পদকে ভূষিত করেন। এছাড়াও
১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক ডি-লিট উপাধিতে ভূষিত করেন। বাংলাদেশ সরকার ও
বাংলাদেশের মানুষ তাকে আমাদের জাতীয় কবির মর্যাদা ও স্বীকৃতি দিয়ে সম্মানিত করেন। ১৯৭৬ সালের ২৯
আগস্ট ১৩৮৩ বাং সালের ১২ ভাদ্র রবিবার তৎকালীন ঢাকা পিজি হাসপাতালে বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব
মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে
পরিপূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে সমাহিত করা হয়।

কাজী নজরুল ইসলামের সংগীত জীবন

কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গুণিজনের সাহচর্যে আসেন এবং সংগীত চর্চা করেন। কিশোর
বয়সে অর্থের প্রয়োজনে লেটো দলে যোগ দিয়ে দলপতির কাছে গান শিখে আবার অন্যদের শিক্ষা দিতেন। তাঁর
প্রতিভা ও অনুশীলনের ফলে অভ্যন্ত কম সময়ের মধ্যে তিনি লেটো দলের দলপতির পদে উন্নীত হয়ে
দায়িত্ব পালন করেন। এই সময় তিনি হারমোনিয়াম, বাঁশি ও তবলা বাদনে সবিশেষ পারদর্শী হয়ে ওঠেন।
তারপর শিয়ারসোল রাজ হাইস্কুলের ছাত্র থাকাকালীন উক্ত স্কুল শিক্ষক শ্রী সতীশচন্দ্র কাঞ্জিলালের কাছে
শাস্ত্রীয়সংগীতের তালিম নেন। এছাড়াও কবি মুর্শিদাবাদের তৎকালীন প্রখ্যাত ওস্তাদ কাদের বক্স এবং মঞ্জু
সাহেবের কাছে শাস্ত্রীয়সংগীতের তালিম নেন। চুঁচুড়ার প্রখ্যাত সেতার বাদক প্রকৃতি গঙ্গোপাধ্যায়-এর কাছে
কিছুদিন সেতার শেখেন। এছাড়া নজরুল বিশেষভাবে শাস্ত্রীয়সংগীতের তালিম নেন তৎকালীন প্রখ্যাত
সংগীতগুণি গ্রামোফোন কোম্পানির সংগীত প্রশিক্ষক ওস্তাদ জমিরুদ্দিন খাঁর কাছে। নজরুলের সংগীত চর্চা ও
গবেষণা বাংলাগানের ভাণ্ডারকে করেছে সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময়।

বাংলায় গজল গান ও ইসলামি সংগীতের তিনিই প্রবর্তক। প্রচলিত ও লুপ্তপ্রায় রাগ-রাগিণীর চর্চা ছাড়াও তিনি
বেশ কয়েকটি রাগ সৃষ্টি করেন। তিনি প্রাচীন কয়েকটি ছন্দের প্রচলন ও নবনন্দন নামে একটি ভাল সৃষ্টি করেন।
কবিসৃষ্ট কয়েকটি রাগের নাম এখানে উল্লেখ করা হলো। যেমন: রাগ - বেণুকা, উদাসী ভৈরব, অরুণভৈরব,
সন্ধ্যামালতী, বনকুন্তলা, নির্ঝরিণী, অরুণরঞ্জণী, দোলনচাঁপা, আশাভৈরবী ইত্যাদি। নজরুল যে সকল সংস্কৃত
ছন্দ তাঁর গানে ব্যবহার করেছেন সেগুলো হলো: প্রিয়া (৭ মাত্রা) মনিমালা (২০ মাত্রা) মঞ্জুভাষিণী (১৮ মাত্রা)
স্বাগত (১৬ মাত্রা)।

বাংলাগানে কবি নজরুল যে অবদান রেখে গেছেন তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বাংলাগানের এমন কোনো
শাখা নেই যেখানে কবির বিচরণ ছিল না। ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্পা, ঠুমরি, কাজরি, গজল, দেশাত্মবোধক, হাসির
গান, ইসলামি, জাগরণী, ভাটিয়ালি, ছাত্রদলের গান, মার্চ সংগীত, শ্যামা সংগীত, ঝুমুর, কীর্তন, বাউল, ভজন
সকল পর্যায়ের গান রচনা করে কবি বাংলাগানের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে গিয়েছেন। নজরুল তিন হাজারেরও
অধিক গান রচনা করে গেছেন। এককভাবে কোনো গীতিকবি ও সুরকারও এত বিপুল সংখ্যক গান রচনা
করেননি। বাংলাগানের ইতিহাসে নজরুলের অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে চিরদিন।

তানসেন

সংগীত জগতে নানা অলৌকিক কাহিনি এবং অসামান্য অবদানের জন্য যিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি হলেন
সংগীতসম্রাট তানসেন। এত বড়ো একজন সংগীতগুণি সম্বন্ধে তাই নানা রঙের নানা গল্প এবং নানা বিতর্ক
থাকাও কিছু অস্বাভাবিক নয়। তথাপি অধিকাংশের সমর্থিত মতে জানা যায় যে, গোয়ালিয়রের কাছে 'বিহট'
নামক গ্রামে ১৫২০ খ্রিষ্টাব্দে এক ব্রাহ্মণ বংশে মকরন্দ পাণ্ডের পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করেন তানসেন। প্রথম জীবনে
তার নাম ছিল রামতনু। মহম্মদ গৌসের পরামর্শে পরে মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত হন এবং গোয়ালিয়রেই
স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন।

বালক রামতনুর অপূর্ব কন্ঠস্বর ও সংগীতের অসামান্য মেধার পরিচয় পেয়ে সংগীতজ্ঞ মাতুল গদাধর মিশ্র
তাঁকে খুবই আগ্রহ ভরে গান শেখাতে শুরু করেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই রামতনুর সংগীতের কৃতিত্বের কথা
চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। পরে বৃন্দাবনের প্রসিদ্ধ হরিদাস স্বামীর সাক্ষাৎ পান রামতনু এবং তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ
করেন। গুরুকে মান্য করে কিছু গানও তিনি রচনা করেছিলেন, যা আজও গ্রন্থের পাতায় তার গুরুভক্তির স্বাক্ষর
বহন করছে। কারো কারো মতে, গোয়ালিয়রের রাজা মানসিংহ তোমরের পত্নী মৃগনয়নীর কাছে তানসেনের
প্রথম সংগীত শিক্ষা ঘটে। কিন্তু অধিকাংশের মতে তানসেনের জন্মের পূর্বেই পাঠানের হাতে মানসিংহের মৃত্যু
ও গোয়ালিয়রের পতন ঘটায় মৃগনয়নীর অস্তিত্বের কথাই জানা যায় না। সুতরাং তাঁর কাছে সংগীত শিক্ষার
প্রশ্নই ওঠে না। হরিদাস স্বামীর পরে গোয়ালিয়রের মহম্মদ গৌসের কাছেও তিনি সংগীত শিক্ষা করেন, যিনি
পারস্যের সংগীতধারার বাহক। মনে হয় সেইজন্যেই তানসেনের মধ্যে ভারতীয় ও পারস্য উভয় সংগীতধারার
সংমিশ্রণে গড়ে ওঠে সম্পূর্ণ নতুন সাংগীতিক বৈশিষ্ট্যযুক্ত 'সেনী ঘরানা'।

১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে বান্ধবগড়ের রাজা রামচাঁদের দরবারে ছত্রিশ বছর বয়সে তানসেন শ্রেষ্ঠ গায়কের পদে
অধিষ্ঠিত হন । রামচাদের সুমিষ্ট ব্যবহারে বিগলিত হয়ে তানসেন চৌতালে দরবারী কানাড়া রাগে যে গান রচনা
করেন তার স্থায়ীতে তিনি বলেন 'রাজা রামগুণ নিধান, আর আভোগে বলেন 'তানসেন কহত যুগযুগ জিয়ো
জিয়ো।' দিল্লীর সম্রাট আকবরের অভিপ্রায়ে ১৫৬২ খ্রিষ্টাব্দে তানসেন প্রিয় রাজ্য, নিজ স্ত্রী-পুত্র প্রভৃতিকে ছেড়ে
মনে পরম বেদনা নিয়ে আগ্রায় সম্রাটের দরবারে চলে যেতে বাধ্য হন। কিন্তু আগ্রায় গিয়ে ভাঙা মন নিয়ে
তানসেন প্রথমে কিছুতেই নিজেকে গানের মধ্যে সম্পূর্ণ নিয়োজিত করতে পারতেন না। সম্রাট আকবর তার
প্রাণের আবেদনহীন গান শুনে ভাবেন এই কি রাজা রামচাদের দরবারের বহু বিশ্রুত শ্রেষ্ঠ রত্ন। হঠাৎ সম্রাটের
মনে কী ভাবের যেন উদয় হয়। হারেমের অপরূপ সুন্দরী ও মধুময় কন্ঠের অধিকারিণী মেহেরউন্নিসাকে গান
শেখাবার দায়িত্ব সম্রাট তানসেনকে অপর্ণ করেন। তানসেনের জীবনে দেখা দেয় নতুন অধ্যায়। গানের সুর
ক্রমে ক্রমে দুটি প্রাণের সুরকে একাত্ম করে ফেলে। তানসেন রূপান্তরিত হয়ে যান মেহেরউন্নিসার স্বামীরূপে।

 

 

 

Content added || updated By
Promotion