প্রাকৃতিক ফাইবারের মধ্যে জুট ফাইবার একটি সেলুলোজিক ফাইবার। তবে কটনের তুলনায় জুট ফাইবারে সেলুলোজের পরিমাণ অনেক কম। এই ফাইবারে সেলুলোজের পর হেমি সেলুলোজ ও লিগনিন বিদ্যমান। জুট ফাইবারে লিগনোসলুলোজ থাকার কারণে জুট ফাইবার কিছুটা শক্ত ও খসখসে। জুট ফাইবার অর্থাৎ পাট আঁশ এই শক্ত ও খসখসে থাকার কারণে সুতা তৈরির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। সুতা তৈরির জন্য পাক দেওয়ার সাথে সাথে আঁশ ভেঙে যেতে পারে। কাজেই এ ভঙ্গুরতা দূর করার জন্য সুতা তৈরির পূর্বে ইমালশন প্রয়োগ করতে হয়। ইমালশন তৈল ও পানির মিশ্রণ। ইমালশন প্রয়োগের কারণে আঁশ নরম হয়ে সুতা তৈরির উপযোগী হয়।
কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশে পাট আঁশ এককালে প্রধান অর্থকরি ফসল ছিল। পাট থেকে প্রচুর পরিমানে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হতো বলে এই আঁশকে গোল্ডেন ফাইবার অব বাংলাদেশ বলা হতো। কিন্তু বর্তমানে পাট ও পাটজাত পণ্যের পূর্বের মতো রপ্তানি চাহিদা নেই। সিনথেটিক পণ্যের উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে পাট ও পাটজাত দ্রব্যের রপ্তানি আয় নিম্নমুখী।
পাট ও পাটজাত দ্রব্য পরিবেশের সহায়ক। কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন পাটের মূল রাসায়নিক উপাদান। পরিবেশগত কোনো দোষণীয় পদার্থ পাট ও পাটজাত দ্রব্যে নেই। তাই পাটজাত দ্রব্য ব্যবহারে পরিবেশ দূষিত হয় না। অন্য দিকে পাটজাত দ্রব্য অতি সহজেই পচনশীল, মাত্র ৩ থেকে ৫ মাসের মধ্যেই এটি মাটির সাথে মিশে যায়। পরিবেশের কোনো ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে না। অন্যদিকে পাটের মধ্যে সেলুলোজ, হেমিসেলুলোজ এবং লিগনিন থাকে এবং এই লিগনিন পচে জমিতে উর্বরতা বৃদ্ধি করে। উপরোক্ত কারণে পাট দ্বারা পরিবেশের কোনো ক্ষতি হয় না ।
পাটের বোটানিক্যাল নাম (Botanical name of jute)-
উদ্ভিদবিদ্যা মতে পাট করকোরাস (Corcorus) প্রজাতির। এই প্রজাতির ২টি ভাগ
১)করকোরাস কেপসুলারিস (Corcorus Capsularis )
২) করকোরাস ওলিটোরিয়াস (Corcorus Olitorius)
ইহা ছাড়াও বাংলাদেশে পাটসদৃশ্য একটি অ্যালাইড ফাইবার দেখতে পাওয়া যায়, যা মেস্তা নামে পরিচিত। যার বৈজ্ঞানিক নাম হিবিস্কাস ক্যানাবিনাস (Hibiscus Canabinus)
পাট এর গ্রেডিং (Grading of jute)
তোষা পাট (Tossa Jute ) -
পাট-এর গোড়া কেটে পৃথক করার পর উক্ত পাটের পাক্কা গ্রেডে যাচাইতে নামকরণ করার জন্য বাংলা কথাটি যুক্ত থাকে।
পাটের শ্রেণি বিভাগ (Classification of Jute)-
পাট প্রধানত দুই প্রকার
১) দেশি বা সাদা পার্ট (White Jute )
২) বগী বা তোষা পাট (Tossa jute)
তবে গটি ছাড়াও বাংলাদেশে পাট সদৃশ এক প্রকার অ্যালাইড ফাইবার পাওয়া যায়, ইহা মেস্তা। সাদা পাটের আঁশ অপেক্ষাকৃত মোটা ও ওজনে হালকা এবং ইহার রং সাদা ও খিয়া, কিন্তু তোষা পাট সিল্কি, আঁশ চিকন এবং ওজনে অপেক্ষাকৃত ভারী, তোষা পাটের রং মিয়া ও লালচে সোনালি। মেন্তার আঁশ অপেক্ষাকৃত মোটা কম তৈলযুক্ত, কিছুটা ভঙ্গুর ও কম শক্তিসম্পন্ন। পাটের আঁশ জালের মতো একটার সাথে অপরটি যুক্ত কিন্তু মেস্তার আঁশ তেমন জালের মতো থাকে না।
বাংলাদেশে এলাকাভিত্তিক ও স্পিনিং-এর উপযুক্ততা বিবেচনা করে পাটকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন-
১. জাত পাট (Jat jute)
২. ডিস্ট্রিক্ট পার্ট (District jute)
৩. নর্দার্ন পাট (Northern jute)
১) জাত পাট-
বৃহত্তর জেলা ঢাকা, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, জামালপুর ও টাঙ্গাইল এলাকায় জাত পাট জন্মে। সাদা ও তোষা উভয় প্রকার জাত পাটের আঁশ খুবই শক্ত ও শুষ্ক তারের মতো হয়। এই পাটের তৈলাক্ততা ও উজ্জ্বলতা অধিক থাকে। এই পাটের আঁশ খুব ঘন জালবিশিষ্ট, সূক্ষ্মতা ও দৈর্ঘ্যতা বেশি থাকে। কোয়ালিটি বা মানের দিক থেকে এই পাটকে সর্বশেষ্ঠ পার্ট বলে মনে হয়। বি-বাড়িয়ার মাধবপুর হরিণ এলাকার পাট পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পাট। পাক্কা প্যাকিং-এর জন্য আরও উজ্জ্বল হয় এবং আঁশের শক্তি বেশি থাকে।
২) ডিস্ট্রিক্ট পার্ট-
ডিস্ট্রিক্ট পাটকে সাধারণত তিন ভাগে ভাগ করা যায়।
ক) হার্ড ডিস্ট্রিক্ট (Hard district )
খ) ডিস্ট্রিক্ট (District)
গ) সফট ডিস্ট্রিক্ট (Soft district )
ক) হার্ড ডিস্ট্রিক্ট (Hard district)-
এই পাট বৃহত্তর ফরিদপুর জেলায় জন্মে, ইহার মধ্যে তালমা, কানাইপুর, খলিলপুর, চরমুগুরিয়া, টেকেরহাট ইত্যাদি এলাকায় ভালো জাতের হার্ড ডিস্ট্রিক্ট পাট জন্মে। জাত পাটের পরই এই পাটের স্থান। হার্ড ডিস্ট্রিক্ট পাটের আঁশ জাত পাটের আঁশ থেকে সামান্য কম সূক্ষ্ম। কিন্তু অধিক শক্তিসম্পন্ন তৈলাক্ত এবং আঁশ ঘনজাল বিশিষ্ট হার্ড ডিস্ট্রিক্ট পার্ট রং-এর উজ্জ্বলতার জন্য বিখ্যাত। বিশেষত তোষা পাটের রং অত্যন্ত উজ্জ্বল কাঁচা স্বর্ণ বর্ণ হয়ে থাকে। এই পাট অনেক লম্বা হয় এবং কাটিং খুবই সামান্য পরিমাণ হয়। রং, আঁশের গুণ ও কম কাটিং-এর জন্য হার্ড ডিস্ট্রিক্ট পার্ট খুবই সমাদৃত। এই কারণে এই শ্রেণির পাটের চাহিদা ও মূল্য অন্যান্য অঞ্চলের পাটের তুলনায় অধিক থাকে। মূলত হার্ড ডিস্ট্রিক্ট এলাকায় তোষা পাটের উৎপাদন অনেক বেশি হয় । পাক্কা প্যাকিং-এ ইহার রং ও উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায়।
খ) ডিস্ট্রিক্ট (District)-
ডিস্ট্রিক্ট পাট সাধারণত ব্রহ্মপুত্র নদীর পশ্চিম পারের নিম্নভূমিতে জন্মে। মূলত বৃহত্তর পাবনা জেলায় উৎপাদিত সাদা ও তোষা পাট ডিস্ট্রিক্ট পাট। এছাড়া বৃহত্তর সিলেট, নোয়াখালী ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাটকে ডিস্ট্রিক্ট পার্ট বলা হয়ে থাকে। ডিস্ট্রিক্ট পাটের আঁশ জাত পাটের আঁশ থেকে কিছুটা মোটা ও ওজনে হালকা, উজ্জ্বলতা ও তৈলাক্ততা কিছুটা কম। আঁশের শক্তি ও জাল সাদৃশ্য ঘনত্ব ও জাত পাটের তুলনায় কম । সাদা পাটের রং সাধারণত সাদাটে এবং তোষা পাটের রং বাদামি বা ফ্যাকাসে লাল হয়ে থাকে।
গ) সফট ডিস্ট্রিক্ট (Soft district ) -
বৃহত্তর জেলা কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা ও বরিশাল ইত্যাদি এলাকায় উৎপন্ন পাটকে সফট ডিস্ট্রিক্ট পার্ট বলে। সফট ডিস্ট্রিক্ট পাটের আঁশ তুলনমূলকভাবে কিছুটা নরম হয়। তৈলাক্ততা ও রং-এর উজ্জ্বলতা অপেক্ষাকৃত কম থাকে।
৩) নর্দান পাট (Northern jute ) -
বৃহত্তর জেলা রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া ও রাজশাহী এলাকায় উৎপন্ন পাটকে নর্দান ডিস্ট্রিক্ট পার্ট বলে। নর্দান পাটের আঁশের শক্তি কম। কিছুটা ফাঁপা ও মোটা জালের ঘনত্ব কম ও অধিক কাটিং যুক্ত, তৈলাক্ততা কম, পাক্কা প্যাকিং -এর পর সাধারণত নর্দান পাটের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায় না। সাদা পাটের রং সাধারণত মেটে ও তোষা পাটের মেটে তামাটে ও মেটে শ্যামলা হয়ে থাকে।
ছুট উৎপাদনকারী দেশসমূহ-
নিম্নে জুট উৎপাদনকারী দেশসমূহের নাম দেওয়া হলো-
* বাংলাদেশ, ভারত
* বার্মা, চায়না, ব্রাজিল এবং নেপাল
পৃথিবীর প্রায় শতকরা ৮৫ ভাগ পাট ভারত ও বাংলাদেশে জন্মে।
পাটের দোষ-ত্রুটি (Defects of jute)
গোড়াময় পাট (Rooty fibres )-
গোড়ার দিককার অংশ, পচনের স্বল্পতার কারণে, বাকল ও আঠালো পদার্থ সম্পূর্ণ দূরীভূত না হওয়ায় এই প্রকার ত্রুটি দেখা দেয়। এর গোড়ার অংশ কেটে নিম্নমানের পাটের সাথে নিম্নমানের সুতা তৈরির কাজে ব্যবহার করা চলে ।
দাগী পার্ট (Specky fibres ) -
পচন ও ধোয়া যথোপযুক্ত না হলে আঁশের সঙ্গে বাকলের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ লেগে থাকতে দেখা যায় এবং রং -এর অসমতা সৃষ্টি করে। ইমালশন প্রয়োগের পর অধিক সময় পাইলিং এবং উপযুক্ত কার্ডিং করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
আগাশুদ্ধ পাট (Croppy fibres ) -
এই ধরনের পাট আঁশের প্রাপ্ত আঠালো খসখসে, পাট গাছ ভিজানোর অর্থাৎ পচনের সময় পার্ট -এর মাথা পানির ওপরে থাকলে এবং আঁশ ছাড়িয়ে নেওয়ার সময় বিশেষ সতর্ক না হলে এই ধরনের ত্রুটির কারণ ঘটায়। এই ত্রুটিযুক্ত অগ্রভাগ কেটে নিয়ে নিম্নমানের সুতার জন্য ব্যবহার করা হয়।
কাস্টময় পার্ট (Sticky fibres )-
কোনো কারণে পূর্ণতা প্রাপ্তির পূর্বেই পাট কেটে নিলে এ থেকে পাট ছাড়িয়ে নেওয়া সুবিধাজনক। পাট আঁশ পাটকাঠি থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার সময় কিছু কিছু ক্ষুদ্র পাটকাঠির অংশ লেগে থাকে। উপযুক্ত কার্ডিং করে ইহা দূর করা হয়।
গেরোময় পাট (Knotty fibres ) -
পাট গাছ ছোট অবস্থায় পোকার দংশনে এই ধরনের ত্রুটির সৃষ্টি হয়। আঁশগুলি গোছা গোছা এক সঙ্গে থাকে, পাট আঁশ আলাদা করার ক্ষেত্রে অসুবিধা ঘটায় এবং কার্ডিং-এ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আঁশে পরিণত হয়। প্রয়োজনবোধে কেটে নিম্নমানের সুতা তৈরির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।
মরা পাট (Dead fibres)-
পচনের পরিমাণ বেশি হলে অথবা পার্ট ভিজা অবস্থায় অনেক দিন ধরে গুদামজাত করে রাখলে আঁশের রং ফ্যাকাসে হয় এবং শক্তি লোপ পায়। এরূপ পাট নিম্নমানের সুতা তৈরির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।
হুক্কা পাট (Hunka fibres ) -
শক্ত শুষ্ক বাকলযুক্ত পাট এই ত্রুটির কারণ। শুষ্ক অংশ কেটে পুনরায় ইমালশন যোগে পাইলিং করে নিম্নমানের সুতা প্রস্তুত করা সম্ভব।
কমজোর পাট (Weak fibres ) -
অতিরিক্ত পচন অথবা ভিজা অবস্থায় গাঁইট বাঁধা ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে পাটের শক্তি কমে যেতে পারে। বেশি শক্তিসম্পন্ন পাটের সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে।
শেওলাযুক্ত পাট (Mossy fibres ) -
আবদ্ধ জলে উৎপাদিত পাট গাছে শেওলা থাকতে পারে। পাটের শেওলাযুক্ত আঁশ কেটে আলাদা করে নিম্নমানের পার্টের সাথে ব্যবহার করা প্রয়োজন ।
লোমশ পাট (Runners fibres ) -
অসম পচন ও অসতর্কভাবে ধোয়া এবং আঁশ ছড়ানোর জন্য এই প্রকার ত্রুটি হতে পারে। এই প্রকার পাট পৃথক অর্থাৎ আলাদা আলাদা আঁশ সৃষ্টিতে বাধা প্রদান করে ।
আন্ত:বিনষ্ট (Heart damage fibres ) -
গাঁইট বাঁধার সময় অতিরিক্ত জলীয় বাষ্প থাকলে কিছুদিনের মধ্যেই গাইটের ভিতরের কিছু অংশ নরম হয়ে পড়ে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভিতরের পার্ট গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায়। এ ধরনের পাটকে আন্তঃবিনষ্ট পাট বলে।
বহিঃবিনষ্ট (Exterior damage) -
স্থানান্তর করার সময় পাটের গাইটগুলি জাহাজের পার্শ্বের দিকে রাখলে অতিরিক্ত জলীয় বাষ্প ও উত্তাপের প্রভাবে বাইরের দিকের পার্ট বিনষ্ট হয়ে যায়। উপযুক্ত বাছাইয়ের পর বিনষ্ট পার্ট নিম্নমানের পাটের সাথে ব্যবহার করা যেতে পারে।
পাটের ভৌত গুণাবলি (Physical properties of Jute fibre) -
পাট -এর ব্যবহার (Uses of jute ) -
আরও দেখুন...