একটি ক্রেন 100 kg ভরের একটি ব্লককে 0.1 m s¹ ধ্রুববেগে উপরে তুলছে। ক্রেনটির ক্ষমতা-
কাজ, শক্তি ও ক্ষমতা এ তিনটি শব্দ আমাদের অতি পরিচিত। আমরা দৈনন্দিন জীবনে কাজ শব্দটিকে শারীরিক কিংবা মানসিক যে কোন কাজের জন্য ব্যবহার করে থাকি। তাই সাধারণ অর্থে কোন কিছু করার নামই কাজ। যেমন রিকশাওয়ালা যখন রিক্সা টানে তখন সে কাজ করে। কুলি যখন মাল বহন করে তখন সে কাজ করে, ঘোড়া যখন গাড়ি টানে তখন এটি কাজ করে ইত্যাদি। এ থেকে স্পষ্ট যে কাজ শব্দটি দৈনন্দিন জীবনে কোন নির্দিষ্ট অর্থে ব্যবহৃত না হয়ে ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। পদার্থবিজ্ঞানে কাজ বলতে নির্দিষ্ট একটি অর্থ বুঝায়। আবার ক্ষমতা ও শক্তি উভয়ই সাধারণভাবে একই অর্থে ব্যবহার করি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এরা এক নয়। এ অধ্যায়ে কাজ, ক্ষমতা ও শক্তির প্রকৃত ব্যাখ্যা এবং এদের সম্পর্কিত বিভিন্ন সম্পর্ক আলোচনা করা হবে।
পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় কোন বস্তুর উপর বল প্রয়োগ করলে বলের অভিমুখে যদি বস্তুটির সরণ ঘটে তবে ক্রিয়াশীল বল কাজ করেছে বুঝায়। কাজের নিম্নোক্ত সংজ্ঞা দেয়া যায়।
উপরের সংজ্ঞা থেকে স্পষ্ট যে কোন বস্তুর উপরে শুধু বল প্রয়োগ করলেই কাজ হয় না। যেমন একটি কাঠের গুড়ির উপর বল প্রয়োগ করা হল ; কিন্তু গুড়িটির কোন স্থানান্তর হল না। সুতরাং প্রযুক্ত বল কোন কাজ করল না। অতএব, সিদ্ধান্ত এই যে, বস্তুর উপর বল প্রয়োগ করলে যদি বলের ক্রিয়া রেখায় ঐ বস্তুর স্থানান্তর না ঘটে, তবে কাজ সম্পাদিত হয় না।
কাজের জন্য বলের প্রয়োজন। বল দুভাগে কাজ করতে পারে। যথা- (১) বলের দ্বারা বা বলের দিকে কাজ এবং (২) বলের বিরুদ্ধে বা বলের বিপরীত দিকে কাজ।
যদি বল প্রয়োগে বলের প্রয়োগ বিন্দু বলের ক্রিয়ার অভিমুখে সরে যায় বা বলের দিকে সরণের ধনাত্মক উপাংশ থাকে তবে বলের দ্বারা কাজ হয়েছে বুঝায়। বলের দ্বারাকৃত কাজকে ধনাত্মক কাজ বলে।
(ক) একটি বস্তুকে ছাদের উপর হতে নিচে ফেলা হল। এক্ষেত্রে বলের দ্বারা কাজ হল বুঝায়।
(খ) একটি ফুটবল চলন্ত অবস্থায় আছে। বল প্রয়োগ করার ফলে ফুটবলটি বলের দিকে সরে গেল। এ ক্ষেত্রেও বলের দ্বারা কাজ হয়েছে বুঝায়।
সংজ্ঞা : বল প্রয়োগের ফলে যদি বলের প্রয়োগ বিন্দু বলের ক্রিয়ার বিপরীত দিকে সরে যায় বা বলের দিকে সরণের ঋণাত্মক উপাংশ থাকে তবে যে কাজ সম্পাদিত হবে তাকে বলের বিরুদ্ধে কাজ বা ঋণাত্মক কাজ বলে।
(ক) একটি বস্তুকে মাটি হতে টেবিলের উপর উঠানো হল। এক্ষেত্রে অভিকর্ষ বলের বিরুদ্ধে সরানো হল। অতএব বলের বিরুদ্ধে কাজ হয়েছে বুঝাবে।
(খ) সমবেগে গতিশীল একটি গাড়ি ব্রেক করলে কিছুদূর গিয়ে থেমে যাবে। এক্ষেত্রে ব্রেকজনিত বল গাড়ির গতির বিপরীত দিকে ক্রিয়া করায় বলের বিরুদ্ধে কাজ হয়েছে বুঝাবে।
মনে করি A বিন্দুতে অবস্থিত কোন একটি বস্তুর উপর AB বরাবর F বল প্রযুক্ত হওয়ায় বস্তুটি A বিন্দু হতে B বিন্দুতে যেতে s দূরত্ব অতিক্রম করল । চিত্র ৬১ (ক)]। তা হলে,
কৃত কাজ = বলের মান × বলের ক্রিয়া রেখা বরাবর সরণের মান
বা, W=F × s
যদি বল প্রয়োগের ফলে বস্তুর তথা বলের প্রয়োগ বিন্দুর সরণ, বলের বিপরীত দিকে AB = s হয় [চিত্র ৬১ (খ)] তবে,
কৃত কাজ = বলের মান x বলের ক্রিয়া রেখা বরাবর সরণের মান
W= F × ( — s ) = - F × s
ঋণ চিহ্ন বল ও সরণ বিপরীতমুখী বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে।
এবার মনে করি একটি বস্তুর উপর F পরিমাণ বল AB অভিমুখে প্রযুক্ত হওয়ায় বস্তুটি বলের অভিমুখের সাথে কোণ উৎপন্ন করে s পরিমাণ দূরত্ব সরে C বিন্দুতে পৌঁছল[ চিত্র ৬.১ (গ) ]। তা হলে বলের ক্রিয়ারেখা বরাবর বস্তুর সরণ = AB = s cos।
এখানে BC AB,
কৃত কাজ, W= বলের মান × বলের ক্রিয়া রেখা বরাবর সরণের মান
বা, W = Fs
= বলের মান x বলের দিকে সরণের উপাংশের মান।
= সরণের মান × সরণের দিকে বলের উপাংশের মান।
মনে করি, বল একটি ভেক্টর বা দিক রাশি এবং সরণ একটি ভেক্টর বা দিক রাশি।
অতএব, কাজ= বল × সরণ
বা, [s হল বল F-এর দিকে সরণের উপাংশ বা অংশক]
(ক) = 0° হলে, অর্থাৎ বলের দিকে যখন বস্তুর সরণ হয়, তখন
এখানে কাজ ধনাত্মক (positive)। এক কথায় ও সূক্ষ্মকোণ হলে কাজ ধনাত্মক। কাজ ধনাত্মক হলে বলের দ্বারা কাজ বুঝায় ।
(খ) =90° হলে
(গ) = 180° হলে কাজ ঋণাত্মক (negative) হবে।
কাজ ঋণাত্মক হলে বলের বিরুদ্ধে কাজ বুঝায় ।
উপরের সমীকরণগুলো হতে সিদ্ধাস্ত করা যায় যে, বল প্রয়োগের ফলে যদি বনের প্রয়োগ বিন্দুর সরণ ঘটে তবেই কাজ সাধিত হবে। এটিই কাজের শর্ত।
কাজ দুটি দিক রাশি ও এর ডট বা স্কেলার গুণফল। এটি একটি স্কেলার রাশি। কাজের শুধুমাত্র মান রয়েছে।
কতকগুলো বল যদি একসাথে বস্তুর উপর কাজ করে, তবে প্রতিটি বল দ্বারা কাজের পরিমাণ পৃথক পৃথকভাবে নির্ণয় করে সবগুলোকে একত্রে যোগ করে মোট কাজের পরিমাণ পাওয়া যায়। অর্থাৎ মোট কাজের পরিমাণ।
W = w1 + w2 + w3 +…….. + wn
কাজ পরিমাপের সংজ্ঞা এবং সমীকরণ অনুসারে বল প্রয়োগের ফলে যদি বলের প্রয়োগ বিন্দুর সরণ না ঘটে,
তবে কাজ W= 0।
সুতরাং শূন্য কাজের নিম্নোক্ত সংজ্ঞা দেয়া য়ায়।
সংজ্ঞা ঃ বল প্রয়োগের ফলে যদি বস্তুর সরণ না হয় ( = 0), অর্থাৎ বলের প্রয়োগ বিন্দু স্থির থাকে অথবা প্রয়োগ বিন্দু বলের উল্লম্ব অভিমুখে ( = 90°) সরে যায়। তবে বলের দ্বারা শূন্য কাজ হয়েছে বুঝাবে ।
(ক) একজন লোক একটি ভারী বাক্স মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে লোকটি কোন কাজ করছে না, কারণ বাক্সটির কোন সরণ নেই ।
(খ) স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কেটে স্থির থাকলে কোন কাজ করা হয় না।
(গ) একটি বস্তু দড়িতে বেঁধে বৃত্তাকার পথে ঘুরালে কোন কাজ হবে না। কেননা প্রতি মূহূর্তে বস্তুটির বেগ বা সরণ বস্তুর অবস্থান বিন্দু হতে বৃত্তের স্পর্শক বরাবর এবং বলের দিক কেন্দ্রমুখী। অর্থাৎ কেন্দ্রমুখী বল ও সরণের অন্তর্ভুক্ত কোণ 90°। সুতরাং, কেন্দ্রমুখী বল দ্বারা কৃত কাজ শূন্য।
আমরা জানি,
কাজ W = = Fs cos
উপরের সমীকরণের ডানপাশে Fs ও cos তিনটি রাশি রয়েছে। এদের যে কোন একটি শূন্য হলে ডানপক্ষ অর্থাৎ কাজ শূন্য হবে।
(ক) যদি বস্তুতে বল প্রয়োগ না করা হয় তবে কাজ W = 0 হবে।
(খ) বল প্রয়োগ করার ফলে যদি বস্তুর সরণ না ঘটে, তবে W= 0 হবে।
(গ) যদি cos = 0 হয়, অর্থাৎ = 90° হয়, তবে w = 0 হবে। এ অবস্থা ঘটবে যখন বল F ও সরণ s-এর মধ্যবর্তী কোণ 90° হবে।
বলের দ্বারা কাজ | বলের বিরুদ্ধে কাজ |
---|---|
১। যদি বল প্রয়োগের ফলে বলের দিকে বলের প্রয়োগ বিন্দুর সরণ ঘটে বা বলের দিকে সরণের ধনাত্মক উপাংশ থাকে তবে ঐ সরণের জন্য কৃতকাজকে বলের দ্বারা কাজ বলে। | ১। যদি বল প্রয়োগের ফলে বলের বিপরীত দিকে বলের প্রয়োগ বিন্দুর সরণ ঘটে বা বলের দিকে সরণের ঋণাত্মক উপাংশ থাকে তবে ঐ সরণের জন্য কৃতকাজকে বলের বিরুদ্ধে কাজ বলে। |
২। বলের দ্বারা কাজ ধনাত্মক রাশি। | ২। বলের বিরুদ্ধে কাজ ঋণাত্মক রাশি। |
৩। বলের দ্বারা কাজ হলে বস্তুতে ত্বরণের সৃষ্টি হয়। | ৩। বলের বিরুদ্ধে কাজ হলে বস্তুর উপর মন্দন সৃষ্টি হয়। |
৪। বলের দ্বারা কাজ হলে স্থিতিশক্তি হ্রাস পায়। | ৪। বলের বিরুদ্ধে কাজ হলে স্থিতিশক্তি বৃদ্ধি পায়। |
৫। বলের দ্বারা কাজ হলে গতিশক্তি বৃদ্ধি পায়। | ৬। বলের বিরুদ্ধে কাজ হলে গতিশক্তি হ্রাস পায়। |
৬। বলের দ্বারা কাজের ক্ষেত্রে 90° < <0° | ৬। বলের বিরুদ্ধে কাজের ক্ষেত্রে 180°> < 90° । |
কাজের একক আলোচনা করার আগে একক কাজ কি তা জানা দরকার। কোন বস্তুর উপর একক বল প্রয়োগে বলের ক্রিয়ারেখা বরাবর যদি বস্তুর একক সরণ হয়, তবে যে পরিমাণ কাজ সম্পন্ন হয়, একক কাজ বলে ।
এ পদ্ধতিতে কাজের পরম একক হল জুল (Joule)। এক নিউটন বল প্রয়োগের ফলে বলের ক্রিয়া রেখা বরাবর বস্তুর সরণ যদি এক মিটার হয়, তবে যে কাজ সম্পন্ন হয় তাকে এক জুল বলে।
:- 1 জুল = 1 নিউটন × 1 মিটার।
তাৎপর্য : ধরা যাক 50J পরিমাণ কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে।
এখন, 50J = 50 N x 1m = 1N × 50m = 5N × 10m ইত্যাদি।
সুতরাং, 50J কাজ সম্পাদন বলতে বুঝায় 50 N বল প্রয়োগ করে বলের দিকে 1 m সরণ ঘটান বা 1 N বল প্রয়োগ করে 50 m সরণ ঘটান; কিংবা 5N বল প্রয়োগ করে 10m সরণ ঘটান ইত্যাদি।
পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞানে কাজ পরিমাপের জন্য ইলেকট্রন ভোল্ট (eV) নামে পরিচিত একটি সুবিধাজনক একক ব্যবহার করা হয়। এক ভোল্ট বিভব পার্থক্যে একটি ইলেকট্রনের অর্জিত শক্তিই এক ইলেকট্রন ভোল্ট ।
1eV = 1.6 x 10-19 জুল।
বিদ্যুৎবিজ্ঞানে কাজের আর একটি ব্যবহারিক একক আছে। এর নাম কিলোওয়াট-ঘণ্টা (K. W. H.)।
এক কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কোন উৎস এক ঘণ্টায় যে পরিমাণ কাজ সম্পন্ন করে তাকে এক কিলোওয়াট-ঘণ্টা বলে।
কাজের মাত্রা সমীকরণ :
কাজের মাত্রা সমীকরণ : [W] = [বল ] x [সরণ] = [MLT-2] [L] = [ML2T-2]।
(১) মনে করি 'm' ভরবিশিষ্ট একটি বস্তুকে অভিকর্ষ বলের প্রভাবে ‘h’ উচ্চতা হতে ফেলা হল।
কৃত কাজ = বল x সরণ
বা, W= F × h=mgh [:- F = mg]
বা, W = ভর x অভিকর্ষীয় ত্বরণ × উচ্চতা
অভিকর্ষ বলের দিক নিচের দিকে এবং এক্ষেত্রে সরণ ও নিচের দিকে। অর্থাৎ, বল ও সরণ একই দিকে হওয়ায় কাজ ধনাত্মক।
(২) ‘m’ ভরবিশিষ্ট একটি বস্তুকে অভিকর্ষ বলের বিরুদ্ধে ‘h’ উচ্চতা উপরে উঠালে
কৃত কাজ = ভর x অভিকর্ষীয় ত্বরণ x উচ্চতা [বা, W= mgh]
এক্ষেত্রে বল ও সরণ বিপরীত দিকে হওয়ায় এই কাজ ঋণাত্মক।
(৩) মনে করি 'm' ভরবিশিষ্ট একটি বস্তু কোন একটি মসৃণ নততল বেয়ে A হতে B-তে সরে এল। যদি g অভিকর্ষীয় ত্বরণ হয়, তবে অভিকর্ষ বল mg বস্তুটিকে খাড়াভাবে নিচের দিকে টানবে।
ধরি সরণের অভিমুখ এবং অভিকর্ষ বলের অভিমুখের মধ্যে ও কোণ আছে এবং AB = s
অভিকর্ষ বল mg-এর দিকে সরণের অংশ = s cos
যদি তল না থাকত তবে বস্তুটি যে সময়ে A হতে B-তে যায়, সে সময়ে তা AC = h দূরত্ব নিচে নামত ।
h = s cos
কৃত কাজ, W=mgs cos বা, W=mgh
তলটি অনুভূমিকের সাথে x কোণে অবস্থান করলে, = ( 90° – )