ইঞ্জিন (Engine) শব্দটি এসেছে প্রাচীন ফরাসি “engin” এবং ল্যাটিন “ingenium” শব্দ থেকে। আমরা জানি, শক্তির সৃষ্টি বা ধ্বংস নেই, এক রূপ থেকে অন্য রূপে নেয়া যায় মাত্র। সাধারণত যে যন্ত্র শক্তির অন্য যেকোনো রূপকে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তর করে, তাকে ইঞ্জিন বলে। যেমন: ইলেক্ট্রিক মোটর, তাপ ইঞ্জিন প্রভৃতি।
তাপ ইঞ্জিন
তাপগতিবিজ্ঞান অনুসারে, যে যন্ত্রটি তাপ শক্তিকেকার্যকর যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তর করে, তাকে তাপ ইঞ্জিন বা সংক্ষেপে ইঞ্জিন বলে। এটি তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রের ওপর নির্ভর করে তৈরি করা হয়।
তাপ ইঞ্জিনের ব্যবহার
সহজ ভাষায়, ইঞ্জিনের সাহায্যে আমরা গতি (Motion) পাই। ইঞ্জিন আবিষ্কারের পূর্বে মানুষ গতি তৈরি করতো হতো, নিজের পেশী শক্তি দিয়ে না হয় কোন প্রাণী দিয়ে। এখনও আমরা এমন যন্ত্র দেখিনা তা কিন্তু নয়। যেমন রিক্সা, ভ্যান, গরুর গাড়ি ইত্যাদি। ১৭৭২ সালে ইংলিশ বিজ্ঞানী থমাস নিউকমেন বাষ্প চালিত পাম্প আবিষ্কার করে, যে টি খনি থেকে পানি তুলতে ব্যবহার করা হত। এর পূর্বে যে কোন প্রচেষ্টা হয়নি তা কিন্তু নয়। তবে শিল্প বিপ্লবের শুরু যার হাত ধরে তার নাম হল জেমস ওয়াট (১৭৩৬-১৮১৯)। তার ওপর দায়িত্ব ছিল থমাস নিউকমেন এর আবিষ্কৃত বাষ্প ইঞ্জিনকে আরো উন্নত করা। তার ফলশ্রুতিতে যে বাষ্প ইঞ্জিন আবিষ্কৃত হয় তার মাধ্যমে মুলত শিল্প বিপ্লবের সূচনা। বাষ্পের যে চাপ তৈরী হয় তার মাধ্যমে একটি পিস্টন* কে ধাক্কা দেয় এবং পিস্টনটি যুক্ত থাকে একটি কানেকটিং রড এর সাহায্যে Crank Shaft* এর সাথে।
এভাবেই Motion পাওয়া যায়। বাষ্প ইঞ্জিন দিয়ে চলত বাষ্প চালিত ট্রেন। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাষ্প ইঞ্জিনের সাহায্যে শিল্প বিপ্লব হয়। মানুষের জীবনে আসে গতি। উৎপাদন বেড়ে যায় বহুগুণে। বাষ্প ইঞ্জিনে কয়লা দিয়ে পানিকে বাষ্প করা হত। আরেকটি নতুন একটা শব্দ জানা প্রয়োজন তা হল দহন (Combustion)। যে কোন জ্বালানীকে আগুনে পোড়ালে তাপ উৎপন্ন হয়। এই প্রক্রিয়াকে দহন বলে। দহন কোথায় হচ্ছে তার ওপর ভিত্তি করে ইঞ্জিনকে ২ ভাগে ভাগ করা হয়। যেমনঃ অন্তঃ দহন (Internal Combustion) ইঞ্জিন অর্থাৎ এই ইঞ্জিনের ভেতরেই দহন হয়। এবং বহিঃ দহন (External combustion) ইঞ্জিন অর্থাৎ দহন ইঞ্জিনের বাহিরে সম্পন্ন হয়। যেমনঃ বাষ্প ইঞ্জিন। বাষ্প ইঞ্জিন আবিষ্কারের পর অনেক সময় চলে যায়। বিভিন্ন প্রচেষ্টা চলে আরো উন্নত, এবং কম জ্বালানী দিয়ে কিভাবে ভাল ইঞ্জিন তৈরি করা যায়। আচ্ছা আরেকটু চিন্তা করা যাক, আমরা যে গাড়িগুলো ব্যবহার করি সচারচর যেমনঃ মোটরসাইকেল, বাস, ট্রাক, কার ইত্যাদি। এগুলোর ইঞ্জিন কেমন? External combustion ইঞ্জিন দিয়ে কি এগুলো চালানো সম্ভব? অবশ্যই না। যদি তাই হত তাহলে বাসের পিছনে একটি চুল্লি থাকত আর সেখানে কয়েকজন কয়লা দিয়ে আগুন জ্বালাতো। বিশাল বড় একটা পানি গরম করার পাত্র থাকতে হত। আরো কত কি। তাহলে মানুষ বসত কোথায়? তাই না। এই সমস্যার সমাধান হয়েছে Internal Combustion ইঞ্জিন এর সাহায্যে। এই ইঞ্জিনের সুন্দর মডেল প্রথম যিনি দিয়েছিলেন তার নাম নিকোলাস অটো (Nicolaus otto)।
জার্মান এই নাগরিক ১৬ বছর বয়সেই স্কুল ছেড়ে দেন। প্রথমে মুদির দোকানে কাজ করেন তারপর ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা হিসাবে কাজে যোগদান করেন। কাজের জন্য তাকে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হত। ফলে যাতায়াতের অসুবিধা তাকে খুব ভোগাত। তখন সে সপ্ন দেখত এমন একটি যানবাহনের যেটি শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাবে কিন্তু সময় নিবে কম। ১৮৬২ সালে সে একজনের সঙ্গে কাজ শুরু করে কয়েকটি ডিজাইন করেন। কিন্তু সফল হন ১৮৭৬ সালে। এই মূলনীতির ওপর ভিত্তি করেই বর্তমানে অটোমোবাইল এর ইঞ্জিন তৈরি হচ্ছে , যদিও ডিজাইনে অনেক পরিবর্তন হয়েছে এটা মানতে হবে। এই ইঞ্জিনকে গ্যাসোলিন ইঞ্জিনও (Gasoline Engine) বলা হয়। গ্যাসোলিন হল একধরনের জ্বালানী শ্রেণী। যার মধ্যে বহুল ব্যবহৃত হল পেট্রোল, অকটেন ইত্যাদি। এই জন্য এদেরকে পেট্রোল ইঞ্জিন (Petrol Engine) ও বলে। আরেকজন ইঞ্জিনিয়ার এর কথা না বললেই নয়। তিনি হলেন রুডলফ ডিজেল (Rudlof Diesel). প্যারিস এই বিজ্ঞানী ১৮৯২ সালে আরেক ধরনের ইঞ্জিন আবিষ্কার করেন তার নাম ডিজেল ইঞ্জিন (Diesel Engine)।
এই ইঞ্জিনের জ্বালানী হল অন্য শ্রেণীর। বাস, ট্রাক সহ বড় বড় যানবাহন যেগুলোকে অনেক লোড নিতে হয় সেগুলোতে ডিজেল ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে অনেক গাড়ির ইঞ্জিনে জ্বালানী হিসেবে তেলের পরিবর্তে CNG ব্যবহার করা হয়। ইঞ্জিন ডিজাইন, ইঞ্জিন এর জ্বালানী, ইঞ্জিনের তৈরি ধোঁয়া থেকে যে দূষণ ইত্যাদি নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আজ ও প্রচুর কাজ হচ্ছে, গবেষনা চলছে।