আমরা এখন একটি নতুন ধারণার অবতারণা করব যা এন্ট্রপি নামে পরিচিত এবং যা বিজ্ঞানের আলোচনায় মৌলিক গুরুত্ববহ একটি রাশি। কোনো সিস্টেমে শক্তি থাকলেই যে তাকে প্রয়োজনীয় কাজে লাগানো যাবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই । এটা নির্ভর করে সিস্টেমের তাৎক্ষণিক অবস্থার ওপরে। নিচের উদাহরণ দ্বারা বিষয়টি আরো স্পষ্ট করা যাক। ধরা যাক, দুটি পানিপূর্ণ পাত্র নিয়ে একটা সিস্টেম। একটি পাত্রে 90°C উষ্ণতার 5 kg পানি এবং অন্য পাত্রে 10°C উষ্ণতার 5 kg পানি আছে। এখন 90°C উষ্ণতার পাত্রটিকে তাপ উৎস এবং 10°C উষ্ণতার পাত্রটিকে তাপগ্রাহক ধরে আমরা একটা ইঞ্জিন চালু করতে পারি। পাত্র দুটি একই তাপমাত্রায় না পৌঁছা পর্যন্ত এই সিস্টেম হতে বেশ কিছু পরিমাণ কাজ পেতে পারি। কিন্তু এখন যদি আমরা পাত্র দুটির পানি মিশিয়ে দেই তাহলে আমরা 50°C উষ্ণতার 10 kg পানি পাব, কিন্তু এই পানি থেকে ইঞ্জিন কোনো কাজ পেতে আর সক্ষম হবে না, কারণ পাত্র দুটির পানির উষ্ণতার পার্থক্য না থাকায় তাপের প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাবে। তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্র অনুসারে পাত্র দুটির পানির মোট শক্তির পরিমাণ মেশানোর পূর্বে ও পরে একই থাকলেও মেশানোর পরে সিস্টেমটি সাম্যাবস্থায় পৌঁছে যাওয়ায় এটি আর তাপ শক্তিকে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারবে না। কোনো সিস্টেমের শক্তির রূপান্তরের অক্ষমতাকে এনট্রপি বলে ।
আমরা জানি, কোনো গ্যাসকে রুদ্ধতাপীয় প্রক্রিয়ায় সঙ্কুচিত করলে গ্যাসের ওপর কৃতকাজ গ্যাসের অভ্যন্তরীণ শক্তি ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে । আবার রুদ্ধতাপীয় প্রক্রিয়ায় কোনো গ্যাসকে প্রসারিত হতে দিলে গ্যাসকে কিছু কাজ করতে হয়। ফলে গ্যাসের অভ্যন্তরীণ শক্তি ও তাপমাত্রা কমে যায়। সুতরাং দেখা যায় যে, রুদ্ধতাপীয় প্রক্রিয়ায় গ্যাসের অভ্যন্তরীণ শক্তি ও তাপমাত্রা উভয়েরই পরিবর্তন হয়। কিন্তু সমোষ্ণ প্রক্রিয়ায় যেমন তাপমাত্রা স্থির থাকে রুদ্ধতাপীয় প্রক্রিয়ায় তেমনি কোনো একটি রাশি স্থির থাকে। ক্লসিয়াস এই রাশিটির নাম দেন এনট্রপি । এনট্রপি একটি ভৌত রাশি, একে S দ্বারা সূচিত করা হয় ।
কোনো সিস্টেমের শক্তি রূপান্তরের অক্ষমতা বা অসম্ভাব্যতাকে বা রূপান্তরের জন্য শক্তির অপ্রাপ্ততাকে এনট্রপি বলে। কোনো বস্তুর এনট্রপির পরম মান আজও জানা সম্ভব হয়নি। তবে কোনো বস্তু যদি তাপ গ্রহণ অথবা বর্জন করে,
তাহলে বস্তুর এনট্রপির পরিবর্তন হয়। কোনো সিস্টেমের তাপমাত্রার সাপেক্ষে গৃহীত বা বর্জিত তাপ পরিবর্তনের সিস্টেমের তাপমাত্রার হার দ্বারা এনট্রপির পরিবর্তন পরিমাপ করা হয়। যদি কোনো সিস্টেমের 7 তাপমাত্রায় dQ পরিমাণ তাপ গ্রহণ বা বর্জন করার ফলে এনট্রপির পরিবর্তন ds হয় তাহলে,
.. (1.32)
রুদ্ধতাপীয় প্রক্রিয়ায় যেহেতু কার্যনির্বাহী বস্তুর সাথে বাইরের তাপের কোনো আদান প্রদান হয় না, কাজেই dQ= 0,
সুতরাং সমীকরণ (1.32) থেকে দেখা যায় যে, এনট্রপির পরিবর্তন, = 0.. (1.33)
অর্থাৎ রুদ্ধতাপীয় প্রক্রিয়ায় এনট্রপির কোনো পরিবর্তন হয় না।
(1.32) সমীকরণ থেকে আমরা পাই, এনট্রপি বা এনট্রপি পরিবর্তনের একক জুল/কেলভিন বা JK-1
(ক) প্রত্যাবর্তী প্রক্রিয়ার এনট্রপির পরিবর্তন : কার্নোচক্র একটি প্রত্যাবর্তী চক্র।
১.১০ চিত্রে ABCD একটি কার্নোচক্র। কার্নোচক্র থেকে দেখা যায় যে, AB একটি সমোষ্ণ সম্প্রসারণ রেখা এবং CD একটি সমোষ্ণ সঙ্কোচন রেখা। আবার BC একটি রুদ্ধতাপীয় সম্প্রসারণ রেখা ও DA একটি রুদ্ধতাপীয় সঙ্কোচন রেখা। রুদ্ধতাপীয় রেখা বলে BC ও DA বরাবর তাপের কোনো পরিবর্তন হয় না।
AB সমোষ্ণ রেখা বরাবর এনট্রপির পরিবর্তন =
CD সমোষ্ণ রেখা বরাবর এনট্রপির পরিবর্তন =
: কার্য নির্বাহী বস্তুর মোট এনট্রপির পরিবর্তন = - ... (1.34)
কিন্তু কার্নো চক্রে, =
:-মোট এনট্রপির পরিবর্তন ds = - = 0.. (1.35)
অর্থাৎ প্রত্যাবর্তী চক্রে এনট্রপি স্থির থাকে।
আবার অপ্রত্যাবর্তী প্রক্রিয়ায় এনট্রপি স্থির থাকে না। ধরা যাক, দুটি বস্তু পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পরস্পরের সংস্পর্শে আছে। বস্তু দুটির তাপমাত্রা যথাক্রমে T1 ও T2 । যদি T1 > T2 হয় তাহলে উত্তপ্ত বস্তু থেকে শীতল বস্তুতে তাপ সঞ্চালিত হবে। ধরা যাক, খুব অল্প সময়ের মধ্যে dQ পরিমাণ তাপ উত্তপ্ত বস্তু হতে শীতল বস্তুতে সঞ্চালিত হলো। অর্থাৎ উত্তপ্ত বস্তু dQ পরিমাণ তাপ হারাল এবং শীতল বস্তু dQ পরিমাণ তাপ লাভ করল।
সুতরাং - =উত্তপ্ত বস্তুর এনট্রপি হ্রাস এবং =শীতল বস্তুর এনট্রপি বৃদ্ধি
সুতরাং তাপ সঞ্চালনের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, তাপ প্রবাহের দিক এমন হবে যেন এনট্রপি বৃদ্ধি পায় । প্রকৃতিতে সবকিছুই সাম্যাবস্থা পেতে চেষ্টা করে। একটি সিস্টেম যতই সাম্যাবস্থার দিকে এগিয়ে যায় ততই তার কাছ থেকে কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়, সাম্যাবস্থায় পৌঁছলে সিস্টেম থেকে আর কোনো কাজই পাওয়া যাবে না। সিস্টেমের এই শক্তির রূপান্তরের অক্ষমতা বা অসম্ভাব্যতাই হচ্ছে এনট্রপি। এক বা একাধিক সিস্টেম যত সাম্যাবস্থার দিকে এগিয়ে যায় তাদের এনপিও তত বাড়তে থাকে। সাম্যাবস্থায় এন্ট্রপি সবচেয়ে বেশি হয়। অর্থাৎ যখন কোনো সিস্টেম থেকে আর কাজ পাওয়া যায় না তখন তার এনটুপি হয় সর্বাধিক। আমরা আগেই দেখেছি যে সকল স্বতঃস্ফূর্ত পরিবর্তন সর্বদা সাম্যাবস্থার দিকে পরিচালিত হয়। সুতরাং সকল স্বতঃস্ফূর্ত পরিবর্তনেই এনট্রপি বৃদ্ধি পায়। যেহেতু প্রকৃতিতে সবকিছুই সাম্যাবস্থা পেতে চায়, তাই বলা যায় যে, জগতে এন্ট্রপি ক্রমাগত বাড়ছে। জগতের এনট্রপি যখন সর্বোচ্চে পৌঁছাবে তখন সব কিছুর তাপমাত্রা এক হয়ে যাবে। ফলে তাপশক্তিকে আর যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত করা যাবে না।
এনট্রপি ও বিশৃঙ্খলা ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত। কোনো সিস্টেমের এনট্রপি বাড়ার সাথে সাথে সেখান থেকে কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায় তেমনি সিস্টেমের বিশৃঙ্খলাও বৃদ্ধি পায়। উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি পরিষ্কার করা যেতে পারে। একটা গ্লাসে খানিকটা লবণ রেখে তাতে যদি পানি মেশানো হয় তবে লবণ পানিতে গুলে যেতে থাকবে এবং লবণের অণু বা তার আয়নগুলো পানির মধ্যে চারদিকে এলোমেলো ছড়িয়ে পড়তে থাকবে। কঠিন অবস্থায় লবণের মধ্যে আয়নগুলো সুশৃঙ্খলভাবে একটা বিশেষ সজ্জায় বিন্যস্ত থাকে। যদিও লবণ ভারী তবুও গুলে গিয়ে সেটা নিচে পৃথক না থেকে যতোটা সম্ভব বিশৃঙ্খলভাবে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। লবণ যখন দ্রবণের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে তখন আমরা বলে থাকি দ্রবণটি সাম্যাবস্থায় এসেছে। সাম্যাবস্থায় আসলে সিস্টেমের অণুগুলো চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা প্রাপ্ত হয় । এনট্রপিকে তাই বলা হয় সিস্টেমের বিশৃঙ্খলতার মাপকাঠি।
কোনো সিস্টেমের উপর বাইরে থেকে শক্তি প্রয়োগ করে যদি শৃঙ্খলা আনার চেষ্টা করা হয় তাহলে সিস্টেমের এনট্রপি কমে যাবে । বস্তু যখন কেলাসিত অবস্থায় থাকে তখন অণুগুলো সুসংবদ্ধ সুশৃঙ্খল সমাবেশে থাকে, সেই কারণে কঠিন অবস্থায় বস্তুর এনট্রপি খুব কম। একে সৈন্যদের প্যারেড করা বা শিক্ষার্থীদের ক্লাসে বসে লেকচার শোনার সাথে তুলনা করা চলে। সুশৃঙ্খল প্যারেডের সময় বা ক্লাসে লেকচার শোনার সময় এনট্রপি হবে কম। প্যারেড শেষে সৈন্যরা যেমন ছড়িয়ে পড়ে বা ঘণ্টা পড়লে শিক্ষক ক্লাস থেকে চলে গেলে শিক্ষার্থীরা যেমন বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে তখন এনট্রপি বেড়ে যায় ।
আরও দেখুন...