জাহিলিয়া যুগে আরবের অবস্থা
হযরত মুহাম্মদ (স)-এর আবির্ভাবের পূর্বে আরবসহ গোটা বিশ্ব ছিল জাহিলিয়াতের গর্ভে নিমজ্জিত। খ্রিষ্টিয় ষষ্ঠ শতাব্দীর কিছু পূর্বে বা ষষ্ঠ শতাব্দীর শুরু হতে সমস্ত পৃথিবীই অজ্ঞতার চরম সীমায় পৌঁছে ছিল। আরব ভূ-খণ্ডেও এ অজ্ঞতা কুসংস্কারের সয়লার বয়ে গিয়েছিল। আইন-কানুন নিয়ম-শৃক্সখলা, নীতি-নৈতিকতার কোন বালাই ছিল না। ঝগড়া-বিবাদ মানুষের স্বভাবে পরিণত হয়েছিল। লজ্জাহীনতা, বেহায়পনা ও অশ্লীলতায় সমাজ ভেসে গিয়েছিল। মাদকাসক্তি ও ব্যভিচারে সমাজ কলুষিত হয়ে পড়েছিল। নারীদের কোন অধিকার ছিল না। নারীদের উপর নানা অত্যাচার ও নির্যাতন চলত। ক্ষেত্রে বিশেষে কন্যা সন্তানকে জীবন্ত করব দিতেও দ্বিধাবোধ করত না। একত্ববাদ অর্থাৎ এক আল্লাহর কথা ভুলে গিয়ে নানা দেব-বেদীর পূজা করত। কাবা ঘরে ই ৩৬০টি মূর্তি স্থাপন করে পূজা করা হত। শাসন পদ্ধতি বা সরকার গঠনের কোন নীতি-নিয়ম ছিল না। গোত্রীয় শাসনের মধ্য দিয়ে সমাজ পরিচালিত হত। মোটকথা নীতি-নৈতিকতা, শিক্ষা-সভ্যতা, মানবতাবোধ ও ধার্মিকতার কোন পরিবেশ ছিল না। সুস্থ্য পরিবেশ ছিল না আর্থ-সামাজিক বা রাজনৈতিক জীবনেও। তবে আরবদের জীবনে কিছু প্রশংসনীয় দিক ছিল। তাদের ভাষা ছিল সমৃদ্ধ। কাব্য চর্চা, আতিথেয়তা ও নির্ভীকতায় আরবরা ছিল অসাধারণ। হযরত মুহাম্মদ (স)-এর আবির্ভাবে ও তাঁর শিক্ষায় এ অমানিশার অবসান ঘটে। আর সত্য সুন্দরের নতুন আলোয় আরবসহ গোটা বিশ্ব উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।
এই ইউনিটে জাহিলিয়া যুগে আরবের সার্বিক অবস্থা আলোচনা করা হয়েছে।
পাঠ
১ আইয়ামে জাহিলিয়া
উদ্দেশ্য
আ পাঠ শেষে আপনি-
■ আইয়ামে জাহিলিয়া কাকে বলে বর্ণনা করতে পারবেন
■ আইয়ামে জাহিলিয়া সম্বন্ধে ঐতিহাসিক মতামতের বিবরণ দিতে পারবেন
■ আইয়ামে জাহিলিয়ার সময়কাল নির্ণয় করতে পারবেন।
আইয়ামে জাহিলিয়া কাকে বলে
"আইয়াম" শব্দের অর্থ সময় বা যুগ এবং জাহেলিয়া শব্দের অর্থ অজ্ঞতা বা তমসা। সুতরাং আইয়্যামে জাহেলিয়া বলতে 'তমসা বা 'অজ্ঞতার যুগ বুঝায়। পি. কে. হিট্রির মতে, প্রকৃত পক্ষে জাহেলিয়া বলতে সেই যুগকে বুঝায় যে যুগে আরবে কোন নিয়ম কানুন ছিল না, কোন নবীর আবির্ভাব ঘটে এবং কোন ঐশী কিতাব নাজিল হয় নাই।
আইয়ামে জাহিলিয়ার ব্যাপ্তি
ঐতিহাসিকগণ আইয়্যামে জাহেলিয়ার সময়কালের ব্যাপ্তি সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মত দিয়েছেন। যেমন-
ক. কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে হযরত আদম (আ)-এর সৃষ্টিকাল হতে শুরু করে হযরত মুহাম্মাদ (স)-এর নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত এ দীর্ঘ সময়কে আইয়্যামে জাহেলিয়া বলা হয়। কিন্তু এ মতবাদ গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এই দীর্ঘ সময়ে বিপথগামী মানুষকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য অনেক নবী ও রসুলের অবসান খ. ঘটেছিলৗতিহাসিকের মতে- হযরত ঈসা (আ) এর ইন্তেকালের তার থেকে ইসলামের আবির্ভাব পর্যন্ত কালকে
'আইয়্যামে জাহেলিয়ার যুগ বলা হয়। এই অভিমত আংশিক গ্রহণ যোগ্য।
গ. ইংরেজ পি. কে. হিট্রি, ইসলামের আবির্ভাবে পূর্ববর্তী এক শতাব্দীকালকে আইয়্যামে জাহেলিয়া বলে উল্লেখ করেছেন। তমসা যুগের ব্যপ্তিকাল সম্পর্কে এই অভিমত সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য। এ সময়েই আরব দেশে দুর্নীতি, কুসংস্কার প্রচলিত ছিল এবং এ যুগেই তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় জীবন অধঃপতনের পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল বলে একে অন্ধকার যুগ বলা হয় ।
তবে ইতিহাস বিশ্লেষকগণ উপরিউক্ত সংজ্ঞায় আরবকে যুক্ত করার ব্যাপারে ভিন্ন মত প্রকাশ করেন। তারা বলেন, তদানীন্তন সময়ে দক্ষিণ আরব জ্ঞান-গরিমায় উন্নত ছিল এবং তারা সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য চেতনাসহ নানা সদগুণাবলীর অধিকারী ছিল। তবে উত্তর আরব ও মধ্য আরবের হেজাজ ও তৎসলগ্ন এলাকা ইসলামের আবির্ভাবের পূর্ব পর্যন্ত অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। আন্তর্জাতিক কার্যকলাপে তারা কোন খ্যাতি অর্জন করতে পারে নাই । উক্ত অঞ্চলের পরিবেশ ও পরিস্থিতি বিবেচনা করেই আইয়্যামে জাহেলিয়ার সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়েছে। তাই প্রকৃত অর্থে জাহিলী যুগ বলতে বোঝায় আরবের সেই সময় কালকে যখন সেখানে কোন নবী-রাসুলের আবির্ভাব ঘটেনি বা বা কোন ঐশী কিতাব নাযিল হয়নি। ফলে সমাজ-সংস্কারের অভাবে অন্যায় অবিচার ধর্মীয় কুসংস্কার ইত্যাদি নানা অনাচারে ছেয়ে গিয়েছিল। -এক কথায় বলা যায়, এই অন্ধকার সময়ই আইয়্যামে জাহেলিয়া ।
সার-সংক্ষেপ
হযরত মুহাম্মদ (স) এর নবুওয়াত লাভের পূর্বে আরবের লোকেরা ঐশী বাণীর অভাবে অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল । তখন আরবদের মধ্যে নানারূপ ধর্মীয় অনাচার ও কুসংস্কার বিরাজ করছিল। তারা নানা পাপাচারে আসক্ত ছিল। ইসলামের ইতিহাসের ভাষায় বিশ্বনবীর (স) আবির্ভাবের পূর্ববর্তী যুগই আইয়ামে জাহিলিয়া বা অন্ধকার যুগ Age of Ignorance |
আরবের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি-
আরবের ভৌগোলিক অবস্থান বর্ণনা করতে পারবেন
আরবের সীমা, আয়তন ও ভূ-প্রকৃতি বর্ণনা করতে পারবেন
আরবের ভূ-প্রকৃতির উপর জলবায়ুর প্রভাব বিশ্লেষণ করতে পারবেন
আরব চরিত্রের উপর ভৌগোলিক অবস্থা কি প্রভাব ফেলেছিল তার বিবরণ দিতে পারবেন।
অবস্থান
আরবদেশ এশিয়ার দক্ষিণ পশ্চিম কোণে অবস্থিত একটি বিশাল উপদ্বীপ। এটা পৃথিবীর বৃহত্তম উপদ্বীপ এবং মরুভূমির দেশ হিসেবে খ্যাত। আরবভূমি এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা এ তিন মহাদেশের সংযোগ স্থলে অবস্থিত। আরবের এ ভৌগোলিক পরিবেশ ও ভূ-প্রকৃতি আরববাসীদের জীবনে বিপুল প্রভাব ফেলেছিল ।
সীমা ও আয়তন
এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার সঙ্গমস্থল আরব উপদ্বীপ। এর উত্তরে ইরাক, ট্রান্স জর্ডান ও সিরিয়ার মরুভূমি, দক্ষিণে ভারত মহাসাগর, পূর্বে পারস্যোপসাগর এবং পশ্চিমে লোহিত সাগর রয়েছে। পৃথিবীর মানচিত্রে আরব উপদ্বীপ বৃহত্তম। এর আয়তন ১০,২৭,০০০ বর্গমাইল । আরব দেশ তিন দিকে সমুদ্র ও একদিকে স্থল ভাগ দ্বারা বেষ্টিত বলে একে ‘জাযিরাতুল আরব' বা আরব উপদ্বীপ বলা হয় ।
আরবের ভূ-প্রকৃতি
আরব উপদ্বীপ একটি বিশাল মালভূমি। এর পশ্চিম প্রান্ত অন্যান্য প্রান্ত অপেক্ষা উঁচু। এর পশ্চিম দিক হতে পূর্বদিক
ক্রমশ ঢালু। মধ্য আরবে কয়েকটি পর্বতশৃঙ্গ রয়েছে। এগুলো সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে ৪০০০ হতে ৬০০০ ফুট উচ্চ। লোহিত
সাগরের পাশে দাঁড়ানো পর্বতমালাকে আরব দেশের মেরুদণ্ড বলে ।
আরবের ভূ-প্রকৃতির সাথে জলবায়ুর সম্পর্ক
এশিয়ার দক্ষিণ পশ্চিম কোণে আরব অবস্থিত। দীর্ঘ অথচ কম প্রশস্ত লোহিত সাগর দ্বারা আফ্রিকা হতে বিচ্ছিন্ন। এর উপকূল রেখা সম্পূর্ণ অভগ্ন। উপরিভাগ প্রায় মরুময়, জলবায়ু সর্বত্র উষ্ণ। মরুভূমির বৃষ্টির পানি চুইয়ে যে ঝরণার সৃষ্টি হয়, তাকে ‘ওয়াদী' বলে। কাফেলার জন্য মরুবাসী বেদুইনদের জন্য এ ‘ওয়াদী' খুবই প্রয়োজনীয়। লু হাওয়ার জন্য এখানে গাছপালা জন্মায় না। এখানে- সেখানে দু' একটি মরুদ্যান ছাড়া সমগ্র আরব দেশ মরুময়। লু হাওয়ার প্রচণ্ড দাপটে অনেক মানুষ মৃত্যুবরণ করত। তবুও যারা বেঁচে থাকত, এ মরু সাইমুম ঝড়ের সঙ্গে প্রচণ্ড লড়াই করেই বেঁচে থাকত। প্রকৃতির নিষ্ঠুর কৃপণতা দেশবাসীর চরিত্রকে করে তুলেছিল উগ্র, সংগ্রামী ও রুক্ষ করে তুলেছিল। এখানে মাঝে মাঝে বৃষ্টিপাত হত। তবে গ্রীষ্মকালে এখানে কোন প্রাণের স্পন্দন থাকত না।
আবহাওয়া
কিছু উপকূলীয় শহর ও জলবিধৌত উপত্যকা ছাড়া আরবের আবহাওয়া খুবই উষ্ণ ও শুষ্ক। লোহিত সাগর, পারস্য উপসাগরের প্রবাহিত বাতাস এ দেশের জলবায়ুর আদ্রতা বৃদ্ধি করতে পারেনি । হেজাজ প্রদেশেও বৃষ্টিপাত খুবই কম। এমনকি একাধারে দুই তিন বছর ধরে এখানে অনাবৃষ্টি চলতে থাকে। আবার কখনো কখনো ঝড়-বৃষ্টির ফলে জন সাধারণের বিশেষ ক্ষতি সাধিত হয়।
সমগ্র প্রদেশে মদীনাই ছিল একমাত্র স্বাস্থ্যকর নগরী। চাষের উপযোগী বৃষ্টিপাত হয় ইয়েমেনে ও আসীর প্রদেশে। ইয়েমেনের আধুনিক রাজধানী সানা সমুদ্র হতে ৭০০ ফুট উচ্চ এবং তা আরবের অন্যতম স্বাস্থ্যকর ও সুন্দর শহর । হাজরা-মাউত, ওমান প্রভৃতি অঞ্চল হয় সমুদ্র বিধৌত না হয় বৃষ্টিসিক্ত হয়ে কিঞ্চিত পরিমাণে উর্বরতা লাভ করে। সমগ্র আরবে কোথাও নৌ পরিবহণের উপযোগী নদ-নদী নেই। বৃষ্টিপাত সারা বছর ১০” হতে কম। মরুভূমির তপ্ত
আবহাওয়া ও প্রচণ্ড সূর্যকিরণ সমগ্র অঞ্চলের আবহাওয়াকে মরু সদৃশ করেছে। এখানকার ভূমি অনুর্বর, অসমতল ও বালুকাময়। আরবের উচ্চ ভূমিতে গরমের সময় রাত নাতিশীতোষ্ণ হয়ে থাকে। শীতের সময় তীব্র শীতের কারণে কোন কোন সময় পানি জমাট বেঁধে যায়। আরবের উত্তম মৌসুম বসন্তকাল, এ সময় কিছুটা বৃষ্টিপাত হয়। নিম্নাঞ্চলে এ ঋতুতে জীবকুলের আহার উপযোগী তৃণ জন্মে এবং কয়েক দিনের জন্য তা শ্যামল দেখায়।
অধিবাসী ও জীবিকা
আরবগণ সেমেটিক ভাষা গোষ্ঠীর মানুষ। এরা নগরবাসী ও মরুচারী বেদুঈন এ দু'ভাগে বিভক্ত। এদের ভাষা আরবী। মরুভূমিতে ফসল ফলানো কঠিন। মরুদ্যানে গম, যব, ভুট্টা, ফলমূল ও শাকসবজি উৎপন্ন হয়। আরবের খেজুর, ইয়েমেনের মোকাকফি প্রসিদ্ধ। উট, গাধা, মেষ, ছাগল, দুম্বা প্রভৃতি গৃহপালিত জন্তু। আরবের ঘোড়া বিশ্ববিখ্যাত। কৃষিকাজ, পশুপালন ও ব্যবসায় ছিল তৎকালীন আরবের প্রধান জীবিকা। জীবজন্তুর মধ্যে উট ছিল আরববাসীদের নিকট অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ। মরুজীবনের একমাত্র সহায় ও সম্বল ছিল উট। গাছ-গাছড়ার মধ্যে খেজুর গাছ ছিল অধিকতর মূল্যবান ।
আরবদের চরিত্রের উপর ভৌগোলিক প্রভাব
আরব উপ-দ্বীপের ভৌগোলিক পরিবেশ, আবহাওয়া ও জলবায়ু আরববাসীদের সামাজিক, আর্থিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবন যাত্রার উপর প্রভাব বিস্তার করেছে। জীবন ধারণের জন্য দ্রব্য সম্ভারের দুর্গাপ্যতা আরবদের দেহ- মন ও চরিত্রের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। রুদ্র প্রকৃতির সঙ্গে অনবরত সংগ্রাম করে তারা নির্ভীক, পরিশ্রমী ও কষ্ট সহিষ্ণু জাতিতে পরিণত হয়েছিল। পরিবেশ ভেদে আরববাসীদেরকে দু'ভাগে ভাগ করা যেতে পারে-
ক. সভ্য শহরবাসী, খ. মরুচারী বেদুঈন ।
আরবের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য আরববাসীর মনের উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। আরবের অধিকাংশ মরু অঞ্চল হওয়ায় অধিবাসীদেরকে প্রকৃতির সঙ্গে নিরন্তর সংগ্রামে লিপ্ত থাকতে হত। এ জন্য তারা ছিল অত্যন্ত দুর্ধর্ষ প্রকৃতির। আইয়্যামে জাহিলিয়ায় তাদের মধ্যে সত্য ধর্ম না থাকায় তারা চিন্তায় ও আচরণে বর্বর থেকে যায়।
এখানকার বিশাল মরুভূমি ও শুষ্ক আবহাওয়া আরবের মানুষকে একদিকে যেমন করেছে রুক্ষ, নির্দয়, প্রীতিহীন; তেমন মরুভূমির নির্মম প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয় বলে আরবরা অত্যন্ত ধৈর্যশীল, পরিশ্রমী ও কষ্ট সহিষ্ণু করে তুলেছিল । দিগন্ত বিস্তৃত মরুভূমির মুক্ত পরিবেশে প্রতিপালিত বলে তাদের মধ্যে স্বাতন্ত্র্যবোধ ও স্বাধীনতা প্রীতি ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। স্বাধীনতার প্রতি এ অনুরাগের জন্যই আরব জাতি কখনো বিদেশীদের নিকট মাথা নত করেনি। ভৌগোলিক প্রভাবের কারণে চারণ ক্ষেত্র ও পেয় পানির সন্ধানে বেদুইনগণ স্ব স্ব গোত্রের দলপতির অধীনে এক স্থান হতে বসতি উঠিয়ে দল বেঁধে অন্য স্থানে চলে যেত। তাই বেদুইনদের পক্ষে স্থায়ী জীবন গড়া সম্ভব ছিলনা।
মরুভূমিতে রাত্রি ছিল ভয়ঙ্কর, ভূত-প্রেত, দৈত্য দানবের সদা আনা গোনা; এ সাধারণ বিশ্বাসে এবং মরুভূমির বিপদ হতে পথিককে রক্ষা করার জন্য আরবদের মধ্যে অতিথি পরায়ণতা বিকশিত ছিল। মরুভূমি ও অনুর্বর পর্বতাঞ্চলের কারণে আরব সমাজ গোত্র ভিত্তিক হওয়াই ছিল স্বাভাবিক। নিরাপত্তা হীনতা ও বহিরাক্রমণের ভয় তাদেরকে গোত্র প্রিয় করে তুলছিল । এ গোত্র প্রীতি তাদের মধ্যে জন্ম দেয় মানবতাবোধ এবং আত্মংযমের মত মহৎগুণ ।
সার-সংক্ষেপ
একটি জাতির চরিত্র গঠন নির্ভর করে ভৌগোলিক অবস্থা ও এর প্রভাবের উপর। আরব উপদ্বীপের বৃষ্টিপাতহীন শুষ্ক ও উষ্ণ আবহাওয়া, লবনাক্ততায় পূর্ণ এবং বালুকাময় ধূ ধূ মরুভূমি, রুক্ষ পরিবেশ স্বভাবত মরুবাসী আরবদের দুর্ধর্ষ ও সংঘাতময় জীবনযাত্রার দিকে প্ররোচিত করে। এর ফলে এক দিকে যেমন তারা হয়ে পড়ে বেপরোয়া, স্বাধীনচেতা ও নৃশংস, অপরদিকে হয়েছে অসীম সহিষ্ণু, কর্মশীল ও পরিশ্রমী। তাদের জীবন ছিল সহজ সরল ও অনাড়ম্বর। গোত্র প্রথা ভিত্তিক আরব সমাজে গোত্র প্রীতি ও দেশারাধ ছিল খুবই প্রবল। আরবরা ছিল স্বাধীনচেতা তাই তারা কখনো কারও পরাধীন ছিল না।
ইসলাম পূর্ব যুগে আরবের সামাজিক অবস্থা
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি-
■ আরবের সামাজিক অবস্থার বিবরণ দিতে পারবেন
■ ইসলাম পূর্ব যুগে আরবের সামাজিক অবস্থা মূল্যায়ন করতে পারবেন।
ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরবের সামাজিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। বিভিন্ন পাপাচার, ব্যভিচার, দুর্নীতি, কুসংস্কার, অনাচার, অরাজকতা, ঘৃণ্য আচার-অনুষ্ঠান ও নিন্দনীয় কর্মকাণ্ডে কলুষিত হয়ে পড়েছিল সমাজ। গোত্র ভিত্তিক আরব সমাজের দুটো পৃথক শ্রেণী মরুবাসী বেদুঈন এবং শহরবাসী আরবদের জীবনযাত্রা প্রণালী ছিল একই সূত্রে গাঁথা। উভয় শ্রেণীর বৈবাহিক সম্পর্ক ও আচার-অনুষ্ঠান, ধ্যান-ধারণা ও রীতিনীতি ছিল প্রায় একই রকম।
মাদকাসক্তি
প্রাক-ইসলামী যুগের আরবগণ মাদকাসক্তিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিল। ঐতিহাসিক খোদা বকসের ভাষায়ঃ War, women and wine were there observing passions of the Arabs. অর্থাৎ 'যুদ্ধ, নারী ও মদ নিয়ে তারা সর্বদা লিপ্ত থাকতো।' মাদকাসক্ত আরবরা যে কোন গর্হিত কাজ করতে দ্বিধা করত না।
নারীর অবস্থান
সমকালীন বিশ্বের যে কোন দেশের তুলনায় আরবের নারী জাতির অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয় । সে যুগে নারীরা ছিল ভোগের সামগ্রী। বাজারে পণ্যের মত হস্তান্তরযোগ্য ছিল নারী। পুরুষ কর্তৃক নারীরা সর্বত্র নিগৃহীত হত। সে যুগে কন্যা সন্তানকে অপমান ও অভিশাপ মনে করে ক্ষেত্র বিশেষে জীবন্ত কবর দিতেও তারা কুণ্ঠিত হত না। অবশ্য সে যুগে গোত্রীয় সমাজে শিশু হত্যার প্রথা বিশ্বের অন্যত্রও দেখা যেত। তবে মক্কায় নারীদের মর্যাদা কিছুটা ছিল। যেমন, খাদীজা ও আবুজাহলের মা সে যুগে মর্যাদার অধিকারী ছিলেন।
বিবাহ
অন্ধকার যুগের বৈবাহিক প্রথায় কোন সুচিতা ছিল না। পুরুষগণ একাধিক স্ত্রী গ্রহণ, ইচ্ছেমত বৰ্জন, অবৈধ প্রণয় এবং বহু রক্ষিতা রাখতো। নারীগণও একই সঙ্গে একাধিক স্বামী বা বহুপতি গ্রহণ বা ব্যভিচারে লিপ্ত হত। ভাই-বোনে
বিয়ে, বিমাতাকে বিয়ে করার কু-প্রথাও ছিল। পতিতাবৃত্তিও চালু ছিল।
দাস প্রথা
স্মরণাতীতকাল থেকেই আরবে দাসত্ব প্রথা প্রচলিত ছিল। দাস-দাসীদের কোন সামাজিক মর্যাদা ও অধিকার ছিল না। পণ্য-দ্রব্যের মত হাটে-বাজারে কেনা-বেচা হত। দাস-দাসীকে নির্মমভাবে কাজে খাটাত ও নির্যাতন করত। দাসীকে উপপত্নী হিসেবে ব্যবহার করত। তাদের জীবন-মৃত্যু প্রভুর মর্জির উপর নির্ভর করত। বিয়ে-শাদীর অধিকারটুকুও ছিল না।
কুসংস্কার
আরবের জাহিলী সমাজ নানা কুসংস্কারে জর্জরিত ছিল। ভাগ্যনির্ধারক তীর, দেবমূর্তির সাথে অলীক পরামর্শ, মৃতের অজ্ঞাত যাত্রার ধারণা প্রভৃতি কুসংস্কার চালু ছিল। সামাজিক অনাচার-ব্যভিচার, পতিতা বৃত্তি, নৈতিক অধঃপতন, চরিত্রহীনতা, মদ্যপান, জুয়া, লুটতরাজ, নারী হরণ, কুসিদ প্রথা প্রভৃতি নানা অনাচারে নিমজ্জিত ছিল গোটা আরব সমাজ ।
চরিত্র
আরবের তমসা যুগে সমাজে মানুষের মধ্যে আভিজাত্যের দম্ভ, অহঙ্কার, পরশ্রীকাতরতা, চরিত্রহীনতা, পরনিন্দা, পরচর্চা, হিংসা, অপরের কুৎসা রটনা ইত্যাদি অসৎ গুণাবলী মহামারীর রূপ ধারণ করেছিল। এগুলো জাহিলিয়া যুগে আরব চরিত্রকে ভীষণভাবে কলুষিত, কলঙ্কিত করে তুলেছিল। আরবের মত নৈতিক ও সামাজিক অধঃপতন সমকালীন বিশ্বের অন্য কোথাও দেখা যায়নি। প্রাচীন আরব সমাজ বহু নিষ্ঠুরতার ইতিহাসে ভরপুর। ভোগবাদী আরবরা দাস-
দাসী এমনকি শত্রুগোত্রের লোকদের সাথে অবর্ণনীয় নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিত। বিত্তবানরা খেলাচ্ছলে দ্রুতগামী উট, ঘোড়ার সাথে হতভাগ নারী বা শিশুকে বেঁধে দিত। ফলে এদের অনেকেই মৃত্যু বরণ করত।
আরব চরিত্রের উন্নত দিক
জাহিলী আরব সমাজে কিছু উন্নত ও মহৎ গুণও পরিলক্ষিত হয়েছে। অসীম সাহসিকতা, স্বাধীনচিতা, সরলতা, উদারতা, বদান্যতা, একনিষ্ঠতা, আতিথেয়তা, কাব্যচর্চা, বাগ্মিতা, মহানুভবতা, আত্মম্মানবোধ, গোত্রের প্রতি আনুগত্য প্রভৃতি মহৎ গুণরাজি সমাজের মানুষের মধ্যে লক্ষ করা যায়। শত্রুর সাথে তারা বিশ্বাসঘাতকতা করত না। আশ্রিতজন শত্রু হলেও জীবনের বিনিময়ে তাকে রক্ষা করত। নিঃসন্দেহে এগুলো ছিল আরব চরিত্রে প্রশংসনীয় দিক। তবে তাদের চরিত্রে দোষ-ত্রুটি এতই প্রবল ছিল যে, তাদের মহৎ গুণাবলী দোষত্রুটি দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে পড়ে।
সার-সংক্ষেপ
ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরবদের সামাজিক জীবনধারা ছিল অত্যন্ত শোচনীয় । বিভিন্ন অন্যায়-অনাচার, পাপাচার ব্যভিচার, দুর্নীতি ও কুসংস্কারে কলুষিত হয়ে পড়েছিল গোটা সমাজ ও তাদের জীবন। মহানবী (স) এর আবির্ভাবে নীতি-নৈতিকতাহীন আরব সমাজ ইসলামের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে সুষ্ঠু সমাজ-সভ্যতার গোড়া পত্তন করে।
প্রাক-ইসলামী যুগে আরবের রাজনৈতিক অবস্থা
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি-
■ ইসলাম পূর্ব যুগে আরবের রাজনৈতিক অবস্থা বর্ণনা করতে পারবেন
■ ইসলাম পূর্ব যুগে আরবের রাজনৈতিক অবস্থা মূল্যায়ন করতে পারবেন।
কেন্দ্রীয় শাসনের অভাব
অজ্ঞতার যুগে আরবের রাজনৈতিক অবস্থাও ছিল নানা দিক থেকে খুবই নৈরাশ্যজনক ও চরম বিশৃক্মখলাপূর্ণ। আরবে কোন কেন্দ্রীয় শাসন না থাকায় তৎকালীন সাম্রাজ্যবাদী দুই পরাশক্তি রোমান ও পারস্যের লোলুপ দৃষ্টির শিকার ছিল। উত্তর আরব রোমানদের এবং দক্ষিণ আরব ছিল পারসিকদের কর্তৃত্ব বলয়ে। আবিসিনীয় আগ্রাসন দৃষ্টিও আরবকে সদা শঙ্কিত করে রাখতো। ইয়ামেনের দখলদার আবিসিনীয় খ্রিস্টান শাসক আবরাহার বিশাল হস্তিবাহিনী নিয়ে পবিত্র কাবা শরীফ আক্রমণ এর প্রমাণ বহন করে।
গোত্ৰতান্ত্রিক শাসন
প্রাচীন গোত্রতান্ত্রিক শাসনই ছিল আরবদের রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তিমূল। তাদের গোত্রপ্রীতি ও বন্ধন ছিল সুদৃঢ়। প্রত্যেক গোত্রে একজন গোত্রপতি বা শাইখ নির্বাচিত হতেন। প্রার্থীর বংশ গৌরব, মহানুভবতা, বীরত্ব, বিচার-বুদ্ধি, বয়স, পদমর্যাদা ও আর্থ-সামাজিক দিক দিয়ে অগ্রসরতার দিক বিবেচনা করে গণতান্ত্রিকভাবে ‘শাইখ' নির্বাচিত হতেন। গোত্রপতির প্রতি আনুগত্য ছিল অপরিহার্য। গোত্রীয় শাসনে কোন সুনির্দিষ্ট বিধান ছিল না। গোত্রপতিদের পরামর্শ সভার (মালা) মতানুসারে শাসন, বিচার, যুদ্ধ ও অন্যান্য কার্যাবলী সম্পাদন করতেন। সাধারণ সমস্যাগুলো “দারুন নওয়ার” সভায় আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা হত।
কা'বা শরীফের কারণে মক্কানগর ও নগরবাসী-কুরাইশদের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এ কারণে কুরাইশ গোত্রের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা এবং পার্শ্ববর্তী আরো কিছু গোত্রের মধ্যে একটি মৈত্রী-জোট বা গোত্র কমনওয়েলথের রূপ লাভ করে । এ জোটের নেতাদের পরামর্শ অনুযায়ী একটি আন্তঃগোত্রীয় শাসন ব্যবস্থাও গড়ে ওঠে।
গোত্রীয় দ্বন্দ্ব-কলহ
এ সময়ে কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা না থাকায় গোত্রে গোত্রে দ্বন্দ্ব-কলহ এক ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। গোত্রের মান-সম্ভ্রম ও স্বার্থ রক্ষার জন্য সদস্যগণ জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিত। এ গোত্র-কলহ ও বিসংবাদ কখনো বংশানুক্রমিকভাবে চলত। “খুনের বদলে খুন” (Blood for Blood) এ ধারায় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ত বছরের পর বছর। গোত্রে গোত্রে যুদ্ধের ভয়াবহ দিনগুলোকে “আইয়ামুল আরব" (Ayam al Arab) বলা হত।" ঐতিহাসিক গীবনের মতে- “অন্ধকার যুগে আরবে গোত্রীয় দ্বন্দ্বের কারণে ১৭০০ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। বুয়াসের যুদ্ধ, ফিজারের যুদ্ধ, বসুসের যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যে ছিল উল্লেখযোগ্য। উটকে পানি খাওয়ানোর সামান্য ঘটনা কেন্দ্র করে বনু বকর ও বনু তগলিব গোত্রের মধ্যে সুদীর্ঘ ৪০ বছর ব্যাপী যুদ্ধ চলে ছিল ।
রাজনৈতিক ঐক্য ছিল না
আরবে কোন কেন্দ্রীয় শাসন ছিল না। তাই সেখানে কোন সুষ্ঠু রাজনৈতিক ধারা চালু হয়নি। রাজনৈতিক ঐক্য বলতেও কিছু ছিল না। গোটা আরব ছিল শতধা বিভক্ত। রাজনৈতিক বিশৃক্মখলা, অনৈক্য, অস্থিরতা, নৈরাজ্য, সন্ত্রাসবাদ ছিল তাদের রাজনৈতিক জীবনের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। “জোর যার মুল্লুক তার"- এ ছিল তাদের রাজনৈতিক দর্শন।
মক্কার নগররাষ্ট্র
ধর্মীয় ও বাণিজ্যিক গুরুত্বের কারণে মক্কা নগরে প্রাগ্রসর রাজনীতির উন্মেষ ও নগররাষ্ট্রের সূচনা হয়। কুরাইশ গোত্রপতিদের সমন্বয়ে গঠিত মালা বা মন্ত্রণা পরিষদ নামে গঠিত একটি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক এ নগর-রাষ্ট্রের প্রশাসন ব্যবস্থা পরিচালনা ও তদারক করা হত। বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের বেদুঈনদের সাথে মৈত্রীজোট গঠন করাও এ পরিষদের কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল।
ইসলামপূর্ব যুগে আরবের অর্থনৈতিক অবস্থা
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি-
■ প্রাক-ইসলামী যুগে আরবের অর্থনৈতিক অবস্থা জানতে পারবেন
■ প্রাক-ইসলামী যুগে আরবদের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্বন্ধে বিবরণ দিতে পারবেন।
আরব দেশ ছিল অনুর্বর। ইয়েমেন, মদীনা ও তায়েফ কিছুটা কৃষি উপযোগী হলেও সামগ্রিক বিবেচনায় আরব ছিল সম্পূর্ণ কৃষি অনুপযোগী। তাই নগরবাসী আরবগণ ব্যবসায় এবং যাযাবর বেদুঈনরা পশুপালন করে জীবিকা চালাত। যে খাদ্য শস্য উৎপন্ন হত প্রয়োজনের তুলনায় তা ছিল খুবই নগণ্য। তাই আরবদের আর্থিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। আরব জনগণকে অর্থনৈতিক বা পেশাগত শ্রেণী বিভাজন করে দেখলে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার সঠিক চিত্র ফুটে উঠবে।
বণিক শ্রেণী : ধর্মীয় গুরুত্ব পূর্ণ স্থান এবং বিশেষ করে ব্যবসায় কেন্দ্র হিসেবে মক্কা তখন পশ্চিম এশিয়ার অন্যতম সমৃদ্ধ অঞ্চল ছিল। মক্কার বণিক সমাজ এশিয়ার সঙ্গে ভূ-মধ্যসাগরীয় অঞ্চল ও উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার স্থল বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করত। প্রাক-ইসলামী যুগে মক্কা বহির্বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র ছিল। শহরকেন্দ্রিক ধনী বণিক শ্রেণীর বিকাশ ঘটেছিল। এরা সিরিয়া, পারস্য, মিসর, ভারতবর্ষ প্রভৃতি দেশের সাথে বাণিজ্য করত। হযরত আবু বকর, উসমান ও খাদীজা (রা) প্রমুখ ব্যবসায়ী ছিলেন। মক্কায় ব্যাংক স্থাপিত হয়। মহাজনী কারবার গড়ে ওঠে এবং আন্ত র্জাতিক বাণিজ্যের সহায়ক নিকাশ ঘর (Clearing house)- এর প্রবর্তন হয়। মদীনাও এসব ব্যবসায়ের সাথে জড়িত ছিল । ফলে জনগণের একটা অংশ সম্পদশালী ও সমৃদ্ধ জীবনের অধিকারী হয়। তবে এদের সংখ্যা ছিল খুবই কম।
রিক্ত যাযাবর ঃ মরুভূমির তাঁবুতে বসবাসকারী বেদুঈনগণ শহরবাসীদের মত স্থায়ীভাবে এক স্থানে বসবাস করতনা। স্বাধীনচেতা বেদুঈনগণ খাদ্য ও পানীয়ের সন্ধানে মরুভূমির এক স্থান থেকে অপর স্থানে ছুটে বেড়াত। তাই আরব বেদুঈনদের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয় এবং অনিশ্চিত । বিরূপ প্রকৃতির কারণে তারা যাযাবরী জীবন গ্রহণ করে। পশুপালন আর লুটতরাজই ছিল তাদের জীবিকা নির্বাহের উপায়।
সুদখোর ইহুদি ঃ ইসলামপূর্ব যুগের ধনী ইহুদিরা সুদের ব্যবসায় করত। শোষণের ঘৃণ্যতম এ প্রথায় নিঃস্ব আরবগণ আরো নিঃস্ব ও সর্বহারা শ্রেণীতে পরিণত হয়। এমন কি স্ত্রী-কন্যাকেও হারাতে হত। ইহুদিদের সুদের কারবারের নিয়ম ছিল খুবই নিষ্ঠুর ও জটিল। সুদ অনাদায়ের দায়ে ঋণ গ্রহণকারীর স্ত্রী, পুত্র, কন্যাগণ, দাস-দাসী হিসেবে সুদখোর মহাজনের হাতে চলে যেত।
কৃষিজীবী ঃ মদীনা, তায়েফ ও ইয়েমেনের জমি উর্বর থাকায় সেখানে কৃষিকার্য চলত এবং প্রচুর ফসল উৎপন্ন হত।
তায়েফে প্রচুর তরমুজ, কলা, ডুমুর, আঙ্গুর, জলপাই, পীচ ও মধু উৎপন্ন হত। মদীনায় খেজুর ও গম জন্মাত। এসব
অঞ্চলের লোকেরা মোটামুটি ভাল অবস্থায় ছিল ।
কারিগরি ব্যবস্থা ঃ পৌত্তলিক আরবে কিছুসংখ্যক লোক মূর্তি ও ভাস্কর্য নির্মাণে দক্ষ ছিল। সমাজে তাদের মর্যাদাও
বেশ ভাল ছিল এবং আর্থিক অবস্থাও তাদের সচ্ছল ছিল।
সার-সংক্ষেপ
আরব দেশের ভূ-প্রকৃতি ও ভৌগোলিক অবস্থান এর অধিবাসীদের অর্থনৈতিক অবস্থার উপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল। রুক্ষ-মরুর দেশ আরব ছিল অনুর্বর। তাই সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল দুর্দশাগ্রস্ত লুটতরাজ করে ও পশু পালন করেই আরবরা কষ্টে জীবিকা নির্বাহ করত। মক্কা কেন্দ্রিক বণিক শ্রেণীর অর্থনৈতিক অবস্থা কিছুটা ভাল ছিল। ইয়াহুদীরা সুদি কারবার করত। তারা সাধারণ লোকদের শোষণ করত ।
প্রাক-ইসলামী যুগে আরবের ধর্মীয় অবস্থা
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি-
হযরত মুহাম্মদ (স)-এর আবির্ভাবের পূর্বে আরবের ধর্মীয় অবস্থা জানতে পারবেন।
প্রাক-ইসলামী যুগে আরবের ধর্মীয় অবস্থা বর্ণনা করতে পারবেন।
প্রাক-ইসলামী যুগে আরবের ধর্মীয় জীবন ঘোর অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। আরবদের ধর্মীয় বিশ্বাস ছিল নানা রকমের। পৌত্তলিক, জড় পূজারী ও অংশীবাদী ইহুদি, খ্রিস্টান, সাবেয়ী নক্ষত্র পূজারী এবং এক আল্লাহতে বিশ্বাসী হানীফ সম্প্রদায় প্রভৃতি । আরবের অধিকাংশ লোকই ঘৃণ্য ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও আধ্যাত্মি ধ্যান-ধারণা, জড়পূজা ও সৌর পূজায় লিপ্ত ছিল ।
পুতুল পূজা বা পৌত্তলিকতা ছিল আরবদের সর্বজনীন ধর্ম। আদ, সামুদ, জারঈম এবং আমালিকা কাওম ছিল সম্পূর্ণরূপে মুশরিক বা পৌত্তলিক। পবিত্র কা'বা গৃহে ৩৬০ টি প্রতিমা রাখা হয়েছিল। লাত মানাত, উজ্জা প্রভৃতি দেব-দেবী ছিল বিখ্যাত।
আরবরা অসংখ্য দেব-দেবীতে বিশ্বাসী ছিল। আল্লাহর কন্যা স্বরূপ তাদের কল্পিত মূর্তি বানিয়ে নানা উপলক্ষে তারা সেগুলোর পূজা করত। তাদের মূর্তিগুলোর মধ্যে ছিল লাত-মানাত, উজ্জা, হোবল, ওয়ার, সাওয়া, ইয়াগুস, ইয়াউক, নসর প্রভৃতি প্রধান প্রধান দেব-দেবী। তারা হযরত ইবরাহীম, হযরত ইসমাইল, হযরত ঈসা এবং হযরত মরিয়মের মূর্তিও কাবা গৃহে স্থাপন করেছিল। প্রতি বছর তারা ঐসব দেব-দেবীকে অর্ঘ দিতে আসত এবং দেবতাদের মনতুষ্টির জন্য নরবলি দিত। এ উপলক্ষে তারা উকায মেলা নামে বার্ষিক মেলায় যোগ দিত। তারা আল্লাহর একত্ব, আত্ম অমরতা ও আখিরাতকে বিশ্বাস করত না। মৃত্যুকেই জীবনের শেষ মনে করত ।
আরব বেদুঈনরা বিভিন্ন জড় বস্তু, বৃক্ষ, কূপ, প্রস্তর, গুহা, বালির স্তুপকে পূজা করত। উন্মুক্ত মরুপ্রান্তরে বসবাসের কারণে আরব বেদুঈনরা সৌর জগতের বিভিন্ন গ্রহ, নক্ষত্র, সূর্য ও চন্দ্রকে দেবতা স্বরূপ পূজা করত। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ছিল প্রকৃতিবাদী। অর্থাৎ জন্ম-মৃত্যু যা কিছু পৃথিবীতে ঘটছে তা প্রকৃতির নিয়মেই হচ্ছে বলে বিশ্বাস করত।
অধিকাংশ আরবই পরকালের জীবন তথা কিয়ামত, আখিরাত, বেহেশত, দোযখ ইত্যাদিতে অবিশ্বাসী ছিল। আরবগণ মানুষকে নবী-রাসূল হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করে। কাবা শরীফকে তারা দেবালয় বানিয়ে নিয়েছিল। কা'বা শরীফের ধর্মীয় গুরুত্ব ছিল অত্যন্ত বেশি। নির্দিষ্ট সময়ে তারা তীর্থযাত্রায় কা'বায় আসত এবং এর প্রদক্ষিণ ও বলিদানের মাধ্যমে ধর্মীয় অনুষ্ঠানও পালন করত। তাদের মধ্যে কোন কোন গোত্রের নারী-পুরুষ উলঙ্গ হয়ে কা'বা প্রদক্ষিণ করত।
তাদের মধ্যে একদল বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন, যাঁরা ছিলেন যাবতীয় কুসংস্কারমুক্ত। এঁরা এক আল্লাহতে বিশ্বাস করত এবং ইব্রাহীমের ধর্মের উপর তাদের আস্থা ছিল- এজন্য এদেরকে হানীফ বলা হত। যেমন- ওরাকা-ইবনে-নওফেল, আব্দুল্লাহ ইবনে জাহাস, কবি জুহাইর, আবু বকর প্রমুখ। তারা স্বতন্ত্রভাবে ধর্মীয় জীবন যাপন করতেন এবং কোন প্রকারের মূর্তি পূজায় অংশগ্রহণ করতেন না।
সর্বোপরি আরবরা নানা ধর্মীয় গোঁড়ামী ও কুসংস্কারে নিপতিত ছিল। জীবজন্তু ও নরবলি, তন্ত্র-মন্ত্র, যাদু-টোনা, ভূত-
প্রেত, ভবিষ্যদ্বাণীতে বিশ্বাসী ছিল ।
প্রাক-ইসলামী যুগে আরবে ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্ম প্রচলিত ছিল। ইহুদি খ্রিস্টানরাও নানা কুসংস্কারে ও ধর্ম ব্যবসায় জর্জরিত ছিল । ইহুদিগণ অবজ্ঞাবশত জেহোবাকে বিশ্ব স্রষ্টা ও নিয়ন্তা মনে করত। নবী উযাইর (আ) কে খোদার পুত্র মনে করত। অপর দিকে খ্রিস্টানরা এক আল্লাহর একত্ববাদের পরিবর্তে ত্রিত্ববাদে বা তিন খোদায় বিশ্বাস করত। তাদের মতে ঈশ্বরের স্ত্রী ছিলেন বিবি মরিয়ম (মেরী) এবং ঈসা (আ) ছিলেন ঈশ্বরের পুত্র।
ইসলামপূর্ব যুগে আরবের সাংস্কৃতিক অবস্থা
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি-
■ ইসলাম পূর্ব যুগে আরবের সাংস্কৃতিক অবস্থা জানতে পারবেন
আরবের সাংস্কৃতিক অবস্থা সম্বন্ধে বিবরণ দিতে পারবেন।
ইসলামের অভ্যুদয়ের পূর্বে আরবে বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষাপদ্ধতি বা রুচিপূর্ণ ও মার্জিত জীবনধারা তথা উন্নত সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। মক্কা-মদীনা ও অপরাপর কয়েকটি শহর ছাড়া আরবরা প্রায়ই ছিল মূর্খ ও নিরক্ষর। তা সত্ত্বেও তাদের মধ্যে কিছু সাংস্কৃতিক তৎপরতা লক্ষ করা যায়। যেমন :
প্রাক-ইসলামী যুগেও আরব সাহিত্য চর্চায় ছিল খুবই উন্নত। হিট্টি বলেন, 'পৃথিবীতে সম্ভবত অন্য কোন জাতি আরবদের ন্যায় সাহিত্য চর্চায় এত বেশি স্বতঃস্ফূর্ত একাগ্রতা প্রকাশ করেনি'। প্রাচীন আরবি সাহিত্য তারই প্রমাণ বহন করে। তখন আরবে লিখন পদ্ধতি বিকাশের অভাবে গদ্য-সাহিত্য রচনা সমৃদ্ধি লাভ করেনি। তবে বংশবৃত্তান্ত, গোত্র-কলহ ও যুদ্ধ-বিগ্রহের ইতিহাস গদ্যে রচিত হয়েছিল ।
আরব সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন আরবি গীতিকবিতা বা কাসীদা ইতিহাসে অতুলনীয়। তাদের কবিতার সাবলীলতা ও স্বচ্ছ কাব্যবিন্যাস ছিল বৈশিষ্ট্যময়। হিট্টি বলেন : ‘মধ্যযুগে বহু শতাব্দীকাল পর্যন্ত আরবী ভাষা সভ্যজগতের শিক্ষা- সংস্কৃতি এবং উন্নতির একমাত্র মাধ্যম ছিল'। তিনি আরো বলেন, 'কাব্যপ্রীতিই ছিল বেদুঈনদের সাংস্কৃতিক সম্পদ'। প্রাক-ইসলামী যুগের কবি ও পণ্ডিতদের মধ্যে ইমরুল কায়স, উম্মে কুলসুম, লাবিদ, তারফা, যুহাইর, আন্তারা, হারিস-প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সাবা মুয়াল্লাকাত, দিওয়ানে হামাসা প্রভৃতি গ্রন্থের মাধ্যমে প্রাক- ইসলামী যুগের গীতিকাব্যসমূহ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় ।
প্রাক-ইসলামী যুগের কবিদের মধ্যে যশস্বী ছিলেন সাতটি ঝুলন্ত গীতিকাব্যের রচয়িতাগণ। সোনালী হরফে লিপিবদ্ধ
এ-‘সাবা মুয়াল্লাকাত' ছিল প্রাচীন আরব কবিদের অমর কীর্তি। জাহিলিয়া যুগে অসংখ্য গাঁথা ও কাব্য সাহিত্য প্রণীত
হয়। এগুলো আরব্য সংস্কৃতির অমূল্য সম্পদ ।
ইসলামের অভ্যুত্থানের পূর্বে আরব্য সাংস্কৃতিক জীবনে ‘উকায মেলা' ছিল বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার। প্রতি বছর এ মেলা বসত। আর এখানে বিভিন্ন বিষয়ের যেমন, কাব্য, গাঁথা, প্রবাদ, বীরত্ব, বাগ্মিতার প্রতিযোগিতা হত এবং পুরস্কৃত করা হত শ্রেষ্ঠদের । এখানে গান-বাজনা, নৃত্য, জুয়া-লটারী প্রভৃতির আসর বসত।
আরব যাযাবরেরা মরুভূমিতে নিজেদের জীবন কাটাত। এজন্য তাঁরা তারকাসমূহের নাম গতি ও স্থানসমূহ জানত। আবার মৌসুমী আবহাওয়া কখন ঝড় বৃষ্টি ইত্যাদি বয়ে আনত তাও বলতে পারত। শহরের অনেকে তাদের কাছ থেকে সাধারণভাবে রোগের চিকিৎসা করে নিত। যাযাবরেরাও ঔষধ সম্পর্কে জ্ঞান রাখত, তারা বিশেষভাবে উটের চিকিৎসা জানত।
তারা ভবিষ্যদ্বানী বিদ্যা জানত। ভবিষ্যদ্বাণী বিদ্যা দু'ভাগে বিভক্ত ছিল। প্রথমত পায়ের চিহ্ন দেখে পথচারীর সন্ধান দেওয়া। দ্বিতীয়ত শরীরের অঙ্গ ও গঠন দেখে বলা সে অমুক বংশের লোক। এ দু'ধরনের বিদ্যায় আরবদের গভীর জ্ঞান ছিল। তাদের স্মরণ শক্তি প্রখর ছিল।
সার-সংক্ষেপ
বর্তমান যুগের ন্যায় প্রাক-ইসলামী যুগের শিক্ষা ও সংস্কৃতি না থাকলেও আরবরা সাংস্কৃতিক জীবন থেকে একে বারে বিচ্ছিন্ন ছিল না। গীতিকাব্য রচনা, ভাস্কর্য নির্মাণে তারা দক্ষ ছিল। বার্ষিক উকাযের মেলায় তাদের সাংস্কৃতিক চর্চার অসর বসত। যৌনতা, নারী, যুদ্ধ, বীরত্ব ও গৌরব গাথা ছিল তাদের সাহিত্যের বিষয়। সোনালী হরফে লেখা 'সাবামুয়াল্লাকাত' বা ঝুলন্ত কাব্য মালা প্রাক-ইসলামী যুগের আরবি সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। তারা প্রবাদ-প্রবচন ও রচনা করত। বাগ্মিতায় পারদর্শী ছিল। তারা বংশ তালিকা কণ্ঠস্থ করত। আবহাওয়া বিদ্যা ও ভবিষ্যদ্বানী বিদ্যায় দক্ষ ছিল।
প্রাক-ইসলামী যুগে আরবদের প্রশংসনীয় দিক
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি-
জাহিলিয়া যুগে আরবদের প্রশংসনীয় দিক সম্পর্কে জানতে পারবেন
জাহিলিয়া যুগে আরব চরিত্রের প্রশংসনীয় গুণাবলীর বিবরণ দিতে পারবেন।
প্রাক-ইসলামী যুগে আরবের কয়েকটি গোত্র ছাড়া প্রায় সকল স্থানের আরবগণই ছিল অশিক্ষিত ও সভ্যতা বর্জিত। তাদের জীবন ছিল বর্বরতায় পূর্ণ। তবে তাদের জীবনে কিছু কিছু প্রশংসনীয় বৈশিষ্ট্য ছিল। যার বিবরণ নিম্নরূপঃ
প্রাক-ইসলামী যুগের আরবগণ ছিল কষ্ট-সহিষ্ণু, নির্ভীক ও চির সংগ্রামী। মরুময় রুক্ষ আরবে জীবন-যাপন উপযোগী খাদ্য ও পানীয়ের বড় অভাব ছিল। বাঁচার জন্য তারা প্রকৃতির সাথে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করত। তারা আরব সীমানা পেরিয়ে ব্যবসায়-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছিল। এভাবে তারা নিজেদের এবং পরিবারের সকলের জীবিকা অর্জনের সুব্যবস্থা করত।
প্রাক-ইসলামী যুগে আরবগণ সমবায় ভিত্তিতে ব্যবসায়-বাণিজ্য করত। তাই সে সময়ে উত্তর ও দক্ষিণ আরবে বিপুল বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের ফলে সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছিল। তারা দীর্ঘ দু'হাজার বছর বিশ্বের বিভিন্ন সভ্য জাতির সাথে ব্যবসায়-বাণিজ্য চালিয়েছিল। প্রাক-ইসলামী যুগে ব্যবসায়-বাণিজ্যের এরূপ প্রসার নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য।
প্রাক-ইসলামী যুগের আরবগণ ছিলেন অত্যন্ত কর্তব্যপরায়ণ। ক্ষুধার্তকে অনুদান, আশ্রয় প্রার্থীকে আশ্রয়দান এবং
অত্যাচারিতকে রক্ষা করা তারা তাদের কর্তব্য বলে মনে করত। আশ্রিত ব্যক্তিকে রক্ষা করার জন্য তারা নিজেদের
জীবন পর্যন্ত বিলিয়ে দিত। পরবর্তীকালে তাদের এ গুণাবলীকে লালন করার জন্য মহানবী (স) বলেন, “অন্ধকার
যুগের আদর্শ গুণাবলীর প্রতি লক্ষ কর এবং সেগুলোকে ইসলামের কাজে লাগাও। অতিথিকে আশ্রয় দাও, এতিম
শিশুর প্রতি সদয় হও এবং আশ্রিতদের সাথে সদয় ব্যবহার কর”।
প্রাক-ইসলামী যুগের আরবগণের একটি প্রশংসনীয় গুণ ছিল অতিথিপরায়ণতা। তাছাড়া তাদের সরলতা এবং উদারতাও বিশেষ প্রশংসাযোগ্য ছিল। অতিথির থাকা-খাওয়া এবং মর্যাদা রক্ষার জন্য তারা সর্বস্ব বিলিয়ে দিতেও কুণ্ঠিত হত না। ইসলাম-পূর্ব যুগে একমাত্র আরবদের উদ্যোগে এশিয়ার সঙ্গে ইউরোপের সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তাদের ব্যবসায়-বাণিজ্য শুধুমাত্র উৎপন্ন পণ্যদ্রব্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তারা নিজেদের পণ্যদ্রব্য আফ্রিকা ও ভারতে রপ্তানি করত। সেখান থেকেও অনেক পণ্যদ্রব্য তারা আমদানি করত।
প্রাক-ইসলামী যুগে আরবগণ কবিতা রচনা ও বক্তৃতায় বিশেষ পারদর্শী ছিল। কবিতার মাধ্যমে তাদের সাহিত্য প্রতিভার প্রকাশ পেত । সে যুগে কবির মর্যাদা ছিল অসাধারণ। অধ্যাপক নিকলসন বলেন, 'কবিতা কেবল সে যুগের কিছু সংখ্যক লোকের কাছে বিলাসিতার বস্তুই ছিল না, বরং তা ছিল তাদের সাহিত্য প্রতিভা প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম'। ঐতিহাসিক হিট্টি বলেন, ‘কাব্যপ্রীতিই ছিল বেদুঈনদের সাংস্কৃতিক সম্পদ”। তাদের কবিতাগুলো ‘কাসিদা' নামে খ্যাত ছিল । তিনি আরো বলেন, ‘এ কাসিদাগুলো ছন্দ এবং বিশদ ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে ‘ইলিয়ড' ও 'অডিসি'কেও অতিক্রম করেছিল'।
আরবের অধিকাংশ লোক যদিও নিরক্ষর ও মূর্খ ছিল, তবুও তাদের স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ। এ গুণের মাধ্যমে তারা প্রাচীন যুগের লোকগাঁথা, প্রবাদ, লোকশ্রুতি ইত্যাদি সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল। তাদের পূর্ব-পুরুষদের নাম তথা বংশ বৃত্তান্ত তারা বিশেষভাবে স্মরণ রাখত। এছাড়া তারা অনায়াসে অসংখ্য কবিতা কন্ঠস্থ করে রাখতে পারত।
প্রাক-ইসলামী যুগে প্রতিবছর নির্ধারিত সময়ে মক্কার অদূরে উকায নামক স্থানে একটি বাৎসরিক মেলা বসত। এখানে খ্যাতনামা আরব কবিদের মধ্যে কবিতা পাঠের আসর বসত। বিজয়ী কবিদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করা হত। ঐতিহাসিক হিট্টি, উকাযের মেলাকে প্রাচীন আরবের ‘একাডেমিক ফেঞ্চাজ' বলে অভিহিত করেছেন ।
সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে প্রাক-ইসলামী যুগের আরবদের আগ্রহ ছিল সীমাহীন, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। সাহিত্যিকগণ প্রায় প্রতি সপ্তাহেই সাহিত্য আসরের আয়োজন করতেন। হিট্টির মতে, 'পৃথিবীতে সম্ভবত অন্য কোন জাতি আরবদের ন্যায় সাহিত্য চর্চায় এত বেশি প্রাণঢালা আগ্রহ প্রকাশ করেনি এবং কথিত বা লিখিত শব্দ দ্বারা এত আবেগাপ্লুত হয়নি'।
প্রাক-ইসলামী যুগে আরবগণ তাদের আবাস শিল্প ও মুদ্রাকে যথেষ্ট উন্নত করেছিল। আবাস গৃহ নির্মাণের ক্ষেত্রে সে
যুগে কিছু কিছু গ্রানাইট ও মারবেলের ব্যবহারও বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সানার মুসকানের ২০ তলা দুর্গ এবং দক্ষিণ
আরবে অবস্থিত বিশাল বাঁধ আরবদের স্থাপত্য শিল্পের পরিচয় বহন করে।
সার-সংক্ষেপ
প্রাক-ইসলামী যুগে আরবদের কাব্যময় প্রতিভা ও অন্যান্য প্রশংসনীয় গুণাবলী থাকা সত্ত্বেও তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় এবং অর্থনৈতিক জীবনযাত্রা ছিল অরাজকতা ও বিশৃক্মখলায় পরিপূর্ণ। সমগ্র আরব রাজ্য পাপাচার ও কুসংস্কারে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল । মানুষের জীবন ও সম্ভ্রমের কোন নিরাপত্তা ছিল না। নারীরা ছিল ভোগের সামগ্রী ।