তাপ খুব সহজেই পাওয়া যায়। যে কোনো জ্বালানি পোড়ালেই তাপ উৎপন্ন হয়। আবার একটি উষ্ণতর বস্তু ঠাণ্ডা হওয়ার সময় তাপ আপনাআপনি বেরিয়ে আসে। অন্য কোনো শক্তি তাপের ন্যায় এত সহজে মেলে না। তাই বৈজ্ঞানিকদের প্রথম প্রচেষ্টাই হলো কত বেশি পরিমাণ তাপকে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত করা যায় তার উপায় বের করা।
প্রকৃতিতে প্রতিনিয়ত অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনা কিন্তু খেয়াল খুশি মতো ঘটতে পারে না। প্রাকৃতিক প্রতিটি ঘটনাই কোনো না কোনো নিয়ম মেনে চলে। বস্তুত প্রকৃতির রাজ্য নিয়মের অধীন, সবকিছুই শৃঙ্খলা মেনে চলে। আর সেই নিয়মগুলো অপরিবর্তনীয়। যেমন পাহাড়ের ওপর থেকে পাথর গড়িয়ে নিচে পড়ে। অতীতেও এমন হয়েছে ভবিষ্যতেও হবে। কেওকারাডাং থেকেও পড়বে, হিমালয় থেকেও পড়বে। শক্তির রূপান্তরকেও কোনো না কোনো নিয়ম মেনে চলতে হয় । এই নিয়মগুলোকে বলা হয় তাপগতিবিদ্যার সূত্রাবলি। আমরা দেখেছি তাপ যান্ত্রিক শক্তি বা কাজে রূপান্তরিত হতে পারে। আজ যে পরিমাণ তাপ খরচ করে একটা কাজ পাওয়া গেল, কাল আবার সেই কাজটি করতে গেলে সেই একই পরিমাণ তাপ প্রয়োজন হবে। পরিমাণের ব্যতিক্রম হতে পারবে না। বহু রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এটা জানা গেছে।
বিজ্ঞানী জুল সর্বপ্রথম কাজ ও তাপের মধ্যে একটি সঠিক সম্পর্ক নির্ণয় করেন এবং এ সম্পর্কটি একটি সূত্রের আকারে প্রকাশ করেন। এই সূত্রকে জুলের সূত্র বলে। এই সূত্রকে তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্রও বলা হয়।
এই সূত্রানুসারে,
এখানে W হলো কাজের পরিমাণ, H হলো তাপের পরিমাণ এবং J হচ্ছে জুলের ধ্রুবক, একে বলা হয় তাপের যান্ত্রিক তুল্যাঙ্ক বা সমতা। উপরিউক্ত সমীকরণে H = 1 একক হলে W = J হয়। একক তাপ উৎপন্ন করতে যে পরিমাণ কাজ করতে হয় বা একক তাপ দ্বারা যে পরিমাণ কাজ করা যায় তাকে তাপের যান্ত্রিক তুল্যাঙ্ক বা সমতা বলে।
পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময় আমরা জড় জগতের খানিকটা নির্দিষ্ট অংশ বিবেচনা করি। জড় জগতের এই নির্দিষ্ট অংশকে সিস্টেম বা ব্যবস্থা বলে। সিস্টেমের বহির্ভূত সব কিছুকেই এর পরিবেশ বলে গণ্য করা হয়।
তাপগতিবিদ্যায় কিছু রাশির সাহায্যে কোনো সিস্টেমের অবস্থা বর্ণনা করা হয়। তাপগতীয় আলোচনার জন্য সাম্যাবস্থায় চাপ p, আয়তন V এবং উষ্ণতা T-এর সাহায্যে সিস্টেমকে বর্ণনা করা যায়। এই রাশিগুলোকে ভাপগতীয় স্থানাঙ্ক বলে। যে পরিবর্তনের কারণে তাপগতীয় স্থানাঙ্কের মানের পরিবর্তন হয় সেই পরিবর্তনকে তাপগতীয় প্রক্রিয়া বলে।
প্রত্যেক সিস্টেমের একটা নির্দিষ্ট আয়তন, ভর ও অভ্যন্তরীণ শক্তি থাকে। সিস্টেম বিভিন্ন ধরনের হয়। যেমন-উন্মুক্ত সিস্টেম, বদ্ধ সিস্টেম এবং বিচ্ছিন্ন সিস্টেম।
আগুনের কাছে একটি ধাতব বস্তু ধরলে দেখা যায়, সেটি বেশ গরম হয়ে ওঠেছে। আমাদের কাছে মনে হয় আগুন থেকে 'একটা কিছু' বস্তুতে এসে একে উত্তপ্ত করে তুলেছে। এই একটা কিছুই হচ্ছে তাপ।
প্রকৃতপক্ষে তাপ কোনো পদার্থ নয়, তাপ হচ্ছে একটা প্রক্রিয়া যা বস্তুর অভ্যন্তরীণ শক্তির পরিবর্তন ঘটায়। প্রকৃতিতে শক্তি বিভিন্নরূপে বিরাজ করে; যেমন যান্ত্রিক শক্তি, তাপ শক্তি, রাসায়নিক শক্তি, অভ্যন্তরীণ শক্তি ইত্যাদি । যান্ত্রিক শক্তি, তড়িৎ শক্তি, রাসায়নিক শক্তি প্রভৃতির প্রকৃতি সহজেই বোঝা যায় কিন্তু অভ্যন্তরীণ শক্তি বলতে আমরা কী বুঝি? যখন কোনো বস্তুকে উত্তপ্ত করা হয়, তখন এর অভ্যন্তরীণ শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং এই শক্তি হ্রাস পায় যখন একে শীতল করা হয়। প্রত্যেক বস্তুর ভেতরই একটি শক্তি থাকে যার দ্বারা এটি কাজ করতে পারে। এই শক্তি অন্য শক্তিতে রূপান্তরিত হতে পারে। এই শক্তিই অভ্যন্তরীণ শক্তি। প্রকৃতপক্ষে পদার্থের অণুগুলোর রৈখিক গতি, পরমাণুর কম্পন ও আবর্তন, নিউক্লিয়াসের চারদিকে ইলেকট্রনের গতির প্রভাবে অভ্যন্তরীণ শক্তির উদ্ভব হয়।
প্রত্যেক বস্তুর মধ্যে একটা সহজাত শক্তি নিহিত থাকে, বা কাজ সম্পাদন করতে পারে, যা অন্য শক্তিতে রূপান্তরিত হতে পারে। বস্তুর অভ্যন্তরস্থ অণু, পরমাণু ও মৌলিক কণাসমূহের রৈখিক গতি, স্পন্দন গতি ও আবর্তন গতি এবং তাদের মধ্যকার পারস্পরিক বলের কারণে উদ্ভূত শক্তিকেই অভ্যন্তরীণ বা অন্তস্থ শক্তি বলে।
কোনো বস্তুর অভ্যন্তরীণ শক্তির মানের চেয়ে অভ্যন্তরীণ শক্তির পরিবর্তন অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কোনো বস্তুর অভ্যন্তরীণ শক্তি নির্ভর করে তার চাপ (p), আয়তন (V) এবং তাপমাত্রা (T) এর সাথে সাথে আরো কিছু ভৌত ধর্ম যেমন আপেক্ষিক তাপ, প্রসারণ সহগ ইত্যাদির ওপর। দুটি ভিন্ন উষ্ণতার বস্তুকে পরস্পরের সংস্পর্শে রাখলে উষ্ণতর বস্তুটি শীতল হয় এবং শীতলতর বস্তুটি উত্তপ্ত হয় এবং ক্রমান্বয়ে বস্তু দুটি একই উষ্ণতা প্রাপ্ত হয়। এরকম হলে আমরা বলি বস্তু দুটি তাপীয় সমতায় পৌঁছেছে। দুটি বস্তুর তাপীয় সমতায় পৌঁছার জন্য উষ্ণতর বস্তুটির অভ্যন্তরীণ শক্তি হ্রাস এবং শীতলতর বস্তুটির অভ্যন্তরীণ শক্তি বৃদ্ধি পায়। একটি বস্তু থেকে অন্য বস্তুতে তাপ শক্তি স্থানান্তরের ফলে বস্তুর অভ্যন্তরীণ শক্তির পরিবর্তন হয়। বস্তুর অভ্যন্তরীণ শক্তির পরিবর্তন হলেই তার তাপমাত্রার পরিবর্তন হয়।
আরও দেখুন...