“শান্তির গান” কবিতাটি কবি মহাদেব সাহার 'ফুল কই, শুধু অস্ত্রের উল্লাস' (১৯৮৪) গ্রন্থ থেকে সংকলন করা হয়েছে । পৃথিবীব্যাপী মানুষের জন্য শান্তির অন্তহীন প্রত্যাশা নিয়ে কবি যে গান রচনা করে চলেন অবিরাম, তারই দ্যোতনা বহন করে আলোচ্য কবিতাটি । এ কবিতায় কবি ধাপে ধাপে তুলে ধরেছেন—কাদের জন্য এই জন্য, শান্তি, কেমন করে তারা শাস্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করে, শান্তিকামী এই মানুষগুলোর মনস্তত্ত্বই বা কেমন। এক কথায় বলা যায় যে, কবির এই শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা মূলত মেহনতি মানুষের জন্য, শিশুদের মনুষ্যত্ববোধে উদ্দীপ্ত সকলের জন্য । তাই কবি এশিয়ার কৃষক, আফ্রিকার শ্রমিক, ইউরোপের শিশু—সকলকে এই শাস্তি-পতাকার তলে সমবেত করতে চান । শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে কবি এবং কবির মতো মানুষেরা লড়াই করেন; প্রতিবাদের ঝড় তোলেন মিউনিখ, নিউইয়র্কসহ ইতালির বিভিন্ন শহরের পথে পথে। কিন্তু শান্তি বিরোধীরাও থেমে থাকে না । তারা হয়ে ওঠে আরও হিংস্র, ঝাঁপিয়ে পড়ে সাধারণ শান্তিপ্রিয় মানুষের ওপর। এইসব অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে, অশান্তির গর্জনকে থামিয়ে দিতে প্রয়োজন হয় সতর্ক প্রহরার । তাই যুগে যুগে আফ্রিকার শিশু, প্যালেস্টাইনের কিশোর, নামিবিয়ার যুবক এমনকি বাংলাদেশের দামাল মুক্তিযোদ্ধারা নির্ঘুম রাত জেগে হয়ে ওঠে শান্তির প্রহরী । একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধারা যেমন 'একটি ফুলকে বাঁচানোর জন্য যুদ্ধ করেছিল, তেমনি এই শান্তির সেনানীরা 'শস্যক্ষেত, সদ্যফোটা ফুল, শিশুর হাসির জন্যে' শান্তি চায়। এই শান্তির পক্ষের মানুষগুলোর মন হয় কোমল, হৃদয়জুড়ে থাকে অফুরান আবেগ। তাই তারা লুমুম্বা, আলেন্দে, শেখ মুজিবের নির্মম হত্যাকাণ্ডে অশ্রুসিক্ত হয়, পিকাসোর প্যের্নিকা তাদের আবেগাপ্লুত করে ।
কবিতাটি বিবৃতিধর্মী; বিশেষ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কবি একের পর এক স্বভাবোক্তি করে চলেন । কেননা, কবি জানেন, প্রতিবাদের কথা, প্রত্যাশার কথা বলতে হয় সরাসরি স্পষ্টভাবে। তিনটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে বলা যায়, অলংকারসমৃদ্ধ কবিতা রচনার প্রচল রীতি থেকে মহাদেব সাহা এই কবিতায় বেরিয়ে আসতে চেয়েছেন। যা তিনি বলতে চান তাতে কোনো আড়াল রাখার পক্ষে তিনি নন । কবি মানুষের দুঃখের কথা বেদনার কথা আশার কথা প্রত্যাশার কথা তুলে ধরার জন্য গদ্যের সহজ ভঙ্গি কবিতায় ব্যবহার করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। কবিতাটিকে নিবিড়ভাবে বাস্তবঘনিষ্ঠ করে তুলতে তিনি ব্যবহার করেন অনেক ঐতিহাসিক অনুষঙ্গ। পৃথিবীর চেনা ভূগোলকে তিনি কাব্যিক পেলবতায় পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেন । আর এরই সঙ্গে কবি অন্তর্বয়ন ঘটান ‘বকুলের ঝরে পড়ার মতো শান্তি', 'রজনীগন্ধার খোলা পাপড়ির মতো শান্তি - এরকম উপমামণ্ডিত
নান্দনিক আবহসমৃদ্ধ পঙ্ক্তিমালা । এভাবে কবিতাটি বিষয়ে ও আঙ্গিকে বিশেষ তাৎপর্যবহ হয়ে ওঠে । কবিতাটি গদ্যছন্দের চাল অনুসরণ করে রচিত । অন্ত্যমিলবিহীন ছোটবড় পঙ্ক্তিতে কবিতাটির কাঠামো গড়ে উঠেছে ।
আরও দেখুন...