ব্যবস্থাপনার সংজ্ঞা
ব্যবস্থাপনা একটি ব্যাপক অর্থবহ শব্দ । ব্যবস্থাপনার সুনির্দিষ্ট ও সর্বজনীন গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা দেওয়া কঠিন । Management শব্দটি ইতালীয় শব্দ ‘Maneggiare' হতে উদ্ভুত । Maneggiare শব্দের অর্থ ‘To train up the horses' অর্থাৎ অশ্বকে প্রশিক্ষণ দিয়ে শিক্ষিত করে তোলা । তাই শাব্দিক অর্থে পরিচালনার সাথে সম্পর্কিত (to handle) কাজকে ব্যবস্থাপনা বলে ।
অনেক ব্যবস্থাপনাবিদ মনে করেন Management শব্দটি ফরাসি Manage এবং Menager শব্দ হতে উৎপত্তি হয়েছে । Manage শব্দের অর্থ হলো (The act of guiding or leading) অর্থাৎ পরিবার পরিচালনা করা ।
সাধারণ অর্থে: প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত উদ্দেশ্য অর্জনের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত শ্রমিক-কর্মচারীদের সুকৌশলে পরিচালনা করাকে ব্যবস্থাপনা বলে ।
ব্যাপক অর্থে: প্রতিষ্ঠানের মানবীয় ও বস্তুগত সম্পদসমূহের কার্যকর ব্যবহারের মাধ্যমে পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য পরিকল্পনা, সংগঠন, সমন্বয় সাধন, নির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণ কার্যাবলির সমাহারকে ব্যবস্থাপনা বলে ।
নিম্নে প্রখ্যাত মনীষী ও ব্যবস্থাপনাবিদদের কতিপয় উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা প্রদত্ত হলো:
১। এল. এ. এলেন ( L. A Allen ) -এর মতে, ‘একজন ব্যবস্থাপক যা করেন তাই ব্যবস্থাপনা । (Management is what a manager does)
২। এল.এ. এপলি (L.A Appley)-এর মতে, ‘ব্যবস্থাপনা হলো অন্যের মাধ্যমে কাজ করিয়ে নেওয়ার কৌশল ।' (Management is the art of getting things done through the efforts of other people)
৩। জর্জ. আর. টেরি (GR. Terry)-এর মতে, ব্যবস্থাপনা হচ্ছে পরিকল্পনা, সংগঠন, উৎসাহিতকরণ ও নিয়ন্ত্রণের একটি প্রক্রিয়া যা মানুষ ও অন্যান্য সম্পদের ব্যবহারের মাধ্যমে উদ্দেশ্য নির্ধারণ ও লক্ষ্য অর্জন করে ।
৪ । ই.এফ.এল ব্রিচ (E.F.L Breach) -এর মতে, ‘ব্যবস্থাপনা হচ্ছে দক্ষতার সাথে কার্য সম্পাদিত হচ্ছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করা ।
৫। আধুনিক ব্যবস্থাপনার জনক হেনরি ফেয়ল (Henry Fayol)-এর মতে, ‘ব্যবস্থাপনা হলো পূর্বানুমান ও পরিকল্পনা, সংগঠন, নির্দেশনা, সমন্বয় সাধন ও নিয়ন্ত্রণ করা ।’
৬। আমেরিকার ম্যানেজমেন্ট সমিতি (American Management Association)- এর মতে, ‘মানুষের উদ্যম সংগঠিত ও পরিচালিত করার মাধ্যমে প্রাকৃতিক শক্তি ও সম্পদগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের কল্যাণ সাধনে নিয়োজিত করার বিজ্ঞান ও কলাকে ব্যবস্থাপনা বলে ।
ব্যবস্থাপনার কার্যাবলি
Function of Management
ব্যবস্থাপনা বিশারদ চিন্তাধারা ও মতামতের উপর ভিত্তি করে ব্যবস্থাপনার কার্যাবলি কে নিম্নোক্তভাবে বর্ণনাকরা হলো।
নিম্নে ব্যবস্থাপনার কার্যাবলি আলোচনা করা হলো:
১। পরিকল্পনা (Planning) : পরিকল্পনা ব্যবস্থাপনার প্রথম ও মৌলিক কাজ। পরিকল্পনা হলো ভবিষ্যৎ কার্যক্রমের দিক-নির্দেশনা। অর্থাৎ ভবিষ্যতে কী কাজ করা হবে, কে করবে, কখন করবে, কীভাবে করবে ইত্যাদি নির্ধারণ করাই হলো পরিকল্পনা ।
পরিকল্পনা সম্বন্ধে অধ্যাপক নিউম্যান বলে, 'ভবিষ্যতে কী করতে হবে তার অগ্রিম সিদ্ধান্তকেই পরিকল্পনা বলে । মোটকথা প্রতিষ্ঠানের পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রণীত ভবিষ্যৎ নকশাকে পরিকল্পনা বলে ।
২। সংগঠন (Organization): পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অপরিহার্য উপাদান হলো সংগঠন । পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্য বা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সংগৃহীত উপাদান ও জনশক্তির সুশৃঙ্খল বিন্যাসকে সংগঠন বলে । সংগঠন হচ্ছে একটি কাঠামো বিশেষ। যেখানে কাজের প্রকৃতি অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কর্মীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য বণ্টন করে দেওয়া হয় । এতে কর্মীরা সহজেই প্রতিষ্ঠানে নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারে ।
৩। কর্মীসংস্থান (Staffing): সাংগঠনিক কাঠামো নির্ধারণের পর ব্যবস্থাপনার অন্যতম কাজ হলো বিভিন্ন স্তরে কাজের প্রকৃতি অনুযায়ী যোগ্যতাসম্পন্ন প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মী জোগাড় এবং তাদের যথাযথভাবে নিয়োগ দান করা। সুতরাং সাংগঠনিক কাঠামোতে মানব শক্তির অভাব পূরণের জন্য যে কৌশল অবলম্বন করা হয় তাকে কর্মীসংস্থান বলে ।
৪ । নির্দেশনা (Direction) : প্রাতিষ্ঠানিক গতিশীলতা ও উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য কর্মীদেরকে যে আদেশ, নির্দেশ ও পরামর্শ প্রদান করা হয় তাকে নির্দেশনা বলে । নির্দেশনা প্রতিষ্ঠানের মূল চালিকাশক্তি । তাই একে প্রশাসনের হৃৎপিণ্ড বলা হয় ।
৫। প্রেষণা (Motivation) : প্রেষণা ব্যবস্থাপনার একটি মনস্তাত্ত্বিক দিক । যে প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থাপক শ্রমিক কর্মীদের মধ্যে কাজের প্রতি আকৃষ্ট, আগ্রহী এবং উৎসাহ উদ্দীপনা সৃষ্টি করে থাকেন, তাকে প্রেষণা বলা হয় । এর মাধ্যমে কর্মীদের মধ্যে কাজ ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি আন্তরিকতা সৃষ্টি হয়। মাইকেল জুসিয়াস-এর মতে, 'প্রেষণা হলো ব্যবস্থাপনা কর্তৃক সেই ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ যা কর্মীদেরকে নির্ধারিত কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে উৎসাহিত ও প্রণোদিত করে।'
৬। সমন্বয় সাধন (Co-ordination) : প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত বিভিন্ন ব্যক্তি, বিভাগ, উপকরণ ও কাজের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের প্রক্রিয়াই হলো সমন্বয় সাধন । সমন্বয় সাধন দলগত সমঝোতার একটি মাধ্যম। সমন্বয় সাধনের ফলে সংগঠনের বিভিন্ন অংশের মধ্যে অসামঞ্জস্য দূর হয় এবং সকলে একযোগে ও স্বাচ্ছন্দ্যে প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য অর্জনে সচেষ্ট হয় ।
৭। নিয়ন্ত্রণ (Controlling): নিয়ন্ত্রণ হলো ব্যবস্থাপনার সর্বশেষ কাজ। পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী কার্যসম্পাদন হচ্ছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করা এবং প্রয়োজনে যথাস্থানে সংশোধনী ব্যবস্থা গ্রহণ করাই হলো নিয়ন্ত্রণ । হেনরি ফেয়ল-এর মতে, 'নিয়ন্ত্রণ হলো গৃহীত পরিকল্পনা, জারিকৃত নির্দেশনা ও প্রতিষ্ঠিত নীতি অনুযায়ী কার্য পরিচালিত হচ্ছে কিনা তা পরীক্ষা করা।
আরও দেখুন...