১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়। তৎকালীন পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের একটি অংশে পরিণত হয় । পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা, সংস্কৃতি কোনো কিছুরই মিল ছিল না। হাজার মাইল ব্যবধানের পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) দুইটি ভূখণ্ডকে এক করা হয় শুধু ধর্মের ভিত্তিতে। ফলে পাকিস্তান নামক এই নতুন রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠী প্রথমেই বাঙালিকে শোষণ করার কৌশল হিসেবে বাংলা ভাষার ওপর আঘাত হানে । নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে? এ প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বেই। সে সময় মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতারা উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে মতামত দেন। তখনই ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাসহ বাংলার বুদ্ধিজীবী, লেখকগণ এর প্রতিবাদ করেন। পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হওয়ার পর পরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে তমদ্দুন মজলিশ গঠিত হয়। এটিই ছিল ভাষা আন্দোলনের প্রথম সংগঠন। এ সংগঠনের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর ভাষা আন্দোলনের প্রথম পুস্তিকা ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু' প্রকাশিত হয়। পুস্তিকাটিতে রাষ্ট্রভাষা বাংলা দাবির পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করা হয় ।
তমদ্দুন মজলিশের উদ্যোগে ভাষা আন্দোলনকে রাজনৈতিক রূপদানের জন্য ৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে গঠিত হয় প্রথম ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ', যার আহ্বায়ক মনোনীত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নূরুল হক ভূঞা। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের পাশাপাশি পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ, পূর্ববঙ্গ বুদ্ধিজীবী সমাজ, সাংবাদিক সংঘ বিভিন্ন সভা-সমিতিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। সব কিছুকে উপেক্ষা করে ডিসেম্বর মাসে করাচিতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য সংবিধান সভার কাছে সুপারিশ করে । ১৯৪৮ সালের প্রথম থেকেই শিক্ষিত বাঙালি সমাজ বাংলা ভাষার দাবি নিয়ে সোচ্চার হয়ে ওঠে । এ সময় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের এক সভায় শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলাকে গ্রহণের প্রস্তাব দেওয়া হয়। ২৩শে ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে ইংরেজির পাশাপাশি উর্দুতে কার্যক্রম শুরু হলে পূর্ব বাংলা কংগ্রেস পার্টির সদস্য কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এর প্রতিবাদ করেন এবং বাংলাকেও অধিবেশনের অন্যতম ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান। কিন্তু, মুসলিম লীগের সকল সদস্য এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে । এ ঘটনায় পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ ব্যাপকভাবে প্রতিবাদ করতে থাকে। ২৬ ও ২৯শে ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সালে ঢাকার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয় । ২রা মার্চ দেশের ছাত্রসমাজ বুদ্ধিজীবীদের উপস্থিতিতে দ্বিতীয় বারের মতো 'রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ' গঠন করে ।
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নতুন কমিটির আহ্বানে ১১ই মার্চ ধর্মঘট পালিত হয়। আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা । ধর্মঘটের পক্ষে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' স্লোগানসহ মিছিল করার সময় পুলিশের লাঠিচার্জে অনেকে আহত হন । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ, কাজী গোলাম মাহবুবসহ অনেকেই গ্রেফতার হন । এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৩-১৫ই মার্চ আবার ধর্মঘট পালিত হয়। এবার শুধু ঢাকা নয়, দেশের সর্বত্র ধর্মঘট পালিত হয়। তীব্র আন্দোলনের মুখে ১৫ই মার্চ মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন আন্দোলনকারীদের সাথে আলোচনায় বসে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এ চুক্তিতে গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি, তদন্ত কমিটি গঠন, শিক্ষার মাধ্যম বাংলা, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব আইন পরিষদে উত্থাপন প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত ছিল ।
১৯৪৮ সালের ১৯শে মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসেন । ২১শে মার্চ রমনার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এবং ২৪শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি বক্তব্য রাখেন। দুটি বক্তব্যেই তিনি বাংলা ভাষার দাবি অগ্রাহ্য করে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দেন । সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, 'উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা' । উপস্থিত ছাত্ররা তীব্র প্রতিবাদে ‘না না' ধ্বনি দিয়ে ওঠে। এ সময় সারা পূর্ব পাকিস্তানেই ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে । ১৯৪৮ সালের ১৮ই নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঢাকায় এসে বক্তৃতাকালে আবার উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দেন । ছাত্ররা 'না না' বলে প্রতিবাদ করে ওঠে ।
১৯৪৮ সালে করাচিতে অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে বাংলা ভাষা আরবি হরফে লেখার প্রস্তাব দেওয়া হয় । ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এর প্রতিবাদ করেন । আরবি হরফে বাংলা লেখার ষড়যন্ত্রের প্রচেষ্টা হিসেবে বাংলা ভাষা সংস্কারের নামে ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে 'পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি' গঠন করা হয় । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর প্রতিবাদ জানায়। ১৯৫০ সালের ১১ই মার্চ আবদুল মতিনকে আহ্বায়ক করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এ বছরের সেপ্টেম্বর মাসে গণপরিষদ কর্তৃক গঠিত মূলনীতি কমিটির সুপারিশে বলা হয়, উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে। দেশজুড়ে প্রতিবাদ সভা-সমাবেশ চলতে থাকে । পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান আততায়ীর হাতে নিহত হলে প্রধানমন্ত্রী হন খাজা নাজিমুদ্দীন । ১৯৫২ সালে ঢাকায় খাজা নাজিমুদ্দীনের বক্তব্যে জিন্নাহর কথার প্রতিধ্বনি হলে ভাষা আন্দোলন নতুন মাত্রা ও সর্বাত্মক রূপ লাভ করে । এভাবে চূড়ান্ত পর্যায়ের সূচনা হয় ।
আরও দেখুন...