কোন ব্যক্তি, বস্তু বা পদার্থের কাজ করার সামর্থ্য বা ক্ষমতাকে এর শক্তি বলে। একটি বস্তু এই শক্তি তার আপেক্ষিক অথবা পারিপার্শ্বিক অবস্থা বা অবস্থানের সাপেক্ষে অথবা গতির দরুন অর্জন করতে পারে। বিশেষ অবস্থায় বস্তু মোট যে পরিমাণ কাজ সম্পন্ন করতে পারে, তা দ্বারাই শক্তি পরিমাপ করা হয়। যার কাজ করার সামর্থ্য যত বেশি তার শক্তিও তত বেশি। আর যার কাজ করার সামর্থ্য যত কম তার শক্তিও তত কম। অতএব বলা যায় কাজ শক্তির মাপকাঠি। যদি বলা হয় কোন বস্তু W পরিমাণ কাজ করল, তবে বুঝতে হবে যে, তার ব্যয়িত শক্তির মান W।
মোটর ইঞ্জিনে পেট্রোলের বাষ্প, বাষ্পীয় ইঞ্জিনে জলীয় বাষ্পের চাপ পিস্টনকে চালায়। সুতরাং বাষ্পের শক্তি আছে। বিদ্যুতেরও শক্তি আছে। এই শক্তিতেই ট্রেন, ট্রাম, কল-কারখানা চলে। শক্তি আছে বলেই এই মহাবিশ্ব চলছে। শক্তির অভাবে জগৎ অচল।
যখন কোন বস্তু বলের বিরুদ্ধে কাজ করে, তখন তা শক্তি হারায়। আবার কোন বস্তুর উপর বল ক্রিয়া করলে তা শক্তি লাভ করে।
কাজ দ্বারাই শক্তির পরিমাপ করা হয় অর্থাৎ কাজই শক্তির মাপকাঠি। অতএব কাজ এবং শক্তির একক ও মাত্রা সমীকরণ সম্পূর্ণ অভিন্ন।
শক্তিকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে, যথা-
(১) যান্ত্রিক শক্তি (Mechanical energy)
(২) তাপ শক্তি (Heat energy)
(৩) শব্দ শক্তি (Sound energy)
(৪) আলোক শক্তি (Light energy)
(৫) চুম্বক শক্তি (Magnetic energy)
(৬) বিদ্যুৎ শক্তি (Electric energy)
(৭) রাসায়নিক শক্তি (Chemical energy)
(৮), পারমাণবিক শক্তি (Atomic energy)
(৯) সৌরশক্তি (Solar energy)।
কোন বস্তুর মধ্যে তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা বা অবস্থানের সাপেক্ষে অথবা গতির জন্য কাজ করার সামর্থ্য তথা শক্তি থাকে, তবে ঐ শক্তিকে যান্ত্রিক শক্তি বলে।
এই অধ্যায়ে আমরা যান্ত্রিক শক্তি আলোচনা করব। এটি প্রধানত দুই প্রকার; যথা-
( ১ ) গতিশক্তি (Kinetic energy)। একে সংক্ষেপে K. E. লেখা হয় এবং
(২) বিভব বা স্থিতিশক্তি (Potential energy)।
রাইফেলের একটি গুলি লক্ষ্যবস্তুতে সজোরে আঘাত করার পর তা বস্তুর বাধা অতিক্রম করে খানিকটা ঢুকে যায়। অর্থাৎ গুলি কিছু কাজ করে। গুলি যতক্ষণ বন্দুকের ভিতর থাকে ততক্ষণ তার এই কাজ করার সামর্থ্য থাকে না।
কাজেই বুঝা যায় গুলি এই কাজ করার সামর্থ্য অর্থাৎ শক্তি অর্জন করে গতি হতে। বায়ুর গতির দিকে নৌকা চালালে তার গতি বৃদ্ধি পায় এবং বিপরীত দিকে চালালে তার গতি হ্রাস পায়। নৌকা পানির বাধা অতিক্রম করার শক্তি সংগ্রহ করে গতি হতে।
আরও সংক্ষেপে বলা যায়, গতির জন্য বস্তুতে যে শক্তির উদ্ভব হয় তাকে তার গতিশক্তি বলে।
দোলায়মান দোলক, ঘূর্ণায়মান ফ্লাই হুইল, নিক্ষিপ্ত তীর, চলন্ত ফুটবল, প্রচণ্ড ঝড়, চলন্ত সাইকেল ইত্যাদি সকলের শক্তিই পতিশক্তি। কোন গতিশীল বস্তু গতিতে থাকাকালীন অর্থাৎ স্থিতিতে আসার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত যে পরিমাণ কাজ সম্পন্ন করে তা দ্বারা তার গতিশক্তি পরিমাপ করা হয়।
রৈখিক গতির ক্ষেত্রে : গতিশীল বস্তু স্থিতিতে আসার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত যে পরিমাণ কাজ সম্পন্ন করে তাই গতিশক্তির পরিমাপ ।
মনে করি, 'm' ভরবিশিষ্ট একটি বস্তু AB বরাবর বেগে চলছে। গতির বিপরীত দিকে BA বরাবর তার উপর F পরিমাণ ধ্রুব বল প্রয়োগ করা হল। এতে সম-মন্দনের সৃষ্টি হবে। মনে করি, সম-মন্দন = a এবং বস্তুটি A হতে s দূরত্ব অতিক্রম করার পর B বিন্দুতে এসে থেমে গেল। এ ক্ষেত্রে শেষ বেগ = 0.
= স্থিতিতে আসার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত কৃত কাজ
= বল × স্থিতিতে আাসার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত অতিক্রান্ত দূরত্ব
= F × s
নিউটনের ২য় গতি সূত্র হতে আমরা জানি,
বল = ভর x ত্বরণ বা মন্দন
F = ma
বর্ণনা অনুসারে, 0 = v2 -2as
বা, 2as = v2
উপরের সমীকরণে F এবং s-এর মান বসিয়ে আমরা পাই,
গতিশক্তি
বা, K. E.
উপরের সমীকরণ হতে আমরা সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে,
ধরা যাক, m ভরের একটি বস্তুর উপর নির্দিষ্ট দিকে F বল প্রয়োগ করে গতিশীল করা হয়। বলের দিক অপরিবর্তী, কিন্তু মান পরিবর্তনশীল। বস্তুটির সরণ X-অক্ষ বরাবর।
বস্তুর সরণ ঘটার ফলে বল দ্বারা মোট কৃত কাজ
ত্বরণ a-কে লেখা যায়,
ধরা যাক, বস্তুতে ক্রিয়াশীল বল বস্তুটির বেগ 0 হতে ৮-তে উন্নীত করে।
অতএব,
এই কৃত কাজই হচ্ছে বস্তুটির গতিশক্তি।
m ভরের একটি বস্তু বেগে গতিশীল হলে এর ভরবেগ, P = mv
এবং গতিশক্তি
এটিই গতিশক্তি ও ভরবেগের সম্পর্ক।
কোন বস্তুর উপর ক্লিয়ারত লখি বল কর্তৃক কৃত কাজ তার গতিশক্তির পরিবর্তনের সমান। নিম্নোক্ত দুটি সমীকরণের সাহায্যে কাজ শক্তি উপপাদ্য প্রমাণ করা হবে। একটি হল শক্তি লাভ (Gain of energy) আর অপরটি হল শক্তি ক্ষয় ( Loss of energy)। সমীকরণ দুটি সাধারণভাবে কাজ শক্তি উপপাদ্য নামে পরিচিত।
মনে করি 'm' ভরবিশিষ্ট একটি বস্তু 'v0' আদি বেগে চলছে। গতির দিকে নির্দিষ্ট মানের একটি বল F বস্তুর উপর প্রয়োগ করলে বস্তুর বেগ বৃদ্ধি পাবে। ফলে বস্তু শক্তি লাভ করবে। মনে করি দূরত্ব অতিক্রম করার পর শেষ বেগ 'v' হল। তা হলে কৃত কাজ, W= F × s।
বল কর্তৃক সৃষ্ট ত্বরণ,
বা,
কৃত কাজ,
(২) শক্তি ক্ষয় ঃ মনে করি, 'm' ভরবিশিষ্ট একটি বস্তু ' ' আদি বেগে চলছে। গতির বিপরীত দিকে নির্দিষ্ট মানের বল প্রয়োগ করলে তার বেগ কমবে এবং বলের বিরুদ্ধে কাজ করতে গিয়ে বস্তু শক্তি হারাবে। গতির বিপরীতে F বল প্রয়োগে মন্দন হলে এবং 5 দূরত্ব অতিক্রমের পর বস্তুর বেগ হলে, মন্দনের ক্ষেত্রে,
কাজেই কৃত কাজ,
সুতরাং কোন বস্তুর উপর ক্রিয়ারত লম্বি বল কর্তৃক কৃত কাজ তার গতিশক্তির পরিবর্তনের সমান। এটি ‘কাজ-শক্তি উপপাদ্য' নামে পরিচিত। সমীকরণ (23) ও (24) উপপাদ্যটি প্রমাণ করে।
আরও দেখুন...