রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (রবীন্দ্রনাথের সংগীত জীবনের পারিবারিক পটভূমি) বাংলা তথা ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে কোলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। এই বাড়ির পৃষ্ঠপোষকতায় ও এর সদস্যদের দানে বঙ্গসংস্কৃতির বহুমুখী পুষ্টিসাধন ঘটেছে। এই পরিবারের রামলোচন ঠাকুরের সংগীতপ্রীতির কথা জানা যায়। তিনি যে সংগীতের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ও সেকালের খ্যাতিমান পেশাদার গায়ক-বাদকদের স্বগৃহে আমন্ত্রণ জানিয়ে সমারোহের সঙ্গে সংগীতানুষ্ঠান করতেন সমকালীন বিবরণে তার উল্লেখ মেলে। দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪-১৮৪৬) ছিলেন স্বয়ং সংগীতজ্ঞ, সুকণ্ঠ গায়ক, রাগসংগীত ও পাশ্চাত্য সংগীত পদ্ধতিতে অভিজ্ঞ। এর সংগীত শিক্ষা সম্পর্কে কোনো প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায় না। তবে তাঁর সংগীতজ্ঞান ও চমৎকার গায়নক্ষমতা সম্পর্কে নানা জনের স্মৃতিচারণে উল্লেখ পাওয়া যায়। বিশ্ববিখ্যাত জার্মান পণ্ডিত ও প্রাচ্যতত্ত্ববিদ ম্যাকমুলার সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তাঁর পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুরের সংগীতজ্ঞান ও গাইবার শক্তি সম্পর্কে যেভাবে জানিয়েছিলেন, তাতে বোঝা যায় যে, রাগসংগীত ও পাশ্চাত্য সংগীত পদ্ধতিতে তিনি ব্যুৎপন্ন ছিলেন এবং ভালো গান গাইবার মতো মার্জিত কন্ঠস্বর ছিল তাঁর। সংগীত ও সংস্কৃতিকর্মীদের পৃষ্ঠপোষকরূপেও তিনি উদার ভূমিকা পালন করতেন। পিতার মতো তিনিও সংগীতোৎসবের আয়োজন করতেন। সেকালে প্রকাশিত সংবাদপত্রে তেমন অন্তত দুটি উৎসবের বিবরণ পাওয়া যায়। রামলোচন ঠাকুরের আমলে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িকে কেন্দ্র করে সংগীত ঐতিহ্যের যে সুত্রপাত ঘটে, স্বারকানাথ ঠাকুরের আমলে তার বিকাশের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দেয় এবং সে সময় থেকেই ঠাকুরবাড়ির সদস্যরা সংগীত চর্চায় ব্রতী হয়ে ওঠেন।
দ্বারকানাথ ঠাকুরের সংগীতোদ্যোগ সাফল্যমণ্ডিত হয়ে ওঠে তার পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫) এর আমলে। দেবেন্দ্রনাথ তরুণ বয়সে রাগসংগীতের চর্চা করেছিলেন। সে চর্চা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি বটে, তবে ধ্রুপদীয় সংগীতের ধারাটি তিনি আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন। পাশ্চাত্য সংগীতেও তাঁর শিক্ষা ছিল। তাঁর কন্ঠস্বর ছিল সুরেলা ও গম্ভীর। দেবেন্দ্রনাথ সংগীত রচয়িতা ছিলেন। বাংলায় ও সংস্কৃতে তিনি গান রচনা
করেছেন। তাঁর গানের সংখ্যা বেশি নয়। তবে তিনিই ঠাকুরবাড়ির প্রথম সংগীত রচয়িতা। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩)-এর প্রভাব ছিল গভীর সমাজসংস্কারক
রামমোহন রায় ঊনিশ শতকের প্রথম দিকে, সেই সময়েই সংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মের বিপরীতে একেশ্বরবাদী অপৌত্তলিক ব্রাহ্ম ধর্মের প্রচলন করেন। ব্রাহ্ম ধর্মের উপাসনার জন্য প্রচলন করেন ব্রহ্মসংগীতের। রামমোহনের ব্রাহ্মধর্ম বা সমাজ সংক্রান্ত ভাবনাই শুধু নয়, তাঁর উপাসনা সংগীতের ভাবনাও দেবেন্দ্রনাথকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। রামমোহনের পর তিনি যখন ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন, তখন ব্রাহ্ম উপাসনা সংগীতের বা ব্রহ্মসংগীতের বিকাশেও তিনি সর্বতোভাবে মনোনিবেশ করেন। দেবেন্দ্রনাথ রাগসংগীত, বিশেষ করে ধ্রুপদরীতির বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। ধ্রুপদী বিষ্ণু চক্রবর্তী ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরে সংগীতাচার্য হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন রাজা রামমোহন রায়ের আমন্ত্রণে। দেবেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি ব্রাহ্মসমাজের কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে পরিণত হয় এবং বিষ্ণু চক্রবর্তীও ঠাকুরবাড়িতে আমন্ত্রিত হয়ে এ বাড়ির পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মসমাজে সংগীত বিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিষ্ণু চক্রবর্তী ব্যতীত স্বনামধন্য ধ্রুপদী যদু ভট্টও সেই বিদ্যালয়ে সংগীত শিক্ষক নিযুক্ত হয়েছিলেন। ব্রাহ্মসমাজে কালক্রমে বিভাজন দেখা দেয় এবং বিভিন্ন শাখার উপাসনা সংগীত রীতিতে পরিবর্তন আসে। কিন্তু দেবেন্দ্রনাথের নেতৃত্বাধীন আদি ব্রাহ্মসমাজে ধ্রুপদ সংগীতরীতির প্রভাব অক্ষুন্ন থাকে। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর সমাজ মন্দিরে সংগীতাচার্যের পদে অধিষ্ঠিত থেকে বিষ্ণু চক্রবর্তী ধ্রুপদ সংগীত রীতির প্রসারে এবং তার একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেন। দেবেন্দ্রনাথ নিজ গৃহকে রাগসংগীত চর্চার একটি উচ্চমানের কেন্দ্রে পরিণত করেছিলেন। ব্রাহ্মসমাজে আমন্ত্রিত নন এমন সব সংগীতগুলিও জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে আমন্ত্রিত হয় এবং দেবেন্দ্রনাথের পারিবারিক সংগীত শিক্ষক রূপে নিয়োজিত হন। এঁদের মধ্যে ছিলেন যদু ওই, রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামী, শ্যামসুন্দর মিত্র, মওলা বখশ প্রমুখ ভারতবিখ্যাত সংগীতাচার্য। দেবেন্দ্রনাথের উৎসাহে তাঁর পুত্রকন্যাসহ পরিবারের অনেক সদস্য এই সব গুণীর অধীনে রাগসংগীতে তালিম নিতে থাকেন। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ ঠাকুরবাড়ির অনেক সদস্যই এই সব উচ্চমানের গুণীর তালিমে তাঁদের সংগীত জীবন গঠন করেন। শুধু বাড়ির ছেলেদের সংগীতাভ্যাস করিয়েই ক্ষান্ত হননি দেবেন্দ্রনাথ, মেয়েদের সংগীত শিক্ষার ব্যাপারেও তিনি গভীর উৎসাহের পরিচয় দিয়েছেন। সেকালে ওস্তাদের অধীনে বাড়ির মেয়েদের তালিম নেওয়া এক অভাবিত ব্যাপার ছিল। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এ ক্ষেত্রে পথিকৃৎ।
ব্রহ্মসংগীত রচনার যে দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেন তা তাঁর পুত্রকন্যা ও পরিবারের সকল সদস্যের জন্য প্রেরণার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ভিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, হেমেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এঁরা সবাই ব্রহ্মসংগীত রচয়িতারূপে আবির্ভূত হন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর দেশানুরাগী ছিলেন। জনগণের মধ্যে দেশপ্রেম সৃষ্টি করার ব্যাপারে তার গভীর উৎসাহ ছিল। সংগীত দেশপ্রেমের বাণী প্রচারে বিশেষ সহায়ক ভূমিকা গ্রহণ করে। ফলে ঠাকুরবাড়ির তরুণ সদস্যগণ ব্রহ্মসংগীত রচনার পাশাপাশি দেশাত্মবোধক গান রচনায়ও মনোনিবেশ করেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন যে, ইউরোপের গান এক দিক দিয়ে তাঁর হৃদয়কে খুবই আকর্ষণ করত কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর মনে হতো যে, ইউরোপের গান এবং আমাদের গানের মহল যেন ভিন্ন, ঠিক এক দরজা দিয়া হৃদয়ের একই মহলে যেন তাহারা প্রবেশ করে না। ১৮৭৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্যে বিলেত যাত্রা করেন রবীন্দ্রনাথ। প্রায় সতের মাস বিলেত বাসের পর ১৮৮০ সনে ফেব্রুয়ারি মাসে রবীন্দ্রনাথ
কোলকাতায় ফেরেন। পাশ্চাত্য সংগীতের একটা বেশ রয়ে গেল মনে। সে সময়কার গান ও গীতিনাট্য রচনায়
পাশ্চাত্য সংগীতের যে প্রভাব পড়েছিল তা খুবই লক্ষ্য করার মতো।
পাশ্চাত্য সংগীত রচয়িতার কাজের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যে গভীর পরিচয় ছিল তা তাঁর জীবনস্মৃতি থেকে বোঝা যায়। যদিও প্রথম জীবনে পাশ্চাত্য সংগীতের প্রতি এই আকর্ষণ দেখে এ কথা বলার কোনো অবকাশ নেই যে, রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্য সংগীতরীতি দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। পরিণত বয়সের সংগীত রচনায় রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্য সংগীতরীতির কোনো উল্লেখযোগ্য প্রয়োগ ঘটাননি। তবে পাশ্চাত্য সংগীত রচয়িতার রচনাকর্মের অপরিবর্তনীয়তার ধারণা তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল। ভারতীয় সংগীতে গায়কীর যে চিরাচরিত রীতি তাতে গায়ক স্বাধীনভাবে সুরবিহার করতে পারেন। সেক্ষেত্রের মূল রচয়িতার রচনা অনেকাংশেই পরিবর্তিত হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ ভারতের চিরাচরিত পরিবর্তনীয়তার রীতি অপেক্ষা পাশ্চাত্যের অপরিবর্তনীয়তার রীতিটিই গ্রহণ করলেন সানরে ।
১৮৯১ সালে রবীন্দ্রনাথ বর্তমান বাংলাদেশে তাঁদের জমিদারি পরিদর্শনে আসেন। কুষ্টিয়ার শিলাইদহে আসেন তিনি। সেখানকার পল্লি প্রকৃতি ও লৌকিক সংগীত, বিশেষ করে বাউল গান তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। রাগসংগীতের পরিমণ্ডলে পরিবর্ধিত এবং পাশ্চাত্য সংগীত দ্বারা প্রভাবিত ত্রিশ বছরের তরুণ কবি অনুপ্রেরণার অপর একটি বিশাল জগৎ খুঁজে পান। বাউল সংগীত এবং বাউল তত্ত্ব রবীন্দ্রনাথের সংগীত রচনা পদ্ধতি ও দর্শন চিন্তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। সংগীত রচনার সূচনা
সঠিকভাবে বলা না গেলেও মোটামুটিভাবে ধরে নেওয়া যায় যে, ১৮৭৫ সালের দিক থেকে রবীন্দ্রনাথ গান রচনা করতে শুরু করেন। রবীন্দ্রসংগীতালোচক শুভ গুহঠাকুরতা মনে করেন যে, ১৮৮১ সালকে রবীন্দ্রনাথের সংগীত রচনার প্রারম্ভকাল হিসেবে ধরে নেওয়াই ভালো। তিনি বলেন- “আমরা ১৮৮১ সাল থেকে তাঁর রচনা আরম্ভ হয়েছে ধরে নেব। কেননা, এই সময় থেকেই রবীন্দ্রসংগীতের একটা ক্রমপর্যায় করা সম্ভব, এর পূর্বেকার রচনা বিক্ষিপ্ত ও সংখ্যাও খুব অল্প। এই হিসেবে রবীন্দ্রনাথের সংগীত রচনাকাল ৬০ বছর বিস্তৃত।
রবীন্দ্রসংগীত রচনার তিন পর্যায় রবীন্দ্রনাথের সংগীত রচনার কাল, তথা রবীন্দ্রসংগীতের ক্রমবিকাশের ধারাকে তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন শুভ গুহঠাকুরতা। পর্যায়সমূহ হচ্ছে- ১৮৮১ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত প্রথম পর্যায়, ১৯০১ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় পর্যায় এবং ১৯২১ সাল থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত তৃতীয় পর্যায়। প্রথম পর্যায়কে বলা হয়ে থাকে প্রস্তুতির পর্যায়। সে পর্যায়ে ঠাকুরবাড়ির হিন্দুস্তানি রাগসংগীতের পরিমণ্ডল থেকে প্রেরণা আহরণ করে রবীন্দ্রনাথ নিজেকে প্রস্তুত করে তুলছিলেন। সামনে ছিল ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্পা প্রভৃতি সংগীতরীতি নির্মাণের দৃষ্টান্ত। সেসব দৃষ্টান্তকে নিজের রচনায় ব্যবহার করে তিনি পদ্ধতিগত রচনার শিক্ষাকে পাকা করে তুলেছিলেন। পাশ্চাত্য সংগীতের দৃষ্টান্তেও গান রচনা করেছিলেন। ভারতের নানা প্রদেশে প্রচলিত কিছু সংগীত অবলম্বনেও রবীন্দ্রনাথ গান রচনা করেন। সেজন্য সে পর্যায়ে অনেক রচনাকে বলা হয়ে থাকে সংগৃহীত সুর প্রভাবিত গান। বাল্মীকি প্রতিভা, কালমৃগয়া ও মায়ার খেলা এই তিনটি গীতিনাট্য এ পর্যায়ের বিশেষ উল্লেখযোগ্য রচনা।
দ্বিতীয় পর্যায়কে বলা হয় পরীক্ষার পর্যায়। এই পর্যায়ে এসে রবীন্দ্রনাথ সংগৃহীত সুর প্রভাবিত গান অর্থাৎ
হিন্দুস্তানি গান ভেঙে গান রচনার ধারা বহুলাংশে ত্যাগ করে রাগসংগীতের ভিত্তিতে মৌলিক সংগীত রচনায়
ব্রতী হন। প্রথম পর্যায়ে রাগসংগীতের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির যে আভাস পাওয়া যাচ্ছিল তা এখানে এসে স্পষ্ট
হয়ে ওঠে। লোকসংগীত, বিশেষত বাড়ল সম্পর্কে তার ব্যাপক আগ্রহ দেখা যায় এই পর্যায়ে।
তৃতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্রসংগীত রচনায় যে বৈশিষ্ট্যময় প্রকাশ তার ভিত্তি স্থাপনা হয় মধ্য পর্যায়ের পরীক্ষামূলক রচনায়। গীতাঞ্জলি, গীতিমাল্য ও গীতাদির রাগসম্মত অথচ কাব্য শ্রীমণ্ডিত গানগুলো পাওয়া যায় এই যুগে। রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ দেশাত্মবোধক গান এই পর্যায়ে রচিত হয়। দেশাত্মবোধক গানে লোকসংগীতের ব্যাপক ব্যবহার এই যুগের রচনার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ঝম্পক, ষষ্ঠী, রূপকড়া, নবতাল, একাদশী ও নবপঞ্চ এই ছয়টি নতুন তাল এই পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন। সুররচনা ও ছন্দনির্মাণ এইসব দিক থেকেই রবীন্দ্রনাথ। তখন এক ব্যাপক পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। এই পর্যায়কে রবীন্দ্রসংগীতের পরিপূর্ণতার যুগ রূপে আখ্যায়িত করা হয়। রবীন্দ্রনাথের সংগীত রচনার পরিপূর্ণ বৈশিষ্ট্য তখনকার গানে প্রতিফলিত হয়েছে। সুর ও বাণীর মর্মানুযায়ী সম্মিলন এবং লোকসুর ও রাগসুরের মিলনে এক নব সুর ঢঙ রচনা এ যুগের রবীন্দ্রসংগীতের বৈশিষ্ট্য। বিগত দু-পর্যায়ের প্রচেষ্টা যেন এই যুগে এসে সার্থকতা পেল।
গীতশ্রেণি বিভাজন
রবীন্দ্রনাথের গীতসংকলন গ্রন্থের নাম গীতবিতান। এই গ্রন্থে তিনি নিজে তাঁর রচিত গানসমূহকে চারটি প্রধান ভাগে ভাগ করেছেন। বিভাগসমূহ হচ্ছে- পূজা, স্বদেশ, প্রেম ও প্রকৃতি। বিচিত্র ও আনুষ্ঠানিক নামে দুটি অপ্রধান বিভাগও রয়েছে। পূজা পর্যায়ের গানসূহকে রবীন্দ্রনাথ ২১টি উপবিভাগে বিভক্ত করেছেন। উপবিভাগ সমূহ হচ্ছে- গান, বন্ধু, প্রার্থনা, বিরহ, সাধনা ও সংকল্প, দুঃখ, আশ্বাস, অন্তর্মুখে, আত্মবোধনে, জাগরণ, নিঃসংশয়, সাধক, উৎসব, আনন্দ, বিশ্ব, বিবিধ, সুন্দর, বাউল, পথ, শেষ ও পরিণয়। প্রেম পর্যায়ের গানে ২টি উপবিভাগ-গান ও প্রেমবৈচিত্র্য। প্রকৃতি পর্যায়ের গানসমূহ ৭টি উপবিভাগে বিভক্তঃ সাধারণ, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত । শুভ গুহঠাকুরতা রবীন্দ্রনাথের সংগীত রচনাকে ১৭টি ভাগে ভাগ করেছেন। বিভাগগুলে হচ্ছে- ধ্রুপদ ও খামার, খেয়াল ও ঠুমরি, টপ্পা, ভাঙাগান, লোকসংগীত, নতুন তালের গান, ধর্মসংগীত, প্রেমসংগীত, ঋতুসংগীত, ভানুসিংহের পদাবলি, দেশাত্মবোধক গান, আনুষ্ঠানিক গান, হাস্যরসাত্মক গান, শিশুসংগীত, কাব্যসংগীত, উদ্দীপক গান এবং বেদগান।
পূজা
পূজা পর্যায়ের অন্তর্গত রবীন্দ্রসংগীত সংখ্যায় প্রায় সাড়ে ছয়শত। এ পর্যায়েই রবীন্দ্রনাথ সর্বোচ্চ সংখ্যক গান রচনা করেন। রাজা রামমোহন রায় তার প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মধর্মের উপাসনা সংগীত হিসেবে ব্রহ্মসংগীতের যে ধারা প্রবর্তন করেন, সে ধারায়ই দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর পুত্রদের, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব। ১৮৮০ সালে রবীন্দ্রনাথ প্রথম ব্রহ্মসংগীত রচনা করেন। গানটি হচ্ছে- 'তুমি কি গো পিতা আমাদের'। রবীন্দ্রনাথের সংগীত রচনার যে তিনটি পর্যায়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তার শেষ পর্যায়ের ব্রহ্মসংগীতসমূহে পরিণত রাবীন্দ্রিক সংগীত রচনার বৈশিষ্ট্য উপলব্ধি করা যায়। ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্পা প্রভৃতি অঙ্গে যেমন ব্ৰহ্মসংগীত পাওয়া যায়, লোকসংগীতের সুরেও তেমনি এই শ্রেণির গান রচিত হয়েছে।
ভাঙাগান
"ভাঙাগান' বলতে সেইসব গানকে বোঝায় যেগুলো রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন হিন্দুস্তানি সংগীতের বিভিন্ন পদ্ধতির গান, ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের গান ও পাশ্চাত্যের কতিপয় গানের দৃষ্টান্ত অবলম্বনে। এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ মুখ্যত সেইসব গানের সুর অবলম্বনে গান রচনা করেছিলেন। দু' একটি গানেমূল গানের বাণী প্রতিধ্বনি ঘটতেও দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথের ভাঙাগান রচনার বিপুল উৎস ছিল হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয়সংগীত। ঠাকুরবাড়িতে ভাঙা রচনার একটি ঐতিহ্য ছিল। রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতারাও কম বেশি এই ধরনের গান রচনা করেছেন। তাঁদের গৃহে অধিষ্ঠিত হিন্দুস্তানি সংগীতশুণিদের সঞ্চয় থেকেই মূলগান সংগ্রহ করে রাখতেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেও গান সংগ্রহ করেছিলেন, জ্যেষ্ঠভ্রাতাদের সংগ্রহও তাঁর কাজে লেগেছিল।
ভাঙাগান রচনার মাধ্যমে তিনি হিন্দুস্তানি রাগসংগীতের বিভিন্ন পদ্ধতি সম্পর্কে এবং হিন্দুস্তানি সংগীত ঐতিহ্য প্রচলিত শ্রেষ্ঠ গানগুলো সম্পর্কে নিবিড় পরিচয় লাভে সমর্থ হন এবং রবীন্দ্রনাথকে সুরচয়িতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যথেষ্ট সাহায্য করে। তবে একটি মূলগান ভেঙে গান রচনা করলেও এর ভেতর দিয়েই কবি তাঁর নিজ সাংগীতিক দৃষ্টিভঙ্গিটি প্রকাশ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। হিন্দুস্তানি গান মূলত সুরধর্মী, বাংলাগান কাব্যধর্মী। সুর ও তাল লয়ের কলাকৌশল প্রকাশ হিন্দুস্তানি গানের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। কিন্তু বাণীবাহিত ভাবের বিকাশই বাংলাগানের প্রধান বিষয়। বাংলাগানের এই মূল বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ সংগীত রচনার প্রারম্ভকাল থেকেই অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। তাঁর সমগ্র জীবনের সুর যোজনায় যে আদর্শ, সেই আদর্শেই তিনি হিন্দুস্তানি গানের সুরকে কাব্যভাবে উদ্বুদ্ধ করে তুলেছিলেন। ভাঙাগানের ব্যাপারটি রবীন্দ্রনাথের সংগীত রচনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এর মাধ্যমে একদিকে যেমন তিনি হিন্দুস্তানি রাগসংগীতে ব্যাপক অধিকার অর্জন করেছিলেন, অপরদিকে হিন্দুস্তানি সংগীতকলাকে সার্থকভাবে বাংলাগানে ব্যবহার করার শক্তিও তিনি আয়ত্ত করেছিলেন। ব্রহ্মসংগীত পর্যায়েই রবীন্দ্রনাথ সর্বাধিক ভাঙাগান রচনা করেন। ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্পা, ঠুমরি, সেতারের গৎ, বাংলা লোকসংগীত, ভারতের নানা প্রদেশের কিছু গান ও কতিপয় পাশ্চাত্যসংগীত ভেঙে রবীন্দ্রনাথ বহু সংখ্যক গান রচনা করেছিলেন। ধ্রুপদ ও খেয়াল ঢঙ্গেই রবীন্দ্রনাথ সর্বাধিক ভাঙা গান রচনা করেন।
নতুন তালের গান
রবীন্দ্রনাথ ৬টি নতুন ভাল প্রবর্তন করেছিলেন। এগুলো হচ্ছে- ঝম্পক, ষষ্ঠী, রূপকড়া, নবতাল, একাদশী ও নবপঞ্চ। এসব তালে রবীন্দ্রনাথ যে সমস্ত গান রচনা করেন সেগুলোই নতুন তালের পান হিসেবে পরিচিত। দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত তালসমূহে তালি ও খালি বা তাল ফাঁক প্রথার প্রচলন আছে। রাবীন্দ্রিক তালের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, এখানে কোনো খালি বা ফাঁক রাখা হয়নি। নিয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রবর্তিত রচিত তালের বিবরণ এবং সেইসব তালে রচিত কয়েকটি করে গানের উদাহরণ দেওয়া হলো:
৫ মাত্রায় গঠিত মাত্রাবিভাগ ৩/২
মধ্য ও দ্রুতপয় সম্পন্ন ভাল ঠেকা ভবলা
ঠেকা পাখোয়াজ
२ I ধা দেন তা। তেটে ঘেনে
গান
যে ধ্রুবপদ দিয়েছ বাঁধি যেতে যেতে একলা পথে এই লভিনু সঙ্গ ত
৬ মাত্রায় গঠিত মাত্রা বিভাগ ২/৪
সাধারণত দ্রুতলয় সম্পন্ন তাল, মধ্য ও বিলম্বিত লয়েও ব্যবহার আছে। ঠেকাः তবলা, মধ্য ও বিলম্বিত লয়ে 1 া ডেটে ধাপে তেটে দিন না I ধা
দ্রুতলয়ে
[I] [ধা গে। যা গে ধিনা I ধা
জ্বলেনি আলো অন্ধকারে নিদ্রাহারা রাতের এ গান
এবার এল সময় রে তোর
রূপকড়া
৮ মাত্রায় গঠিত মাত্রা বিভাগ: ৩/২/৩
মধ্যলয় সম্পন্ন তা
ঠেকা ভবলা
ধিন ধিন ধাগে। তিন ভাগে। ধিন ধিন ভেটেধিন ঠেকা পাখোয়াজ
ধা দেন তা। তেটে কতা। যেনে ডেটে যেনে । খা
কত অজানারে জানাইলে তুমি
জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে
কেন সারাদিন ধীরে ধীরে
শরত আলোর কমল বনে
নবতাল
৯ মাত্রার গঠিত মাত্রা বিভাগ: ৩/২/২/২
ঠেকা ভবলা
I ধিন ধিন না । ধিন না । ধিন না। নাগে তেটে । ধিন সংগীতের ইতিহাস
ঠেকা পাখওয়াজ
8
I ধা দেন তা। তেটে কতা। গদি যেনে ধাগে ডেটে
নিবিড় ঘন আঁধারে
প্রেমে প্রাণে গানে গন্ধে
যে কাঁপনে হিয়া কাঁদিছে (৬। ৩)
ব্যাকুল বকুলের ফুলে (৩৬)
একাদশী
১১ মাত্রায় গঠিত
মধ্যলয় সম্পন্ন তা
মাত্রা বিভাগ: ৩/২/২/৪
ঠেকা ভবলা
8 ॥ ধিন ধিন না । ধিন না । ধিন না। ধিন ধিন লাগে তেটে 1 দিন
ঠেকা পাখওয়াজ
8 ধা দেন তা তেটে কতা। গদি যেনে ধাগে তেটে ভাগে ডেটে 1 ধা
দুয়ারে দাও মোরে রাখিয়া
কাঁপিছে দেহ লতা থর থর (৩/৪/৪)
নবপঞ্চ
১৮ মাত্রায় গঠিত
প্রায় বিলম্বিত মধ্যলয় সম্পন্ন তাল মাত্রা বিভাগ: ২/৪/৪/৪/8
ঠেকা তালা
8 1 খা তেরে কেটে। ধিন ধা ধাগে ধিন ধিন ধা তা তেটে। তিন তা কত ভাগে। ডেটে ধিন ধিন ধা |
ঠেকা পাখওয়াজ 8 I ধা গে। যা গে দেন তা। কৎভাগে দেন তা। তেটে ধা দেন তা। তেটে কতা গদি যেনে I বা
জননী তোমার করুণ চরণ খানি
রবীন্দ্রনাথ কয়েকটি বৈদিক মন্ত্রে ও বৌদ্ধ মন্ত্রে সুরারোপ করেছিলেন। এগুলো মন্ত্রগান হিসেবে অভিহিত হয়।
ভানুসিংহের পদাবলি
গীতবিতানে ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলি নামে একটি পাত বিভাগ রাখা হয়েছে। মোট ২০ টি গান এই বিভাগের অন্তর্গত। ভানু, ভানুসিংহ প্রভৃতি ছদ্মনামে রবীন্দ্রনাথ এই সব গানে ভণিতা করেছেন। বৈষ্ণব পদাবলির অনুসরণে ব্রজবুলি ভাষায় ভানুসিংহের পদাবলি রচিত। এগুলো রবীন্দ্রনাথের প্রথম দিককার রচনা। ১৮৭৭ থেকে ১৮৮৪ সালের মধ্যে এই পর্যায়ের অধিকাংশ পদ রচিত। সংখ্যায় কম হলেও সাংগীতিক মাধুর্যে ও বৈশিষ্ট্যে ভানুসিংহের পদাবলি রবীন্দ্ররচনায় বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে।
দেশাত্মবোধক গান
এক গভীর স্বাদেশিক আবহে রবীন্দ্রনাথের সৃজনশীল প্রতিভার উন্মেষ ঘটেছিল। কিশোর বয়সেই রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হিন্দুমেলা, 'সঞ্জীবনী সভা' নামে দুটি স্বদেশি আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। 'তোমারি তরে মা সঁপিনু দেহ' এবং 'এক সূত্রে বাঁধায়াছি সহস্রটি মন' দেশাত্মবোধক গান দুটি রবীন্দ্রনাথের প্রাথমিক রচনা হিসেবে উল্লিখিত হয়।
১৮৭৮ সালে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত 'জাতীয় সংগীত' নামক দেশাত্মবোধক গীতসংকলনে রবীন্দ্রনাথের চারটি গান স্থান পায়। গান চারটি হচ্ছে- 'ঢাকোরে মুখ চন্দ্রমা জলদে, তোমারি তরে যা সঁপিনু এ 'দেহ', 'অয়ি বিঘাদিণী বীণা আয় সখী' এবং 'ভারত রে তোর কলঙ্কিত পরমানুরাশি। দেশাত্মবোধের যে আবহে রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার স্ফুরণ ঘটেছিল তা পরবর্তী জীবনেও তাঁর চেতনায় অটুট ছিল। ১৮৮৬ সালে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের দ্বিতীয় কোলকাতা অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথের 'মিলেছি আজ মায়ের ডাকে' গানটি পরিবেশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ নিজেই গানটি গেয়েছিলেন। রামপ্রসাদী সুরে রচিত গানটি রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত মিলন गान। এতে ভারতবর্ষের সকল সম্প্রদায়ের মানুষের ঐক্য ও মিলন কামনা করা হয়েছে। এ বছরই কবি 'আগে চল আগে চল ভাই' এবং 'তবু পারিনে সঁপিতে প্রাণ' গান দুটিও রচনা করেন। ১৮৯৬ সালে কংগ্রেসের কোলকাতা অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নবরচিত 'অয়ি ভুবনমনোমোহিনী মা' গানটি গেয়ে শুনিয়েছিলেন। ১৮৯৭ সালে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন 'কে এসে যায় ফিরে ফিরে আকুল নয়ন নীরে' গানটি।
তবে রবীন্দ্রনাথের দেশাত্মবোধক গান রচনার সর্বশ্রেষ্ঠ পর্যায়টি রচিত হয় বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে (১৯০৫-১৯১১) কেন্দ্র করে। একক ঘটনা হিসেবে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ছিল বাংলা দেশাত্মবোধক গান রচনার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ প্রেরণাদায়ক। ১৯০৫ সালে ভারতের গভর্ণর জেনারেল লর্ড কার্জন শাসনকার্যের সুবিধার কথা বলে বঙ্গ বা বাংলাকে ভঙ্গ বা দ্বিখণ্ডিত করার কথা ঘোষণা করেন। এই ঘোষণা প্রকাশের সিদ্ধান্ত প্রকাশিত হওয়া মাত্রই এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই আন্দোলনই বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন নামে খ্যাত। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী এই আন্দোলনের ফলেই ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ঘোষণা প্রত্যাহার করা হয়। এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সারা বাংলায় দেশাত্মবোধক গান রচনার এক অভূতপূর্ব প্রেরণা দেখা দেয়। একে বলা হয়েছে বাংলা দেশাত্মবোধক গান রচনার সুবর্ণ যুগ। এই যুগের নেতৃত্বে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই আন্দোলনের ভাবাদর্শসমূহ তাঁর গানে অসামান্য আবেদন সৃষ্টি করেছিল। এ সময়ই রবীন্দ্রনাথ তাঁর অধিকাংশ উল্লেখযোগ্য দেশাত্মবোধক গান রচনা করেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি অনেকগুলো গান রচনা করেছিলেন তাঁর সে সময়কার বিখ্যাত গানগুলো হচ্ছে।
সার্থক জন্ম আমার জন্মেছি এই দেশে আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি আমি ভয় করব না ভয় করব না এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি নিশিদিন ভরসা রাখিস্ ওরে মন হবেই হবে। যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক আমি তোমায় ছাড়ব না মা যে তোরে পাগল বলে তারে তুই বলিস্ নে কিছু
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন উপলক্ষে রচিত হলেও আন্দোলনের সাময়িকতায় গানগুলোর আবেদন নিঃশেষিত হয়নি। দেশপ্রেমের চিরন্তন ভাবটি এসব গানে অত্যন্ত গভীরভাবে প্রকাশিত হয়েছে। ফলে এসব গান বাঙালির চিরকালীন দেশাত্মবোধক গানে পরিণত হয়েছে। পাকিস্তানি অপশাসনের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি সংগ্রাম যে রক্তক্ষয়ী রূপ নিয়েছিল এবং দেশের মুক্তির জন্য যে অগণিত মানুষ আত্মদান করেছিল, রবীন্দ্রনাথের এই সব গান তাতে প্রেরণা যুগিয়েছিল। সবচেয়ে বেশি প্রেরণা যুগিয়েছিল 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি' গানটি। সেজন্যই পাকিস্তানি শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। এই যুগের দেশাত্মবোধক গানে রবীন্দ্রনাথ ব্যাপকভাবে লোকসংগীতের সুর ব্যবহার করেন। এর মধ্যে বাউল সুরের ব্যবহারই বেশি। দু'একটি গানে সারি গানের সুর,
ব্যবহৃত হয়েছে। "আমার সোনার বাংলা' গানটি বাউল সুরে রচিত। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের শেষে রবীন্দ্রনাথ দেশাত্মবোধক গান রচনার ধারা থেকে প্রায় সরে দাঁড়ান। ১৯১১ সালে রচিত 'জনগণ মন অধিনায়ক' ও ১৯১৭ সালে রচিত 'দেশ দেশ নন্দিত করি' গান দুটি ছাড়া রবীন্দ্রনাথ স্বদেশ চেতনার আর কোনো গান রচনা করেননি বললেই চলে। ১৯২৯-৩০ সালের পর রবীন্দ্রনাথ সঙ্কোচের বিহ্বলতা' 'সর্ব খর্বতারে দহে', 'শুভ কর্মপথে ধর নির্ভর গান', 'চলো যাই চলে যাই', 'খর বায়ু বয় বেগে, প্রভৃতি গান রচনা করেন। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের এই জাতীয় উদ্দীপনার গান হিসেবে পাওয়া হলেও এই গানগুলি দেশাত্মবোধক গান, স্বদেশ ভাবনার গান হিসেবে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেননি। এসব গান বিশেষ বিশেষ উপলক্ষে রচিত।
উদ্দীপকগান
রবীন্দ্রনাথের কিছু গান উদ্দীপকগান হিসেবে অভিহিত। এসব গানের মূলভাব উদ্দীপনা। উদ্দীপনামূলক গানে বীর রসেরই এক প্রকার অভিব্যক্তি ঘটে। দেশাত্মবোধক গানও উদ্দীপনারই গান। 'উদ্দীপক গানা শ্রেণিটিকে চিহ্নিত করেছেন শুভ গুহঠাকুরতা তার 'রবীন্দ্রসংগীতের ধারা' গ্রন্থে। যৌবনের জয়গান করে যেসব গান রচনা
করেছেন রবীন্দ্রনাথ সেগুলো উদ্দীপক গানের পর্যায়ে পড়ে। যেমন:
আমরা নূতন যৌবনেরই দূত সব কাজে হাত লাগাই মোৱা
এক সূত্রে বাঁধিয়াছি
এবার তো যৌবনের কাছে আমরা লক্ষ্মীছাড়ার দল
আমরা নূতন প্রাণের চর
আমাদের ভয় কাহারে
মৃত্যু সম্পর্কে রচিত রবীন্দ্রনাথের কিছু গানকেও উদ্দীপকগান হিসেবে বিবেচনা করা যায়। কেননা, এসব গানের মূলভাগ শোক নয়, শোককে জয় করার শক্তি লাভ। দুঃখ জয়ী এসব রচনা। যেমন:
বজ্রে তোমার বাজে বাঁশি
দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে তব মঙ্গল-আলোক
দুঃখ যদি না পাবে তো
মোর মরণে তোমার হবে জয়।
রবীন্দ্রনাথ অন্যায়ের প্রতিবাদে শক্তি সঞ্চয়ের চেতনার রচনা করেছেন কিছু উদ্দীপকগান। যেমন: সর্ব খর্বতারে নহে তব ক্রোধদাহ।
প্রচণ্ড গর্জনে আনিল একি দুর্দিন
জাগো হে রুদ্র জাগো
হিংসায় উন্নত পৃথ্বি
তিমিরময় নিবিড় নিশা কাপুরুষতাকে আঘাত করে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছেন উদ্দীপক গান। যেমন:
ওরে ভীরু তোমার হাতে নাই ভুবনের ভার
কোন ভীরুকে ভয় দেখাবি ভয়েরে মোর আঘাত করো
বিপদের সম্মুখীন হয়ে কবি প্রার্থনা করছেন বিপদায়ী উদ্দীপনা- বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা
শিশুসংগীত
রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং শিশুসংগীত বলে তাঁর কোনো গীতগুচ্ছকে নির্দিষ্ট করেননি। শিশুসংগীত বলতে যে ধরনের রচনাকে বোঝায় তেমন গান রবীন্দ্র রচনায় বেশি নয়। তবে কিছু রবীন্দ্রসংগীত রয়েছে যেগুলো শিশুদের গাওয়ার উপযোগী। রবীন্দ্রনাথের শিশুতোষ গদ্য ও পদ্য রচনা যথেষ্ট। সে তুলনায় গান কম। বিভিন্ন নাটকে ঠাকুরদা চরিত্রটি তিনি যেভাবে ব্যবহার করেছেন, তাতে শিশুমন সম্পর্কে তাঁর অপার কৌতূহল ও সহানুভূতির পরিচয় পাওয়া যায়। শুভ গুহঠাকুরতার 'রবীন্দ্রসংগীতের ধারা' গ্রন্থে তেমন কিছু গানের তালিকা দিয়েছেন। সেখান থেকে কয়েকটি জনপ্রিয় শিশুসংগীতের উল্লেখ করা হলো: আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায়
মেঘের কোলে রোদ হেসেছে
ফাগুনের নবীন আনন্দে
হাস্যগীতি
বাংলা হাসির গানের একটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্য আছে। হাস্যরস অবলম্বনে পূর্বে প্রচুর বাংলাগান রচনা করা হয়েছে। হাসির গানের ব্যবহার নাটকেই হয়েছে বেশি। মঞ্চে পরিবেশকে একটু উপভোগ্য করে তোলার জন্য হাসির গান গাইবার একটা রীতি ছিল। আলাদাভাবেও এ শ্রেণির গান রচিত হতো এবং কিছু গীতরচয়িতা, সুরকার ও গায়ক এ ব্যাপারে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। বাঙ্গ ও রঙ্গ উভয়ই হাসির গানের বিষয়। বাংলা হাসির গানের বিকাশে দুটি অনুভবই গুরুত্বপূর্ণভাবে রূপায়িত হয়। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩) বাংলা হাসির গানের সর্বশ্রেষ্ঠ রচয়িতা হিসেবে বিবেচিত হন। রবীন্দ্রনাথ হাস্যগীতি রচনায় গভীরভাবে মনোনিবেশ করেননি। তবুও তাঁর রচিত এই ধরনের পান সংখ্যায় ৮০ থেকে ৯০ এর মধ্যে দাঁড়ায়। রবীন্দ্রনাথের হাসির গান মুখ্যত বিভিন্ন নাটকের অন্তর্গত। স্বতন্ত্রভাবে রচিত গান সংখ্যায় খুবই অল্প। ১৯৩৫ সালে হৈ হৈ সঙ্ঘ'-এর জন্য রচিত চারটি হাসির গান পাওয়া যায়। শান্তিনিকেতনে 'চা-চক্র'-এর জন্য রচিত গানটিও হাস্যগীতি পর্যায়ের। নিম্নে রবীন্দ্ররচিত কয়েকটি হাস্যগীতির উল্লেখ করা হলো। 'হৈ হৈ সঙ্ঘ'-এর জন্য গান চারটি হচ্ছে।
কাঁটা বন বিহারিণী সুরকানা দেবী
পায়ে পড়ি শোন ভাই গাইয়ে না গান গাওয়ার দলরে মোরা ও ভাই কানাই কারে জানাই
শান্তিনিকেতনের চা-চক্রের জন্য রচিত গানটি হচ্ছে:
হায় হায় হায়, দিন চলি যায়
বিভিন্ন নাটকে হাসির গান আছে। যেমন 'তাসের দেশ' নাটকে।
জয় জয় তাসবংশ
তোলন নামন পিছন সামন আমরা চিত্র অতি বিচিত্র
চিড়েতন হৰ্ত্তন ইস্কাবন
'ফাল্গুনী' নাটকের গান, যেমন:
আমাদের পাকবেনা চুল গো
আমাদের ভয় কাহারে
এর ভাব দেখে যে পায় হাসি
ভালো মানুষ নইরে মোরা
আনুষ্ঠানিক সংগীত
নানা ধরনের অনুষ্ঠানের উপযোগী কিছু গান রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছেন। এগুলো আনুষ্ঠানিক সংগীত নামে আখ্যায়িত হয়েছে। বাংলা নাগরিক সংগীতের ধারায় এইসব গান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক জীবনের উপযোগী বহু গান রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছেন। আশ্রমিক প্রয়োজনের বাইরে সাধারণ অনুষ্ঠানাদির জন্যও কবি অনেক গান রচনা করেছেন। এই সব গান পরে বিভিন্ন অনুষ্ঠান উদ্যাপনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে। জন্ম, বিবাহ, মৃত্যু, বর্ষশেষ, নববর্ষ, বৃক্ষরোপণ, হলকর্ষণ, গৃহপ্রবেশ, শিল্পোৎসব, বিদায়জ্ঞাপন প্রভৃতি অনুষ্ঠানের জন্য রবীন্দ্রনাথ গান রচনা করেছেন। এছাড়াও আছে দোলযাত্রার দিনে শান্তিনিকেতনে বসন্তোৎসবে নৃত্যগীত সহযোগে শোভাযাত্রার জন্য রচিত গান- 'ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল লাগল যে দোল' গানটি, আছে শরৎ ঋতু আবাহনের জন্য পহেলা আশ্বিনে গেয় আমার নয়ন ভুলানো এলো, বসন্ত ঋতুর বন্দনার জন্য আছে পহেলা ফাল্গুনে গেয়- 'আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে' বা 'আজ দখিন দুয়ার খোলা' ইত্যাদি। নিহে কতিপয় আনুষ্ঠানিক পর্যায়ের রবীন্দ্রসংগীতের উল্লেখ করা হলো:
বিবাহ অনুষ্ঠানের গান
দুই হৃদয়ের নদী
প্রেমের মিলন দিনে সুমঙ্গলী বধূ
দুইটি হৃদয়ে একটি আসন
মৃত্যুদিনের গান
আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে সমুখে শান্তি পারাবার
এই মরণের সাগর পারে
নববর্ষের গান
এসো হে বৈশাখ
ওরে নতুন যুগের ভোরে জয় হোক জয় হোক নব অরুণোদয়
গৃহপ্রবেশের গান
এসো হে গৃহদেবতা হৃদি মন্দির ঘারে বাজে
বৃক্ষরোপণের গান
আয় আমাদের অঙ্গনে
মরু বিজয়ের কেতন উড়াও
হলকর্ষণের গান
আমরা চাষ করি আনন্দে
ফিরে চল মাটির টানে
শিল্পোৎসবের গান
নমো যন্ত্র নমো যন্ত্ৰ
কঠিন লোহা কঠিন ঘুে
রবীন্দ্রনাথ একবার বলেছিলেন, “জীবনের আশি বছর অবধি চাষ করছি অনেক। সব ফসলই যে সরাইতে জমা হবে তা বলতে পারিনে। কিছু ইঁদুরে যাবে, তবুও বাকী থাকবে কিছু। যুগ বদলায়, কাল বদলায়, তার সঙ্গে সবকিছুইতো বদলায়। তবে সবচেয়ে স্থায়ী আমার গান এটা জোর করে বলতে পারি। বিশেষ করে বাঙালিরা, শোকে দুঃখে সুখে আনন্দে, আমার গান না গেয়ে তাদের উপায় নেই। যুগে যুগে এ গান তাদের গাইতেই হবে।” নানা অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়ার ব্যাপারটি বিশেষভাবে লক্ষ করবার মতো।
প্রকৃতির গান
বাংলা নাগরিক সংগীতের ভাণ্ডারে এক অমূল্য সম্পদ হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতির গান। এই শ্রেণির গানকে ঋতুসংগীতও বলা হয়। ষড়ঋতুতে বাংলাদেশের প্রকৃতির যে লীলাবৈচিত্র্য, তা রবীন্দ্রনাথের ঋতুসংগীতে যেমনটি রূপায়িত হয়েছে তেমন আর কারও রচনায় পাওয়া যায় না। এ শুধু আকাশে বাতাসে তরুলতায় ঋতুক্রমে যে দৃষ্টিগ্রাহ্য পরিবর্তন আসে তার রূপায়ণমাত্র নয়, মানুষের হৃদয়ভাবেও যে পরিবর্তন আসে তাকেও এই শ্রেণির গানে সম্যক উপলব্ধি করা যায়। প্রকৃতির সঙ্গে সংগীতের সম্পর্ক অতি গভীর। সকল শ্রেণির গানেই প্রাকৃতিক পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট মানব হৃদয়ের প্রতিক্রিয়া স্থান পায়। রাগসংগীত পরিকল্পনায়ও প্রকৃতির গভীর প্রভাব রয়েছে।
প্রাচীনকালে মানুষের জীবন ছিল প্রকৃতির কোলে লালিত। তখনকার দিনে প্রকৃতির স্পন্দন মানুষের গানে স্বতই ধ্বনিত হয়ে উঠত। প্রকৃতির লীলাবৈচিত্র্যাকে নিয়ে উৎসবের আয়োজন ছিল মানুষের জীবনের অন্তরঙ্গ অঙ্গ। নাগরিক সভ্যতার গোড়াপত্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে ব্যবধান গড়ে উঠতে থাকে। রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের লুপ্তপ্রায় সম্পর্কের সূত্রটি পুনরুদ্ধার করে তাকে পূর্ণ গৌরবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তাঁর গানে। ঋতু উৎসবের প্রবর্তন করে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের রূদ্ধপ্রায় জানালাগুলোকে খুলে দিয়েছেন।
নগরবাসী কবির সঙ্গে বাংলার প্রকৃতির নিবিড় যোগাযোগ ঘটল ১৮৯১ সালে, ৩০ বছর বয়সে যখন তিনি কুষ্টিয়ায় এলেন জমিদারি তদারকি করতে। কুষ্টিয়া-পাবনা অঞ্চলের প্রকৃতির একরূপ, আবার ৪০ বছর বয়সে যখন শান্তিনিকেতন বিদ্যালয় স্থাপন করে সেখানে পেলেন স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য, তখন সেখানে ঘট প্রকৃতির আরেক রূপের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। বাংলার প্রকৃতির এই দুই রূপই রবীন্দ্রনাথের চেতনাকে পরিপুষ্ট করে। তাঁর প্রকৃতির গানে এই দুই রূপই প্রকাশ পায়।
মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ককে রবীন্দ্রনাথ নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ
করেছেন এ কথাটির ওপর যে, মানুষের জন্ম কেবল লোকালয়ে নয়, বিশাল বিশ্বে তাঁর জন্ম। মানুষের
চিত্রমহলের দ্বার খুলে বিশ্বপ্রকৃতিকে আহ্বান না করলে বিরাটের সঙ্গে তার মিলন ঘটে না। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের মিলন সাধনের বড়ো উপায় হচ্ছে প্রাকৃতিক উৎসব, প্রকৃতির গান। গানের ভেতর দিয়ে প্রকৃতির বিপুলতাকে, এর সঞ্জীব গভীর অস্তিত্বকে যতটা উপলব্ধি করা যায়, আর কিছুতেই তেমন করা যায় না। রবীন্দ্রনাথের গানের ভেতর দিয়েই বাংলার ষড়ঋতুর বৈচিত্র্যকে আমরা গভীরভাবে অনুভব করি। রবীন্দ্রনাথ প্রবর্তিত বর্ষামঙ্গল, শেষ বর্ষন, শারদোৎসব, বসন্তোৎসব, ঋতুরঙ্গ প্রভৃতি ঋতু উৎসব এবং তাঁর রচিত অজস্র
প্রকৃতির গান আমাদের মধ্যে সেই বোধটিকেই তাঁর করে তোলে যে, মানবপ্রকৃতি ও বিশ্বপ্রকৃতি একটি অখত
সূত্রে গাঁথা। ঋতু উৎসবের সূচনা হয় শান্তিনিকেতনে ১৯০৭ সালে। প্রথম বর্ষা উৎসব ও শারদোৎসব
পরিবেশিত হয় ১৯০৮ সালে। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে প্রথম বর্ষামঙ্গল মঞ্চস্থ হয় ১৯২১ সালে।
বাংলার ঋতুচক্রের সূচনা হয় নববর্ষ থেকে। গ্রীষ্মকাল থেকেই ঋতু পরিক্রমার সূত্রপাত। রবীন্দ্র রচিত গ্রীষ্ম ঋতুর গান পাওয়া যায় ১৬টি। তাপদগ্ধ প্রকৃতির রূপ ফুটে উঠেছে এই সব গানে। এই ঋতুকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন 'মৌনী তাপস, রুদ্র ভৈরব। গ্রীষ্ম ঋতু সম্পর্কে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য রবীন্দ্রসংগীত হচ্ছে— দারুণ অগ্নিবাণে রে
নাহি রস নাহি
বৈশাখী হে মৌনী তাপস
বর্ষা ঋতুর ওপর রচিত রবীন্দ্রনাথের গান ১১৫টি। এছাড়াও বর্ষার অনুষঙ্গে অন্যান্য পর্যায়ে রচিত অনেক গান রয়েছে। গ্রীষ্মের দাহে তপ্ত পৃথিবীতে নেমে এলো স্নিগ্ধ, তৃষাহরা, শ্যামলসুন্দর মেঘ। বর্ষা রবীন্দ্রনাথের অতিপ্রিয় ঋতু বাঙালি কবি মাত্রেরই প্রিয় ঋতু বর্ষা। নিজের বর্ষার গান সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- "আমি যখন বর্ষার গান গেয়েছি তখন সেই মেঘমল্লার জগতের সমস্ত বর্ষার অশ্রুপাতধ্বনি নবতর ভাষা এবং অপূর্ব বেদনায় পূর্ণ হয়ে উঠেছে।"
রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বর্ষার গান হচ্ছে:
এসো শ্যামল সুন্দর
মেঘের পরে মেঘ জমেছে
বজ্রমানিক দিয়ে গাঁথা আষাড় তোমার মালা
ঝরঝর বরিষে বারিধারা উত্তন ধারা বাদল করে মন মোর মেঘের সঙ্গী
হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে তৃষ্ণার শান্তি সুন্দর কান্তি
বর্ষা ঋতুকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন সংসারী, গৃহী। আর শরৎ ঋতুকে তিনি বলেছেন অনাসক, নিঃসম্ব সন্ন্যাসী। নীল আকাশে হাল্কা সাদা মেঘ, তার প্রয়োজন নেই, তার জলভার নেই। কাশের স্তবক না বাগানের না বনের, সে হেলাফেলায় মাঠেঘাটে নিজের ঐশ্বর্য্য বিস্তার করে বেড়ায়। রবীন্দ্রনাথ শরৎকে বলেছেন ছুটির খাতু। এই ঋতু নিয়ে রবীন্দ্রনাথ গান লিখেছেন ৩০টি। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য শরৎ বিষয়ক রবীন্দ্রসংগীত হচ্ছে:
মেঘের কোলে রোদ হেসেছে আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায়
আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ
এরপর হেমন্ত। এ ঋতু নিয়ে রবীন্দ্রনাথ মাত্র ৫টি গান রচনা করেছেন। হেমন্ত সম্পর্কে তিনি তেমন
উৎসাহী নন। হেমন্ত রিক্ত, শস্যহীন দিগন্ত তাকে অনুপ্রাণিত করেনি। হেমন্ত বিষয়ে উল্লেখযোগ্য রবীন্দ্রসংগীত হচ্ছে:
হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে
হায় হেমন্ত লক্ষ্মী তোমার নয়ন কেন ঢাকা। হেমন্তে কোন বসন্তেরই বাণী
এবার ঋতুচক্রে শীতের পালা। শীত আসে জীর্ণ সাজে। একে রবীন্দ্রনাথ শুদ্ধাসন সন্ন্যাসীর সঙ্গে তুলনা করেছেন। শীত নিয়ে রবীন্দ্রসংগীত ১২টি। এখানে শুধুই পত্রহীন, পুষ্পহীন, কাঙাল প্রকৃতির বর্ণনা। কয়েকটি
উল্লেখযোগ্য শীত বিষয়ক রবীন্দ্রসংগীত হচ্ছে:
শীতের হাওয়ার লাগল নাচন
এল যে শীতের বেলা পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে
প্রকৃতির রঙ্গমঞ্চের পরে আবির্ভূত হয় রঙ্গশালার নায়ক ঋতুরাজ বসন্ত। শীতের জীর্ণতাকে, শূন্যতাকে লয় করে দিয়ে পত্রে, পুষ্পে, গছে প্রকৃতির ভাণ্ডার পূর্ণ করে দিয়ে আসে তারুণ্য ও যৌবনের প্রতীক বসন্ত ঋতু। বসন্ত রবীন্দ্রনাথের প্রিয় তু। এই ঋতু নিয়ে রচিত তাঁর গানের সংখ্যা ৯৩। তাপদগ্ধ গ্রীষ্মের গান দিয়ে ঋতু সংগীত শুরু হয়েছিল, নবযৌবনের ঋতু বসন্তের গান দিয়ে তার সমাপন ঘটল। বসন্ত বিষয়ে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য রবীন্দ্রসংগীত হচ্ছে:
আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল
একটুকু ছোঁয়া লাগে।
আজি দখিন দুয়ার খোলা ওগো দখিন হাওয়া ও পথিক হাওয়া মোর বীণা ওঠে কোন সুরে বাজি
ঋতু সংগীত প্রধানত পরিণত বয়সের রচনা- ফলে এইসব গানে পরিণত রবীন্দ্রসংগীতের বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত
হয়েছে।
প্রেম
রবীন্দ্রনাথের প্রেম পর্যায়ের গীতসংখ্যা প্রায় ৪০০-এর কাছাকাছি। প্রেম পর্যায়ের গীত রচনার ধারাটি রবীন্দ্রনাথের সংগীত রচনার প্রথম যুগ থেকে শেষ অবধি বিস্তৃত।
নরনারীর অন্তরঙ্গ সম্পর্কের গানকেই প্রেম পর্যায়ের গান বলা হয়। রবীন্দ্রনাথ প্রধানত এই সম্পর্কের মাধুর্যময় এবং বেদনাকাতর এই দুটি দিক নিয়েই গান রচনা করেছেন। কখনো কখনো তার অনুভূতির প্রকাশ এমন সূক্ষ্ম হয়ে ওঠেছে যে, সেখানে ব্যক্তির অনুভূতির চেয়ে সর্বজনের ভাবের বিষয়টি প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক স্থানে এমনও হয়েছে যে, পূজার গানে প্রেমের গানে পার্থক্য করা যায় না। প্রিয়জনকে নেওয়ার তাই তিনি দিচ্ছেন দেবতাকে এবং দেবতাকে যা দেওয়ার তাই যেন নিচ্ছেন প্রিয়জনকে। সুরে ও বাণীতে অসামান্য বৈচিত্র্য রবীন্দ্রনাথের প্রেমসংগীতে। ঊনবিংশ শতাব্দীর সূচনায় রামনিধি গুপ্ত এই পর্যায়ের গীতিরচনার সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন। ধারাবাহিকভাবে এসে রবীন্দ্রনাথে এই শ্রেণির গানের সর্বোৎকৃষ্ট রূপটি প্রতিফলিত হয়। নিজে প্রেম পর্যায়ের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য রবীন্দ্রসংগীতের দৃষ্টান্ত দেওয়া হলো।
মনে রবে কি না রবে আমারে
আমার কণ্ঠ হতে গান কে নিল
গানের ভেলায় বেলা অবেলায়
তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা আমার জীবনপাত্র উচ্ছলিয়া মাধুরি করেছ দান গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্য গীতিনাট্য রচনার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের অবদান অসামান্য। সংগীত রচয়িতা হিসেবে জীবন শুরু করার ঊষাকালেই রবীন্দ্রনাথ তিনটি গীতিনাট্য রচনা করেন। গীতিনাট্যসমূহ হচ্ছে বাল্মীকি প্রতিভা (১৮৮১), কালমৃগয়া (১৮৮২) ও মায়ার খেলা (১৮৮৮)। কবি তাঁর শেষ জীবনে রচনা করেন তিনটি নৃত্যনাট্য- 'চিত্রাঙ্গদা', 'চণ্ডালিকা' ও 'শ্যামা'। তিনটি নৃত্যনাট্যই কবির প্রথম জীবনে রচিত কাব্যনাট্যের পরিবর্তিত রূপ। চিত্রাঙ্গদা পৌরাণিক উপাখ্যান মহাভারতের গল্প অবলম্বনে রচিত। চণ্ডালিকা ও শ্যামা নৃত্যনাট্যের মূল কাহিনি নেয়া হয়েছে বৌদ্ধ উপাখ্যানধর্মী গ্রন্থ 'মহাবন্ধু অবদান থেকে।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর নৃত্যনাট্যের উপযোগী একটি নৃত্যধারা প্রবর্তন করেছিলেন, এই ধারাটি রবীন্দ্রনৃত্য নামে অভিহিত হয়। ভারতের প্রধান শাস্ত্রীয় নৃত্যধারা ভরতনাট্যম, কথাকলি, ও মণিপুরী এই তিনটি ধারা থেকেই উপাদান নিয়েছেন তিনি। মণিপুরী নৃত্য সম্পর্কে কবির বিশেষ আগ্রহ ছিল। রবীন্দ্রসংগীতকলার মতো রবীন্দ্রনৃত্যকলাও কবির অসাধারণ সৃষ্টিশীলতার পরিচয় বহন করে।
সংগীতচিন্তা
রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে একটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ব্যাপার যে, তিনি বাংলাগানকেই শুধু একটি বিশিষ্ট স্তরে উন্নীত করেননি, বাংলায় সংগীতালোচনাকেও তিনি একটি বিশিষ্ট পর্যায়ে তুলে এনেছিলেন। বলতে গেলে, বাংলায় রসগ্রাহী সংগীতালোচনার সূত্রপাত তাঁর হাতেই। রবীন্দ্রনাথ বিশেষ করে বলেছেন বাংলা গানের সুর ও বাণীর সমন্বয়ের কথা এবং সর্বোপরি তাঁর নিজের সংগীত ভাবনার বৈশিষ্ট্যের কথা। রবীন্দ্রনাথ নিজেই তাঁর সংগীত কর্মের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাকার। প্রবন্ধ অভিভাষণ, পত্রাবলি ও সাক্ষাত আলাপ আলোচনা, সমালোচনা প্রভৃতি মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের সংগীতচিন্তা প্রকাশিত। অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক হয়ে দাঁড়িয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ও দিলীপকুমার রায় এবং রবীন্দ্রনাথ ও ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মধ্যকার আলাপ আলোচনা। একেবারে তরুণ বয়স থেকেই রবীন্দ্রনাথ সংগীতালোচনায় হাত দেন। সংগীত বিষয়ে তাঁর প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ১৮৮১ সালে। সংগীত বিষয়ে তিনি সর্বশেষ অভিভাষণ দেন ৩০ জুন, ১৯৪০। এই সুদীর্ঘকাল সংগীত সম্পর্কে, বিশেষত বাংলাগান ও নিজের সংগীত রচনা সম্পর্কে লিখতে বা বলতে রবীন্দ্রনাথ সর্বদাই উৎসাহ বোধ করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ যে বিষয়টির প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছেন তা হচ্ছে হিন্দুস্তানি গান ও বাংলাগানের বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য। হিন্দুস্তানি গান ও বাংলাগানের রীতিপ্রকৃতি এক নয়। হিন্দুস্তানি গান সুরপ্রধান, বাণীর মর্যাদা যেখানে কম আর বাংলাগান বাণীপ্রধান। সুর বাণীর ব্যঞ্জনাকে তীব্র করে তুলতে সাহায্য করে। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই জীবনের শুরু থেকেই রবীন্দ্রনাথ সংগীতরচনা করতে শুরু করেছিলেন। তিনি ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্পা প্রভৃতি হিন্দুস্তানি সংগীতে গান রচনা করেছেন। কিন্তু হিন্দুস্তানি সংগীতের অলংকার বাহুলাকে তিনি গ্রহণ করেননি। বাণীর ভাব প্রকাশ করার জন্য সুরের যেটুকু প্রয়োগ প্রয়োজন, তিনি সেটুকুই করেছেন। এই সংযম ও পরিমিতি বোধ থেকে তিনি কখন বিচ্যুত হননি। তিনি সর্বদাই ভেবেছেন সংগীতে বাহুল্যের চেয়ে সারল্য শ্রেয়, মূল বিষয় হচ্ছে আনন্দ। সরল উপায়ে যদি আনন্দ পাওয়া যায় তাহলে জটিল উপায়ের চেয়ে তা অনেক ভালো। এই তত্ত্বটি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেই বা লিখেই ক্ষান্ত হননি। প্রায় আড়াই হাজার গান রচনা করে একে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথের সংগীত ভাবনায় অপর প্রধান দিক হচ্ছে যে, তিনি তাঁর রচিত সুরকে পরিবর্তন করানো কোনো অধিকার কাউকে দেননি। প্রাচীনকাল থেকেই ভারতবর্ষে গায়ক এই অধিকারটি পেয়ে আসছেন। গাইবার সময় তিনি স্বাধীনভাবে কিছু না কিছু সুরের কাজ করতে পারেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে গায়ককে এই অধিকার দিতে সম্মত হননি। এ নিয়ে তর্ক হয়েছে, কথা উঠেছে যে, তিনি আবহমানকালে রীতির বিরুদ্ধে যাচ্ছেন। তবু সম্মতি মেলেনি তাঁর। তিনি বলেছেন, কবির গীতিরচনা যেমন অপরিবর্তনীয়, তেমনি তাঁর সুররচনাও অপরিবর্তনীয়। এটিই রবীন্দ্রসংগীতের ঐতিহ্য। স্বরলিপি অনুসরণ করে সর্বদাই রবীন্দ্রসংগীতের শুদ্ধতা বজায় রাখতে হয়।
কাজী নজরুল ইসলাম
কাজী নজরুল ইসলাম ১৩০৬ বাংলা সনের ১১মে জ্যেষ্ঠ (১৮৯৯ সালের ২৪ মে) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া থানার অন্তর্গত চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা কাজী ফকির আহমদ, পিতামহ কাজী আমানুল্লাহ। কবির মাতার নাম জাহেদা খাতুন, মাতামহ মুন্সী তোফায়েল আলী। কাজী ফকির আহমদের দুই স্ত্রী, সাত পুত্র ও দুই কন্যা। কবির সহোদর তিন ভাই, এক বোন। কবি তাঁর পিতার দ্বিতীয় পক্ষের দ্বিতীয় সন্তান। জ্যেষ্ঠ সাহেবজানের জন্মের পর চার পুত্রের অকাল মৃত্যু হওয়ার পর জন্ম নেন কাজী নজরুল। ছোটো বেলায় কেউ কেউ তাঁকে তারা খ্যাপা বলে ডাকত, আবার আদর করে ডাকত নজর আলী নামে
কবি পিতৃহীন হন ১৩১৪ সালের (ইংরেজি ১৯০৮ সালে) ৭ চৈত্র। কবি তখন গ্রামের মক্তবের ছাত্র। দারিদ্র্যের
সংসারে দেখা দেয় আর্থিক টানাপোড়েন, লেখাপড়ার ক্ষতি হতে থাকে কবির। ১৩১৬ সালে ১০ বৎসর বয়সে
নজরুল গ্রামের মক্তব থেকে নিম্ন প্রাথমিক পরীক্ষা পাশ করেন। এরপর এক বছর এই মক্তবেই শিক্ষকতা
করেন। সে সময় আশেপাশে গ্রামগুলোতে মোল্লার কাজ করেও রোজগারের চেষ্টা করতেন। মাঝে মাঝে
মসজিদের মুয়াজ্জিন ও ইমাম এর দায়িত্ব পালন করতেন।
আরবি ও ফারসি ভাষায় প্রথম পাঠ ছিল মক্তবের শিক্ষক মৌলভী কাজী ফজলে আহমদের কাছে। তাঁর এক পিতৃব্য কাজী বজলে করীম ফারসি ভাষায় ছিলেন সুপণ্ডিত। এর সাহচর্যে কবির আরবি-ফারসি-উর্দু মিশ্রিত বাংলায় কাব্য রচনার সূত্রপাত হয়। আরবি-ফারসি শিক্ষা, ইমামতি, গোরখেদমতগারী, কুরআন খোৎবা পাঠ, কবির ধর্মীয় জীবনকে অনুপ্রাণিত করেছিল। পরবর্তী জীবনে বাংলা সাহিত্যে ও বাংলাগানে ইসলামী তাহজীব ও তমদ্দুনের যে নতুন ধারার প্রবর্তন তিনি করলেন তার উৎস ছিল কৈশোরের এই দিনগুলো। তাঁর কাব্য ও গীতিতে, বিশেষ করে গাল গানে, আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দের যে সচ্ছন্দ প্রয়োগ, যে অনায়াস স্ফূর্তি, তার বীজও ছিল এই সময়টিতে রোপিত।
কবি বারো বছর বয়সে বাসুদেবের লেটোগানের দলে যোগ দেন। এই দলের সঙ্গে যুক্ত থাকায় তিনি হিন্দু সংস্কৃতি ও পৌরাণিক উপাখ্যানের সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত হন। লেটো দলের জন্য শকুনি বধ, মেঘনাদ বধ, রাজপুত্র, চাষার সৎ, দাতাকর্ণ পালাগান প্রহসনে কবির চিত্তে হিন্দু ও মুসলমান সংস্কৃতির পাশাপাশি অবস্থানের একটি উদার পরিমণ্ডল গড়ে উঠতে দেখা যায়, যার ফসল পাওয়া যায় তাঁর ভবিষ্যত কাব্য জগতে।
লেটো দলে যোগদান কবিচিত্তকে নানা ভাবরসে সিক্ত করেছে। পরবর্তী সময়ে তিনি যে ফরমায়েশ মতো দু'হাতে অজস্র গান লিখেছেন ফুলঝুরির মতো, তারও হাতেখড়ি এই লেটোদলের পরিবেশে। এই সময়ের অপরিণত বয়সের মধ্যেও প্রকাশ পেয়েছে দেহতত্ত্ব ও মুর্শিদ-ভাবের উপস্থিতি। কিন্তু নজরুলের প্রকৃতি ছিল সদ চঞ্চল, কোথাও দুইদত্ত স্থির থাকবেন এমন মানসিকতা তাঁর ছিল না। কৈশোর, যৌবনে কোনো জায়গায় তাঁকে কেউ দীর্ঘদিন অবস্থান করতে দেখেনি। এই অসামান্য প্রতিভার পালন হয়েছে নেহায়েতই কাকতালীয়ভাবে। যথেষ্ট অবকাশ নিয়ে অনুশীলনে, শৃঙ্খলায় তার প্রতিভার লালন হয়নি। লেটো দলে তিনি যোগদান করেন সাধারণভাবে। অথচ নিজ প্রতিভায় হলেন এঁদের ওস্তাদ। আবার আকর্ষণ শেষ হলেই তিনি দলত্যাগ করে চলে গেলেন, হলেন মাথরুন গ্রামের নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউশনের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। সেখানে শিক্ষক হিসেবে পেলেন কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিককে। বয়স তখন এগারো, সালটি ১৯১১। অল্প সময়ের মধ্যেই মাথরুন স্কুলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন হলো, শুধুমাত্র অর্থাভাবে। রাণিগঞ্জে রেলওয়ের এক গার্ড সাহেবের খপ্পরে পড়ে কিছুদিন বাবুর্চীগিরি করলেন। আবার বাসুদেবের শখের কবিগানের আসরে ঢোলক বাজিয়ে গান গাইতে দেখা যায় নজরুলকে। নজরুলের জীবনে ছিল নানান উত্থান পতন, কিন্তু সংগীতচর্চার ধারাবাহিকতায় তার ছেদ পড়েনি কখনো। আসানসোলে একটি চা-রুটির দোকানে কাজ পেলেন, মাইনে মাসিক এক টাকা। কিন্তু থাকার জায়গা নেই। পাশেই একটি তিন তলা বাড়ির নিচের সিঁড়ির ঘরে সারাদিনের পরিশ্রান্ত ক্লান্ত নজরুল-এর থাকার জায়গা হলো। এক পুলিশ ইন্সপেক্টর, নাম কাজী রফিজউল্লাহ, থাকতেন এ বাড়িতে। এখানে কবি থাকেন তিন মাস গৃহভৃত্য হিসেবে মাসিক পাঁচ টাকায়। কাজী রফিজউল্লাহ ও তাঁর স্ত্রী শামছুন্নেসা কবিকে স্নেহ করতেন। তাঁদের বাড়ি ছিল ময়মনসিংহ জেলার কাজীর শিমলা গ্রামে। তাঁদের প্রচেষ্টায় কবি ভর্তি হন সপ্তম শ্রেণিতে, ময়মনসিংহের দরিরামপুর হাই স্কুলে। ১৯১৪ সালে ডিসেম্বরে বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে তিনি কাউকে কিছু না জানিয়ে সে স্থান ত্যাগ করেন। এরপরে তিনি ভর্তি হন রাণিগঞ্জ শিয়ারশোল রাজ হাই স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে। ১৯১৫ থেকে ১৯১৭ এই তিন বছর স্থিত থাকেন এই স্কুলেই, যেখানে তাঁর বন্ধু হয়ে আসেন সাহিত্যিক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়। সাত টাকা মাসিক বৃত্তিও পান কবি। ফারসি ভাষার প্রতি তাঁর আগ্রহ আরও বৃদ্ধি পায় এই স্কুলের ফারসি ভাষার শিক্ষক হাফিজ নুরুন্নবীর সাহচর্যে। স্কুলের অপর শিক্ষক সতীশচন্দ্র কাঞ্জিলালও তাকে সংগীতে করেন দীক্ষিত। শাস্ত্রীয়সংগীতের প্রাথমিক পাঠ তাঁর কাছেই হতে থাকে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তৃতীয় বছরে অর্থাৎ ১৯১৭ সালে নজরুল ছিলেন দশম শ্রেণিতে। প্রি-টেস্ট পরীক্ষা হয়েছে। নজরুল দেখলেন শহরের দেয়ালে আঁটা পোস্টারে বাঙালি যুবকদের সেনাবাহিনীতে যোগদানের আহবান। সেনাবাহিনীর উত্তাল জীবন তাকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকলো। পরীক্ষা জলাগুলি দিয়ে সেনাদলে নাম লেখালেন তিনি। চলে গেলেন লাহোর হয়ে নওশেরওয়াতে। এখানে তিন মাসের ট্রেনিং শেষে তাঁকে যেতে হয় ৪৯ নং বাঙালি পল্টনের হেড কোয়ার্টার করাচি।
অল্পদিনের মধ্যে তিনি ব্যাটেলিয়ান কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পদে উন্নীত হন। নজরুলের সৈনিক জীবন আড়াই বছরের। কঠোর শৃঙ্খলার মধ্যেও তার সাহিত্যচর্চা ছিল নিরলস। তাঁর প্রথম গল্প 'বাউণ্ডেলের আত্মকাহিনি এবং প্রথম কবিতা 'মুক্তি' এই সময়েরই লেখা। 'বাউণ্ডেলের আত্মকাহিনি' প্রকাশিত হয় মাসিক সওগাতের প্রথম বর্ষের সপ্তম সংখ্যায় (জ্যৈষ্ঠ ১৩২৬ সালে) এবং 'মুক্তি' প্রকাশিত হয় ১৩২৬ সালের শ্রাবণ মাসের ত্রৈমাসিক 'বঙ্গীয় মুসলমান-সাহিত্যে। সওগাতে এর পরপরই আশ্বিন সংখ্যায় কবিতা- 'সমাধি' ভদ্রে সংখ্যায় ‘স্বামীহারা' এবং 'বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্যে' পত্রিকা'র কার্তিক ও মাঘ (১৩২৬ সালে) সংখ্যায় যথাক্রমে প্রকাশিত হয় 'হেনা' ও 'ব্যথার দান' গল্প দুটি। এই সময় গল্প লেখক হিসেবেই নজরুলের প্রকাশ ঘটে। এই সময়েই 'রিক্তের বেদন' ও 'বাঁধনহারা' পত্রোপন্যাসের বেশকিছু অংশ লেখা হয়। বাঙালি পল্টনের পাঞ্জাবি মৌলভী সাহেবের কাছে দিওয়ান-ই-হাফিজ, মহানবী, রুমি প্রভৃতি বিখ্যাত ফারসি কাব্য পাঠ করে তিনি মহৎ সাহিত্য ও মহৎ জীবনের সন্ধান পান। সাধক শ্রেষ্ঠ প্রেমিক রুমির গজল ও দিওয়ান-ই-হাফিজ থেকে মূল ছন্দের অনুসরণে ছয়টি গজল বাংলায় অনুবাদ করেন। পরিণত বয়সে তাঁর লেখা 'রুবাইয়াত-ই-হাফিজ' ও 'রুবাইয়াত-এ ওমর খৈয়াম' বাংলা পদ্যে অনুবাদ, তাঁর সৈনিক জীবনের পড়াশোনার সুফল। ১৩২৭ সালের বৈশাখ মাসে কবি মোজাম্মেল হকের সম্পাদনায় 'মোসলেম ভারত' প্রকাশিত হয়। তার প্রথম সংখ্যা থেকে নজরুলের 'বাঁধনহারা' পরোপন্যাস প্রকাশিত হতে থাকে। বাংলা ভাষায় সম্ভবত 'বাঁধনহারা' প্রথম পত্রোপন্যাস। বাঁধনহারার মূলে ছিল ব্যর্থ প্রেম। যার পরিণতি বিদ্রোহ। এই পত্রোপন্যাসে 'সাহসিক এক সুদীর্ঘ চিঠিতে বিদ্রোহের বাণী উপস্থিত, যা তাঁর বিদ্রোহী কবিতারই পূর্বাভাস, বা পূর্বলেখ। ইতোমধ্যে সান্ধ্য দৈনিক নবযুগে যোগ দিলেন কবি। নবযুগের প্রথম প্রকাশ ছিল ১৯২০ সালের ১২ জুলাই স্বত্বাধিকারী শেরে বাংলা একে ফজলুল হক। যুগ্ম সম্পাদক কাজী নজরুল ইসলাম ও মুজফ্ফর আহমদ। নবযুগে নজরুল যে প্রবন্ধগুলো লিখেছিলেন তার কিছু সংকলিত হয় 'যুগবাণী প্রবাহ' পুস্তকটিতে, যা ছাপা হয় ১৩২৯ সালের কার্তিক মাসে। নবযুগের কাজ ছেড়ে হাওয়া পরিবর্তনের জন্যে নজরুল ১৯২০ সালের ডিসেম্বরে দেওঘরে যান। যাওয়ার আগে লেখেন 'বন্ধু আমার। থেকে থেকে কোন সুদূরের নির্জন-দূরে, ডাক নিয়ে যাও ব্যথার সুরে?" তাঁর কণ্ঠে গানটি শুনে মোহিতলাল মজুমদারের মতো সমালোচকও আনন্দিত হয়ে ওঠেন। গল্প-কবিতা-উপন্যাস রচনার ফাঁকে ফাঁকে কবির সংগীত চর্চাও চলতে থাকে পুরোদমে। তিনি গানও গাইতেন সুন্দর কণ্ঠে, তাঁর গলার প্রশংসাও কোলকাতার সংগীত মহলে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি বন্ধুদের অনুরোধে গাইতেন "পিয়া বিনা মোরা হিয়া না মানে, বদরী ছাইরে' একটি হিন্দুস্তানি গান।
দেওঘর থেকে ফিরে কবি সাহিত্য সমিতির অফিসে আফজাল-উল-হকের সঙ্গে থাকেন। এখানে কুমিল্লার আলী আকবর খানের সঙ্গে হয় তার পরিচয়, তারই অনুরোধে তিনি দৌলতপারে এসে হাজির হন ১৯২১ সালের এপ্রিল মাসে। কুমিল্লায় আসার পথে ট্রেনে বসে কবি রচনা করেন 'নীলপরী' কবিতাটি। দৌলতপুরে আলী আকবর খানের এক ভাগ্নী নার্গিস আরা খানমের সঙ্গে তাঁর প্রথম বিবাহ সম্পন্ন হয় (বাংলা ১৩২৮ সনের ৩ আষাঢ়) ১৯২১ সালের ১৭ জুন শুক্রবারে। কিন্তু এ বিয়ে টেকেনি। বিয়ের দিন রাতেই কবি দৌলতপুর ত্যাগ করে কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে চলে আসেন বিখ্যাত সেনগুপ্ত পরিবারের অতিথি হিসেবে। দৌলতপুরে থাকার সময় লেখা হয় 'অ-বেলায়', 'অনাদৃত', 'বিদায় বেলায়', 'হারমানা-হার', 'হারামনি', 'বেদনা', 'অভিমান' 'বিধুরা', 'পথিক প্রিয়া' ইত্যাদি কবিতা। কুমিল্লায় সেবার কবি ছিলেন মোট ২১ দিন। রচনা করেন 'পরশ-পূজা", বিজয় গান, 'পাগল পথিক', 'মনের মানুষ', 'বন্দী-বন্দনা', 'মরণ-বরণ' ইত্যাদি কবিতা ও গান।
বেদনাবিহবল নজরুল এই সময় আশ্রয় গেলেন মুজফ্ফর আহমদের বাড়িতে তালতলা লেনে। এই বাড়িতেই নজরুল লিখলেন তার সর্বাধিক পঠিত কবিতা 'বিদ্রোহী' কবিতাটি প্রথম মুদ্রিত হয় ১৩২৮ সালের কার্তিক সংখ্যায় 'মোসলেম ভারত' পত্রিকায়। বাংলায় 'বিজলীতে' ছাপা হওয়ার পরই কবিতাটি তুমুলভাবে আলোড়ন জাগায় সারা বাংলায়। বাইশ বছরের এক তরুণ কবি লিখেছেন এমন একটি কবিতা, যার প্রতি ছত্রে রয়েছে বিদ্রোহের বহ্নিশিখার প্রজ্বলন। একটি কবিতাকে কেন্দ্র করে এমন অকুণ্ঠ প্রশংসা বোধ হয় আর কোনো দ্বিতীয় কবিতাকে নিয়ে হয়নি বাংলা সাহিত্যে।
১৯২১ সালের নভেম্বরে কবি আবার কুমিল্লায় আসেন। এই সময়ে প্রিন্স অব ওয়েলসের (পরে অষ্টম এডওয়ার্ড) ভারত আগমন উপলক্ষে সারা দেশে হাঙ্গামা হয়, পালিত হয় হরতাল। হরতাল উপলক্ষে নজরুল লেখেন একটি বিখ্যাত জাগরণী গান এবং মিছিলের পুরোভাগে এই গানটি গেয়ে কবি সারা শহর প্রদক্ষিণ করেন। ১৯২২ সালের প্রথম দিকে নজরুল আবার কুমিল্লায় গিয়ে বেশ কিছুদিন অবস্থান করেন। এই সময় প্রমিলা সেনগুপ্তর সঙ্গে তার গভীর প্রণয় সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ১৩২৯ বাংলা সনের ২৫ শ্রাবণ 'ধূমকেতু' প্রকাশ লাভ করে। ধূমকেতু আদি সাপ্তাহিক, প্রতি সংখ্যা এক আনা, পত্রিকার সারথি কাজী নজরুল ইসলাম, প্রিন্টার পাবলিশার আফজাল উল হক। ধূমকেতুতে বের হতে থাকে নজরুলের জ্বালাময়ী সব প্রবন্ধ। ১৯২২ সালের সেপ্টেম্বর 'ধূমকেতু'র পূজা সংখ্যায় নজরুলের কবিতা 'আনন্দময়ীর আগমনে বের হওয়ার পর পত্রিকাটি বাজেয়াপ্ত হয় এবং নজরুলের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। শেষ পর্যন্ত কুমিল্লাতে আত্মগোপন করার সময় তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। রাজদ্রোহের অভিযোগে ১৯২৩ সালের ১৬ জানুয়ারি বিচারে কবির এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়।
ধূমকেতু প্রকৃতপক্ষে হয়ে উঠেছিল বাংলার নির্যাতিত দলের অগ্নিবাণীর বাহন। সম্পাদকীয়গুলো বাছাই করে 'রুদ্রমঙ্গল' ও 'দুর্দিনের যাত্রী' নামে দুইটি গ্রন্থ বের হয়। বাংলা ১৩২৯ সালের কার্তিক মাসে নজরুলের 'অগ্নিবীণা' গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। 'প্রলয়োল্লাস', 'বিদ্রোহী', 'ধূমকেতু', 'কামাল পাশা', 'আনোয়ার", 'রণভেরী' 'সাত-ইল-আরব', 'খেয়াপারের তরণী', 'কোরবানী', 'মোহররম' প্রভৃতি কবিতা এতে ছিল। প্রথম সংকলন অল্পদিনেই নিঃশেষিত হয়ে যায়। বাংলা ভাষায় আর কোনো কাব্য বাজারে এত সমাদৃত হয়নি।
কিছুকাল আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে রাখার পর নজরুলকে হুগলী জেলে বদলী করা হয়। সেখানে কবি লেখেন শিকল পরার গান, বন্দনা প্রভৃতি গান। জেলের ব্যবস্থার প্রতিবাদে নজরুল ৩৯ দিন অনশন ধর্মঘট করেন। হুগলী জেলেই নজরুল লেখেন 'সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে' কবিতাটি। তিনি জেলে থাকতেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'বসন্ত' নাটিকা নজরুলের নামে উৎসর্গ করেন (১০ ফাল্গুন ১৩২১)। ১৯২৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর নজরুল কারামুক্ত হলে সোজা চলে যান কুমিল্লায়। পরে ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল প্রমীলা সেনগুপ্তের সঙ্গে নজরুল পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। বিবাহ উৎসব অনুষ্ঠিত হয় কোলকাতার ৬ নং হাজি লেনের বাড়ির একটি কক্ষে। মা ও মেয়ে' উপন্যাসের লেখিকা মিসেস এম রহমানের উদ্যোগে এই বিবাহকার্য সম্পাদিত হয়। নজরুল তাঁর 'বিষের বাঁশি' উৎসর্গ করেছিলেন মিসেস এম রহমানের নামে। বিয়ের পর কবি সপরিবারে হুগলীতে চলে যান। এই সময়টি ছিল কবির বিশেষ আর্থিক দুরবস্থার দিন, তবুও লেখা থেমে থাকেনি। তার 'মুক্তিকাম', 'দ্বীপান্তরের বন্দিনী', সব্যসাচী, ঝড়, ফালগুনী, 'চরকার গান', 'কৃষাণের গান' এই সময়ের রচনা।
হুগলীর বাড়িতে থাকাকালীন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস মৃত্যু বরণ করেন। নজরুল প্রার্থ জানান 'অর্থ' নামে একটি গানে যা দেশবন্ধুর শবাধারে মালার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। দেশবন্ধুর মৃত্যুতে আরও লেখেন 'অকাল-সন্ধ্যা" 'সানা' 'ইন্দ্ৰ পতন' কবিতা এবং 'রাজভিয়ারী' নামে একটি গান। রচনাগুলো একত্রে প্রকাশিত হয় 'চিত্তনামা" নামে কাব্যগ্রন্থে। এই সময় বাঁকুড়ার দলমাদল কামানের গায়ে হেলান দিয়ে ভোলা নজরুলের বিখ্যাত ছবিটি 'চিত্তনামা' গ্রন্থে স্থান পায়। শ্রমিক-প্রজা স্বরাজ সম্প্রদায়ের সাপ্তাহিক মুখপত্র “লাঙল'-এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৯২৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর। সম্পাদক শ্রী মণিভূষণ মুখোপাধ্যায়, প্রধান পরিচালক কাজী নজরুল ইসলাম। 'লাঙল'-এ প্রকাশিত হয় 'সাম্যবাদী' 'কৃষাণের গান' 'সব্যসাচী'। এই কবিতাগুলো সাম্যবাদী পরে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়।
১৯২৬ সালের ৩ জানুয়ারি হুগলী ছেড়ে কবি আসেন কৃষ্ণনগরে। এখানে লেখেন শ্রমিকের গান, কোরাস সংগীত: 'কাণ্ডারী হুঁশিয়ার'। 'ছাত্রদলের গান' তাঁর এই সময়ের রচনা। ১৯২৬ সালের জুন মাসে নজরুল একবার ঢাকায় আসেন। মুসলিম সাহিত্য-সমাজের প্রথম বর্ষের চতুর্থ অধিবেশন (২৭ জুন রবিবার) কবি কয়েকটি গান গেয়ে তরুণদের মাঝে বিপুল উদ্দীপনার সৃষ্টি করেন। আর্থিক নিক দিয়ে নিঃস্ব কবি এই সময় কেন্দ্রীয় আইন সভার পদপ্রার্থী হয়ে ব্যয়বহুল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। জুলাইতে যান চট্টগ্রামে। রচনা করেন, 'অনামিকা' ও 'গোপন প্রিয়া'। তাঁর 'সিন্ধু-হিন্দোলা কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ লেখাই এই সময়ের। লাওল এর পনেরটি সংখ্যা বেরিয়েছিল। এ পত্রিকায় নারুলের 'মন্দির ও মসজিদ' হিন্দু-মুসলমান' নামে দুটি প্রবন্ধ ও 'জাগো অনশন বন্দি ওঠোরে যত 'অন্তর-ন্যাশনাল সংগীত' 'রক্ত পতাকার গান প্রকাশিত হয়। ১৯২৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর নজরুলের দ্বিতীয় পুত্র বুলবুল ভূমি হয়। পুত্রের নাম অনুযায়ী তাঁর সংগীত গ্রন্থের নাম রাখেন বুলবুল। এই সময় ১৯২৬ সাল থেকেই নজরু গজল গান লেখার দিকে আকৃষ্ট হন। মিসরীয় নর্তকী ফরিদার নৃত্য সহযোগে গজল 'কিসকি খায়রো ম্যায় করবো যে দিন হিলা দিয়া' সুরে ১৩৩৩ সনের ২৮ অগ্রহায়ণে রচনা করেন 'আসে বসন্ত ফুলবনে সাজে বনভূমি সুন্দরী' গানটি। এই সময় থেকেই নজরুলের গানে স্বকীয়তা ফুটে ওঠে।
কৃষ্ণনগরেও কবির আর্থিক অনটন অব্যাহত থাকে। এই পটভূমিকায় কবি লেখেন তার সুবিখ্যাত 'দারিদ্র্য" কবিতাটি, পরে তা কল্লোল' ও 'সওগাতে' প্রকাশিত হয়।
১৯২৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজের উদ্বোধন উপলক্ষে কবি কৃষ্ণনগর থেকে ঢাকার আসেন। আসার পথে স্টিমারে বসে রচনা করেন উদ্বোধনী গান, 'আসিলে কে গো অতিথি উড়িয়ে নিশান সোনালি', এবং 'বসিয়া নদীকূলে এলোচুলে কেগো উদাসিনী' গান দুইটি। আবার ১৯২৮ সালের মার্চ মাসের প্রথম দিকে ঢাকায় এলে লেখেন সেই বিখ্যাত মার্চ সংগীতটি 'চল চল চল ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাनল'।
১৯২৪ সালে আফজাল-উল-হকের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় নওরোজ" নামে মাসিক পত্রিকাটি। নওরোজে নজরুলের ‘ঝিলিমিলি', 'সারব্রীজ' ও 'কুহেলিকা' উপন্যাসের অংশ প্রকাশিত হয়।
১৯২১ সালের প্রথম দিকে তিনি চলে আসেন আবার কোলকাতায়, 'সওগাত' অফিসের দুইটি ছোটো ঘরে আশ্রয় নেন তিনি। কবির সংকলন 'সঞ্চিতা' ১৯২৫ সালে প্রকাশিত হয়।
সমর্থন ও বিরোধিতা দুইটিই নজরুলের ভাগ্যে ছিল। 'শনিবারের চিঠি', 'ইসলাম দর্শন', 'মোসলেম দর্শন, 'মোহাম্মনী' একদিকে, অন্যদিকে 'সওগাত' ও তার সঙ্গী গুনিজন নজরুলের পক্ষে। তবে নজরুলের অপ্রতিরোধ্য জনপ্রিয়তা বেড়েই চলে। ১৩৩৬ বঙ্গাব্দের ২১ অগ্রহায়ণ অ্যালবার্ট হলে নজরুলকে বিপুল সংবর্ধনা দেওয়া হয় যেখানে সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরুদ্দীন, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদ, হাবীবুল্লাহ বাহার ছিলেন উদ্যোক্তা। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, প্রধান অতিথি নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। নজরুল সবার অনুরোধে গেয়ে শোনান 'দুর্গম গিরি কান্তার মরু' ও 'বীরদল চলে সমরে' গান দুটি।
১৯৩০ এর অগাস্ট মাসে নজরুলের 'প্রলয় শিখা' কাব্য গ্রন্থটি প্রকাশিত হলে আবার ইংরেজ শক্তির হামলার শিকার হন তিনি। বিচারে ছয় মাসের জেল হয়। তারপর ১৯৩১ সালের ৩০ মার্চ তিনি জেল থেকে ছাড়া পান। নজরুল একবার মুজাফফর আহমদের জন্মস্থান সন্দ্বীপ যান। সমুদ্রবেষ্টিত দ্বীপটির সৌন্দর্য তাকে মুগ্ধ করে নজরুল রচনা করেন 'মধুমালা' ও 'চক্রবাক এর কবিতাগুলো আর ভাটিয়ালি আশ্রিত 'সাম্পানের গান"। এর আগে নজরুলের মা ইস্তেকাল করেন (১৯২৮) এবং নজরুলের প্রথম ছেলে আজান কামালেরও অকাল মৃত্যু হয় হুগলীতে। দ্বিতীয় পুত্র বুলবুল মারা যায় বসন্ত রোগে ১৯৩০ সালে কোলকাতায়।
নজরুলের মানসিক জগতে আসে বিরাট পরিবর্তন। আধ্যাত্মিকতায় মনোনিবেশ করেন তিনি। এর মধ্যেই
মূল ফারসি থেকে 'রুবাইয়াৎ-ই-হাফিক্স' অনুবাদ করেন। রোগশয্যায় শায়িত বুলবুলের শিয়রে বসেই এই
অনুবাদের শুরু করেছিলেন তিনি। ১৯২৯ সালে গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে নজরুলের যোগাযোগ ঘটে।
১৯৩৫ সালে কবি গ্রামোফোন কোম্পানির একমাত্র গীতিকার-সুরকার পদটি পান। ১৯৩১ এর দিকে কবি
সিনেমা ও রঙ্গমঞ্চের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। তাঁর 'আলেয়া" সাধারণ রঙ্গমঞ্চে মঞ্চস্থ হয়। 'ধ্রুব' (চলচ্চিত্র) মুক্তি পায় ১৯৩৫ সালের ১ জানুয়ারি। এই ছবির সংগীত রচনা ও পরিচালনা ছাড়াও তিনি নারদের ভূমিকায় অভিনয় করেন। তাঁর লেখা 'বিদ্যাপতি (১৯৩৮ সালে ২ এপ্রিল) এবং 'সাপুড়ে' (১৯৩৯ সালের ২৭ মে) ছায়াছবিতে রূপ লাভ করে। ১৯৪০ সালে নজরুল কোলকাতা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হন। 'হারামণি' এবং 'নবরাগ মালিকা অনুষ্ঠান দুইটি জনপ্রিয় হয়। অসংখ্য লুপ্তপ্রায় রাগের ওপর ভিত্তি করে আয়োজিত হারামণি অনুষ্ঠান। 'কাফেলা', “কাবেরী
তীরে' প্রভৃতি গীতি-নাটিকা বেতারের জন্যেই লিখিত হয়েছিল। নজরুলের গান ও সুরের ছোঁয়ায় অল ইন্ডিয়া রেডিওর অনুষ্ঠান প্রাণবন্ত হয়ে উঠত। নবপর্যায়ে দৈনিক 'নবযুগ' প্রকাশিত হলো ১৯৪০ সালের অক্টোবরে। নজরুল হলেন প্রধান সম্পাদক। এ
সময় 'নবযুগ' ও 'সঙ্গীত'-এ প্রকাশিত কবিতার সংকলিত রূপ নতুন চাঁদ ও শেষ সওগাত।
কিছুকাল ধরেই কবির জীবনে অশান্তির পর অশান্তি নেমে আসছিল। স্ত্রী প্রমিলা নজরুল ১৯৪০ সালে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হলেন। আর্থিক অনটন চরম পর্যায়ে এলো চারদিকে অর্থাভাব, অনটন। সেদিন কেউই তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসেনি।
সুরের বুলবুল, সারা জীবনে দুঃখের নদীতে সন্তরণরত দুখু মিঞা ১৯৪২ সালের ১ জুলাই একেবারে নির্বাক হয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে কোনো চিকিৎসা হলো না। সুদীর্ঘ দশ বছর পর কয়েকজন গুণিমানুষের চেষ্টায় 'নজরুল নিরাময় সমিতি' গঠিত হলো। সম্পাদক কাজী আব্দুল ওদুদ। এঁরা সঙ্গীক কবিকে রাচী সেন্ট্রাল হসপিটালে পাঠান। দীর্ঘ চার মাস চিকিৎসার পরও কোনো রোগ পাওয়া যায়নি। শেষে কবি সঙ্গীক ১৯৫৩ সালের ১০ মে কোলকাতা থেকে রওনা হয়ে ৮ জুন লন্ডনে পৌঁছান। এখানে সারগাট, টি এ বেটন ম্যাকসিক এবং ব্যাসেল ট্রেন কবিকে পরীক্ষা করেন। কিন্তু রোগ নির্ণয়ে তারা একমত হতে পারলেন না। এরপর কবিকে ৭ ডিসেম্বর ভিয়েনায় পাঠানো হয়। বিশ্ববিখ্যাত স্নায়ু বিশেষজ্ঞ ড. হ্যাল কক্ষ কবিকে পরীক্ষা করেন। ১৫ ডিসেম্বর কবিকে কোলকাতায় ফিরিয়ে আনা হয়। সমস্ত বাংলা ভাষাভাষী মানুষ তার জন্য তখন পাগল। সবার প্রিয় কবি আর সুস্থ হলেন না। ১৯৪৫ সালে কবিকে 'জগতারিণী' পুরস্কার দেওয়া হয় কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ভারত সরকা পদ্মভূষণ উপাধি দেন ১৯৬০ সালে। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করেন ১৯৬৯ সালে। সুদীর্ঘকাল রোগভোগের পর কবিপত্নী প্রমীলা ১৯৬২ সালের ৩০ জুন লোকান্তরিত হন।
কবির দুই পুত্র কাজী সनাটী ইসলাম ও কাজী অनি ইসলাম। কাজী সব্যসাচী ছিলেন শীর্ষস্থানী আবৃত্তিকার আর কাজী অনিরুদ্ধ অন্যতম শ্রেষ্ঠ গীটার বাদক। কাজী অনিরুদ্ধ ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মারা যান। কাজী সব্যসাচী ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ মারা যান। সনাতীর দুই কন্যা দিল কাজী, মিষ্টি কাজী ও এক পুত্র বাবুল কাজী। অনিরুদ্ধের বিধবা পত্নী কল্যাণী কাজী ও দুই পুত্র কাজী অনির্বাণ কাজী অরিন্দম এক কন্যা অনিশিতা বর্তমাन।
১৯৭২ সালে ২৪ মে কবিকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবু রহমানের আমন্ত্রণে তাঁর ঢাকা আগমন। বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে অসুস্থ অবস্থার কবিকে বরণ করে নেওয়া হয়। কবিকে দেওয়া হয় রাজকীয় সম্মান। কবির জন্য সম্পূর্ণ দোতলা একটি বাড়ি, একটি গাড়ি, নার্স, ভাণ্ডার দিয়ে সব রকম সেবা অন্যার ব্যাপক বন্দোবস্ত করা হয়। কবির প্রতি অপরিসীম ভালোবাসার হিসাবর লালের জানুয়ারি মানে কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে সম্মানসূচক ডিলিট উপাধি দেন ১৯৭৬ সালের ১ ডিসেম্বর। ১৯৭৬ সালে কবিকে দেওয়া হয় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পুরস্কার একুশে পদক। ১৯৭৫ সালের ২২ জুলাই কবির স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকে। তাঁকে পিজি হাসপাতালে বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তরিত করা হয়। ১৯৭৬ সালের ২১ আগস্ট তিনি ইন্তেকাল করেন। বাংলাদেশের সকল মানুষ তার মৃত্যুতে শোকাবিহ্বল হয়ে পড়ে। ২১ আগস্ট তার জানাজায় লক্ষ লক্ষ মানুষ শরিক হন। পরিপূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ঐ দিন বিকেল সাড়ে পাঁচটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে তাকে দাফন করা হয়। 'মসজিদেরই পাশে আমার ক ভাই' গানে কৰি এই ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন।
লালন শাহ (১৭৭৮ - ১৮৯০)
বাংলা লোকসাহিত্যের তথা এই উপমহাদেশের অন্যতম দিকপাল বাউল সাধক ফকির লালনশাহ্। তিনি ১১৭৯ সালের (বাংলা) ১ কার্তিক ১৭৭৪ সালের ১৪ অক্টোবর বর্তমানে ঝিনাইদহ জেলার হরিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম দরীবুল্লাহ দেওয়ান এবং মাতার নাম আমিনা খাতুন। তিনি ১১৮ বৎসর বয়স পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। ১২৯৭ সালের ১ কার্তিক শুক্রবার (বাংলা) এবং ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর (খ্রি.) এই দার্শনিক কবি দেহত্যাগ করেন। এই সমস্ত তথ্য লালনের প্রিয় শিষ্য দুদুশাহ লিখিত একটি ক্ষুদ্র কলমী পুঁথি থেকে (রচনা ১৩০৬ সাল ১৮৯৬ খ্রি:) পাওয়া যায়।
লালন শাহের বাল্যজীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তবে লালনের শিষ্য দুদ্দু শাহের লেখা থেকে জানা যায় যে, অতি শৈশবে লালনের পিতা-মাতা পরলোকগমন করেন। তাঁরা ছিলেন তিন ভাই। যথাক্রমে আলম, কলম ও লালন। লালন ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। সাধক লালনের জন্যের মাত্র দুই বছর পূর্বে ঐতিহাসিক ছিয়াত্তরের মন্বন্তর দেখা দেয়। পিতৃ-মাতৃহীন লালন তখন আত্মীয়-স্বজন দ্বারা লালিত-পালিত হন। আবার জনাব আফসারউদ্দীন শেখ সাহেব বলেছেন, কিশোর লালন এক সময় হরিশপুরে দক্ষিণ পাড়ার ইনু কাজীর বাড়িতে আশ্রয় নেন এবং গো রাখালের কাজে নিযুক্ত হন। তবে একথা কতটুকু সত্য তা নির্ণয় করা সম্ভব নয়। আবার লালন শিষ্য দুদু শাহ্ বলেছেন, লালন শাহের বালাকাল এবং তরুণ জীবন অতিবাহিত হয় লালন গুরু সিরাজ শাহের আশ্রয়ে।
বাল্যকাল থেকেই লালন গীত-বাদ্য পছন্দ করতেন। ঐ সময় হরিশপুর অঞ্চলে ধুয়া-জারিগানের বিশেষ প্রচলন ছিল। লালন শাহ এই গানের প্রতি এতই তিনি অনুরক্ত ছিলেন যে তিনি সংসারের কাজকর্ম উপেক্ষা করে মান গেয়ে বেড়াতেন। এজন্য লালনকে বড়ো ভাইদের ভৎসনা ও নির্যাতন সহ্য করতে হতো। কিন্তু কোনো বাধাই কিশোর লালনকে পরাভূত করতে পারেনি। তখন থেকেই লালনশাহ্ গায়ক হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে থাকেন।
বাউল কবি লালন শাহের লেখা-পড়া সম্পর্কে শিষ্য দুদু শাহ্ তেমন কোনো তথ্য দেননি। বেশকিছু সংখ্যক ফকিরের মতে তিনি নিরক্ষর ছিলেন। এ বিষয়ে উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেছেন "হিতকারী পত্রিকাতেও ঐ রূপ সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল যে, সাধক লালন তাঁর গানের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান ধর্মশাস্ত্রের যে জ্ঞান, মতবাদের ওপর যে অবিচলিত নিষ্ঠা, যে সভ্য দৃষ্টি ও কবি শক্তি প্রকাশ পাইয়াছে তাহা দেখিলে লালনকে নিরক্ষর ভাবিতে কুণ্ঠাবোধ হয়। তিনি যে নিরক্ষর ছিলেন এই মতের পক্ষে তেমন গ্রহণযোগ্য কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। লালন পুঁথিগত বিদ্যা অপেক্ষা প্রকৃতি থেকে শিক্ষা গ্রহণকেই শ্রেয় মনে করতেন। তাই তিনি বলেছেন,
এলমে লাদুন্নি হয় যার সর্বভেদে মালুম হয় তার।
উল্লিখিত পংক্তিসমূহে শাস্ত্রাদি আলোচনা ও মীমাংসার কথা আছে। অশিক্ষিত ব্যক্তির পক্ষে নিশ্চয় শাস্ত্র বিশ্লেষণ করা মোটেই সম্ভব নয়। বিভিন্ন ভাষা ভালোভাবে পড়তে, লিখতে ও বুঝতে না পারলে শুধুমাত্র অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষে বিভিন্ন শাস্ত্রের তুলনা, গ্রহণযোগ্য তথ্য এবং সেই বিষয়ে যথাযথ বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। মরমী কবি লালন শাহ যে শিক্ষিত ছিলেন তার স্পষ্ট প্রমাণ উল্লিখিত পংক্তিগুলোতে বিদ্যমান। সাধক কবি লালন শাহ্ কোন্ জাতি বা কোন সম্প্রদায়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এ বিষয়ে তার জীবৎকালেই প্রশ্ন উঠেছিল। এই মতভেদ বর্তমানেও বিদ্যমান। প্রচলিত বিশ্বাস মতে লালন জন্মগতভাবে কায়স্থ সন্তান। তার মায়ের নাম পদ্মাবতী এবং মাতামহের নাম ভ্রমদাস। সাধক লালনের জীবনীকার বসন্ত কুমার পাল মনে করেন ভাঁড়ারা গ্রামে পালনের জন্ম হয় এবং লালনের আসল নাম লালন চন্দ্র দাস। তিনি ভাঁড়ারার ভৌমিকদের
জ্ঞাতি ছিলেন।
যৌবনের প্রাক্কালে সাধক লালনশাহ্ কাশী বা পুরীর তীর্থস্থান থেকে ফেরার পথে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে সঙ্গীরা তাঁকে ছেঁউড়ে নামক গ্রামের কাছে ফেলে রেখে চলে যায়। পরে ফুলবাড়ী নিবাসী সিরাজশাহ্ নামে এক মুসলমান ফকির মুমূর্ষ অবস্থায় লালনকে নিজ বাড়িতে নিয়ে যান। তার এবং তার স্ত্রীর সেবা যত্নে লালন
আরোগ্য লাভ করেন। লালন আরোগ্য লাভ করলেও তার একটি চক্ষু নষ্ট হয়ে যায়। এরপর তিনি এই মুসলমান
ফকিরের নিকট ইসলাম ধর্ম মতান্তরে বাউল বা ফকিরী ধর্মে দীক্ষিত হন। অপরপক্ষে লালনশিষ্য দুদু শাহ বলেছেন যে, (১২২২ সালে) লালন শাহ্ পঁয়তাল্লিশ বৎসর বয়সে খেতুরীর মেলায় যোগদান করেন। মেলা থেকে প্রত্যাবর্তন কালে লালন শাহ্ বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। ধারণা করা যায় বসন্তের পূর্বলক্ষণসমূহ খেতুরী অবস্থানকালে প্রকাশ পায়। লালন শাহের পক্ষে পদব্রজে গমন করা অসম্ভব মনে হওয়ায়, তিনি ভাড়াটিয়া নৌকাযোগে গড়াই নদী দিয়ে কুষ্টিয়া ভাঁড়ারা অভিমুখে যাত্রা করেন। কিন্তু পথিমধ্যে লালন শাহ ব্যাধির প্রকোপে জীবনমৃত অবস্থায় উপনীত হন। নৌকার মাঝি তাকে মৃত মনে করে এবং গায়ে বসন্তের চিহ্ন দেখে কুষ্টিয়ার নিকটবর্তী কালিগঙ্গার মোহনায় ফেলে যায়। কালিগঙ্গা তীরস্থ এই স্থানটি ছেঁউড়িয়া। এই ছেঁউড়িয়া গ্রামের মলম বিশ্বাসের ঘাটে লালন শাহ সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পড়েছিলেন। লালনের দেহে জীবনের লক্ষণ অবশিষ্ট থাকায় মলম বিশ্বাস দয়া পরবশ হয়ে লালনকে তার আপন গৃহে নিয়ে যান, স্বামী-স্ত্রী মিলে তাঁর সেবা যত্ন করেন। ক্রমে ক্রমে লালনের পাণ্ডিত্য, বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্রে গভীর জ্ঞান ও শক্তির পরিচয় পেয়ে মলম বিশ্বাস ও তার স্ত্রী লালন শাহের নিকট 'বাইয়াৎ' গ্রহণ করেন। এভাবেই লালন শাহ্ ছেঁউড়িয়া উপস্থিত হন। বর্তমানে লালন শাহের মাজার ও দরগাহ কুষ্টিয়া শহরের অদূরে 'হেঁউড়ে' নামক স্থানে বিদ্যমান।
লালন জীবনী অনুসরণ করলে দেখা যায় যে, শৈশবে পিতৃ-মাতৃহীন লালন শুরু সিরাজ শাহের স্নেহছায়ায় প্রতিপালিত হন। এই গুরুর সাহচর্যে তাঁর জীবনের সুদীর্ঘ ছাব্বিশ বৎসর অতিবাহিত হয়। এইসময় লালন-গুরু সিরাজ শাহের নিকট বাউল তত্ত্বে পুরোপুরিভাবে দীক্ষিত হন।
উল্লেখযোগ্য যে, বাউল মতবাদ উপমহাদেশের বিশেষত পূর্ব ভারতের প্রাচীনতম লোকায়ত মতবাদের সঙ্গে তন্ত্র, বৌদ্ধাশূন্যবাদ, সংখ্যাযোগ, বৈষ্ণব সহজিয়া মত এবং সুফীবাদী ধ্যান-ধারণার সংমিশ্রণে বিকশিত। বাউল মতের রূপান্তর সাধনে লালন শাহের দার্শনিক ভিত্তি অত্যন্ত প্রগতিশীল ও মূল্যবান। বিশ্বমানবতার প্রবক্তা লালন শাহ মানব জাতির জন্য কোনো বিভাগ-উপবিভাগের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন না। গোত্র, বংশ, বর্ণ সম্পর্কে লালন শাহের শ্রদ্ধাহীনতা কেবলমাত্র ভাবাবেগের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না। লালনের ধর্মমত ছিল অতি সরল ও উদার। তিনি জাতিভেদ মানতেন না। হিন্দু-মুসলমান শিষ্যদের তিনি সমভাবে গ্রহণ করতেন। লালন শাহকে অনেক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। তবুও তিনি নিজের পথ থেকে এতটুকুও বিচ্যুতি হননি।
লালন শাহ কোনো ধর্মমতকে কখনও আঘাত করতেন না। তিনি সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে সৌহাদ্য রক্ষার কথা
উদার কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন।
সমগ্রভাবে তিনি মানুষকেই স্রষ্টা ও সৃষ্টির মৌলিক সত্য বলে স্বীকার করেছেন। লালন শাহী বাউল তত্ত্বে স্রষ্টা 'বস্তু' স্বরূপ মানব দেহে অধিষ্ঠিত। তিনি স্বর্গে মহাশূন্যে বা অপর কোনো কাল্পনিক লোকে অবস্থিত নন। তার নৈকট্য লাভ করতে হলে মানুষের দেহের ভিতরই অন্বেষণ করতে হবে। সেই অনুসন্ধান বা উপায় জানেন গুরু বা মুরশিদ। বস্তুবাদী দর্শন মানব-শক্তিকে করেছে আস্থাবান ও মানব মহিমায় উজ্জ্বল। মরমী কবি লালনের প্রধান কৃতিত্ব এখানেই।
মরমী কবি লালনশাহের সাধনার ন্যায় তার গানগুলোও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে সাধনার ক্রম অনুযায়ী লালন শাহের বাউল গান চার স্তরে বিভক্ত। প্রতিটি স্তর আবার চৌদ্দটি শাখায় বিভাজ্য। এভাবে লালনগীতি সমগ্রভাবে মোট ছাপান্ন শাখায় ভাগ করা যায়। কিন্তু কাব্যগত ঐতিহ্য ধারায় এসব গান তিনভাগে বিভক্ত করাই শ্রেয় বলে মনে হয়।
১। বাউল গীতির ঐতিহ্য ধারায় রচিত লালনগীতি।
২। সুফীবাদের ঐতিহ্য ধারায় রচিত লালনগীতি।
৩। বৈষ্ণব পদাবলির ঐতিহ্য ধারায় রচিত লালনগীতি।
এই তিন ঐতিহ্য ধারায় রচিত লালন গীতি দেহতত্ত্ব-সমর্পিত হলেও কেউ কেউ প্রথম শ্রেণির গানকেই শুধু বাউল গান বা দেহতত্ত্বমূলক গান বলে নির্দেশ করতে ইচ্ছুক। আবার সুফীবাদী ঐতিহ্য ধারায় লালনগীতিকে তারা ইসলামী মরমীয়া সংগীত নামে চিহ্নিত করতে আগ্রহী। আর বৈষ্ণব পদাবলির ঢঙ্গে রচিত লালনগীতিকে তারা বলতে চান বৈষ্ণব পদাবলি। কিন্তু তিনি যেকোনো পরিমণ্ডলে প্রবেশ করে গান রচনা করুন না কেন, সর্বত্রই দেহের জয়গান ও বাউল মনোভাবের আধিপত্য বিদ্যমান। এই কারণে লালনগীতি অন্য গান নয়। এই গান শুধু বাউল গান ।
লালন শাহের কিছু বিখ্যাত গানের কলি নিম্নে বর্ণিত করা হলো।
১। সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে।
২। আছে দীন দুনিয়ার অচিন মানুষ একজনা।
৩। ভক্তের দ্বারে বাধা আছে সই, হিন্দু কি যবন বলে, জাতের বিচার নাই।
৪। চিরদিন পোষলাম এক অচিন পাখি।
৫। কে কথা কয়রে দেখা দেয় না।
৬। জাত গেল জাত গেল বলে একি আজব কারখানা।
৭। বাড়ির কাছে আরশী নগর। ৮। খাচার ভিতর অচিন পাখি ।
৯। পার কর হে দয়াল চাঁদ আমারে।
১০। শুরু আমারে রাখবেন ক'রে চরণ দাসী।
১১। কে তোমার আর যাবে সাথে।
১২। পারে লয়ে যাও আমায় ।
১৩। সময় গেলে সাধন হবে না।
১৪। সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন।
১৫। মন সহজে কি সই হবা।
১৬। ধন্য ধন্য বলি তারে।
১৭। আপন ঘরের খবর নে না।
১৮। চাতক স্বভাব না হ'লে।
১৯। পাখি কখন যেন উড়ে যায়।
২০। দেখনা মন ঝকমারি এই দুনিয়াদারী।
শেষ জীবনে লালন শাহ্ দিনে একবার মাত্র আহার করতেন। ছেঁউড়িয়ার তাঁর সময়ে তৈরি একটি পানের বর ছিল। তিনি প্রত্যহ একশোটি করে গান গ্রহণ করতেন। বৃদ্ধ বয়সে শারীরিক ক্লেশের জন্য তিনি ঘোড়ায় চড়ে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করতেন। তাঁর মাথায় লম্বা চুল ছিল। মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে তিনি পেটের পীড়ায় আক্রান্ত ছিলেন, এবং হাতে পায়ে জলক্ষীত দেখা দেয়। এই সময় তিনি দুখ ছাড়া কিছুই খেতেন না। মৃত্যুর পূর্বের রাত্রে তিনি প্রায় সমস্ত রাত গান করেছিলেন। রাতের শেষ প্রহরে তিনি শিষ্যদের বলেলেন, 'আমি চললাম। এর কিছুক্ষণ পরই তার শ্বাস রোধ হয়। তার আখড়ার ভেতর একটি ঘরে এই মহান প্রতিভাধর মরমী সাধক কবি লালন শাহের সমাধি স্থাপন করা হয়। বর্তমানে পালন শাহের সমাধি কুষ্টিয়া শহরের অনুরে 'ছেঁউড়িয়া' নামক স্থানে বিদ্যমান। লালন শাহের সমাধি নাগণে প্রতি বছর ১ কার্তিক বাউল মেলায় বাউল গানের আসর বসে। এখানে বিভিন্ন দেশ থেকে বড়ো বড়ো সাধক ও বাউলগণ এই মেলায় যোগদান করেন।
মোমতাজ আলী খান
মোমতাজ আলী খান ১৩২৬ সালে মানিকগঞ্জ জেলার এবং সিংগাইর থানার ইরতা কাশিমপুর গ্রামে এক সম্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আফসার উদ্দীন খান। আফসার উদ্দীন অত্যন্ত সৌখিন লোক ছিলেন। তিনি গ্রামে প্রচুর জমি-জমার মালিক ছিলেন। একদিন তিনি লোকমুখে কলের গানের কথা শুনলেন। গ্রামের মানুষ তখন কলের গান শোনেও নি, দেখেওনি। মোমতাজ আলী খানের বাবা একটি কলের গান কিনে আনেন। আফসার উদ্দীন সাহেবের গ্রামের বাড়িতে কলের গান আসার খবর পেয়ে আবালবৃদ্ধবণিতা বাড়িতে এসে ভিড় জমালো। সবাই প্রাণভরে অনেক গান কল- সেদিন কিশোর মোমতাজও একাগ্রচিত্তে প্রথম কলের গান শুনলেন। তখন থেকেই মোমতাজকে গানের নেশায় পেয়ে বসল। তিনি গান শেখাবার জন্য মনে মনে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হলেন। এ সময় তিনি দূরের গ্রামে সারারাত জেগে যাত্রাগান, কবিগান, শোনার জন্য যেতে।
সারারাত গান শুনে এসে নিজে নির্জন স্থানে বসে খালি গলায় গান গাইতেন। এ ছাড়া বাড়ি বাড়ি ঘুরেও সেসব গানগুলো গাইতেন। সামাজিক বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও মোমতাজ এতটুকু বিচলিত নন। তিনি চলে যান। কোলকাতা মেজ ভাই-এর বাসায়।
মোমতাজ আলী খান ১৩২৬ সালে মানিকগঞ্জ জেলার এবং সিংগাইর থানার ইরতা কাশিমপুর গ্রামে এক সম্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আফসার উদ্দীন খান। আফসার উদ্দীন অত্যন্ত সৌখিন লোক ছিলেন। তিনি গ্রামে প্রচুর জমি-জমার মালিক ছিলেন। একদিন তিনি লোকমুখে কলের গানের কথা শুনলেন। গ্রামের মানুষ তখন কলের গান শোনেও নি, দেখেওনি। মোমতাজ আলী খানের বাবা একটি কলের গান কিনে আনেন। আফসার উদ্দীন সাহেবের গ্রামের বাড়িতে কলের গান আসার খবর পেয়ে আবালবৃদ্ধবণিতা বাড়িতে এসে ভিড় জমালো। সবাই প্রাণভরে অনেক গান কল- সেদিন কিশোর মোমতাজও একাগ্রচিত্তে প্রথম কলের গান শুনলেন। তখন থেকেই মোমতাজকে গানের নেশায় পেয়ে বসল। তিনি গান শেখাবার জন্য মনে মনে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হলেন। এ সময় তিনি দূরের গ্রামে সারারাত জেগে যাত্রাগান, কবিগান, শোনার জন্য যেতে।
সারারাত গান শুনে এসে নিজে নির্জন স্থানে বসে খালি গলায় গান গাইতেন। এ ছাড়া বাড়ি বাড়ি ঘুরেও সেসব গানগুলো গাইতেন। সামাজিক বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও মোমতাজ এতটুকু বিচলিত নন। তিনি চলে যান। কোলকাতা মেজ ভাই-এর বাসায়। মোমতাজ যে বাড়িতে থাকতেন একদিন সে বাড়ির ভিতর থেকে ভেসে এলো গানের সুর। মমতাজ ভিতরে গিয়ে দেখলেন তার গ্রামের অনেককে। তারা মমতাজকে গান গাইবার জন্য অনুরোধ করলেন। গানের আসরে যিনি হারমোনিয়াম বাজাচ্ছিলেন তিনি হলেন ওস্তাদ নেছার হোসেন। তিনি মোমতাজের গান শুনে প্রশংসা করলেন এবং গান শিখবার জন্য অনেক উৎসাহ দিলেন। ওস্তাদ নেছার সাহেব চলে যাওয়ার সময় মোমতাজকে গান শিখানোর প্রতিশ্রুতি দিলেন এবং নিজের বাসার ঠিকানাও দিয়ে গেলেন।
এরপর সংগীত-পাগল মোমতাজ পরের দিনই ওস্তাদ নেছার সাহেবের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলেন। এভাবেই
প্রস্তাদের বাড়িতে মোমতাজ গানের তালিম নেওয়া শুরু করলেন।
এভাবেই একদিন দেখা হয়ে গেল ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু সাহেবের সাথে। খসরু সাহেব মোমতাজ-এর অপূর্ব কন্ঠস্বর শুনে মুগ্ধ হলেন এবং মোমতাজকে ডেকে বললেন, চাকরি করবেন কি না? তখন মোমতাজ জিজ্ঞেস করলেন, কিসের চাকরি? ওস্তাদ খসরু সাহেব বললেন গানের চাকরি। এতে মোমতাজ অবাক হয়ে গেলেন এবং মনে মনে ভাবলেন, গানের আবার চাকরি হয় নাকি? মমতাজ রাজি হলেন, চাকরি করার জন্য ওস্তাদ খসরু মোমতাজকে নিয়ে এলেন 'সংগীত প্রচার বিভাগে। কবি জসীমউদ্দীন তখন এই বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। কবি বললেন, গানের চাকরির পদ আপাতত খালি নেই, তবে যন্ত্রী হিসেবে নেওয়া যেতে পারে। ইতোমধ্যে এক মজার ঘটনা ঘটে গেল। মোমতাজের গ্রাম থেকে একজন লোক কোলকাতায় এলেন এবং তার হাতে ছিল একটি সুন্দর দোতারা। মমতাজ এক টাকা আট আনা দিয়ে দোতারাটি কিনে ঘরে এনে এক নাপিতের কাছে দোতারা বাজানো তালিম নিতে লাগলেন। ইতোমধ্যে একদিন ওস্তাদ নেছার সাহেব ব্যাপারটা জানতে পেরে তিনি নিজেই মমতাজকে দোতারায় তালিম দিতে শুরু করলেন। অতি অল্প সময়ইে মোমতাজ দোতারা বাজনায় পারদর্শী হয়ে উঠলেন। এই শিক্ষাকে সম্বল করেই তার চাকরি হয়ে গেল— 'সংগীত প্রচার বিভাগে" দোতারা বাদক হিসেবে। আব্বাসউদ্দিন আহমদ, আবদুল আলীম এবং শেখ লুতফুর রহমান গাইতেন আর দোতারা বাজাতেন মোমতাজ আলী খান।
এরপরও তিনি সংগীত শিল্পী হওয়ার দুরন্ত বাসনা সযত্নে লালন করে রাখতেন বুকের মাঝে। একবার সিংগীত প্রচার বিভাগের এক অনুষ্ঠানে গান গাইতে গিয়েছিলেন বিশিষ্ট শিল্পীরা। কিন্তু অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা মাইকের কোনো ব্যবস্থা করতে পারেননি। তার ফলে শ্রোতাদের মধ্যে দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা। এই সময় মোমতাজ অনুষ্ঠানে গান গাইবার জন্য কবি জসীমউদ্দীন সাহেবের কাছে অনুরোধ জানালেন। কবি মোমতাজকে গান গাইবার জন্য অনুমতি দিলেন। মোমতাজ অপূর্ব কণ্ঠে ধরলেন ভাটিয়ালি গান। শ্রোতারা মুগ্ধ হলেন, তাঁর গান শুনে। গান শেষ হওয়ার পর কবি জসীমউদ্দীন সাহেব খুশি হয়ে মোমতাজকে দশ টাকা পুরস্কার দিলেন। এরপর তার গায়ক হিসেবে চাকরি হয়ে গেল 'সংগীত প্রচার বিভাগে।
পরে আর একটি অনুষ্ঠানে মোমতাজের গান শুনলেন তৎকালীন 'অল ইন্ডিয়া রেডিও'র অনুষ্ঠানের প্রযোজক সাদেকুর রহমান সাহেব। তিনি মোমতাজের গান শুনে তাঁকে রেডিওতে কন্ঠস্বর পরীক্ষা দিতে বললেন। মোমতাজ যথাসময় রেডিওতে কন্ঠস্বর পরীক্ষা দিয়ে পাশ করলেন। এরপর থেকে নিয়মিত প্রোগ্রাম করতে থাকেন (অল ইন্ডিয়া রেডিওতে)। এটা আনুমানিক ১৯৪৩/১৯৪৪ সালের কথা। এরপর সাদেকুর রহমান সাহেব মোমতাজকে নিয়ে গেলেন আমোেফান কোম্পানিতে। সেখানে মোমতাজ রেকর্ড করলেন দুইটি গান। গান দুইটি হলো:
১। ও শ্যাম বন্ধুরে তোর লাইগ্যা
মোর প্রান কাদেৱে । ২। রাধে ভাবিলে আর কি হবে,
শ্যাম তোমারে ফাঁকি নিয়া
সেই সময়ে রেকর্ডকৃত গান দুইটি প্রচুর জনপ্রিয়তা পায়। তিনি গানের রয়েলটি (সম্মানী) পেলেন আটশত টাকা।
দেশ বিভাগের পর তিনি পূর্ব বাংলার চলে আসেন। এরপর ১৯৫০ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ইতোমধ্যে তিনি 'সংগীত প্রচার বিভাগ এর চাকরি ছেড়ে দিয়ে অনিয়মিত শিল্পী হিসেবে রেডিওতে যোগদান করেন। সেই সময়ে রেডিও পাকিস্তান ছিল পুরানো ঢাকার নাজিমউদ্দীন রোডে। পরে ১৯৬০ সালে রেডি পাকিস্তান স্থানান্তরিত করা হয় শাহবাগে। তিনি নীলিন রেডিওতে চাকরি করেন এবং ১৯৬৫ সালে রেডিওয় চাকরি ছেড়ে দিয়ে যোগদান করেন তৎকালীন পি. আই. এ-এর নিজ শিল্পী হিসেবে অর্টিস একাডেমিতে। চাকরি নিয়ে তিনি চলে গেলেন তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে (বর্তমান পাকিস্তান)। ১৯৭১ সালে মাত্র বারো দিনের ছুটি নিয়ে বেড়াতে এসেছিলেন ঢাকায়। এর মধ্যে শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। তিনি আর ফিরে গেলেন পশ্চিম পাকিস্তানে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মোমতাজ আলী খান যোগদান করলেন বাংলাদেশ বিমাে তিনি সরকারি সাংস্কৃতিক দলের প্রতিনিধি হয়ে বহুবার বিভিন্ন দেশে গান পরিবেশন করে প্রচুর প্রশংসা অর্জন
করেছেন।
মোমতাজ আলী খান সুরারোপিত অসংখ্য জনপ্রিয় গান তাঁর ছাত্র-ছাত্রীরা এখনও বেতার ও টেলিভিশনে নিয়মিত পরিবেশন করে থাকেন। তার অনেক গান শিল্পীয়া রেকর্ড করেছেন এবং তিনি নিজেও বহুগান রেকর্ড করেছেন। ১৯৮১ সালে তাকে অটীয় 'একুশে পদক' পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। সংগীত সাধক মোমতাজ আলী খান ১৯৯০ সালের ৩১ আগস্ট মারা যান।
রাধারমণ দত্ত (১২৪১-১৩২২)৷
সাধক কবি রাধারমণ দত্ত ছিলেন বীরভূম জেলার অধিবাসী চক্রপাণি দত্তের বংশোদ্ভূত। চক্রপাণি দত্ত ছিলেন তৎকালীন যুগের সবচেয়ে বড়ো পণ্ডিত। চক্রপাণি দত্ত সিলেটের রাজা প্রথম গোবিন্দকেশব সেন (ভাটেয়া তাম্রশাসন অনুযায়ী ১০৪৯ খ্রিস্টাব্দে) এর চিকিৎসার জন্য তিন পুরন সিনেটে আসেন। পরবর্তীকালে ভা দুই পুত্র সিলেটে থেকে যান কিন্তু তিনি জ্যেষ্ঠপুত্রসহ বীরভূমে ফিরে যান। আর এভাবেই মরুপালি পক্ষের বংশধরেরা পরম্পরার সিলেটে বসবাস করতে থাকেন।রাধারমণের গান বোঝায়। ধামাইল সিলেট অঞ্চলের নিজস্ব নৃত্যগীতি। গ্রামে বিবাহ, উপনয়ন, অন্নপ্রাশন, সাধভক্ষণ, দুর্গাপূজা, মনসাপূজা, সূর্যব্রত প্রভৃতি অনুষ্ঠানে রাধারমণের গান ধামাইল নৃত্যের সাথে পরিবেশিত হয়। ধামাইল গানের নমুনা: উদাহরণ হিসেবে বলা যায় - ১। কেন গো রাই কাঁদিতেছ পাগলিনী হইয়া ২। জলে যাইও না গো রাই
সাধক রাধারমণ এর গানের সংখ্যা আজও অনির্দিষ্ট। অনেক গবেষক দুহাজার বা তিন হাজার গান রচনা করেছেন বলে দাবি করেন। রাধারমণের গানের বাণী প্রায়ই পরিবর্তিত কারণ তিনি নিজে হাতে কোনো গান লেখেননি। সাধক কবি রাধারমণ দত্ত ধ্যানমগ্ন অবস্থায় গান রচনা করে সঙ্গে সঙ্গেই গাইতেন। আর সেই সঙ্গে শিষ্য-প্রশিষ্যরা তার গান শুনে শিখতেন এবং আশ্রমে পরিবেশন করতেন। পরে হয়ত অনেকে সেই গান সংগ্রহ করে লিখেছেন। ১৩২২ বঙ্গাব্দের ২৬ কার্তিক শুক্রবার সাধক কবি রাধারমণ দত্ত ইহধাম ত্যাগ করেন। কেশবপুরে তার নিজ
বাড়িতে মরদেহ ভস্মীভূত না করে বৈষ্ণবমতে সমাহিত করা হয়। তাঁর সমাধিতে এখনও প্রতি সন্ধ্যার প্রদীপ
জ্বালিয়ে কীর্তন করে ভক্তবৃন্দরা তাঁকে স্মরণ করেন।
আবদুল লতিফ (১৯২৫-২০০৬)
আবদুল লতিফ ছিলেন একাধারে সংগীতশিল্পী, গীতিকার ও সুরকার। তিনি বরিশালের রায়পাশা গ্রামে ১৯২৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও ছোটোবেলা থেকেই গানের প্রতি তার আকর্ষণ ছিল। এ আকর্ষণ তাঁর গ্রামে তাঁকে গায়ক হিসেবে পরিচিত করে তোলে। গান গাওয়ার অপরাধে তার ফুফু তাঁকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন ফুফুর কাছে। গানগুলো ছিল ইসলাম বিরোধী। কিশোর আবদুল লতিফ এ ঘটনার আকস্মিকতায় বিচলিত না হয়ে অবিশ্বাসের সঙ্গে ফুফুকে একটি গান শোনাতে চান এবং তিনি সে প্রস্তাবে সম্মত হন। আবদুল লতিফ আল্লাহ-রসুলের প্রশংসায় ভরা আব্বাসউদ্দীনের গাওয়া নজরুলের একটি ইসলামি পান গেয়ে শুনান। গান শুনে ফুপু মুগ্ধ হন এবং তাঁকে গান পাওয়ার অনুমতি দেন। এভাবেই পারিবারিক স্বীকৃতি নিয়ে আবদুল লতিফের শিল্পীজীবনের শুরু।
আবদুল লতিফ যখন সপ্তম শ্রেণির ছাত্র তখন তিনি ১৯৩৯ সালে ১৬ বেঙ্গল ব্যাটেলিয়ান ইন্ডিয়ান টেরিটোরিয়াল ফোর্স এ নির্বাচিত হন। ছয়মাস পর এ ব্যাটেলিয়ন ভেঙে দেওয়া হয়। পরে তিনি কোলকাতায় বসবাস শুরু করেন। সরাসরি রাজনীতিতে যোগ না দিলেও তিনি রাজনীতি সম্পর্কিত সাংস্কৃতিক আন্দোলনে যোগ দেন। চল্লিশের দশকের প্রথম দিকে তিনি কোলকাতার কংগ্রেস সাহিত্য সংঘে যোগ দেন সংস্থার অফিস ছিল কোলকাতার গোপাল মল্লিক লেনে। রাজনীতি সচেতন নতুন শিল্পীদের এখানে গান শেখানোর ব্যবস্থা ছিল। গান শেখাতেন সুকৃতি সেন। আবদুল লতিফ ও তাঁর কাছে গান শেখেন।
আবদুল লতিফ কোলকাতা থেকে ১৯৪৮ সালে ঢাকা আসেন। এখানে বিখ্যাত গায়ক ও সংগীত পরিচালক
আবদুল হালিম চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। ১৯৪৭ পরবর্তীকালে হিন্দু শিল্পী-গীতিকারদের দেশত্যাগের
ফলে পূর্ববাংলায় বড়ো রকমের শূন্যতা সৃষ্টি হয়। এ সঙ্কট মুক্তির লক্ষ্যে তিনি আবদুল লতিফকে গান লিখতে
উদ্বুদ্ধ করেন। ১৯৪৯-৫০ সালে তিনি প্রথমে আধুনিক গান ও পরে লেখেন পল্লিগীতি । আবদুল লতিফের মেজাজে গণসংগীতের উপাদান ছিল। সেটা তাঁর প্রথম জীবনের কোলকাতা - পর্বেই পরিলক্ষিত হয়। কংগ্রেস সাহিত্য সংঘে কোরাসে তারা যেসব গান পাইতেন, তা ছিল গণসংগীত। এটা ছিল তাঁর রন্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত। বরিশালের গ্রামীণ জীবনধারার লোকজ সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁর মানসজগত ছিল গভীরভাবে প্রোথিত। কীর্তন, পাঁচালি, কথকতা, বেহুলার ভাসান, রমানি গান, কবিগান, শুনাই যাত্রা, জারি-সারি, পালকির গান প্রভৃতি সংগীতের সুরকে তিনি নিজের কণ্ঠে ধারণ করেন। তাঁর গানগুলোতে পূর্ব-বাংলার অধিকার বঞ্চিত মানুষের আশা-আকাঙ্খার প্রকাশ ঘটেছে। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের সময়ে লেখা তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বিখ্যাত গান 'ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়। এ গানটিতে তিনি বাংলাদেশের লোকসংগীতের আবহ ও সুরকে ফুটিয়ে তুলেছেন। গানটি পূর্ববাংলার ঐতিহ্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠার এক প্রতীকী গানের বৈশিষ্ট্য অর্জন করে।
আবদুল লতিফ ছিলেন একজন বহুমাত্রিক মানুষ। এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সাথে সূচনালগ্ন
থেকেই যুক্ত ছিলেন বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সৈনিকও তিনি। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে
ফেব্রুয়ারি'- এই বিখ্যাত গানটির প্রথম সুরকার আবদুল লতিফ (পরে শহিদ আলতাফ মাহমুদ গানটির নতুন
সুর করেন। ঐ সময়ে গানটি গাওয়ার পর তদানীন্তন শাসকগোষ্ঠীর রোষাণলে পড়তে হয়েছিল তাকে।
আবদুল লতিফ কেবল সংগীত শিল্পীই ছিলেন না, ছিলেন গণসংগীতের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব, গীতিকার, সুরকার ও ভাষাসৈনিক। পুঁথিপাঠক হিসেবেও তিনি ছিলেন খ্যাতির শীর্ষে। তিনি কাল ও যুগ সচেতন সময়োপযোগী অনেক গানও রচনা করেছেন। ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে তিনি লিখেন: 'দুঃখের দইরা হইবা যদি পার দেখো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর / হাল ধইরা বইসা নৌকায়...।' এ ছাড়া সোনা সোনা সোনা, লোকে বলে সোনা সোনা নয় ভত ঘাঁটি'; 'দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা / কারো দানে পাওয়া নয়, তোরা ঢাকা শহর রক্তে ভাসাইলিসহ অনেক বিখ্যাত ও জনপ্রিয় গানের রচয়িতা তিনি। আবদুল লতিফ যখন গান গাইতেন, দর্শক-শ্রোতারা সে গানের মধ্যে খুঁজে পেতেন চেতনাময় প্রতিবাদের ভাষা। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তাঁর জীবদ্দশায়ই তিনি শতাধিক সম্মাননা ও পদক পেয়েছেন। পেয়েছেন মানুষের অফুরন্ত ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। তিনি ১৯৭১ সালে পেয়েছেন একুশে পদক এবং ২০০২ সালে স্বাধীনতা পদক লাভ করেন।
আবদুল লতিফ সংগীতের নানা শাখায় বিচরণ করেছেন। বাল্যকাল থেকে গ্রামবাংলার জীবনযাপন পদ্ধতি, আচার-অনুষ্ঠান, সংগীতকলার সঙ্গে পরিচিত হলে তাঁর নিজের মধ্যে একটি স্বকীয় বৈশিষ্ট্য লাভ করে। উদার ও মানবিক মূল্যবোধে আবদুল লতিফের সংগীতে পরিস্ফুট হয় অসাম্প্রদায়িক লৌকিক গণচেতনা। তাঁর লিখিত গান সব সংগ্রহ করা যায়নি। তবে তাঁর তিনটি গানের বই পাওয়া গেছে। ১৯৮৫ সালে বাংলা একাডেমি প্রকাশ করে তাঁর 'ভাষার গান', 'দেশের গান'। এতে আছে বাংলা ভাষা-সম্পর্কিত চব্বিশটি গণসংগীত ও দেশের গান একান্নটি দুটি জারি এবং আটটি মানবাধিকার সম্পর্কিত গান। তাঁর অন্য দুটি বইয়ের নাম 'দুয়ারে আইয়াছে পালকি' (মরমী গান) এবং 'দিলরবাব'। গণমানুষের মহান এই শিল্পী ২০০৬ সালের ২৩ ফ্রেব্রুয়ারি মৃত্যু বরণ করেন। আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এবং গানের ভুবনে আবদুল লতিফের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।
আবদুল আলীম (১৯৩১-১৯৭৪)
প্রত্যেক জাতির নিজস্ব সংগীত হচ্ছে তার লোকসংগীত। নিজস্ব সংস্কৃতির ধারক-বাহক হলো লোকসংগীত যা গণমানুষের নিজস্ব সৃষ্টি ও ঐতিহ্য সমৃদ্ধ লোকসংগীত উজ্জ্বল জাতীয় সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে। বাংলাদেশের পল্লিগানের ইতিহাসে আবদুল আলীম এক অবিস্মরণীয় নাম। কন্ঠস্বরের অসাধারণ সহজাত ঐশ্বর্য নিয়ে তিনি জন্মেছিলেন এবং সেক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দী দরাজ কন্ঠের অধিকারী। আবদুল আলীম যখন গান গাইতেন তখন মনে হতো পদ্মা, মেঘনার ঢেউ উছলে পড়ছে শ্রোতার বুকের পাঁজরে। প্রাণের সঙ্গে প্রাণ মিলিয়ে আবদুল আলীম যে গান গাইতেন, সে শুধু বাংলা ভাষা-ভাষীদের মনেই নয়, বিশ্বের সকল সুররসিক- যারা ভাষা জানেন না তাদেরও আপ্লুত করতো।
শিল্পী আবদুল আলীম ১৯৩১ সালের ২৭ জুলাই পশ্চিম বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার তালিবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শেখ ইউসুফ আলী মাতার নাম খাসা বিবি। শিল্পীর বয়স যখন ১০-১১ বছর তখন তাঁর এক সম্পর্কিত চাচা আমের বাড়িতে কলের গান (গ্রামোফোন) নিয়ে আসেন। তিনি তখন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। ভাষা আন্দোলনের বীর শহিদ বরকত তাঁর সহপাঠী। প্রায় প্রতিদিনই তিনি চাচার বাড়িতে গিয়ে গান শুনতেন। পড়াশোনার জন্য গ্রামের স্কুল তাঁকে বেশিদিন ধরে রাখতে পারেনি। তাই কিশোর বয়সেই শুরু করলেন সংগীত চর্চা। আবদুল আলীমের নিজ গ্রামেরই সংগীত শিক্ষক সৈয়দ গোলাম আলীর (ওলু মিয়া) কাছে তালিম নিতে শুরু করেন। ওস্তাদ তাঁর ধারণ ক্ষমতা নিরীক্ষণ করে খুবই আশান্বিত হলেন। গ্রামের লোক আবদুল আলীমের গান শুনে মুগ্ধ হতো। পালা-পার্বণে তাঁর ডাক পড়ত। আবদুল আলীম গান গেয়ে আসর মাতিয়ে তুলতেন। সৈয়দ গোলাম আলী, আবদুল আলীমকে কোলকাতা নিয়ে গেলেন। কিছুদিন কোলকাতা ছায়াছবিতে গান গেয়েছেন। উল্লেখযোগ্য ছায়াছবি গুলো হলো: মুখ ও মুখোশ (১৯৫৬), জোয়ার এলো (১৯৬২), রূপবান (১৯৬৫), আপন দুলাল (১৯৬৬), সুজন সখি (১৯৭৩)। আবদুল আলীমের ভরাট গলা, তাঁর কন্ঠের খাদ ও উপরে দিকে কন্ঠের চলন এক নতুন মাত্রা পায়। তাঁর জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে- হলুদিয়া পাখী সোনারই বরণ, দুয়ারে আইসাছে পাল্কী নাইওরি গাও তোলো, নাইয়ারে নায়ে বাদাম তুইলা, এই যে দুনিয়া কিসের লাগিয়া, পরের জাগা পরের জমিন, প্রেমের মরা জলে ডোবে না অন্যতম। তিনি তদানীন্তন পূর্বপাকিস্তানের প্রথম ছবি 'মুখ ও মুখোশ'-এ কণ্ঠ দেন। তার স্ত্রীর নাম জমিলা খাতুন। তিনি সাত সন্তানের জনক। তিন পুত্র জহির আলীম, আজগর আলীম ও হায়দার আলীম। চার কন্যা আখতার জাহান আলীম, আসিয়া আলীম, নূরজাহান আলীম ও জোহরা আলীম। এরা সকলেই সংগীত শিল্পী।
এ পর্যন্ত তাঁর প্রায় ৪০০-৫০০ গান রেকর্ড হয়েছে। এছাড়া বেতার স্টুডিও রেকর্ডে প্রচুর গান আছে। বাংলাদেশ গ্রামোফোন কোম্পানি (ঢাকা রেকর্ড) শিল্পীর একটি লংপ্লে রেকর্ড বের করেছে। তিনি জীবদ্দশায় ও মরণোত্তর বিভিন্ন পুরস্কার লাভ করেন। এর মধ্যে একুশে পদক (১৯৭১), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, পূর্বাণী চলচ্চিত্র পুরস্কার, বাচসাস পুরস্কার ও স্বাধীনতা পদক (১৯৯৭) উল্লেখযোগ্য। নিখিল পাকিস্তান সংগীত সম্মেলনে পেয়েছিলেন ৫টি স্বর্ণ পদক। তিনি সংগীত কলেজ এর প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই লোকসংগীত বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। পল্লিগানের যে ধারা তিনি প্রবর্তন করে গেছেন সেই ধারাই এখন পর্যন্ত বিদ্যমান। তিনি পল্লি গানের এক আদর্শবান গায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। ১৯৭৪ সালে ৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার পিজি হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আবদুল আলীম তাঁর গানের মাঝে যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকবেন সংগীত পিপাসু মানুষের মাঝে।
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ (১৮৭০-১৯৭২)
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, হিন্দুস্তানি সংগীতের ধারায় এক প্রবাদ প্রতিম নাম। তাঁর জন্ম বাংলাদেশে, বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার শিবপুর গ্রামে। পিতা সংগীতজ্ঞ সবদর হোসেন খাঁ ওরফে সনু খাঁ, আর মাতা সুন্দরী বেগম। সদু খাঁর পাঁচ পুত্র ছমির উদ্দিন খাঁ, আফতাব উদ্দিন খাঁ, আলাউদ্দিন খাঁ, নায়েব আলী খাঁ ও আয়েত আলী খাঁ। পিতা সেতার বাজাতেন। পুত্র আলাউদ্দিনকে আদর করে 'আলম' নামে ডাকতেন। বাল্যকাল থেকেই আলাউদ্দিনের সংগীতের প্রতি গভীর অনুরাগ জন্মে। বড়ো ভাই ফকির আফতাব উদ্দিনের কাছে তার হাতে খড়ি। ছোটো বেলায় তাঁর সংগীত প্রীতি ছিল অধিক। তিনি ছিলেন সুরের পাগল। সুরের অমোঘ আকর্ষণে অতি অল্প বয়সে সকলের অগোচরে, সংগীত শিক্ষার উদ্দেশ্যে ঘর ছাড়া হন। সামান্য পাথেয় সম্বল করে তিনি বাড়ি থেকে বের হয়ে প্রথমে পাশের গ্রামে এক যাত্রা দলে এবং পরে ঢাকা হয়ে কোলকাতায় পৌঁছান।
কোলকাতায় তিনি স্বনাম ধন্য গায়ক নুলো গোপালের সান্নিধ্যে আসেন এবং কণ্ঠসংগীতে তালিম নিতে শুরু করেন। নুলো গোপাল তাকে শর্ত দেন যে, ১২ বছর তাকে কেবল স্বর সাধতে হবে তারপর রাগের তালিম নিতে পারবেন। আলাউদ্দিন সেখানে কঠোর সাধনায় ৭/৮ বৎসর কাটান। তাঁর সংগীত শিক্ষায় যথেষ্ট উন্নতি সাধিত হয়। কিন্তু হঠাৎ শুরু মারা গেলেন। শুরুর মৃত্যুতে আলাউদ্দিন নিদারুণ আঘাত পেলেন। তাই সিদ্ধান্ত নিলেন কণ্ঠসংগীত সাধনা আর করবেন না। এবার শিখবেন যন্ত্রসংগীত।
আলাউদ্দিন খাঁ এই সময়ে অমৃতলাল দত্ত ওরফে হাবু দত্তের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। হাবু দত্তের একটি অর্কেস্ট্রা দল ছিল, নাট্যকার গিরিশ ঘোষের নাট্যদলে এর বাজনা হতো। তিনি দিনের বেলায় সংগীতের তালিম নিতেন এবং রাতে অর্কেস্ট্রার দলে বাজাতেন। সে সময়ে মিনার্ভা থিয়েটারে কিছুদিন চাকরিও করেছিলেন। কয়েকটি বাদ্যযন্ত্রের তালিম তিনি এ সময়ে গ্রহণ করেন। গোয়ানীজ লরো সাহেবের কাছে পাশ্চাত্য রীতিতে এবং অমর দাশের কাছে হিন্দুস্তানি রীতিতে বেহালা বাজানো শেখেন। মৃদঙ্গ বাদক নন্দবাবুর কাছে পাখওয়াজ এবং হাজারী ওস্তাদের কাছে সানাই শেখেন। হাবু দত্তের কাছে তিনি ক্লারিওনেট বাজানোর তালিম নেন। এভাবে তিনি সর্ববাদ্যে বিশারদ হয়ে ওঠেন।
এমন সময় আলাউদ্দিন খাঁ, মুক্তাগাছার (ময়মনসিংহ) রাজা জগৎ কিশোরের দরবারে সংগীত পরিবেশনের
আহ্বান পেলেন। রাজদরবারে তিনি সে যুগের যশস্বী সরোদ বাদক ওস্তাদ আহমদ আলী খাঁর সাক্ষাৎ লাভ
করেন। ওস্তাদ আহমদ আলীর বাজনা শুনে তাঁর কাছে সরোদ শেখার জন্য আলাউদ্দিনের মন ব্যাকুল হয়ে
উঠে। মহারাজা তাকে ওস্তাদ আহমদ আলীর শিষ্য করে দেন। দীর্ঘ চার বছর তিনি গুরুর কাছে সরোদ বাদনের
তালিম নেন।
আলাউদ্দিন খাঁ তানসেন বংশীয় বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ ওয়াজির যাঁর কাছে সংগীতের তালিম নেন। ওয়াজির খাঁ ছিলেন রামপুরের [ভারতের উত্তর প্রদেশে। সভাবাদক। পরে বহু কৌশলে তিনি ওয়াজির খাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে সক্ষম হন। কিন্তু শিষ্যরূপে গ্রহণ করলেও দুই তিন বৎসর তিনি [ওয়াজির খাঁ। কিছুই শেখান নাই আলাউদ্দিন খাঁকে। আলাউদ্দিন খাঁ অপেক্ষা করতে থাকেন তালিমের জন্য, শেষ পর্যন্ত তার অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটে। ওয়াজির বা আলাউদ্দিন খাঁ কে তালিম দিতে শুরু করেন। সুদীর্ঘকাল ওয়াজির খাঁর কাছে শিক্ষা গ্রহণের পর ওয়াজির খাঁ আলাউদ্দিনকে স্বাধীনভাবে সংগীত চর্চার অনুমতি দেন। আলাউদ্দিন বা গুরুর আশীর্বাদ নিয়ে চলে আসেন কোলকাতায়।
১৯১৮ সালে মাইহার এর রাজা ব্রজনাথ আলাউদ্দিনের কাছে সংগীত শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে তাকে গুরুর পদে বরণ করে মাইহারে নিতে সক্ষম হন। তারপর থেকে বাকী জীবন তিনি সেখানেই কাটান। ১৯৩৪-৩৫ সালে উদয় শঙ্করের নৃত্যদলের সঙ্গে তিনি বিশ্বভ্রমণে বের হন। অবাক করেন বিদেশি শ্রোতাদের তার অগাধ পাণ্ডিত্যে। ব্রিটিশ সরকার তাকে 'খাঁ সাহেব' উপাধিতে সম্মানিত করেন। ১৯৫২ সালে তিনি ভারতের সংগীত নাটক একাডেমির শ্রেষ্ঠ পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৫৪ সালে তিনি সংগীত নাটক একাডেমির ফেলো নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সালে 'পদ্মভূষণ' এবং ১৯৭২ সালে 'পদ্মবিভূষণ রাষ্ট্রীয় খেতাব লাভ করেন। দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় সংগীতে অতুলনীয় অবদানের জন্য তাঁকে সম্মানসূচক 'ডক্টরেট' উপাধিতে ভূষিত করেন।
আলাউদ্দিন খাঁ বেশ কয়েকটি নতুন রাগ প্রণয়ণ করেন। সেগুলো হচ্ছে- হেমন্ত, শোভাবর্তী, উমাবতী, নাগার্জুন, দুর্গেশ্বরী, মেঘ-বাহার, প্রভাতবেলী, হেম বিহাগ, মদন মঞ্জুরী প্রভৃতি। সরোদ যন্ত্রের সংস্কার ছাড়াও তিনি চন্দ্র সারং নামে একটি সংগীত যন্ত্র উদ্ভাবনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। সংগীতের আচার্যরূপে আলাউদ্দিন বা নিণ্ডিল্য গৌরব লাভ করেছেন। কৃতী শিষ্যমগুলি গঠন করে তিনি তাঁর সংগীত ধারাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। তাঁর শিষ্যমগুলির মধ্যে যারা বিখ্যাত হয়েছেন তাদের মধ্যে পুত্র ওয়ান আলী আকবর খান, কন্যা রখশন আরা ভরকে অনুপূর্ণ, জামাতা পণ্ডিত রবিশঙ্কর, তিমিরবরণ, পান্নালাল ঘোষ, শ্যাম গাণী, নিহার বিন্দু চৌধুরী, দ্যুতিকিশোর আচার্যচৌধুরী, ভ্রাতৃদু ওয়া হার, ব্যানার্জীর রাণী মানুষ প্রণে নাম উল্লেখযোগ্য।
১৯৭২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর মাইহার রাজ্যে তার নিজস্ব বাসভবনে [ মদিনা ভবন] শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ
করেন। আলাউদ্দিন খাঁর সংগীত জীবন ছিল যেমন সুদীর্ঘ তেমনি ঘটনাবহুল। আমাদের সংগীতের ধারায় তিনি
এক উজ্জল নক্ষত্র, সংগীত সাধনার পথ প্রদর্শক এবং অনুপ্রেরণার উৎস।
চিত্র: স্বামী হরিদাস
উত্তর প্রদেশের আলীগড় জেলার একটি গ্রামে স্বামী হরিদাসের জন্য 'ভক্তসিন্ধু' গ্রন্থে তাঁর জন্ম ১৪৪১ খ্রিস্টাব্দে উল্লেখ রয়েছে। কেউ বলেন ১৪৩৭ খ্রিস্টাব্দে আবার কারও মতে ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিলো স্বামী আবীর এবং মাতার নাম গঙ্গা। আন্তধীর মূলতান জেলার উচ্চশ্রেণির সারস্বত ব্রাহ্মণ ছিলেন এবং স্বামী-স্ত্রী দুজনই বিশেষ ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন। তবে স্বামী হরিদাস জাতীয় স্বামীর পুত্র ছিলেন কিনা সে বিষয়ে অনেকে সন্দেহ পোষণ করেন। তাঁদের
মতে, হরিদাস ছিলেন ধনাঢ্য ব্রাহ্মণ এবং আতধীর সারস্বত ব্রাহ্মণ। সুতরাং তাদের মধ্যে কোনো রক্তের সম্পর্ক থাকা সম্ভব নয়। তাই পুত্র নয় পুত্রসম ছিলেন বলাই হয়তো ঠিক হবে। তবে প্রথম মতটিই অধিকাংশ ব্যক্তি সমর্থন করেন।
সংগীতের সংস্কার নিয়েই হরিদাস জন্মগ্রহণ করেছিলেন। জনে জনে তাঁর সাধক জীবনে সংগী সাধনার পথে একটি প্রধান অবলম্বন হিসেবে পরিগণিত হয়। তিনি মাত্র ২৫ বছর বয়সে বৃন্দাবনে চলে যান। অতঃপর কৃষ্ণ ভজনায় মনপ্রাণ সমর্পণ করেন। হরিদাস ছিলেন নিঃস্বার্থ সম্প্রদায়ক্ত এবং বৃন্দাবনে হরিলালের নামানুসারে 'হরিদাসী সম্প্রদায়' নামে একটি সম্প্রদায় গড়ে ওঠে। তিনি বৃন্দাবনের বাঁকেবিহারীয় মন্দিরটির প্রতিষ্ঠাতা। বৃন্দাবনের নিধুবন নিকুঞ্জে একটি ছোটো কুটিরে সাধন-ভজন করেই তিনি সারাজীবন অতিবাহিত করেছিলেন। সে সময় অন্যান্য দু একজন হরিদাসেরও খোঁজ পাওয়া যায়, সেজন্য হরিদাস স্বামীকে বলা হতো 'আসুনো যाিन হরিদাস স্বামী নন ভাষার ধ্রুপদানের কিছু কিছু পদ রচনা করেছেন। প্রত্যেকটি গানে রাগরূপকে তিি অবিকৃত রেখে সুরারোপ করেছেন এবং তালকে যথে প্রাধান্য দিয়েছেন। শারীরসংগীতে যথাযথ প্রচারের জন্য তিনি যে শিষ্যগুলি তৈরি করেছিলেন, উত্তরকালে তারা সকলেই সংগীতের জগতে এক একজন ি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে তানসেনই ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। অন্যান্যদের মধ্যে রাজা শৌরসে লিবাকর পতিত, সোমনাথ পক্ষিত, রামদাস, বৈজু বাওয়া, গোপাল লাল, মনন রায় প্রমুখের নাম উল্লেযোগ্য।
ধর্ম প্রচারের জন্য সুরারোপ করে নৃত্যসহযোগে তিনি বৃন্দাবনে রানের পদশানের যে প্রচলন করেন তাই
বর্তমান কালের বন্ধখামের রাসলীলা। কেবল রাসলীলা নগ্ন তিনি হোলি গানেরও উন্নততর প্রবর্তক। একই সঙ্গে বাদ্য এবং নৃত্যের যথেষ্ট উন্নতিবিধান করেছিলেন। তিনি ১৫শ শতাব্দীর পরিবর্তিত বাখৰহ্মাবলিকেই গ্রহ এবং ভগবানের গুণকীর্তনের মাধ্যমে তা প্রকাশ করেছিলেন। হরিদাস স্বামীর নামে কয়েকটি গ্রন্থ পাওয়া যায়, যেমন: 'হরিদাসঙ্গী কো' গ্রন্থ, 'স্বামী হরিদাসঙ্গী কা পদ
ইত্যাদি। তবে এই গ্রন্থগুলো তাঁর নামে অন্য কারও রচিত কিনা জানা যায় না। ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি
সেতা করেন।
বারীণ মজুমদার (১৯২১-২০০১)
আগ্রা ও রহিমা ঘরানার যোগ্য উত্তরসাধক বারীণ মামলার ১৯২১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পাবনার রাধানগর গ্রামে অন্যগ্রহণ করেন। পিতা নিপেন্দ্রনাথ মজুমদার, মাতা মনিমালা মজুমদার। পারিবারিক পরিমণ্ডলে সংগীত শিক্ষার শুরু হলেও ১৯৩৮ সালে কোলকাতায় ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছেই প্রথম রীতি অনুযারী সংগীতের তালিম নিতে শুরু করেন। পুত্রের সংগীতের প্রতি আগ্রহ দেখে পিতা জমিদার নিপেন্দ্রনাথ লক্ষ্ণৌ থেকে ওস্তা রঘুনন্দন গোস্বামীকে নিয়ে আসেন এবং বারীণ মজুমদারের ওয়ান হিসেবে নিয়োগ দেন। পরে ১৮৩৯ সালে লক্ষ্ণৌ-এর 'মরিস কলেজ অব মিউজিক' এ সরাসরি তৃতীয় বর্ষে ভর্তি হন এবং বি. মিউজ ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৪৩ সালে তিনি মরিস 'কলেজ অব মিউজিক' থেকে 'সংগীত বিশারদ' ডিগ্রি অর্জন করেন। ইতোমধ্যে তিনি কলেজের অধ্যক্ষ গণিত গ্রীকৃষ্ণ রতনজনকর, অধ্যাপক ডা. এন. না জান হামিन হাসেন সংগীতজ্ঞের কাছে তালিম নেন। পরে স্বতন্ত্রভাবে ছাদ খুी চ ন, আফতাব-এ-মৌলিকী ওভাল ফরাজীর কাছ থেকে সংগীতের তালিম দেন। ১৯৪৭ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময় বারীণ মজুমদার চিরস্থায়ীভাবে পাবনায় চলে আসেন। ১৯৫২ সালের জমিদারি হুকুম দখল আইনের বলে ১৮ বিঘা জমির ওপর নির্মিত তাঁদের বসতভিটাসহ সব পৈতৃক সম্পত্তি সরকারি দখলে চলে যায়। সম্পত্তিহীন এ বিপর্যস্ত পরিস্থিতিতে ১৯৫৭ সালে তিনি ঢাকায় আসেন। ওই বছরেই বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে শাস্ত্রীয়সংগীতের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। এসময় তিনি সংগীতের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে দেশে একটি মিউজিক কলেজ প্রতিষ্ঠার বিষয়ে মনোনিবেশ করেন। তিনি ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সংগীত বিষয়ে সিলেবাস প্রণয়ন করেন। উল্লেখ্য ১৯৫৭ সাল থেকেই তিনি ঢাকা বেতারে নিয়মিত শাস্ত্রীয়সংগীত পরিবেশন করেছেন। ক্রিয়াপরতার সঙ্গে সৃজনশীলতার সংযোগে তিনি অধীত বিদ্যার একটি নিজস্ব পরিবেশনকলা রচনায় সমর্থ হয়েছিলেন।
বারীণ মজুমদার ১৯৬৩ সালের ১০ নভেম্বর কাকরাইলের একটি বাসায় মাত্র ৮৭ টাকা, ১৬জন শিক্ষক এবং ১১ জন ছাত্র-ছাত্রীর সহায়তায় দেশের প্রথম (কলেজ অব মিউজিক) এর কার্যক্রম শুরু করেন। তাছাড়া তিনি শাস্ত্রীয়সংগীতে উচ্চতর প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য 'মনিহার সংগীত একাডেমি' প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৬৫ সাল থেকে তিনি নিয়মিত ঢাকা টেলিভিশনের বিশেষ শ্রেণির শিল্পী হিসেবে শাস্ত্রীয়সংগীত পরিবেশন করতেন। ১৯৬৮ সালে তিনি ডিগ্রি ক্লাসের সিলেবাস তৈরি করে সংগীত মহাবিদ্যালয়কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজে পরিণত করেন এবং ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিষয়ক পরীক্ষা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ সালে সংগীত কলেজের তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্য ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে সংগীত সম্মেলনের আয়োজন করেন। এই সম্মেলনে ওস্তাদ নাজাকত আলী, সালামত আলী, ওস্তাদ আমানত ফতেহ আলী, ওস্তাদ মেহেদী হাসান, ওস্তাদ আসাদ আলী খাঁসহ বহু গুণ শিল্পী অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালে তিনি ভারতের প্রখ্যাত কন্ঠ ও যন্ত্রশিল্পীদের অংশগ্রহণে 'আলাউদ্দিন সংগীত সম্মেল আয়োজন করেন। ১৯৭৩ সালে শিক্ষা কমিশনের অধীন প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের সিলেবাস প্রণয়ন করেন এবং এই কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২-৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের অভিশন ও গ্রেডেশন বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৮১ সাল থেকে তিনি নিয়মিত বিভিন্ন একক সংগীতানুষ্ঠানে গান পরিবেশন করেন। ১৯৮২ সাল থেকে দীর্ঘ সময় তিনি 'সুর সপ্তক' নামে একটি মাসিক পত্রিকায় সম্পাদনার কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
সংগীতে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি অনেক সম্মাননা ও পদকে ভূষিত হন। ১৯৭০ সালে তাঁকে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসের বেসামরিক খেতাব 'তমঘা-ই-ইমতিয়াজ' দেওয়া হয়। ১৯৮৩ সালে তিনি একুশে পদকে ভূষিত হন। একই বছর 'বরেন্দ্র একাডেমি তাঁকে সংবর্ধনা প্রদান করে। তিনি ১৯৮৮ সালে বারীণ মজুমদার 'কাজী মাহবুব উল্লাহ জনকল্যাণ ট্রাস্ট পুরস্কার' ও ১৯৯০ সালে সিধু ভাই স্মৃতি পুরস্কার' লাভ করেন। ১৯৯১ সালে শিল্পকলা একাডেমি তাঁকে গুণিজন সম্মননা প্রদান করেন। ১৯৯৩ সালের জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ তাঁকে 'রবীন্দ্রপদক'-এ ভূষিত করে। ১৯৯৫ সালে বেতার টেলিভিশন শিল্পী সংসদ তাঁকে "শিল্পী- শ্রেষ্ঠ' খেতাব প্রদান করে। ভারতের বিখ্যাত অভিনেতা দিলীপ কুমার আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁকে সম্মাননা পত্র প্রদান করেন। ১৯৯৭ সালে বারীণ মজুমদারকে 'বাংলা একাডেমির ফেলোশিপ প্রদান করা হয়। ১৯৯৮ সালে বারী মনার 'জনকন্ঠ জন সম্মাননা পদক লাভ করেন। ২০০১ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর 'স্বাধীনতা পদক' প্রদান করে। স্বাগসংগীত ও সংগীত শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে অবদানের জন্য বারীণ ম বাংলাদেশের সংগীতের ইতিহাসে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। তাছাড়া তিনি 'সংগীত' ও 'সুর লহরী' নামে দুটি পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন। ২০০১ সালের ৬ অক্টোবর এ তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
ওস্তাদ ফেরাজ খাঁ
ধ্রুপদী সংগীত ধারার সমৃদ্ধি সামনে 'আফতাব এ মৌসিকী ভাল কৈরাজ ধী'র নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এই অনন্য প্রতিভার জাদু স্পর্শে আা ঘরানা তথা ভারতবর্ষের ধ্রুপদী সংগীত ধারা হয়েছিল বেগবান সমৃদ্ধতর। অপূর্ব কন্ঠ, সৃজনী ক্ষমতা ও গারন শৈলীর সৌরভে সারা হিন্দুস্তান হয়েছিল মাতোয়ারা। আগ্রা ঘরানার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিত্ব ওখান ফৈয়াজ খাঁ ১৮৮৬ সালে আমায় এক সম্রাপ্ত সংগীত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। সেকেন্দার রহিলা ঘরানার সংগীত । তাঁর পিতা এবং কিনা হোসেন খাঁ তাঁর চাচা। মাতা আব্বাসী বেগম ছিলেন আগ্রা ঘরানার মিয়া শ্যামরা যা কইয়াম খাঁর পুত্র বলে শুনা যখন এর নাতিন এবং গোলাম আব্বা । রাজ আকাশী বেগমের একমাত্র পুত্র সন্তান। ওাদ ফৈয়াজ খ জন্মগ্রহণ করার আগেই তার পিতা ওাদ সফদর ा মারা যান। এরপর তিনি নানার কাছেই মানুষ হতে থাকেন এবং যৌবনকাল পর্যন্ত তাঁর নান্নিধ্যেই ছিলেন। আগ্রা ঘরানার অপর শাখা অরোগীর খ্যাতিমান সংগীতজ্ঞ ও সংগীত রচয়িতা মেহবুব খাঁ (লখন পিয়া) এর কন্যার সাথে ওস্তাদ ফৈরাজ খাঁর বিয়ে হয়। ফৈয়াজ তাঁর জন্মের আগেই পিতা সফদর খাঁর মৃত্যু হওয়ায় নানা গোলাম আব্বাস বা তাঁকে গান শেখানোর পুরো দায়িত্ব নিয়েছিলেন। গোলাম আব্বাস তাঁর তালিমেই ফৈয়াজ । এছাড়া নানা গোলাম আব্বা যাঁর করুন খাঁর কাছেও তান রা न সংগীতে তালিম পেয়েছেন। শোনা যায় বারো বছর বয়স পর্যন্ত ফৈয়াজ খাঁকে সাতটি শুদ্ধ সুরে সুর ভাঁজতে হয়েছিল। গোলাম আব্বাস ও নবী উভয়েই কৈরাজ শাঁকে অত্যাধিক স্নেহ করতেন। তাঁরা চেয়েছিলেন তাঁদের এই প্রতিভাবান নাভি যেন সারা হিন্দুস্তানের সেরা গাইয়ে হিসেবে বংশের মুখ উজ্জ্বল করে। দৈনিক বারো ঘন্টা করে তাঁকে রেওয়াজ করতে হতো। গোলাম আব্বাসী ও করুন বা ছাড়াও চাচা অরৌলির বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ ওস ফিদা হোসেন খাঁর কাছেও ফৈয়াজ খাঁ কিছুকাল তালিম নিয়েছিলেন। আবার বৈবাহিকসূত্রে তিনি স্বভর মেহৰুৰ খাঁ দরস পিয়া) এর কাছ থেকেও অনেক প্রচলিত ও অপ্রচলিত রাগের গান সংগ্রহ করেছিলেন। ধ্রুপদ, খামার, খেয়াল, ঠুমরি, টপ্পা প্রভৃতি গান শিক্ষার মধ্য দিয়েই তাঁর গানের ভিতটি পড়ে উঠেছিল। তাদ ফৈয়াজ খাঁকে বলা হতো ছন্সের রাজা আর মাহফিলের বাদশা। তাঁর গানের সুখ্যাতি অল্পদিনের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়তে থাকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে। ইতোমধ্যে আমন্ত্রণ আসে হায়দ্রাবাদের নিজামের দরবার থেকে। হায়দ্রাবাদের নিজাম ওস্তাদ
ফৈয়াজ খাঁর গানে মুগ্ধ হয়ে একটি মূল্যবান হীরের আংটি প্রদান করে পুরষ্কৃত করেন। ১৯০৬ সালে মহীশূরের মহারাজা এই অসাধারণ সংগীত শিল্পীর গানে মুগ্ধ হয়ে স্বর্ণপদক ও মূল্যবান বস্ত্রাদি উপহার দিয়ে তাঁকে সম্মানিত করেন। শুধু তাই নয়, ১৯১১ সালে মহীশূরের রাজা' ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁকে 'আফতাব-এ-মৌলিকী' উপাধিতে ভূষিত করেন। ভারতবর্ষের এই বরেণ্য সংগীতগুণির চিত্তাকর্ষক গায়কীতে অভিভূত হয়ে ১৯১৫ সালে বড়োদার মহারাজ তাঁকে দরবারের সভাগায়ক হিসেবে নিযুক্ত করেন। ১৯১৮ সালে ইন্দোরের মহারাজা হোলী উৎসবে সংগীত পরিবেশনের জন্য এই খ্যাতিমান গুণীকে আমন্ত্রণ জানান। তাঁর গানে মুগ্ধ হয়ে মহারাজা তাকে নিজ গলার হীরের মালা প্রদান করেন। ১৯৩৫ সালে ওস্তাদ ফৈয়াজ বা প্রথম কোলকাতায় সংগীত পরিবেশন করার আমন্ত্রণ পান।
তাঁর গানে মুগ্ধ হয়ে কোলকাতার সংগীত রসিক মহল নাগরিক সংবর্ধনা দিয়ে এ অনন্য গুণীকে বরণ করে
নিয়েছিলেন। এছাড়া কোলকাতার বিখ্যাত জোড়াসাঁকোর বাড়িতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ওস্তাদ ফৈয়াজ
গান আলাপ, ধ্রুপদ, খেয়াল গান শুনে মুগ্ধ হয়ে একুশটি মোহর নজরানা দিয়েছিলেন।
কট্টর শাস্ত্রীয়সংগীতের নিয়ম নিষ্ঠার মধ্যে মানুষ হয়েও তিনি এই ঐতিহ্যের গণ্ডির ভিতর থেকেই গানের কাঠামোতে (ফর্মে) এনেছিলেন এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। আর সেই পরিবর্তনের ধারা বেয়ে সৃষ্টি হয়েছিল একটি নিজস্ব গায়ন শৈলী, যা নতুন রূপে-রসে-ভাবে সমৃদ্ধ হয়েছিল। শ্বশুর মেহবুব বাঁ (দরস পিয়া) এর প্রভাবে তিনি 'প্রেমপিয়া' ছদ্মনামে অনেক গান রচনা করেন। সে গানগুলো আজও সংগীত শিল্পীদের কণ্ঠে পরিবেশিত হয়। তাঁর একটি বিখ্যাত ভৈরবী ঠুমরি হলো 'বাজু বন্দ খুল খুল যায়ে। তাছাড়া নট-বিহাগের বিখ্যাত গান 'ঝন ঝন ঝন ঝন পায়েল বাজে' তাছাড়া মিয়া কি টোড়ী রাগে অননকে লড়াই লাইড়য়ে সবরণী' প্রভৃতি গানগুলো আজও জনপ্রিয়।
ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁর ছিল অপূর্ব জোয়ারি পূর্ণ কন্ঠের আওয়াজ। আর সে আওয়াজে ছিল সুর-গমকের গভীর গর্জন। তার গায়কির মর্ম হলো গভীর আওয়াজ, দেওয়া হলকার তান, আর বাট বোলের এক অপরূপ সমন্বয়। আলাপচারীতে তিনি রি, রে, নোম, তোম প্রভৃতি অর্থহীন শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে যে রাগরূপ প্রতিষ্ঠা করতেন তা ছিল অতুলনীয়। তাঁর গানে শান্ত সমাহিত স্বর-বিস্তার, নীড়, গমক ও লয়কারী ইত্যাদির চমকপ্রদ প্রয়োগ থাকত। বোল বাটে যে 'রঙরস' তিনি দিতেন তা ছিল এক কথায় অনবদ্য সংগীত। ওস্তাদ ফৈয়াজ বা এমন এক সৌন্দর্যজ্ঞান ও সাংগীতিক বুদ্ধি সম্পন্ন কলাকার ছিলেন যে, যখন তিনি ধ্রুপদ-ধামার গাইতেন তখন মনে হতো আজন্য তিনি এগুলোর মধ্যেই লালিত হয়েছেন। যখন খেয়াল গাইতেন তখন মনে হতো তিনিই শ্রেষ্ঠ। খেয়ালিয়া। আবার যখন ঠুমরি, দাদরা, গজল প্রভৃতি গাইতেন তখন মনে হতো জীবনভর তিনি এগুলোরই সাধনা করে এসেছেন। মোটকথা ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁর গান ছিল কলা, রুচি ও পাণ্ডিত্যের এক নন্দিত সমন্বয়।
ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁর শিষ্যবর্গের মধ্যে দিলীপ চন্দ্র বেনী, শ্রীকৃষ্ণ রতনজনকার, নরেন্দ্রনাথ শুক্লা, মোহন সিং স্বামী বল্লভ দাস, আসাদ আলী খাঁ, মৌজুদ হুসেন খাঁ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। বাঙালি শিষ্যবর্গের মধ্যে ছিলেন জ্ঞানেন্দ্র প্রসাদ গোস্বামী, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, রঙ্গীন চট্টোপাধ্যায়, প্রমোদ গাঙ্গুলী, ননী গোপাল বন্দ্যোপাধ্যায়, দীপালী নাগ প্রমুখ। আর নিকটতম আত্মীয়দের মধ্যে শিষ্য ছিলেন খাদিম হুসেন খাঁ, আতা হুসেন খাঁ, ফিদা হুসেন খাঁ লতাফাৎ হোসেন খাঁ, শরাফত হোসেন খাঁ প্রমুখ।
আগ্রা ঘরানার ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ ছিলেন ভদ্র, রুচিশীল, দয়ালু, অতিথি বৎসল, সৌখিন ও সুগন্ধীর মর্যাদা সম্পন্ন
এক উদার মানুষ। সৌম্য-শান্ত স্নিগ্ধ-কান্তি বিশিষ্ট এই অনন্য মানুষটি নিজ গুণে ভারতবর্ষের সংগীত ইতিহাসে
এক বিশেষ স্থান অধিকার করে খ্যাতির চরম শীর্ষে আরোহণ করেছিলেন । "আফতাব-এ-মৌসিকী ওস্তাদ ফৈয়াজ । ১৯৫০ সালের ৫ নভেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন ঐতিহাসিক বড়োদার শ্বেত পাথরের ছত্রীওয়ালা এক কবরে।
আরও দেখুন...