এ অধ্যায়ে পুষ্টিগত গুরুত্ব আলোচনার সময় আমরা ক্যালরি ও কিলোক্যালরি সম্বন্ধে ধারণা পেরেছি। একজন পূর্ণবয়সের শারীরিক পরিশ্রম করা মানুষের দৈনিক ২০০০-২৫০০ কিলোক্যালরি খাবার গ্রহণ করা উচিৎ। ভিটামিন, খনিজ লবণ এবং রাফেজ বা আশেঁর জন্য এর সাথে প্রয়োজনীয় শাক-সবজি এবং ফল খাওয়া প্রয়োজন।
১.৩.১ সুষম খাদ্য
খাদ্য কী এবং খাদ্যের উপাদানসমূহ কী কী, আমরা সেটি এর মাঝে জেনে গেছি। প্রয়োজন থেকে কম খেলে যেরকম আমাদের স্বাস্থ্যহানি হয়, ঠিক সেরকম প্রয়োজন থেকে বেশি খেলেও স্বাস্থ্যহানি হয়। বেশী খেয়ে স্থূলকার হয়ে যাওয়া উন্নত বিশ্বের মানুষের একটি বড় সমস্যা। তাই আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য সব সময় সুষম খাবার খাওয়া প্রয়োজন।
সুষম খাদ্য বলতে কোনো নির্দিষ্ট খাদ্যবস্তুকে বোঝায় না। যে খাদ্যে ছয়টি উপাদানই গুণাগুণ অনুসারে উপযুক্ত পরিমাণে থাকে এবং যে খাদ্য গ্রহণ করলে দেহে স্বাভাবিক কাজ-কর্মের জন্য উপযুক্ত পরিমাণ ক্যালরি পাওয়া যায়, তাকে সুষম খাদ্য (বা ব্যালান্সড ডায়েট) বলে। যেমন: একজন পূর্ণবয়স্ক সুস্থ কর্মশীল পুরুষের প্রতিদিন প্রায় ২৫০০ এবং নারীর বেলায় ২০০০ কিলোক্যালরি শক্তির প্রয়োজন। এ শক্তি বা ক্যালরি আমরা খাদ্য থেকে পাই। সেজন্য আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় এমন ধরনের খাদ্য থাকা দরকার, যাতে সে খাদ্যের মধ্যে ছয়টি উপাদানই সঠিক পরিমাণে থাকে।
সুষম খাদ্যতালিকা তৈরির সময় মানুষের বয়স, লিঙ্গভেদ, কী রকম কাজ করে (অর্থাৎ অধিক পরিশ্রমী, মাঝারি পরিশ্রমী নাকি স্বল্প পরিশ্রমী) ইত্যাদি বিবেচনা করা দরকার। শিশু ও বৃদ্ধদের খাদ্যতালিকায় সহজপাচ্য এবং চর্বি বর্জিত খাদ্যের প্রাধান্য থাকতে হবে। বাড়ন্ত শিশুদের ক্ষেত্রে প্রোটিনজাতীয় খাদ্য এবং হাড় ও দাঁতের বৃদ্ধির জন্য ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসসমৃদ্ধ খাদ্য থাকতে হবে। গর্ভবতী নারীদের খাদ্যতালিকায় রক্ত উৎপাদনের জন্য এবং ভ্রূণস্থ শিশুর বৃদ্ধির জন্য বাড়তি প্রোটিন, ক্যালসিয়াম ও আয়োডিন থাকা খুবই প্রয়োজন। কোনো নির্দিষ্ট সুষম খাদ্য প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না। সুষম খাদ্য তৈরি করে নিতে হয়।
সুষম খাদ্য পিরামিড
যেকোনো সুষম খাদ্যতালিকায় শর্করা, শাক-সবজি, ফলমূল, আমিষ এবং স্নেহ বা চর্বিজাতীয় খাদ্য অন্তর্ভুক্ত করতে হয়। তোমরা নিশ্চয়ই এর মাঝে লক্ষ করেছে যে একজন কিশোর বা কিশোরী, প্রাপ্ত বয়স্ক একজন পুরুষ বা নারীর সুষম খাদ্যতালিকা লক্ষ করলে দেখা যায় যে তালিকায় শর্করার পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। স্নেহ ও চর্বি জাতীয় খাদ্যকে সাজালে যে কাল্পনিক পিরামিড তৈরি হয়, তাকে সুষম খাদ্য পিরামিড বলে। এই পিরামিডের দিকে তাকালেই কোন ধরনের খাদ্য উপাদান কতটুকু খেতে হয় তার একটা ধারণা পাওয়া যায়।
১.৩.২ উন্নত জীবনযাপনের জন্য খাদ্য উপাদান বাছাই
সব মানুষের খাদ্যাভ্যাস এক রকম নয়। প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক কারণে খাদ্যদ্রব্যের প্রাপ্যতাও সব দেশে এক রকম নয়। শীত ও গ্রীষ্মের প্রকোপ অনুসারেও খাদ্যের প্রয়োজন এবং পার্থক্য রয়েছে। সকল পরিবেশে মানিয়ে চলাই হচ্ছে জীবনের লক্ষ্য। এ জন্য দেহের গঠন ও বৃদ্ধিতে এবং শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন করতে মূল খাদ্য উপাদানগুলোর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে মূল উপাদানগুলোর পরিমাণ এবং ক্যালরি ভ্যালু বিচার করে উন্নত জীবনযাপনের জন্য খাদ্য উপাদান বাছাই করতে হয়।
আমরা খাদ্য পিরামিডে কোন জাতীয় খাদ্য উপাদান কতটুকু খেতে হয় সেটা দেখিয়েছি। এখন আমরা বলব এই খাদ্য উপাদান ব্যবহার করে কী কী খাদ্য তৈরি করা যায়। যেমন খাদ্য পিরামিডের দেখানো তেল কিংবা মাখন সরাসরি খাওয়া হয় না, সেটি ব্যবহার করে অন্য খাবার প্রস্তুত করা হয়।
পুষ্টি বিশারদগণ এই খাবারকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। এগুলো হলো:
১. মাংস, মাছ, ডিম ও ডাল (মটর, ছোলা কিংবা বাদাম)।
২. পনির ও দই।
৩. সকল ভোজ্য ফল এবং খাওয়ার উপযোগী সবজি।
৪. শস্য ও শস্যদানা থেকে তৈরি খাবার যেমন: রুটি, ভাত ।
সুষম খাদ্য পেতে হলে প্রতিদিন এই চার শ্রেণির খাদ্য খেতে হবে। এই চার শ্রেণি থেকে খাদ্য নির্বাচনে বৈচিত্র্য থাকা উচিত বলে পুষ্টিবিদগণ মনে করেন। খাবার তৈরি করার সময় লক্ষ রাখতে হবে সেখানে যেন আমিষ, শর্করা, স্নেহ পদার্থ, ভিটামিন ও খনিজ লবণ থাকে।
সকালের খাবার আমাদের দেশে অত্যন্ত হালকা ধরনের হয়ে থাকে। আজকাল গ্রাম বা শহরে প্রায় সর্বত্রই বয়স্কদের সকালের দিকে চা পান করতে দেখা যায়। চায়ের সাথে অন্তত হালকা কিছু খাবার গ্রহণ করা উচিত। সকাল বেলায় খাবার হিসেবে রুটি, মাখন বা একটি ডিম, একটি কলা খেতে পারলে দেহের যাবতীয় পুষ্টি উপাদানগুলো সংগ্রহ করা সহজ হবে। গরমের দিনে আখের গুড়ের সাথে চিড়া ভিজিয়ে খেলে শরীর সুস্থ থাকে।
আমাদের দেশে দুপুরের খাবারকে সাধারণত প্রধান খাদ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দুপুরের খাবারের খাদ্য উপাদান ৰাছাইয়ে অবশ্যই সুষম খাদ্যতালিকার সাহায্য নিয়ে সেভাবে খাদ্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। গরমের দেশে মাছ প্রোটিনের উৎকৃষ্ট উৎস। তবে শীতকালে মাছের সাথে মাংস খাবারের মাঝে বৈচিত্র্য এনে দেবে। খাওয়ার শেষে দই অথবা ফল খাদ্যতালিকায় থাকলে ভালো হয়।আমাদের দেশে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের ও চাকরিজীবীদের অনেকেরই দুপুরে খাবার সময় ঠিক থাকে না। তাই তারা বিকেলে কিছু হালকা খাবার খেয়ে থাকেন। আর্থিক অবস্থা অনুযায়ী বিকেলের জন্য এমন খাদ্যের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত, যেন সকল ধরনের খাদ্য উপাদান থাকে।
রাতের খাবার সাধারণত সহজপাচ্য হওয়া উচিত। এজন্য রাতে আমিষজাতীয় খাবার কম খাওয়া ভালো। ছাত্রছাত্রীদের প্রতিদিন রাতে শোয়ার আগে আর্থিক সামর্থ্য অনুসারে দুধ বা অন্য শক্তি উৎপাদক তরল খাদ্য গ্রহণ করা উচিত। এভাবে খাদ্য বাছাই করে উন্নত জীবন যাপন করা যেতে পারে।
ফাস্ট ফুড বা জাঙ্ক ফুড
ফাস্ট ফুড বা জাঙ্ক ফুড হচ্ছে এমন এক ধরনের খাবার, যা স্বাস্থ্যগত উপাদানের পরিবর্তে মুখোরচক স্বাদের জন্য উৎপাদন করা হয়। এগুলো খেতে খুব সুস্বাদু মনে হতে পারে, কিন্তু বেশির ভাগ সময়েই এই খাবার শরীরের জন্য ভালো নয়। সুস্বাদু করার জন্য এতে প্রায়শই অতিরিক্ত রাসায়নিক পদার্থ থাকে যেগুলো অস্বাস্থ্যকর। ফাস্টফুডে সাধারণত প্রচুর পরিমাণে প্রাণিজ চর্বি ও চিনি থাকে। বার্গার, ফ্রায়েড চিকেন, পিজ্জা, চিপস, মচমচে ভাজা খাবার, কেক কিংবা বিস্কুটে উচ্চমাত্রায় প্রাণিজ চর্বি থাকে। সফ্ট ড্রিংক, কোলা কিংবা লেমনের মতো গ্যাসীয় পানীয়তে অতিরিক্ত চিনি থাকে। আমরা যখন অধিক পরিমাণে চর্বিজাতীয় খাবার খাই, তখন আমাদের দেহ এগুলোকে চর্বিকলায় রূপান্তরিত করে এবং অধিক পরিমাণে চিনি আমাদের দাঁত ও ত্বককে নষ্ট করে দিতে পারে। ফাস্ট ফুড কখনো সুষম খাদ্যের মধ্যে পড়ে না। ফার্স্ট ফুডে আমাদের জন্য দরকারি ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের অভাব রয়েছে। ফার্স্ট ফুড খাওয়ার কারণে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের দেহ স্থূলকায় হয়ে পড়ে। প্যাকেট বা কৌটাজাত খাবারের চেয়ে প্রাকৃতিক সজীব খাবার স্বাস্থ্যের জন্য অনেক ভালো।
কাজ: কোনো একটি ফাস্ট ফুড জাতীয় খাবার নিয়ে তার মাঝে কোন কোন খাদ্য উপাদান আছে এবং কোনটি নেই তার তালিকা কর। |
আরও দেখুন...