৩. খাদ্যনিরাপত্তা:
খাদ্যনিরাপত্তা কী?
খাদ্যনিরাপত্তা বলতে খাদ্যের প্রাপ্যতা, খাদ্য ক্রয় করার ক্ষমতা এবং খাদ্যের পুষ্টি—এই তিনটি বিষয়কে বোঝানো হয়। অবশ্য বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যে যেহেতু খাদ্যশস্য, বিশেষ করে চাউলের প্রাধান্য রয়েছে, সেহেতু চাউলের সরবরাহ এবং মূল্যের স্থিতিশীলতাই খাদ্যনিরাপত্তা অর্জনের মূল বিষয় । বাংলাদেশে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার প্রকৃতি বাংলাদেশের বিপুল জনগোষ্ঠী খাদ্যভিত্তিক দারিদ্র্যের শিকার। মাথাপিছু দৈনিক প্রয়োজনীয় ২,১২২ কিলোক্যালরি গ্রহণ করার জন্য পর্যাপ্ত খাবার কেনার সামর্থ্য তাদের নেই । খাদ্যে ক্যালরি ঘাটতি ছাড়াও এই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্য সুষম নয় । তাদের প্রতি বেলার খাদ্যেই শস্যের প্রাধান্য রয়েছে । তারা প্রতিদিন যে ক্যালরি গ্রহণ করে, তার ৮০ শতাংশই আসে শস্য হতে, যার মধ্যে চাউলই প্রধান । চর্বি, তেল এবং প্রোটিনযুক্ত খাদ্য তারা সামান্যই গ্রহণ করে । এই ধরনের সমতাহীন খাদ্য গ্রহণের ফলে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় বিশেষভাবে শিশুদের পুষ্টিহীনতা দেখা দেয়।
খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার কারণ:
১. কম খাদ্য উৎপাদন : জনসংখ্যার তুলনায় দেশে ফল, ডাল, তৈলবীজ, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ইত্যাদির উৎপাদন কম। অন্যদিকে জনগণের ক্রয় ক্ষমতার স্বল্পতার কারণে দেখা দেয় খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা ।
২. জনগণের কম আয় : আমাদের দেশের জনগণের মাথাপিছু আয় বিশ্বের বেশিভাগ দেশের তুলনায় কম । জনগণের মাথাপিছু আয় কম হলে তাদের পক্ষে প্রয়োজন অনুযায়ী খাদ্য কেনা সম্ভব হয় না । ফলে দেখা দেয় খাদ্যের নিরাপত্তাহীনতা ।
৩. পুষ্টি জ্ঞানের অভাব : জনগণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের মধ্যে পুষ্টি জ্ঞানের অভাব রয়েছে । আর এই জ্ঞানের অভাবের কারণে তারা সঠিক স্বাস্থ্য উপযোগী খাদ্য বেছে নিতে পারে না ।
বর্তমানে সরকার দেশে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। পাশাপাশি প্রয়োজন অনুযায়ী খাদ্যশস্য ও অন্যান্য ভোগ্যপণ্য আমদানি করছে। এছাড়া সরকার স্বল্পমূল্যে দরিদ্র লোকজনের খাদ্য ক্রয় করার সুযোগ প্রদান করে থাকে। বিশেষভাবে দুর্যোগের সময় দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে খাদ্য সহায়তা প্রদান করে। তবে খাদ্য সহায়তা কর্মসূচীর মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না ।
খাদ্যনিরাপত্তা অর্জনের উপায়:
খাদ্যনিরাপত্তা অর্জনে দরকার হয় একটি সঠিক খাদ্যনীতি। দারিদ্র্য নিরসনের মাধ্যমে খাদ্যনিরাপত্তা বিধানই বাংলাদেশের খাদ্যনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ । সরকার কর্তৃক শস্য মজুদ জরুরি অবস্থায় খাদ্যশস্যের ন্যূনতম সরবরাহকে নিশ্চিত রাখে । প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কোনো কারণে খাদ্যঘাটতি দেখা দিলে দরিদ্র শ্রেণি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। আর এই সংকট মোকাবেলায় সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি গ্রহণ করে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মোট ব্যয়ের ৯৫ শতাংশ ব্যয় হয় খাদ্য বিতরণ কর্মসূচি বাস্তবায়নে। এর মধ্যে রয়েছে ত্রাণ প্রদান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আয় উপার্জনকারী দক্ষতা বৃদ্ধি এবং অবকাঠামো উন্নয়ন। সরকারের খাদ্য সাহায্য কর্মসূচিগুলোর মধ্যে Vulnerable Group Development (VGD), Food For Education 4 Vulnerable Group Feeding (VGF) –এই তিনটি কর্মসূচি অন্যতম।
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি বাজার কাঠামো ও বিপণন ব্যবস্থা আধুনিকীকরণ প্রয়োজন। কারণ কৃষকগণ যদি খাদ্য উৎপাদন ও বিপণনে সহায়তা না পায় তবে তারা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। এছাড়া খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে কৃষককে সহজ শর্তে ঋণ দিলে কৃষক এই ঋণ ব্যবহার করে উৎপাদন বৃদ্ধির চেষ্টা করবে।
এছাড়া খাদ্যে ভেজাল খাদ্যের নিরাপত্তার একটি বিরাট প্রতিবন্ধকতা। মানবস্বাস্থ্যের জন্যও তা মারাত্মক ক্ষতিকর। প্রচলিত আইন ব্যবহার করে এবং প্রয়োজনবোধে আইন সংস্কার করে ও সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে সরকার কর্তৃক খাদ্যে ভেজাল নিয়ন্ত্রণ করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে ।
খাদ্যনিরাপত্তা অর্জনে নাগরিক হিসেবে আমাদের করণীয়:
২০০০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত ৪৪ শতাংশ মানুষ । ২০০৫ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৪০ শতাংশে। এই হতদরিদ্র মানুষ খাদ্যের ন্যূনতম চাহিদা পূরণ করতে পারে না । নাগরিক হিসেবে খাদ্যনিরাপত্তা অর্জনের জন্য আমাদের সকলের দায়িত্ব রয়েছে। খাদ্যনিরাপত্তা সম্পর্কে আমরা ভালোভাবে জেনে তা নিশ্চিত করতে নিজেরা উদ্যোগ নিতে পারি। বাড়ির আশেপাশে খালি জায়গায় আমরা নানা রকম শস্য চাষ করে শস্যের চাহিদা মেটাতে পারি । ব্যক্তিগতভাবে আমরা প্রত্যেকেই খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে সচেতন হয়ে নিজের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারি ।
আরও দেখুন...