Admission
সাহিত্য কণিকা (বাংলা) - কৃষি শিক্ষা - দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পারিবারিক দুগ্ধ খামার

গাভী পালন একটি লাভজনক ব্যবসা । একজন মানুষের বছরে প্রায় ৯০ লিটার দুধ পান করা দরকার। কিন্তু আমাদের দেশের একজন মানুষ বছরে গড়ে প্রায় ১০ লিটার দুধ পান করে থাকে। তাই দেশে দুধের উৎপাদন ও চাহিদার ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। বিদেশ থেকে গুঁড়া দুধ আমদানি করে এই ঘাটতি আংশিক পূরণ করা হয়। দেশে দুধের ঘাটতি থাকায় বিগত দুই দশকে মানুষের মধ্যে গাভী পালন ও দুগ্ধখামার স্থাপনে বেশ আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে । বর্তমানে গ্রাম থেকে শহর ও উপশহরে অনেকেই পারিবারিকভাবে গাভী পালন করছেন। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গাভী পালনে গাভীর বাসস্থান ও খাদ্যের প্রতি অধিক গুরুত্ব দিতে হবে । গাভী পালন করে স্বকর্মসংস্থান বাড়ানো যায়, ভূমিহীন ও প্রান্তিক চাষিদের আয় বাড়ানো যায় এবং পরিবারের পুষ্টি ও বাড়তি আয়ের ব্যবস্থা করা যায় । সুতরাং আমরা নিজের বাড়িতে পারিবারিক খামার করে ২-৫টি গাভী পালনের মাধ্যমে আয়ের পথ সুগম করে দুধের চাহিদা মেটাতে পারি । উন্নত জাতের গাভীর খামার স্থাপনের পরিকল্পনা করতে হবে। পারিবারিক পর্যায়ে ২-৫টি গাভী সমন্বয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খামার স্থাপন করা যায়। সাধারণত ৫টি বা তদূর্দ্ধ গাভী সমন্বয়ে বাণিজ্যিক খামার স্থাপন করা যায়। ঋণের মাধ্যমে মূলধন সংগ্রহ করলে ব্যাংক ঋণ পরিশোধের ক্ষতিয়ান বিবেচনা করে খামার স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয়। খামারের জন্য গাভী নির্বাচনের সময় খেয়াল রাখতে হবে, যাতে উন্নত জাতের অধিক দুগ্ধসম্পন্ন হয় । পারিবারিক দুগ্ধ খামার স্থাপনের জন্য বসতবাড়ির উঁচু স্থান নির্বাচন করতে হবে । খামারের স্থান নির্বাচনে যেসব বিষয়গুলো বিবেচনায় আনতে হবে, সেগুলো নিম্নে দেওয়া হলো :

  • অপেক্ষাকৃত উঁচু ও শুষ্ক ভূমি
  • খামারের ভূমি উন্নয়ন ও নির্মাণ
  • খামার সম্প্রসারণ করার সুযোগ
  • বসতঘর হতে একটু দূরে
  • ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা
  • পানি ও পশু খাদ্যের প্রাপ্যতা
  • পণ্যের চাহিদা ও বাজার ব্যবস্থা বিবেচনা

পারিবারিক দুগ্ধ খামারের প্রয়োজনীয় উপকরণ

পারিবারিক দুগ্ধ খামার স্থাপন করতে বিভিন্ন উপকরণের প্রয়োজন হয় । খামার নির্মাণের জন্য মূলধন থেকে শুরু করে গাভীর বাচ্চা প্রসব পর্যন্ত বিভিন্ন উপকরণের প্রয়োজন হয় । উপকরণ নির্বাচন ও ক্রয়ের সময় গুণগতমান সম্পর্কে খেয়াল রাখতে হবে । নিম্নে উপকরণসমূহের পরিচিতি দেওয়া হলো :

মূলধন, খামারের ভূমি বা জমি, ভালো জাতের গাভী, আদর্শ গোশালা, গোশালা নির্মাণ সামগ্রী, উন্নত খাদ্যের ও পানির পাত্র, ঘাসের জমি, পানির লাইন, পরিবহনের জন্য পিক আপ/ মটরভ্যান বা রিকসা ভ্যান, ঘাস কাটার চপিং মেশিন, ফিড ট্রলি ও খামারের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, দুগ্ধ দোহন ও বিতরণ সামগ্রী, পশুর প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জামাদি, পশুর জন্য প্রয়োজনীয় সবুজ ঘাস ও দানাদার খাদ্য, টিকার সরবরাহ এবং পশুকে কৃত্রিম প্রজননের ব্যবস্থা

 কাজ : পারিবারিক দুগ্ধ খামারের উপকরণের তালিকা তৈরি করবে ।

দুগ্ধ দোহন
গাভীর ওলান থেকে দুধ সংগ্রহের প্রক্রিয়াকে দুধ দোহন বলে । নির্দিষ্ট সময় ও স্থানে একই গোয়ালা দ্বারা গাভী থেকে দুধ দোহন করতে হয়। এতে করে গাভী স্থিরতাবোধ করে এবং উৎপাদনের ধারাবাহিকতা বজায় থাকে ।

দুধ দোহনের ধাপ-

১। দুধ দোহনের সময় : প্রতিদিন দুইবার অথবা তিনবার দুধ দোহন করা যায়। নির্দিষ্ট সময়সূচি মেনে দোহন করলে দুধ উৎপাদন বাড়ে ।

২। গাভী প্রস্তুত করা : দুধ দোহনের পূর্বে কখনোই গাভীকে উত্তেজিত বা বিরক্ত করা যাবে না । কোনো অবস্থাতেই গাভীকে মারধর করা যাবে না । দুধ দোহনের পূর্বে গাভীর ওলান ও বাঁট কুসুম গরম পানি দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে। তারপর পরিষ্কার কাপড় বা তোয়ালে দিয়ে ওলান ও বাট মুছে নিতে হবে।

৩ । গোয়ালার প্রস্তুতি : দোহনের পূর্বে গোয়ালাকে পরিষ্কার কাপড় পরিধান করতে হবে । গামছা বা কোনো কাপড় দিয়ে চুল ঢেকে রাখতে হবে । দোহনকারীর নখ কেটে নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে । দুধ দোহনের সময় দোহনকারীর বদভ্যাস যেমন- থুথু ফেলা, নাক ঝাড়া এমনকি কথা বলা ইত্যাদি ত্যাগ করতে হবে।

৪। দোহনের জন্য পরিষ্কার পাত্র ব্যবহার করা : ওলান থেকে দুধ দোহনের সময় বালতির পরিবর্তে গম্বুজ আকৃতির ঢাকনাসহ স্বাস্থ্যসম্মত হাতাওয়ালা বালতি ব্যবহার করা উচিত। দুধ দোহনের পর দুধের পাত্র প্রথমে গরম পানি দিয়ে এবং পরে ব্রাশ দিয়ে ঘষে পরিষ্কার ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। পরবর্তী দোহনের পূর্ব পর্যন্ত তাকে পাত্রগুলো উপুড় করে রাখতে হবে।

৫। গাভীকে মশামাছি যুক্তরাখা : দুধ দোহনের সময় মশা মাছি যেন গাভীকে বিরক্ত না করে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে ।

৬। দুধ দোহনের জন্য গাভীকে উদ্দীপিত করা : বাছুরের দ্বারা গাভীর বাঁট চুষিয়ে অথবা গোয়ালা কর্তৃক ওলান ম্যাসাজ করে গাভীকে দুধ দোহনের জন্য উদ্দীপিত করতে হবে।

৭। দোহনের সময় পাতীকে খাওয়ানো : দুধ দোহনের সময় গাভীকে ব্যস্ত রাখার জন্য অল্প পরিমাণ দানাদার খাদ্য বা সবুজ ঘাস গাভীর সামনে দেওয়া উচিত। এতে গাভী খাবার খেতে ব্যস্ত থাকে এবং দুধ দোহন সহজ হয় ।

দুগ্ধ দোহন পদ্ধতি : দুগ্ধ দোহন পদ্ধতি দুই প্রকার -

১। সনাতন পদ্ধতি : হাত দ্বারা দোহন

২। আধুনিক পদ্ধতি : যন্ত্রের সাহায্যে দোহন

দুধ দোহনের সময় যে কোনো একটি পদ্ধতি সঠিকভাবে অনুসরণ করতে হবে ।

১। হাত দিয়ে দুগ্ধ দোহন
দোহনের সময় ওলানের বাঁটের গোড়া বন্ধ রেখে বাঁটের উপর চাপ প্রয়োগ করতে হয় । ফলে বাঁটের মধ্যে জমা হওয়া দুধ বের হয়ে আসে। আবার চাপ সরিয়ে নেওয়ার সাথে সাথে ওলান থেকে বাঁটে দুধ এসে জমা হয়। এভাবেই প্রক্রিয়াটি বারবার চলতে থাকে । হাত দিয়ে দোহনের সময় গাভীর বামপাশ থেকে দোহন করতে হয়। দুধ দোহনের সময় প্রথমে সামনের দুই বাঁট একসাথে ও পরে পিছনের দুই বাঁট একসাথে দোহন করা হয় । আবার অনেকে গুণ (x) চিহ্নের মতো সামনের একটি ও পিছনের একটি বাঁট একসাথে অথবা যে বাঁটে দুধ বেশি আছে বলে মনে হয় সেগুলো আগে দোহন করে থাকে ।

২। যন্ত্রের সাহায্যে দোহন
বড় বড় বাণিজ্যিক খামারে যেখানে গাভীর সংখ্যা অনেক বেশি সেখানে একসঙ্গে অনেকগুলো গাভীকে দোহনের জন্য দোহন যন্ত্র ব্যবহার করা হয় । দোহনের সময় হলে গাভীর বাঁটে টিট কাপ লাগিয়ে দুগ্ধ দোহন যন্ত্র চালু করা হয় । এতে সহজে এবং স্বাস্থ্যসম্মতভাবে দুধ দোহন করা সম্ভব হয় ।

 কাজ : শিক্ষার্থীরা দুগ্ধ দোহনের আধুনিক ও সনাতন পদ্ধতি সম্পর্কে তুলনামূলক আলোচনা করবে ।

দুগ্ধ সংরক্ষণ
নির্দিষ্ট সময়-সীমা পর্যন্ত দুধকে খাদ্য হিসাবে উপযোগী রাখতে পচনমুক্ত রাখার প্রক্রিয়াকে দুধ সংরক্ষণ বলে । দোহনের পর পরই দুধকে ছাঁকতে ও ঠাণ্ডা করতে হয় । দুধের সংরক্ষণ ব্যবস্থা তেমন সহজ নয় । কারণ দুধের রাসায়নিক গঠনের পরিবর্তন খুব সহজে ঘটে । বাংলাদেশের সর্বত্রই সাধারণত কাঁচা দুধ বিক্রি করা হয়। দুধ অধিক সময় কাঁচা অবস্থায় থাকলে গুণগত মান ক্ষুণ্ণ হয় । সাধারণ তাপমাত্রায় বিভিন্ন জীবাণু দুধে ল্যাকটিক এসিড উৎপন্নের মাধ্যমে দুধকে টক স্বাদযুক্ত করে ফেলে । স্ট্রেপটোকক্কাই (Streptococci) নামক জীবাণু প্রধানত দুধে এসিড তৈরি করে । জীবাণু সাধারণ তাপমাত্রায় দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে দুধ নষ্ট করে ফেলে । নিম্নে দুধ সংরক্ষণ পদ্ধতি আলোচনা করা হলো ।

ক) দুধ সংরক্ষণের সনাতন পদ্ধতি
দুধ তাপ দ্বারা ফুটিয়ে সংরক্ষণ করা : পারিবারিকভাবে এটি সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি । একবার গরম করলে ৪ ঘণ্টা ভালো থাকে । তাই ৪ ঘণ্টা পর পর ২০ মিনিট করে ফুটালে প্রায় সবরকম রোগ উৎপদানকারী জীবাণু ধ্বংস প্রাপ্ত হয় । তবে, এতেও দুধের পুষ্টিমান কিছুটা কমে যায়। কেননা উচ্চ তাপ প্রক্রিয়ায় কিছু সংখ্যক ভিটামিন ও অ্যামাইনো এসিড নষ্ট হয়ে যায় ।

খ) দুধ সংরক্ষণের আধুনিক পদ্ধতি

১। রিফ্রিজারেটরে অল্প সময়ের জন্য ৪° সে. রেখে দুধ সংরক্ষণ করা যায় ।

২। ডিপ ফ্রিজে দুধ সংরক্ষণ করা যায় । এখানে দুধে জীবাণুর বংশবৃদ্ধি হয় না ঠিক, তবে দুধের রাসায়নিক বন্ধন ভেঙে যায় । ফলে দুধের গুণগত মান কিছুটা হ্রাস পায় ।

৩। দুধ পাস্তুরিকরণ
পৃথিবীতে দুধকে অন্যতম আদর্শ খাদ্য বলা হয় । এই দুধ বাছুর বা মানুষের জন্য আদর্শ খাবার, সাথে সাথে এটি অণুজীবের জন্যও সমানভাবে আদর্শ মাধ্যম। দুধ দোহনের পর সময়ের সাথে সাথে দুধের গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যেতে শুরু করে এবং দীর্ঘক্ষণ সাধারণ তাপমাত্রায় রাখলে এক সময় সম্পূর্ণরূপে এটি নষ্ট হয়ে যায় । এই নষ্ট হওয়ার কারণ হিসাবে প্রধানত অণুজীবকে দায়ি করা হয় । এই অণুজীব অতি উচ্চ তাপমাত্রায় ও নিম্ন তাপমাত্রায় জন্মাতে ও বংশ বিস্তার করতে পারে না । এই তাপমাত্রা ব্যবহার করে দুধের রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু নিয়ন্ত্রণ করার উপায় হলো পাস্তুরিকরণ । দুধ পাস্তুরিকরণের প্রধান উদ্দেশ্য হলো রোগ উৎপাদনকারী জীবাণু ধ্বংস করা । দুধ বেশি সময় সংরক্ষণের জন্য অবাঞ্ছিত জীবাণু ধ্বংস করা, দুধে উপস্থিত এনজাইম নিষ্ক্রিয়করণ ।

লুই পাস্তুর (১৮৬০-১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দ) একজন ফরাসি রসায়নবিদ প্রথম অনুধাবন করেন যে, পচন প্রণালি এক প্রকারের জীবাণু দ্বারা সংঘঠিত হয়। যদিও লুই পাস্তুরই পাস্তুরিকরণ প্রক্রিয়ার আবিষ্কারক, কিন্তু দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণে ড. সথস লট নামক এক জার্মান বিজ্ঞানী প্রথম এর ব্যবহার করেন। দুধে উপস্থিত রোগ উৎপাদনকারী জীবাণু ও এনজাইম ধ্বংস কল্পে দুধের প্রত্যেক কণাতে ১৪৫° ফা. (৬২.৮° সে.) তাপমাত্রায় ৩০ মিনিট সময়কাল অথবা ১৬২° ফা. (৭২.২° সে.) তাপমাত্রায় ১৫ সেকেন্ড সময়কাল পর্যন্ত উত্তপ্ত করাকে পাস্তুরিকরণ বলে । পাস্তুরিকৃত দুধ সঙ্গে সঙ্গে ৪° সে. তাপমাত্রার নিচে ঠাণ্ডা করতে হবে ।

পাস্তুরিকরণ এর সুবিধা

১। পাস্তুরিকৃত দুধ নিরাপদ, কেননা এতে রোগ উৎপাদনকারী জীবাণু ধ্বংস হয় ।

২। পাস্তুরিকরণ দুধের সংরক্ষণকাল দীর্ঘায়িত করে, কেননা ইহা ল্যাকটিক এসিড প্রস্তুতকারী জীবাণুর সংখ্যা কমায় ।

৩। পাস্তুরিকরণ এর ফলে দুধের এনজাইম নষ্ট হয়ে যায় । যার ফলে দুধ দীর্ঘক্ষণ ভালো থাকে ।

৪ । পাস্তুরিকরণের মাধ্যমে অধিকাংশ ক্ষতিকর জীবাণু বিনষ্ট হয়ে যায় । ৫। এই প্রক্রিয়ায় দুধের পুষ্টিমান ঠিক থাকে, কোনো বিস্বাদের সৃষ্টি হয় না ।

পাস্তুরিকরণের অসুবিধা

১। পাস্তুরিকরণ প্রক্রিয়া আদর্শ উপায়ে করতে না পারলে অতিরিক্ত আলোচ্ছলে দুধের চর্বিকণা পৃথক হতে পারে ।

২। তাপ সংবেদনশীল ভিটামিন নষ্ট হয়ে যেতে পারে ।

৩। উচ্চ তাপজনিত কিছুটা বিস্বাদের সৃষ্টি করতে পারে ।

পাস্তুরিকরণের প্রকারভেদ

১। নিম্ন তাপ দীর্ঘ সময় পাস্তুরিকরণ ৬২.৮° সে. তাপ ৩০ মিনিট সময়ের জন্য ।

২। উচ্চ তাপ কম সময় পাস্তুরিকরণ ৭২.২° সে. তাপ ১৫ সেকেন্ড সময়ের জন্য ।

৩। অতি উচ্চ তাপে পাস্তুরিকরণ ১৩৭.৮° সে. তাপে ২ সেকেন্ড সময়ের জন্য ।

নতুন শব্দ: দুগ্ধ দোহন, পাস্তুরিকরণ

Content added By
Promotion