রজঃচক্র (Menstrual cycle: ল্যাটিন mensis = month) স্ত্রীলোকের সমগ্র যৌন জীবনকালে প্রতি ২৮ দিন (২৪-৩২ দিন) অন্তর ৩-৫ দিন ধরে জরায়ুর অন্তঃস্থ স্তর বা এন্ডোমেট্রিয়ামের অবক্ষয়ের ফলে রজঃস্রাব এবং পরে দেহের অন্যান্য জননাঙ্গসমূহের যেমন-ডিম্বাশয়, জরায়ু ইত্যাদির যে পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তন ঘটে তাকে রজঃচক্র বলে। প্রথম রজচক্রকে মেনার্কি (menarche) এবং যৌন জীবনকালের শেষে রজঃচক্রের নিবৃত্তি বা বন্ধ হওয়াকে মেনোপজ (menopause) বলে।

 

রজঃচক্রের প্রক্রিয়া (Process of menstrual cycle):

প্রায় ৮০% নারী রজঃচক্র শুরুর ১/২ সপ্তাহ আগে থেকেই কিছু উপসর্গ বুঝতে পারে। সাধারণ উপসর্গের মধ্যে রয়েছে ব্রণ ওঠা, স্তন স্পর্শকাতর ও স্ফীত হওয়া, পরিশ্রান্ত, খিটখিটে ও অস্থির মেজাজ ইত্যাদি। এসব উপসর্গ দৈনন্দিন কাজকর্মের ব্যাঘাত সৃষ্টি করে, তাই এগুলোকে প্রাক রজঃচক্রীয় উপসর্গ (premenstrual syndrome) বলে। রজঃচক্রের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া দুটি চক্রের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়, একটি ডিম্বাশয় চক্র, অন্যটি জরায়ু চক্র। 
 

ডিম্বাশয় চক্র (Ovarian cycle)


১. ফলিকুলার পর্যায় (Follicular phase): ডিম্বাশয় চক্রের যে অংশে ডিম্বাশয় ফলিকলের বৃদ্ধি ঘটে এবং উওসাইট পরিণত হয় তাকে ফলিকুলার পর্যায় বা ফলিকুলোজেনেসিস (folliculosenesis) বলে। প্রত্যেক ডিম্বাশয়ে অনেক ফলিকল (follicle) থাকে এবং প্রত্যেক ফলিকলে থাকে একটি করে প্রাইমারি উওসাইট। প্রাইমারি উওসাইট পুষ্টি সরবরাহকারী গ্র্যানুলোসা কোষ (granulosa cells)-এর একটি স্তরে পরিবৃত থাকে। প্রাইমারি উওসাইট ও গ্র্যানুলোসা একত্রে অপরিণত ফলিকল গঠন করে। ডিম্বাশয় চক্রের শুরুতে মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস থেকে GnRH ক্ষরণ বেড়ে যায় এবং সম্মুখ পিটুইটারি গ্রন্থি FSH ও LH ক্ষরণ বাড়িয়ে দেয়। এ দুই হরমোন একদিকে ফলিকলের বৃদ্ধি ও আকার পরিবর্তনকে যেমনি উদ্দীপ্ত করে, অন্যদিকে ফলিকলকে ইস্ট্রোজেন ক্ষরণে উদ্বুদ্ধ করে। গ্র্যানুলোসা কোষগুলো থেকে এক ধরনের চিনিজাতীয় পদার্থ (গ্লাইকোপ্রোটিন) ক্ষরিত হয় এবং উওসাইটের চারপাশে অকোষীয় স্তর হিসেবে অবস্থান নেয়। ফলিকলের ভিতরে তখন তরলে পূর্ণ একটি গহ্বর বা অ্যান্ট্রাম (antrum) সৃষ্টি হয়। গ্র্যানুলোসা কোষ থেকে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্ট্রেরন ক্ষরণ শুরু হয়। প্রাইমারি উওসাইট মিয়োসিস-১ দশা সম্পন্ন করে একটি সেকেন্ডারি উওসাইট ও একটি অকার্যকর পোলার বডি সৃষ্টি করে। পরিণত ফলিকল (গ্রাফিয়ান ফলিকল নামে পরিচিত) একটি সেকেন্ডারি উওসাইট, একটি পোলার বডি ও অসংখ্য গ্র্যানুলোসা কোষে গঠিত। এটি ডিম্বাশয়ের কোনো এক পাশে তরলে পূর্ণ গহ্বরযুক্ত স্ফীতি হিসেবে এবং ডিম্বাশয়ের যোজক বা কানেকটিভ (connective) টিস্যুকোষে বেষ্টিত হয়ে অবস্থান করে।

 

২. ডিম্বপাত পর্যায় (Ovulatory phase): রজঃচক্রের সময় নির্দিষ্ট হরমোনের উদ্দীপনায় ডিম্বাশয়ে পরিণত ফলিকল থেকে সেকেন্ডারি উওসাইটের নির্গমনকে ডিম্বপাত বলে। কম মাত্রার ইস্ট্রোজেন পিটুইটারি হরমোনের ক্ষরণকে বাধা দেয়, ফলে FSH ও LH-এর মাত্রা অপেক্ষাকৃত কম থাকে। ফলিকল থেকে ইস্ট্রোজেন ক্ষরণ বেড়ে গেলে FSH ও LH মাত্র উল্লেখযোগ্য পরিমানে বেড়ে যায়। চক্রের ১২তম দিনে হঠাৎ LH-এর পরিমাণ প্রচণ্ড বেড়ে যাওয়ায় একদিনের মধ্যে ডিম্বপাত (ovulation) ঘটে।

 

৩. লুটিয়াল পর্যায় (Luteal phase): ডিম্বপাতের পর শুরু হয় লুটিয়াল পর্যায়। লুটিনাইজিং হরমোন অবশিষ্ট ফলিকুলার টিস্যুকে উদ্দীপ্ত করে কর্পাস লুটিয়াম নামক একটি হলদে গ্রন্থিময় পিন্ডে পরিণত করে। এটি LH-এ উদ্দীপ্ত হয়ে প্রচুর প্রোজেস্টেরন ও সামান্য ইস্ট্রোজেন ক্ষরণ করে। হরমোন দুটি নিষিক্ত ডিম্বাণুর সম্ভাব্য আগমন, সংস্থাপন ও পরিস্ফুটনের উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে এন্ডোমেট্রিয়ামকে প্রস্তুত করে রাখে। উচ্চ মাত্রার ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন ক্ষরণের ফলে হাইপোথ্যালামাস FSH-এর নিঃসরণ এতটাই কমিয়ে দেয় যেন সাময়িকভাবে আর কোনো ফলিকলের পরিস্ফুটন না ঘটে।

জরায়ু চক্র (Uterine cycle) 


১. রজঃস্রাবীয় বা ব্লিডিং পর্যায় (Menstrual or Bleeling phase):

১ম-৫ম দিন: জরায়ু চক্রের যে পর্যায়ে রজঃস্রাব (menses) নিষ্কাশিত হয় তাকে রজঃস্রাবীয় পর্যায় বলে। ডিম্বপাতের পর ডিম্বাণ ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে নিষিক্ত না হলে কর্পাস লুটিয়াম থেকে নিঃসত ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরনের প্রভাবে সম্মুখ পিটুইটারি গ্রন্থি FSH ও LH ক্ষরণ বন্ধ করে দেয়। LH-এর অভাবে কর্পাস লুটিয়ামের কর্মতৎপরতা বন্ধ হয়ে বিধ্বস্ত হয়। চক্রের এ পর্যায় ৪টি হরমোনের (ইস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরন ফলিকল স্টিমুলেটিং হরমোন ও লুটিনাইজিং হরমোন) ক্ষরণ মাত্রাই নিম্নতম পর্যায়ে থাকে।ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরনের ক্ষরণমাত্রা কমে যাওয়ায় এন্ডোমেট্রিয়ামের আর বৃদ্ধি ঘটে না, বরং তা ভাঙতে শুরু করে। রক্তের অভাবে তখন এন্ডোমেট্রিয়ামের ধমনিকুন্ডলী প্রসারিত হয়, ফলে ধমনিকা ও কৈশিকজালিকা ছিন্নভিন্ন হলে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। পরে অবশ্য কিছু রক্তবাহিকার সংকোচনে স্থানীয় রক্তপাত বন্ধ হয়, কিন্তু অন্যান্য রক্তবাহিকার অক্ষমতার জন্য রক্তক্ষরণ ৪-৫ দিন স্থায়ী হয়। এ সময় রক্তের সাথে এন্ডোমেট্রিয়াম, রক্তবাহিকার ভগ্নাংশ ও অনিষিক্ত ডিম্বাণু যোনিপথে নিষ্কাশিত হয়। এসব পদার্থকে রজঃস্রাব বলে। প্রত্যেক জরায়ু চক্রে রজঃস্রাবের পরিমাণ ৩০-৪০ মিলিলিটার।

 

২. বর্ধনশীল পর্যায় (Proliferative phase):

৬-১৪তম দিন: রজঃচক্রের যে পর্যায়ে পরিস্ফুটনের পরবর্তী ফলিকল (ভবিষ্যতে ফলিকল) থেকে ডিম্বপাতের (ovulation) পূর্ব পর্যন্ত ক্ষরিত প্রচুর পরিমাণ ইস্ট্রোজেনের প্রভাবে এন্ডোমেট্রিয়াল স্তর দ্রুত পুনর্নির্মিত হয়ে নিষিক্ত ডিম্বাণু ধারণ ও নিরাপদ পরিস্ফুটন নিশ্চিত করে সে পর্যায়কে বর্ধনশীল পর্যায় বলে। এ পর্যায়ে জরায়ুর এন্ডোমেট্রিয়াল স্তর প্রায় ৩-৪ মি.মি. পুরু হয়, রক্তবাহিকা ও গ্রন্থিসমৃদ্ধ হয়। ডিম্বাশয়ে যখন বর্ধনশীল ফলিকলের ফলিকল কোষ থেকে প্রচুর পরিমাণ ইস্ট্রোজেন হরমোন ক্ষরিত হয় তখন FSH ও LH মাত্রাও বেড়ে যায়। ১৪তম দিনে অর্থাৎ চক্রের ঠিক মধ্যবর্তী সময়ে ডিম্বপাত ঘটে।

 

৩. ক্ষরণশীল পর্যায় (Secretory phase):

১৫-২৮তম দিন: রজঃচক্রের যে পর্যায়ে ব্লাস্টোসিস্ট ধারণের জন্য জরায়ুর কর্পাস লুটিয়াম থেকে ক্ষরিত প্রোজেস্টেরন ও সামান্য পরিমাণ ইস্ট্রোজেনের প্রভাবে এন্ডোমেট্রিয়াম পুনর্গঠিত পর্যায়ে অপেক্ষমান থাকে, তাকে ক্ষরণশীল পর্যায় বলে। এ পর্যায়ে জরায়ুর এন্ডোমেট্রিয়ামের কোষগুলো বৃদ্ধি পায়, প্রাচীরের স্থলতা প্রায় ৩ গুণ বেড়ে যায়। জরায়ুতে অবস্থিত গ্রন্থিগুলো পরিণত হয়ে ভ্রুণের পুষ্টির উৎস হিসেবে গ্লাইকোজেন উৎপন্ন করে এবং এমন সব উপাদান ক্ষরণ করে যাতে এন্ডোমেট্রিয়ামের গঠন ধরে রাখে ও বিধ্বস্ত হওয়া থেকে রক্ষা পায়। বর্ধনশীল পর্বে সার্ভিক্সে ক্ষরিত পাতলা মিউকাস স্তর এ পর্যায়ে ঘন ও চটচটে হয়ে সার্ভিকাল প্লাগ (cervical plug) গঠন করে, ফলে ব্যাকটেরিয়া বা আর কোনো শুক্রাণু জরায়ুর ভিতর প্রবেশ করতে পারে না।


রজঃচক্রের তাৎপর্য (Significance of Menstrual Cycle):

রজঃচক্র মেয়েদের যৌন জীবনকালের সূচনা করে; 
*এটি স্ত্রীলোকের প্রজনন সক্ষমতা নির্দেশ করে;
*রজঃচক্র স্ত্রীলোকের সন্তান উৎপাদন সক্ষমতা নির্দেশ করে এবং প্রতিমাসে একবার গর্ভধারণের সুযোগ সৃষ্টি করে; 
*রজঃচক্র ডিম্বাণু উৎপাদন, ডিম্বথলির পরিপক্কতা; ডিম্বপাত, শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলন, ভ্রুণ সৃষ্টি এবং জরায়ুকে ভ্রণ ধারণ ও পোষণের উপযোগী করার সুযোগ সৃষ্টি করে; 
*নিয়মিত রজঃচক্র মেয়েদের যৌন সুস্থতার বহিঃপ্রকাশ; 
*অনিয়মিত রজঃচক্র মেয়েদের যৌন অসুস্থতার প্রকাশ করে;

Content added By

Related Question

View More