জনাব সাদমান একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। শিক্ষার হার বাড়ানোর লক্ষ্যে তিনি নিজ গ্রামে একটি বিদ্যালয় স্থাপনে ১০ লক্ষ টাকা ব্যয় করেন। উক্ত বিদ্যালয়ে ৫০ জন শিক্ষক কর্মচারী নিয়োগপ্রাপ্ত হয়। এতে তার সুনাম বৃদ্ধি হয় ৷
কোন ধরনের দায়বদ্ধতা থেকে জনাব সাদমান বিদ্যালয় স্থাপন করেন ?
স্মরণাতীতকাল থেকে আমাদের দেশ শিল্প বাণিজ্যে ঐতিহ্য ও গৌরব বহন করলেও দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে শিল্পের অবদান তেমন উজ্জ্বল নয়। স্বাধীনতার আগে মাত্র অল্প কয়েকজন বাঙালি ব্যবসায়ে সফলতা অর্জন করেন। মূলত ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর বাঙালিরা ব্যবসায়ের সুযোগ পান। বিগত ৪০ বছরে বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তা ছোট ব্যবসায় দিয়ে শুরু করে দেশের শ্রেষ্ঠ ব্যবসায় উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিত হন এবং তাদের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায় দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। এ অধ্যায়ে দেশের দুইজন স্বনামধন্য শিল্প উদ্যোক্তা জনাব জহুরুল ইসলাম ও জনাব স্যামসন এইচ চৌধুরীসহ বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তার জীবনী আলোচনা করা হলো যাদের জীবন ও কর্ম থেকে আমরা সকলেই অনুপ্রাণিত হতে পারব।
এ অধ্যায় শেষে আমরা-
জহুরুল ইসলাম
বাংলাদেশের অন্যতম সফল উদ্যোক্তা হচ্ছেন জনাব জহুরুল ইসলাম। ব্যবসায় প্রতিভা, কঠোর পরিশ্রম, দুরদর্শিতা ও সৃজনশীলতার সমন্বয়ে গঠিত এ মানুষটি স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের ব্যবসায়-শিল্প-বাণিজ্য জগতে একটি অতি পরিচিত নাম। তিনি ১৯২৮ সালে কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর উপজেলার ভাগলপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম আলহাজ্ব আফতাব উদ্দিন ছিলেন ময়মনসিংহ জেলা বোর্ডের একজন সাধারণ কন্ট্রাক্টর। তার মাতার নাম বেগম রহিমা আক্তার খাতুন। পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে জহুরুল ইসলাম ছিলেন দ্বিতীয়। তার চাচা ছিলেন কলকাতার পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের একজন ওভারশিয়ার। স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির পড়া শেষ করে তিনি কিছুদিন সরারচর শিবনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন। এরপর ভর্তি হন বাজিতপুর হাইস্কুলে। কিছুদিন পর তিনি চাচা মুর্শেদ উদ্দীনের সঙ্গে চলে যান কলকাতায়। ১৯৪৫ সালে তিনি কলকাতার রিপন হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৪৮ সালে মুন্সীগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলেও উত্তীর্ণ হতে পারেননি। প্রতিকূল পরিবেশ ও পারিবারিক দায়-দায়িত্বের চাপে তার আনুষ্ঠানিক পড়াশুনার সমাপ্তি ঘটে। পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতার জন্য ১৯৪৮ সালে সি এন্ড বি ডিপার্টমন্টের ওয়ার্ক সরকার পদে মাত্র সাতাত্তর টাকা বেতনের চাকরি নেন। তিনি কিছুদিন পর ঐ বিভাগে নিম্নমান সহকারী বা লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক পদ লাভ করেন। চাচার চাকরি ও পিতার কন্ট্রাকটরি ব্যবসার প্রভাব তার জীবনের উপর পড়েছিল। আড়াই বছর পর ১৯৫১ সালে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন এবং একজন তৃতীয় শ্রেণির কন্ট্রাক্টর হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। বেঙ্গল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড নামে একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠা করে তিন-চার হাজার টাকার মতো সামান্য পুঁজি নিয়ে তিনি সম্পূর্ণভাবে ব্যবসায় শুরু করেন। কঠোর পরিশ্রম ও ব্যবসায়ের প্রতি একাগ্রতা ও আন্তরিকতা তাকে ধীরে ধীরে একজন সার্থক ব্যবসায় উদ্যোক্তা ও অন্যতম ধনাঢ্য ব্যক্তি হিসেবে পরিণত করেন। ঠিকাদারি জীবনের শুরুতেই তিনি কিশোরগঞ্জ পোস্ট অফিস নির্মাণের কাজ করেন। পরে ঢাকার গুলিস্তান থেকে টিকাটুলী সড়কের কাজ। কাজের সততা ও গুণগত মানের কারণে দুই বছরের মধ্যেই অর্থাৎ ১৯৫৩ সালে তিনি পর্যায়ক্রমে দ্বিতীয় ও প্রথম শ্রেণির কন্ট্রাক্টর বা ঠিকাদার হিসেবে পরিণত হন। সব ধরনের নির্মাণ কাজে আগ্রহ ছিল। বাড়ি, রাস্তা, ব্রিজ, সেচ ব্যবস্থা, স্যানিটেশন সব কিছুতেই তিনি বিনিয়োগ করেছিলেন। কাজের মাধ্যমে তিনি যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতেন তা পরবর্তী কাজে ব্যবহার করতেন। তিনি দূরদর্শিতা দিয়ে বুঝতে পারলেন ঢাকার আশেপাশে এক সময় বসতি বাড়বে এবং একই সঙ্গে বাড়বে জমির চাহিদা। তাই তিনি ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে এবং মিরপুর, সাভার, জয়দেবপুর, কালিয়কৈর অঞ্চলে বিপুল পরিমাণ জমি ক্রয় করেন। সে জমিগুলোতে তিনি শিল্প স্থাপন ও আবাসিক গৃহ নির্মাণের কাজে লাগান। দিনে দিনে জমির দাম বাড়ার কারণে জহুরুল ইসলামের বিনিয়োগকৃত মূলধনের মূল্যও বাড়তে থাকে। তিনি ১৯৬০ সালের দিকে চট্টগ্রামে একটি টিম্বার কারখানা ও ঢাকার জিঞ্জিরায় একটি গ্লাস কারখানা স্থাপন করেন। ঢাকা শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে মানুষের আবাসন চাহিদা মেটাতে ১৯৬৪ সালে ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেড নামে একটি সহ প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন যা বর্তমানে বাংলাদেশের আবাসন খাতের অন্যতম প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে তার প্রতিষ্ঠিত সকল ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ইসলাম গ্রুপ অব কোম্পানিজ নামে পরিচিত যা ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর আওতায় রয়েছে ইস্টার্ন হাউজিং লিঃ, নাভানা লিঃ, মিলনার্স লিঃ, এসেনশিয়াল প্রোডাক্ট লিঃ, ঢাকা ফাইবার্স লিঃ, ক্রিসেন্ট ইন্টারন্যাশনাল লিঃ, নাভানা স্পোর্টস লিঃ, ঢাকা রি-রোলিং মিলস্ লিঃ, আফতাব অটোমোবাইরস লিঃ, আফতাব ডেইরি ইত্যাদি। তাঁর প্রতিষ্ঠিত শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ নিয়োজিত আছে।
পরিশ্রম, সততা, নিষ্ঠা এবং আত্মবিশ্বাস তাকে সফল মানুষে পরিণত করেছিল। এই অসাধারণ বাঙালি কৃতী সন্তান শুধু শিল্পপতি পরিচয়ে সীমাবদ্ধ থাকেননি। একজন সমাজ সংস্কারক, সফল সংগঠক, ব্যবস্থাপকের মডেল তিনি। তার সব অর্জনই সম্ভব হয়েছে কঠোর শ্রম ও আন্তরিকতায়। শুধু বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানেই নয়, সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে তার জনহিতকর হাত প্রসারিত হয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, ব্যাংকিং, কৃষি, ক্রীড়াসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে। তিনি বহু অনাথ আশ্রম, শিশু প্রতিষ্ঠান, মাদরাসা ও স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন । তার উদ্যোগে বাজিতপুরে স্থাপিত ৩৫০ শয্যার জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালটি বেসরকারি উদ্যোগে স্থাপিত দেশের সর্ববৃহৎ মেডিকেল কলেজ। তাছাড়া নার্সিং ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ও জহুরুল ইসলাম এডুকেশন কমপ্লেক্স তার অন্যতম কীর্তি। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধেও তিনি নানাভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৯৯৫ সালের ১৯ অক্টোবর এই কর্মবীরের জীবনাবসান হয়।
স্যামসন এইচ চৌধুরী
বাংলাদেশের শিল্প-বাণিজ্যের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় নাম স্কয়ার গ্রুপের চেয়ারম্যান, জনহিতৈষী ব্যক্তিত্ব স্যামসন এইচ চৌধুরী। তার জন্ম ১৯২৬ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ফরিদপুর জেলায়। পিতা ই এইচ চৌধুরী ও মাতা লতিকা চৌধুরী। স্যামসন চৌধুরীর পিতা ছিলেন আউটডোর ডিসপেনসারির মেডিকেল অফিসার। তিনি ১৯৩০-৪০ সাল পর্যন্ত কলকাতার বিষ্ণুপুর উচ্চবিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন। সেখান থেকে তিনি সিনিয়র কেমব্রিজ ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি হাভার্ড ইউনিভার্সিটি স্কুল থেকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষাজীবন শেষে তিনি ফিরে আসেন পাবনার আতাইকুলা গ্রামে। পিতার পেশার কারণে ছোটবেলা থেকেই তিনি ঔষধ নিয়ে নাড়াচাড়া করতেন। অনেক চিন্তা-ভাবনা করে তিনি ফার্মেসি বা ঔষধের দোকানকেই ব্যবসা হিসেবে গ্রহণ করেন। গ্রামের বাজারে দিলেন একটি ছোট দোকান। সময়টি ১৯৫২ সাল। ১৯৫৮ সালে তিনি ঔষধ কারখানা স্থাপনের একটি লাইসেন্স পান। তিনিসহ আরো তিন বন্ধু মিলে প্রত্যেকের ২০,০০০ টাকা করে মোট ৮০,০০০ টাকায় ১২ জন শ্রমিক নিয়ে স্থাপন করেন স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস। এ কারখানায় প্রথম যে ঔষধটি তৈরি হয় তা ছিল রক্ত পরিশোধনের ‘এস্টন সিরাপ'। দেশীয় আমদানিকারকদের
কাছ থেকে চড়া দামে কাঁচামাল কিনে তৈরি করতে হতো এ ঔষধ। গুণগতমানের সাথে আপোস করা হয়নি কখনো। গুণগতমানের কারণেই প্রেসক্রিপশনে এ ঔষধের নাম উল্লেখ করতেন স্থানীয় ডাক্তারগণ । এক পর্যায়ে নামকরা কোম্পানির ঔষধের চেয়েও বেশি চলতে থাকে স্কয়ারের এ ঔষধ। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন স্কয়ার একদিন অনেক বড় হবে। এ স্বপ্ন বুকে নিয়ে অফুরন্ত উদ্যম ও সাহসকে পুঁজি করে সামনের সব প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করে ধীরে ধীরে এগিয়েছেন তিনি। কঠোর পরিশ্রম, সততা ও শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে সেই ছোট উদ্যোগ আজ বিশাল স্কয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে সেখানে প্রায় ৩০,০০০ শ্রমিক কর্মরত। শুধু ঔষধ শিল্প নয়, এ শিল্প গ্রুপের ব্যবসায় সম্প্রসারিত হয়েছে প্রসাধন সামগ্রী, টেক্সটাইল, কৃষিপণ্য, তথ্যপ্রযুক্তি, স্বাস্থ্যসেবা ও মিডিয়ায়। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে স্কয়ারের পণ্য। ঔষধের গুণগতমান দেশে বিদেশে স্বীকৃত। পৃথিবীর ৫০টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে স্কয়ারের ঔষধ। দেশের অন্যতম বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল মাছরাঙা টেলিভিশনের তিনি ছিলেন চেয়ারম্যান। তাছাড়া তিনি মেট্রোপলিটন চেম্বার ও ঔষধ শিল্প সমিতির সভাপতি ছিলেন। যুক্ত ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার এন্ড কমার্স বাংলাদেশের সাথে। স্যামসন এইচ চৌধুরী সম্পর্কে শোভা অধিকারী লিখেছেন, ‘একাধারে তিনি ছিলেন মালিক-ম্যানেজার, হিসাবরক্ষক, টাইপিস্ট, কেরানি, শ্রমিক ও মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ। উপর থেকে নিজ পর্যন্ত এমন কোনো কাজ নেই যা তাকে করতে হয়নি। এ দেশের প্রায় সবকটি শহর, বন্দর ও গঞ্জে স্কয়ারের তৈরি ঔষধ বাজারজাতকরণের উদ্দেশ্যে নিরলসভাবে ঘুরেছেন। বহু চড়াই-উত্রাই পেরিয়ে স্কয়ার এখন বাংলাদেশের একটি গর্বিত নাম। ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে স্কয়ার গ্রুপ বছরের সেরা করদাতা হিসেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক নির্বাচিত হয়েছিল।
স্কয়ারের তৈরি হরেক রকমের পণ্য আজ মানুষের ঘরে ঘরে। মান, প্রতিযোগিতামূলক মূল্য, গুণগতমান ও কাজের শৃঙ্খলার কারণে দেশে-বিদেশে স্কয়ার পণ্য সমাদৃত। শিল্প সৃষ্টির নেশা স্যামসন চৌধুরীকে পৌঁছে দিয়েছে সফল শিল্পপতি ও সার্থক উদ্যোক্তার কাতারে। নিরলস প্রচেষ্টা ও উদ্যমে তিনি একের পর এক গড়ে তুলেছেন নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে স্কয়ার গ্রুপের বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, স্কয়ার টয়লেট্রিজ, স্কয়ার টেক্সটাইলস, স্কয়ার হোল্ডিংস, স্কয়ার স্পিনিংস, স্কয়ার কনজিউমার প্রোডাক্টস, স্কয়ার নিট ফেব্রিকস, স্কয়ার ফ্যাশনস, স্কয়ার হারবাল এন্ড ন্যাচারেলস, স্কয়ার হাসপাতাল লিমিটেড। বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাতকারে এ শিল্পোদ্যোক্তা তার সাফল্যের ভিত্তি হিসেবে ধৈর্য, অধ্যবসায় ও সততাকেই মূল হিসেবে উল্লেখ করেছেন। প্রতিটি স্তরে সর্বোচ্চ মূল্যবোধ ও নৈতিকতার চর্চাই স্কয়ারকে মানুষের আস্থার আসনে বসিয়েছে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। সর্বদাই আশাবাদী এ উদ্যোক্তা মালিক ও শ্রমিকের যৌথ প্রয়াসকেই ব্যবসায় সাফল্যের চাবিকাঠি হিসেবে মনে করতেন। শ্রমিকবান্ধব এ শিল্পপতির কারখানায় কখনো শ্রমিক অসন্তোষ দেখা যায়নি। ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি ৮৬ বছর বয়সে এ কীর্তিমানের জীবনাবসান হয়। তার স্ত্রীর নাম অনিকা চৌধুরী। তার তিন ছেলে তপন চৌধুরী, অঞ্জন চৌধুরী, স্বপন চৌধুরী ব্যবসায়ী হিসেবে স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।
দেশের বেসরকারি খাতে শিল্প স্থাপন, পণ্য উৎপাদন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও জাতীয় আয় বৃদ্ধিসহ সামগ্রিকভাবে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখার জন্য ২০১০ সালে সরকার ৪২ জন ব্যক্তিকে বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (Commercially Important Prerson-CIP) নির্বাচন করে। তন্মধ্যে বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর ১৮ জনের মধ্যে একজন ছিলেন স্যামসন এইচ চৌধুরী। তিনি ২০০০ সালে দৈনিক ডেইলি স্টার ও ডি এইচ এল প্রদত্ত বিজনেসম্যান অব দি ইয়ার এবং ১৯৯৮ সালে অ্যামেরিকান চেম্বার অব কমার্সের দৃষ্টিতে ‘বিজনেস এক্সিকিউটিভ অব দি ইয়ার' নির্বাচিত হয়েছিলেন।
বরিশালের লিবার্টি জেন্টস টেইলার্সের স্বত্বাধিকারী শাহিদা বেগম। শখ বা পরিকল্পনা করে নয়, নিতান্ত প্রয়োজনে তিনি ব্যবসায় শুরু করেন। কখনও ভাবেননি এরকম কিছু করতে হবে। এ ক্ষেত্রে তার কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না। যখন শুরু করলেন তখন নানা বাধা-বিপত্তির মধ্যে পড়েছিলেন। কিন্তু দৃঢ় মনোবল ও পরিশ্রমই তাকে এনে দিয়েছে সাফল্য ও সম্মান। পুরুষদের পোশাক তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন এবং এখনো করছেন। শাহিদা বেগম বাস করেন বরিশাল শহরে। স্বামীর টেইলারিং ব্যবসায় আর চার মেয়ে নিয়ে তার দিনগুলো ভালোই চলছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই তার স্বামী অসুস্থ হন। ১৯৯৭ সালে তার স্বামী তাদের সবাইকে রেখে চলে যান পরপারে। শাহিদা যেন চোখে অন্ধকার দেখেন। কীভাবে চলবে সামনের দিনগুলো? মেয়েদের ভবিষ্যত কী হবে? ঘর সংসারের কাজ ছাড়া তিনি কিছুই জানতেন না। ব্যবসায় বোঝেন না। বরিশাল সদর হাসপাতালের কাছে তার স্বামীর জেন্টস টেইলার্সটির অবস্থাও তখন ভালো ছিল না। স্বামী অনেকদিন অসুস্থ থাকায় সমস্ত সঞ্চয়ও শেষ হয়েছিল। শাহিদার সামান্য গহনাই সম্বল ছিল। গহনা বিক্রি করে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়েই ব্যবসায়টি শুরু করেন। দোকানের কর্মচারীও তখন ছিল ২ জন। তাদের কাছে টেইলারিং শেখেন। শুরু করেন কাজ।
শুরুতে পুরুষ ক্রেতা, পরিবারের লোকজন, আত্মীয়-স্বজন কেউ এ কাজটিকে ভালোভাবে নেননি। কিন্তু তিনি হাল ছেড়ে দেননি। আত্মবিশ্বাস ও কঠিন মনোবল নিয়ে তিনি পুরো পরিস্থিতি সামলে নিয়ে একটি আধুনিক জেন্টস টেইলার্স গড়ে তোলেন। এভাবেই তিনি সাধারণ গৃহবধূ থেকে পুরোপুরি ব্যবসায়ী হয়ে উঠেন। তিনি ২০০৮ সালে সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে এসএমই ফাউন্ডেশন থেকে পুরস্কার পেয়েছেন।
জীবনের প্রথম ব্যবসায় শুরু করেছিলেন মাত্র ৪৫০ টাকা পুঁজি নিয়ে। ধীরে ধীরে সে ব্যবসায় পরিণত হয়েছে বিশাল প্রতিষ্ঠানে। আজকে তিনি দেশের স্বনামধন্য ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান আজাদ প্রোডাক্টসের কর্ণধার। নাম আবুল কালাম আজাদ। ১৯৭০ সালের কথা। এসএসসি পরীক্ষার পর বাবার সঙ্গে বাজারে গিয়েছিলেন পাটের বিনিময়ে ইলিশ মাছ ও কাঁঠাল কিনতে। সেখানে নারিকেল বিক্রি করে লাভবান হবার সুযোগ দেখে খালাত ভাইয়ের সহায়তায় মাত্র ৪৫০ টাকা মূলধন নিয়ে ব্যবসায় শুরু করলেন। এটিই ছিল তার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। ছোট নৌকা করে এক হাট থেকে অন্য হাটে নারিকেল আনা নেওয়া করতেন। একসময় আরো কিছু করার আশায় গ্রাম থেকে শহরে পাড়ি জমালেন। শুরু হলো কষ্টের জীবন। সারাদিন পথে পথে ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন এবং স্বপ্ন দেখতেন। এক সময় একটি উপায়ও পেলেন। বায়তুল মোকাররমের সামনে পোস্টার বিক্রি করতে দেখে নিজেও সে রকম একটি পরিকল্পনা করলেন। প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহ করে শুরু করে দিলেন ছোট পরিসরের ব্যবসায় ‘আজাদ পোস্টার হাউস'। এল রহমান জুয়েলার্সের সামনে একটি খাম্বার সাথে ঝুলিয়ে বিক্রি করতেন পোস্টার। ব্যাপারটা নিয়ে অনেকে উপহাস করতেন, আবার অনেকে উৎসাহও দিতেন। অনেক পরিশ্রম করে দেশের টিভি-সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের পোস্টার ও ভিউকার্ড তৈরি করে বাজারে ছাড়লেন। দেশের নামকরা তারকাদের ঝকঝকে পোস্টারগুলো দেশের সাধারণ মানুষ ভালোভাবেই গ্রহণ করল। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সেদিনের সেই ভ্রাম্যমাণ দোকান পরিণত হলো বিশাল আজাদ প্রোডাক্টসে। আবুল কালাম আজাদের মতে, তার সাফল্যের পেছনে আছে কঠোর পরিশ্রম ও মায়ের দোয়া। তাই নিজের মা সহ পৃথিবীর সকল মায়েদের শ্রদ্ধা জানাতে ২০০৩ সাল থেকে প্রচলন করেছেন ‘রত্নগর্ভা মা অ্যাওয়ার্ড'। প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মাকে দেওয়া হয় এ স্বীকৃতি ও পুরস্কার। যে মায়েদের কমপক্ষে তিনজন সন্তান বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল ও প্রতিষ্ঠিত তাদেরকে রত্নগর্ভা মা আখ্যায়িত করে এ পুরস্কার। মায়েদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোও এ পুরস্কারের অন্যতম লক্ষ্য । প্রতি বছর বিশ্ব মা দিবসে এ পুরস্কারের আয়োজন করা হয়।
বন্দরনগরী চট্টগ্রামের হালিশহরের অনিন্দ্য বুটিক এবং পার্লারের মালিক লুৎফা সানজিদা যিনি মাত্র ১৫ হাজার টাকা দিয়ে ব্যবসায় শুরু করে আজ কোটিপতির তালিকায় নাম লিখিয়েছেন। তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন বুটিক ও পার্লার। সংগ্রামই তার জীবনের মূলমন্ত্র। অবিরাম চেষ্টা না থাকলে আজকের অবস্থায় আসা কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। যখনই কোনো সমস্যা দেখা দিয়েছে তখনই ধৈর্য ও পরিশ্রম দিয়ে তা অতিক্রম করেছে। ১৯৮৮ সালে যখন তার এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার সময়, সংসারের প্রয়োজনে তাকে পার্টটাইম চাকরি করতে হয়েছিল। লুৎফা শিশুদের পোশাক ও পাঞ্জাবি তৈরি করে স্থানীয় বাজারের দোকানে সরবরাহ করতেন। এক কাজিনের নিকট থেকে ৩০ হাজার টাকা ধার নিয়ে ১৯৮৯ সালে তিনি চকভিউ মার্কেটে একটি শোরুম দিয়েছিলেন। সেটিই ছিল তার জীবনের ঘুরে দাঁড়ানোর সময়। শুরু থেকেই দোকানটিতে বেচাকেনা ভালো হতো। ১৯৯৫ সালে তিনি চট্টগ্রামের মাইডাস থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে চিটাগাং শপিং কমপ্লেক্সে আরেকটি শোরুম দেন। ব্যবসা জমে উঠে। পরিবারে সচ্ছলতা আসতে থাকে। ২০০৪ সালে তিনি একটি বিউটি পার্লার দেন। তার প্রতিষ্ঠান অনিন্দ্য এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের শ্রম এবং ক্রেতার স্বতঃস্ফূর্ত পদচারণাই তাকে সাহস জুগিয়েছে সবসময়।
তিনি সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে সমাজের দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়াতে চেষ্টা করেন। প্রতিবন্ধী নারী, স্বামী পরিত্যক্তা ও নির্যাতিতা নারীদের বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা করেন। তার প্রতিষ্ঠিত অনিন্দ্য ও আরো কিছু করার স্বপ্নকে সঙ্গী করে তিনি এগিয়ে যাবেন বহুদূর।
চরম হতাশা ও দুর্ভোগের পরেও শ্রম, মেধা ও সামান্য পুঁজির সমন্বয় ঘটিয়ে ভাগ্য উন্নয়ন সম্ভব এটা প্রমাণ করেছেন বগুড়ার যুবক নায়ের আলী। জমিজমা বেচে আর ঋণ করে ভাগ্য ফেরাতে বিদেশ গিয়ে আদম ব্যাপারির প্রতারণায় সর্বস্বান্ত হয়েছিলেন তিনি। বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলার হরিহারা গ্রামের আব্দুস সাত্তারের ছেলে ২৭ বছরের যুবক নায়েব আলী গ্রামের সমিতি থেকে লক্ষাধিক টাকা নিয়ে বিদেশ গিয়েছিলেন। সবকিছু হারিয়ে যখন নিঃস্ব তখনই আবার নতুন করে বেঁচে থাকার আশা জাগে তার মনে। সামান্য লেখাপড়া জানা নায়ের আলী ধৈর্য ধরে নিজ বুদ্ধিকে সম্বল করে দেশেই কিছু করার সিদ্ধান্ত নেন। তার এ সিদ্ধান্তে হাত বাড়িয়ে দেন পরিবারের সদস্যরা ও তার বন্ধু মিজানুর রহমান। হরিহারা গ্রামের বেশিরভাগ এলাকা জুড়ে রয়েছে প্রচুর পুকুর ও খালবিল। এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ এ উপাদানটির কথা মাথায় রেখে নায়েব আলী পরিকল্পনা নেন হাঁস পালনের। পাশের গ্রাম থেকে কিনে আনেন ৩০টি হাঁসের বাচ্চা। মাত্র এক হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে ২০০৯ সালে তিনি নিজ গ্রামে গড়ে তোলেন হাঁসের খামার। বিদেশ যাবার নামে টাকা খোয়া যাওয়া নায়েব আলীর এ কাজ দেখে গ্রামের অনেকেই হাসি-তামাশা করলেও দৃঢ় মনোবল নিয়ে ছয় মাসের মধ্যেই তিনি একজন আদর্শ হাঁস খামারি হিসেবে পরিচিতি পেয়ে যান এলাকায়। প্রতিটি মুহূর্ত খামারের কাজে লাগিয়ে অভাবকে জয় করেন তিনি। শুধু তাই নয়, হাঁস পালন করেও যে স্বাবলম্বী হওয়া যায় অল্প দিনেই বুঝিয়ে দেন সবাইকে। এভাবে স্বাবলম্বী হওয়া নায়েব আলী এলাকার হতাশাগ্রস্ত বেকার যুবকদের জন্য কেবল অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত নন, তাদের আশার আলোও। বর্তমানে তিনি এক হাজার হাঁসের খামারের মালিক । অনুকূল পরিবেশ ও প্রাকৃতিক খাবারের সহজলভ্যতার জন্য হাঁসগুলো বেশী ডিম দেয়। দু'বছর আগে বিদেশ যাওয়ার জন্য যে অর্থ ঋণ করেছিলেন, খামারের আয় থেকে সে অর্থ পরিশোধ করে দিয়েছেন এবং কিছু জায়গা-জমিও কিনেছেন। খামারের পরিধি বেড়ে যাওয়ায় দু'জন কর্মচারী রেখেছেন খামার দেখাশুনার জন্য। এছাড়া হাঁসের খামার গড়ে উঠার কারণে খাদ্য, শামুক ও হাঁসের ডিম বিক্রির মাধ্যমে আরো ১০ জনের কর্মসংস্থানের পথ সৃষ্টি হয়েছে। তার দেখাদেখি এ অঞ্চলে অনেকগুলো হাঁসের খামার গড়ে উঠেছে। নায়েব আলীর স্বপ্ন আগামীতে হরিহারা গ্রামের প্রতিটি বেকার যুবক হাঁস-মুরগি পালনের প্রশিক্ষণ নিয়ে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে সারা দেশের যুব সম্প্রদায়ের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ সৃষ্টি করবে।