দন্ত্য ব্যঞ্জনধ্বনির মুখ্য বাপ্রত্যঙ্গ কোনটি ?
উচ্চারণের স্থান ও প্রকৃতি এবং ধ্বনির কম্পন ও বায়ুপ্রবাহ বিবেচনায় ব্যঞ্জনধ্বনিকে অন্তত চার ধরনে ভাগ করা যায়: ১. উচ্চারণস্থান অনুযায়ী বিভাজন, ২. উচ্চারণের প্রকৃতি অনুযায়ী বিভাজন, ৩. ধ্বনির কম্পনমাত্রা অনুযায়ী বিভাজন এবং ৪. ধ্বনি সৃষ্টিতে বায়ুর প্রবাহের মাত্রা অনুযায়ী বিভাজন।
বাকপ্রত্যঙ্গের ঠিক যে জায়গায় বায়ু বাধা পেয়ে ব্যঞ্জনধ্বনি সৃষ্টি করে সেই জায়গাটি হলো ঐ ব্যঞ্জনের উচ্চারণস্থান। উচ্চারণস্থান অনুযায়ী ব্যঞ্জনধ্বনিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়: ১. ওষ্ঠ্য ব্যঞ্জন, ২. দন্ত্য ব্যঞ্জন, ৩. দন্তমূলীয় ব্যঞ্জন, ৪. মূর্ধন্য ব্যঞ্জন, ৫. তালব্য ব্যঞ্জন, ৬. কণ্ঠ্য ব্যঞ্জন, ৭. কণ্ঠনালীয় ব্যঞ্জন।
ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণের সময়ে কোন বাষ্প্রত্যঙ্গের অংশগ্রহণ মুখ্য এবং কোন বাষ্প্রত্যঙ্গের অংশগ্রহণ গৌণ, নিচের সারণিতে তা দেখানো হলো:
ধ্বনি | মুখ্য বাকপ্রত্যঙ্গ | গৌণ বাকপ্রত্যঙ্গ |
ওষ্ঠ্য ব্যঞ্জন | নিচের ঠোট | উপরের ঠোট |
দন্ত্য ব্যঞ্জন | জিভের ডগা | উপরের পাটির দাঁত |
দন্তমূলীয় ব্যঞ্জন | জিভের ডগা | দন্তমূল |
মূর্ধন্য ব্যঞ্জন | জিভের ডগা | দন্তমূলের পিছনের উঁচু অংশ (মূর্ধা) |
তালব্য ব্যঞ্জন | জিভের সামনের অংশ | শক্ত তালু |
কণ্ঠ্য ব্যঞ্জন | জিভের পেছনের অংশ | নরম তালু |
কণ্ঠনালীয় ব্যঞ্জন | ধ্বনিদ্বারের দুটি পাল্লা | ধ্বনিদ্বার |
ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণে বাক্ প্রত্যঙ্গের সক্রিয়তা
যেসব ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণের সময়ে ঠোঁট দুটি কাছাকাছি এসে বায়ুপথে বাধা সৃষ্টি করে, সেগুলোকে ওষ্ঠ্য ব্যঞ্জন বলে। এগুলো দ্বি-ওষ্ঠ্য ধ্বনি নামেও পরিচিত। পাকা, ফল, বাবা, ভাই, মা প্রভৃতি শব্দের প, ফ, ব, ড, ম ওষ্ঠ্য ব্যঞ্জনধ্বনির উদাহরণ।
যেসব ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণের সময়ে জিভের ডগা উপরের পাটির দাঁতে লেগে বায়ুপথে বাধা সৃষ্টি করে, সেগুলোকে দন্ত্য ব্যঞ্জন বলে। তাল, থালা, দাদা, ধান প্রভৃতি শব্দের ত, থ, দ, ধ দন্ত্য ব্যঞ্জনধ্বনির উদাহরণ।
যেসব ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণের সময়ে জিভের ডগা উপরের পাটির দাঁতের গোড়ার সঙ্গে লেগে বায়ুপথে বাধা সৃষ্টি করে, সেগুলোকে দন্তমূলীয় ব্যঞ্জন বলে। নানা, রাত, লাল, সালাম প্রভৃতি শব্দের ন, র, ল, স দন্ত্যমূলীয় ব্যঞ্জনধ্বনির উদাহরণ।
দন্তমূল এবং তালুর মাঝখানে যে উঁচু অংশ থাকে তার নাম মুর্ধা। যেসব ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণের সময়ে জিভের ডগা মূর্ধার সঙ্গে লেগে বায়ুপথে বাধা সৃষ্টি করে, সেগুলোকে মূর্ধন্য ব্যঞ্জন বলে। টাকা, ঠেলাগাড়ি, ডাকাত, ঢোল, গাড়ি, মূঢ় প্রভৃতি শব্দের ট, ঠ, ড, ঢ, ড়, ঢ় মূর্ধন্য ব্যঞ্জনধ্বনির উদাহরণ।
যেসব ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণের সময়ে জিভের ডগা খানিকটা প্রসারিত হয়ে শক্ত তালুর কাছে বায়ুপথে বাধা সৃষ্টি করে, সেগুলোকে তালব্য ব্যঞ্জন বলে। চাচা, ছাগল, জাল, ঝড়, শসা প্রভৃতি শব্দের চ, ছ, জ, ঝ, শ তালব্য ব্যঞ্জনধ্বনির উদাহরণ।
যেসব ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণের সময়ে জিভের পিছনের অংশ উঁচু হয়ে আলজিভের কাছাকাছি নরম তালুর কাছে বায়ুপথে বাধা সৃষ্টি করে, সেগুলোকে কণ্ঠ্য ব্যঞ্জন বলে। কাকা, খালু, গাধা, ঘাস, কাঙাল প্রভৃতি শব্দের ক, খ, গ, ঘ, ঙ কণ্ঠ্য ব্যঞ্জনধ্বনির উদাহরণ।
কণ্ঠনালীয় ব্যঞ্জন উচ্চারণের সময়ে ধ্বনিদ্বার থেকে বায়ু কণ্ঠনালি হয়ে সরাসরি বের হয়ে আসে। হাতি শব্দের হ কণ্ঠনালীয় ব্যঞ্জনধ্বনির উদাহরণ।
ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণের সময়ে ঠোঁট, জিভ, জিভমূল ইত্যাদি বাক্সত্যঙ্গের আকৃতিগত পরিবর্তন হয়। এতে বায়ুপথে সৃষ্ট বাধার ধরন আলাদা হয়ে উচ্চারণের প্রকৃতি বদলে যায়। উচ্চারণের এই প্রকৃতি অনুযায়ী ব্যঞ্জনধ্বনিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা: স্পৃষ্ট ব্যঞ্জন, নাসিক্য ব্যঞ্জন, উষ্ম ব্যঞ্জন, পার্শ্বিক ব্যঞ্জন, কম্পিত ব্যঞ্জন, তাড়িত ব্যঞ্জন ইত্যাদি।
যেসব ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণের সময়ে দুটি বাষ্প্রত্যঙ্গ পরস্পরের সংস্পর্শে এসে বায়ুপথে বাধা তৈরি করে, সেগুলোকে স্পৃষ্ট ব্যঞ্জন বলে। এগুলো স্পর্শ ব্যঞ্জনধ্বনি নামেও পরিচিত। পথ, তল, টক, চর, কল শব্দের প, ত, ট, চ, ক স্পৃষ্ট ব্যঞ্জনধ্বনি। উচ্চারণস্থান অনুযায়ী এগুলোকে ওষ্ঠ স্পৃষ্ট, দন্ত স্পৃষ্ট, মুর্ধা স্পৃষ্ট, তালু স্পৃষ্ট এবং কণ্ঠ স্পৃষ্ট - এই পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়, যথা -
ওষ্ঠ সৃষ্ট ব্যঞ্জন: প, ফ, ব, ভ
দন্ত স্পষ্ট ব্যঞ্জন: ত, থ, দ, ধ
মূর্ধা স্পৃষ্ট ব্যঞ্জন: ট, ঠ, ড, ঢ
তালু স্পৃষ্ট ব্যঞ্জন: চ, ছ, জ, ঝ
কণ্ঠ স্পৃষ্ট ব্যঞ্জন: ক, খ, গ, ঘ
যেসব ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণের সময়ে ফুসফুস থেকে আসা বাতাস মুখের মধ্যে প্রথমে বাধা পায় এবং নাক ও মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়, সেসব ধ্বনিকে নাসিক্য ব্যঞ্জন বলে। মা, নতুন, হাঙর প্রভৃতি শব্দের ম, ন, ও নাসিক্য ব্যঞ্জনধ্বনি।
যেসব ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণের সময়ে দুটি বাষ্প্রত্যঙ্গ কাছাকাছি এসে নিঃসৃত বায়ুতে ঘর্ষণ সৃষ্টি করে, সেগুলোকে উষ্ম ব্যঞ্জন বলে। সালাম, শসা, হুঙ্কার প্রভৃতি শব্দের স, শ, হ উষ্ম ধ্বনির উদাহরণ। উচ্চারণস্থান অনুসারে উষ্ম ব্যঞ্জন ধ্বনিগুলোকে দন্তমূলীয় (স), তালব্য (শ), এবং কণ্ঠনালীয় (হ) এই তিন ভাগে ভাগ - করা যায়। এগুলোর মধ্যে স এবং শ-কে আলাদাভাবে শিস ধ্বনিও বলা হয়ে থাকে। কারণ স, শ উচ্চারণে শ্বাস অনেকক্ষণ ধরে রাখা যায় এবং শিসের মতো আওয়াজ হয়।
যে ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণের সময়ে জিভের ডগা দন্তমূল স্পর্শ করে এবং ফুসফুস থেকে আসা বাতাস জিভের দুই পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়, তাকে পার্শ্বিক ব্যঞ্জন বলে। লাল শব্দে ল পার্শ্বিক ব্যঞ্জনধ্বনির উদাহরণ।
যে ধ্বনি উচ্চারণের সময়ে জিভ একাধিক বার অতি দ্রুত দন্তমূলকে আঘাত করে বায়ুপথে বাধা সৃষ্টি করে, তাকে কম্পিত ব্যঞ্জন বলে। কর, ভার, হার প্রভৃতি শব্দের র কম্পিত ব্যঞ্জনধ্বনির উদাহরণ।
যে ধ্বনি উচ্চারণের সময়ে জিভের সামনের অংশ দন্তমূলের একটু উপরে অর্থাৎ মূর্ধায় টোকা দেওয়ার মতো করে একবার ছুঁয়ে যায়, তাকে তাড়িত ব্যঞ্জন বলে। বাড়ি, মূঢ় প্রভৃতি শব্দের ড়, ঢ় তাড়িত ব্যঞ্জনধ্বনির উদাহরণ।
ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণের সময়ে স্বরযন্ত্রের ধ্বনিদ্বারে বায়ুর কম্পন কমবেশি হওয়ার ভিত্তিতে ব্যঞ্জনধ্বনিকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়: ঘোষ ও অঘোষ।
যেসব ধ্বনি উচ্চারণের সময়ে ধ্বনিদ্বারের কম্পন অপেক্ষাকৃত বেশি, সেসব ধ্বনিকে বলা হয় ঘোষধ্বনি। যথা: ব, ভ, ম, দ, ধ, ন, র, ল, ড, ঢ, ড়, ঢ়, জ, ঝ, গ, ঘ, ঙ, হ।
যেসব ধ্বনি উচ্চারণের সময়ে ধ্বনিদ্বারের কম্পন অপেক্ষাকৃত কম, সেসব ধ্বনিকে বলা হয় অঘোষধ্বনি, যথা: প, ফ, ত, থ, স, ট, ঠ, চ, ছ, শ, ক, খ।
ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণের সময়ে বায়ুপ্রবাহের বেগ কমবেশি হওয়ার ভিত্তিতে ব্যঞ্জনধ্বনিকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়: অল্পপ্রাণ ও মহাপ্রাণ।
সেসব ধ্বনি উচ্চারণের সময়ে ফুসফুস থেকে নির্গত বায়ুপ্রবাহের মাত্রা অপেক্ষাকৃত কম, সেগুলোকে বলা হয় অল্পপ্রাণ ধ্বনি। যেমন প, ব, ত, দ, স, ট, ড, ড়, চ, জ, শ, ক, গ ইত্যাদি।
সেসব ধ্বনি উচ্চারণের সময়ে ফুসফুস থেকে নির্গত বায়ুপ্রবাহ অপেক্ষাকৃত বেশি, সেগুলোকে বলা হয় মহাপ্রাণ ধ্বনি। যেমন- ফ, ভ, থ, ধ, ঠ, ঢ, চ, ছ, ঝ, খ, ঘ, হ ইত্যাদি।