মিসেস শাহানার দিন শুরু হয় কাকডাকা ভোরে। ওয়াশিং মেশিনে কাপড় দেওয়া, ছেলে-মেয়ের টিফিন তৈরি করা, তাদের বাবার নাস্তা এরপর নিজে তৈরি হয়ে অফিসে যাওয়া। তার মেয়ে সারা দশম শ্রেণিতে আর ছেলে সামি অষ্টম শ্রেণিতে তাদেরও কোনো ফুরসত নেই। স্কুল শেষে ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, গণিত, আরো কত কোচিং, বাড়ি ফিরে আবার স্কুলের কাজ, বাড়ির কাজ, কোচিং এর কাজ। স্কুল-কোচিং আর বাড়ির চার দেয়াল এই যেন তাদের জীবন। বাবা-মা অফিস শেষে তাদের পছন্দের খাবার নিয়ে ফিরেন, নয়তো নিজেরাই অনলাইনে অর্ডার দিয়ে পছন্দের খাবার আনিয়ে নেয়।
মিসেস তামিমা মেয়ের প্রাতিষ্ঠানিক বই ছাড়া অন্য কোনো বইপড়া সময় আর অর্থের অবচয় মনে করেন। মেয়ের হাতে কোনো গল্প-উপন্যাস দেখলেই ঘোর আপত্তি তার। তিনি মনে করেন ভালো প্রাতিষ্ঠানিক ফলাফল এরপর ভালো চাকরি-এই তো জীবন। কিন্তু স্বামী হাবীব রহমান স্ত্রীর এই ধারণার ঘোর বিরোধী আর তাই তো মেয়ের জন্য অপ্রাতিষ্ঠানিক বই বিশেষ করে জীবনী, গল্প-উপন্যাস-এইসব কিনে দেওয়াতে কখনো আপত্তি করেন না। তিনি বলেন- মনের বিকাশের জন্য, আলোকিত হওয়ার জন্য সাহিত্য চর্চার বিকল্প নেই।
একমাত্র সন্তান কাব্য বাকপ্রতিবন্ধী বিষয়টি যখন জানলেন মিসেস শরীফা একটুও ঘাবড়ালেন না: স্বামীকেও বোঝালেন। বাবা-মা'র পরম স্নেহ-মমতা ও আদর-যত্নে বেড়ে উঠতে লাগলো কাব্য। একদিন মা লক্ষ্য করলেন ছেলে আপন মনে কাগজে আঁকি-বুকি করছে: তিনি বুঝে গেলেন মুখে ভাষা না থাকলেও তুলির আঁচড়েই সে একদিন বিশ্বজয় করবে। স্বামীর সাথে পরামর্শ করে ছেলের আঁকা-আঁকির জন্য যা যা করা দরকার সব করলেন। আজ দেশে-বিদেশে কাব্যে'র আঁকা ছবি প্রদর্শনী হচ্ছে। বিক্রি হচ্ছে বহুমূল্যে।
অধ্যাপক ডক্টর মনজুর রশীদের গবেষণার বিষয় ছিল নাট্যসাহিত্য। নাটকের প্রতি তাঁর ভীষণ অগ্রহ: নাটক লেখেন, নাট্যরূপ দেন আবার মঞ্চায়নেরও ব্যবস্থা করেন। নিজ জেলা কুষ্টিয়ার বিভিন্ন লোককবির পালাগান ও কাহিনি সংগ্রহের কাজে হাত দেন। একবার পদ্মা-গড়াই নদীর তীরবর্তী এলাকার দুইজন লোককবির লোকগাথা সংগ্রহ করে নাট্যরূপ দেন এবং নিজেই পরিচালনা ও নির্দেশনা দিয়ে সেগুলো দেশে-বিদেশে মঞ্চায়নের ও প্রচারের ব্যবস্থা করেন।
আরাফ আর আয়মান যেন একবৃন্তে দুটি কুসুম। এইচএসসি পাসের পর দুজনই ভর্তি হলো তাদের কাক্ষিত ও স্বপ্নের বুয়েটে। এর মধ্যে আয়মান আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের খোঁজ-খবর নেয় কারণ, বুয়েট শেষ করে সে আমেরিকা পাড়ি জমাতে চায়। কিন্তু আরাফের এককথা পড়াশুনা শেষ করে সে দেশেই থাকবে। যা করবে দেশের জন্যই করবে-এভাবে সবাই দেশ ছেড়ে গেলে দেশই বা কীভাবে সমৃদ্ধি অর্জন করবে? আজ আয়মান আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু তার মন পড়ে থাকে দেশের বিস্তীর্ণ মাঠ, অবারিত ধানক্ষেত, বন্ধু-বান্ধব, ছুটোছুটি এসবের মধ্যে। আরাফের সাথে কথা বললেই সে তার ফেলে যাওয়া সব কিছু নিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে।
ছেলের অসুস্থতার খবর পেয়ে বাড়িতে ছুটে আসেন পাগলপ্রায় ফারহানা বাস্ত ও উদ্বিগ্ন অবস্থায় স্বামীকেও খবর পাঠান। ঘরে ফিরে দেখেন জ্বরে ছেলের গা পুড়ে যাচ্ছে। ঝাঁড়ফুকের জন্য তার শাশুড়ি গ্রামের ইদ্রিস মোল্লাকে নিয়ে এসেছেন। এসব বাদ দিয়ে ফারহানা ছেলেকে নিয়ে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। ডেঙ্গু আশঙ্কা করে চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপত্র দিলেন। পরদিন পরীক্ষার রিপোর্ট ডেঙ্গু শনাক্ত হয় এবং ছেলের প্লাটিলেট দ্রুত কমতে থাকে। ফারহানা ছেলেকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে নাওয়া-খাওয়া ভুলে সারাক্ষণ ছেলের সেবা করে তাকে সারিয়ে তোলেন। এদিকে তার শাশুড়ি নাতির রোগমুক্তি কামনা করে মসজিদে দান করার মানত করেন।
মেডিকেলে পড়ার সুযোগ পায়নি বলে সুইটি নাওয়া-খাওয়া সব বাদ দিয়েছে: যোগাযোগ বন্ধ করেছে বন্ধু-বান্ধবের সাথেও। তার সেই এককথা "আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না'-সে আর পড়াশুনাও করতে চায় না। মেয়ের কথা শুনে বাবা হাসেন বলেন, "মানবজীবনই হলো সংগ্রামের, মেডিকেলে পড়াই জীবনের সব নয়, তুমি তোমার মেধা যে কোনো কাজে লাগিয়ে সফল হতে পার। কোনো সাধারণ বিষয়ে পড়াশুনা করে তুমি 'অসাধারণ' হয়ে উঠতে পারো, প্রতিটি দায়িত্বশীল ও সময়ানুবর্তী মানুষ পৃথিবীতে সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। বাবার কথা মেনে সুইটি আজ একজন সফল বিসিএস কর্মকর্তা। অনেকের আদর্শ-অনুকরণীয়।