আমরা প্রায়শই দেখি ডাক্তার-নার্সন হাসপাতাল বা ক্লিনিকে রোগীদের শরীরে বিভিন্ন সরঞ্জাম যেমন: থার্মোমিটার, রক্তচাপ মাপার মেশিন, স্টেথোস্কোপ কিংবা খালি হাতে বা খালি চোখে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকেন। এটি স্বাস্থ্য বিজ্ঞান বা মেডিক্যাল সাইন্সে মানবদেহের সাধারণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা নামে অবস্থিত। অনেক সময় নিজের বাড়িতেও আমরা অসুস্থ কারো সাধারণ এই ধরনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে থাকি। অর্থাৎ, সাধারণ স্বাস্থ্য পরীক্ষার মৌলিক বিষয়গুলো জানা থাকলে এবং উল্লেখিত যন্ত্রাদি ব্যবহার সম্পর্কে সাধারণ কিছু দক্ষতা থাকলে যেকোনো মানুষই প্রয়োজনের সময় চট করে পরিমাপ করে ফেলতে পারে মানবদেহে রক্তের চাপ, নাড়ির গতি কিংবা তাপমাত্রা প্রভৃতি। আগের অধ্যায়গুলোতে আমরা পেশেন্ট কেয়ার টেকনিক এবং মানবদেহের গঠন ও ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে প্রাথমিক কিছু ধারণা লাভ করেছি। এই অধ্যারে আমরা সাধারণ স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ভাষিক জ্ঞান ও যন্ত্রপাতি সম্পর্কে ধারণা লাভের পাশাপাশি কিভাবে খুব সহজ ও সঠিক উপায়ে সাধারণ স্বাস্থ্য পরীক্ষার কাজটি সম্পন্ন করা যায় সে বিষয়ে ব্যবহারিক দক্ষতা অর্জন করতে পারব।
এ অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা
উল্লিখিত শিখনফল অর্জনের লক্ষ্যে এই অধ্যায়ে আমরা বিভিন্ন আইটেমের জব (কাজ) সম্পন্ন করব। এই জবের মাধ্যমে আমরা মানবদেহের উচ্চতা ও ওজন, নাড়ির গতি, শ্বাসপ্রশ্বাসের হার, তাপমাত্রা ও রক্তচাপ পরিমাপ করতে পারবো। জবগুলো সম্পন্ন করার পূর্বে প্রথমেই আমরা প্রয়োজনীয় তাত্ত্বিক বিষয়সমূহ জানবো।
স্বাস্থ্য সেবাপ্রার্থী যেকোনো রোগী বাঁ ব্যক্তিকে প্রথমেই কিছু সাধারণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। যার মাধ্যমে একজন সেবাপ্রদানকারী (Service Provider) রোগীটি সম্পর্কে প্রাথমিক কিছু ধারণা লাভ করে । এগুলোকে বলা হয় সাধারণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা বাঁ বেসিক হেল্থ স্ক্রিনিং যা রোগীর কোনো নির্দিষ্ট সমস্যা বা রোগের প্রাথমিক অবস্থা সনাক্তকণের একটি কার্যকর উপায়, এমনকি যদি কোনো রোগের লক্ষণ বা উপসর্গ নাও থাকে।
সাধারণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা বলতে আমরা সাধারণত মানবদেহের চারটি মৌলিক লক্ষণ (vital signs) যেমন: শরীরের তাপমাত্রা, রক্তচাপ, নাড়ির গতি বা হৃদস্পন্দন এবং শ্বাস প্রশ্বাসের গতি (Respiration Rate) পরিমাপ করে থাকি। এছাড়াও আরো কিছু সাধারণ পরীক্ষা নিরীক্ষা যেমন শরীরের ওজন ও উচ্চতা, রক্তের গ্লুকোজ বা শর্করার মাত্রা পরিমাপ বা প্রস্রাবের প্রকৃতি বা পরিমাণ জানতে পারি। এই পরীক্ষাগুলো হাসপাতাল বাঁ ক্লিনিকে সাধারণত ডাক্তার বা নার্সগণ পরিমাপ করে থাকেন। তবে নির্দেশনা অনুযায়ী কেয়ারগিভারও পরিমাপ করতে পারেন। আবার বৃদ্ধাশ্রম কিংবা হোম কেয়ার সেটিংসে যেহেতু কেয়ারগিভারই রোগীর সার্বক্ষণিক সঙ্গী, সেহেতু এই বিষয়গুলো প্রাথমিকভাবে একজন কেয়ারগিভারকেই সঠিকভাবে পরিমাপ করে লিপিবদ্ধ করতে হয় এবং প্রয়োজনে চিকিৎসককে অবহিত করতে হয়।
তবে পূর্নাঙ্গ স্বাস্থ্য পরীক্ষা বলতে এর চেয়ে আরো অনেক বেশিকিছু বুঝানো হয়, যেটি একজন ডাক্তারের নির্দেশনায় সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে রুটিন কিছু টেস্টও অন্তর্ভুক্ত। চিকিৎসকগণ রোগীর সমস্যা অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের রক্ত পরীক্ষা, প্রস্রাব পরীক্ষা ইত্যাদির মাধ্যমে রোগ নির্নয় করে থাকেন। তবে এই অধ্যায়ে আমরা কেবল সাধারণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা সম্পর্কিত জ্ঞান ও দক্ষতা অনুশীলন করবো যাতে করে কর্মক্ষেত্রে আমরা এই দক্ষতাগুলো পেশাদারিত্বের সাথে প্রয়োগ করতে পারি।
শারীরিক পরীক্ষা বা ফিজিক্যাল এসেসমেন্ট রোগীর রোগ নির্নয়ের জন্য চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহৃত একটি অত্যাবশ্যকীয় কৌশল। ডাক্তার-নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীগণ কোনো রোগীর শারীরিক বিভিন্ন পরীক্ষা সম্পন্ন করার জন্য চারটি মৌলিক পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকেন। এগুলো হচ্ছে :
ক. ইনস্পেকশন (Inspection): ইনস্পেকশন এর অর্থ হলো চোখ দিয়ে দেখা। কোনো রোগীকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার সময় চোখ দিয়ে দেখে (ভিশন) শরীরের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে সাধারণ কিছু ধারণা করা যায়। খালি চোখে আমরা রোগীর বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অবস্থা, রঙ বা কালার, আকার-আকৃতি, গঠন বা টেক্সচার (Texture), প্রতিসাম্য ( Symettrey), নড়াচড়া প্রভৃতি বিষয় নির্নয় করতে পারি। এটি স্বাস্থ্য পরীক্ষার একেবারে প্রথম ধাপ। গুরুত্বপূর্ণ ভাইটাল সাইন শ্বাসপ্রশ্বাসের হারও আমরা ইন্সপেকশনের মাধ্যমে বুক ও পেটের উঠানামা দেখে পরিমাপ করে থাকি।
খ. পালপেশন (Palpation) : পালপেশন মানে হলো রোগীর শরীর স্পর্শ করে পরীক্ষা করা। এই স্পর্শ বনা পালপেশন আবার দুই রকম; লাইট পালপেশন বা হালকা স্পর্শ এবং ডীপ পালপেশন বা গভীর স্পর্শ। শরীরের কোনো অস্বাভাবিকতা বুঝার জন্য বিভিন্ন অপপ্রভাল বাঁ বডি পার্টস পালপেট করতে হয়। লাইট পালপেশনের মাধ্যমে আমরা শরীরের উপরিভাগের গঠন, কোমলতা বা টেন্ডারনেস, টেমপারেচার বা তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, স্থিতিস্থাপকতা, স্পদন, টিউমার প্রভৃতি পরীক্ষা করতে পারি ৷ এটার জন্য হাতের আংগুলের ডগা (Finger Pad) দিয়ে খুব আলতোভাবে আধা ইঞ্চি পর্যন্ত চামড়ার উপর চাপ দেওয়া হয়। আবার ডীপ পলিপেশনের ক্ষেত্রে চামড়ার উপর দিয়ে দেয় বাঁ দুই ইঞ্চি পর্যন্ত গভীর চাপ দেওয়া হয়। অনেক সময় অধীক চাপ প্রয়োগের প্রয়োজন হলে দুই হাত একসাথে রেখে গভীর চাপ দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে আমরা শরীরের ভিতরের অরগান যেমন কিডনী, পাকস্থলী প্রভৃতি অঙ্গের আকার-আকৃতি, ব্যথা ও এর প্রকৃতি, প্রতিসাম্যতা, অবস্থান ইত্যাদি বিষয় নির্ণয় করতে পারি।
গ. পারকাশন (Percussion) : পারকাশন বলতে আঙুল বা হাত দিয়ে দ্রুত এবং তীক্ষ্ণভাবে রোগীর শরীরের বিভিন্ন অংশে টোকা দিয়ে পরীক্ষা করাকে বুঝায়। এর মাধ্যমে বিভিন্ন অঙ্গের অবস্থান, আকৃতি-প্রকৃতি, সীমানা, অবস্থান প্রভৃতি বিষয় সনাক্ত করা যায়। শরীরের কোনো অভন্তরীণ অঙ্গে যেমন কিডনি বাঁ ফুসফুসে পানি বাঁ গ্যাসীয় পদার্থ আছে কিনা তা সনাক্ত করতেও পারকাশন ব্যবহার করা হয়। পারকেশন দুই প্রকার: ডাইরেক্ট বা সরাসরি পারকাশন এবং ইনডাইরেক্ট বা পরোক্ষ পারকাশন। ভাইরেক্ট পারকাশনে হাতের একটি বাঁ দুটি আঙ্গুলের সাহায্যে রোগীর শরীরে সরাসরি টোকা দেওয়া হয়। আর ইনডাইরেক্ট পারকাশনে একটি হাত রোগীর শরীরে রেখে সেই হাতের উপরে অন্য হাতের আঙ্গুল দিয়ে একইভাবে টোকা দেওয়া হয়। উভয় ক্ষেত্রেই টোকার প্রকৃতি ও শব্দ লক্ষ করা হয়। রোগীর ব্যথা আছে কিনা সেটা রোগীকে জিজ্ঞেস করে এবং তার মুখায়াব দেখেও ৰুঝা যায়। অনেক সময় বিশেষ একধরনের হাতুড়ি দিয়ে এটি করা হয়ে থাকে। এটিকে বলা হয় পারকাশন হ্যামার।
ঘ. অসকালটেশন (Amscultation): স্টেথোস্কোপ নামক একটি বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে বিভিন্ন ইন্টার্নাল অরগান বা আভ্যন্তরীণ অঙ্গ যেমন: ফুসফুস, হার্ট বা হৃৎপিণ্ড কিংবা অস্ত্রের শব্দ (বাওয়েল সাউন্ড শোনার কৌশলকেই অসকালটেশন বলা হয়। এই শব্দের মাধ্যমে অরগানটি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায় যেমন, সেখানে পানি বা গ্যাস জমে গেছে কিনা, অস্বাভাবিক কোনো ফিজিওলজি আছে কিনা প্রভৃতি। এ জন্য একটু নিরিবিলি পরিবেশ হলে শব্দ ভালোভাবে শোনা যায় ।
হেল্থ স্ক্রিনিং-এর গুরুত্ব ( Importance of Health Screening)
সুস্থ অসুস্থ সকলের জন্যই সাধারণ স্বাস্থ্য পরীক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। একটি নির্দিষ্ট সময় গর গর (সাধারণত ৬-১২ মাস) মানুষের শরীরে সুপ্ত কোনো রোগ আছে কি না তার পরীক্ষা করার নামই হেল্থ স্ক্রিনিং। অনেক দেশেই হেল্থ ইন্সুরেন্স-এর প্রচলন অটা না থাকায় কোনো সমস্যা দেখা না দিলে কেউ নিজের টাকা খরচ করে ডাক্তারের কাছে যেতে চান না। কিন্তু এই অসতর্কতা জীবনে অনেক সময় বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে । জৰে প্ৰাপ্ত বয়স্ক বিশেষ করে যাদের বয়স ৪০ বছর বা তার বেশি তাদের জন্য হেন ক্ষিনিং অত্যন্ত জরুরি। হেল্থ স্ক্রিনিং এর মূল বিষয় হচ্ছে যে সমস্ত রোপের প্রাথমিক অবস্থায় কোনো লক্ষণ থাকে না সেগুলোকে শনাক্ত করা। যেমন- ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্ত চাপ, কিডনীর সমস্যা, হার্টের সমস্যা, রক্তের চর্বি বা কোলেষ্টেরলের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, রক্ত শূন্যতা, মূত্রনালীতে বাঁ শরীরের অন্য যেকোনো জায়গায় ইনফেকশন, পেটের ভিতরে পিত্তথলি, কিডনি ও মূত্রথলিতে পাথর, জরায়ুর সমস্যা ইত্যাদি রোগসমূহ হেল্থ স্ক্রিনিং এর মাধ্যমে অনেক প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত করা যায়। হেল্থ স্ক্রিনিংএ সাধারণত সিবিসি- (কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট), ফাস্টিং ব্লাড সুগার, সেরাম ক্রিয়েটিনিন, ইউরিন আরএমই, ইসিজি, আল্ট্রাসনোগ্রাফি, লিপিড প্রোফাইল ইত্যাদি করতে দেওয়া হয়। এসব টেস্টের মাধ্যমে কোনো রোগের প্রাথমিক অবস্থা অথবা কারো কোনো পূর্বের অসুখ থাকলেও তার অবস্থা জানা যায়। শরীরের লুকিয়ে থাকা অসুখ জটিল আকার ধারণ করার আগেই হেলথ স্ক্রিনিং করা খুবই প্রয়োজন। তবে একজন কেয়ারগিভার হিসেবে আমরা মানবদেহের তাপমাত্রা, নাড়ির গতি, ব্লাড প্রেসার, প্রস্বাসের হার-শ্বাস প্রভৃতির মাধ্যমেই হেল্থ স্ক্রিনিং এর প্রাথমিক কাজ সমাপন্ন করবো। এগুলোকে বলা হয় ভাইটাল সাইন্স বাঁ মানবদেহের অত্যাবশ্যকীয় লক্ষণসমূহ। এর পাশাপাশি মানবদেহের উচ্চতা, ওজন, বডি ম্যাস ইনডেক্স, তরল পদার্থের ইনটেক ও আউটপুট দেখা, রক্তের গ্লুকোজ ও অক্সিজেনের পরিমাণ ইত্যাদিও হেল্থ স্ক্রিনিং এর অন্তর্ভুক্ত। যেগুলো একজন কেয়ারগিভার সহজেই তার কর্মক্ষেত্রে অনুশীলন করতে পারে। এ ধরনের পরীক্ষা সাধারণত কোনো রোগ সরাসরি ডায়াগণসিস করে না, এটা অনুমেয় স্বাস্থ্য ঝুঁকির উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি প্রকাশ করতে সাহায্য করে।
ভাইটাল সাইন বাঁ অত্যাবশ্যকীয় লক্ষণ হল কোনো ব্যক্তি বাঁ রোগীকে প্রাথমিকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য ব্যবহৃত অত্যাবশ্যকীয় কতগুলো শরিরবৃত্তীয় সাইন বাঁ লক্ষণ। এই পরিমাপগুলো একজন ব্যক্তির সাধারণ শারীরিক স্বাস্থ্যের মূল্যায়ন করতে ব্যবহৃত হয়। মূলত চার ধরনের ভাইটাল সাইন আছে যথা: তাপমাত্রা, স্পন্দন, শ্বাস-প্রশ্বাসের হার এবং রক্তচাপ। কোনো ব্যক্তির দেহে ভাইটাল সাইনগুলো স্বাভাবিক পরিমাপের চেয়ে কম বাঁ বেশি হয়ে গেলে সেটি নির্দিষ্ট কোনো সমস্যার কারণে হচ্ছে বলে ধরে নেয়া যায়। তখন চিকিৎসক আরো উন্নত পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারেন। প্রধান ৪ প্রকার ভাইটাল সাইন নিম্নরুপ:
ভাইটাল সাইনের নাম | সহজে মনে রাখার উপায় |
১। তাপমাত্রা (Temperature) | T (Temperature) |
২। নাড়ির স্পন্দন (pulse / heart rate) | P (Pulse) |
৩। শ্বাস-প্রশ্বাস (Respiratory rate) | R (Respiration) |
৪। রক্তচাপ (Blood Pressure) | BP (Blood Pressure) |
টেবিল ৪.১: বিভিন্ন ধরনের ভাইটাল সাইন্স
এর পাশাপাশি আমরা মানবদেহের উচ্চতা ও ওজন, বিএমআই, দেহে তরল পদার্থের ইনটেক ও আউটপুট, রক্তের শর্করা ও অক্সিজেনের পরিমাণও নির্নয় করে থাকি।
রোগীর গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণগুলো বা ভাইটাল সাইন পর্যবেক্ষণ করা চিকিৎসা পেশাদারদের মধ্যে একটি সাধারণ অনুশীলন। স্বাস্থ্যসেবায় এর বিভিন্ন গুরুত্ব রয়েছে। যেমন:
১। রোগীর স্বাস্থ্য এবং ক্লিনিকাল ফলাফলগুলোতে মূল ভূমিকা পালন করে।
২। নিয়মিতভাবে লক্ষণগুলো পর্যবেক্ষণ করে স্বাস্থ্যসেবা কাজে নিয়োজিত পেশাদারগণ রোগীর অবস্থার পরিবর্তন সনাক্ত করতে পারেন।
৩। এটি প্রাথমিকভাবে রোগীর অবনতি সনাক্ত করতে এবং রোগীর ক্ষতি করতে পারে এমন সমস্যাগুলো প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।
৪। গুরুতর লক্ষণগুলোর পরিবর্তন দ্রুত সনাক্তকরণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৫। হেল্থ স্ক্রিনিং-এ কোনো ব্যত্যয় ঘটলে উপযুক্ত চিকিৎসা শুরু করতে বিলম্ব ঘটে এবং রোগীর আরোগ্যকে প্রলম্বিত করে ও মারাত্বক স্বাস্থ্যঝুকির সন্মুখিন হয়। সুতরাং, ভাইটাল সাইন প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবায় এক অপরিসীম গুরুত্ব বহন করে।
শারীরিক তাপমাত্রা চারটি গুরুত্বপূর্ণ জরুরি লক্ষণগুলোর মধ্যে একটি যা নিরাপদ এবং কার্যকর সেবা নিশ্চিত করার জন্য পরিমাপ করা হয়। শিশু থেকে প্রাপ্ত বয়স্ক যেকোনো তীব্র অসুস্থতার প্রাথমিক মূল্যায়নের অংশ হিসেবে চিকিৎসকগণ তাপমাত্রা পরিমাপের নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। শরীরের তাপমাত্রা পরিমাপ করার জন্য ব্যবহৃত পদ্ধতি এবং দক্ষতার ভিন্নতার কারণে তাপমাত্রার তারতম্য লক্ষ করা যায়। তাই তাপমাত্রা সঠিকভাবে পরিমাপ করার জন্য সর্বাধিক উপযুক্ত কৌশলটি ব্যবহার করা প্রয়োজন। ভুল ফলাফল ব্যক্তির রোগ নির্নয় ও চিকিৎসার উপর প্রভাব ফেলতে পারে।
তাপমাত্রা: তাপমাত্রা হচ্ছে শরীরের তাপীয় অবস্থা যা মানবদেহের তাপপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে। অন্যভাবে বলা যায়, মানবদেহের শরীর কতটুকু ঠাণ্ডা বা কতটুকু গরম তাপমাত্রা দিয়ে তা বুঝা যায়।
তাপমাত্রা পরিমাপের গুরুত্ব: শরীরের তাপমাত্রা পরিমাপ চিকিৎসা বিজ্ঞানে খুব গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ধরনের রোগ শরীরের তাপমাত্রা পরিবর্তনের দ্বারা চিহ্নিত হয়। এটি একটি প্রাথমিক সতর্কতা লক্ষণ যা নির্ণয় করতে পারে যে একজন মানুষ অসুস্থ হতে চলেছে। শরীরের তাপমাত্রা পরিমাপ করে রোগের চিকিৎসা শুরু করা যেতে পারে। দেহের নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য দেহ তার স্বাভাবিক তাপমাত্রার পরিবর্তন করে। জ্বর শরীরের তাপমাত্রায় রোগ বৃদ্ধির সর্বাধিক সাধারণ রূপ। এটি শরীরে সংক্রমণের প্রথম প্রতিক্রিয়াগুলোর মধ্যে একটি। শরীরের তাপমাত্রা পরিমাপ করে তাড়াতাড়ি রোগ সনাক্ত করতে সহায়তা করে। হাইপোথ্যালামাস নামে পরিচিত মস্তিষ্কের কিছু অংশ দেহের ক্রিয়াকলাপের জন্য সর্বোত্তম পরিবেশ বজায় রাখার জন্য নিয়মিত দেহের তাপমাত্রাকে সামঞ্জস্য করে। যখন ইমিউন সিস্টেমটি শরীরে কোনো ভাইরাস অথবা সংক্রমনের উপস্থিতি সনাক্ত করে, তখন হাইপোথ্যালামাসকে তাপমাত্রা বাড়িয়ে চালু করার ইঙ্গিত দেয় যাকে আমরা জ্বর বলে অবহিত করি। এটি দেহের অভ্যন্তরে একটি উষ্ণ এবং বৈরী পরিবেশ যা জীবানুকে দুর্বল করে এবং প্রতিরোধক প্রতিক্রিয়া জাগিয়ে তোলে। তাই দেহের তাপমাত্রা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা খুবই জরুরি, বিশেষ করে অসুস্থ রোগীদের ক্ষেত্রে।
তাপমাত্রা পরিমাপক যন্ত্র: তাপমাত্রা পরিমাপক যন্ত্রের নাম হল থার্মোমিটার। অর্থাৎ যে যন্ত্রের সাহায্যে কোনো বস্তুর তাপমাত্রা সঠিকভাবে পরিমাপ করা যায় এবং বিভিন্ন বস্তুর তাপমাত্রার পার্থক্য নির্ণয় করা যায় তাকে থার্মোমিটার বলে। মানবদেহের তাপমাত্রা পরিমাপ করার জন্যেও থার্মমিটার নামক যন্ত্রটি ব্যবহার করা হয়। তাপমাত্রা পরিমাপের জন্য বিভিন্ন প্রকার থার্মোমিটার রয়েছে, তবে মানদেহের তাপমাত্রা পরিমাপের জন্য অধিক ব্যবহৃত এমন তিনটি থার্মোমিটার নিয়ে এখানে আলোচনা করা হলো:
১। ক্লিনিক্যাল বা গ্লাস থার্মোমিটার: এর প্রাধানত তিনটি অংশ। এর নিচের দিকে থাকে সরু মারকারি বাল্ব, মূল বর্তি কাচের গ্লাস দিয়ে আবধ্য এবং এর মাঝখানে থাকে লিকুইড মার্কারী বা পারদপূর্ণ কলাম যা দ্বারা তাপমাত্রার পরিমাণ নির্ণয় করে। একে অনেক সময় পারদ বা মার্কারী থার্মোমিটারও বলা হয়ে থাকে। এটিতে ৯৪-১০৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৩৫-৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত স্কেল থাকে।
২। ডিজিটাল থার্মোমিটার: এটিরও নিচের দিকে থাকে সরু মারকারি বাল্ব, বডির মাঝখানে একটি ডিসপ্লে থাকে যেখানে তাপমাত্রা দেখা যায়। ডিসপ্লের উপরে একটু সুইচ থাকে যার মাধ্যমে থার্মোমিটারটি চালু এবং বন্ধ করা যায়। এর কোন স্কেল থাকে না তাপমাত্রা সরাসরি ডিসপ্লেতে দেখা যায়।
৩। ইনফ্রারেড থার্মোমিটার: এটি সাধারণ সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে শরীরের তাপমাত্রা পরিমাপের জন্য ব্যবহার করা হয়। এই মার্মোমিটার দিয়ে তাপমাত্রা মাপার জন্য পারদপূর্ণ অংশটি রোগীর শরীরে স্পর্শ করার প্রয়োজন হয় না। যেমন, সাম্প্রতিক করোনা মহামারির সময় আমাদের দেশেও এর ব্যাপক ব্যবহার দেখা গেছে। এর উপরের ও সামনের দিকে একটা স্ক্যানার থাকে যা তাপমাত্রা নির্ণয় করে এবং পিছন দিকে একটা ডিসপ্লে থাকে যেখানে ভাপমাত্রা দেখা যায়। ডিসপ্লের নিচের দিকে একটি সুইচ থাকে যার মাধ্যমে থার্মোমিটারটি চালু এবং বন্ধ করা যায়।
তবে ডিজিটাল ও ইনফ্রারেড থার্মোমিটার অনেক সময় ব্যয়সাধ্য বিধায় আমাদের দেশে হাসপাতাল, ক্লিনিক কিংবা বাসাবাড়িতে শরীরের তাপমাত্রা মাপার ক্ষেত্রে এনালপ থার্মোমিটারের ব্যবহার কিছুটা বেশি দেখা যায়। এটিকে আবার ক্লিনিক্যাল থার্মোমিটারও বলা হয়ে থাকে।
আবার শরীরের কোন অংশ থেকে ভাপমাত্রা নেয়া হচ্ছে সেটির উপর নির্ভর করে থার্মোমিটারকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন:-
১। ওরাল থার্মোমিটার: সজ্ঞান রোগীর জন্য সবচেয়ে উপযোগী হচ্ছে ওরাল থার্মোমিটার। এ ধরনের থার্মোমিটার দিয়ে সাধারণত জিহ্বার নিচে একপাশে রেখে তাপমাত্রা মাপা হয়। এক্ষেত্রে স্বার্মোমিটারটি অবশ্যই জীবাণুমুক্ত ও পরিষ্কার করে ব্যবহার করতে হবে। মুখে তাপমাত্রা পরিমাপের ৫-১০ মিনিট পূর্বে কোন ঠাণ্ডা বা গরম খাবার গ্রহণ, ব্যায়াম বা ধুমপান করা যাবে না। এতে সঠিক তাপমাত্রা নাও আসতে পারে। ৫ বছরের কম বয়সের বাচ্চাদের মুখে তাপমাত্রা নেয়া যাবে না। আবার মুখে অস্ত্রপাচার হয়েছে, অজ্ঞান কিংবা মানসিক সমস্যা আছে এমন রোগীর ক্ষেত্রে সুখে তাপমাত্রা পরিমাপ করা যায় না।
২। এক্সিলারি থার্মোমিটার: বাহুর নিচে (Armpit বা axilla ) ক্লিনিক্যাল থার্মোমিটার রেখে তাপমাত্রা মাপা যায়। এটি শিশুদের জন্যে সবচেয়ে সুবিধাজনক স্থান। এক্সিলারি তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ১ ডিগ্রি ফারেনহাইট কম থাকে।
৩। রেকটাল থার্মোমিটার: পায়ুপথের মাধ্যমে শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা পরিমাপের জন্য ব্যবহার করা হয় ব্রেকটাল থার্মোমিটার। সাধারণত যেসকল রোগীর মুখে তাপমাত্রা মাপতে পারে না (যেমন, অজ্ঞান রোগী, মুখে অপারেশন বা সার্জারী হয়েছে এমন রোগী) তাদের ক্ষেত্রে এ ধরনের থার্মোমিটার ব্যবহার করা হয়। পায়ুপথে ভাপমাত্রা পরিমাণের সময় বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ১ ইঞ্চি এবং বড়দের ক্ষেত্রে ১.৫ ইঞ্চি থার্মোমিটার পায়ু পথে প্রবেশ করাতে হবে। এক্ষেত্রে থার্মোমিটার প্রবেশ করানোর সময় কখনোই জোরে ধাক্কা দেওয়া যাবে না। পায়ুপথে ভাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ১ ডিগ্রি বেশি থাকে।
৪। টিমপেনিক থার্মোমিটার: টিমপেনিক থার্মোমিটারে একটি সেন্সর থাকে যার মাধ্যমে ইনফ্রারেড থার্মোমিটারের মত কানের টিমপেনিক পর্দার তাপমাত্রা পরিমাপ করা হয়। এক্ষেত্রেও তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ১.৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট বেশি পাওয়া যায়।
সাধারণত মুখের তাপমাত্রা মানবদেহের আদর্শ তাপমাত্রা নির্দেশ করে। এক্সিলারি তাপমাত্রার সাথে সাধারণত ১ ডিগ্রি ফারেনহাইট যোগ করে এবং রেকটাল বা পায়ুপথে প্রাপ্ত তাপমাত্রা থেকে ১ ডিগ্রি ফারেনহাইট বিয়োগ করলে তা মুখের ভাগমাত্রার সমান হয়।
তাপমাত্রা পরিমাণের স্কেল ও সংকেত
মানবদেহের তাপমাত্রাকে সাধারণত দুটি ছেলে পরিমাণ করা হয়। যেমন:
স্কেলের নাম | সংকেত |
১। সেলসিয়াস স্কেল | °C |
২। ফারেনহাইট স্কেল | °F |
এক স্কেল থেকে অন্য স্কেলে তাপমাত্রা রূপান্তরের সূত্র: সেলসিয়াস থেকে ফারেনহাইট: C/5=F-32/9
উদাহরণ: ৩৭.৩ ডিগ্রী সেলসিয়াসকে ফারেনহাইটে রূপান্তর ।
আমরা জানি,C/5=F-32/9;
Or; 37.3/5= F-32/9; Or, 5F - 160 = 335.7; Or, 5F = 335.7 +160; Or, F = 495.7/5; Or, F=99.14; So, F= 99.10
অর্থাৎ, সেলসিয়াস স্কেলে প্রাপ্ত ৩৭.৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস হলে তা ফারেনহাইট স্কেলে ৯৯.১ ডিগ্রী ফারেনহাইট।
মানবদেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা: মানবদেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা হলো ৯৮.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর নরমাল রেঞ্জ হলো ৯৭.০ থেকে ৯৯.০ ডিগ্রী ফারনহাইট কিংবা 36.1 থেকে 37.2 ডিগ্রি সেলসিয়াস। শরীরের তাপমাত্রা যখন স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায় তখন তাকে জ্বর বা পাইরেক্সিয়া বা হাইপারথার্মিয়া বলা হয়। অর্থাৎ জ্বর হলে দেহের তাপমাত্রা ৯৯.০ °F এর অধিক নির্দেশ করে। আবার যদি শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যায় তখন তাকে হাইপোথার্মিয়া বলা হয়।
তাপমাত্রা পরিমাপের উপায়: ক্লিনিক্যাল থার্মোমিটার ব্যবহার করে তাপমাত্রা পরিমাপের সাধারণত চারটি উপায় রয়েছে। যথা :
১. এক্সিলারি মেথড (বগলের নিচে)
২. ওরাল মেথড (মুখে)
৩. টিম্প্যানিক মেথড (কানে) ও
৪. রেকটাল মেথড (মলদ্বারে বা পায়ুপথে)।
ক্লিনিক্যাল ও ডিজিটাল থার্মোমিটার দিয়ে তাপমাত্রা মাপার পদ্ধতি :
আবার ইনফ্রারেড থার্মোমিটার দিয়ে তাপমাত্রা মাপার ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে থেকে রোগীর শরীরে ইনফ্রারেড রশ্মির সাহায্যে তাপমাত্রা মেপে নেয়া যায় খুব সহজেই।
টেম্পারেচার বা তাপমাত্রা চার্ট: টেম্পারেচার বা তাপমাত্রা চার্ট হল এমন একটি চার্ট যা দেহের তাপমাত্রা নথিভুক্ত ও রেকর্ড করতে ব্যবহৃত হয়। হাসপাতাল বা ক্লিনিকে কাজ করতে গেলে কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত চার্টে তাপমাত্রা রেকর্ড করতে হয়। আবার হোম কেয়ার সেটিংসে প্রায়শই কেয়ারগিভার নিজেই এটি ছক করে বানিয়ে নিয়ে রেকর্ড করে।
টেম্পারেচার চার্ট প্রনরুন: টেম্পারেচার চার্ট প্রনয়নে কিছু বিষয়ের প্রতি নজর রাখা অবশ্যই বাঞ্জনীয়। টেম্পারেচার চার্টের সাধারণত দুই ধরনের তথ্য সম্বলিত অংশ থাকে। যথা: প্রথম অংশ ও দ্বিতীয় অংশ।
নিম্নে একটি টেমপারেচার চার্টের নমুনা দেওয়া হল:
দিনে যদি ২ এর অধিক বার তাপমাত্রা দেখা হয় তাহলে প্রয়োজন মত সময় ও তাপমাত্রার কলাম বাড়িয়ে নিতে হবে। উল্লেখযোগ্য যদি কোনো বিশেষ মন্তব্য থাকে তাহলে তা নির্দিষ্ট ঘরে নোট করতে হবে।
থার্মোমিটার রক্ষণাবেক্ষণ
অন্যান্য মেডিকেল সরঞ্জামাদির মতই থার্মোমিটার রক্ষণাবেক্ষণ একটি অবশ্য করণীয় কাজ। ব্যবহারের পর থার্মোমিটার সাবান মিশ্রিত পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে অবথা ৭০% আইসোপ্রোপ্রাইল এলকোহল দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। থার্মোমিটারকে ৪২ ডিগ্রী সেলসিয়াস বা ১০৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট এর বেশি তাপমাত্রায় রাখা যাবে না। সূর্যের আলো সরাসরি পড়ে এমন স্থানেও রাখা যাবে না। মার্কারী বাল্বটি সবসময় নিচের দিকে রাখতে হবে এবং থার্মোমিটারের তাপমাত্রা ৯৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর নিচে নামিয়ে রাখতে হবে। এছাড়াও কাজ করার পূর্বে থার্মোমিটারটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি আছে কিনা তা চেক করে নিতে হবে এবং কাজ করার পর নির্দিষ্ট জায়গায় পরবর্তীতে ব্যবহার উপযোগী করে সংরক্ষণ করতে হবে। বাসাবাড়িতে থার্মোমিটার অবশ্যই ছোট বাচ্চাদের নাগালের বাইরে রাখতে হবে।
নাড়ির গতি ও শ্বাসপ্রশ্বাসের হার খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুটি ভাইটাল সাইন্স যেগুলো একজন কেয়ারগিভার খুব সহজেই পরিমাপ করতে পারে। অন্যান্য ভাইটাল সাইনের মতই এগুলোও রেস্টিং বা রোগীকে বিশ্রামরত অবস্থায় পরিমাপ করতে হয়।
মানবদেহের হৃৎপিণ্ড একটি স্বয়ংক্রিয় পাম্পের মতো দেহাভ্যন্তরে সারাক্ষণ সংকোচন-প্রসারনের মাধ্যমে স্পন্দিত হয়। হৃৎপিণ্ডের এই স্পন্দনকে হৃদস্পন্দন বা হার্ট-বিট বলা হয়। এই হৃৎস্পন্দনের মাধ্যমেই হৃৎপিন্ড আমাদের শরীরে রক্ত প্রবাহিত করে। একজন সুস্থ মানুষের হৃৎস্পন্দন প্রতি মিনিটে ৬০-৯০ বা ৬০-১০০ বার হয়। এটিকে হার্ট-বিটও বলা হয়। বুকের বাম পার্শ্বে হৃৎপিণ্ডের এপেক্সের উপর স্টেথোস্কোপ নামক যন্ত্রের সাহায্যে এই শব্দ শোনা যায়। আবার হাতের কব্জির রেডিয়াল আর্টারি বা রেডিয়াল ধমনিতে হৃৎস্পন্দন অনুভব করা যায়। এটিকে তখন পাল্স নামেও অভিহিত করা হয়। স্টেথোস্কোপের সাহায্যে হৃৎস্পন্দনের যে শব্দ শোনা যায় তাকে হার্টসাউন্ড বলে। হৃৎস্পন্দন বা হার্ট-বিটকে যখন প্রতি মিনিটে হাতের কব্জির রেডিয়াল আর্টারিতে আঙ্গুলের মাধ্যমে পালপেশন করে গণনা করা যায় তখন তাকে পাল্স রেট বলা হয়। হৃদপিণ্ডের নিলয় সংকোচনের ফলে রক্তচাপের দরুন রক্ত সারা শরীরে ছড়িয়ে যাওয়ার সময় ধমনীর গায়ে যে চাপ দেয় তাকে হার্টবিট বা নাড়ির গতি বলে। পালস রেট হল হৃদপিণ্ড এক মিনিটে যে পরিমাণ বিট দেয় তার সংখ্যা। এই হৃদস্পন্দন আর্টারি বা ধমনীতে পাওয়া যায়। পুরুষদের তুলনায় নারীদের পালস রেট বেশী থাকে। আবার বড়দের তুলনায় বাচ্চাদের হার্টবিট আরো বেশী হয়।
নরমাল পালস রেট: একজন প্রাপ্ত বয়ষ্ক মানুষের মিনিটে সাধারণত ৬০ থেকে ৯০ বা ১০০ বার বিট দেয়।
পালস দেখার সাইট: যেসব সাইটগুলোতে পালস দেখা হয় সেগুলো হল-
মানবদেহে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট স্থানে হাতের আঙ্গুলের সাহায্যে সহজেই পাল্স রেট মাপা যায়। স্থানানুযায়ী ঐ পালুসের নামকরণ করা হয়। যেমন:
১। রেডিয়াল পাল্স : বেইজ অফ থাম্ব (base of thumb) বা বৃদ্ধাঙ্গুলির গোড়ায় এটি পাওয়া যায় ।
২। টেম্পোরাল পাল্স: সাইড অফ ফোরহেড (side of forehead) বা কপালের দুই পাশে এটি পাওয়া যায় ।
৩। ক্যারোটিড পাল্স: সাইড অফ নেক (side of neck) বা ঘাড়ের দুই পাশে এটি পাওয়া যায়।
৪। ব্র্যাকিয়াল পাল্স: ইনার আস্পেক্ট অফ এলবো (Inner aspect of elbow) অর্থাৎ, দুই কনুইয়ের ভিতরের দুই পাশে এটি পাওয়া যায়।
৫। ফিমোরাল পাল্স: ইনার আস্পেক্ট অফ আপার থাই (Inner aspect of upper thigh) অর্থাৎ, থাইয়ের উপরে উরুর দুই সন্ধিস্থলে এটি পাওয়া যায়।
চিত্রে আরো কিছু স্থানের কথা উল্লেখ করা আছে যেখান থেকে আমরা পালপেশনের মাধ্যমে খুব সহজেই নাড়ির গতি পরিমাপ করতে পারি।
পাল্স রেট পরিমাপ করার পদ্ধতি: উপরের চিত্রে প্রদর্শিত স্থানসমূহের যেকোনোটিতে পালপেশনের সাহায্যে পাল্স রেট পরিমাপ করা যায়। হাতের কব্জির (রিষ্ট) উপরে যে আর্টারি থাকে তাকে রেডিয়াল আর্টারি বলে। এই আর্টারি থেকেই সাধারণত পাল্স রেট পরিমাপ করা হয়। রেডিয়াল আর্টারি থেকে প্রাপ্ত পাল্স কে রেডিয়াল পাল্স বলা হয়ে থাকে। নিচে রেডিয়াল,পাল্স পরিমাপ করার ধারাবাহিক পদ্ধতি উল্লেখ করা হলো:
আবার পাল্স অক্সিমিটার যন্ত্রের সাহায্যে খুব সহজেই পাল্স রেটের পাশাপাশি অক্সিজেন স্যাচুরেশন, ডিজিটাল মেশিনে মাপা যায়। রক্তে অক্সিজেনের শতকরা মাত্রাকেই মেডিকেলের ভাষায় বলা হয় অক্সিজেন স্যাচুরেশন। একজন সুস্থ ব্যক্তির রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা থাকা উচিৎ ৯০ থেকে ১০০ শতাংশ। অক্সিজেন ৯০ এর নিচে নেমে গেলেই সমস্যা শুরু হয়। মাত্রা বেশি কমে গেলে রোগীকে কৃত্রিমভাবে অক্সিজেন দিতে হয়। পাস অক্সিমিটারের সাহায্যে পাস ও অক্সিজেন স্যাচুরেশন মাপার জন্য রোগীর আঙ্গুলে চিত্রের ন্যায় ডিজিটাল মেশিনটি লাগিয়ে দিতে হয়। তারপর সুইচ টিপে সেটি চালু করলে ১ মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ডিসপ্লেতে পালস রেট ও অক্সিজেনের মাত্রা চলে আসে।
শ্বাসপ্রশ্বাসের হার বা রেসপিরেটরি রেট হল একজন ব্যক্তির প্রতি মিনিটে শ্বাস-প্রশ্বাসের সংখ্যা। কোনো ব্যক্তিকে বিশ্রামরত অবস্থায় রেখে এটি পরিমাপ করতে হয়। আমরা ফুসফুসে অক্সিজেন নেয়ার জন্য শ্বসনযন্ত্রের মাধ্যমে বাতাস নেই, এটিকে নিঃশ্বাস বা শ্বাস বলে আবার যখন কার্বনডাইঅক্সাইড যুক্ত বাতাস বের করে দেই, সেটিকে বলে প্ৰশ্বাস। এই শ্বাস-প্রশ্বাসের হার প্রতি মিনিটে বুক কতবার ওঠা-নামা করে তা গণনা করে পরিমাপ করা হয়। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক সুস্থ ব্যক্তির বিশ্রামরত অবস্থায় স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাসের হার হল মিনিটে ১২ থেকে ২০ টি। কোনো ব্যক্তির এটি যদি ১২ থেকে ২০ এর মধ্যেই থাকে তাহলে তিনি স্বাভাবিকভাবেই শ্বাসপ্রশ্বাস নিচ্ছেন বলা যায়, যেটিকে মেডিকেলের ভাষায় বলা হয় 'ইউশনিয়া (Eupnea)। আবার এটি ১২ এর কম হলে তাকে বলা হয় ব্র্যাডিশনিয়া (Bradypnea) এবং ২৫ এর বেশি হলে তাকে বলা হয় ট্যাকিনিয়া (Tachypnea)। ব্র্যাডিপনিয়া ও ট্যাকিপনিয়া অস্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস নির্দেশ করে এবং এর দ্বারা অন্য কোনো শারীরিক বা মানসিক সমস্যার উপস্থিতি বুঝা যায়। ব্র্যাভিলনিয়া ও ট্যাকি পনিয়ার কিছু উপসর্গ আছে যেগুলো দেখে এগুলোকে সহজেই সনাক্ত করা যায়। যেমন :
ব্র্যাডিপনিয়া | ট্যাকিপনিয়া |
|
|
আবার বয়সভেধে শ্বাসপ্রশ্বাসের হার বিভিন্ন হয়। যেমন:
বয়স | শ্বাসপ্রশ্বাসের হার (প্রতি মিনিটে) |
নবজাতক ইনফ্যান্ট টভলার চাইল্ড এডোলসেন্ট প্রাপ্তবয়স্ক | ৩০-৬০ ব্রেদ/মিনিট ২৫-৪০ ব্রেদ/মিনিট ২০-৩০ ব্রেদ/মিনিট ২০-২৫ ব্রেদ/মিনিট ১৫-২০ ব্রেদ/মিনিট ১২-২০ ব্রেদ/ মিনিট |
টেবিল : বয়সবেধে শ্বাসপ্রশ্বাসের হার
শ্বাসপ্রশ্বাসের হার বা রেসপিরেটরি রেট পরিমাপের পদ্ধতিঃ
৪.৫.১ রক্তচাপ বা ব্লাড প্রেসার কি?
হৃৎপিণ্ডের সংকোচন ও প্রসারণের ফলে হৃৎপিণ্ড থেকে রক্ত ধমনীর মধ্য দিয়ে সমগ্র শরীরে প্রবাহিত হওয়ার সময় ধমনীর ভিতরের দেওয়ালে যে পার্শ্বচাপ বা প্রেসার উৎপন্ন করে, তাকে রক্তচাপ বা ব্লাড প্রেসার বলে। ভাই রক্তচাপ বলতে সাধারণভাবে ধমনির রক্তচাপকেই বুঝানো হয়। এটি মানবদেহের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া যা মাধ্যমে দেহকোষে অক্সিজেন ও প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ নিশ্চিত হয়। রক্তচাপ হৃৎপিণ্ডের কার্যকারিতা, ধর্মনির প্রাচারের স্থিতিস্থাপকতা, রক্তের ঘনত্ব ও পরিমাপের উপর নির্ভর করে। আমরা ইতোমধ্যেই হৃৎপিন্ডের ঘটন সম্পর্কে জেনেছি। হৃৎপিণ্ডের স্বতস্ফূর্ত সংকোচনকে সিস্টোল (Systole) এবং স্বতস্ফূর্ত প্রসারণকে ডায়াস্টোল (Diastole) বলে। অলিন্দে যখন সিস্টোল হয়, নিলয় তখন ডায়াস্টোল অবস্থায় থাকে। নিলয়ের সিস্টোল অবস্থায় ধমনিতে যে চাপ থাকে তাকে সিস্টোলিক রক্তচাপ এবং ডায়াস্টোল অবস্থায় যে চাপ থাকে, তাকে ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ বলে। সিস্টোলিক চাপ ওপরে এবং ডায়াস্টোলিক চাপ নিচে লিখে রক্তচাপ প্রকাশ করা হয়। যেমন, ১২০/৮০ মি.মি. পারদ চাপ ( mmHgP) বলতে বুঝায় সিস্টোলিক চাপ ১২০ এবং ডায়াস্টোলিক চাপ ৮০ মি.মি. পারদ চাপ। এটি একজন প্রাপ্ত বয়স্ক সুস্থ মানুষের আদর্শ রক্তচাপ। স্বাভাবিক ও সুস্থ একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সিস্টোলিক রক্তচাপের পাল্লা পারদস্তম্ভের ১১০-১৪০ মিলিমিটার এবং ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ পারদ স্তম্ভের ৬০-৯০ মিলিমিটার। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঊর্ধ্ব বাহুর ব্র্যাকিয়াল ধমনিতে নির্দিষ্ট উপায়ে রক্তচাপ পরিমাপ করা যায়। এছাড়াও শরীরের আরো কিছু স্থানে রক্তচাপ মাপা যায়। স্ফিগমোমেনোমিটার নামক যন্ত্রের সাহায্যে রক্তচাপ নির্ণয় করা হয়।
শ্রেণিবিভাগ | সিস্টোলিক | ডায়াস্টোলিক |
সাধারণ | ১২০ | ৮০ |
উচ্চ রক্তচাপের পূর্বাবস্থা (প্রি-হাইপারটেনশেন) | ১২০-১৩৯ | ৮০-৮৯ |
উচ্চ রক্তচাপ পর্যায় ১ | ১৪০-১৫৯ | ৯০-৯৯ |
উচ্চ রক্তচাপ পর্যায় ২ | ১৬০ বা তার বেশি | ১০০ বা তার বেশি |
মারাত্মক ঝুকিপূর্ণ উচ্চ রক্তচাপ (হাইপারটেনসিভ ক্রাইসিস) | ১৮০ বা তার বেশি | ১১০ বা তার বেশি |
টেবিল : রক্তচাপের সারণী
উচ্চ রক্তচাপ: হাইপারটেনশনের আরেক নাম উচ্চ রক্তচাপ, যাকে HTN দিয়ে প্রকাশ করা হয়। যখন কোনো ব্যক্তির রক্তের চাপ সব সময়েই স্বাভাবিকের চেয়ে ঊর্ধ্বে থাকে, তখন ধরে নেওয়া হয় তিনি হাইপারটেনশনে ভুগছেন। কারো রক্তচাপ যদি উভয় বাহুতে ১৪০/৯০ মি.মি. বা তার ওপরে থাকে, তাহলে তার উচ্চ রক্তচাপ হয়েছে বলা যেতে পারে।
ঝুঁকি: শরীরের অন্যান্য অঙ্গের ওপর স্বল্প থেকে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে এই উচ্চ রক্তচাপ। বিশেষত স্ট্রোক, হার্ট ফেইলিওর, হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া, চোখের ক্ষতি এবং বৃক্ক বা কিডনির বিকলতা ইত্যাদি রোগের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায় ।
কারণ: অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ, অতিরিক্ত মেদ, কাজের চাপ বা টেনশন, মদ্যপান, অতিরিক্ত আওয়াজ, বদ্ধ পরিবেশ ইত্যাদি উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। আবার এটি বংশগত সূত্রে প্রাপ্ত একটি অসুখও। তবে ধারণা করা হয়, প্রায় ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে উচ্চমাত্রার কারণ হিসেবে লবণের ব্যবহারকে দায়ী করা হয়।
করণীয়: চিকিৎসকরা মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের রক্তচাপের জন্য ওজন কমানো, ধূমপান ছেড়ে দেওয়া এবং নিয়মিত হালকা ব্যায়ামকে চিকিৎসার প্রথম ধাপ হিসেবে ধরেন। যদিও ধূমপান ছেড়ে দেওয়ায় সরাসরি রক্তচাপ কমে না; কিন্তু উচ্চ রক্তচাপের সঙ্গে এটি সম্পৃক্ত, কারণ এটি ছেড়ে দিলে উচ্চ রক্তচাপের বেশ কিছু উপসর্গ নিয়ন্ত্রণে আসে। যেমন স্ট্রোক অথবা হার্ট অ্যাটাক। মৃদু উচ্চ রক্তচাপ সাধারণত খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, ব্যায়াম এবং শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সারিয়ে তোলা যায়। ফল, শাকসবজি, স্নেহবিহীন দুগ্ধজাত খাদ্য এবং নিম্নমাত্রার লবণ ও তেলজাতীয় খাদ্য উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। এ ছাড়া পরিবেশগত চাপ যেমন উঁচু মাত্রার শব্দের পরিবেশ বা অতিরিক্ত আলো পরিহার করাও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য উপকারী। এর পরও যাঁরা মাঝারি থেকে উচ্চ রক্তচাপে ভোগেন, তাঁদের রক্তচাপ নিরাপদ মাত্রায় নিয়ে আসার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শে অনির্দিষ্টকালের জন্য ওষুধের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়।
নিম্ন রক্তচাপ: নিম্ন রক্তচাপ বা Low Blood pressure শব্দটা বেশ প্রচলিত। মেডিক্যাল পরিভাষায় নি রক্তচাপ হলো দেহের রক্ত সংবহনতন্ত্রের এমন একটি অবস্থা, যেখানে রক্তের সিস্টোলিক চাপ ৯০ মি.মি. পারদের নিচে এবং ডায়াস্টোলিক চাপ ৬০ মি.মি. পারদের নিচে থাকে।
কারণ: দেহে রক্তের পরিমাণ কমে যাওয়া, রক্তস্বল্পতা, হরমোনের পরিবর্তন, রক্তগাত্রের প্রশস্ততা বেড়ে যাওয়া, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, হৃৎপিণ্ড কিংবা অন্তঃক্ষরা গ্রন্থির সমস্যা, ঠিকমতো বা সময়মতো না খেলে নিম্ন রক্তচাপ হতে পারে। তবে রক্তের পরিমাণ কমে যাওয়াই হাইপাটেনশনের প্রধান কারণ বলে ধরা হয়। এ ছাড়া রক্তপাত, অপর্যাপ্ত তরল গ্রহণ যেমন অনশন কিংবা অতিরিক্ত ফ্লুইড বের হয়ে যাওয়া; যেমন বমি কিংবা ডায়রিয়ার কারণেও নিম্ন রক্তচাপ হয় ।
ঝুঁকি: যাদের রক্তচাপ অস্বাভাবিক হারে কম, তাদের হৃক্রিয়া, অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি কিংবা মস্তিষ্কজাত সমস্যা থাকতে পারে। এই রক্তচাপ বজায় থাকলে মস্তিষ্ক এবং অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গে রক্ত সরবরাহ কম থাকার কারণে সেখানে অক্সিজেন ও পুষ্টির অভাব হতে পারে, যা জীবনের জন্য হুমকির কারণ হতে পারে।
করণীয়: আলু, ডিম, মাছ, মাংস, ছানা, বাদাম, সবুজ শাক ইত্যাদি এবং লবণযুক্ত খাবার গ্রহণ, খাদ্যে কিছু ইলেকট্রোলাইট (গ্লুকোজ ও স্যালাইন) যোগ, সকালে ক্যাফেইন গ্রহণ সহায়ক হতে পারে। আমাদের শরীরের প্রতিটি অঙ্গের সুস্থতার জন্য রক্তচাপকে নিরাপদ মাত্রার মধ্যে রাখা প্রয়োজন। তাই নিয়মিত রক্তচাপ মাপা সবার জন্যই অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য নিচের সতর্কতামূলক নিয়মগুলো পালন করলে উপকার পাওয়া যায়:
১। ডায়াবেটিস থাকলে সেটি নিয়ন্ত্রণে রাখা ।
২। দেহের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা।
৩। চর্বিযুক্ত খাবার বর্জন করা, যেমন: ঘি, মাখন, গরু ও খাসির মাংস, চিংড়ি ইত্যাদি।
৪। সুষম খাদ্য গ্রহণ করা ।
৫। পরিমাণের অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকা।
৬। নিয়মিত ব্যায়াম করা।
৭। ধুমপান থেকে বিরত থাকা।
৮। দৈনিক ৭/৮ ঘণ্টা ঘুমান।
৯। মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তামুক্ত জীবনযাপন করা।
১০। খাবারে অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ থেকে বিরত থাকা।
অসুস্থ রোগীদের ক্ষেত্রে ডাক্তারের নির্দেশনা মোতাবেক রক্তচাপ মাপা হয়ে থাকে। রক্তচাপ মাপার জন্য স্ফিগমোমেনোমিটার নামক যন্ত্র ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এটি মূলত তিন প্রকারের হতে পারে।
ক. এনারয়েড স্ফিগমোমেনোমিটার
খ. পারদ স্ফিগমোমেনোমিটার ও
গ. ডিজিটাল স্ফিগমোমেনোমিটার।
এনারয়েড স্ফিগমোমেনোমিটারের সাহায্যে রক্তচাপ পরিমাপের জন্য স্টেথিস্কোপ নামক যন্ত্রের প্রয়োজন হয় যার সহায়তায় শব্দের মাধ্যমে সিস্টোলিক ও ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ নির্ধারণ করা হয়। ডিজিটাল থার্মোমিটার সরাসরি রক্তচাপ পরিমাপ করে একটি ডিজিটাল স্ক্রিনে ফলাফল প্রদর্শন করে। পক্ষান্তরে পারদ স্ফিগমোমেনোমিটারে ফলাফলটি প্রদর্শিত হয় একটি পারদ মিটারে।
তবে হাসপাতাল, ক্লিনিক বা অন্যান্য সেবাদানকেন্দ্রে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এনারয়েড স্কিলমোনেলোমিটারের বহুল ব্যবহার দেখা যায়। নিচে একটি আদর্শ এনারয়েড মোমেনোমিটারের বিভিন্ন অংশ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
১। বিপি বা ব্লাড প্রেসার কাফ (BP Cuff or Blood Pressure Cuff): এটি একটি ইনফ্ল্যাটেবল ব্যাগ যা ধমনীকে আটকানোর জন্য হাতকে সংকুচিত করতে ব্যবহৃত হয়। সঠিকভাবে ব্ল্যাকিয়াল আর্টারিকে নির্ধারণ করার জন্য রোগীর বয়স ও শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী সঠিক মাপের বিপি কাষ ব্যবহার করতে হয়। বয়স্ক ও শিশুদের জন্য পৃথক বিপি কাফ ব্যবহার করতে হয়। প্রাপ্তবয়স্ক রোগীর জন্য বাহুর আকারের উপর নির্ভর করে ১২*২২ সে.সি. থেকে শুরু করে ১৬*৪২ সে.মি. পর্যন্ত হতে পারে। আবার বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এটি ৪*৮ থেকে ৯*১৮ সে.মি. পর্যন্ত হতে পারে।
২। ইনফ্লেশন বাল্ব (Inflation Bulb): এয়ার রিলিজ বাল্ব বন্ধ রেখে ইনফ্লেশন বাল্ব হাত দিয়ে চেপে চেপে বিপি কাফের ভিতরে প্রয়োজন অনুযায়ী বাতাস প্রবেশ করানো যায়।
৩। এয়ার রিলিজ বাল্ব (Afr Release Bulb): এয়ার রিলিজ বাল্বের মাধ্যমে বিপি কাফের ভিতরে বাতাসের আসা যাওয়া নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
৪।এনারয়েড ম্যানোমিটার (Anaroid Manometer): এটি একটি চাপ পরিমাপক যন্ত্র যেটি মি. মি. পারদ চাপ এককে রক্ত চাপ পরিমাপ করে।
৫। টিউব কানেক্টর (Tube Connector): টিউব কানেকটরের সাহায্যে এনাররেড ম্যানোমিটার ও ইনফেশন বাল্ব বিপি কাফের সাথে সংযুক্ত হয়। এর মাধ্যমে বাতাস ভিতরে প্রবেশ করে ও বাহিরে যার আবার চাপের কারণে ম্যানোমিটারের কাটা উঠা নামা করা যায়।
স্টেথোস্কোপ (Stethoscope): স্টেথোস্কোপ হলো মানুষ অথবা প্রাণিদেহের হৃদস্পন্দন কিংবা অন্যান্য অভ্যন্তরীণ শব্দ শোনার জন্য ব্যবহৃত একটি যন্ত্র। এটি প্রধানত হৃদস্পন্দন এবং নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে ব্যবহার করা হয়। তবে এটি আর, ধমনী এবং শিরার রক্ত বয়ে চলার শব্দ শোনার জন্যও ব্যবহৃত হয় ।
প্রকারভেদ: স্টেথোস্কোপ বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
১. Acuortic Stethoscope: আমাদের দেশের চিকিৎসকেরা সচরাচর এই ধরনের স্টেথোস্কোপ ব্যবহার করেন। বাজারে বিভিন্ন কোম্পানির একুয়ান্টিক থার্মোমিটার পাওয়া যায়।
২. Electronic Stethoscope: এ ধরনের স্টেথোস্কোপ শব্দতরঙ্গকে বৈদ্যুতিক সংকেতে পরিণত করে সেটিকে অ্যাম্পি-ফাই করে জোরালো ও পরিষ্কার শব্দে পরিণত করে।
৩. Noise Reduction Stethoscope: এ ধরনের স্টেথোস্কোপ চারপাশের অপ্রয়োজনীয় নয়েজ বাদ দিয়ে কেবল কাংখিত শব্দ শুনতে সাহায্য করে ।
8. Recording Stethoscope: এর সাহায্যে শুভ শব্দকে রেকর্ড করে রাখা যায় এবং পরবর্তীতে ধারনকৃত শব্দ বিশ্লেষণ করে রোগ নির্ণয় করা হয়।
৫. Fetal Stethoscope: গর্ভাবস্থায় ভ্রুনের হৃদস্পন্দন শুনতে এ ধরনের স্টেথোস্কোপ ব্যবহার করা হয় ।
স্টেথোস্কোপের নানাবিধ ব্যবহার থাকলেও চিকিৎসকেরা মূলত: রোগ নির্ণয়ের কাজেই এটি ব্যবহার করেন। রোগীর Clinical Examination এর চারটি ধাপের মধ্যে একটি হচ্ছে Auscultation, যা স্টেথোস্কোপের সাহায্য ছাড়া প্রায় অসম্ভব। নিচে একটি স্টেথিয়োগের বিভিন্ন অংশ সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো:
১। ইয়ারপিস (enrpiece): এই অংশটি কানের মধ্যে প্রবেশ করানোর পর ডায়াফ্রাম চালু থাকলে শরীরের অভ্যন্তরীণ শব্দসমূহ শোনা যায়।
২। টিউবিং: এটি একটি নমনীয় রাবার টিউব যেট তায়াক্রাম দ্বারা গৃহীত শব্দ ইয়ারপিসের মাধ্যমে আমাদের শ্রবণযন্ত্রে পৌঁছে দেয়।
৩। বেগঃ বেল বা ঘণ্টা ডায়াফ্রামের উল্টো পাশে লাগানো থাকে এবং এটি মৃদু ও অমসৃন শব্দ শুনতে সাহায্য করে। এটিকে ঘুরিয়ে ডায়াফ্রানের মুখ খোলা বা বন্ধ করা যায়।
৪। ডায়াফ্রাম: ডায়ায়াম বা মধ্যচ্ছদা স্টেথোস্কোপের এমন একটি সমতল অংশ যেটি রোগীর শরীরের বিভিন্ন অংশে স্পর্শ করাতে হয়। এটিই মূলত শব্দ গ্রহণ করে টিউবের মাধ্যমে আমাদের কানে পৌঁছে দেয়।
রক্তচাপ মাপার পদ্ধতি
১। সঠিক নিয়মে হ্যান্ড ওয়াশ করে নিতে হবে।
২। স্টেথোস্কোপের এয়ার পিস ও ডায়াফ্রাম জীবানুমুক্ত করে নিতে হবে।
৩। ব্লাড প্রেসার মনিটর ঠিক আছে কিনা তা পরীক্ষা করে নিতে হবে।
৪। রোগীকে আরামদায়কভাবে বসিয়ে অথবা শুইয়ে নিতে হবে ।
৫। রক্তচাপ মাপার জন্য চাপবিহীন অবস্থায় বিপি কাফের নিচের প্রায় কনুইয়ের সামনের ভাঁজের ২.৫ সেঃ সি. উপরে ভালোভাবে আটকিয়ে নিতে হবে।
৬। কনুইয়ের সামনে হাত দিয়ে ব্রাকিয়াল ধমনীর অবস্থান স্থির করে তার উপর স্টেথো স্কোপের ডায়াফ্রাম ৰসিয়ে নিতে হবে।
৭। ডায়াফ্রামটি এমনভাবে আলতো করে চাপ দিতে হবে যেন ডায়াফ্রাম এবং ত্বকের মাঝখানে কোনো ফাকা না থাকে।
৮। চাপ মাপার সময় টেষোক্ষোপ কিংবা কাফের ওপরে হাত না রেখে কাজ করতে হবে।
৯। ব্যারোমিটারের ঘড়ি হৃদপিণ্ডের সাথে একই তলে অবস্থান করিয়ে নিতে হবে।
১০। এরপর রেডিয়াল ধমনী অনুভব করে ধীরে ধীরে ইনফ্লেশন বাল্বের সাহায্যে বিপি কাফটি ফুলিয়ে চাপ বাড়াতে হবে।
১১। রেডিয়াল পালস বদ্ধ হওয়ার পর ব্যারোমিটারে চাপ ৩০ মি. মি. উপরে নিতে হবে।
১২। তারপর আস্তে আস্তে চাপ কমাতে হবে। প্রতি বিটে সাধারণত ২ মি. মি. চাপ কমানো যেতে পারে।
১৩। এবার চাপ কমানোর সময় স্টেথোস্কোপ দিয়ে ব্রাকিয়াল ধমনীতে সৃষ্ট শব্দ মনোযোগের সঙ্গে শুনো। চাপ কমতে শুরু করলে রক্ত চলাচলের ফলে এক ধরনের শব্দ সৃষ্টি হয়। একে করটকফ শব্দ (Korotkoff sound) বলা হয়। করটকফ শব্দ ধাপে ধাপে পরিবর্তন হয়।
১৪। প্রথমে এক ধরনের যে তীক্ষ্ণ শব্দে পাওয়া যায় এটাকে সিস্টোলিক রক্তচাপ হিসেবে কাউন্ট করতে হবে।
১৫। করটকফ শব্দের তীক্ষ্ণতা ধীরে ধীরে কমে আসতে আসতে এক সময় প্রথম পর্যায়ের শব্দ থেমে যায়। এই শব্দ বন্ধ হওয়ার আগে যে শব্দ শোনা যায় সেটাকেই ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ হিসেবে কাউন্ট করতে হবে।
১৬। বিপি মেশিন খুলে ফেলে পরিমাপ করা ব্লাড প্রেসার রেকর্ড চার্চে লিপিবদ্ধ করতে হবে। কাজ শেষে বিপি ইন্সট্রুমেন্ট নির্ধারিত জায়গায় সংরক্ষণ করে রাখতে হবে এবং কোনো অসুবিধা থাকলে চিকিৎসক বা নার্সকে অবহিত করতে হবে।
সেবাগ্রহীতা ব্যক্তির উচ্চতা ও ওজন দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ফেগুলো অন্যান্য ভাইটাল সাইন বা অত্যাবশ্যকীয় লক্ষণগুলোর সাথে হাসপাতাল বা ক্লিনিকে যেকোনো কাজের শুরুতেই নেপে নিয়ে রেকর্ড করতে হয় । স্বাস্থ্যের ভালোমন্দের অনেকখানিই নির্ভর করে উচ্চতা ও ওজন অনুযায়ী শারীরিক ভারসাম্যের উপর। ওজন বেশি হলে শারীরিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। ফলে দেহে বাসা বাধে নানা রোগ। তাই উচ্চতার সাথে ভারসাম্য রেখে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত। এজন্য অসুস্থ রোগী ছাড়া সুস্থ ব্যক্তির জন্যেও নিয়মিত ওজন মাপা এবং উচ্চতা অনুযায়ী আদর্শ ওজন বজায় রাখা অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
উচ্চতা ও ওজন পরিমাপ করার উপায়: উচ্চতা ও ওজন পরিমাপ করে একজন মানুষের আস্থামান জানা যায়। তার বয়স অনুযায়ী উচ্চতা ও ওজনে কোনো তারতম্য আছে কিনা তা অবগত হওয়া যায়। বিশেষ করে নিউট্রিশনাল স্ট্যাটাস খুব সহজেই অনুমান করা যায়। উচ্চতা ও ওজন হলো স্বাস্থ্য ঝুঁকির একটি ফুল ইন্ডিকেটর। ওজনকে সাধারণত পাউন্ড অথবা কিলোগ্রাম হিসেবে দেখা হয় এবং উচ্চতাকে মিটার/সেন্টমিটার/ইঞ্চিতে দেখা হয়। ওজন পরিমাপের জন্য ওজন পরিমাপক যন্ত্র পাওয়া যায়। ওজন পরিমাপক যন্ত্র মূলত দু রকমের যথা: এনালগ ও ডিজিটাল। কিন্তু নিয়ম মেনে এই মেশিনের উপর সোজা হয়ে দাড়ালে মিটার বা ডিসপো দেখে সহজেই ওজন দেখা যায়। তবে বাসা কিংবা স্বাস্থসেবা কেন্দ্রে যেখানেই হউক না কেনো ওজন মাপার ক্ষেত্রে কিছু বিষয় নজর দেওয়া উচিৎ, যেমন:
যন্ত্রটি কার্পেট, ম্যাট বা মেঝেতে সমান জায়গায় রাখতে হবে। সেবাগ্রহীতাকে ভারী জামাকাপড় পরিহার করার জন্য অনুরোধ করতে হবে। মুঠোফোন, মানিব্যাগ, ভ্যানিটি ব্যাগ, ফাইল বা অন্য যেকোনো ব্যক্তিগত সরঞ্জাম বা সঠিক ওজনের তারতম্য সৃষ্টি করতে পারে সেগুলো অন্যত্র রেখে মেশিনের উপর দাড়ানোর জন্য নির্দেশনা দিতে হবে। জুতা না পরে ওজন মাপা শ্রেয়। পেট স্তরে খেয়েই বা অনেক পানি বা তরল পান করার পরপর ওজন মাপা উচিৎ নয়। ব্যায়ামের পরপরও ওজন মাপবেন না। নারীদের ক্ষেত্রে পিরিয়ড বা মাসিকের সময় বাদ দিয়ে ওজন মাপতে বলা উচিৎ। যাঁরা ওজন কমানোর চেষ্টা করছেন, তাঁরা ওজন নেপে একটা চার্ট তৈরি কর ।
অনেক যন্ত্র পাউন্ডে ওজন দেখায়। পাউন্ডকে কিলোগ্রামে রূপান্তর করতে প্রাপ্ত ওজনকে ০.৪৫ দিয়ে গুণ করতে হবে। ওজন পরিমাপের পর তার চার্টে লিপিবদ্ধ করতে হবে। আবার উচ্চতা মাপার জন্য দরকার হয় একটি উচ্চতা পরিমাপক ফিতা বা উল্লম্ব স্ট্যান্ডের যেখানে মিটার বা সেন্টিমটার বা উভয় ক্ষেলে দাগ কাটা থাকে। উচ্চতা মাপার জন্য সোজা হয়ে স্বাভাবিকভাবে দাঁড়াতে হয়। ফুট এবং ইঞ্চিতেও উচ্চতা মাপা হয়ে থাকে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে মিটার ফেলে উচ্চতার মান আমাদের জানতে হয়। যেমন শরীরের বিএমজাই মাপার ক্ষেত্রে। তবে বর্তমানে উন্নত প্রযুক্তির সেন্সর সম্বলিত মেশিন পাওয়া যায় যেগুলো নিমিশেই শরীরের ওজন, উচ্চতা, বিএমআই প্রভৃতি পরিমাপ করতে পারে সঠিকভাবে।
মানবশিশু জন্মানোর পর থেকেই দৈহিক বৃদ্ধি ঘটতে থাকে যা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত হয়ে থাকে। একজন ব্যক্তির ২০-২৪ বছরের পর সাধারণত দৈহিক উচ্চতার তেমন একটা বৃদ্ধি বা পরিবর্তন হয় না। তখন খাদ্যের কাজ হয় শুধুমাত্র দেহের ক্ষয়পূরণ এবং দেহকে সুস্থ, সবল ও রোগমুক্ত রাখা। প্রাপ্তবয়সে সুস্বাস্থের জন্য দেহের উচ্চতার সাথে দেহের ওজনের একটি সামঞ্জস্য প্রয়োজন হয়। দেহের উচ্চতার সাথে ওজনের সামঞ্জস্য রক্ষা করার সূচককেই বিএমআই বা ৰডি ম্যাস ইনডেক্স বা সূচি বলা হয়। উচ্চতার সাথে দেহের ওজনের সামঞ্জস্য থাকলে একজন ব্যক্তিকে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী বলা যায়। আবার যদি শরীরের ওজন ভরসূচি অনুযায়ী নির্দেশিত বা প্রাপ্ত ওজনের চেয়ে খুব বেশি কমবেশি হয়ে পড়ে তখন নানাবিধ সমস্যা দেখা দিতে পারে।
বিএমআই মাপার সুত্র হচ্ছে: দেহের ওজন (কেজি)/ {দেহের উচ্চতা (মিটার)}২
অর্থাৎ কিলোগ্রাম এককে কোনো ব্যক্তির দেহের ওজন পরিমাপ করে সেটিকে মিটার এককে পরিষিত উচ্চতার বর্গ দিয়ে ভাগ করলে সেই ব্যক্তির বিএমআই বা ভরসূচি পাওয়া যায়। উদাহরণ: ধরা যাক একজন ব্যক্তির দেহের ওজন ৭২ কেজি এবং উচ্চতা ১.৭৮ মিটার। তাহলে তার বিএমআই= ৮০/ (১.৭৮*১.৭৮)= ২৫.২৫ (প্রায়)। যেকোনো বয়সের নারী বা পুরুষ নির্বিশেষে বিএমআই এর স্বাভাবিক পাল্লা বা রেঞ্জ হচ্ছে ১৮.৫ থেকে ২৪.৯। বিএমআই মান যদি ১৮.৫০ এর চেয়ে কম হয় তাহলে বলা যার ব্যক্তিটি ওজনস্বল্পতার ভুগছে। আবার যদি বিএমআই এর মান ২৫ থেকে ২৯.৯ পর্যন্ত হয়, তাহলে ব্যক্তিটি ওজনাধিক্যে ভুগছে। বিএমআই এর মান ৩০ থেকে ৩৯.৯ হলে স্কুল এবং ৪০ এর অধিক হলে অতিরিক্ত স্থুল বলা হয়ে থাকে ।
কোনো ব্যক্তির এরকম স্বাভাবিকের চেয়ে কম বা বেশি বিএমআই পাওয়া গেলে তাকে জীবন যাত্রার ধরন যেমন: খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম ও বিশ্রাম ইত্যাদি পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যাতে করে শরীরের ওজন আদর্শ বিএমআই নির্দেশিত ওজনের চেয়ে কম বা বেশি না হয়ে যায়। নিয়ে নির্দিষ্ট উচ্চতা অনুযায়ী নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে আদর্শ ওজন কত হওয়া উচিৎ তার একটি চার্ট প্রদান করা হলো:
উচ্চতা | পুরুষ (কেজি) | নারী (কেজি) |
৪ ফুট ১০ ইঞ্চি | ৪৪-৫৪ | ৪১-৫২ |
৫ ফুট | ৪৭-৫৮ | ৪৩-৫৫ |
৫ ফুট ৪ ইঞ্চি | ৫৩-৬৬ | ৪৯-৬৩ |
৫ ফুট ৬ ইঞ্চি | ৫৬-৭০ | ৫৩-৬৭ |
৫ ফুট ৮ ইঞ্চি | ৬০-৭৪ | ৫৬-৭১ |
৫ ফুট ১০ ইঞ্চি | ৬৪-৭৯ | ৫৯-৭৫ |
৬ ফুট | ৬৭-৮৩ | ৬৩-৮০ |
টেবিল ৪.৫: উচ্চতা অনুযায়ী আদর্শ ওজন
পারদর্শিতার মানদন্ড
ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (PPE): প্রয়োজন অনুযায়ী।
প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি (টুল্স, ইকুইপমেন্ট ও মেশিন): স্টেথোস্কোপ, ব্লাড প্রেসার মেশিন (এ্যানালগ এবং ডিজিটাল), ক্লিনিক্যাল থার্মোমিটার (এ্যানালগ এবং ডিজিটাল), স্টপ ওয়াচ, ওজন পরিমাপক যন্ত্র, মেজারিং টেপ বা উচ্চতা মাপক যন্ত্র, ময়লা ফেলার বিন, জার উইথ স্যাভলন অথবা এ্যালকোহল, কিডনী ট্রে ইত্যাদি।
ধাপ-১। পরিমাপ করার আগে ওজন মেশিনটি কাজ করে কিনা বা ঠিক আছে কিনা তা পরীক্ষা করে নিতে হবে।
ধাপ-২। রোগী মেশিনে ওঠার আগে ওজন স্কেল জিরো বা নিউট্রাল করে নিতে হবে।
ধাপ-৩।পকেটে কোনো ভারী বস্তু যেমন চাবি, মোবাইল, ওয়ালেট থাকলে তা বের করে রাখুন।
ধাপ-৪। পায়ের জুতা, ভারী জ্যাকেট বা সোয়েটার থাকলে তা খুলে রাখুন।
ধাপ-৫। ওজন মাপার সময় রোগীকে শরীর সোজাসুজি রেখে সামনের দিকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলুন।
ধাপ-৬। মেজারিং স্কেল অথবা ডিজিটাল স্ক্রিন স্থির হলে ওজনটি দেখুন ও তা চার্টে রেকর্ড করা।
ধাপ-১। উচ্চতা মাপার আগে উচ্চতা মাপক স্কেল অথবা মেশিনটি ঠিক আছে কিনা তা চেক ও কেলিব্রেটেড করে নিন
ধাপ-২। তারপর রোগীকে তার জুতা খুলতে বলুন।
ধাপ-৩।রোগীকে পিছন দিকে ফিরিয়ে ওয়ালের সাথে তার পিঠ ঠেকিয়ে নিন।
ধাপ-৪। রোগীর সন্মুখভাগ সামনা সামনি বরারর রেখে সোজা হয়ে দাড়াতে বলুন।
ধাপ-৫। এবার ভালো করে খেয়াল করে দেখুন যেন তার পায়ের গোড়ালি, পিঠ, মাথার পিছন সাইট হাইট স্কেলের ওয়ালে লেগে থাকে।
ধাপ-৬। এবার আস্তে আস্তে উচ্চতা মেশিনের সাথে লাগানো মেজারিং ডিভাইসটি একদম মাথার উপরের অংশে এডজাষ্ট করে নিন এবং আপনার আই লেভেল সোজাসুজি রেখে উচ্চতা পরিমাপ করে রেকর্ড কর।
ধাপ-১। প্রথমেই সাবান ও পানি দিয়ে সঠিক নিয়মে হাত ধৌত কর।
ধাপ-২। গ্লাভস পরিধান কর।
ধাপ-৩। তাপমাত্রা পরিমাপের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি একটি ট্রেতে সাজাও।
ধাপ-৪। ডিজিটাল অথবা গ্লাস থার্মোমিটারটি জীবাণুনাশক দিয়ে ভালোভাবে মুছে নিতে হবে।
ধাপ-৫। রোগী যদি বসতে পারে তাহলে সোজা করে বসিয়ে নাও।
ধাপ-৬। রোগীকে তার মুখ খুলতে এবং জিহ্বা তুলতে বল।
ধাপ-৭। গ্লাস বা মারকারি থার্মোমিটারের ক্ষেত্রে সাবধানে ঝাঁকিয়ে ৩৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের নীচে নামিয়ে নিয়ে রোগীর জিহ্বার নীচে অর্থাৎ জিভের গোড়ায় ডান বা বাম দিকে আস্তে আস্তে রাখ।
ধাপ-৮। রোগীকে তার ঠোঁট বন্ধ করতে বল এবং খেয়াল রাখো যেন থার্মোমিটারটি দাঁত দিয়ে কামড়ে না দেয়। যদি ডিজিটাল থার্মোমিটার হয় তাহলে স্টার্ট বাটন পুশ কর।
ধাপ-৯। রিডিং কাউন্ট সম্পন্ন হলে ডিজিটাল থার্মোমিটারটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিপ দেওয়ার সাথে সাথে বের কর। তবে গ্লাস বা মারকারি থার্মোমিটারের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ২ থেকে ৩ মিনিট অপেক্ষা কর।
ধাপ-১০। তারপর থার্মোমিটারটি বের করে তাপমাত্রা দেখ।
ধাপ-১১।থার্মোমিটারটি হালকা গরম সাবান পানিতে ধৌত কর (কখনই অধিক গরম পানিতে নয়) জীবাণুনাশক দিয়ে মুছে শুকনো করে নির্দিষ্ট জায়গায় সংরক্ষণ কর।
ধাপ-১২। গ্লাভস খুলে ফেলে তা নির্ধারিতে বর্জ্য ধারকে রেখে হ্যান্ড ওয়াশ কর।
ধাপ-১৩। টেমপারেচার চার্টে তাপমাত্রা রেকর্ড কর।
ধাপ-১। প্রথমেই সাবান ও পানি দিয়ে সঠিক নিয়মে হাত ধৌত কর।
ধাপ-২। গ্লাভস পরিধান কর।
ধাপ-৩। তাপমাত্রা পরিমাপের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি একটি ট্রেতে সাজাও।
ধাপ-৪। ডিজিটাল অথবা গ্লাস থার্মোমিটারটি জীবাণুনাশক দিয়ে ভালোভাবে মুছে নিতে হবে।
ধাপ-৫। গ্লাস বা মারকারি থার্মোমিটারের ক্ষেত্রে সাবধানে ঝাঁকিয়ে ৩৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের নীচে নামিয়ে নিয়ে বগলের নীচে থার্মোমিটারটি স্থাপন করা।
ধাপ-৬। রোগীকে বুকের সাথে হাত শক্ত করে চেপে রাখতে বলে ডিজিটাল থার্মোমিটারটি বিপ দেওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এবং গ্লাস অথবা মারকারি থার্মোমিটারের ক্ষেত্রে তিন থেকে চার মিনিট রেখে দাও ।
ধাপ-৭। নির্ধারিত সময় অপেক্ষা করার পর থার্মোমিটারটি বের কর এবং সঠিক তাপমাত্রাটি দেখে নাও।
ধাপ-৮। থার্মোমিটারটি হালকা গরম সাবান পানিতে ধুয়ে (কখনই অধিক গরম পানিতে নাও)। জীবাণুনাশক দিয়ে মুছে শুকনো করে নির্দিষ্ট জায়গায় সংরক্ষণ করা।
ধাপ-৯। গ্লাভস খুলে ফেলে তা নির্ধারিত বর্জ্য ধারকে রেখে হ্যান্ড ওয়াশ কর।
ধাপ-১০। টেমপারেচার চার্টে তাপমাত্রা রেকর্ড কর।
ধাপ-১। প্রথমেই হ্যান্ড ওয়াশিং কর।
ধাপ-২। গ্লাভস পড়ার প্রয়োজন হলে তা পড়ে নাও।
ধাপ-৩। যে হাত দিয়ে হার্ট বিট ফিল করবে তার অন্য হাতে হাতঘড়ি পরে নিতে হবে।
ধাপ-৪। রোগীর পজিশনিং করে নাও। রোগীর হাতটি একটি টেবিলের উপরে রেষ্টিং অবস্থায় রাখ।
ধাপ-৫। ইন্ডেক্স ফিঙ্গার বা মাঝখানের তিন আংগুলের মাঝের আংগুলোটি ব্যবহার কর ও রোগীর কব্জিতে বুড়ো আংগুলের ২ ইঞ্চি নীচে নাড়ি অনুভব না করা অবধি মাঝারি চাপ প্রয়োগ কর।
ধাপ-৬। পুরো এক মিনিট ধরে পালস কাউন্ট কর অথবা ৩০ সেকেন্ড কাউন্ট করে ২ দিয়ে গুণ করা।
ধাপ-৭। পালস রেট রেকর্ড কর।
ধাপ-১। হ্যান্ড ওয়াশ কর।
ধাপ-২। স্টেথোস্কোপের এয়ার পিচ ও ডায়াফ্রাম জীবানুমুক্ত করে নাও।
ধাপ-৩। ব্লাড প্রেসার মনিটর ঠিক আছে কিনা তা পরীক্ষা কর।
ধাপ-৪। রোগীকে বসিয়ে অথবা শুইয়ে নাও।
ধাপ-৫। রক্তচাপ মাপার জন্য চাপবিহীন অবস্থায় রক্তচাপ মাপার যন্ত্রের কাফ-এর নিচের প্রান্ত কনুইয়ের সামনের ভাঁজের ২.৫ সে. মি. উপরে ভালোভাবে আটকাও।
ধাপ-৬। কনুইয়ের সামনে হাত দিয়ে ব্রাকিয়াল ধমনীর অবস্থান স্থির করে তার উপর স্টেথোস্কোপের ডায়াফ্রাম বসিয়ে নাও।
ধাপ -৭। ডায়াফ্রাম এমনভাবে চাপ দাও যেন ডায়াফ্রাম এবং ত্বকের মাঝখানে কোনো ফাঁক না থাকে ।
ধাপ-৮। চাপ মাপার সময় স্টেথোস্কোপের কাপড় কিংবা কাফের ওপরে হাত না রেখে পরবর্তী কাজ কর।
ধাপ-৯। রক্ত চাপমান যন্ত্রের ঘড়ি হৃদপিণ্ডের একই তলে অবস্থান করে নাও।
ধাপ-১০। এরপর রেডিয়াল ধমনী অনুভব করে ধীরে ধীরে চাপমান যন্ত্রের চাপ বাড়াতে হবে।
ধাপ-১১। রেডিয়াল পালস বন্ধ হওয়ার পর চাপ ৩০ মি. মি. উপরে নাও ।
ধাপ-১২। তারপর আস্তে আস্তে চাপ কমাও। প্রতি বিটে সাধারণত ২ মি. মি. চাপ কমানো যেতে পারে।
ধাপ-১৩। এবার চাপ কমানোর সময় স্টেথোস্কোপ দিয়ে ব্রাকিয়াল ধমনীতে সৃষ্ট শব্দ মনোযোগের সঙ্গে শুনো। জেনে রাখ, চাপ কমতে শুরু করলে রক্ত চলাচলের ফলে এক ধরনের শব্দ সৃষ্টি হয়। একে করটকফ শব্দ (Korotkoff sound) বলা হয়। করটকফ শব্দ ধাপে ধাপে পরিবর্তিত হয়।
ধাপ-১৪। প্রথমে এক ধরনের যে তীক্ষ্ণ শব্দ পাওয়া যায় এটাকে সিস্টোলিক রক্তচাপ হিসেবে কাউন্ট কর।
ধাপ-১৫। করটকফ শব্দের তীক্ষ্ণতা ধীরে ধীরে কমে আসতে আসতে এক পর্যায়ে প্রথম পর্যায়ে করটকফ শব্দ থেমে যায়। এই শব্দ বন্ধ হওয়ার আগে যে শব্দ শোনা যায় সেটাকেই ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ হিসেবে কাউন্ট কর।
ধাপ-১৬। বিপি মেশিন খুলে ফেলে পরিমাপ করা ব্লাড প্রেসার রেকর্ড চার্টে লিপিবদ্ধ কর।
ধাপ-১৭। কাজ শেষে বিপি ইন্সট্রুমেন্ট নির্ধারিত জায়গায় সংরক্ষণ করে রাখ।
আরও দেখুন...