জনাব রতন একজন ধর্মী কৃষক। গত কয়েক বছর ধরে তাঁর জমিতে আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি অনুসরণ করার অধিক ফসল উৎপাদিত হয়। পারিবারিক ব্যয় বহন করার পর উদ্বৃত্ত অতিরিক্ত অর্থ জনাব রতন সংসার করেন। গত বছর তিনি একটি ছোট তৈরি পোশাক কারখানা স্থাপন করেন, যা তাঁর স্ত্রী জয়ন্তী পরিচালনা করেন। সেখানে তাঁর গ্রামের নারী শ্রমিকেরা কাজ করে। তাঁরা তাদের একমাত্র ছেলে রুনীকে একটি ভালো স্কুলে ভর্তি করেন। রনী অসুস্থ হলে তাকে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তারের পরামর্শমতো চিকিৎসা দেওয়া হয়।
উপরিউক্ত আলোচনায় বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের একটি চিত্র পাওয়া যাচ্ছে, যেমন : কৃষি, শিল্প এবং সেবা।
হাসান সাহেব পোশাক কারখানার মালিক। তার পোশাক কারখানাটি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে অবস্থিত। এ অঞ্চল দেশি বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করে দেশে শিল্প খাত বিকাশে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করে আসছে।
জহির একজন ব্যবসায়ী। তার ব্যবসায়িক পণ্যগুলো হলো চামড়া জাত দ্রব্য, তৈরী পোশাক, প্লাস্টিক প্রভৃতি। এ ব্যবসা পরিচালনার মাধ্যমে জহির তার পরিবারের সকল চাহিদা মেটায়।
আকবর আলী একজন কৃষক। তিনি গ্রামে চাষাবাদ করেন। পূর্বে তিনি পণ্যের ন্যয্যমূল্য পেতেন না। কিন্তু বর্তমানে তার উৎপন্ন দ্রব্য অন্যক্ষেত্রে কাজে লাগিয়ে দ্রব্যের প্রকৃত মূল্য আদায়ে সমর্থ হন।
প্রায় ২০০ বছরের ইংরেজ শোষণ ও ২৪ বছরের পাকিস্তানি শাসনের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়ে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়নি। উপরন্তু ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাসের স্বাধীনতাযুদ্ধে অর্থনৈতিক অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। স্বাধীনতা লাভের পর চার দশক ধরে উন্নয়নের ফলে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। বাংলাদেশ এখন একটি নিম্নমধ্যম আয়ের উন্নয়নশীল দেশ।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নিম্নলিখিত প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য সহজেই লক্ষ করা যায় :
১. কৃষি কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ খাত। কিন্তু অনুন্নত চাষ পদ্ধতি, উন্নত বীজ, সার, সেচ এবং কৃষিঋণের অভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে উন্নত দেশের তুলনায় আমাদের কৃষি উৎপাদন অনেক কম। ক্রমান্বয়ে এ অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। উন্নত বীজ, সার, কীটনাশক, সেচসুবিধা বাড়ছে। একই সাথে উৎপাদনও বাড়ছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনে সার্বিক কৃষিখাতের (ফসল, প্রাণিসম্পদ ও বনজ সম্পদ) অবদান প্রায় ১৫.৩৫ শতাংশ হয়েছে। কিন্তু দেশের শ্রমশক্তির মোট ৪৫.১০ শতাংশ কৃষিখাতে নিরোজিত (এল. এফ. এস., ২০১৩ বিবিএস)।
২.
বাংলাদেশের শিল্প উন্নয়নের গতি ধীর। তাই দেশের শিল্পায়নের গতিকে বাড়াতে আধুमিক শিল্পনীতি ঘোষণা প্রয়োজন। এ পরিপ্রেক্ষিতে শিল্পনীতি ২০১০ ঘোষণা করা হয়েছে। এ নীতির দ্দশ্য হলো- কর্মসংস্থান বাড়ানো, শিল্পায়নে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য কমানো। এই লক্ষগুলো বাস্তবায়নের জন্য সরকারি কর্মসূচি হলো- বিনিয়োগে বাধা কমানো, কর মুক্ত করা, বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিত করা, মূলধনের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা, বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি, বিদেশে বাজার সৃষ্টি এবং শ্রমনির্ভর শিল্প স্থাপন। এসব কর্মসূচির সুফল এখন পাওয়া যাচ্ছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সার্বিক শিল্পখাতের অবদান প্রায় ৩১.৫৪ শতাংশ। কিন্তু মোট শ্রমশক্তির ২০.৭০ শতাংশ এ খাতে নিয়োজিত। (এল. এফ. এস., ২০১৩, বি.বি.এস) ৩. মাথাপিছু আয়ের ক্রমবৃদ্ধি
এ দেশে কৃষি ও শিল্পের স্বল্প উৎপাদন, অধিক জনসংখ্যা এবং কাজের সুযোগ কম থাকায় মাথাপিছু আয় উন্নত দেশের তুলনায় কম। ২০১৭ সালে চলতি মূল্যে মাথাপিছু জাতীয় আয় ১৬০২ মার্কিন ডলার এবং মাথাপিছু জিডিপি ১৫৩৮ মার্কিন ডলার । আমাদের মাথাপিছু আয় ধীরগতিতে হলেও বাড়ছে । ৪. জীবনযাত্রার ক্রমোন্নতি
স্বল্প আয়ের জন্য ২০১০ সালে আমাদের দেশের প্রায় ৩১.৫০ ভাগ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে জীবনযাপন করছিলেন। প্রতিবছর ১ শতাংশ হারে কমে তা বর্তমানে ২০১৬ সালে ২৩.৫ শতাংশে নেমে এসেছে বলে ধরা হয়। ধীরগতিতে হলেও জীবনযাত্রার মান পূর্বাপেক্ষা উন্নত হওয়ায় মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ুষ্কাল ২০১৬ সালে ৭০.৯বছরে উপনীত হয়েছে। সুপেয় পানি গ্রহণকারী ৯৭.৯০ শতাংশ এবং সাক্ষরতার হার (৭ বছর+) ৬৩.৬ শতাংশ।
৫. বিনিয়োগযোগ্য পুঁজির প্রবাহ বৃদ্ধি আমাদের মাথাপিছু আয় কম বলে সঞ্চয় ক্ষমতা কম । তাই বিনিয়োগ বা পুঁজি গঠনের হারও কম । বর্তমানে দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার অনেক উদ্দীপনামূলক ও সহযোগিতামূলক নীতি ঘোষণা করেছে । এর ফলে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ ধীরগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মোট বিনিয়োগ ছিল জিডিপির ৩০.২৭ শতাংশ । বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে আমাদের কৃষি ও শিল্পের উৎপাদন বৃদ্ধি পায় । যা
আমাদের দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়ক ।
৬. খাদ্যঘাটতি ও পুষ্টিহীনতা
কৃষিপ্রধান দেশ হলেও অধিক জনসংখ্যার কারণে এদেশে বহুদিন ধরে খাদ্যঘাটতি ও পুষ্টিহীনতা লক্ষ করা যায় । তাই সরকার বাংলাদেশকে বিভিন্ন প্রকার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে সার্বিক কৃষি খাতকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছে । এর ফলে বিগত কয়েক বছর ধরে খাদ্যশস্য উৎপাদন-ব্যবস্থায় উন্নত বীজ, সার এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে অধিক ফসল উৎপাদন সম্ভব হয়েছে । ২০১৫-১৬ অর্থবছরে খাদ্যশস্যের উৎপাদন হয়েছিল ৩৮৮.১৭ লাখ মেট্রিক টন ।
৭. জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস
বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। সর্বশেষ আদমশুমারী অনুযায়ী এ দেশে মোট জনসংখ্যা ১৪ কোটি ৯৭ লাখ ৭২ হাজার ৩৬৪ (২০১১ সালের হিসাব অনুযায়ী)। জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১০১৫ জন এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩৭%, যা ২০০১ সালে ছিল ১.৪৮%। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ক্রমশ হ্রাস পেলেও আয়তনের দিক দিয়ে অনেক ছোট এই দেশটি জনসংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বে নবম বৃহত্তম দেশ । ২০১৭ সালের বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী আমাদের জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি এবং মোট আয়তন প্রায় ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিলোমিটার। সেই অনুযায়ী বর্তমান জনসংখ্যার ঘনত্ব হচ্ছে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ১০৭৭ জন।
৮. বেকারত্ব
আমাদের দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় সঞ্চয় কম বলে বিনিয়োগ কম হয় । ফলে মূলধন গঠনের হার কম। প্রয়োজনীয় মূলধনের অভাবে কৃষি ও শিল্প খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত। ফলে এ দেশে বেকারত্ব দেখা যায় ।
তবে রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলে (EPZ: Export Processing Zone) বেসরকারি ও সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৈদেশিক বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করার জন্য বিভিন্ন উদ্দীপনামূলক ও সহযোগিতামূলক নীতি ঘোষণা করায় বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ছে এবং অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু হচ্ছে। যার ফলে বেকার সমস্যা অদূর ভবিষ্যতে আরো কমে যাবে বলে আশা করা যায় । (২০১৪-১৫ সালে শ্রমশক্তির প্রায় ২৫ লাখ লোক বেকার ছিল)।
৯. প্রাকৃতিক ও মানবসম্পদের ব্যবহার বৃদ্ধি দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে প্রাকৃতিক সম্পদ গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অবকাঠামোগত উপাদান। বর্তমানে এসব সম্পদের আবিষ্কার ও ব্যবহার পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে । জিডিপিতে প্রাকৃতিক গ্যাস ও অপরিশোধিত পেট্রোলিয়াম এবং কয়লা ও অন্যান্য খনিজ সম্পদ খাতের সমন্বিত অবদান স্থির মূল্যে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১.৭৭ শতাংশ হয়েছে। প্রাকৃতিক গ্যাস দেশের মোট বাণিজ্যিক জ্বালানি ব্যবহারের শতকরা প্রায় ৭৫ ভাগ পূরণ করে। আমাদের দেশে এযাবৎ আবিষ্কৃত ২৬টি গ্যাসক্ষেত্রের মধ্যে বর্তমানে ২০টি গ্যাসক্ষেত্রের ১০১টি কুপ হতে গ্যাস উত্তোলিত হচ্ছে। উৎপাদিত গ্যাস বিদ্যুৎ উৎপাদনে সর্বাধিক ব্যবহৃত হয় । দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণকল্পে ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং গভীর সমুদ্রে শোধিত ও অপরিশোধিত জ্বালানি তেল খালাসের জন্য এসপিএম (Single Point Mooring) কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। দেশের মোট ৫টি কয়লাক্ষেত্রের (রংপুরের খালাশপীর, দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া, ফুলবাড়ি ও দীঘিপাড়া এবং বগুড়ার জামালগঞ্জ) মোট মজুদ প্রায় ২৭০० মিলিয়ন টন। উত্তোলিত কয়লার ৬৫ ভাগ বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় ।
মানবসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে । এদের মধ্যে পরিবার পরিকল্পনা, নারী ও শিশু, সমাজকল্যাণ, যুব ও ক্রীড়া উন্নয়ন, সংস্কৃতি, শ্রম ও কর্মসংস্থানক্ষেত্রে উন্নয়ন উল্লেখযোগ্য ।
১০. বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতি
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বহুমুখী চাহিদা পূরণ এবং উন্নয়নের জন্য আমাদের ভোগ্যপণ্য ও মূলধনী দ্রব্য আমদানি বাবদ প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়, যা আমাদের রপ্তানি আয়ের তুলনায় অনেক বেশি। এ জন্য বাণিজ্যের ভারসাম্যে অব্যাহত ঘাটতি দেখা যায় । বর্তমানে বিভিন্ন দেশে আমাদের দেশের পণ্যসামগ্রীর রপ্তানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বাণিজ্যিক ঘাটতির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে । এছাড়া প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থের (রেমিটেন্স) কারণে আমাদের চলতি হিসাব খাতে ঘাটতি দূর হয়ে উদ্বৃত্ত সৃষ্টি হয়েছে।
১১. বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস
অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য আমাদের যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন, তা দেশের অভ্যন্তর থেকে সংগ্রহ করা যায় না । তাই বিদেশি সাহায্যের উপর নির্ভর করতে হয় । তবে আশার কথা হলো বর্তমানে বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতার হার হ্রাস পাচ্ছে । কেননা এসব সাহায্যের অপর্যাপ্ততা, অনিশ্চয়তা, প্রতিকূল শর্তসমূহ ও সময়ক্ষেপণের দরুণ আমাদের উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত হয়। তাই অভ্যন্তরীণ উৎসের উপর নির্ভরতা বাড়ছে,যা ইতিবাচক অগ্রগতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয় ।
১২. অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামোর ক্রমোন্নতি
দেশের উৎপাদন বৃদ্ধি, উৎপাদনের উপকরণ ও উৎপাদিত পণ্যের সুষ্ঠু বাজারজাতকরণ এবং দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য অর্থনৈতিক অবকাঠামো যেমন সড়ক, রেল ও নৌপথ, বিদ্যুৎ ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । সরকার এসব অবকাঠামো উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সরকারের উল্লেখযোগ্য কর্মসূচির মধ্যে পদ্মা সেতু নির্মাণ কার্যক্রম, ঢাকা শহরে যানজট নিরসনে ২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ, নিরাপদ নৌযান চলাচল নিশ্চিতকরণ, বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার এবং দ্বিতীয় একটি সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে একটি আধুনিক টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক তৈরির জন্য কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে । আমাদের দেশের মানবসম্পদ উন্নয়নে সামাজিক অবকাঠামো যেমন শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, গবেষণা, জনস্বাস্থ্য, সাংস্কৃতিক চেতনা ও মূল্যবোধ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বর্তমান সরকার শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের লক্ষ্যে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন করেছে এবং জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০১১-২০১৬ মেয়াদে সমন্বিত স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি উন্নয়ন খাত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে ।
১৩. বেসরকারিকরণ কর্মসূচি
আমাদের দেশে মিশ্র অর্থনীতি চালু থাকলেও দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে বাজার অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার আওতায় বেসরকারি খাতের উন্নয়নের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এ উদ্দেশ্যে বিভিন্ন নীতি ও সংস্কার কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। ১৯৯৩ সালে বেসরকারীকরণ বোর্ড (বর্তমানে প্রাইভেটাইজেশন কমিশন) গঠনের পর থেকে জুন ২০১২ পর্যন্ত মোট ৭৭টি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বেসরকারীকরণ করা হয়েছে । তন্মধ্যে ৫৬টি প্রতিষ্ঠান সরাসরি বিক্রির মাধ্যমে এবং ২১টি প্রতিষ্ঠান/কোম্পানির শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে বেসরকারীকরণ করা হয়েছে । বিশেষজ্ঞদের মতে এর ফলাফল মিশ্র প্রকৃতির ।
১৪. পরিকল্পনা গ্রহণ
আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সরকারি ও বেসরকারি কর্মসূচির সমন্বয় সাধন এবং সম্পদের সুষম বণ্টন ও ব্যবহারের জন্য বাস্তবায়নযোগ্য উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন । এ লক্ষ্যে সরকার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী সামনে রেখে রূপকল্প ২০২১-এর আলোকে “বাংলাদেশ প্রেক্ষিত পরিকল্পনা রূপরেখা (২০১০-২০২১)” শীর্ষক পরিকল্পনা দলিল প্রণয়ন করেছে । এর মৌলিক উদ্দেশ্য হচ্ছে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জন, দারিদ্র্য বিমোচন, বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা এবং আঞ্চলিক বৈষম্যসহ সকল প্রকার বৈষম্য দূর করা
উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যের আলোকে বলা যায়, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা পূর্বের তুলনায় বেশ উন্নতি লাভ করেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন গতিশীল কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন হচ্ছে । শিক্ষা ও প্রযুক্তির প্রসারের মাধ্যমে কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন শ্রমিক ও উদ্যোক্তা শ্রেণি তৈরি হচ্ছে । যারা স্বকর্মসংস্থানের মাধ্যমে দেশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে এবং সামাজিক কুসংস্কার দূর করতে ভূমিকা পালন করছে, তবে সুশাসনের অভাব এবং ক্রমবর্ধমান আয় ও সম্পদ বৈষম্যের কারণে বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভাবনা কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
যেকোনো দেশের অর্থনীতিতে বিদ্যমান শাখা বা বিভাগসমূহ নিজ নিজ পরিমণ্ডলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পাদন করে থাকে এবং এদের সমষ্টিগত অবদানের দ্বারা দেশের অর্থনীতির ভিত্তি গড়ে ওঠে । অর্থনীতির অন্তর্ভুক্ত এসব শাখা বা বিভাগকে অর্থনৈতিক খাত বলে ।
কৃষি খাত (Agriculture Sector)
কৃষিকাজ হচ্ছে ভূমিকর্ষণ, বীজ বপন, লস্য- উদ্ভিদ পরিচর্যা, ফসল কর্তন ইত্যাদি থেকে শুরু করে উৎপাদিত পণ্য গুদামজাতকরণ, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ পর্যন্ত বিস্তৃত কার্যক্রম। ফসল উৎপাদন ছাড়াও মাছ ও মৌমাছি চাষ, পশুপালন ও বনায়ন কৃষি খাতের অন্তর্ভুক্ত।
নিম্নে কৃষি খাতের উপখাতসমূহের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া হলো;
ক) শস্য ও শাকসবজি
আমাদের দেশের কৃষকেরা শস্যের মধ্যে ধান, গম, পাট, ডাল, আৰু, তামাক, চা ও তৈলবীজ ইত্যাদি আর শাকসবজির মধ্যে আলু, শিম, লাউ, মটরশুঁটি, পটল, করলা ও বেগুন ইত্যাদি উৎপাদন করে ।
খ) প্রাণিসম্পদ
আমাদের দেশে পারিবারিকভাবে ও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল, ভেড়া, মহিষ, ঘোড়া, কবুতর ও অন্যান্য পাখি পালন করা হয়। এদের মাংস, ডিম, দুধ, পালক ও চামড়া ইত্যাদি এ খাতের অন্তর্ভুক্ত।
গ) বনজ সম্পদ
আমাদের দেশের মোট ভূখণ্ডের প্রায় শতকরা ১১.১ ভাগ জুড়ে রয়েছে বনাঞ্চল, যেখানে একটি দেশের থাকা উচিত মোট ভূখণ্ডের শতকরা ২৫ ভাগ। এসব বনাঞ্চলে রয়েছে বাঁশ, বেত, শাল, সেগুন, গর্জন, সুন্দরী, গরান, গেওয়া, পামারি, কড়াই, কুচি ও কেওড়া ইত্যাদি গাছ। এগুলো থেকে কাঠ, রাবার, গাম-তৈল, শপ, মোম ও মধু ইত্যাদি আমরা পেয়ে থাকি ।
ঘ) মৎস্য সম্পদ
এ দেশের নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর, হাওর ও সাগর থেকে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও মৎস্যজাত দ্রব্য পাওয়া যায় । এদেরকে আবার ২টি ভাগে বিভক্ত করা হয়। যেমন- মিঠা পানির মৎস্য এবং সামুদ্রিক মৎস্য। মিঠা পানির মৎস্য হলো রুই, চিতল, কই, শিং, মাগুর ইত্যাদি এবং সামুদ্রিক মৎস্য হলো, রূপচাঁদা, ভেটকি, লইট্যা ইত্যাদি । সম্প্ৰতি মৎস্য খাতে উৎপাদন প্রচুর বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকার মৎস্য খাতকে একটি পৃথক খাতের মর্যাদা প্রদান করেছেন।
কৃষি খাতের অবদান বা গুরুত্ব
কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কৃষি খাতের উন্নয়নের উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা তথা খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জন, দারিদ্র্য বিমোচন, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ইত্যাদি কৃষির অগ্রগতির সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত । ফলে কৃষি খাতের উন্নয়নে সরকার সব রকম চেষ্টা চালাচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে কৃষি প্রযুক্তির উদ্ভাবন, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ, দেশের সর্বত্র মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের দোরগোড়ায় কৃষি উপকরণ পৌঁছানো, সহজ পদ্ধতিতে কৃষিঋণ প্রদান, কৃষিবীমার প্রচলন ও কৃষি কার্যক্রমে ভর্তুকি প্রদান ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে । আমাদের দেশের শতকরা প্রায় ৭৫ ভাগ লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। এ দেশের জনগণের খাদ্যের যোগানদাতা হিসেবে কৃষি খাতে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মোট খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়েছিল ৩৮৮.১৭ লাখ মেট্রিক টন । দেশের শ্রমশক্তির মোট ৪৫.১ শতাংশ কৃষিখাতে নিয়োজিত । কৃষি থেকে প্রাপ্ত শণ, গোলপাতা, খড়, বাঁশ, বেত ও কাঠ ইত্যাদি এ দেশের জনগণ কর্মসংস্থান, আসবাবপত্র এবং জ্বালানির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করছে। এছাড়া জনগণের প্রাণিজ আমিষের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ, শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ এবং শিল্পজাত দ্রব্যাদির বাজার সৃষ্টি করে সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে কৃষি গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন করছে ।
অতএব, ২০১২-১৩ এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জিডিপিতে সার্বিক কৃষি (১+২) খাতের অবদান ছিল যথাক্রমে ১৬.৭৭ শতাংশ এবং ১৫.৩৫ শতাংশ। কৃষি খাতের প্রধান প্রধান রপ্তানি পণ্য যেমন : হিমায়িত খাদ্য, কাঁচা পাট, পাটজাত দ্রব্য ও চা। আমাদের মোট দেশজ উৎপাদনে সার্বিক কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধির হার নিচের তালিকায় উল্লেখ করা হলো :
শিল্প খাত (Industry Sector )
প্রকৃতি প্রদত্ত সম্পদ বা কাঁচামাল বা প্রাথমিক দ্রব্যকে কারখানাভিত্তিক প্রস্তুত প্রণালির মাধ্যমে মাধ্যমিক দ্রব্য বা চূড়ান্ত দ্রব্যে রূপান্তরিত করাকে শিল্প বলে । বাংলাদেশের জাতীয় আয় নির্ণয়ে ১৫টি খাতের মধ্যে খনিজ ও খনন; ম্যানুফ্যাকচারিং: বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি
সরবরাহ এবং নির্মাণ এ খাতগুলোর সমন্বয়ে সার্বিক শিল্প খাত গড়ে উঠেছে।
শিল্প খাতের সংক্ষিপ্ত পরিচয় নিম্নে দেওয়া হলো :
১. খনিজ ও খনন
এ খাতের প্রধান উপখাত হলো-
ক) প্রাকৃতিক গ্যাস ও অপরিশোধিত তেল
খ) অন্যান্য খনিজ সম্পদ ও খনন (কয়লা, চুনাপাথর, চীনামাটি, গন্ধক, কঠিন শিলা, সিলিকা বালু ও তামা ইত্যাদি)
২. ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প
ক) বৃহৎ ও মাঝারি শিল্প : নিম্নে আলাদাভাবে বৃহৎ ও মাঝারি শিল্প উল্লেখ করা হলো :
বস্ত্রশিল্প, চিনিশিল্প, সারশিল্প, সিমেন্টশিল্প, জাহাজ নির্মাণশিল্প, পাটশিল্প, কাগজশিল্প প্রভৃতি বৃহৎ শিল্পের অন্তর্ভুক্ত। দেশের উল্লেখযোগ্য মাঝারি শিল্প হলো, চামড়াশিল্প, তৈরি পোশাকশিল্প, সিগারেট শিল্প, প্লাস্টিক শিল্প, হোসিয়ারি শিল্প ইত্যাদি ।
খ) ক্ষুদ্রায়তন শিল্প : নিম্নে ক্ষুদ্রায়তন শিল্প দুই ভাগে উল্লেখ করা হলো :
ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ তৈরি শিল্প, দিয়াশলাই শিল্প, কাঠশিল্প, সাবানশিল্প, প্রসাধনীশিল্প এবং যানবাহন সার্ভিসিং ও মেরামতশিল্প ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ক্ষুদ্র শিল্প।
রেশমশিল্প, বাঁশ ও বেতশিল্প, পিতল ও কাঁসাশিল্প এবং তাঁতশিল্প ও মৃৎশিল্প উল্লেখযোগ্য কুটির শিল্প।
৩. বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি : এ খাতের উপখাত ৩টি হলো- ক. বিদ্যুৎ, খ. গ্যাস ও গ. পানি
৪. নির্মাণ শিল্প : এই খাতে অন্তর্ভুক্ত – সেতু নির্মাণ, নতুন রাস্তাঘাট নির্মাণ ও আবাসিক ও বাণিজ্যিক ঘর-বাড়ি
নির্মাণ ।
উপরিউক্ত চারটি খাতের সমন্বয়ে সার্বিক শিল্প খাত গঠিত ।
শিল্প খাতের অবদান বা গুরুত্ব
২০১২-১৩ অ ধ্বছরে দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) বৃহৎ খাতসমূহের মধ্যে সার্বিক শিল্প খাতের অবদান ছিল ২৯ শতাংশ । ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সার্বিক শিল্প খাতের অবদান ৩০.৪২ শতাংশ হয়েছে। যা ২০১৫-১৬ সালে ৩১.৫৪ শতাংশ।
দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, শিল্প খাতের দ্রুত বিকাশের জন্য বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ দেশে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (EPZ) স্থাপন করেছে। যা দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করে দেশে শিল্প খাত বিকাশে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করে আসছে।
ডিসেম্বর ২০১২ পর্যন্ত ৮টি EPZ [চট্টগ্রাম, ঢাকা, মংলা, কুমিল্লা, ঈশ্বরদী, উত্তরা (নীলফামারী), আদমজী ও কর্ণফুলী] এ ৪১২টি শিল্প প্রতিষ্ঠান উৎপাদনরত রয়েছে; ৩,৫০,২৬৩ জন বাংলাদেশি নাগরিক সেখানে কর্মরত এবং ৪,২১০.৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রপ্তানি করা হয়েছে ।দেশের শিল্পায়নের গতিকে বেগবান করতে সরকার শিল্পনীতি ২০১০ ঘোষণা করেছে । এ নীতির গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হচ্ছে উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নারীকে শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার মূল ধারায় নিয়ে আসা, দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রসার ঘটানো । উন্নয়ন রূপকল্প ২০২১ অনুযায়ী ২০২১ সালে একটি শক্তিশালী শিল্প খাত গড়ে উঠবে যেখানে জাতীয় আয়ে শিল্প খাতের অবদান হবে ৪০ শতাংশ এবং মোট কর্মসংস্থানে অবদান হবে ২৫ শতাংশ ।
কৃষি, শিল্প, পরিবহন ও যোগাযোগ, গৃহস্থালি, সেবা খাতসমূহ বিভিন্ন আয়বর্ধনকারী কর্মকাণ্ডে বিদ্যুৎ, গ্যাস, তেল ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদের চাহিদা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাই সরকার এ খাতে বিভিন্ন মেয়ানি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ২০২১ সালের মধ্যে দেশের সকল জনসাধারণকে বিদ্যুৎ-সুবিধার আওতায় আনার ব্যাপারে সরকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাই সরকার ২০২১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যে পরিকল্পনা করেছে। প্রাকৃতিক গ্যাস দেশের মোট বাণিজ্যিক জ্বালানি ব্যবহারের শতকরা প্রায় ৭১ ভাগ পুরণ করে। উৎপাদিত গ্যাসের সর্বাধিক ব্যবহার হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে। রাসায়নিক সার তৈরির কাঁচামাল রূপে, কলকারখানা, পরিবহন ও গৃহে গ্যাস জ্বালানি হিসেবে ।
সিমেন্ট, কাগজ, সাবান, ব্লিচিং পাউডার উৎপাদনে চুনাপাথর বাসনপত্র ও স্যানিটারি দ্রব্য তৈরিতে চীনামাটিঃ কাঁচ ও রাসায়নিক দ্রব্য তৈরিতে সিলিকা বালু; ৰাৱণ ও দিয়াশলাই কারখানার এবং তেল পরিশোধনে গন্ধক ব্যবহৃত হয়। অবকাঠামোগত খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাওয়ায় নির্মাণ খাতে প্রবৃদ্ধির হার বাড়ছে।
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যার, সার্বিক শিল্প খাতের দ্রুত বিকাশের মাধ্যমে জাতীর আর ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, বাণিজ্য ঘাটতি দূর করার পাশাপাশি পরনির্ভরশীলতা হ্রাস করা সম্ভব।
সেবা খাত (Service Sectur
অৰ্থনৈতিক যেসব কাজের মাধ্যমে অবস্থগত সেবাকর্ম উৎপাদিত হয় অর্থাৎ যা রূপান্তরিত কাঁচামাল হিসাবে দৃশ্যমান নয় কিন্তু মানুষের বিভিন্ন অভাব পূরণ করে এবং বার বিনিমর মূল্য রয়েছে, তাকে সেবা বলে ।
পরিবহনব্যবস্থা
বাংলাদেশে পাইকারি ও খুচরা বিপশন, হোটেল ও রেস্তোরাঁ, পরিবহন, সংরক্ষণ ও যোগাযোগ, ব্যাংক, বিনা ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান, গৃহায়ণ, লোকপ্রশাসন ও প্রতিরক্ষা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সেবা, কমিউনিটি, সামাজিক ও ব্যক্তিগত সেবা প্রভৃতি ক্ষেত্রে সেবাকর্ম উৎপন্ন হয়। এসব সেবা অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান ও জনগণের নিকট সরবরাহ করা হয় এবং জনগণ এসব সেবা ক্রয় করে তাদের অভাব পূরণ করে । পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও সেবা খাত হলো একক বৃহত্তম খাত । ২০১৪-১৫ অর্থবছরে জিডিপিতে সার্বিক সেবা খাতের অবদান দাঁড়িয়েছে ৫৩.৫৮ শতাংশ। ২০১৫-১৬ সালে ৫৩.১২ শতাংশ। সার্বিক সেবা খাতের অন্তর্ভুক্ত উপখাতসমূহের জিডিপিতে অবদানের হার নিচের তালিকায় দেখানো হলো :
উপরের তালিকা থেকে দেখা যায় যে পাইকারি ও খুচরা বাণিজ্য খাতে অবদান সর্বোচ্চ আর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খাত হলো পরিবহন, সংরক্ষণ ও যোগাযোগ খাত যার অধীনে রয়েছে-
ক) স্থলপথ পরিবহণ
যার আওতায় সড়কপথ ও রেলপথ রয়েছে। সড়কপথের মধ্যে ২০১৬ সাল অনুযায়ী জাতীয় মহাসড়ক ৩,৮১৩ কিলোমিটার, আঞ্চলিক সড়ক ৪, ২৪৭ কিলোমিটার এবং জেলা সড়ক ১৩,২৪২ কিলোমিটার । রেলপথের দৈর্ঘ্য ২,৮৭৭ কিলোমিটার (ব্রডগেজ ৬৫৯ কি.মি, ডুয়েল গেজ ৩৭৫ কি.মি এবং মিটার গেজ ১,৮৪৩ কি.মি.)।
খ) জলপথ পরিবহণ
আমাদের প্রধান সামুদ্রিক বন্দর চট্টগ্রাম। এর মাধ্যমে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের প্রায় ৯৭ শতাংশ পরিচালিত হয়ে থাকে এবং দ্বিতীয় সামুদ্রিক বন্দর মংলা। আর অভ্যন্তরীণনৌ পরিবহন কর্পোরেশনের ১৮৮টি জলযান দ্বারা ফেরি সার্ভিস, প্যাসেঞ্জার সার্ভিস, কার্গো সার্ভিস এবং শিপ রিপেয়ার সার্ভিস ইত্যাদির وا মাধ্যমে নাগরিক সেবা অব্যাহত রেখেছে।
গ) আকাশপথ পরিবহণ
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ বর্তমানে দেশে ৩টি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও ৭টি অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর পরিচালনা করছে। এ ছাড়া ২টি স্টল পোস্ট ব্যবহার উপযোগী রয়েছে (STOL - Short Take off and Landing) |
ঘ) ডাক ও তার যোগাযোগ
দেশের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং এর মান উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) বিভিন্ন কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। ২০০২ সালে সরকার বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বিটিআরসি) গঠনের পর গ্রাহকসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে । জানুয়ারী ২০১৭ এ গ্রাহকসংখ্যা ১২.৮ কোটি অতিক্রম করেছে । ডাক বিভাগ সারাদেশে ৯,৮৮৬টি ডাকঘরের মাধ্যমে ডাক সেবা প্রদান করে যাচ্ছে। এ উপখাতে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৬.৮১ শতাংশ ।
মোট দেশজ উৎপাদনে সার্বিক সেবা খাতের খাতওয়ারি প্রবৃদ্ধির হার নিচের তালিকায় দেওয়া হলো :
৯. কমিউনিটি, সামাজিক ও ব্যক্তিগত সেবা
এ খাতের উন্নয়নে সরকার বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছে । দেশের জনগণের জীবনমান উন্নয়ন, নিরাপত্তা বিধান, উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাতকরণ, উপকরণের গতিশীলতা আনয়নে, সর্বোপরি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী প্রশিক্ষিত ও শিক্ষিত মানবসম্পদ উন্নয়নে এবং আত্মকর্মসংস্থানে সার্বিক সেবা খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে ।
উৎপাদন ভিত্তিতে নিরূপিত আমাদের দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (GDP) ১৫টি খাত নিয়ে গঠিত । খাতসমূহ কৃষি, শিল্প ও সেবা-এ তিনটি বৃহৎ খাতে বিভক্ত । বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে কৃষি হলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তির একটি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাবিকাঠি, কেননা এ দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে উঠেছে কৃষি কার্যক্রমকে কেন্দ্র করে । বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, দারিদ্র্য বিমোচন, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ইত্যাদি কৃষির অগ্রগতির সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত । কিন্তু কৃষি প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল বলে তা স্থিতিশীল অর্থনীতি নির্দেশ করে না । কারণ এ দেশে প্রতিবছরই বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও খরা ইত্যাদি নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন অনিশ্চিত থাকে । তাই বর্তমান মুক্তবাজার অর্থনীতি এবং বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আমাদের দেশের সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে শিল্পায়িত অর্থনীতি গড়ে তোলা প্রয়োজন । কেননা শিল্পায়নের মাধ্যমে কৃষির আধুনিকীকরণ, প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার, বিদেশের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাসের পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং শক্তিশালী প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব । কৃষি ও শিল্প খাতের উন্নয়নের পাশাপাশি সার্বিক সেবা খাতের বিভিন্নমুখী কার্যক্রম, যেমন শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত মানবসম্পদ গড়ে তোলা, নারী ও শিশু উন্নয়ন, যুব উন্নয়ন, ক্রীড়া উন্নয়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন সাধন করে বর্তমান সরকারের রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নের মাধ্যমে একটি সমৃদ্ধিশালী সোনার বাংলা গড়ে তোলা সম্ভব । এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য কৃষি খাতে টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে ব্যাপক সরকারি সহায়তা যেমন পর্যাপ্ত ভর্তুকি প্রদান, সেচের জন্য নরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ, কৃষিঋণের প্রবাহ বৃদ্ধি, প্রতিকূল আবহাওয়া ও লবণাক্ততা সহিষ্ণু বীজ উদ্ভাবন এবং কৃষিভিত্তিক শিল্পের বিকাশে সহায়তা প্রদান প্রভৃতি কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি সন্তোষজনক পর্যায়ে রাখা সম্ভব হয়েছে । বিদ্যুৎসহ অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির ফলে শিল্প খাতে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে । সার্বিক সেবা খাতের অন্তর্ভুক্ত প্রায় সবগুলো খাতই মোটামুটি প্রবৃদ্ধি বজায় রাখায় এ খাতের প্রবৃদ্ধিও সন্তোষজনক পর্যায়ে রয়েছে ।
নিচের লেখচিত্রে বৃহৎ খাতভিত্তিক জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার উপস্থাপন করা হলো :
উপরোক্ত লেখচিত্রে ২০১৪-১৫, ২০১৫-১৬ এবং ২০১৬-১৭ -এই তিন বছরের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হারের কালানুক্রমিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। চিত্রে দেখানো হয়েছে যে ২০১৪-১৫ সালে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬.৫৫ শতাংশ। ২০১৫-১৬ সালে তা ছিল ৭.১১ শতাংশ। ২০১৬-১৭ সালে ছিল ৭.২৮ শতাংশ। অর্থাৎ খুব ধীরে হলেও আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বাড়ছে । জিডিপি প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রধান যে তিনটি খাত অবদান রেখেছে, তারা হচ্ছে:- কৃষি, শিল্প এবং সেবা খাত। উপরোক্ত চিত্রে স্তম্ভরেখার মাধ্যমে এই তিনটি খাতের প্রবৃদ্ধির হারের তথ্যও তুলে ধরা হয়েছে। চিত্রে দেখা যাচ্ছে। কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধির হার এই তিন বছর যথাক্রমে ছিল ৩.৩৩ শতাংশ, ২.৭৯ শতাংশ এবং ২.৯৭ শতাংশ । অনুরূপভাবে শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি হার ছিল যথাক্রমে ৯.৬৭ শতাংশ, ১১.০৯ শতাংশ এবং ১০.২২ শতাংশ। সেবা খাতের প্রবৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৫.৮০শতাংশ, ৬.২৫ শতাংশ এবং ৬.৬৯ শতাংশ। অতএব দেখা যাচ্ছে, আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে সম্প্রতি নেতৃত্ব দিচ্ছে উচ্চ প্রবৃদ্ধির হার সম্পন্ন সার্বিক শিল্প খ
সার্বিক খাতসুমুহ | ২০১৪-২০১৫ | ২০১৫-২০১৬ | ২০১৬-২০১৭ |
কৃষি | ১৬.০১ | ১৫.৩৫ | ১৪.৭৪ |
শিল্প | ৩০.৪২ | ৩১.৫৪ | ৩২.৪২ |
সেবা | ৫৩.৫৭ | ৫৩.১১ | ৫২.৮৪ |
সর্বমোট | ১০০ | ১০০ | ১০০ |
তালিকা থেকে বোঝা যায় যে ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে কি ধারণ ভাবে প্রধান অবদান রাখছে সেবা থাক প্রায় ৫ শতাংশ। তার পরেই করেছে শিল্প খাতের অবদান প্রায় ৩২ শতাংশ । সবচোর কম এবং সমান गদান রাখছে কৃষি শীত পার ১৫ শতাংশ ।
রমিজ একজন ধনি কৃষক। তিনি ফলনশীল ধান চাষ করেন, গভীর নলকূপের মাধ্যমে সেচের স্থান এবং ব্যবহার করে অধিক ধান উৎপাদন করেন। উৎপাদিত যান- পাটের আঁশ দিয়ে তৈরী করে বাজার থেকে খাদ্য ক্রয় করে তাদের খাদ্যর অভাব করেন।
উপরের অনুচ্ছেদ থেকে আমরা বলতে পারি, কৃষি খাতের উন্নতি ও মাধুনিক ও সাজের যোগান দেয় শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আসে কৃষি খাত থেকে।
বাংলাদেশে কৃষি ও শিল্প খাতের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা নিচে আলোচনা করা হলো;
আমাদের দেশের অধিকাংশ শির কৃষিভিত্তিক। এ দেশের উল্লেখযোগ্য শিল্প যেমন- পাট, চা, চামড়া, চিনি ও কাগজ প্রভৃতি শিল্প প্রধান কাঁচামালের জন্য কৃষির উপর নির্ভরশীল। তাই আমাদের দেশ কোনো কোনো আঞ্চলিক শিল্পায়ন ঘটে, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে পাট শিল্প , চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে ,উত্তরবঙ্গে চিনিশিল্প গড়ে উঠেছে। এ শিল্পের প্রসারে ফলে কাঁচামালের বর্ধিত চাহিদার কারণে কৃষি উৎপাদন বাড়বে, কৃষক উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম পাবে। ফলে কৃষকদের আয় বাড়বে এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে । জনগণের আয় বৃদ্ধির ফলে সঞ্চয় ও মূলধন গঠন বৃদ্ধি পাবে এবং শিল্পক্ষেত্রে বেশি করে বিনিয়োগ করা সম্ভব হবে ।
আমাদের ক্ষুদ্র শিল্পের ভিত্তি হলো কৃষি। কৃষিতে উৎপাদিত বাঁশ-বেত ক্ষুদ্র শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অন্যদিকে শিল্পে উৎপাদিত চাষাবাদের যন্ত্রপাতি, সার, কীটনাশক, ওষুধ ইত্যাদি কৃষিকাজে ব্যবহার করা হয় । তাই শিল্পজাত দ্রব্যের বাজার সৃষ্টিতে কৃষি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । কৃষকদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে শিল্পজাত অন্যান্য দ্রব্যের চাহিদাও বৃদ্ধি পায়, যা শিল্পের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
কৃষির আধুনিকায়নের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারলে আমদানি ব্যয় বাঁচবে, যা শিল্পোন্নয়নে ব্যয় করা যাবে ।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বলা যায়, আমাদের কৃষি ও শিল্পের উন্নয়ন পরস্পর নির্ভরশীল এবং একে অপরের পরিপূরক । তাই আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এবং আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনের জন্য দুটি খাতের একই সঙ্গে উন্নতি একান্তভাবে কাম্য ।
Read more