বর্তমান জগতে মানুষের জীবন বড় জটিল ও অস্বস্তিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। কি তার জন্য কাম্য, কি নয়, এই নিয়ে পণ্ডিতে পণ্ডিতে মতভেদের আর অন্ত নেই। ধ্রুব বলে' কোথাও কিছু আছে কি না এই সংশয় জনসাধারণে পর্যন্ত সংক্রমিত হচ্ছে।
তবু যে-সব দেশ ভাগ্যবান সে-সব দেশে এই বিপদ কাটিয়ে উঠবার চেষ্টাও কম হচ্ছে না। মানুষের এতদিনের জ্ঞান ও বিশ্বাসের সবকিছুই যদি ঝালিয়ে নিতে হয় তবে তা নিতে হবে এ সঙ্কল্প যাঁদের অন্তরে প্রবল তাঁদের জন্য বেশীর ভাগ বিপদ কেটে গেছে বলা যেতে পারে।
কেউ কেউ বলতে পারেন, নানা-অভাবে-জর্জরিত আমাদের এ দেশেও এই ধরণের এক ভাগ্যবন্ত দেশ। তাঁদের মতে, ভারতবাসী আজ নিষ্ক্রিয় নয়, তাদের সামনে সকল লক্ষ্যের বড় লক্ষ্য রাষ্ট্রনৈতিক লক্ষ্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এসব কথার বিরুদ্ধে কিছু বলতে যাওয়া হয়ত অশোভন। কিন্তু সন্দেহ কীট যাদের অন্তরে প্রবেশ করেছে তাদের পক্ষে মৌনের মাধুর্য উপভোগ করাও সম্ভবপর নয়। আমাদের দেশের আধুনিক চিত্ত যে কত বিশৃঙ্খলাপূর্ণ তার কিছু পরিচয় পাওয়া যাবে দেশের শিক্ষার অবস্থা একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলে।
যে ভাষা আমাদের মাতৃভাষা নয় তার সাহায্যে শিক্ষালাভ করলে তাতে অনেক ত্রুটি যে অনিবার্য হয়ে পড়ে এ-বিষয়ে আমাদের দেশের চিন্তাশীলেরা বোধ হয় একমত। এই সমস্যার মীমাংসার চেষ্টাও এতদিনে হয়ত আরম্ভ হতো যদি নানা অনিবার্য রাজনৈতিক কারণে শিক্ষা-সমস্যা আমাদের দেশের লোকদের চোখে নগণ্য হয়ে না পড়ত । কিন্তু শিক্ষার বাহনের সুমীমাংসা হলেও শিক্ষার অবস্থা যে আশানুরূপ সুন্দর হবার পথে দাঁড়াবে সে আশায় আশান্বিত হওয়া শক্ত এই একটি কারণে যে, শিক্ষাদান গ্রহণ করবে যে-মন তার অবস্থায় যদি কিছু স্বাভাবিক থাকে তবে শুধু শিক্ষাদানের ভাষার পরিবর্তনে বাঞ্ছিত ফলাফল লাভ হওয়া সম্ভবপর । এই সুব্যবস্থিত মনের অভাব নানা কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সুপ্রকট হয়ে উঠেছে এই অভিযোগ আজকাল শিক্ষার্থীদের গুরুজনের অনেকেরই মুখে শোনা যায়। কিন্তু সমস্যা যদি এই হতো তবে ব্যাপার মোটেই কঠিন হতো না, কেননা জ্ঞানের ক্ষেত্রে যারা প্রবেশার্থী তাদের ত্রুটি নগণ্য। এই মনের গন্ডগোল আমাদের দেশে এর চাইতেও জটিল— এ ব্যাধিতে হয়ত বেশী করে ভুগছেন শিক্ষার্থীদের গুরুস্থানীয়েরাই।
এই ব্যাধি দেশের গুরুস্থানীয়দের আক্রমণ করেছে এই সব দিক থেকে: প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য জীবনযাপন প্রণালীর সংঘর্ষ; একালের প্রাচ্য জীবনে যে-সব চিন্তাধারা ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করছে দেশের বৃহত্তর জীবনের সঙ্গে সে-সবের কি যোগ সে-সব অনুধাবনে অনিচ্ছা; দারিদ্র্য।
অনেক শিক্ষিত ব্যক্তিকে বলতে শুনেছি, পাশ্চাত্য প্রভাবে আমরা জীবনে আদর্শহীন হয়ে পড়েছি বেশী। কিন্তু পাশ্চাত্য লোকেরা বাস্তবিকই তো আদর্শহীন নন, আর পাশ্চাত্য আদর্শের পরিবর্তে অন্য আদর্শ (তা হোকনা দেশের প্রাচীন আদর্শ) তারা সর্বান্তঃকরণে গ্রহণ করেন কেন, এ সম্পর্কে কোনো সন্তোষজনক উত্তর তাদের মুখে শুনি নি । দারিদ্র্য তাঁদের এ অবনতির কারণ বলা চলে না, কেননা, যে-সব শিক্ষক দরিদ্র নন আদর্শ নিষ্ঠার অভাব তাঁদের ভিতরেও কম লক্ষযোগ্য নয় ।
কিন্তু পাশ্চাত্য প্রভাব ও দারিদ্র্য আমাদের জীবনে যে বিশৃঙ্খলা এনে দিয়েছে তার চাইতে অনেক বেশী বিশৃঙ্খলা এনে দিয়েছে একালে আমাদের দেশে যে সব চিন্তাশীলের জন্ম হয়েছে তাদের প্রভাব। প্রতিভাবান শক্তিমান নিশ্চয়ই কিন্তু তাঁর সাহচর্য বা অনুবর্তিতা করতে হয় সজাগভাবে, কেননা, শক্তিমান বলেই ব্যক্তিত্বেও বিশেষত্ব-বর্জিত তিনি নন, আর সে-বিশেষত্ব যুগ-ধর্মের প্রভাবে গঠিত; তাই এক যুগের মহাপুরুষের অনুবর্তিতা অন্য যুগের লোকদের করতে হয় যথেষ্ট সচেতন হয়ে, নইলে; তাঁদের জন্য যেটি সব চাইতে বাঞ্ছিত— তাদের যুগে সমসাময়িক জগতে তাঁদের জীবনকে সার্থক করা— তা থেকেই তাঁরা বঞ্চিত হন।
সার্থক জীবন-যাত্রার জন্য বিচারপরায়ণতা আমাদের চাই-ই, তা যত ভুলত্রুটির ভিতর দিয়েই সে বিচার চলুক— সেই বড় প্রয়োজন শিক্ষকরা এমনি গন্ডগোল সমাধান করতে পারছেন না, বা করছেন না ।
শিক্ষকরা এই মানসিক বিশৃঙ্খলার জন্য যথেষ্ট অস্বস্তি অনুভব করছেন না কেন তার দুটি কারণ নির্দেশ করা যেতে পারে— একটি, দেশের রাজনৈতিক গন্ডগোল, সেই গন্ডগোলে আত্ম-অন্বেষণ প্রায় অসম্ভব; অপরটি, জনসাধারণের অজ্ঞতা ও ঔদাসীন্য। পুত্রকন্যার শিক্ষাদানে যে অর্থ ব্যয় তাঁদের হচ্ছে তার বিনিময়ে তারা কি পাচ্ছেন এ প্রশ্ন তাঁরা নিজেদের ভালো করে করতে পারছেন না এজন্য যে কিছুদিন আগেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ যোগাড় করতে পারলেই অন্নের ব্যবস্থা একরকম হতে পারত, সেই মোহ আজো পুরোপুরি কাটে নি। শিক্ষার উদ্দেশ্য জ্ঞানার্জন নিশ্চয়ই, কিন্তু সদুপায়ে অর্থার্জনও ঘৃণার সামগ্রী আদৌ নয় । শিক্ষার উদ্দেশ্য যদি হয় মানুষের ভিতরকার সুপ্ত সৃষ্টি-শক্তিকে সচেতন করা, তবে যে শিক্ষা মানুষের প্রয়োজনীয় জীবিকা আহরণের জন্য সাহায্য করে না, সে-শিক্ষা কেন আদৌ শিক্ষা নামে খ্যাত হবে, এ প্রশ্ন জনসাধারণের মনে জাগলে শিক্ষকদের হুঁশিয়ার হয়ে উঠতে হবে অনেকখানি। কিন্তু দায়িত্বও মানুষ গ্রহণ করতে পারে ইচ্ছুক হয়ে বা অনিচ্ছুক হয়ে দেশের জনসাধারণ যখন দেশের শিক্ষকদের প্রদত্ত শিক্ষার মূল্য যাচাই করতে চাইবেন তখন সে পরীক্ষা যদি তাঁরা শ্রদ্ধার ভাবে গ্রহণ করতে পারেন তবে সেইটিই হবে দেশের জন্য কল্যাণকর।
সমুদ্রগামী জাহাজের জন্য যেমন নাবিক, সমাজ বা দেশের পক্ষেও তেমনি শিক্ষক। আরোহীরা কত বিচিত্র খেয়াল ও খুশীর ভিতর দিয়ে দিন কাটাতে থাকেন, নাবিকরা সে সব দেখেন, সময় সময় তাঁদের বুকও আন্দোলিত হয়, তবু জাহাজ চালনা তাদের বড় লক্ষ্য এ-ব্যাপারে ভুল হওয়া মারাত্মক। সমাজ বা দেশের বিচিত্র জীবনযাত্রাও তেমনি শিক্ষকের বুকে স্পন্দন জাগাতে পারে, কিন্তু সর্বাগ্রে তিনি শিক্ষক— মানুষের মনের লালন, শৃঙ্খলা-বিধান তাঁর বড় কাজ, এবং সেই জন্য তিনি স্বদেশ-প্রেমিক বা বিশেষ-ধর্ম-প্রেমিক ইত্যাদি যাই হোন তারও উপরে তিনি বৈজ্ঞানিক, man of science, বিচারবুদ্ধি তাঁর শ্রেষ্ঠ অবলম্বন – একথা বিস্মৃত হলে মানুষের সেবাও আর তাঁর দ্বারা হয় না।
আমাদের দেশের শিক্ষক-সমাজ আজ মনোজীবী নন, বড়-জোর ভাবপ্রবণ মনে হয়, শিক্ষা-ব্যাপারে এ একটা
বিষম সঙ্কট ।
কাজী আবদুল ওদুদ ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ শে এপ্রিল রাজবাড়ি জেলার পাংশা থানার বাগমারা গ্রামে মামা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কাজী সগীরউদ্দীন ও মাতা খোদেজা খাতুন। অসাধারণ মেধাবী কাজী আবদুল ওদুদ কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ এবং অর্থনীতি বিষয়ে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, বিচারপতি রমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, বিচারপতি আমীন আহমদ প্রমুখ তাঁর সহপাঠী ছিলেন। তিনি সংস্কৃত, ফারসি, উর্দু ও আরবি ভাষায়ও দক্ষতা অর্জন করেন। ছাত্রাবস্থায়ই তিনি রবীন্দ্রভক্ত হন এবং সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে (বর্তমান ঢাকা কলেজে) বাংলা বিষয়ে অধ্যাপনা করেন। এ সময় ঢাকায় ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ' প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সংগঠনের সদস্যরা ‘বুদ্ধির মুক্তি' আন্দোলন পরিচালনা করেন। কাজী আবদুল ওদুদ ছিলেন এ আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক যুগন্ধর পুরুষ। কাজী আবদুল ওদুদ বাংলা সরকারের টেক্সট বুক কমিটির সম্পাদক নিযুক্ত হয়ে কলকাতা যান। সেখানে অবস্থানকালে তিনি পুরোপুরি সাহিত্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। ‘সংকল্প' এবং ‘তরুণপত্র' নামে দুটি পত্রিকা তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে— গল্প : ‘মীরপরিবার’; উপন্যাস : ‘নদীবক্ষে’, ‘আজাদ’; প্রবন্ধ : ‘নবপর্যায় (১ম ও ২য় খণ্ড)', ‘রবীন্দ্রকাব্যপাঠ’, ‘সমাজ ও সাহিত্য', ‘শাশ্বতবঙ্গ’, ‘আজকার কথা', 'নজরুল প্রতিভা’, ‘কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ’, ‘বাংলার জাগরণ' ইত্যাদি। এছাড়া ‘ব্যবহারিক শব্দকোষ' নামে একটি অভিধান তিনি সংকলন করেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ শে মে কাজী আবদুল ওদুদ কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন ।
ধ্রুব - চিরন্তন।
সংক্রমিত - প্রভাবিত
সংশয় - দ্বিধা ।
ঝালিয়ে নিতে হয় - ঝালানো অর্থ নতুন করে নেয়া। ঝালিয়ে নিতে হয় বলতে নতুন করে নেয়ার কথা বলা হচ্ছে।।
সন্দেহ কীট - সন্দেহ তৈরি করে এমন বুঝানো হয়েছে। কীট বলতে এখানে আক্ষরিকভাবে পোকা বুঝাচ্ছে না ।
প্রবেশার্থী - প্রবেশ করছে যারা ।
গন্ডগোল - হইচই, সমস্যা।
সর্বান্তঃকরণে - মনে প্রাণে ।
অনুবর্তিতা - অনুসরণ, অনুগমন ।
আরোহী - আরোহণ করেছে যারা ।
মনোজীবী - মন ও মনন নিয়ে যারা ভাবেন ।
“আহ্বান” গল্পটি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনাবলি থেকে সংকলিত হয়েছে। এটি একটি উদার মানবিক সম্পর্কের গল্প । মানুষের স্নেহ-মমতা-প্রীতির যে বাঁধন তা ধনসম্পদে নয়, হৃদয়ের নিবিড় আন্তরিকতার স্পর্শেই গড়ে ওঠে। ধনী-দরিদ্রের শ্রেণিবিভাগ ও বৈষম্য, বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে যে দূরত্ব সংস্কার ও গোঁড়ামির ফলে গড়ে ওঠে তাও ঘুচে যেতে পারে— নিবিড় স্নেহ, উদার হৃদয়ের আন্তরিকতা ও মানবীয় দৃষ্টির ফলে । দারিদ্র্য-পীড়িত গ্রামের মানুষের সহজ-সরল জীবনধারার প্রতিফলনও এই গল্পের অন্যতম উপজীব্য। এ গল্পে লেখক দুটি ভিন্ন ধর্ম, বর্ণ ও আর্থিক অবস্থানে বেড়ে ওঠা চরিত্রের মধ্যে সংকীর্ণতা ও সংস্কারমুক্ত মনোভঙ্গির প্রকাশ ঘটিয়েছেন । গ্রামীণ লোকায়ত প্ৰান্তিক জীবনধারা শাস্ত্রীয় কঠোরতা থেকে যে অনেকটা মুক্ত সে-সত্যও এ গল্পে উন্মোচিত হয়েছে।
Read more