আসবাবপত্র ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের উপকরণ দিয়ে আমরা ঘর সাজিয়ে থাকি। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দরজা ও জানালার পর্দা, কার্পেট, দেয়ালচিত্র, আলো এবং ফুলের বিন্যাস।
দরজা ও জানালার পর্দা
গৃহে দরজা ও জানালার পর্দার ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রথমত, পর্দার ব্যবহার আমাদের আব্রু রক্ষা করে। বিশেষ করে পর্দার ব্যবহারে রাতের আলোতে ঘরের ভেতরের কর্মকাণ্ড, চলাফেরা বাইরে থেকে দেখা যায় না। কড়া রোদ, বাইরের ধুলাবালি থেকে অনেক সময় ঘরকে ঢাকার প্রয়োজন হলেও পর্দা ব্যবহার করা হয়। উপযুক্ত রং, আকার, নকশার পর্দা নির্বাচন করতে পারলে ঘরের পরিবেশকে অনেক আকর্ষণীয় ও আরামদায়ক করা সম্ভব।
পর্দা নির্বাচনে লক্ষণীয় বিষয়
ঘরের দেয়াল, মেঝে, ছাদ ও আসবাবপত্রের রঙের সাথে মিল রেখে পর্দার রং নির্বাচন করতে হয়। বর্তমানে ঘরের আকার ছোট হয় বলে হাল্কা রঙের পর্দা ব্যবহারে ঘরকে বড় দেখায়। হাল্কা রঙের পর্দা বিশ্রামের ঘরগুলোতে ঠান্ডা পরিবেশ সৃষ্টি করে। বড় ছাপা, চেক, আড়াআড়ি রেখার পর্দা বড় আকারের ঘরে ব্যবহার করা যেতে পারে। ছোট আকারের ঘরে ছোট ছাপা, লম্বা রেখার পর্দা ব্যবহার করা ভালো। চেক, ছাপার পর্দা ছোট আকৃতির ঘরকে আরও ছোট করে দেয়।
পর্দার কাপড়ের জমিন হাল্কা বা ভারী উভয় ধরনের হতে পারে। এর জন্য কৃত্রিম ও প্রাকৃতিক তন্তুর কাপড় নির্বাচন করা যেতে পারে। ভারী জমিনের পর্দা শীতকালে ঘর গরম রাখে। পর্দা বিভিন্ন নকশার হয়। সজ্জামূলক নকশার পর্দা আমরা বসার ঘরে ব্যবহার করি। জানালার পর্দা অনেক সময় জানালা জুড়ে না হয়ে নিচের অর্ধেক অংশে দেওয়া হয়। এতে বেশি আলো ও বাতাস পাওয়া যায়। একই ঘরে খাবার ও বসার ব্যবস্থা পৃথক করার জন্য পর্দা দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে পাটের বিভিন্ন দড়ি, রং-বেরঙের কাপড় ঝুলিয়ে পর্দার আবহ আনা যায়।
কার্পেট
আমাদের দেশে ঘরের মেঝে বিভিন্ন ধরনের হয়। যেমন- মাটির ও সিমেন্টের মেঝে, মোজাইক মেঝে, টাইলস মেঝে, কাঠের মেঝে ইত্যাদি। বর্তমানে টাইলস মেঝে বিশেষ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বিভিন্ন রং ও নকশায় তৈরি টাইলস মেঝে ঘরের সৌন্দর্য বাড়ায়, মেঝেতে কার্পেট বিছিয়ে ঘরের পরিবেশকে আরও জাঁকজমকপূর্ণ করা যায়।
ঘরের সম্পূর্ণ মেঝেতে কার্পেট বিছানো যায়। আবার মেঝের কিছু অংশজুড়ে ছোট কার্পেট দেওয়া যেতে পারে। পুরাতন বাড়ির মেঝে কিংবা সাধারণ সিমেন্টের মেঝেতে যদি কোনো ত্রুটি থাকে তবে কার্পেট দিয়ে সেটা ঢেকে রাখা যায়। কৃত্রিম তন্তুর কার্পেট যেমন- নাইলন, পলিস্টার এর রং ও উজ্জ্বলতার স্থায়িত্ব বেশি এবং দামে সস্তা হয়। এ ধরনের কার্পেটে ধুলাবালি কম জমে, সহজে পরিষ্কার করা যায়। প্রাকৃতিক তন্তুর কার্পেট (যেমন-উল, পাট, সুতি)-এর মধ্যে উলের কার্পেটে হাঁটতে আরাম এবং শিশুর জন্য কিছুটা নিরাপদ। কার্পেট নিয়মিত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা প্রয়োজন। তা না হলে ধুলাবালিজনিত রোগ, যেমন- শ্বাসকষ্ট বাড়তে পারে।
দেয়ালচিত্র ও আলোক সজ্জা
দেয়ালচিত্র
কক্ষসজ্জার অন্যতম একটি উপকরণ হলো দেয়ালচিত্র। দেয়ালের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে দেয়ালে নানা ধরনের পেইন্টিং এবং ছবি ঝোলানো হয়। দেয়ালচিত্র কোথায় টাঙানো হবে তার জন্য স্থান নির্বাচন এবং উপযুক্ত ছবি নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় তবে আরও কিছু লক্ষণীয় বিষয় হলো-
দেয়ালচিত্র ছাড়াও হাতে তৈরি নানা ধরনের শিল্প দিয়ে দেয়াল সাজানো যায়। দেশীয় কাঁচামাল ব্যবহার করে নিজের হাতে তৈরি যেকোনো দেয়ালসজ্জা গভীর আবেদন সৃষ্টি করতে পারে। এক্ষেত্রে পাট, ঝিনুক, পাখির পালক, শুকনা ডালপাতা, ফলের বীজ, ধানের শিষ ইত্যাদি উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। আবার কাপড়, সুতা, রং, ধাতবসামগ্রী, বোতাম, শব্দ তৈরি হয় এমন বস্তু দিয়েও দেয়ালসজ্জা তৈরি করা যায়। গৃহের যেকোনো সজ্জার মধ্যে দিয়ে দেশিয় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ফুটিয়ে তুলতে পারলে তা সবার কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য ও পছন্দের হয়।
কাজ ১- দেশীয় উপকরণ এবং ভাববস্তু (theme) ব্যবহার করে একটি দেয়ালসজ্জা তৈরি করো। |
আলোকসজ্জা ও আলোর সুষ্ঠু ব্যবহার আলো ছাড়া আমরা চলতে পারি না। আমাদের জীবনের জন্য অপরিহার্য এই আলোর উৎস কী? সূর্য থেকে আমরা প্রাকৃতিক আলো পাই। রাতের বেলা প্রাকৃতিক আলো থাকে না। তখন কৃত্রিম আলো দিয়ে আমাদের চলতে হয়। তোমরা কি লক্ষ করেছ যে, রৌদ্রোজ্জ্বল বা মেঘলা দিনে আমাদের মন কেমন থাকে? রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে কাজ করার ইচ্ছা জাগে, আমরা বাইরে বের হই। অপরদিকে মেঘলা দিনে মনে কিছুটা বিষণ্ণতা আসে, অলসভাবে সময় কাটাতে ইচ্ছে করে। এভাবে আলো আমাদের শরীর ও মনের উপর গভীর প্রভাব ফেলে। গৃহে প্রাকৃতিক আলো আমাদের কর্মস্পৃহা বাড়ায়, উপযুক্ত আলোয় পড়াশোনায় মনোযোগ আসে, শীতকালে ঘরে আলো এলে ঘর গরম থাকে।
ঘরে প্রাকৃতিক আলো আসার ব্যবস্থা করা কাজের জন্য ভালো ও স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক আলো ঘরে প্রবেশের জন্য আজকাল জানালা, দরজায় গ্লাস ব্যবহার করা হচ্ছে। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে আমাদের দেশে দক্ষিণ ও পূর্ব দিক থেকে আলোর প্রাপ্তি ও বায়ুপ্রবাহ বেশি হয়। শীতকাল ছাড়া বছরের প্রায় সব সময় দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে বায়ুপ্রবাহ হয়। তাই গৃহের দক্ষিণ ও পূর্বের জানালা খোলা রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। কখনোই আসবাবপত্র দিয়ে আলো ও বাতাস বন্ধ করা যাবে না। জানালার আকার, সংখ্যা, অবস্থান ইত্যাদির ওপর ঘরে প্রাকৃতিক আলো প্রবেশ নির্ভর করে। এছাড়া পর্দার জমিন, রং, ডিজাইন বা নক্শার উপর কক্ষের সুষ্ঠু প্রাকৃতিক আলোর প্রবেশ নির্ভর করে।
রাতে আমরা কৃত্রিম আলো ব্যবহার করি। প্রয়োজনের উপর ভিত্তি করে আলোর ব্যবস্থা করা হয়। যেমন-রান্নাঘরে রান্নার স্থানে, পড়ার টেবিলের উপর উজ্জ্বল আলোর দরকার। বসার ঘরে মৃদু আলো ঘরকে আকর্ষণীয় করে তোলে। শোবার ঘরের আলো স্নিগ্ধ হতে হয়। অনেক সময় কৃত্রিম আলোর বাল্বের উপর শেড ব্যবহার করা হয়। সেগুলোর রং ও নকশা নির্বাচনে যথেষ্ট সতর্ক হতে হয়। বিভিন্ন রং ও নকশার শেড ঘরের সৌন্দর্য বাড়ায়, সুরুচির পরিচয় বহন করে।
কাজ ১- কক্ষে প্রাকৃতিক আলো প্রবেশের জন্য তুমি কী কী বিষয় লক্ষ রাখবে? তা লেখো। |
পুষ্পবিন্যাস
ফুল ভালোবাসে না এমন মানুষ কি খুঁজে পাওয়া যাবে? নিশ্চয়ই না। আমাদের পছন্দের এই ফুল ও পাতার বিন্যাস কক্ষ সজ্জার অন্যতম অংশ। ফুলদানিতে যদি ফুল ও পাতা থাকে, তবে ঘরের সৌন্দর্য শতগুণ বেড়ে যায়। বাড়িতে ফুল দিয়ে সাজানো কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন অনুষ্ঠানের মান বৃদ্ধি করে, সদস্যদের সুরুচির পরিচয় দেয়। এছাড়া গৃহসজ্জায় আমরা নানা কারণে ফুলের বিন্যাস করি-
ফুল সাজানোর জন্য বিশেষ কিছু সরঞ্জামের দরকার হয়। যেমন- ফুলদানি বা ফুল সাজানোর পাত্র, কাঁচি, পিন হোল্ডার, পানি, চিকন তার ইত্যাদি।
ফুল সাজানোর সময় প্রথমেই উদ্দেশ্যের কথা ভাবতে হয়। ভিন্ন ভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য ফুল সাজানোর পদ্ধতি আলাদা হয়ে থাকে যেমন- কোনো উৎসবে ফুল সাজানো এবং প্রতিদিনের ফুল সাজানো এক হয় না। সাধারণত প্রাচ্যরীতি এবং পাশ্চাত্যরীতি অনুসরণ করে ফুল সাজানো হয়। প্রাচ্য রীতিতে ফুল সাজানো বলতে জাপানি পদ্ধতি অনুসরণ করাকে বোঝায়। জাপানিরা ফুল সাজানোতে খুব দক্ষ। তাদের ফুল সাজাবার পদ্ধতিকে ইকেবানা (IKEBANA) বলা হয়। ইকে অর্থ তাজা, বানা অর্থ ফুলকে বোঝায়। এই রীতিতে অল্পসংখ্যক ফুলের দরকার হয়। এই পদ্ধতিতে ফুলদানিতে তিনটি প্রধান ডাল থাকে। সবচেয়ে উঁচু ডালটি হলো স্বর্গ, দ্বিতীয় উচ্চতার ডালটি মানুষ এবং ছোট ডালটি পৃথিবীর প্রতীক হিসাবে ফুল সাজানো হয়।
প্রথম ডালটির উচ্চতা ফুলদানির ব্যাস ও উচ্চতার যোগফলের সমান। দ্বিতীয় ডালটি প্রথম ডালের ৩/৪ অংশ (৪ ভাগের ৩ ভাগ)। ছোট ডালটি দ্বিতীয় ডালের ১/২ অংশ (অর্ধেক)। প্রধান ডাল তিনটি ছাড়া আশপাশের ডাল, পাতা, ফুলকে ফিলার বলা হয়। পাশ্চাত্য পদ্ধতিতে ফুল সাজানোতে অনেক ফুল ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতিতে স্তূপাকারে ফুল সাজানো হয়। জাঁকজমকপূর্ণ ফুলদানিতে বিভিন্ন রঙের ফুল এক সাথে সাজানো হয়।
যে রীতিতেই আমরা ফুল সাজাই না কেন, আমাদের ফুল সাজানোর সময় কিছু বিষয় মনে রাখতে হবে-
তাজা ফুলের পরিবর্তে কাপড়, কাগজ ও প্লাস্টিকের ফুল দিয়েও ফুলদানি সাজানো যায়। এসব ফুল দিয়ে একবার ফুলদানি সাজালে তা অনেক দিন ধরে রাখা যায়। এতে সময় ও শক্তি বাঁচে। কিন্তু এসব ফুলের আবেদন তাজা ফুলের মতো হয় না। তাজা, টাটকা ফুলের গন্ধ ও সৌন্দর্য আমাদেরকে বেশি আকৃষ্ট করে।
কাজ ১- শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন পদ্ধতিতে ফুল সাজাও। |