ডিম সংরক্ষণ করার বিষয়ে যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করা প্রয়োজন। যথাযথ সংরক্ষণ ব্যবস্থার অভাবে প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক ডিম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বিশেষত গ্রীষ্মকালে ডিম নষ্ট হওয়া বা পঁচে যাওয়ার সংখ্যা অনেক বেশি। এ মৌসুমে বিশেষত মুরগির ডিম অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যায়। এ কারণে ডিম সংরক্ষণ পদ্ধতি সম্পর্কে যথাযথ ও স্পষ্ট জ্ঞান থাকা প্রয়োজন ।
(ক) দেশীয় প্রথায় ডিম সংরক্ষণ:
বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ঐতিহ্যগতভাবে সাধারণ মানুষরা বিভিন্ন পদ্ধতিতে ডিম সংরক্ষণ করে থাকে । যথা-
১) মাটির হাড়িতে ডিম সংরক্ষণ:
প্রথমে মাটির হাঁড়ির মধ্যে ডিম রাখা হয়। পরে হাঁড়ির অর্ধাংশ ভেজা মাটিতে পুঁতে রাখা হয়। এভাবে সংরক্ষিত ডিমের মেয়াদ স্বল্পমেয়াদি বিধায় এটি তেমন কার্যকর পদ্ধতি নয়। ঠান্ডায় সহজ পদ্ধতিতে ডিম সংরক্ষণের উদ্দেশ্য গ্রামাঞ্চলে ঘরের কাঁচা মেঝেতে একটি গর্ত করা হয়। ঐ গর্তের মধ্যে বসানো হয় একটি মাটির হাঁড়ি। হাঁড়ির চারপাশে কাঠ কয়লা দিয়ে ভরাট করা হয়। প্রতিদিন কয়েকবার পানি দিয়ে কাঠ কয়লা ভিজিয়ে দেয়া হয়। এতে হাঁড়ির মধ্যভাগ বেশ ঠান্ডা হয়ে যায় । হাঁড়ির মধ্যে ডিম রেখে মাটির সরা বা ঢাকনা দিয়ে হাঁড়িটি ঢেকে দেয়া হয়। এভাবে সংরক্ষিত ডিম বেশ কিছুদিন ভালোভাবে টিকে থাকে। ফলে এটিকে ডিম সংরক্ষণের একটি মোটামুটি লাগসই প্রযুক্তি বলা যায় ।
২) সিদ্ধ করে ডিম সংরক্ষণ :
ডিম সিদ্ধ করে সংরক্ষণ করা যায়। ৬০° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় গরম পানির মধ্যে ১৫ মিনিট ধরে ডিম সিদ্ধ করলেও তা বেশ কিছুদিন পর্যন্ত ব্যবহারযোগ্য রাখা যায়। গ্রামের হাট, ফেরিঘাট, বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন প্রভৃতি জনবহুল স্থানে ফেরি করে সিদ্ধ ডিম বিক্রি করা হয়। ১০০ টি সিদ্ধ ডিম একই দিনে বিক্রি না হলে তা পরদিন এবং প্রয়োজনবোধে আরও একদিন পর্যন্ত রেখেও বিক্রি করা হয়। এভাবে সিদ্ধ করার পর অন্তত ২ দিন পর্যন্ত ডিম ভালো অবস্থাতেই থাকে।
৩) ডিমের খোসার ছিদ্র বন্ধ করে ডিম সংরক্ষণ :
ডিমের খোসা বা উপরিভাগের আবরণে থাকে অসংখ্য অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র। বাইরের গরম বাতাস এসব ছিদ্রের মধ্য দিয়ে ডিমের মধ্যে প্রবেশ করে এবং তা বের হয়ে আসে জলীয় বাষ্প আকারে। এসব ছিদ্র দিয়ে নানা ধরনের অণুজীব প্রবেশ করে ডিমকে পচিয়ে দেয় বা নষ্ট করে । এসব সূক্ষ্ম ছিদ্র খালি চোখে দৃশ্যমান নয়। তবে ডিমের এসব ছিদ্র যদি বন্ধ করা যায় তবে ডিমের ভেতরের গুনাগুণ অপরিবর্তিত থাকে ।
(ক) সরিষার তেল ব্যবহার:
ডিমকে ১ মিনিট খাঁটি সরিষার তেলের মধ্যে ডুবিয়ে রাখলে ডিমের খোসার গায়ে ছিদ্র বন্ধ হয়ে যায় । এভাবে তেলে ডোবানো ডিম তুলে স্বতন্ত্র পাত্রে রেখে দিতে হয়। এভাবে রাখা ডিম বেশ কিছুদিন ভালো থাকলেও খাওয়ার সময় ডিমে সরিষার তেলের ঝাঁজ পাওয়া যেতে পারে।
(খ) মিনারেল তেল ব্যবহার:
বর্ণ, গন্ধ ও স্বাদহীন মিনারেল তেলের মধ্যে ডিম ডুবিয়ে পরে তুলে তা শুকিয়ে রাখতে হয়। এভাবে তেলে ডুবিয়ে পরে শুকানোর ফলে ডিমের মধ্যকার জলীয় অংশ বাষ্পীভূত হতে পারে না। এভাবে সংরক্ষণের জন্য প্রথমে একটি পাত্রের মধ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণে মিনারেল তেল নিতে হয়। একটি তারের জালের খাচার মধ্যে ভরে নিয়ে খাঁচাটিসহ মিনারেল তেলের মধ্যে কিছুক্ষণ ডুবিয়ে রাখতে হয়। তারপর খাঁচাসহ তুলে নিতে হয়। আজকাল আধুনিক পন্থায় ডিমের উপরে মিনারেল তেল উত্তমরূপে স্প্রে করা হয়। তারপর ঐ ডিম প্যাকেট বন্ধ করা হয়। এভাবে ডিম সংরক্ষিত থাকলেও ব্যবহৃত মিনারেল তেলে যদি কেন গন্ধ বা স্বাদ তবে তা ডিমের মধ্যে প্রবেশ করে ।
(গ) চুনের পানি ব্যবহার:
কোথাও কোথাও চুনের পানির মধ্যে ডিম ডুবিয়ে রেখে পরে তা সংরক্ষণ করা হয়। এভাবে চুনের পানিতে ডুবিয়ে রাখলে ডিমের সূক্ষ্ম ছিদ্রগুলো বন্ধ হয়ে যায়। এভাবে সংরক্ষিত ডিম দীর্ঘ দিন পর্যন্ত ভালো অবস্থায় থাকে। এভাবে সংরক্ষণের লক্ষ্যে প্রথমে একটি পাত্রে ১ লিটার পানি নিতে হয়। পানিতে ১০০ গ্রাম লবণ ভালোভাবে গুলে তারপর গরম করতে হয়। লবণ মেশানো পানি চুলা থেকে নামিয়ে রাখতে হয়। ঐ পানি ঠান্ডা হওয়ার পর তার মধ্যে ২৫০ গ্রাম চুন উত্তমরূপে গুলে নিতে হয়। এরপর পাত্রটি ১ দিন রেখে দিতে হয়। পাত্রের নিচে তলানি জমে। ওপরের পরিষ্কার পানি আরেকটি পাত্রে এমনভাবে ঢেলে নিতে হয় যাতে নিচের তলানি নড়ে না যায়। এরপর ঐ পরিষ্কার পানির মধ্যে তারের খাঁচাসহ ডিম ডুবিয়ে দিতে হয়। খাঁচাসহ ডিম তুলে ছায়াযুক্ত স্থানে রেখে দিলে ডিম শুকিয়ে যায়। ডিম সংরক্ষণের জন্য এটি একটি সহজ উত্তম পদ্ধতি।
(ঘ) সোডিয়াম সিলিকেটের সাহায্যে
এ পদ্ধতিতে ডিম সংরক্ষণের জন্য প্রথমে একটি পাত্রের মধ্যে পানি নিয়ে তা গরম করে পরে আবার ঠান্ডা করতে হয়। পানি ঠান্ডা হলে ৯:১ অনুপাতে ঠান্ডা পানি ও সোডিয়াম সিলিকেট একত্রে মেশাতে হয়। তারের খাঁচাসহ ডিম ঐ সিলিকেট পানির মধ্যে ২০ মিনিট কাল ডুবিয়ে রাখতে হয়। এরপর খাঁচা তুলে নিয়ে ছাঁয়ায় রাখলে ডিম শুকিয়ে যায়। ডিমের গায়ে সিলিকেট পানি শুকিয়ে গেলে ডিমের গায়ের সূক্ষ্ম ছিদ্র বন্ধ হয়ে যায়। এভাবে সংরক্ষিত ডিম দীর্ঘদিন পর্যন্ত ভালো অবস্থায় থাকে। শুকানোর পর ডিম প্যাকেটজাত করে কোনো ঠান্ডা জায়গায় রাখতে হয়। তবে ডিমের সূক্ষ্ম ছিদ্র বন্ধ করে সংরক্ষণ করার ফলে এসব ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানো যায় না ।
ডিম সংরক্ষণ সম্পর্কে সাধারণ তথ্য:
ডিম যদি ফেটে যায় বা ডিমের গায়ে যদি ময়লা থাকে তবে তা সংরক্ষণ করা যায় না। ডিমের খোসার গায়ে লেগে থাকা ময়লা নরম ব্রাশের সাহায্যে পরিষ্কার করতে হয়। সামান্য কুসুম গরম পানিতে তুলা, স্পঞ্জ বা কাপড়ের টুকরা ভিজিয়ে তা দিয়ে ডিমের গায়ে লেগে থাকা ময়লা পরিষ্কার করা যায়। কোনো অবস্থাতেই ডিম পরিষ্কার করার জন্য ঠান্ডা পানি বা কোনো ধরনের রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা যাবে না। রসুন, পেঁয়াজ বা গন্ধযুক্ত অন্য কোনো দ্রব্যের পাশে ডিম রাখা অনুচিত। কারণ গন্ধ খুব | সহজেই এবং দ্রুত ডিমের মধ্যে শোষিত হয়।
তাত্ত্বিক কাজঃ
(খ) উন্নত পদ্ধতিতে ডিম সংরক্ষণ (Preserve eggs in an improved manner):
১) হিমাগারে সংরক্ষণ:
বাচ্চা ফুটানোর জন্য ডিম হিমাগারে ১ সপ্তাহ সংরক্ষণ করা হয়। হিমাগারে তাপমাত্রা রাখা হয় ১২° সেলসিয়াস। খাবার খাবার ডিম সংরক্ষণের জন্য হিমাগারের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা রাখতে হয় যথাক্রমে ০-৩° সেলসিয়াস ও ৬০% আপেক্ষিক আর্দ্রতা।
২) গভীর হিমায়িত ডিমঃ
এ পদ্ধতিতে ডিম ভেঙে ভেতরের কুসুম ও সাদা অংশ ০° সেলসিয়াস বা তার চেয়েও কম তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যেতে পারে। বেকারি, কনফেকশনারি এবং ন্যুডলস্ তৈরির কারখানায় ব্যবহারের জন্য এভাবে ডিম সংরক্ষণ করা হয়।
৩) শুকনো ডিম:
ডিম শুকানোর পদ্ধতিসমূহঃ
(ক) ডিম ভেঙে ভেতরের তরল কুসুম ও সাদা অংশ “ক্ল্যরিফায়ার” যন্ত্রের মধ্যে দেয়া হয়।
(খ) ছাকনির সাহায্যে ডিমের চ্যালাজা এবং ভাইটিলিন পর্দাসমূহ আলাদা করে ফেলা হয় ৷
(গ) তারপর ৬০° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় উষ্ণ বাতাস ডিমের জলীয় অংশ শোষণ করে নেয় এবং ডিম গুঁড়া পাউডার হয়ে যায় ।
এভাবে শুকানো পাউডারকৃত গুঁড়া ডিম অবিলম্বে প্যাকেটবন্ধি ও সীলমোহর করতে হয়। বাতাসে কিছুক্ষণ থাকলে ও ডিম বাতাস থেকে জলীয় বাষ্প শোষণ করতে পারে। অনেক সময় ডিমের সংরক্ষণ ক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে প্যাকেটে কার্বন ডাই অক্সাইড ব্যবহার করা হয়। এভাবে কার্বন ডাই অক্সাইড ব্যবহার করা হলে তা ডিমের মধ্যে অণুজীবের প্রবেশ এবং বংশ বিস্তার রোধ করে । প্যাকেটজাত গুঁড়ায় ২% এর অধিক আর্দ্রতা থাকা অনুচিত ।
দূরের বড় বাজারে ডিম পাঠাতে হলে যত্ন ও সতর্কতার সাথে প্রেরণ করতে হবে। না হলে ডিম ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্রাম থেকে শহরে ডিম পরিবহন করে নিয়ে আসা হয় । ৩ টি পদ্ধতিতে সাধারণত ডিম পরিবহন করা হয় । যথাঃ-
ক) বাঁশের ঝুড়িতে ডিম পরিবহন
এ পদ্ধতিতে তলা চ্যাপ্টা বাঁশের ঝুড়িতে ডিম পরিবহন করা হয়। ঝুড়ির তলাতে ২ ইঞ্চি পুরু করে খড় বিছিয়ে তার উপর তুষ বা কাঠের গুঁড়া বিছিয়ে ডিম সাজাতে হয়। এর উপর আবার তুষ বিছিয়ে আবার ডিম বসানো হয় এভাবে কয়েক স্তরে ডিম সাজানো যায়। সর্ব উপরে খড়ের টুকরা দিয়ে মুখ চট দিয়ে সেলাই করতে হয়।
খ) প্লাস্টিকের ট্রেতে ডিম পরিবহন :
বর্তমানে প্লাস্টিকের তৈরি ট্রেতে নিরাপদে ডিম বসিয়ে পরিবহণ করা হচ্ছে। ১টি ট্রেতে ৩০ টি ডিম বাসানো যায়। এভাবে ২০ টি ট্রে আবার ১ টি ডিমের ক্রেটে ভরা যায়। এভাবে ক্রেট ভর্তি ডিম সহজেই রিকশা ভ্যানে, পিক আপে, ট্রাকে, বাসে, ট্রেনে, নৌকায়, সাইকেলে করেও ডিম পরিবহন করা যায়। এতে ডিম রাখার জন্য পৃথক খোপ থাকে বিধায় ডিমগুলি পরস্পর ঠোকাঠুকি খায় না ।
গ) কাঠের বাক্সে ডিম পরিবহন
হালকা ও কম দামি কাঠ দিয়ে বাক্স তৈরি করে ডিম পরিবহণ করা যায়। বাক্সের তলায় খড়ের টুকরো বিছিয়ে দিয়ে তার উপর কাঠের গুঁড়া বা তুষ বিছিয়ে স্তরে স্তরে ডিম সাজাতে হবে। এরপর বাক্সের মুখ ঢাকনা দিয়ে বন্ধ করে ডিম শহরে নিয়ে যাওয়া হয়। বাক্সের গায়ে “সাবধান, ডিম আছে” কথাটি লিখে দেয়া ভালো ।
দেশে অধিকাংশ ডিম গ্রামের কৃষকের বাড়িতে উৎপন্ন হয়। কৃষক সাধারণত সাপ্তাহিক হাটে বা বাজারে বিক্রি করে । আবার ফেরিওয়ালা সরাসরি কৃষকদের নিকট থেকে এবং হাট থেকে ডিম সংগ্রহ করে পাইকারদের নিকট বিক্রি করে । পাইকার খুচরা বিক্রেতা (স্থানীয়ভাবে) অথবা বড় শহরের আড়তদারের নিকট ডিম বিক্রি করে ।
তবে মাঝারী ও বড় খামারিদের নিকট থেকে ভোক্তা পর্যায়ে নিম্নলিখিতভাবে ডিম পৌছায়:
তবে ডিম বিপণনের প্রক্রিয়ায় মধ্যস্থতাকারী অনুপস্থিত থাকলে উৎপাদানকারীগণ ন্যায্যমূল্য পাবে ও ভোক্তা সঠিক হবে।
আরও দেখুন...