তাপ
আমাদের চারপাশে আমরা নানা ধরনের শক্তি দেখি, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এই শক্তি আমরা নানাভাবে ব্যবহার করি। তাপ ঠিক সেইরকম একটি শক্তি। আমাদের জীবনে আমরা সবাই এই শক্তির সঙ্গে পরিচিত এবং কোথাও না কোথাও সেটি ব্যবহার করেছি। আমরা তাপ প্রয়োগ করে রান্না করি, চা-কফি খাওয়ার জন্য তাপ দিয়ে পানি গরম করি, কাপড় ধুয়ে তাড়াতাড়ি শুকাতে চাইলে রোদে কাপড় দিই। অনেক সময় ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য বাড়তি তাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করি, রোদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিই, গরমের সময় কালো কাপড় না পরার চেষ্টা করি। এই তালিকা আরও অনেক দীর্ঘ করা সম্ভব। তাই স্বাভাবিকভাবেই তাপশক্তিটুকু কীভাবে এসেছে সেটি নিয়ে আমাদের সবার কৌতূহল রয়েছে। কিংবা অন্যভাবে বলতে পারি ঠিক কী কারণে তাপশক্তি গরম পানিতে আছে, কিন্তু ঠান্ডা পানিতে নেই সেটি আমাদের সবার জানা প্রয়োজন।
একসময় এই ব্যাপারটি নিয়ে বিজ্ঞানীদের মনে অনেক প্রশ্ন ছিল, কিন্তু এখন আমরা জানি, সব পদার্থ অণু- পরমাণু দিয়ে তৈরি, এবং এই অণু-পরমাণুগুলোর গতি বা কম্পনকে সামগ্রিকভাবে আমরা তাপ হিসেবে দেখি। অণু-পরমাণুগুলো যত বেশি ছোটাছুটি করবে, সেটি তত বেশি উত্তপ্ত বলে মনে হবে। এক গ্লাস ঠান্ডা পানির ভেতরকার পানির অণুগুলো স্থির হয়ে নেই, সেগুলোও ছোটাছুটি করছে। কিন্তু যখন তাপ দেওয়া হয় তখন সেই পানির ছোটাছুটি অনেক বেশি বেড়ে যায়। যদি বেশি তাপ দেওয়া হয়, তখন কোনো না কোনো পানির অণুর গতিবেগ এত বেড়ে যাওয়া সম্ভব যে, সেটি পানি থেকে মুক্ত হয়ে বের হয়ে যেতে পারে। আমরা সেটাকে বাষ্পীভবন বলি।
তাপ সঞ্চালন
আমাদের নানা কাজে তাপশক্তিকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিতে হয় কিংবা সঞ্চালন করতে হয়। তিনটি উপায়ে তাপ সঞ্চালন করা হয়; সেগুলো হচ্ছে তাপের পরিবহণ, পরিচলন এবং বিকিরণ।
পরিবহণ (conduction) কঠিন পদার্থের বেলায় তাপ হচ্ছে অণুগুলোর কম্পন তাই যখন কঠিন পদার্থের এক প্রান্ত উত্তপ্ত করা হয়, তখন সেই প্রান্তের অণুগুলো নিজের জায়গা থেকেই কাঁপতে থাকে। একটা অণু কাঁপতে থাকলে সেটি তার পাশের অন্য অণুকেও কাঁপাতে শুরু করে। সেই অণুটি তখন তার পাশের অণুকে কাঁপায়। এভাবে কম্পনটি কঠিন পদার্থের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পরিবাহিত হয় যেটি তাপের পরিবহণ নামে পরিচিত।
পরিচলন (Convection): তরল কিংবা গ্যাসকে উত্তপ্ত করা হলে তার ঘনত্ব কমে সেটি হালকা হয়ে যায়, কারণ তখন তাদের অণুগুলোকে বেশি বেগে ছোটাছুটি করতে হয় বলে বেশি জায়গার প্রয়োজন হয়। একই পরিমাণ তরল বা গ্যাস একটু বেশি জায়গায় নিয়ে থাকলে তার ঘনত্ব কমে যায় বা সেটি হালকা হয়ে উপরে উঠে যায়, তখন পাশের শীতল তরল বা গ্যাস সেখানে উপস্থিত হয়। এভাবে তরল বা গ্যাসের ভেতর একটা অভ্যন্তরীণ পরিচলন শুরু হয়, সেটি সকল পানিকে খুব ভালোভাবে মিশিয়ে পানিকে উত্তপ্ত করে।
বিকিরণ (Radiation): আমরা যখন রোদে দাঁড়াই, তখন যে তাপ অনুভব করি, সেই তাপ পরিবহণ কিংবা পরিচলন পদ্ধতিতে সূর্য থেকে আমাদের কাছে পৌঁছায়নি, এই তাপ যে পদ্ধতিতে পৌঁছায় তার নাম বিকিরণ। বিকিরণের জন্য কোনো মাধ্যমের দরকার হয় না, সেজন্য সূর্য আর পৃথিবীর ভেতরে মহাশূন্য থাকার পরেও দৃশ্যমান আলোর সঙ্গে অদৃশ্য অবলোহিত রশ্মি এবং অতিবেগুনি রশ্মি বিকিরণের মাধ্যমে পৃথিবীতে চলে আসতে পারে।
আপেক্ষিক তাপ
একটা বস্তুতে কী পরিমাণ তাপ সঞ্চিত আছে সেটি নির্ভর করে বস্তুটি তাপমাত্রা, তার ভর এবং তার আপেক্ষিক তাপের উপর। যেহেতু বাতাসের ভর খুবই কম তাই তার তাপ ধারণ করার ক্ষমতা খুবই কম। একটি পদার্থের আপেক্ষিক তাপ কম হলে অল্প তাপ প্রদান করেও অনেক উচ্চ তাপমাত্রায় নেওয়া যায়। অন্যদিকে একটি পদার্থের আপেক্ষিক তাপ বেশি হলে একই তাপমাত্রায় নেওয়ার জন্য অনেক তাপ প্রদান করতে হয়।
তাপের প্রবাহ'
দুটি বস্তুর তাপমাত্রা যদি ভিন্ন হয় এবং দুটিকে যদি একটির সংস্পর্শে অন্যটিকে আনা হয়, তাহলে যে বস্তুর তাপমাত্রা বেশি, সেখান থেকে তাপ যে বস্তুর তাপমাত্রা কম সেখানে প্রবাহিত হবে। সে কারণে তাপের প্রবাহের দিক দিয়ে অনেক সময় তাপমাত্রার সংজ্ঞা দেওয়া হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত দুটি তাপমাত্রা একই জায়গায় না পৌঁছাবে ততক্ষণ তাপের প্রবাহ হতেই থাকবে।
একটি সুচকে আগুনে উত্তপ্ত করা হলে তার ভেতরে মোট তাপের পরিমাণ খুব বেশি হবে না। সেই তুলনায় একটা বালতি ভরা পানিতে তাপের পরিমাণ অনেক বেশি। কিন্তু গরম সুচটিকে যদি পানিতে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে সুচটির তাপের পরিমাণ কম হলেও সেটি বালতির পানিতে তার তাপ প্রবাহিত করবে।
২.১ তাপমাত্রা ও অভ্যন্তরীণ শক্তি
তাপ শক্তিটি সঠিকভাবে জানার জন্য আমাদের তাপমাত্রা বিষয়টি সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। কারণ যে কোনো বস্তুর ভেতরে তাপের কারণে যে অভ্যন্তরীণ শক্তি সঞ্চিত থাকে তার সঙ্গে তাপমাত্রার একটি সম্পর্ক রয়েছে।
২.১.১ তাপ শক্তি
তাপ আমাদের সবচেয়ে পরিচিত এবং প্রয়োজনীয় শক্তির একটি। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা নিয়মিত তাপ সৃষ্টি করি, তাপ ব্যবহার করি, আবার অনেক সময় বাড়তি তাপ অপসারণ করারও চেষ্টা করি। পৃথিবীর বর্তমান সভ্যতায় তাপের সৃষ্টি এবং নিয়ন্ত্রণ অনেক বড়ো ভূমিকা রেখেছে। যানবাহনে জ্বালানি ব্যবহার করে তাপ সৃষ্টি করা হয় সেই তাপ শক্তিকে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে যানবাহন চালানো হয়। বিদ্যুৎশক্তি কেন্দ্রে বেশিরভাগ সময়ে তাপশক্তি ব্যবহার করে জেনারেটর ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ সৃষ্টি করা হয়। নিউক্লিয়ার শক্তি ব্যবহার করার সময় সেটি তাপ শক্তি হিসেবে পাওয়া যায়। পৃথিবীতে প্রাণ বিকাশের বেলাতেও সঠিক তাপশক্তির প্রাপ্যতা একটি বড়ো ভূমিকা রেখেছে। জীবিত প্রাণীরাও বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য গ্রহণ করে সেটি প্রথমে তাপশক্তি হিসেবে রূপান্তর করে নেয়। দুর্ভাগ্যক্রমে আবার মানুষ শক্তির অপব্যবহার করে পৃথিবীতে অপ্রয়োজনীয় তাপ সৃষ্টি করে সারা পৃথিবীর জলবায়ুর পরিবর্তন করে পৃথিবীর মানুষকে বিপদের ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে।
তাপ শক্তি যেহেতু একটি শক্তি, তাই স্বাভাবিকভাবেই অন্য শক্তির মতো তাপশক্তির একক হচ্ছে জুল (J)। তাপের আরও একটি একক রয়েছে, সেটি হচ্ছে ক্যালরি (cal), 1 গ্রাম পানির তাপমাত্রা 1 ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়াতে যে পরিমাণ তাপ প্রদান করতে হয় সেটিই ক্যালরি নামে পরিচিত। 1 ক্যালরি তাপের পরিমাণ 4.2J
২.১.২ অণুর গতি ও তাপমাত্রা
আপাতদৃষ্টিতে তাপশক্তিকে যান্ত্রিক শক্তি থেকে পুরোপুরি ভিন্ন এক ধরনের শক্তি মনে হলেও এই শক্তিটা এসেছে পদার্থের অণু-পরমাণুর সম্মিলিত গতিশক্তি কিংবা কম্পন শক্তি থেকে। কঠিন পদার্থের বেলায় তাপের অর্থ অণুগুলোর কম্পন। তরল পদার্থের বেলায় সেটি হচ্ছে অণুগুলো পরস্পরের সংস্পর্শে থেকে গতিশীল থাকা। গ্যাসের বেলায় সেটি হচ্ছে অণুগুলোর একটি তুলনায় অন্যটির মুক্তভাবে ছোটাছুটি। তাপশক্তিকে বুঝতে হলে আমাদের প্রথমে তাপমাত্রা বলতে কী বোঝায় সেটিও বুঝতে হবে। তাপ হচ্ছে শক্তির পরিমাণ এবং তাপমাত্রা হচ্ছে কোনোকিছু কতটুকু উত্তপ্ত কিংবা কতটুকু শীতল তার একটি পরিমাপ। কাজেই আণবিক দৃষ্টিতে তাপমাত্রাকে বলা যায় পদার্থের অণুগুলোর কম্পন কিংবা গতিশক্তি কত তার একটি পরিমাপ। অণুগুলোর গতি কিংবা কম্পন যত বেশি হবে, বস্তুটির তাপমাত্রা তত বেশি।
তাপমাত্রার আন্তর্জাতিক একক হচ্ছে কেলভিন (K), তবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা তাপমাত্রার জন্য যে এককটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করি, সেটি হচ্ছে সেলসিয়াস (°C)। সেলসিয়াস এবং কেলভিনের স্কেল তুলনা করলে তোমরা দেখবে সেলসিয়াস স্কেলের তাপমাত্রার সঙ্গে 273.15° যোগ করা ছাড়া কেলভিন স্কেলে আর কোনো পার্থক্য নেই। কেলভিন স্কেলটি তৈরি করা হয়েছে এই পরম শূন্য তাপমাত্রাকে শূন্য ডিগ্রি ধরে। সেলসিয়াস স্কেলে এই তাপমাত্রা হচ্ছে -273.15° তাই সেলসিয়াস স্কেলের সঙ্গে 273.15 যোগ দিলে কেলভিন স্কেল পাওয়া যায়। সেলসিয়াস স্কেলের পাশাপাশি ফারেনহাইট নামে আরও একটি তাপমাত্রা স্কেল কোনো কোনো দেশে এবং জ্বর মাপার থার্মোমিটারে ব্যবহার করা হয়। সেই স্কেলে বরফের তাপমাত্রা 32°F এবং ফুটন্ত পানির তাপমাত্রা 212°F।
গাণিতিকভাবে এই তিনটি তাপমাত্রার সম্পর্ক এরকম:
২.১.৩ অভ্যন্তরীণ শক্তির ধারণা
কঠিন, তরল এবং গ্যাসের কণার (পরমাণু বা অণু) গতিশক্তি থাকে কারণ সেগুলো গতিশীল। আণবিক বন্ধন কণাগুলোকে টেনে ধরে রাখার চেষ্টা করে বলে তাদের বিভবশক্তিও রয়েছে। গ্যাসের কণাগুলো প্রায় মুক্ত অবস্থায় থাকে বলে তাদের গতিশক্তি সবচেয়ে বেশি। একটি পদার্থের সমস্ত কণার মোট গতিশক্তি এবং বিভবশক্তিকে এর অভ্যন্তরীণ শক্তি বলে। একটি বস্তুর তাপমাত্রা যত বেশি হয়, তার কণাগুলোও তত বেশি গতিশীল হয় বলে অভ্যন্তরীণ শক্তিও তত বেশি হয়।
সাধারণভাবে আমাদের মনে হতে পারে শক্তির প্রবাহ হয় বেশি শক্তি থেকে কম শক্তিতে। একটু আগে তোমাদের বলা হয়েছে একটি উত্তপ্ত আলপিনে যেটুকু তাপশক্তি আছে তার থেকে অনেক বেশি তাপ শক্তি রয়েছে এক বালতি পানিতে। আমরা যদি উত্তপ্ত আলপিনটা পানিতে ডুবিয়ে দেই তাহলে কিন্তু আলপিনের অল্প তাপশক্তির খানিকটাই চলে যাবে বালতির পানিতে। তার কারণ তাপ শক্তির প্রবাহ তাপ শক্তির উপর নির্ভর করে না, এটি নির্ভর করে তাপমাত্রার পার্থক্যের উপর। যদি একটি উত্তপ্ত বস্তু একটি শীতল বস্তুর সংস্পর্শে আসে, তবে উত্তপ্ত বস্তুটি অভ্যন্তরীণ শক্তি হারিয়ে ঠান্ডা হয়ে যায় এবং, একইসঙ্গে শীতল বস্তুটি অভ্যন্তরীণ শক্তি অর্জন করে উত্তপ্ত হয়ে উঠে। যতক্ষণ পর্যন্ত দুটি বস্তুর তাপমাত্রা সমান না হচ্ছে ততক্ষণ তাপশক্তির প্রবাহ চলতে থাকবে। তাপমাত্রার পার্থক্যের কারণে বস্তুর মাঝে স্থানান্তরযোগ্য এই শক্তিই তাপ শক্তি হিসেবে পরিচিত।
একটি উত্তপ্ত বস্তুকে শীতল বস্তুর সংস্পর্শে রাখা হলে যখন উত্তপ্ত বস্তু থেকে শীতল বস্তুতে তাপশক্তি স্থানান্তরিত হতে থাকে তখন সেই বস্তুটির কণাগুলো গতিশক্তি হারাতে থাকে। আবার, শীতল বস্তু উত্তপ্ত হওয়ার সময় এটির কণাগুলো গতিশক্তি লাভ করে। যখন দুইটি বস্তু একই তাপমাত্রায় পৌঁছায়, তখন প্রতিটি কণার গড় গতিশক্তি সমান হয়ে যায় বলে শক্তির এই স্থানান্তর বন্ধ হয়ে যায়। তাপমাত্রা যত বেশি হবে কণাদের এই গড় গতিশক্তিও তত বেশি হবে।
২.২ তাপ প্রয়োগে পদার্থের প্রসারণ
আমরা যদি একটু ভালো করে রেল লাইনের দিকে তাকাই তাহলে আমরা দেখতে পাই যে রেল লাইনের মাঝে সবসময় একটুখানি ফাঁক রাখা হয়। তার কারণ তাপের কারণে রেল লাইনে প্রসারণ হয় রেল লাইন আঁকাবাঁকা হয়ে যেতে পারে । ঠিক কতখানি ফাঁক রাখা হলে রেল লাইন ট্রেনের জন্য সব সময় নিরাপদ হবে এই জাতীয় বিষয়গুলো জানতে হলে জন্য তাপের সঙ্গে পদার্থের প্রসারণের সম্পর্কটি আমাদের বোঝা দরকার।
২.২.১ কঠিন পদার্থের প্রসারণ
তোমরা ইতোমধ্যে তাপ প্রয়োগে পদার্থের তাপমাত্রা পরিবর্তন এবং তার সঙ্গে অণুগুলোর কম্পন বা গতি হ্রাস-বৃদ্ধি সম্পর্কে জেনেছ। কঠিন পদার্থে অণুগুলো নির্দিষ্ট অবস্থানে থেকে একে অন্যকে আণবিক বল দিয়ে আটকে রাখে। এই বলকে আমরা ২.২ ছবিতে দেখানো স্প্রিংয়ের সঙ্গে তুলনা করতে পারি। তবে এই স্প্রিংটি হলো একটি বিশেষ ধরনের স্প্রিং, যা বেশি দূর প্রসারিত হয় কিন্তু কম দূর সংকুচিত হয়-একটি অণু অন্য অণুকে বেশি কাছে আসতে দেয় না বলে এরকমটি ঘটে। তাপ দেওয়া হলে অণুগুলোর কম্পন বেড়ে যায়, তখন প্রসারিত হওয়ার সময় এগুলো একটু বেশি দূরে যায় কিন্তু সংকুচিত হওয়ার বেলায় কম দূরত্ব আসে বলে কম্পনরত অণুগুলো বেশি জায়গা নেয় এবং মনে হয় পদার্থের আয়তন বেড়ে গেছে। তাপ প্রয়োগ করলে কঠিন পদার্থ দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতা এই তিন দিকেই প্রসারিত হয়। তাই কঠিন পদার্থে প্রসারণ পরিমাপ করার জন্য দৈর্ঘ্য, ক্ষেত্রফল এবং আয়তন প্রসারণ সহগ নামে তিনটি রাশি ব্যবহৃত হয়, যেহেতু এগুলো পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত তাই যে কোনো একটি পরিমাপ করলেই অন্য যে কোনো দুটি বের করে ফেলা যায়।
কোনো বস্তুর শুধু দৈর্ঘ্য বরাবর প্রসারণ পরিমাপ করার জন্য দৈর্ঘ্য প্রসারণ সহগ ব্যবহার করতে হয়। একে গ্রিক অক্ষর a (উচ্চারণ আলফা) দিয়ে প্রকাশ করা হয়। অর্থাৎ হচ্ছে প্রতি ডিগ্রি তাপমাত্রার জন্য একটা পদার্থের দৈর্ঘ্যের কত অংশ বৃদ্ধি পায়। ধরা যাক T, তাপমাত্রায় একটি কঠিন বস্তুর দৈর্ঘ্য হচ্ছে L, এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে T₂ করায় বস্তুটির দৈর্ঘ্য হয়েছে L₂
তাহলে দৈর্ঘ্যের মোট পরিবর্তন হয়েছে:
দৈর্ঘ্যের কত অংশ পরিবর্তন হয়েছে:
প্রতি ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য দৈর্ঘ্যের কত অংশ পরিবর্তন হয়েছে:
অর্থাৎ, দৈর্ঘ্য প্রসারণ সহগ ৫ হচ্ছে,
অর্থাৎ কঠিন বস্তুর দৈর্ঘ্য প্রসারণ সহগ a জানা থাকলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে একটি বস্তুর দৈর্ঘ্য কত হবে আমরা এই সমীকরণ থেকে বের করতে পারব। T₁ তাপমাত্রায় একটি কঠিন বস্তুর দৈর্ঘ্য যদি হয় L₁ তাহলে তার তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে T₂ করা হলে বস্তুটির দৈর্ঘ্য হবে L₂
L= L + L (T2- T1)
উদাহরণ: 290 K তাপমাত্রায় থাকা একটি 10 m দৈর্ঘ্যের ধাতব তারকে রোদে ফেলে রাখায় এর তাপমাত্রা 325 K হলো। এখন তারের দৈর্ঘ্য কত হবে? (তারের উপাদানের দৈর্ঘ্য প্রসারণ সহগ 23 × 10-6 K-¹)
সমাধান : পরিবর্তিত দৈর্ঘ্য L2 = L2 + a L1 (T2 - T1) = 10 + 23 × 10-6 × 10 × (325 - 290) 1 = 10.008 m
কোনো বস্তুর ক্ষেত্রফল বরাবর প্রসারণ পরিমাপ করার জন্য ক্ষেত্রফল প্রসারণ সহগ ব্যবহার করা হয়। এটিকে গ্রিক অক্ষর B (উচ্চারণ বেটা) দ্বারা প্রকাশ করা হয়। T1 তাপমাত্রা ও A1 ক্ষেত্রফলের একটি
বস্তুর তাপমাত্রা পরিবর্তিত হয়ে T2 হওয়ায় যদি ক্ষেত্রফল পরিবর্তিত হয়ে A2 হয় তবে
একইভাবে, কোনো বস্তুর আয়তনের প্রসারণ পরিমাপ করার জন্য আয়তন প্রসারণ সহগ ব্যবহার করা হয়। আয়তন প্রসারণ সহগকে গ্রিক অক্ষর । (উচ্চারণ গামা) দিয়ে প্রকাশ করা হয়। T₁ তাপমাত্রা ও V₁ আয়তনের একটি বস্তুর তাপমাত্রা পরিবর্তিত হয়ে T2 হওয়ায় যদি আয়তন পরিবর্তিত হয়ে V2 হয় 2 তবে
তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে দৈর্ঘ্য প্রসারণ সহগ a জানা থাকলে ক্ষেত্রফল প্রসারণ সহগ 3 কিংবা আয়তন প্রসারণ সহগ y আলাদাভাবে পরিমাপ করার কোনো প্রয়োজন নেই, কারণ :
β = 2α
γ = 3α
ক্ষেত্রফল প্রসারণ সহগ বের করার জন্য কঠিন পদার্থের ক্ষেত্রফল বর্গাকৃতি ধরে নিয়ে আমরা A1 এবং A2 -এর জন্য লিখতে পারি :
যেহেতু দৈর্ঘ্য প্রসারণ সহগ a -এর মান খুবই ছোটো, কাজেই a² -এর মান আরও অনেক বেশি ছোটো, তাই a² কে শূন্য ধরে দেখাও B = 2x।
একইভাবে আয়তন প্রসারণ সহগ বের করতে হলে তোমাদের কঠিন পদার্থের আয়তনের জন্য একটি কিউব ধরে নিয়ে আমরা V1 এবং V2 -এর জন্য লিখতে পারি:
যেহেতু দৈর্ঘ্য প্রসারণ সহগ a -এর মান খুবই ছোটো, কাজেই a² এবং a³ -এর মান আরও অনেক বেশি ছোটো, তাই a² এবং a³ কে শূন্য ধরে দেখাও y = 3a।
উদাহরণ: 275 K তাপমাত্রায় থাকা একটি 5 cm বাহুর দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট বর্গাকার ধাতব পাতকে উত্তপ্ত করায় এর তাপমাত্রা 350 K হলো। এখন পাতটির ক্ষেত্রফল কতটুকু বাড়বে? (পাতের উপাদানের দৈর্ঘ্য প্রসারণ সহগ a = 22 × 10-6 Κ-1)
সমাধান : যেহেতু দৈর্ঘ্য প্রসারণ সহগ a = 22 × 10-6 Κ-1
কাজেই ক্ষেত্রফল প্রসারণ সহগ B = 2a = 2 × 22 × 10 = 44 × 10-6K-1
পরিবর্তিত ক্ষেত্রফল A₂ = A + BA1 (T₂ - T₁)এখানে, শুরুতে ক্ষেত্রফল A1 = 5 × 5 = 25 cm²
অর্থাৎ, ক্ষেত্রফলের পরিবর্তন A2 - A1 = BA1(T2-T1) 2 1 2 = 44 × 106 x 25 x (350-275) = 0.0033 cm²
উদাহরণ: সোনার ঘনত্ব 19.30 gm/cc, এর দৈর্ঘ্য প্রসারণ সহগ 14×10-6" C-¹-এর তাপমাত্রা 100°C বাড়ালে ঘনত্ব কত হবে?সমাধান : ঘনত্ব,
যেখানে V হচ্ছে আয়তন এবং m হচ্ছে ভর। তাপমাত্রা বাড়ালে ভর এক থাকলেও আয়তন বেড়ে যায়। কাজেই 100°C তাপমাত্রা বাড়ালে তার আয়তন V1'হবে :
V' = V(1+ 4.2x 10-3)
ρ' =0.9958× 19.30 gm/cc =19.22 gm/cc
একটি পদার্থের প্রসারণ সহগ জানা থাকলে পরিবর্তিত তাপমাত্রায় তার কতটুকু পরিবর্তন হবে সেটি হিসাব করা যায়। বিভিন্ন ব্যবহারিক ক্ষেত্রে প্রসারণ সহগ জানা থাকাটা খুবই প্রয়োজনীয়। তোমরা ইতোমধ্যে জেনেছ যেহেতু রেল লাইন তাপে প্রসারিত হয়, তাই আগেই হিসাব করে নিতে হয় এজন্য কতটুকু ফাঁকা জায়গা রাখতে হবে। তা না হলে রেল লাইন বেঁকে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ইঞ্জিন কিংবা এ ধরনের যন্ত্রপাতি তৈরি করার সময়ও প্রসারণ সহগ জানা প্রয়োজন, কেননা এসব যন্ত্রে অনেক বেশি তাপমাত্রা ওঠানামা করে। আবার রকেট কিংবা কৃত্রিম উপগ্রহ বায়ুমণ্ডলের ভেতর দিয়ে তীব্র গতিতে যাওয়ার সময় উত্তপ্ত হয়। এখানেও প্রসারণ সহগ জানা থাকা প্রয়োজন। দাঁতের ফুটো মেরামত করতে ডেন্টিস্টরা যে পদার্থ ব্যবহার করেন, সেই পদার্থটির প্রসারণ সহগ হতে হয় দাঁতের প্রসারণ সহগের ঠিক সমান। তা না হলে ঠান্ডা কিছু খাওয়ার সময় এটি ছোটো হয়ে খুলে আসবে, অথবা গরম কিছু খাওয়ার সময় বেশি প্রসারিত হয়ে দাঁতের ওপরে চাপ ফেলবে।
২.২.২ তরল পদার্থের প্রসারণ
তরল পদার্থের দৈর্ঘ্য বা ক্ষেত্রফল বলে কিছু নেই, শুধু আয়তন আছে। তাই তরল পদার্থের প্রসারণ বলতে তার আয়তন প্রসারণ বোঝায়। তবে, তরল পদার্থের প্রসারণ মাপার সময় একটু সতর্ক থাকতে হয় কারণ তরল পদার্থকে সব সময়ই কোনো পাত্রে রাখতে হয়। কাজেই প্রসারণ মাপার জন্য তরলটিকে উত্তপ্ত করার সময় পাত্রটিও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং পাত্রটিরও কিছু প্রসারণ হয়। তাই পাত্রে রাখা তরলে যে প্রসারণ দেখা যায় সেটা আসল প্রসারণ না, সেটা হচ্ছে আপাত প্রসারণ। পাত্রের প্রসারণটি বিবেচনায় রেখে তরলের প্রসারণ বের করা হলে সেটি হবে সত্যিকার প্রসারণ বা প্রকৃত প্রসারণ .
একটা সরু নলবিশিষ্ট কাচের পাত্রের A দাগ পর্যন্ত তরল দিয়ে ভরে চিত্র ২.৩ : তরল পদার্থের আপাত ও প্রকৃত প্রসারণ যদি পাত্রটিকে গরম করা হয় তাহলে আমরা দেখব প্রথমে তরলের উচ্চতা B তে নেমে এসেছে। এটি ঘটবে কারণ তাপ দেওয়ার পর তরলটির তাপমাত্রা বাড়ার আগেই পাত্রটির তাপমাত্রা বেড়ে যাবে এবং তার প্রসারণ হবে, অর্থাৎ পাত্রটির আয়তন একটুখানি বেড়ে যাবে। যদি আমরা তারপরও তাপ দিতে থাকি তাহলে এক সময় তরলটির উচ্চতা বাড়তে থাকবে। যেহেতু তরলের প্রসারণ বেশি তাই আমরা দেখব তরলটি A কে অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত C উচ্চতায় পৌঁছেছে। পাত্রের এই অংশের প্রস্থচ্ছেদকে CB উচ্চতা দিয়ে গুণ করে আমরা তরলটির প্রকৃত প্রসারণ পাব।
তরল পদার্থের প্রসারণের সবচেয়ে সহজ উদাহরণ হচ্ছে পারদ বা অ্যালকোহল থার্মোমিটার। নানা রকম থার্মোমিটার রয়েছে, তার মধ্যে জ্বর মাপার থার্মোমিটার সম্ভবত তোমাদের কাছে সবচেয়ে পরিচিত। এই
থার্মোমিটারের গোড়ায় একটা কাচের টিউবে পারদ থাকে। তাপ দেওয়া হলে পারদের আয়তন বেড়ে গিয়ে খুব সরু একটা নল বেয়ে উঠতে থাকে (চিত্র ২.৪)। দাগকাটা থার্মোমিটারে পারদ কতটুকু উঠেছে সেটি দেখে তাপমাত্রা পরিমাপ করা হয়। দেহ থেকে সরিয়ে নেওয়ার পর যেন পারদের অংশটুকু নেমে না যায় সেজন্য সরু নলের গোড়ায় খুব সরু বক্রতা রাখা হয়। এ কারণে একবার প্রসারিত হয়ে উপরে উঠে গেলে তাপমাত্রা কমে যাবার পরও নেমে আসতে পারে না, ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে নামাতে হয়।
উদাহরণ: 280 K তাপমাত্রায় থাকা 4L পানিকে উত্তপ্ত করে এর তাপমাত্রা 360 K করা হলো। এখন পানিটুকুর আয়তন 4.0672 L হলে, পানির আয়তন প্রসারণ সহগ কত?
সমাধান : আয়তন প্রসারণ সহগ
২.২.৩ বায়বীয় পদার্থের প্রসারণ
কঠিন পদার্থের আকার আর আয়তন দুটিই থাকায় প্রসারণ বুঝতে কোনো সমস্যা হয়নি। তরলের নির্দিষ্ট আকার না থাকলেও তার আয়তন আছে, তাই তার প্রসারণও আমরা দেখতে পাই কিংবা মাপতে পারি। গ্যাসের বেলায় বিষয়টা একটু অন্যরকম কারণ তার শুধু যে নির্দিষ্ট আকার নেই তা নয়, তার নির্দিষ্ট আয়তনও নেই। গ্যাসকে যে পাত্রে ঢোকানো হবে গ্যাসটি সঙ্গে সঙ্গে সেই পাত্রের আয়তন নিয়ে নেবে। কঠিন ও তরল পদার্থের প্রসারণ যথেষ্ট কম বলে সেটি আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে খুব বেশি দেখতে পাই না। সে তুলনায় গ্যাসের প্রসারণ যথেষ্ট বেশি বলে আমরা সহজ পরীক্ষা করেই সেটা দেখতে পারি। একটা বেলুনকে একটুখানি ফুলিয়ে একটা বোতলের মুখে লাগিয়ে যদি বোতলটা বরফ দেওয়া পানিতে চুবিয়ে রাখি তাহলে দেখব বেলুনটা সংকুচিত হয়ে নেতিয়ে পড়েছে, আবার বোতলটা যদি গরম পানিতে চুবিয়ে রাখি তাহলে দেখব বেলুনটা ফুলে উঠেছে (চিত্র ২.৫)।
তবে কঠিন কিংবা তরলের বেলায় তাদের উপর প্রযুক্ত চাপ বিষয়টি নিয়ে আমাদের মাথা ঘামাতে হয়নি, গ্যাসের বেলায় কিন্তু চাপ বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। তরল কিংবা কঠিন পদার্থকে চাপ দিয়ে খুব বেশি সংকুচিত করা যায় না। কিন্তু গ্যাসকে খুব সহজে চাপ দিয়ে অনেক বেশি সংকুচিত করা যায়। একই পরিমাণ গ্যাসকে ভিন্ন ভিন্ন আয়তনের পাত্রে ঢোকানো হলে তার চাপও ভিন্ন ভিন্ন হয়, অর্থাৎ তাপমাত্রার মতো চাপ বাড়িয়ে কমিয়েও গ্যাসের প্রসারণ সংকোচন করা যায়। কাজেই আমরা যদি তাপ দিয়ে গ্যাসের আয়তন কতটুকু বৃদ্ধি পেয়েছে মাপতে চাই, তাহলে লক্ষ রাখতে হবে যেন তার চাপের কোনো পরিবর্তন না হয় (চিত্র ২.৬)। তাই প্রথমেই আমাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ গ্যাসের চাপ (P), আয়তন (V) ও তাপমাত্রা (T) -এর মাঝে সম্পর্কটা জানা দরকার। মনে রাখতে হবে, এখানে I তাপমাত্রা কিন্তু কেলভিন স্কেলে। এটাকে বলে আদর্শ গ্যাসের সূত্র এবং গাণিতিকভাবে সূত্রটিকে এভাবে লেখা যায় :
PV = nRT
এখানে R হচ্ছে 'সর্বজনীন গ্যাস ধ্রুবক', এর মান 8.314 JK-mol-¹ আর n হলো মোল এককে গ্যাসের পরিমাণ। এই ধ্রুবকের মান সকল গ্যাসের জন্য সত্যি।
উদাহরণ: একটি 100 ml আয়তনের পাত্রে 108 Pa চাপে 128g অক্সিজেন গ্যাস রাখা হলে এর তাপমাত্রা কত হবে?
সমাধান : চাপ P = 108Pa, আয়তন V = 100 ml = 104 m³, অক্সিজেনের আণবিক ভর 32g, তাই 128 g অক্সিজেন মানে
n = 128/32 = 4 mole
অক্সিজেন যেহেতু, PV = nRT
কাজেই T= PV/nR = (108 x 10-4)/ (4 x 8.314) = 300K
সেলসিয়াস স্কেলে এই তাপমাত্রা হচ্ছে 300 273 27°C
4 mole হাইড্রোজেন বা 4 mole নাইট্রোজেন বা 4 mole যে কোনো গ্যাসের জন্যই ফলাফলটি কিন্তু একই হতো।
আমরা এবারে গ্যাসের জন্য প্রসারণ সহগ বের করতে পারি। আমরা জানি, একটা নির্দিষ্ট চাপে যদি T1তাপমাত্রায় নির্দিষ্ট পরিমাণ গ্যাসের আয়াতন হয় V1 এবং T2 তাপমাত্রায় সে একই গ্যাসের আয়তন হয় V2তাহলে তার প্রসারণ সহগ হবে,
কিন্তু আমরা জানি
PV1 = nRT1
PV2=nRT2
কাজেই
যেহেতু = nRT, তাই বাম দিকে , দিয়ে এবং ডান দিকে , দিয়ে ভাগ করে
কিংবা
কাজেই
তোমরা দেখতে পাচ্ছ গ্যাসের প্রসারণ সহগ ধ্রুব সংখ্যা নয়, এটি তাপমাত্রার বিপরীত। তাপমাত্রা যত কম হবে গ্যাসের প্রসারণ হবে তত বেশি।
২.৪ ক্যালরিমিতি
তাপ, তাপমাত্রা এবং এর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে এ রকম অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হলেও, একটা বস্তুর মোট তাপ কেমন করে মাপতে হয়, কিংবা একটা বস্তুর তাপমাত্রা নির্দিষ্ট পরিমাণ বাড়াতে হলে সেখানে কতটুকু তাপ দিতে হবে সেটি এখনো আলোচনা করা হয়নি। বিজ্ঞানের যে শাখায় তাপ পরিমাপের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হয় সেটাকে ক্যালরিমিতি বলা হয়।
বস্তুর ভেতরে কতটুকু তাপ রয়েছে, সেটি তিনটি বিষয়ের উপর নির্ভর কর। একটি হচ্ছে বস্তুটির ভর,
তোমরা যারা কেতলিতে পানি গরম করেছ তারা সবাই এটি জানো। তোমরা দেখেছ এক কাপ পানি ফুটাতে কেতলিটিতে যত তাপ দিতে হয়, পুরো কেতলির পানি ফুটাতে তার চেয়ে অনেক বেশি তাপ দিতে হয়। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে 'তাপমাত্রা', আমরা সবাই এটিও অনুমান করতে পারি। কারণ আমরা দেখেছি কেতলির পানিকে অল্প তাপ দিলে সেটি একটু উষ্ণ হয়, কিন্তু সময় নিয়ে অনেক তাপ দিলে তাপমাত্রা অনেক বেড়ে যায়। কাজেই দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে আমরা বলতে পারি বেশি ভর এবং তাপমাত্রা বেশি হলে তার ভেতরেও তাপ বেশি থাকে।
তোমরা যারা কেতলিতে পানি গরম করেছ তারা সবাই এটি জানো। তোমরা দেখেছ এক কাপ পানি ফুটাতে কেতলিটিতে যত তাপ দিতে হয়, পুরো কেতলির পানি ফুটাতে তার চেয়ে অনেক বেশি তাপ দিতে হয়। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে 'তাপমাত্রা', আমরা সবাই এটিও অনুমান করতে পারি। কারণ আমরা দেখেছি কেতলির পানিকে অল্প তাপ দিলে সেটি একটু উষ্ণ হয়, কিন্তু সময় নিয়ে অনেক তাপ দিলে তাপমাত্রা অনেক বেড়ে যায়। কাজেই দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে আমরা বলতে পারি বেশি ভর এবং তাপমাত্রা বেশি হলে তার ভেতরেও তাপ বেশি থাকে।
1 kg পদার্থের তাপমাত্রা 1°C বাড়াতে যে পরিমাণ তাপের প্রয়োজন সেটি হচ্ছে ঐ পদার্থের আপেক্ষিক তাপ
|
অর্থাৎ যদি m ভরের কোনো পদার্থকে T₁ থেকে T₂ তাপমাত্রায় নিতে Q তাপের প্রয়োজন হয়, এবং পদার্থটির আপেক্ষিক তাপ s হলে :
Q = m (T₂ - T₁) s
আপেক্ষিক তাপের একক সেলসিয়াস স্কেলে Jkg¹°C¹ এবং কেলভিন স্কেলে Jkg-1K-1
উদাহরণ : কাচের আপেক্ষিক তাপ 840 J kg-1K-1হলে 3 kg কাচের তাপমাত্রা 30 K বৃদ্ধি করতে কী পরিমাণ তাপ প্রয়োজন?
সমাধান : প্রয়োজনীয় তাপ Q = ms (T₂- T₁) = 3 x 840 x 30 = 71280 J
উদাহরণ : 300 K তাপমাত্রায় থাকা 2 Kg পানিকে চুলার উপরে রাখায় এর তাপমাত্রা 310 K হলো। চুলা থেকে 84000 J তাপ পাওয়া গেলে পানির আপেক্ষিক তাপ কত?
সমাধান : তাপ Q = m s (T2-T₁)
অর্থাৎ, আপেক্ষিক তাপ s = Q / {m (T₂- T₁)} = 84000 / {2 (310 - 300)} = 4200 J kg-1K-1
উদাহরণ: 295 K তাপমাত্রায় থাকা 5 kg পানিকে 63000] তাপ দেয়া হলে পানিটুকুর তাপমাত্রা কত হবে?
সমাধান : তাপ Q = m s (T₂ - T₁)
অর্থাৎ, পরিবর্তিত তাপমাত্রা T₂ = T₁ + Q/ms = 295 + 63000/(5 x 4200) = 298 K
বস্তুর তাপ ধারণক্ষমতা বলতে বোঝানো হয় সেই বস্তুটির তাপমাত্রা 1K বাড়াতে কত তাপের প্রয়োজন। বস্তুটির ভর এবং আপেক্ষিক তাপ জানা থাকলে খুব সহজেই যে কোনো বস্তুর তাপ ধারণক্ষমতা C বের করা যায়, কারণ বস্তুর ভর যদি m হয়, আপেক্ষিক তাপ হয় তাহলে বস্তুটির ধারণ ক্ষমতা হচ্ছে:
C = ms
উদাহরণ: 10kg লোহার তুলনায় 10kg পানির তাপ ধারণ ক্ষমতা কত বেশি? (লোহার আপেক্ষিক তাপ 450 Jkg 'K¹, পানির আপেক্ষিক তাপ 4200 Jkg-1K-1)
সমাধান: লোহার তাপ ধারণ ক্ষমতা: C = ms = 10 × 450 = 4500 Jkg-1K-1
পানির তাপ ধারণ ক্ষমতা: C = ms = 10 x 4200 42000 Jkg-1K-1
কাজেই আমরা দেখতে পাচ্ছি পানির তাপ ধারণ ক্ষমতা লোহার তাপ ধারণ ক্ষমতা থেকে প্রায় দশগুণ বেশি।
ক্যালরিমিতির মূলনীতি
শীতকালে গোসলের জন্য অনেক সময় আমরা বালতির ঠান্ডা পানিতে কিছুটা ফুটন্ত গরম পানি ঢেলে দিই। ফুটন্ত গরম পানি বালতির শীতল পানিকে তাপ দিতে দিতে ঠান্ডা হতে থাকে এবং একই সঙ্গে বালতির শীতল পানিও গরম ফুটন্ত পানি থেকে তাপ নিতে নিতে উত্তপ্ত হতে থাকে। কিছুক্ষণের মাঝে দেখা যায় উত্তপ্ত পানির তাপমাত্রা কমে এবং শীতল পানির তাপমাত্রা বেড়ে পুরো পানিটুকুই একটা ব্যবহারযোগ্য উষ্ণতায় চলে এসেছে। খুব সহজেই কোনো পদার্থের কোনো তাপমাত্রার বস্তুর সঙ্গে অন্য কোনো তাপমাত্রার কোনো বস্তু মেশালে কে কতটুকু তাপ দেবে বা নেবে এবং শেষ পর্যন্ত কত তাপমাত্রায় পৌঁছাবে এই বিষয়গুলো বের করে ফেলা যায়। এই ঘটনা দুটি নিয়ম মেনে চলে, যা উপরের বালতির উদাহরণ থেকে বোঝা যায়। এই নিয়ম দুটিই হচ্ছে ক্যালরিমিতির মূলনীতি :
(১) বেশি তাপমাত্রার বস্তু কম তাপমাত্রার বস্তুর কাছে তাপ দিতে থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত না দুটো বস্তুর তাপমাত্রা সমান হয়। (২) উত্তপ্ত বস্তু যতটুকু তাপ ছেড়ে দেবে, শীতল বস্তু ঠিক ততটুকু তাপই গ্রহণ করবে। (এখানে ধরে নেয়া হচ্ছে যে, এই প্রক্রিয়া চলাকালে অন্য কোনোভাবে তাপ নষ্ট হচ্ছে না।)
|
উদাহরণ: 300 K তাপমাত্রার 2 kg পানির মধ্যে 400 K তাপমাত্রার 5 kg উত্তপ্ত লোহার টুকরা ছেড়ে দেয়া হলো। কিছুক্ষণ পরে তাপমাত্রা কত হবে? (লোহার আপেক্ষিক তাপ 450 J kg-1K-1)
সমাধান : যেহেতু, এখানে পানির তাপমাত্রা কম এবং লোহার তাপমাত্রা বেশি ছিল, তাই দুটি একই তাপমাত্রায় না আসা পর্যন্ত তাপের আদানপ্রদান হতে থাকবে। মনে করি এই তাপমাত্রাটি T₁ তাহলে পানির তাপমাত্রা বেড়ে T হবে এবং লোহার তাপমাত্রা কমে T₂ হবে।
তাহলে, পানিকে উত্তপ্ত করতে প্রয়োজনীয় তাপ Q₁ = m, s₁ (T - T₁)
আবার, লোহাকে ঠান্ডা হতে ছেড়ে দেয়া তাপ Q = m, s₂ (T₂ - T)
ক্যালরিমিতির মূলনীতি অনুযায়ী, Q = Q হবে।
অর্থাৎ, m, s₁ (T - T₁) = m, s₂ (T₂- T)
তাহলে, 2 × 4200 × (T300) = 5 x 450 x (400 - T)
বা, T = 321.13 Κ
২.৫ পদার্থের অবস্থার পরিবর্তনে তাপের প্রভাব
তোমরা ইতোমধ্যে জেনে গেছ, সব পদার্থ অণু দিয়ে তৈরি এবং কঠিন পদার্থে অণুগুলো নির্দিষ্ট অবস্থানে থেকে একে অন্যকে আটকে রাখে। তাপ দেওয়া হলে এগুলোর কম্পন বেড়ে যায় এবং আণবিক বন্ধন শিথিল হয়ে একে অন্যের ওপর দিয়ে নড়তে শুরু করে এবং এটাকে আমরা বলি তরল। তাপমাত্রা যদি আরও বেড়ে যায়, তখন অণুগুলো মুক্ত হয়ে ছোটাছুটি শুরু করে, তাকে আমরা বলি গ্যাস। তবে বিশেষ বিশেষ কঠিন পদার্থকে তাপ দিলে সেটি সরাসরি গ্যাসে রূপান্তরিত হতে পারে। এই পরিবর্তনগুলো ভৌত পরিবর্তন, কাজেই তাপ সরিয়ে নিয়ে এই তিনটি অবস্থার বিপরীত পরিবর্তনগুলোও ঘটানো সম্ভব। ২.৭ চিত্রে তাপ প্রয়োগ করে পদার্থের এই তিন অবস্থার পরিবর্তনগুলো দেখানো হয়েছে।
চিত্র ২.৭: তাপ বিনিময় করে পদার্থকে কঠিন তরল এবং গ্যাস এই তিনটি অবস্থার মাঝে রূপান্তর করা যায়।
কঠিন থেকে তরল এবং তরন থেকে কঠিন
একটা কঠিন পদার্থকে যখন তাপ দেওয়া হয়, তখন তার তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। তাপমাত্রা একটা নির্দিষ্ট মানে পৌঁছালে কঠিন পদার্থটি গলতে শুরু করে। এই প্রক্রিয়াটির নাম গলন (melting), আমরা এক টুকরা বরফকে বাইরে রেখে দিলে সেটি চারপাশের বাতাস থেকে তাপ গ্রহণ করে গলতে থাকে। যে তাপমাত্রায় গলন শুরু হয়, সেটাকে বলে গলনাঙ্ক। বরফের গলনাংক ০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপ দিয়ে কঠিন থেকে তরল যে রকম রূপান্তর করা হয় তার উল্টো প্রক্রিয়াটিও ঘটে। তাপ সরিয়ে নিলে একটা তরল কঠিন হতে পারে। তরল অবস্থা থেকে কঠিন অবস্থায় রূপান্তরিত হওয়াকে কঠিনীভবন (Solidification) বলে। জ্বলন্ত মোমবাতি থেকে যে গলিত মোম গড়িয়ে পড়ে, সেটি শীতল হয়ে আবার কঠিন হয়ে যায়, এটি কঠিনীভবনের একটি উদাহরণ।
তরন থেকে গ্যাস এবং গ্যাস থেকে তরন:
তরল পদার্থকে তাপ দিলে তার তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করে এবং তাপমাত্রা বাড়তে বাড়তে এক সময় তরল পদার্থটি গ্যাসে পরিবর্তিত হতে শুরু করে। এই প্রক্রিয়াটির নাম বাষ্পীভবন (vaporization) এবং যে তাপমাত্রায় বাষ্পীভবন ঘটে, সেটাকে বলে স্ফুটনাঙ্ক। পানির স্ফুটনাংক 100 ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপ দিয়ে তরল থেকে গ্যাসে যে রকম রূপান্তর করা হয় তার উল্টো প্রক্রিয়াটিও ঘটে। তাপ সরিয়ে নিলে একটা গ্যাস তরল হতে পারে। একটা গ্লাসে কয়েক টুকরা বরফ রেখে দিলে আমরা দেখতে পাই গ্লাসের গায়ে জলীয় বাষ্প শীতল হয়ে বিন্দু বিন্দু পানি হিসেবে জমা হয়েছে। বায়বীয় অবস্থা থেকে এভাবে তরল অবস্থায় রূপান্তরিত হওয়াকে ঘনীভবন (condensation) বলে।
কঠিন থেকে গ্যাস এবং গ্যাস থেকে কঠিন :
যে প্রক্রিয়ায় কোনো কঠিন পদার্থকে তাপ প্রদান করা হলে, সেগুলো তরলে পরিণত না হয়ে সরাসরি বাষ্পে পরিণত হয়, সেই প্রক্রিয়াকে ঊর্ধ্বপাতন (Sublimation) বলে। আমরা কাপড়ে পোকা না ধরার জন্য সেখানে ন্যাপথালিন ব্যবহার করতে দেখেছি। কঠিন ন্যাপথালিনকে তাপ দিলে সেটি তরল না হয়ে সরাসরি গ্যাসীয় পদার্থে পরিণত হয়।
ঊর্ধ্বপাতনের বিপরীত প্রক্রিয়াটির নাম অবক্ষেপ (Deposition) যেখানে একটি পদার্থের বাষ্পকে শীতল করা হলে সেটি তরল না হয়ে সরাসরি কঠিন পদার্থে রূপান্তরিত হয়। আয়োডিন মেশানো খাদ্য লবণের মধ্যে আয়োডিন একটি ঊর্ধ্বপাতিত পদার্থ। কাজেই এই আয়োডিন মেশানো খাদ্য লবণের মিশ্রণকে তাপ দিলে আয়োডিন সহজেই বাষ্পীভূত হয়ে যায়, তখন ঐ বাষ্পকে ঠান্ডা করে আয়োডিনের বাষ্পকে সরাসরি কঠিন আয়োডিনে পরিণত করা যায়।
তাপ প্রদান অথবা অপসারণের মাধ্যমে কঠিন, তরল ও গ্যাসীয় পদার্থের প্রসারণ বা সংকোচনের পরিমাণ আলাদা আলাদা হয়ে থাকে।
পদার্থের অবস্থার পরিবর্তন
বরফ কিংবা মোমকে যদি তাপ দিয়ে গলানো হয় তাহলে সেগুলো গলার সময় তাপমাত্রা একই থাকে। অন্যান্য কঠিন পদার্থকে গলিয়ে তরল করতে গেলেও একই ঘটনা ঘটে, কেবল ভিন্ন পদার্থের জন্য তাপমাত্রাটি ভিন্ন হয়। তোমরা জানো যে কঠিন থেকে তরলে রূপান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়াটির নাম 'গলন' আর গলন ঘটার এই নির্দিষ্ট তাপমাত্রাটি হচ্ছে 'গলনাঙ্ক'। এই সময় যে তাপ দেওয়া হয় সেটি কঠিন পদার্থের অণুগুলোর আণবিক বন্ধন শিথিল করার কাজে ব্যবহৃত হয় বলে সেগুলোর গতিশক্তি বাড়ানোর কাজে ব্যবহৃত হতে পারে না, তাই তাপমাত্রা বাড়ে না (চিত্র ২.৮)। একইভাবে পানি ফোটাতে গেলেও একই ঘটনা ঘটে। অর্থাৎ, পুরো পানিটুকু ফুটে বাষ্পীভূত হওয়ার আগে পর্যন্ত তাপমাত্রা একই থাকে। বিভিন্ন তরল পদার্থকে ফুটিয়ে বাষ্পীভূত করতে গেলেও একই ঘটনা ঘটে, শুধু তাপমাত্রাটি ভিন্ন হয়। তাপ প্রয়োগের কারণে তরল পদার্থ বাষ্পে রূপান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়াটির নাম 'বাষ্পীভবন' আর বাষ্পীভবন ঘটার এই নির্দিষ্ট তাপমাত্রাকেই পদার্থটির 'স্ফুটনাঙ্ক' বলে।
চিত্র ২.৮: সময়ের সঙ্গে পানির ভাপমাত্রা বৃদ্ধির যেখচিত্র। গলন এবং বাষ্পীভবনের সময় তাপমাত্রার পরিবর্তন হয় না।
গলন কিংবা বাষ্পীভব ঘটানোর জন্য বাইরে থেকে তাপ দিতে হয়। এই দুটি ঘটনা ঘটার সময় যেহেতু পদার্থের তাপমাত্রায় কোনো পরিবর্তন হয় না, তাই এসময় পুরো তাপটুকুই পদার্থের অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে কাজে লাগে। পদার্থের পরিমাণ যত বেশি হয়, তত বেশি তাপের প্রয়োজন হয়। বিভিন্ন পদার্থের জন্য এই পরিমাণটি কম-বেশি হয়ে থাকে। পদার্থের অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে ব্যবহৃত এই তাপকে বলা হয় সুপ্ততাপ। গলনের ক্ষেত্রে এটি 'গলনের সুপ্ততাপ' এবং বাষ্পীভবনের ক্ষেত্রে এটি 'বাষ্পীভবনের সুপ্ততাপ' নামে পরিচিত।
বস্তুর সুপ্ততাপ জানা থাকলে আমরা খুব সহজেই কোনো পদার্থের অবস্থার পরিবর্তনে প্রয়োজনীয় তাপ Q বের করতে পারব। কারণ বস্তুর ভর যদি m হয়, আর সংশ্লিষ্ট অবস্থা পরিবর্তনের সুপ্ততাপ। হয়, তাহলে Q = ml
উদাহরণ: বরফ গলনের সুপ্ততাপ 33600 J Kg' হলে গলনাংক তাপমাত্রায় থাকা 3 Kg বরফ গলিয়ে 300 K তাপমাত্রার পানি পেতে কী পরিমাণ তাপ প্রয়োজন?
সমাধান: শুধু বরফ গলাতে প্রয়োজনীয় তাপ
Q,m L=333600 = 100800 J
আবার, 273 K তাপমাত্রার পানিকে 300 k তাপমাত্রায় নিতে প্রয়োজনীয় তাপ
Qms (TT) = 3 x 4200 × (300273) = 340200 J
অর্থাৎ, মোট তাপের প্রয়োজন হবে Q1 + Q 2= 441000 J
তাপ বাড়ানোর সময় যেহেতু একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় পৌঁছানোর পর গলন এবং বাষ্পীভবন ঘটে থাকে, তাই তোমাদের ধারণা হতে পারে সেই তাপমাত্রায় না পৌঁছানো পর্যন্ত প্রক্রিয়াগুলো ঘটে না। কিন্তু সেটি সত্যি নয়, পানির স্ফুটনাংক 100 ডিগ্রি সেলসিয়াস কিন্তু আমরা দেখতে পাই একটি মেঝেতে পানি পড়ে থাকলে ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় দেখতে দেখতে সেটি শুকিয়ে যায়। হাতে একটু অ্যালকোহল লাগিয়ে ফুঁ দিলে আমরা সেই জায়গাটুকু শীতল অনুভব করি। অ্যালকোহল বাষ্পীভূত হওয়ার জন্য তার সুপ্ত তাপটুকু আমাদের ত্বক থেকে নিয়ে নেয় বলে এরকমটি ঘটে। আমরা যদি পদার্থের আণবিক মডেলে ফিরে যাই তাহলে বিষয়টা বোঝা মোটে কঠিন নয়। একটি অণু যদি কোনোভাবে যথেষ্ট শক্তি পেয়ে যায় এবং তার কারণে যদি তার গতিশক্তি যথেষ্ট বেড়ে যায় তাহলে সেটি কঠিন কিংবা তরল পদার্থের পৃষ্ঠদেশ থেকে বের হয়ে আসতে পারে। কঠিন কিংবা তরল পদার্থের পৃষ্ঠদেশে যেহেতু অসংখ্য অণু ক্রমাগত আঘাত করছে তাই তাদের আঘাতে কোনো কোনো অণু মুক্ত হয়ে যাবার মতো শক্তি পেয়ে যেতে পারে। আমরা সবাই এই প্রক্রিয়াটি দেখেছি।
পানির বাষ্পীভবনের সময় পানি যেরকম তার বাষ্পীভবনের সুপ্ত তাপটুকু নিয়ে নেয়, এর উল্টোটুকুও সত্যি, বাষ্প যখন পানির কণায় পরিণত হয় তখন বাষ্পীভবনের সুপ্ত তাপটুকু তাপ হিসেবে ফিরিয়ে দেয়। ঘূর্ণিঝড়ের সময় পানি সমুদ্রের পৃষ্ঠদেশ থেকে বাষ্পীভবনের সুপ্ততাপ নিয়ে জলীয় বাষ্পে পরিণত হয়ে উপরে উঠে যায়, সেখানে শীতল হওয়ার পর জলকণায় পরিণত হওয়ার সময় বাষ্পীভবনের সুপ্ত তাপটুকু শক্তি হিসেবে বের হয়ে আসে। এই শক্তি ঘূর্ণিঝড়ের প্রচণ্ড শক্তি হিসেবে কাজ করে।
২.৬ তাপগতিবিদ্যা
তাপ শক্তির অন্যান্য শক্তিতে রূপান্তর সংক্রান্ত বিজ্ঞানকে তাপগতিবিদ্যা বলা হয়। অতীতে তাপের উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন বিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে চিন্তা করেছেন। এক সময় মনে করা হতো তাপের হ্রাস- বৃদ্ধির কারণ হচ্ছে ক্যালরিক নামে একটি তরল পদার্থের প্রবাহ, যেটি সৃষ্টি কিংবা ধ্বংস করা যায় না।
তবে বিজ্ঞানী কাউন্ট রামফোর্ড কামানের নল ফুটো করার সময়ে ড্রিল দিয়ে ঘর্ষণ করে ক্রমাগত তাপ সৃষ্টি করে দেখান তাপ ক্যালরিক নামে কোনো তরল নয়, এটি এক ধরনের যান্ত্রিক শক্তি। বর্তমানে ক্যালরি তত্ত্ব না থাকলেও ক্যালরি এককটি এখনো রয়ে গেছে, বিশেষ করে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের প্যাকেটে এই এককের একটি রূপ নিয়মিত ব্যবহার করা হয়।
বিজ্ঞানী জুল যান্ত্রিক কাজের সঙ্গে তাপের একটি সমানুপাতিক সম্পর্ক পর্যবেক্ষণ করেন এবং দুটির ভেতর গাণিতিক সম্পর্কটি বের করেন। বিজ্ঞানীরা তখন তাপকেও শক্তির একটি রূপ হিসেবে গ্রহণ করেন।
বিজ্ঞানী জুনের পরীক্ষণএই অধ্যায়েই আমরা ক্যালরিমিতির মূলনীতিটি জেনেছি এবং তাপমাত্রা এবং আপেক্ষিক তাপের সাহায্যে তাপ পরিমাপ করতে শিখেছি। আগের অধ্যায়ে আমরা বিভবশক্তি নির্ণয়ের গাণিতিক রাশিমালা শিখেছিলাম। এই দুটি বিষয়কে একত্র করেই বিজ্ঞানী জেমস জুল তাঁর বিখ্যাত পরীক্ষণটি করেছিলেন (চিত্র ২.৯)। এখানে পুলির মাধ্যমে রোলারে পেঁচানো একটি দড়িতে আটকানো ভরটি অভিকর্ষের প্রভাবে নামতে থাকে। এসময় প্যাঁচ খোলার সঙ্গে সঙ্গে রোলারটি ঘুরতে থাকে এবং এর সঙ্গে আটকানো একটি চাকাকে ঘোরাতে থাকে। পানিতে ডোবানো চাকাটি পানিকে আলোড়িত এবং উত্তপ্ত করে। একটি থার্মোমিটারের মাধ্যমে পানির তাপমাত্রার পরিবর্তন পরিমাপ করে উৎপন্ন তাপের পরিমাণ হিসাব করা যায়। অন্যদিকে ভরটির কতটুকু নিচে নেমেছে সেখান থেকে কতটুকু বিভব শক্তি কাজে রূপান্তরিত হয়েছে সেটি বের করা যায়। এভাবে জুল যান্ত্রিক কাজের সঙ্গে তাপের সম্পর্কটি বের করেছিলেন।
তোমরা জানো পানির আপেক্ষিক তাপ 4200 Jkg'K' এখান থেকেই বুঝতে পারছ জুল তার পরীক্ষায় 1kg পানির উপর 4200J কাজ করে তার তাপমাত্রা 1K বাড়াতে পেরেছিলেন।
উদাহরণ: জুলের পরীক্ষণে আবদ্ধ পাত্রের ভেতরে 310 K তাপমাত্রার 100g পানি নেয়া হলো। এরপরে রোলারের সঙ্গে দড়িতে বাঁধা 50 kg ভর 3 m নামানোর ফলে সৃষ্ট আলোড়নের পরে পানির তাপমাত্রা কত হবে? (মনে করো অন্য কোনোভাবে শক্তির অপচয় হয়নি)।
সমাধান: এখানে, ভরটির বিভব শক্তি হ্রাস পায় E = mgh = 50 × 3 × 9.8 = 1470 J
আলোড়নের পরে পানির তাপমাত্রা T₂ হলে Q = m s (T₂ - T₁)
যেহেতু, অন্য কোনোভাবে শক্তির অপচয় হচ্ছে না, তাই ভরটির হ্রাস পাওয়া বিভবশক্তির পুরোটাই গতিশক্তিতে রূপান্তরিত হবে, এবং সেই গতিশক্তিই পানিকে আলোড়িত করে উত্তপ্ত করবে।
অর্থাৎ, E = Q = m s (T2- T₁)
তাহলে, 1470 = 0.1 × 4200 × (T₂ - 310)
বা, T = 313.5 K
পরবর্তী কালে বিজ্ঞানী জুল, ক্লসিয়াস, সাদি কার্নট এবং কেলভিন তাপগতিবিদ্যাকে এগিয়ে নেন, এদের মাঝে সাদি কার্নটকে তাপগতিবিদ্যার জনক বলা হয়। এই বিজ্ঞানীরা প্রবাহিত পদার্থ হিসেবে তাপের ক্যালরিক তত্ত্বকে বাতিল করে দিয়ে বলেন যে তাপ হলো শক্তি, অর্থাৎ কাজ করার ক্ষমতা।
তাপগতিবিদ্যার তিনটি সূত্র রয়েছে, এই তিনটি সূত্র তাপশক্তি কীভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে ধারণা দেয়। এই সূত্র তিনটি নানাভাবে লেখা হয়, তবে সূত্রের মূল ভাবটি খুব সহজে প্রকাশ করে এভাবে লেখা সম্ভব :
তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্র: শক্তিকে তাপ, অভ্যন্তরীণ শক্তি কিংবা কাজ হিসেবে রূপান্তর করা সম্ভব কিন্তু তাকে সৃষ্টি কিংবা ধ্বংস করা যাবে না। তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র: যখন শক্তিকে একরূপ থেকে অন্যরূপে পরিবর্তন করা হয় তখন সব সময়ই খানিকটা শক্তি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে যায়। তাপগতিবিদ্যার তৃতীয় সূত্র: পরম শূন্য তাপমাত্রায় পৌঁছানো সম্ভব নয়।
|
তাপগতি বিদ্যার তিনটি সূত্র প্রকাশ করার পর বিজ্ঞানীরা আরও একটি বিষয়কে সূত্র হিসেবে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। সূত্রটির গুরুত্বের কারণে সেটিকে সবার আগে স্থান দেওয়ার জন্য এটিকে তাপগতিবিদ্যার শূন্যতম সূত্র হিসেবে প্রকাশ করা হয়:
তাপগতিবিদ্যার শূন্যতম সূত্র: যদি দুটি সিস্টেম তৃতীয় একটি সিস্টেমের সঙ্গে একই তাপমাত্রায় থাকে তাহলে প্রথম দুটি সিস্টেম একই তাপমাত্রায় থাকবে।
|
এই শূন্যতম সূত্রের ভিত্তিতেই আমরা থার্মোমিটার তৈরি করে থাকি।
আরও দেখুন...