বাগদা চিংড়ির কৃত্রিম প্রজনন থেকে শুরু করে চিংড়ি চাষ পর্যন্ত লোনা পানির সুব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ অতি জরুরি। তাই প্রতিটি হ্যাচারির পানি ব্যবস্থাপনা এবং খরচ কমানোর জন্য একটি নির্ভরযোগ্য এবং দক্ষ সেচযন্ত্র বাধ্যতামূলকভাবে থাকা উচিত। হ্যাচারিতে লোনা এবং মিঠাপানি উত্তোলন করে নির্দিষ্ট ট্যাংকে মজুদ করা হয়। পরবর্তীকালে মজুদকৃত ট্যাংক থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানির ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়।
হ্যাচারিতে যন্ত্রপাতি পরিচালনা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় উৎপাদন উপকরণ সচল রাখার জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ অপরিহার্য। এয়ার ব্লোয়ার, পাম্প, রেফ্রিজারেটর ইত্যাদি চালু রাখার জন্য নির্ভরযোগ্য বিদ্যুতের উৎস থাকতে হবে। এছাড়াও যেসব এলাকায় ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটে সেসব এলাকার হ্যাচারিতে নিজস্ব জেনারেটর থাকা প্রয়োজন।
পানিতে পর্যাপ্ত দ্রবীভূত অক্সিজেনের ঘনত্ব বজায় রাখার জন্য সর্বদা বায়ু চলাচল অপরিহার্য। প্রজননক্ষম চিংড়িকে বাঁচিয়ে রাখা, জীবন্ত খাবার (live food) উৎপাদন, লার্ভার লালন-পালন প্রভৃতি কাজের জন্য কৃত্রিম বায়ু প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষুদ্র ব্যাসের পিভিসি পাইপের মাধ্যমে প্রতিটি ট্যাংকে কৃত্রিমভাবে বায়ু সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। পিভিসি পাইপের মুখে সরু প্লান্টিকের পাইপ ও এয়ার স্টোন ব্যবহার করে অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়। এতে পানির তাপমাত্রা ও অ্যামোনিয়ার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে থাকে।
বাগদা হ্যাচারিতে লোনাপানি সংগ্রহের পর নির্দিষ্ট ট্যাংকে মজুদ রাখা হয়। ট্যাংকের আকার ও আয়তন নির্ভর করে পোনা উৎপাদনের পরিমাণের ওপর। উত্তোলিত পানি সরাসরি ব্যবহার না করে প্রথমে জীবাণুমুক্ত করা হয় এবং পরবর্তীতে প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করা হয়।
মজুদকৃত লোনা পানিতে প্রচুর পরিমাণে বালি এবং ভাসমান ও ঝুলন্ত (suspended) পদার্থ থাকে। এজন্য পরিস্রাবক (filter) স্থাপন করা জরুরি। পরিস্রাবক হলো এমন এক ধরনের সূক্ষ যন্ত্র যা রাসায়নিক প্রক্রিয়া বা জৈবিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পানির মধ্যে বিদ্যমান দূষিত পদার্থ ও জীবাণু অপসারণ করে। পানি পরিস্ফুত করতে বিভিন্ন ধরনের পরিস্রাবক ব্যবহার করা যায়। যেমন-
ক) বালি, কংকর দিয়ে তৈরি পরিস্রাবক
খ) চাপ প্রয়োগকৃত বালি দিয়ে নির্মিত পরিস্রাবক
গ) কার্টিজ পরিস্রাবক
ঘ) ইউভি পরিস্রাবক
ঙ) কার্বন পরিস্রাবক ইত্যাদি।
চিংড়ির হ্যাচারিতে একটি বালি ছাকুনি স্থাপন করা প্রয়োজন। ছাকুনি ব্যবস্থাটি মজুদ ট্যাংক সংলগ্ন স্থানে নির্মাণ করা যেতে পারে। সামুদ্রিক পানিতে প্রচুর জীবাণু থাকে যা ছাকুনির মাধ্যমে নির্মূল বা ধ্বংস করা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্যাদি ব্যবহার করে পানিকে সম্পূর্ণভাবে জীবাণুমুক্ত করা হয় এবং মজুদ ট্যাংকে জমা রাখা হয়।
পরিপক্ককরণ ট্যাংক হলো এমন এক ধরনের কংক্রিটের তৈরি চৌবাচ্চা যেখানে প্রজননক্ষম স্ত্রী এবং পুরুষ বাগদা চিংড়িকে প্রজনন ক্ষেত্র থেকে সংগ্রহের পর সংরক্ষণ করা হয়। এখানে স্ত্রী ও পুরুষ বাগদা চিংড়িকে প্রজননক্ষম করে তোলার চেষ্টা চালানো হয়। প্রথমদিকে এদেরকে শামুক, ঝিনুক, কাঁকড়া ও স্কুইডের মাংস খেতে দেয়া হয়। এতে চিংড়ির প্রজনন ক্ষমতা বাড়ে। চিংড়ির ডিমের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য অনেক সময় স্ত্রী চিংড়ির একটি চোখ অপসারণের কৌশল ব্যবহার করা যেতে পারে। এসময় স্ত্রী ও পুরুষ বাগদা চিংড়িকে একসাথে রাখা হয়। প্রজননক্ষম বাগদা চিংড়িকে পীড়নমুক্ত রাখতে ট্যাংকটি কালো শীট দিয়ে ঢেকে দিতে হয়। এসময় ট্যাংকে পরিষ্কার পানিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে কৃত্রিম বায়ু প্রবাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হয়। ট্যাংকের ধারণক্ষমতা সাধারণত ৮-১৬ টন পর্যন্ত হতে পারে।
প্রজনন ট্যাংক হলো এমন এক ধরনের চৌবাচ্চা যেখানে প্রজননক্ষম স্ত্রী বাগদা চিংড়িকে প্রজনন না হওয়া পর্যন্ত অস্থায়ীভাবে ধরে রাখতে ব্যবহৃত হয়। তবে প্রজননক্ষম চিংড়ি প্রজনন ট্যাংকে স্থানান্তরের পূর্বে লক্ষ্য রাখতে হবে যে স্ত্রী চিংড়ি খোলস পাল্টিয়েছে কি-না। এ ট্যাংকের আকার সাধারণত ১.৫ টন পর্যন্ত হতে পারে।
সদ্য ডিম ফোটানো লার্ভা পালনের জন্য যে ট্যাংক ব্যবহার করা হয় তাকে লার্ভি পালন ট্যাংক বলে। হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদনের পরিমাণের ওপর এ ট্যাংকের আকার ও আয়তন নির্ভর করে। ট্যাংকের আকার বর্গাকার, গোলাকার বা আয়তাকার হয়ে থাকে। এ ট্যাংকে পিএল-১ থেকে পিএল-১৫ পর্যন্ত পালন করা যায়। তবে অনেক সময় কোন কোন হ্যাচারিতে বিভিন্ন স্তরের লার্ভি প্রতিপালনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন আয়তনের ট্যাংক ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সাধারণত লার্ভি প্রতিপালন ট্যাংকের আয়তন ২ থেকে ৪০ টন পর্যন্ত হতে পারে।
প্লাংকটন হলো পানিতে থাকা এক ধরনের জীব যা স্রোতের বিপরীতে নিজেদেরকে চালিত করতে অক্ষম। প্লাংকটন অনেক ছোট বড় জলজ প্রাণির খাদ্যের গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিটোসেরাস (Chaetocerus), স্কেলোটোমা (Skeletoma), নাভিকুলা (Navicula), রটিফেরা (Rotifera) প্রভৃতি এই ট্যাংকে চাষ করা হয়। এসব প্লাংকটন বাগদা পোনার জীবনচক্রের প্রথম পর্যায়ে খাবার হিসেবে সরবরাহ করা হয়। এটি চিংড়ির খাদ্য হিসেবে একটি চমৎকার সংযোজন এবং পোনার বিকাশের জন্য সর্বোত্তম উৎস।
আর্টিমিয়া চিংড়ির জন্য দ্রুত বর্ধনশীল খাদ্যের উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এদের ডিমগুলো লবণাক্ত হ্রদ থেকে সংগ্রহ করার পর শুকনো করে মৎস্য খামারে পাঠানো হয়। শুষ্ক আর্টিমিয়ার ডিম কয়েক মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। প্রয়োজনের সময় ডিম ফুটে নগ্নি উৎপাদন করা হয়। নগ্নি উৎপাদনের জন্য কোণাকৃতির ট্যাংক ব্যবহার করা হয়। এসময় মৃদু লবণাক্ত পানিতে নির্দিষ্ট পরিমাণ ডিম দিয়ে প্রচন্ড বায়ু প্রবাহ চালু করা হলে ২৪ ঘন্টার মধ্যে ডিম ফুটে নগ্নি বের হয়। যা বাগদা চিংড়ির পোনার খাবার হিসেবে সরবরাহ করা হয়।
আরও দেখুন...