শক্তির নিত্যতা ও রুপান্তর

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - পদার্থবিজ্ঞান - কাজ, ক্ষমতা ও শক্তি (Work,Power and Energy) | | NCTB BOOK

পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় শক্তি বলতে কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর কাজ করার সামর্থ্যকে বুঝায়। প্রধানত শ‌ক্তি হ‌চ্ছে পদা‌র্থের এমন একটি বৈ‌শিষ্ট্য যার সৃ‌ষ্টি বা ধ্বংস নেই, এক রূপ থে‌কে অন্য রূপ নি‌তে পা‌রে এবং এক বস্তু থে‌কে অন্য বস্তুতে যেতে পারে। 

Content added || updated By

শক্তির নিত্যতা

আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে চারপাশে যে শক্তি দেখি সেটি অবিনশ্বর। এর কোনো ক্ষয় নেই, এটি শুধু একটি রুপ থেকে অন্য রূপে পরিবর্তন হয়। একটা পাখর উপরে তুললে তার মাঝে স্থিতিশক্তি বা বিভব শক্তির জন্ম হয়। পাথরটা ছেড়ে দিলে বিভব বা স্থিতিশক্তি কমতে থাকে এবং গতিশক্তি বাড়তে থাকে। মাটি স্পর্শ করার পূর্ব মুহূর্তে পুরো শক্তিটাই গতিশন্তিতে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু মাটিকে স্পর্শ করার পর পাথরটি যখন থেমে যায় তখন তার ভেতরে গতিশক্তিও থাকে না বিভব শক্তি থাকে না, তাহলে শক্তিটা কোথায় যায় ? 

                         চিত্র 4.02: একটি পেন্ডুলাম দুলছে ,মোট গতিশক্তি এবং বিভবশক্তির মাঝে স্থান বদল করছে

তোমরা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছ পাথরটা যখন মেঝেতে আঘাত করে তখন সেটি শব্দ করে যেখানে আঘাত করেছে সেখানে তাপের সৃষ্টি করে অর্থাৎ গতিশক্তিটুকু শব্দ কিংবা তাপ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। 

বিভব এবং গতিশক্তির ভেতরে রূপান্তরের উদাহরণটি চমৎকার (চিত্র 4.02)। একটি ছোট পাথরকে সুতা দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে দিয়ে যদি আমরা একপাশে একটু টেনে নিই তাহলে সেটি তার স্থির অবস্থা থেকে একটু উপরে উঠে যায় বলে তার ভেতর এক ধরনের স্থিতিশক্তির জন্ম হয়। এখন পাথরটা ছেড়ে দিলে তার ভেতরকার অসাম্য বলের জন্য সেটি তার স্থির অবস্থার দিকে যেতে থাকে এবং তার মাঝে গতির সঞ্চার হয়। ঠিক মাঝখানে যখন পৌঁছায় তখন তার বেগ থাকে সবচেয়ে বেশি তাই সেটি থেমে না গিয়ে অন্যদিকে যেতে থাকে এবং বেগ নিঃশেষ না হওয়া পর্যন্ত উপরে উঠতে থাকে অর্থাৎ তার ভেতরে আবার স্থিতিশক্তির জন্ম হয়। যখন এটি সবচেয়ে উঁচুতে পৌঁছে গিয়ে থেমে যায় তখন তার স্থিতিশক্তির জন্য সেটি আবার স্থির অবস্থার দিকে যেতে থাকে। এভাবে পাথরটি দুলতে থাকে এবং স্থিতিশক্তি থেকে গতিশক্তি এবং গতিশক্তি থেকে স্থিতিশক্তির মাঝে রূপান্তর হতেই থাকে। ঘর্ষণ এবং অন্যান্য কারণে শক্তি ক্ষয় না হলে এই প্রক্রিয়াটি অনন্তকাল ধরে চলতে থাকত! 

কাজেই শক্তির রূপান্তর খুবই স্বাভাবিক একটা প্রক্রিয়া। শুধু বিভব শক্তি এবং গতিশক্তির মাঝে যে রূপান্তর হতে পারে তা নয়। আমাদের পরিচিত সব শক্তিই এক রূপ থেকে অন্য রূপে যেতে পারে। আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে চারপাশে যে শক্তি দেখি সেটি সৃষ্টিও হয় না ধ্বংসও হয় না, শুধু তার রূপ পরিবর্তন করে। এটাই হচ্ছে শক্তির নিত্যতার সূত্র। 

Content added By
Content updated By

শক্তির রুপান্তর

আমরা আমাদের চারপাশে শক্তির রূপান্তরের অনেক উদাহরণ দেখি, যেমন: 

(a) বিদ্যুৎ বা তড়িৎ শক্তি 

শক্তির রূপান্তরের উদাহরণ দিতে হলে আমরা সবার আগে বিদ্যুৎ বা তড়িৎ শক্তির উদাহরণ দিই, তার কারণ এই শক্তিকে সবচেয়ে সহজে অন্যান্য শক্তিতে রূপান্তর করা যায়। শুধু তা-ই নয়, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বিদ্যুৎ শক্তি সরবরাহ করা সবচেয়ে সহজ। তাই আমাদের চারপাশে নানা ধরনের শক্তি থাকার পরও আমরা আমাদের বাসায় অন্য কোনো শক্তি সরবরাহ না করে সবার প্রথমে তড়িৎ শক্তি বা ইলেকট্রিসিটি সরবরাহ করে থাকি। আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বৈদ্যুতিক পাখা বা অন্যান্য মোটরে তড়িৎ বা বৈদ্যুতিক শক্তিকে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত হতে দেখি। (যদিও চৌম্বক শক্তি আসলে বিদ্যুৎ বা তড়িৎ শক্তি থেকে ভিন্ন কিছু নয়, তার পরেও আমরা মোটর বা বৈদ্যুতিক পাখার ভেতরে বিদ্যুৎ শক্তিকে প্রথমে চৌম্বক শক্তিতে রূপান্তর করে সেখান থেকে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তর হতে দেখি।) বৈদ্যুতিক ইস্ত্রি বা হিটারে এটা তাপশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। বাল্ব, টিউবলাইট বা এলইডিতে তড়িৎ শক্তি আলোতে রূপান্তরিত হয়। শব্দশক্তি তৈরি করার জন্য সাধারণত কোনো কিছুকে কাঁপাতে হয়। সেটি এক ধরনের যান্ত্রিক শক্তি। তারপরও আমরা বলতে পারি স্পিকারে বিদ্যুৎ শক্তি শব্দশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। আমরা সবাই আমাদের মোবাইলে টেলিফোনের ব্যাটারিকে বিদ্যুৎ দিয়ে চার্জ করি, যেখানে আসলে তড়িৎ শক্তি রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয় । 

(b) রাসায়নিক শক্তি 

শক্তি রূপান্তরের উদাহরণ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি নিশ্চয়ই রাসায়নিক শক্তি। আমরা আমাদের বাসায় রান্না করার জন্য যে গ্যাস ব্যবহার করি সেটা রাসায়নিক শক্তির তাপ শক্তিতে রূপান্তরের উদাহরণ। সে কারণে আমাদের বাসায় বৈদ্যুতিক শক্তি সরবরাহ করার সাথে সাথে গ্যাসও সরবরাহ করা হয়। রাসায়নিক শক্তিকে তাপে রূপান্তর করার কারণে আমরা আলোও পেয়ে থাকি। মোমবাতির আলো তার একটা উদাহরণ। গ্যাস, পেট্রল, ডিজেল বা এ ধরনের জ্বালানি ব্যবহার করে আমরা নানারকম ইঞ্জিনে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত হতে দেখি। যদিও ভালো করে দেখলে আমরা দেখব রাসায়নিক শক্তি প্রথমে তাপশক্তি এবং সেই তাপশক্তি যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। তবে আধুনিক প্রযুক্তির যুগে রাসায়নিক শক্তির রূপান্তরের সবচেয়ে বড় উদাহরণটি হচ্ছে ব্যাটারি, যেখানে এই শক্তি বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। মোবাইল টেলিফোন থেকে শুরু করে গাড়ি কিংবা ঘড়ি থেকে মহাকাশযান এমন কোনো জায়গা খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে ব্যাটারি ব্যবহার করে রাসায়নিক শক্তিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তরিত করা হয়নি। রাসায়নিক শক্তির সবচেয়ে চমকপ্রদ উদাহরণ অবশ্য আমাদের বা জীবন্ত প্রাণীর শরীর, যেখানে খাদ্য থেকে রাসায়নিক শক্তি যান্ত্রিক কিংবা বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। 

(c) তাপশক্তি 

পরিমাণের দিক থেকে বিবেচনা করলে নিঃসন্দেহে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি শক্তির রূপান্তর হয় তাপশক্তি থেকে। যাবতীয় যন্ত্রের যাবতীয় ইঞ্জিনে তাপশক্তিকে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তর করা হয়। থার্মোকাপলে (Thermocouple) দুটি ভিন্ন ধাতব পদার্থের সংযোগস্থলে তাপ প্রদান করে সরাসরি তাপ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদাহরণ থাকলেও প্রকৃত পক্ষে প্রায় সবক্ষেত্রেই তাপশক্তি থেকে যান্ত্রিক শক্তি এবং যান্ত্রিক শক্তি দিয়ে বিদ্যুৎ শক্তি তৈরি করা হয়। (পরিবেশ রক্ষা করার জন্য আমরা আজকাল শক্তির অপচয় করতে চাই না। তাই তাপ দিয়ে আলো তৈরি হয় সে রকম লাইট বাল্ব ব্যবহার না করে আজকাল বেশি বিদ্যুৎসাশ্রয়ী বাল্ব ব্যবহার করা হয়।) আমরা মোমবাতির শিখায় রাসায়নিক শক্তিতে সৃষ্ট তাপের কারণে উত্তপ্ত গ্যাসের কণা বা বাল্বের ফিলামেন্টে তাপকে আলোক শক্তিতে রূপান্তরিত হতে দেখি। 

(d) যান্ত্রিক শক্তি 

জেনারেটরে যখন বিদ্যুৎ তৈরি হয় তখন আসলে যান্ত্রিক শক্তি ব্যবহার করে তারের কুণ্ডলীকে চৌম্বক ক্ষেত্রে ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তর করা হয়। ঘর্ষণের কারণে সব সময়ই তাপশক্তি তৈরি হচ্ছে, সেখানে আসলে যান্ত্রিক শক্তি তাপশক্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। 

(e) আলোক শক্তি 

আলো হচ্ছে বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ এবং এই তরঙ্গের একটা নির্দিষ্ট মাত্রার তরঙ্গদৈর্ঘ্য আমরা চোখে দেখতে পাই, সেটাকে আমরা আলো বলি। এর চেয়ে বেশি এবং কম তরঙ্গদৈর্ঘ্যও প্রকৃতিতে রয়েছে এবং আমরা নানাভাবে তৈরিও করছি। যেমন মাইক্রোওয়েভ ওভেনে আমরা এই বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গকে তাপশক্তিতে রূপান্তর করি। আজকাল সোলার সেল ব্যবহার করে সরাসরি আলো থেকে বিদ্যুৎ তৈরি করা হয়। এখন যদিও ফটোগ্রাফিক কাগজ ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে কিন্তু আমরা সবাই জানি আলোক সংবেদী ফটোগ্রাফির ফিল্মে আলোর উপস্থিতি রাসায়নিক শক্তির জন্ম দেয়। 

(f) ভর 

তোমরা নিশ্চয়ই বিভিন্ন ধরনের শক্তির রূপান্তরের মাঝে হঠাৎ করে ভর শব্দটি দেখে চমকে উঠেছ। আমরা যখন শক্তিকে বোঝাই তখন কখনো সরাসরি ভরকে শক্তি হিসেবে কল্পনা করি না। কিন্তু আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিক সূত্র দিয়ে দেখিয়েছেনE=mc2 এবং এই সূত্রটি দিয়ে ভরকে শক্তিতে  রূপান্তরের সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন। নিউক্লিয়ার বোমাতে ভর থেকে শক্তি রূপান্তর করা হয়েছিল, সেখানে প্রচণ্ড তাপ, আলো এবং শব্দ শক্তি হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহর ধ্বংস করে দিয়েছিল। শক্তির রূপান্তরের এই পদ্ধতিটি শুধু বোমাতে নয়, নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্রেও ব্যবহার করা হয়। সরাসরি তাপশক্তি তৈরি হলেও সেই তাপকে ব্যবহার করে বাষ্প এবং বাষ্পকে ব্যবহার করে টারবাইন ঘুরিয়ে সেই টারবাইন দিয়ে জেনারেটরে বিদ্যুৎ তৈরি করা হয়  

শক্তির এই ধরনের রূপান্তর আমাদের চারপাশে ঘটতে থাকলেও আমাদের একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানা দরকার। শক্তি থাকলেই কিন্তু সব সময় সেই শক্তি ব্যবহার করা যায় না। পৃথিবীর সমুদ্রে বিশাল পরিমাণ তাপশক্তি রয়েছে, সেই শক্তি আমরা ব্যবহার করতে পারি না। (ঘূর্ণিঝড় মাঝে মাঝে সেই শক্তি নগর লোকালয় ধ্বংস করে দেয়!) আবার যখনই শক্তিকে একটি রূপ থেকে অন্য রূপে পরিবর্তন করা হয় তখন খানিকটা হলেও শক্তির অপচয় হয়। মূলত এই অপচয়টা হয় তাপশক্তিতে এবং সেটা আমরা ব্যবহার করার জন্য ফিরে পাই না। শক্তির এই অপচয়টি আসলে প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা নয়। এটি পদার্থবিজ্ঞানের বেঁধে দেওয়া নিয়ম। 

বিজ্ঞান শেখার প্রাথমিক পর্যায়ে অনেকেই এটা জানে না এবং তারা এক শক্তিকে অন্য শক্তিতে রূপান্তর করে অনন্তকাল চলার উপযোগী একটা মেশিন তৈরি করার চেষ্টা করে (একটি মোটর জেনারেটরকে ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি করছে সেই বিদ্যুৎ দিয়েই আবার মোটরটিকে ঘোরানো হচ্ছে। এটি অনন্তকাল চলার একটি মেশিনের উদাহরণ। যেটি কখনোই কাজ করবে না।) 

Content added By
Content updated By
Promotion