নবম-দশম শ্রেণি (দাখিল) - বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি - তৃতীয় অধ্যায় | NCTB BOOK

সব ভাষায় লিঙ্গভেদে শব্দভেদ আছে, বাংলা ভাষায়ও আছে।
বাংলা ভাষায় বহু বিশেষ্য পদ রয়েছে যাদের কোনোটিতে পুরুষ ও কোনোটিতে স্ত্রী বোঝায়। যে শব্দে পুরুষ বোঝায় তাকে পুরুষবাচক শব্দ আর যে শব্দে স্ত্রী বোঝায় তাকে স্ত্রীবাচক শব্দ বলে। যেমন : বাপ-মা, ভাই- বোন, ছেলে-মেয়ে— কেউই মৃত্যুর সময় তার কাছে ছিল না। এ বাক্যে বাপ, ভাই ও ছেলে পুরুষবাচক শব্দ, আর মা, বোন ও মেয়ে ত্রীবাচক শব্দ। তৎসম পুরুষবাচক বিশেষ্য শব্দের সঙ্গে পুরুষবাচক বিশেষণ ব্যবহৃত এবং স্ত্রীবাচক বিশেষ্য শব্দের সঙ্গে স্ত্রীবাচক বিশেষণ ব্যবহৃত হয়। যেমন – বিদ্বান লোক এবং বিদুষী নারী। এখানে ‘লোক’ পুরুষবাচক বিশেষ্য এবং ‘নারী’ স্ত্রীবাচক বিশেষ্য। “বিদ্বান’ পুরুষবাচক বিশেষণ এবং ‘বিদুষী’ স্ত্রীবাচক বিশেষণ। কিন্তু বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে সংস্কৃত ব্যাকরণের এ নিয়ম মানা হয় না। যেমন— সংস্কৃতে ‘সুন্দর বালক ও সুন্দরী বালিকা’ বাংলায় ‘সুন্দর বালক ও সুন্দর বালিকা'।

                                                                                           বাংলায় পুরুষ ও স্ত্রীবাচক শব্দ
১। বাংলায় পুরুষ ও স্ত্রীবাচক শব্দ মূলত দুই ভাগে বিভক্ত
১. পতি ও পত্নীবাচক অর্থে এবং ২. পুরুষ ও মেয়ে বা স্ত্রীজাতীয় অর্থে।
১. পতি ও পত্নীবাচক অর্থে : আব্বা-আম্মা, চাচা-চাচী, কাকা-কাকী, জেঠা-জেঠী, দাদা-দাদী, নানা- নানী, নন্দাই-ননদ, দেওর-জা, ভাই-ভাবী/বৌদি, বাবা-মা, মামা-মামী ইত্যাদি ।
২. সাধারণ পুরুষ ও স্ত্রীজাতীয় অর্থে : খোকা-খুকী, পাগল-পাগলী, বামন-বামনী, ভেড়া-ভেড়ী, মোরগ-
মুরগী, বালক-বালিকা, দেওর-ননদ।
২। বাংলা স্ত্রী প্রত্যয়
পুরুষবাচক শব্দের সঙ্গে কতগুলো প্রত্যয় যোগ করে স্ত্রীবাচক শব্দ গঠন করা হয়। এগুলো হলো : ঈ, নি, নী, আনী, ইনী, ন।
১. ঈ-প্রত্যয় : বেঙ্গমা-বেঙ্গমী, ভাগনা/ভাগনে-ভাগনী ৷
২. নী-প্রত্যয় : কামার-কামারনী, জেলে-জেলেনী, কুমার-কুমারনী, ধোপা-ধোপানী, মজুর-মজুরনী
ইত্যাদি।
৩. পুরুষবাচক শব্দের শেষে ঈ থাকলে স্ত্রীবাচক শব্দে নী হয় এবং আগের ঈ ই হয়। যেমন : ভিখারি- ভিখারিনী, অভিসারী-অভিসারিণী। 

৪. আনী-প্রত্যয় : ঠাকুর-ঠাকুরানী, নাপিত-নাপিতানী, মেথর-মেথরানী, চাকর-চাকরানী ইত্যাদি । ৫. ইনী-প্রত্যয় : কাঙাল - কাঙালিনী, গোয়ালা - গোয়ালিনী, বাঘ-বাঘিনী ইত্যাদি ।
উন-প্রত্যয় : ঠাকুর-ঠাকরুন / ঠাকুরানী।
আইন-প্রত্যয় : নতুন নতুন প্রত্যয়ের প্রয়োগ দেখা যায়। যেমন : ঠাকুর-ঠাকুরাইন।
দ্রষ্টব্য : বাংলায় কতগুলো তৎসম স্ত্রীবাচক শব্দের পরে আবার স্ত্রীবাচক প্রত্যয় ব্যবহৃত হয়। যেমন— অভাগা—অভাগী/অভাগিনী, ননদাই-ননদিনী/ননদী ইত্যাদি ৷
৩। নিত্য স্ত্রীবাচক শব্দ
কতগুলো শব্দ নিত্য স্ত্রীবাচক। এগুলোর পুরুষবাচক শব্দ নেই। যেমন— সতীন, সৎমা, এয়ো, দাই, সধবা ইত্যাদি।
৪। কতগুলো শব্দের আগে নর, মদ্দা ইত্যাদি পুরুষবাচক শব্দ এবং ত্রী, মাদী, মাদা ইত্যাদি ত্রীবাচক শব্দ যোগ করে পুরুষবাচক ও স্ত্রীবাচক শব্দ গঠন করা হয়। যেমন – নর / মদ্দা / হুলো বিড়াল-মেনি বিড়াল; মদ্দা হাঁস-মাদী হাঁস; মদ্দা ঘোড়া-মাদী ঘোড়া; পুরুষ লোক-মেয়েলোক / স্ত্রীলোক; বেটাছেলে-মেয়েছেলে ; পুরুষ কয়েদী -স্ত্রী / মেয়ে কয়েদী; এঁড়ে বাছুর-বকনা বাছুর; বলদ গরু-গাই গরু ইত্যাদি ।
৫। কতগুলো পুরুষবাচক শব্দের আগে স্ত্রীবাচক শব্দ প্রয়োগ করে স্ত্রীবাচক শব্দ গঠিত হয়। যেমন- কবি-
মহিলা কবি, ডাক্তার-মহিলা ডাক্তার, সভ্য-মহিলা সভ্য, কর্মী-মহিলা কর্মী, শিল্পী-মহিলা বা নারী শিল্পী,
সৈন্য-নারী / মহিলা সৈন্য, পুলিশ মহিলা পুলিশ ইত্যাদি।
৬। কতগুলো শব্দের শেষে পুরুষ ও স্ত্রীবাচক শব্দ যোগ করে পুরুষ ও স্ত্রীবাচক শব্দ গঠন করা হয়। যেমন : বোন-পো-বোন-ঝি, ঠাকুর-পো-ঠাকুর-ঝি, ঠাকুর দাদা / ঠাকুরদা-ঠাকুরমা, গয়লা-গয়লা-বউ, জেলে- জেলে বউ ইত্যাদি।
৭। অনেক সময় আলাদা আলাদা শব্দে পুরুষবাচক ও স্ত্রীবাচক বোঝায়। যেমন : বাবা-মা, ভাই-বোন, কর্তা- গিন্নী, ছেলে-মেয়ে, সাহেব-বিবি, জামাই-মেয়ে, বর-কনে, দুলহা-দুলাইন/ দুলহিন, বেয়াই-বেয়াইন, তাঐ-মাঐ, বাদশা—বেগম, শুক-সারী ইত্যাদি।


   সংস্কৃত ত্রী প্রত্যয়
তৎসম পুরুষবাচক শব্দের পরে আ, ঈ, আনী, নী, ইকা প্রভৃতি প্রত্যয়যোগে স্ত্রীবাচক শব্দ গঠিত হয়। যেমন-
১. আ-যোগে
(ক) সাধারণ অর্থে : মৃত-মৃতা, বিবাহিত-বিবাহিতা, মাননীয়-মাননীয়া, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, প্রিয়-প্রিয়া, প্রথম- প্রথমা, চতুর—চতুরা, চপল-চপলা, নবীন-নবীনা, কনিষ্ঠ-কনিষ্ঠা, মলিন-মলিনা ইত্যাদি। (খ) জাতি বা শ্রেণিবাচক : অজ-অজা, কোকিল-কোকিলা, শিষ্য-শিষ্যা, ক্ষত্রিয়-ক্ষত্রিয়া, শূদ্র-শূদ্রা ইত্যাদি ।

২. ঈ-প্রত্যয় যোগে
(ক) সাধারণ অর্থে : নিশাচর-নিশাচরী, ভয়ংকর-ভয়ংকরী, রজক-রজকী, কিশোর-কিশোরী, চতুর্দশ-চতুর্দশী, ষোড়শ-ষোড়শী ইত্যাদি। (খ) জাতি বা শ্রেণিবাচক সিংহ-সিংহী, ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণী, মানব-মানবী, বৈষ্ণব-বৈষ্ণবী, সুন্দর-সুন্দরী,কুমার-কুমারী,ময়ূর-ময়ূরী ইত্যাদি।
৩. ইকা—প্রত্যয় যোগে
(ক) যেসব শব্দের শেষে ‘অক্’ রয়েছে সেসব শব্দে ‘অক্’ স্থলে ‘ইকা’ হয়। যেমন : বালক-বালিকা, নায়ক- নায়িকা, গায়ক-গায়িকা, সেবক-সেবিকা, অধ্যাপক-অধ্যাপিকা ইত্যাদি। কিন্তু গণক-গণকী, নর্তক—নর্তকী, চাতক—চাতকী, রজক-রজকী (বাংলায়) রজকিনী।
(খ) ক্ষুদ্রার্থে ইকা যোগ হয়। যেমন : নাটক-নাটিকা, মালা-মালিকা, গীত-গীতিকা, পুস্তক-পুস্তিকা ইত্যাদি। (এগুলো ত্রী প্রত্যয় নয়, ক্ষুদ্রার্থক প্রত্যয়। ) ৪। আনী-যোগ করে : ইন্দ্র-ইন্দ্রানী, মাতুল-মাতুলানী, আচার্য-আচার্যানী (কিন্তু আচার্যের কর্মে নিয়োজিত অর্থে
আচার্য)। এরূপ : শূদ্র-শূদ্রা (শূদ্র জাতীয় ত্রীলোক), শূদ্রানী (শূদ্রের ত্রী), ক্ষত্রিয়-ক্ষত্রিয়া/ ক্ষত্রিয়ানী ইত্যাদি।
আনী-প্রত্যয় যোগে কোনো কোনো সময় অর্থের পার্থক্য ঘটে। যেমন—অরণ্য-অরণ্যানী (বৃহৎ অরণ্য), হিম-
হিমানী (জমানো বরফ)।
৫. ঈনী, নী, যোগে : মায়াবী-মায়াবিনী, কুহক-কুহকিনী, যোগী-যোগিনী, মেধাবী-মেধাবিনী, দুঃখী- দুঃখিনী ইত্যাদি।
৬. বিশেষ নিয়মে সাধিত স্ত্রীবাচক শব্দ
(ক) যেসব পুরুষবাচক শব্দের শেষে ‘তা’ রয়েছে, স্ত্রীবাচক বোঝাতে সেসব শব্দে ‘ত্রী’ হয়। যেমন— নেতা- নেত্রী, কর্তা-কর্ত্রী, শ্রোতা-শ্রোত্রী, ধাতা-ধাত্রী।
(খ) পুরুষবাচক শব্দের শেষে অত্, বান্, মান্, ঈয়ান থাকলে যথাক্রমে অতী, বতী, মতি, ঈয়সী হয়। যথা : সৎ-সতী, মহৎ-মহতী, গুণবান-গুণবতী, রূপবান-রূপবতী, শ্রীমান-শ্রীমতী, বুদ্ধিমান-বুদ্ধিমতী, গরীয়ান- গরিয়সী।
(গ) কোনো কোনো পুরুষবাচক শব্দ থেকে বিশেষ নিয়মে স্ত্রীবাচক শব্দ গঠিত হয়। যেমন— সম্রাট-সম্রাজ্ঞী, রাজা-রানি, যুবক-যুবতী, শ্বশুর- শ্বশ্রূ, নর-নারী, বন্ধু-বান্ধবী, দেবর-জা, শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রী, স্বামী- ত্রী, পতি-পত্নী, সভাপতি-সভানেত্রী ইত্যাদি।
বিদেশি স্ত্রীবাচক শব্দ : খান-খানম, মরদ-জেনানা, মালেক-মালেকা, মুহতারিম-মুহতারিমা, সুলতান- সুলতানা।
নিত্য স্ত্রীবাচক তৎসম শব্দ : সতীন, অর্ধাঙ্গিনী, কুলটা, বিধবা, অসূর্যম্পশ্যা, অরক্ষণীয়া, সপত্নী ইত্যাদি। 

দ্রষ্টব্য
(ক) কতগুলো বাংলা শব্দে পুরুষ ও স্ত্রী দু-ই বোঝায়। যেমন— জন, পাখি, শিশু, সন্তান, শিক্ষিত, গুরু ইত্যাদি। (খ) কতগুলো শব্দে কেবল পুরুষ বোঝায়। যেমন—কবিরাজ, ঢাকী, কৃতদার, অকৃতদার ইত্যাদি । (গ) কতগুলো শব্দ শুধু স্ত্রীবাচক হয়। যেমন— সতীন, সত্মা, সধবা ইত্যাদি ।
(ঘ) কিছু পুরুষবাচক শব্দের দুটি করে স্ত্রীবাচক শব্দ রয়েছে। যথা— দেবর-ননদ (দেবরের বোন)/জা (দেবরের সত্রী), ভাই-বোন এবং ভাবী (ভাইয়ের স্ত্রী), শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রী (শিক্ষিকা) (পেশা অর্থে) এবং শিক্ষকপত্নী (শিক্ষকের স্ত্রী), বন্ধু-বান্ধবী (মেয়ে বন্ধু) এবং বন্ধুপত্নী (বন্ধুর স্ত্রী), দাদা-দিদি (বড় বোন) এবং বৌদি (দাদার স্ত্রী)।
(ঙ) বাংলা স্ত্রীবাচক শব্দের বিশেষণ স্ত্রীবাচক হয় না। যেমন : সুন্দর বলদ-সুন্দর গাই, সুন্দর ছেলে-সুন্দর
মেয়ে, মেজ খুড়ো—মেজ খুড়ি ইত্যাদি।
(চ) বিধেয় বিশেষণ অর্থাৎ বিশেষ্যের পরবর্তী বিশেষণও স্ত্রীবাচক হয় না। যেমন— মেয়েটি পাগল হয়ে গেছে (পাগলি হয়ে গেছে হবে না)। আসমা ভয়ে অস্থির (অস্থিরা হবে না) । (ছ) কুল—উপাধিরও স্ত্রীবাচকতা রয়েছে। যেমন : ঘোষ (পুরুষ) ঘোষজা (কন্যা অর্থে), ঘোষজায়া (পত্নী অর্থে)।

Content added By