নবম-দশম শ্রেণি (দাখিল) - বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় - বাংলাদেশের নদ-নদী ও প্রাকৃতিক সম্পদ | NCTB BOOK

প্রাকৃতিক সম্পদের ধারণা

 প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত সম্পদকে প্রাকৃতিক সম্পদ (Natural Resource) বলা হয়। মাটি, পানি, বনভূমি, সৌরতাপ, মৎস্য, খনিজ ইত্যাদি প্রাকৃতিক সম্পদ ।

বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ 

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত, মিয়ানমার ও নেপালের প্রাকৃতিক সম্পদ প্রায় একই রকম। নিম্নে এসব প্রাকৃতিক সম্পদের বিবরণ দেওয়া হলো।

কৃষিজ সম্পদ : দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত, বাংলাদেশ, মিয়ানমার এবং নেপাল বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে কৃষিপ্ৰধান। এই অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি, জলবায়ু, মাটি, নদ-নদী ইত্যাদির উপর নির্ভর করে কৃষকগণ এখানকার কৃষিজ সম্পদ উৎপাদন করে। কৃষি উৎপাদনে একটি সুনির্দিষ্ট মাত্রার তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের দরকার হয়। এজন্য অঞ্চলভেদে কৃষি উৎপাদনে তারতম্য ঘটে। অত্যন্ত শীতল জলবায়ুর কারণে কিংবা বৃষ্টিপাতের অভাবে ভারতের কয়েকটি অঞ্চলে শস্য উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটে। নেপালে হিমালয়ের পাদদেশে শস্য উৎপাদন সীমিত আকারে হয়। অথচ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে নদী বিধৌত উর্বর অঞ্চলে ধান, গমসহ কৃষিজ পণ্য বছরে কয়েকবার উৎপাদন করা সম্ভব। বাংলাদেশে ধান, আলু ও পাটের উৎপাদন ব্যাপক হয়। ভারতের পূর্বাঞ্চলে এবং বাংলাদেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ে চা উৎপাদন হচ্ছে। গম, ভুট্টা, সরিষা ইত্যাদির ফলনও বেশ ভালো হয়। এ অঞ্চলে কৃষিপণ্য উৎপাদনের পিছনে মাটির গুণাগুণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ভারত ও মিয়ানমারে তুলা, চা, ডাল, মরিচ ইত্যাদির উৎপাদন বেশ ভালো।

বনজ সম্পদ : জলবায়ুগত অবস্থার সঙ্গে বনজ সম্পদের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশ- ভারত, মিয়ানমার ও নেপালের মধ্যে জলবায়ুগত ভারতম্য রয়েছে। উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু অঞ্চলে সারা বছর প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় বলে সেখানে নিবিড় ও বড় বড় অরণ্য বেড়ে উঠেছে। এজন্যই বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, ভারতের পূর্বাঞ্চল ও মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলে চির হরিৎ অরণ্য সৃষ্টি হয়েছে।

মৎস্য সম্পদ : যে কোনো দেশের মৎস্য সম্পদের সঙ্গে সরাসরি ভূ-প্রকৃতি ও জলবায়ুর সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশে বৃষ্টিপাত, নদ-নদীতে পানিপ্রবাহ, খাল, বিল, হাওড়, পুকুর ইত্যাদিতে পানি থাকায় দেশটি মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধ দেশ বলে পরিচিত। এখানে ছোট বড় নানা প্রকারের মাছ পাওয়া যায়। বঙ্গোপসাগরে মাছের ভাণ্ডার রয়েছে। প্রতিবেশী মিয়ানমার ও ভারতে প্রচুর মৎস্য সম্পদ রয়েছে।

খনিজ সম্পদ : বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড়ি জেলাসমূহের মাটির নিচে গ্যাস, কয়লা, তেল, চুনাপাথরসহ নানা ধরনের মূল্যবান খনিজ পদার্থের সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব সম্পদ আহরণ করে দেশের গ্যাসের চাহিদা মেটানো হচ্ছে। বঙ্গোপসাগরের তলদেশেও গ্যাস আবিষ্কৃত হয়েছে। সেখানে আরও অনেক ধরনের প্রাণিজ এবং খনিজ পদার্থ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত একটি বড় দেশ। সেখানে ভূতাত্ত্বিক অবস্থা বৈচিত্র্যময়। ফলে নানা খনিজ সম্পদে ভারত অনেক বেশি সমৃদ্ধ। মিয়ানমার খনিজ সম্পদে বেশ অগ্রসর অবস্থানে আছে। তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে আছে নেপাল।সৌরশক্তি : নিরক্ষীয় নিম্ন অক্ষাংশ অঞ্চলে সূর্য বছরের প্রায় সবসময়ই লম্বভাবে কিরণ দেয়। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অপরাপর দেশগুলো নিরক্ষীয় বা ক্রান্তীয় অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ার কারণে এসব দেশ সহজে প্রচুর সৌরশক্তি পেয়ে থাকে। এ অঞ্চলের দেশগুলোতে তাপমাত্রা কখনো নিম্ন পর্যায়ে নামে না। ফলে সূর্যের আলো ছাড়া অন্ধকারে বসবাস করতে হয় না। ইউরোপ ও আমেরিকা মহাদেশের বেশকিছু দেশে সূর্য বছরে কয়েকমাস বাঁকাভাবে কিরণ দেয়, কখনো কখনো সূর্য প্রায় দেখাই যায় না। সে কারণে সেসব দেশে রাষ্ট্র ও জনগণকে বাড়িঘর বসবাসের জন্যে উপযোগী রাখতে প্রচুর জ্বালানি সম্পদ ব্যয় করতে হয়। আমাদের এ অঞ্চলের দেশগুলোকে তা করতে হয় না। আমরা প্রকৃতি থেকে সূর্যের যে আলো অনায়াসে লাভ করি তা অনেক মূল্যবান সৌর সম্পদ। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এ সম্পদ দিয়ে আমরা আমাদের বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করতে পারি। আমাদের খাদ্য, চিকিৎসা, বাসস্থানসহ নানা ক্ষেত্রেই সৌরশক্তিকে ব্যবহার করে বাংলাদেশের আরও উন্নতি লাভ করার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।

পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনার ধারণা

মানুষসহ জীব জগতের অস্তিত্ত্বের জন্যে পানির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই পানি অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ। কৃষি ও শিল্পের বিকাশে পানির ব্যবহার অপরিহার্য। বৃষ্টি থেকে পর্যাপ্ত পানি পাওয়া গেলেও শীত ও গ্রীষ্মকালে পানির অভাব হলে কৃষি, শিল্প ও জীবনযাপন সংকটাপন্ন হয়ে ওঠে। সে কারণে সারাবছর পানির প্রাপ্তি, প্রবাহ ও বণ্টন নিশ্চিত রাখতে এই সম্পদের ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হয়। পানির পরিকল্পিত প্রাপ্যতা ও ব্যবহারকে পানি ব্যবস্থাপনা বলা হয়। সাধারণত কঠিন, তরল ও বাষ্পাকারে পানি থাকে। শীত ও শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে নদ-নদী, খাল, পুকুর, হাওড় ও বিলে পরিকল্পিতভাবে পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে পানি সম্পন ব্যবস্থাপনা করা যায়। আধুনিককালে পানি সম্পনকে মানুষের কল্যাণে ব্যয় করার জন্যে এর ব্যবস্থাপনার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। নতুবা এ সম্পদের অপব্যবহার, দুষ্প্রাপ্যতা, রাসায়নিকীকরণসহ নানা কারণে পরিবেশ বিপর্যয় এবং জীব জগতের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে।

বাংলাদেশের পানি ও খাদ্য নিরাপত্তায় পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব

বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। এত মানুষের খাদ্য, পানি ও অন্যান্য নিরাপত্তা বিধান করা বেশ কঠিন। তাই জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা খুবই কঠিন হয়ে উঠেছে। দিন দিন এদেশে ভূমি, পানি ও খাদ্য ব্যবস্থাপনাসহ নানা সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদিও স্বাধীনতার চল্লিশ বছরে জনসংখ্যা দ্বিগুণ বেড়েছে, খাদ্যোৎপাদন তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এজন্য দেশে তেমন খাদ্য সংকট নেই। কিন্তু পানিদূষণ ও দুষ্প্রাপ্যতা যেভাবে বেড়ে চলেছে তাতে খাদ্যোৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশংকা রয়েছে। সেজন্যে দেশে পানি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জনগণের খাদ্য নিরাপত্তার স্বায়ী সমাধানে সকলকে কাজ করতে হবে। পানি ব্যবস্থাপনার জন্য যে উদ্যোগগুলো নিতে হবে তা হলো-

১. পরিবেশ সংরক্ষণ : নদ-নদী, পুকুর, খাল, বিল, হাওড়, বাওড়, বন ও ভূমির পরিবেশ রক্ষা করতে হবে।

২. পানির সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা : শুষ্ক ও শীত মৌসুমে দেশের সর্বত্র পানির অপব্যবহার দূর করার নীতি ও কৌশল

বাস্তবায়ন করতে হবে। 

৩. নদ-নদীর নাব্য সংকট দূর করা দেশের নদ-নদীগুলো পলি পড়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। প্রায় প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন অঞ্চল বন্যা কবলিত হয়ে পানি দূষিত হয়। এটি থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিরোধ ব্যবস্থা, যেমন- বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও বাঁধ নির্মাণের দিকে নজর দিতে হবে। অনেক নদী শুকিয়ে গেছে। এসব করলে পানির প্রবাহ এবং সরক্ষণ সম্ভব হবে। তাতে কৃষি ও শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় 88 / 247 

৪. সংযোগ খাল ও রিজার্ভার খনন করা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে পরিকল্পিতভাবে কে করা শুষ্ক মৌসুমে খাদ্য উৎপাদনে প্রয়োজনীয় পানির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে। মাছ চাষ ও প্রজনন স্বাভাবিক থাকবে।

৫. লবণাক্ততা দূর করা : দক্ষিণাঞ্চলের বেশকিছু এলাকায় সমুদ্রের পানির কারণে মাটি লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। মাটির উপর পাতলা আবরণ পড়ে ফসল উৎপাদন নষ্ট করে দিচ্ছে। ফলে মিঠা পানির অভাবে মাছ চাষ, কৃষিকাজ,গাছপালা ইত্যাদি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসব এলাকায় মিঠা পানির সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার জন্য বিভিন্ন ধরনের বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। তাহলে পানি ও খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার হতে পারে।

৬. নদীভাঙন রোধ করা : বর্ষাকালে কোনো কোনো অঞ্চলে নদী ভাঙনের ফলে নদীতে চর জাগে, নদী ভরাট হওয়ার উপক্রম হয়। দ্রুত সেসব ভাঙন রোধ ও নদীতে ড্রেজিং সম্পন্ন করে পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি দিতে হবে। 

৭. পরিমিত সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা আমাদের দেশে দীর্ঘদিন থেকে কৃষি কাজে অপরিমিতভাবে সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে পানি দূষণে মাছ ও কৃষি উৎপাদনের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। অপ্রয়োজনে সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা না হলে পানি ও ভূমির গুণাগুণ অক্ষত থাকবে।

৮. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার দেশের পানি সম্পদকে মানুষের জীবন-জীবিকার উন্নয়নে কাজে লাগাতে হবে। একই সঙ্গে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে বৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারণা ও শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। প্রযুক্তির ব্যবহারে যত্নবান হতে হবে। দেশের পানি সম্পদ সারা বছরের সকল চাহিদা পূরণ করতে পারলে দেশে কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাবে। সে কারণে প্রথমে পানির নিরাপত্তা বিধান করতে হবে, তাহলে খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। এর জন্য দেশে জাতীয় পানি নীতিমালা যথাযথভাবে কার্যকর করার প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে।

বাংলাদেশের বনভূমির শ্রেণিবিভাগ

বৃক্ষরাজি যে ভূমিতে সমারোহ ঘটায় তাকে বনভূমি বলা হয়। এসব বনে কাঠ, মধু, মোম ইত্যাদি বনজ সম্পদ পাওয়া যায়। বাংলাদেশে পর্যাপ্ত বনভূমি নেই। একটি দেশের মোট আয়তনের ২০-২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে এ সম্পদের পরিমাণ রয়েছে মাত্র ১৩ শতাংশ। জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে মানুষের ঘরবাড়ি এবং আসবাবপত্র নির্মাণে মূল্যবান কাঠের প্রয়োজন। এসব কাঠ বনভূমি থেকেই সরবরাহ করা হয়। যার কারণে এ দেশের বনভূমি ক্রমেই কমে যাচ্ছে।

মূলত জলবায়ু ও মাটির ভিন্নতার কারণে এক এক অঞ্চলে এক এক ধরনের বনের সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের বন এলাকাকে মোটামুটি চারটি ভাগে ভাগ করা যায় চট্টগ্রামের বনাঞ্চল, সিলেটের বন, সুন্দরবন ও ঢাকা-টাঙ্গাইল ময়মনসিংহ অঞ্চলের বনভূমি। উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্য অনুসারেও বনাঞ্চলের শ্রেণিবিভাগ করা যায়, যেমন- ১. ক্রান্তীয় চির হরিৎ এবং পত্র পতনশীল বনভূমি, ২. ক্রান্তীয় পাতাঝরা বা পত্র পতনশীল বনভূমি এবং ৩. স্রোতজ (ম্যানগ্রোভ) বা গরান বনভূমি।

১. ক্রান্তীয় চিরহরিৎ এবং পত্রপতনশীল বনভূমি : বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব অংশের পাহাড়ি অঞ্চলকে ক্রান্তীয় চিরহরিৎ এবং পত্রপতনশীল বনভূমি এলাকা নামে অভিহিত করা হয়। মূলত উষ্ণ ও আর্দ্রভূমির কিছু এলাকা জুড়ে বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা, তরুলতা, ঝোপঝাড় ও গুলু জন্ম নেয়। এসব গাছের পাতা একত্রে ফোটেও না, ঝরেও না। ফলে সারা বছর বনগুলো সবুজ থাকে। সে কারণেই এসব বনকে চিরহরিৎ বা চির সবুজ বনভূমি বলে। চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি রাঙামাটি, বান্দরবান ও সিলেট এই অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। এ বনভূমির পরিমাণ প্রায় ১৪ হাজার বর্গ কিলোমিটার। চাপালিশ, ময়না, তেলসুর, মেহগনি, জারুল, সেগুন, গর্জন এ বনভূমির উল্লেখযোগ্য গাছ। সিলেটের পাহাড়ে প্রচুর বাঁশ ও বেত জন্মে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে রাবার চাষ হয়।

২. ক্রান্তীয় পাতারা বা পত্রপতনশীল অরণ্য: বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, দিনাজপুর ও রংপুর জেলা পাতাঝরা অরণ্যের অঞ্চল। এ বনভূমিতে বছরের শীতকালে একবার গাছের পাতা সম্পূর্ণ রূপে ঝরে যায়। শাল বা গজারি ছাড়াও এ অঞ্চলে কড়ই, বহেড়া, হিজল, শিরীষ, হরীতকী, কাঁঠাল, নিম ইত্যাদি গাছ জন্মে। এ বনভূমিতে প্রধানত শালগাছ প্রধান বৃক্ষ তাই এ বনকে শালবন | হিসেবেও অভিহিত করা হয়। ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও গাজীপুরে এ বনভূমি মধুপুর ভাওয়াল বনভূমি নামে পরিচিত। দিনাজপুর অঞ্চলে এটিকে বরেন্দ্র অঞ্চলের বনভূমি বলা হয়।

৩. স্রোতজ (ম্যানগ্রোভ) বা গরান বনভূমি: বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ খুলনা এবং দক্ষিণ পূর্বাংশে নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম জেলার উপকূলে জোয়ার ভাটার লোনা ও ভেজা মাটিতে যেসব উদ্ভিজ্জ জন্মায় তাদের স্রোতজ বা গরান বনভূমি বলা হয়। প্রধানত সুন্দরবনে এসব উদ্ভিদ বেশি জন্ম নেয়। স্যাঁতসেঁতে লোনা পানিতে সুন্দরী, গেওয়া, পশুর, ধুন্দল, কেওড়া, বাইন, গরান, গোলপাতা ইত্যাদি বৃক্ষ এ বনভূমির অন্তর্গত। বাংলাদেশে মোট ৪,১৯২ বর্গ কিলোমিটার স্রোতজ বা গরান বনভূমি রয়েছে।

বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে বনভূমি শুধু বনজ সম্পদের জন্যেই নয়, আলো, বাতাস, সবুজ-শ্যামল স্বাস্থ্যসম্মত জীবনের জন্যও এর গুরুত্ব অপরিসীম।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রাকৃতিক সম্পদের গুরুত্ব বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রাকৃতিক সম্পদের গুরুত্ব অপরিসীম। ভূমি, বনভূমি, মৎস্য, খনিজ পদার্থ, সৌর তাপ, প্রাকৃতিক জলাশয় ইত্যাদি এ দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এসব প্রাকৃতিক সম্পদকে যথাযথভাবে ব্যবহার করে দারিদ্র্য দূরীকরণ, খাদ্য নিরাপত্তা বিধান এবং উন্নত জীবনমান নিশ্চিত করা সম্ভব। প্রাকৃতিক এসব সম্পদই অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ ত্বরান্বিত করবে। বাংলাদেশের মাটি আমাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। অত্যন্ত উর্বর এই মাটিতে ফসল ফলাতে বেশি পুঁজির প্রয়োজন পড়ে না। মাটির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে আমাদের কৃষিজ ফসল, ফুল, ফল, শাকসবজিসহ বনজ সম্পদের প্রসার ঘটাতে পারি। বাংলাদেশ স্বাধীনতার চল্লিশ বছরে তিনগুণ খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পেরেছে। উন্নত প্রযুক্তি, বীজ, চাষাবাদের নিয়ম-কানুন মেনে বাংলাদেশ এই মাটিতে আরও বেশি ফসল উৎপাদন করতে পারবে। বিভিন্ন দেশি-বিদেশি ফল ফলিয়ে মানুষের পুষ্টির চাহিদা পূরণ সম্ভব। শাক-সবজির দেশীয় চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রপ্তানি করা যেতে পারে। তবে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ, মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি বাড়িঘর, কলকারখানা, পুল, রাস্তাঘাট, শহর-উপশহর নির্মাণে বাংলাদেশের উর্বর ভূমি হ্রাস পাচ্ছে। পরিকল্পিতভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে ভূমির ব্যবহার না করা হলে জাতীয় জীবনে বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। সে কারণে বাংলাদেশে ভূমির ব্যবহার আরও বেশি পরিকল্পিতভাবে করতে হবে। আমাদের অর্থনীতিতে প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে পানির গুরুত্বও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের নদ-নদী, খাল বিল, হাওড় বাঁওড়, পুকুর ইত্যাদির পানির ওপর কৃষি ও শিল্প অর্থনীতি সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল। যোগাযোগ ব্যবস্থাও পানিপথের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। দেশের খনিজ, বনজ, সৌরসহ সকল প্রাকৃতিক সম্পদকে ব্যবহার করে দেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হওয়ার পথে অগ্রসর হচ্ছে। দেশের জাতীয় আয়ের সিংহভাগই আসে এ সব সম্পদকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে। দেশে যে সব শিল্প কলকারখানা গড়ে উঠেছে বা উঠছে তার পিছনে রয়েছে দেশীয় প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার। এর ফলে মানুষজন কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে। দেশীয় চাহিদার পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে। বিদেশে রপ্তানিজাত দ্রব্যসামগ্রীও এ সব সম্পদকে ব্যবহার করেই তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন নতুন উদ্যোগ গৃহীত হচ্ছে। প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার সেই সব উদ্যোগকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করছে। কাঁচামাল হিসেবে প্রাকৃতিক সম্পদের চাহিদা ও জোগান বাড়ছে, পণ্য উৎপাদনে প্রাকৃতিক সম্পদের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। তৈরিকৃত পণ্য দিয়ে দেশীয় চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। এর ফলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে। মানুষ খাদ্যশস্য উৎপাদন, বনজ সম্পদের ব্যবহার, প্রাকৃতিক অন্যান্য সম্পদের ব্যবহারে আরও বেশি আগ্রহী ও সচেতন হচ্ছে। এভাবে প্রাকৃতিক সম্পদের যথোপযুক্ত সুষ্ঠু ব্যবহার ও মানুষের নানামুখী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে দেশের অর্থনীতি দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে, মানুষ উন্নত জীবনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

Content added By