নবম-দশম শ্রেণি (দাখিল) - গার্হস্থ্য বিজ্ঞান - শিশুর বিকাশ ও পারিবারিক পরিবেশ | NCTB BOOK

একটি চারাগাছের কথা ধরা যাক, বীজ থেকে যখন চারাগাছটি জন্মায় তখন তা বেশ দুর্বল থাকে। সময়ে উপযুক্ত যত্ন পরিচর্যার উপর গাছটির বেঁচে থাকা নির্ভর করে। একবার যদি গাছটির গোড়া মাটিতে শক্ত হয়ে যায় তবে পরবর্তীতে বিশেষ যত্ন ছাড়াই গাছটি বেড়ে উঠতে পারে। ঠিক তেমনি মানব শিশুর জীবনের প্রথম কয়েক বছরের যত্ন পরিচর্যা পরবর্তী জীবনের ভিত্তি তৈরি করে।

জন্ম থেকে শুরু করে জীবনের প্রথম পাঁচ বছর একটি শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশের ক্ষেত্রে মূলভিত্তি রচনা করে। সময়ে দ্রুতগতিতে শারীরিক বৃদ্ধির পাশাপাশি তার আচরণগত পরিবর্তন ঘটতে থাকে। সময়ের জন্য প্রয়োজন হয় শারীরিক যত্ন এবং পরিবারের বা তার চারপাশের ব্যক্তিদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ, উষ্ণ সাড়া যা তাকে নতুন নতুন দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করে। যে শিশু জীবনের প্রথম বছরগুলোতে তার বিকাশের জন্য সহায়ক পরিবেশ পায় সে শিশুটি অন্যদের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান, সামাজিক সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়। তার সামাজিক দক্ষতা, ভাষার দক্ষতা, সৃজনশীলতা, আত্মবিশ্বাস প্রভৃতির বিকাশ ঘটে যা পরবর্তী জীবনে তাকে সুখী সুন্দর থাকতে সহায়তা করে।

সকল পরিবারই তাদের শিশুদের ভালোবাসে। কিন্তু আমাদের অনেকের মধ্যে শিশু প্রতিপালন বিষয়ে ভ্রান্ত ধারণা আছে বা কীভাবে তাকে সহায়ক পরিবেশ দিতে হবে সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা থাকে না। আমরা - অনেকেই জানি না যে, শিশুর সাথে খেলা ভাব বিনিময় শিশুর জীবনের প্রথম বছরগুলোতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

শিশুর সাথে বন্ধন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মা- হচ্ছেন প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। বুকের দুধ খাওয়ানো এবং বিভিন্ন মাতৃ পরিচর্যা হলো শিশুর শরীর, মন আবেগ বিকাশের ক্ষেত্রে মায়ের শ্রেষ্ঠ অবদান সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণায় স্পষ্ট হয়েছে যে, মা নবজাতকের মধ্যে জন্মের এক ঘণ্টা প্রথম কয়েক দিনের সান্নিধ্য উভয়ের মাঝে গভীর বন্ধন গড়ে তোলে, যা বিকশিত হতে থাকে এবং স্থায়ী হয় বছরের পর বছর। শিশুর সাথে বন্ধন তৈরির কয়েকটি পদক্ষেপ হলো-

  • শিশুকে জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যেই মায়ের দুধ দেওয়া
  • শিশুর কান্নায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সাড়া দেওয়া
  • শিশুকে কাছে নিয়ে ঘুমানো
  • শিশুকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া

 

শিশুকে জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যেই মায়ের বুকের দুধ দেওয়া -

  • বহু সংস্কৃতিতেই সোনাকে মূল্যবান হিসাবে বিবেচনা করা হয়। সোনার তুলনায় ব্রোঞ্চ মূল্যহীন। মায়ের দুধের পরিবর্তে কৃত্রিম দুধ শিশুর জন্য সোনার পরিবর্তে ব্রোঞ্চের মতোই মূল্যহীন। জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানো শিশুর জীবনে শ্রেষ্ঠ সূচনা। জন্মের পরপরই সুস্থ নবজাতককে উষ্ণ রাখার জন্য মায়ের পেট এবং বুকে রাখা হয়। শিশু মায়ের দুধ খেতে শুরু করে। এতে শিশুর প্রতি মায়ের ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়।

 

 

  • মায়ের দুধ শিশুর সুস্থতা বেঁচে থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। দুধ খাওয়ানোর সময় মায়ের ত্বকের স্পর্শে শিশু উষ্ণ থাকে। এই অবস্থা আড়াই কেজির কম ওজনের শিশুর ক্ষেত্রে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ
  • শিশুর প্রথম খাবার হিসেবে শালদুধ (মায়ের বুকের প্রথম দুধকে শালদুধ বা কলোস্ট্রাম বলা হয়) শিশুর প্রথম টিকা হিসেবে কাজ করে। শালদুধ নানা রকম প্রতিরোধমূলক (ইমিউনোলোজিক্যাল) সক্রিয় কোষ, এন্টিবডি অন্যান্য প্রতিরক্ষামূলক প্রোটিন সমৃদ্ধ হওয়ায় শিশুর বহু রোগ সংক্রমণ প্রতিরোধ করে।
  • শিশু জন্মের প্রথম দিন শালদুধ অল্পমাত্রায় আসে। তবে এই পরিমাণই নবজাতকের শারীরিক সুরক্ষার জন্য যথেষ্ট। শালদুধ শিশুর পরিপাচক অস্ত্রসমূহকে উদ্দীপিত করে। যার ফলে অস্ত্র থেকে দ্রুত মিকোনিয়াম (শিশুর প্রথম মল) পরিষ্কার হয়। এই অবস্থা জন্ডিস সৃষ্টিকারী জীবাণু শরীর থেকে বের হয়ে যেতে সাহায্য করে।
  • জানোর এক ঘন্টার মধ্যে শিশুকে মারের দুধ খাওয়ানো শিশুর জীবনে শ্ৰেষ্ঠ সূচনা
  • শিশুর মায়ের স্তন মুখে নেওয়া চোবার ফলে মায়ের শরীরে অক্সিটোসিন নামক হরমোন নির্গত হয়। এতে মা শান্ত, অবসাদমুক্ত বোধ করেন এবং শিশুর সাথে মায়ের ভালোবাসার কখন দৃঢ় হয়
  • মায়েরা তাদের সন্তানদের সাথে এই প্রথম যোগাযোগে অতিশয় আনন্দবোধ করেন। এভাবে মা শিশুর মধ্যে কখনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এভাবে শিশু জীবনের প্রথম ছয় মাস শুধু মায়ের দুধ এবং হয় মাস পর থেকে বছর পর্যন্ত বাড়তি খাবারের সাথে মায়ের দুধ দেওয়া চলতে থাকে।

শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে মায়ের জন্য সহায়ক পরিবেশের দরকার হয়। এই পরিবেশ তৈরিতে পরিবারের বাবার ভূমিকা থাকে সবচেয়ে বেশি। তিনি বিভিন্নভাবে স্তন্যদানকারী মাকে সাহায্য করেন।

  • মায়ের পুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় খাবারের ব্যবস্থা করেন।
  • মা শিশুকে বেশি সময় একত্রে রাখার সুযোগ সৃষ্টি করেন।
  • গৃহস্থালীর প্রয়োজনীয় কাজে মাকে সহায়তা করেন।
  • পরিবারে বড় শিশুটির যত্ন নিতে মাকে সাহায্য করেন
  • স্তন্যদানকারী মায়ের প্রতি সহানুভূতিশীল হন।

কাজগুলোর মধ্য দিয়ে বাবা পরোক্ষভাবে সন্তানের সাথে বন্ধন তৈরিতে ভূমিকা রাখেন

শিশুর কান্নার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সাড়া দেওয়া

মাজের সাথে বার সহযোগিতা শিশুর জন্য মহারক পরিবেশ তৈরি কর

ভাষা বিকাশের আগে সাধারণত শিশুরা কান্না দিয়েই তাদের চাহিদা অসুবিধাগুলো প্রকাশ করে। অতি শৈশবের শিশু সাধারণত দুইটি কারণে কাঁদে। ক্ষুধার কারণে এবং যে কোনো ধরনের শারীরিক অসুবিধার

কারণে। ক্ষুধার শিশুকে খাবার দেওয়া এবং শারীরিক অসুবিধা দূর করার জন্য ব্যবস্থা করা যেমন- শিশুকে ভেজা বিছানায় না রাখা, মলমূত্র ঠিকমতো পরিষ্কার করা, পেট ব্যাথায় উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ ইত্যাদি কাজগুলো শিশুকে আরাম দেয়। শিশু যদি আরামে ঘুমাতে পারে, কান্নার যত তাড়াতাড়ি মা-বাবার সাড়া পায়, তাকে কোলে তুলে নেওয়া হয়, তাহলে মা-বাবার প্রতি শিশুর বিশ্বাস আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠে। বিপরীতে যখন শিশুর অসুবিধাগুলো সময়মতো দূর করা হয় না অথবা শিশু কোনো কারণে আরাম পায় না তখন তার মধ্যে অবিশ্বাস অনাস্থার অনুভূতি জন্মাতে থাকে। বাবা-মায়ের আদর, যত্ন, স্নেহ ভালোবাসার অভাবে একটি শিশুর মা-বাবার প্রতি অনাস্থার পাশাপাশি পরিবেশ সম্পর্কেও শিশুটির মধ্যে অনাস্থা নিরাপত্তাহীনতা এবং হতাশার জন্ম নেয়। সেক্ষেত্রে শিশু বেশি কান্নাকাটি করে।

শিশুকে কাছে নিয়ে ঘুমানো-

দিনের বেলার মতো রাতেও শিশুর বিভিন্ন ধরনের চাহিদা পূরণ করতে হয়। রাতে মা-বাবা শিশুকে ঘুম পারিয়ে দেওয়া এই চাহিদাগুলোর মধ্যে অন্যতম। জীবনের প্রথম কয়েকটি বছর শিশুকে কাছে নিয়ে ঘুমানো জরুরি। এতে মা রাতে শিশুর চাহিদা ভালোভাবে বুঝতে পারেন এবং মায়ের দুধ খাওয়ানো সহজ হয়। ছাড়া রাতে শিশুর আশপাশে মা-বাবার উপস্থিতি শিশুর জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করে। বিছানায় যাওয়ার আগে প্রত্যেক শিশু মা-বাবাকে কাছে পেতে চায়। স্কুলে যাওয়ার পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত এটা খুবই সাধারণ ঘটনা। কখনো বড় শিশুরাও তাদের সারা দিনের কর্মকান্ড ঘুমানোর আগে মা-বাবাকে বলতে পছন্দ করে।

শিশুকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া-

শিশুরা সাধারণত খাদ্য নানা ধরনের শরীর বৃত্তীয় কাজে মায়ের উপর নির্ভরশীল থাকে। এসব কাজে বাবারও সহায়ক ভূমিকা থাকলে শিশুর মায়ের উপর নির্ভরশীলতা কমে এবং বাবার সাথে তার আসক্তি তৈরি হয়।

 

শিশুকে পর্যাপ্ত সময় দিতে করণীয়-

  • শিশুর সাথে খেলা করা, গান, ছড়া,গল্প বলা- যা শিশুর সামাজিক বুদ্ধিবৃত্তীয় বিকাশ ঘটায় শিশুকে বাইরে নিয়ে যাওয়া- থেকে শিশু বাইরের অভিজ্ঞতা অর্জন করে
  • পারিবারিক কাজে শিশুকে সাথে নেওয়া (যেমন- বাগানে পানি দেওয়া, ঘর পরিষ্কারের কাজ ইত্যাদি) - এতে শিশুর নিজের দক্ষতা সম্পর্কে আস্থা আসে।

ছাড়া জীবনের প্রথম বছরগুলোতে শিশুকে বেশি কাছে রাখা, শারীরিক সংস্পর্শ, শিশুকে আদর, স্নেহ করা, বিষয়গুলো শিশুর সাথে মা-বাবার বন্ধনকে মজবুত করে। শৈশবে মা-বাবা শিশুকে যত বেশি সময় দেবে এবং স্নেহ করবে তাদের বন্ধন ততই দৃঢ় হবে এবং বন্ধন তাদের পরবর্তী বয়সে মা-বাবার সাথে সন্তানের সুসম্পর্ক বজায় রাখতে সাহায্য করবে।

 

কাজ : শিশুকে মায়ের দুধ দেওয়া- শিশুর সাথে মায়ের বন্ধন তৈরির শ্রেষ্ঠ সূচনা” – বিষয়টির উপর - একটি প্রতিবেদন তৈরি কর।

Content added By