সপ্তম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - ইসলাম শিক্ষা - জীবনাদর্শ | NCTB BOOK

(নবুয়ত থেকে হিজরত পর্যন্ত)

প্রিয় শিক্ষার্থী, তোমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, আমরা ষষ্ঠ শ্রেণিতে আমাদের প্রিয়নবি মুহাম্মাদ (সা.)-এর জন্ম থেকে নবুয়ত পর্যন্ত জীবনচরিত সম্পর্কে জেনেছি। আজ নবুয়ত পরবর্তী প্রিয়নবি (সা.)-এর মক্কার কাফের- মুশরিকদের অত্যাচার-নির্যাতন উপেক্ষা করে ইসলাম প্রচার, আল্লাহর দিদার লাভে মিরাজ গমন এবং মদিনায় হিজরতসহ আরও অনেক বিষয় সম্পর্কে জানব।

গোপনে ইসলাম প্রচার

মহানবি (সা.) নবুয়ত লাভের কিছু দিন পরে আবার তাঁর প্রতি ওহী পাঠিয়ে আল্লাহ তা'আলা বললেন –

অর্থ: ‘হে রাসুল! আপনার প্রতিপালকের নিকট থেকে আপনার প্রতি যা নাযিল হয়েছে তা প্রচার করুন।' (সূরা মায়িদা, আয়াত: ৬৭)

মহান আল্লাহর এ নির্দেশের পর মহানবি (সা.) আরববাসীকে পৌত্তলিকতা ত্যাগ করে সত্য ধর্ম ইসলাম গ্রহণের জন্য আহ্বান জানান। প্রথমে তিন বছর তিনি তাঁর নিকট আত্মীয়-স্বজন ও অন্তরঙ্গ বন্ধু-বান্ধবদের নিকট গোপনে ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন। হযরত খাদিজা (রা) সর্বপ্রথম তাঁর দাওয়াতে সাড়া দিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এরপর বয়স্কদের মধ্যে তাঁর একান্ত সহচর আবু বকর (রা.), বালকদের মধ্যে হযরত আলী ও যায়েদ ইসলাম গ্রহণ করেন।

প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার

নবুয়তের তিন বছর পর প্রকাশ্যে দাওয়াত প্রদানের জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি মহান আল্লাহর নিকট থেকে ওহী আসলো। আল্লাহ বললেন,

অর্থ: ‘আপনি আপনার নিকটাত্মীয়দের সতর্ক করুন।' (সূরা শুআরা, আয়াত: ২১৪)

রাসুলুল্লাহ (সা.) মহান আল্লাহর এ নির্দেশনা পেয়ে মক্কাবাসীদের সাফা পাহাড়ের পাদদেশে জড়ো করে উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা দিলেন, হে আব্দুল মুত্তালিবের বংশধরগণ! আমি যদি বলি, এ পাহাড়ের অপর দিকে শত্রুপক্ষ রয়েছে। তারা তোমাদেরকে আক্রমণ করতে উদ্যত। তোমরা কি আমার কথা বিশ্বাস করবে? তারা সকলে বলল, হ্যাঁ অবশ্যই বিশ্বাস করব। তখন তিনি বললেন, আমি তোমাদেরকে সতর্ক করছি আসন্ন কঠিন শাস্তির ব্যাপারে। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই। তখন আবু লাহাব (আল্লাহ তার প্রতি লা‘নত বর্ষিত করুন) বলে উঠল, আজই তুমি ধ্বংস হও। তুমি কি এজন্যই আমাদের এখানে ডেকেছিলে? আবু লাহাবের এ আচরণে রাসুল (সা.) অনেক কষ্ট পান। এরই পরিপ্রেক্ষিতে রাসুল (সা.) কে সান্ত্বনা দিয়ে আল্লাহ তা'আলা সূরা লাহাব নাযিল করেন।

মুসলমানদের উপর কুরাইশদের নির্যাতন

প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের পর থেকেই মক্কার কুরাইশরা মহানবি (সা.) ও তাঁর অনুসারীদের উপর অত্যাচার ও নির্যাতন শুরু করে। ইসলাম ত্যাগে বাধ্য করার জন্য তারা মুসলমানদেরকে বন্দী করে রাখা, ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কষ্ট দেওয়া, প্রহার করা, লৌহদণ্ড গরম করে শরীরের বিভিন্ন স্থানে দাগ দেয়া, প্রখর রৌদ্রে মরুভূমিতে চিৎ করে শুইয়ে পাথর চাপা দেওয়াসহ নানা প্রকারের অমানবিক নির্যাতন চালাতে থাকে। (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া)। তাদের বর্বর নির্যাতনে হযরত আম্মারের মা সুমাইয়া (রা.) সর্বপ্রথম শহীদ হন। ইসলাম গ্রহণের অপরাধে হযরত বেলাল (রা.)-এর মুনিব তাঁকে অমানুষিক শাস্তি প্রদান করেন। তারা প্রিয়নবির পথে কাঁটা ছড়িয়ে রাখত, তাঁকে প্রস্তর মারত। কিন্তু তাদের অকথ্য অত্যাচারের পরেও তৌহিদের পথ থেকে কেউ বিচ্যুত হননি; তাদের সমস্ত চেষ্টাই ব্যর্থ হলো।

আবিসিনিয়ায় গমন

নবদীক্ষিত মুসলমানদের উপর অমানবিক নির্যাতন দেখে প্রিয়নবি (সা.)-এর প্রাণ কেঁদে উঠল। তিনি কুরাইশদের অমানবিক নির্যাতন থেকে পরিত্রাণের জন্য অসহায় নওমুসলিমদেরকে আবিসিনিয়ায় আশ্রয় নেওয়ার নির্দেশ দিলেন। প্রথমে নবুয়তের পঞ্চম বছর রজব মাসে হযরত উসমান ও তাঁর স্ত্রী রাসুল (সা.)-এর কন্যা রোকাইয়াসহ ১১জন পুরুষ ও ৪ জন মহিলা আবিসিনিয়ায় আশ্রয় গ্রহণ করলেন। কিছু দিন পর দ্বিতীয় ধাপে নারী-পুরুষ ও শিশুসহ আরও ৮৩ জন মুসলমান সেখানে আশ্রয় নেন। কুরাইশরা আমর ইবন আসের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল পাঠিয়ে আশ্রিত মুসলিমদেরকে তাদের হাতে সমর্পণের অনুরোধ করে। কিন্তু বাদশাহ নাজ্জাসী মুসলমানদের কথায় মুগ্ধ হয়ে কুরাইশ প্রতিনিধি দলকে আবিসিনিয়া থেকে বের করে দেন।

কুরাইশদের বয়কট ও দুঃখের বছর

কাফির-মুশরিকদের নির্যাতন ও ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে বনূ হাশিম ও বনূ আব্দুল মুত্তালিবের লোকজন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সহায়তায় এগিয়ে আসেন। এ ছাড়া ইতোমধ্যে মহানবি মুহাম্মাদ (সা.)-এর চাচা হামযা (রা.) এবং হযরত উমর (রা.) ইসলাম গ্রহণ করায় মুসলমানদের শক্তি আরও বৃদ্ধি পায়। ফলে উপয়ান্তর না পেয়ে কুরাইশরা মিলে মহানবি মুহাম্মাদ (সা.) ও তাঁর অনুসারীদেরকে বয়কটের সিদ্ধান্ত নিলো। তারা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পরিবার ও অনুসারীদের উপর সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করল। হযরত মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর অনুসারীদের নিয়ে শিয়াবে আবু তালেব নামক নির্জন পার্বত্য উপত্যকায় আশ্রয় নিলেন। খাদ্য-পানীয় চরম সংকটসহ ভীষণ দুঃখ-কষ্টে তাঁদের দিন কাটে। এভাবে ৩ বছর কঠোর অগ্নিপরীক্ষার পরেও তাঁরা আল্লাহর উপর বিশ্বাস হারালেন না। অবশেষ ৩ বছর পর কুরাইশরা তাদের প্রত্যাহার করল।

কুরাইশদের থেকে মুক্তি পাওয়ার পর নবুয়তের ১০ম বছরে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রিয় স্ত্রী বিবি খাদিজা (রা.) ও অভিভাবক চাচা আবু তালেব দুজনেই ইন্তেকাল করেন। তাঁরা ছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর শক্তি ও সাহায্যকারী, সত্যিকারের বন্ধু ও পরামর্শদাতা, বিপদে আপদে রক্ষাকর্তা। তাদের অভাবে মহানবি (সা.) ভীষণভাবে ভেঙ্গে পড়েন। এ সুযোগে কাফেররা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর উপর অত্যাচার ও নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিলো। প্রিয়নবি (সা.)-এর একান্ত প্রিয়জনের মৃত্যু এবং এ ধরনের অত্যাচার নির্যাতনের জন্য এ বছরকে আমুল হুযন বা দুঃখের বছর বলা হয়।

তায়েফ গমন

চাচা আবু তালেবের মৃত্যুর পর কুরাইশরা মহানবি (সা.)-এর উপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিল। শেষ পর্যন্ত তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তায়েফ গমন করলেন। কিন্তু তায়েফবাসী তাকে প্রস্তরাঘাতে রক্তরঞ্জিত করল। তারা জঘন্য অত্যাচার করে তাঁকে পাগল বলে শহর থেকে তাড়িয়ে দিল।

রাসুল (সা.)-এর মিরাজ

মিরাজ অর্থ ঊর্ধ্ব গমন, ইসরা অর্থ রাত্রিকালীন ভ্রমণ। পবিত্র কুরআনে সূরা বনী ইসরাইল এর প্রারম্ভে এই ইসরা ও মিরাজের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। স্বজন হারানোর বেদনা ও কাফিরদের অব্যাহত নিষ্ঠুর আচরণের এই দুঃসময়ে মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবীব (সা.) কে নিজের কাছে ডেকে নিয়ে সৃষ্টির অপার রহস্য প্রদর্শন করেন এবং তাঁর দিদারে প্রিয় নবির মনকে আনন্দে ভরে দেন। এই পর্বটিকেই মিরাজ বলা হয়। মিরাজ রাসুল (সা.)- এর জীবনে অতি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। রাসুল (সা.) নবুয়তের ১০ম বা ১১শ বছরে রজব মাসের ২৭ তারিখ গভীর রজনীতে বোরাক নামক বেহেশ্তি বাহনে চড়ে কাবাগৃহ হতে জেরুজালেমে বাইতুল মাকদাস এবং পরে সেখান থেকে উর্ধ্বালোকে গমন করে মহান আল্লাহর দিদার লাভ করেন। মিরাজের রজনীতেই প্রিয়নবি (সা.)-এর উম্মতদের উপর দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করা হয়।

আকাবার শপথ

নবুয়তের দ্বাদশ বছরে হজ্জের সময়ে ইয়াছরিব (মদিনার পূর্ব নাম) থেকে আগত ১২ জনের একটি দল রাসুল (সা.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা আকাবা উপত্যকায় মহানবি (সা.)-এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন। তারা এক আল্লাহর উপাসনা করা এবং যাবতীয় পাপাচার থেকে দূরে থাকার শপথ করেন। ইসলামের ইতিহাসে এই শপথকেই আকাবার প্রথম শপথ বলা হয়।

আকাবার প্রথম শপথের পরবর্তী বছরে ৬২২ খ্রি. মদিনা হতে ৭৫ জনের একটি দল (৭৩ জন পুরুষ ও ২ জন মহিলা) এসে রাসুল (সা.) এর হাতে বায়'আত গ্রহণ করেন। তাঁরা প্রিয়নবিকে তাঁদের দেশে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। এ ছাড়াও তাঁরা ইসলাম প্রচারে সর্বপ্রকার সাহায্য এবং ইসলামকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দেন। ইসলামের ইতিহাসে এটাই আকাবার দ্বিতীয় শপথ। ইসলামের ইতিহাসে আকাবার শপথ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

মদিনায় হিজরত

আকাবার শপথের পর মদিনায় ইসলাম দ্রুত প্রসার লাভ করতে থাকে। মদিনার মনোরম প্রকৃতি ও ইসলাম প্রচারের অনুকুল পরিবেশের জন্য মহানবি (সা.) সেখানে হিজরতের জন্য মনস্থির করেন। এদিকে মক্কার কুরাইশরা দারুন নদওয়া বৈঠকে তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করে। অবশেষে তিনি ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে ইসলামের জন্য মাতৃভূমির মায়া ত্যাগ করে মদিনা হিজরত করেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু হযরত আবু বকর (রা.) এ হিজরতের সময়ে সঙ্গী ছিলেন।

মহানবি (সা.) এর মাক্কী জীবন থেকে আমাদের শিক্ষণীয় :

• সকলের মাঝে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়া;

• আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়, তাঁর কোনো শরিক নেই একথা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করা;

• বিপদে আপদে সর্বদা ধৈর্যধারণ করা;

• ইসলামের প্রচার ও প্রসারে কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করা;

• শত্রু হলেও তার আমানত রক্ষা করা;

• নামাজ আমাদের জন্য মহান আল্লাহর উপহার, তাই ওয়াক্তমতো নামাজ আদায় করা।

দলগত কাজ: শিক্ষার্থীরা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে মহানবি (সা.)-এর ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, ত্যাগ-তিতিক্ষা, আমানতদারিতা প্রভৃতি গুণাবলি সম্পর্কে আলোচনা করবে ও নিজেদের মধ্যে এসব গুণের অনুশীলনের চেষ্টা করবে।
Content added By