নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - রসায়ন - পদার্থের গঠন | NCTB BOOK

এই অধ্যায়ে আমরা আইসোটোপ সম্পর্কে জেনেছি। কিছু কিছু আইসোটোপ রয়েছে যাদের নিউক্লিয়াস স্বতঃস্ফূর্তভাবে (নিজে নিজেই) ভেঙে আলফা রশ্মি, বিটা রশ্মি, গামা রশ্মি ইত্যাদি নির্গত করে তাদেরকে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ বলে। এখন পর্যন্ত 3000 সংখ্যক থেকে বেশি আইসোটোপ সম্বন্ধে জানা গেছে। এদের মধ্যে কিছু প্রকৃতিতে পাওয়া গেছে, অন্যগুলো গবেষণাগারে তৈরি করা হয়েছে। বিভিন্ন আইসোটোপ এবং তাদের তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে তোমাদের পদার্থবিজ্ঞান বইয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। তাই এখানে শুধু তাদের কিছু ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করা হবে।

তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ-এর নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার দিয়ে মানুষ অনেক কিছু করতে পারে যেটি অন্যভাবে করা দুঃসাধ্য ছিল। বর্তমানে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ চিকিৎসাক্ষেত্রে, কৃষিক্ষেত্রে, খাদ্য ও বীজ সংরক্ষণে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে, কোনো কিছুর বয়স নির্ণয়সহ আরও অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।

 

3.10.1. চিকিৎসাক্ষেত্রে:
চিকিৎসাক্ষেত্রে বর্তমানে বিভিন্ন প্রয়োজনে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন:

রোগ নির্ণয়ে:
আইসোটোপ ব্যবহার করে রোগাক্রান্ত স্থানের ছবি তোলা সম্ভব। এ পদ্ধতিতে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ টেকনিশিয়াম - 99 (9 Tc) কে শরীরের ভেতরে প্রবেশ করানো হয়। এই আইসোটোপ যখন শরীরের নির্দিষ্ট স্থানে জমা হয় তখন ঐ তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ গামা রশ্মি বিকিরণ করে, তখন বাইরে থেকে গামা রশ্মি শনাক্তকরণ ক্যামেরা দিয়ে সেই স্থানের ছবি তোলা সম্ভব। এই তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ টেকনিশিয়াম-99 এর লাইফটাইম 6 ঘণ্টা। তাই সামান্য সময়েই এর তেজস্ক্রিয়তা শেষ হয়ে যায় বলে এটি অনেক নিরাপদ।

রোগ নিরাময়ে:
সর্বপ্রথম থাইরয়েড ক্যানসার নিরাময়ে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ব্যবহার করা হয়। রোগীকে পরিমাণমতো তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ 1311 সমৃদ্ধ দ্রবণ পান করানো হয়। এই আইসোটোপ থাইরয়েডে পৌঁছায়। এ আইসোটোপ থেকে বিটা রশ্মি নির্গত হয় এবং থাইরয়েডের ক্যানসার কোষকে ধ্বংস করে। এছাড়া ইরিডিয়াম আইসোটোপ ব্রেইন ক্যানসার নিরাময়ে ব্যবহার করা হয়। টিউমারের উপস্থিতি নির্ণয় ও নিরাময়ে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ °Co ব্যবহার করা হয়। "Co থেকে নির্গত গামা রশ্মি ক্যানসারের কোষকলাকে ধ্বংস করে। রক্তের লিউকোমিয়া রোগের চিকিৎসায় 32P এর ফসফেট ব্যবহার করা হয়।

3.10.2 কৃষিক্ষেত্রে:

ফসলের পুষ্টিতে:
ফসলের পুষ্টির জন্য জমিতে পরিমাণমতো সার ব্যবহার করতে হয়। সার মূল্যবান বস্তু। তাই অতিরিক্ত ব্যবহার করা আর্থিক ক্ষতির কারণ। একদিকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সার পরিবেশের ক্ষতির কারণ, অপরদিকে প্রয়োজনের চেয়ে কম পরিমাণ সার ব্যবহার করা হলে ফসলের উৎপাদন কম হয়। তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ব্যবহার করে জমিতে কী পরিমাণ নাইট্রোজেন ও ফসফরাস আছে তা জানা যায়। আর তা জেনে জমিতে আরও কী পরিমাণ নাইট্রোজেন ও ফসফরাস প্রয়োজন তারও হিসাব করা যায়। উদ্ভিদ তেজস্ক্রিয় নাইট্রোজেন ও তেজস্ক্রিয় ফসফরাস মূলের মাধ্যমে গ্রহণ করে এবং তা উদ্ভিদের শরীরের বিভিন্ন অংশে শোষিত হয়। এসকল তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ থেকে তেজস্ক্রিয় রশ্মি নির্গত হয়। গাইগার মুলার কাউন্টার ব্যবহার করে এ তেজস্ক্রিয় রশ্মি শনাক্ত ও পরিমাপ করা হয়।

ক্ষতিকারক পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ করতে:
ফসলের জন্য ক্ষতিকারক পোকামাকড় সব সময়ই মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। এগুলো যেমন ফসলের উৎপাদন কমায় তেমনই এদের মাধ্যমে রোগ-জীবাণুও উদ্ভিদে প্রবেশ করে। এ সকল পোকামাকড় ধ্বংস করার জন্য ফসলে এবং জমিতে কীটনাশক দেওয়া হয়। এ কীটনাশক পরিবেশ ও আমাদের শরীরের জন্য ক্ষতিকর। শুধু তাই নয়, এ কীটনাশক ক্ষতিকারক পোকামাকড়ের সাথে সাথে অনেক উপকারী পোকামাকড়ও ধ্বংস করে। তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ সমৃদ্ধ কীটনাশক ব্যবহারের মাধ্যমে জানা সম্ভব হয়েছে সর্বনিম্ন কতটুকু পরিমাণ কীটনাশক একটি ফসলের জন্য ব্যবহার করা যাবে।

ফসলের মানোন্নয়নে:
বিভিন্ন ধরনের নিয়ন্ত্রিত তেজস্ক্রিয় রশ্মি ব্যবহারের মাধ্যমে উদ্ভিদ কোষের জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে উন্নত মানের ফসলে পরিণত করা হয়।

 

3.10.3 বিদ্যুৎ উৎপাদনে:
কিছু কিছু পরমাণুকে ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরমাণুতে পরিণত করলে অর্থাৎ ফিশান বিক্রিয়া ঘটালে প্রচুর পরিমাণে তাপশক্তি বের হয়। এই তাপশক্তি ব্যবহার করে জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয়। আমরা সেটিকে নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র বলি। তোমাদের পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের চতুর্থ অধ্যায়ে এটি বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশে পাবনা জেলার রূপপুরে বাংলাদেশ সরকার পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করতে যাচ্ছে। এ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হলে দুই হাজার চারশত মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

 

3.10.4 তেজস্ক্রিয় আইসোটোপের প্রভাব:
তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ আমাদের অনেক উপকারে আসে সে কথা সত্যি কিন্তু এটি আমাদের জন্য ক্ষতির কারণও হতে পারে। তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ থেকে যে আলফা, বেটা ও গামা রশ্মি নির্গত হয় তা কোষের জিনগত পরিবর্তন ঘটাতে পারে যার ফলাফল হিসেবে ক্যানসারের মতো রোপ হতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটেছিল, তার জন্য কয়েক লক্ষ জীবন ধ্বংস হয়েছে। 1986 সালে রাশিয়ার চেরোনোবিলে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে যে দুর্ঘটনা ঘটেছিল তার ফলে অনেক প্রাণ হারিয়েছে এবং ঐ এলাকায় পরিবেশ দূষণ ঘটেছে।

Content added By